আমেরিকান গডস – ৯

নিল গেইম্যান

অধ্যায় নয় 

…আর ধ্বংসস্তূপের ফাঁক থেকে উঁকি দেয় পৌরাণিক চরিত্ররা… 

–ওয়েনডি কোপ, ‘আ পুলিসম্যান্স লট’ 

.

ইলিনয় থেকে বেরোবার পথে, সন্ধ্যার দিকে শ্যাডো প্রথম প্রশ্নটা করল। উইসকনসিনে স্বাগতম-লেখা সাইনটা নজরে আসার পর জানতে চাইল, ‘পার্কিং লটে আমাকে অপহরণকারী লোকগুলো কারা? এই মি. উড আর মি. স্টোনের পরিচয় কী?’ 

গাড়ির হেডলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে শীতের অধিকারে থাকা চারপাশ। ওয়েনসডে আগেই জানিয়েছেন, ফ্রি-ওয়েতে ওঠা যাবে না। এই ফ্রি- ওয়েরা কোন দলে আছে, তা এখনও জানেন না তিনি। তাই পার্শ্ব-রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে শ্যাডোকে। অবশ্য তাতে কিছু মনে করেনি সে; ওয়েনসডে যে মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ-সেটাই নিশ্চিত হতে পারেনি এখনও। 

ওয়েনসডে ঘোঁত করে উঠলেন। ‘কিম্ভূত। বিপক্ষ দলের গুন্ডা।’ 

‘আমার ধারণা,’ বলল শ্যাডো। ‘ওরা নিজেদেরকে গুন্ডা না, রক্ষাকর্তা মনে করে।’ 

‘তা তো করেই। যে যুদ্ধে দুই পক্ষই নিজেদেরকে সঠিক বলে মনে করে, তার চাইতে নির্মম যুদ্ধ আর কোনটা হতে পারে? সবচেয়ে বিপজ্জনক কারা জানো? যাদের ধারণা, তাদের সমস্ত পদক্ষেপ ভালোর জন্য নেওয়া।’ 

‘আর আপনি?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘আপনি এসব কেন করছেন?’

‘কারণ…আমার ইচ্ছা।’ হাত বের করে হাসলেন ওয়েনসডে। 

‘আপনারা পালালেন কীভাবে? নাকি সবাই পারেনি?’ 

‘পেরেছে।’ উত্তর দিলেন ওয়েনসডে। তবে আরেকটু হলেই ধরা পড়ে গেছিলাম। তোমাকে অপহরণ করার জন্য সময় ব্যয় না করলে সম্ভবত পারতাম না। তবে লাভ হয়েছে আমারই। বেশ কয়েকজন এখন আমার পক্ষে!’ 

‘আপনি কীভাবে পালালেন? 

মাথা নাড়লেন ওয়েনসডে। ‘তোমাকে আমি প্রশ্ন করার জন্য টাকা দেই না, শ্যাডো। আগেও বলেছি কথাটা।’ 

শ্রাগ করল যুবক। 

রাতটা ওরা কাটাল লা ক্রসের দক্ষিণে, একটা সুপার এইট মোটেলে। 

ক্রিসমাস চলে গেল রাস্তায়, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গাড়ি চালিয়ে। খেত-খামারকে হটিয়ে জানালার ওপাশটা দখল করে নিলো পাইন গাছের বন। শহরগুলোকেও এখন অনেক দূরে দূরে অবস্থিত বলে মনে হচ্ছে। 

দুপুরের খাবার খাওয়ার সুযোগ এলো বিকালে, উইসকনসিনের উত্তরের একটা রেস্তোরাঁয়। শ্যাডো নিলো শুকনো টার্কি, ক্রানবেরি সস, কাঠের মতো শক্ত আলু সিদ্ধ আর সবুজ মটরশুঁটি। তবে ওয়েনসডের খাওয়ার গতি দেখে মনে হলো, আনন্দ নিয়েই খাচ্ছেন। আস্তে আস্তে খুলে গেল তার মুখ। গল্প আর ঠাট্টা করতে শুরু করলেন। ওয়েস্ট্রেস কাছে এলে তার সাথে দুষ্টামিও করলেন কিছুক্ষণ। মেয়েটা চিকন-চাকন, স্বর্ণকেশী মেয়ে; দেখে মনে হয় এখনও হাই-স্কুলে পড়ে। 

‘আহ, প্রিয়ে, তোমার হাতের মজাদার গরম চকলেট কি আরেক কাপ মিলবে? আর ভালো কথা, যদি বলি পোশাকটায় তোমাকে দারুণ লাগছে, তাহলে আশা করি অপরাধ নেবে না?’ 

উজ্জ্বল লাল-সবুজ স্কার্ট পরা মেয়েটা লাল হয়ে গেল লজ্জায়। বিশাল এক হাসি হেসে চলে গেল আরেক কাপ চকলেট আনতে। 

মেয়েটার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে টার্কির শেষ টুকরাটা মুখে দিলেন ওয়েনসডে, ন্যাপকিন ব্যবহার করে দাড়ি পরিষ্কার করে নিয়ে খালি প্লেটটা ঢেলে দিলেন সামনে। ‘আহ, শান্তি।’ চারপাশে তাকালেন তিনি। হালকা শব্দে ক্রিসমাসের গান বাজছে পারুপাপম-পম, রাপাপম পম, রাপাপম পম। 

‘সময়ের সাথে অনেক কিছুই বদলায়।’ আচমকা বললেন ওয়েনসডে। কিন্তু মানুষ…মানুষ বদলায় না। কোন কোন ধোঁকাবাজি টিকে থাকে অনন্তকাল। আবার ইতিহাস আর সময় গিলে নেয়, এমন ধোঁকাবাজিও আছে। যেমন ধরো স্প্যানিশ প্রিজনার, পিজিয়োন ড্রপ, ফওনি রিগ, ফিডল গেম…’ 

‘অন্যগুলোর নাম শুনেছি,’ বলল শ্যাডো। ‘কিন্তু ফিডল গেমের কথা এই প্রথম শুনলাম। আমার সেলমেটও একজন প্রতারক ছিল।’ 

‘আহ,’ বললেন ওয়েনসডে, একমাত্র ভালো চোখটা আনন্দে ঝিলিক দিচ্ছে। ‘ফিডল গেমের মতো ধোঁকাবাজি আর হয় না। তবে এর জন্য চাই দুজন। কৌতূহল আর লোভের উপর দাঁড়িয়ে আছে পুরো পরিকল্পনাটা। হ্যাঁ, নির্লোভ আর সৎ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া যায় বটে, কিন্তু তাতে পরিশ্রম বেশি। পুরোটা বলি, শোণো। নিজেই বুঝতে পারবে। একদম প্রথমে দরকার ভালো একটা মোটেল বা রেস্তোরাঁ। আচমকা দেখতে পেলে, এক জীর্ণ পোশাক পরিহিত লোক খাবার খাচ্ছে। জীর্ণ হলেও, একেবারে সস্তা নয় সেই পোশাক। দেখেই বোঝা যায়, ভদ্রলোকের সময় ভালো যাচ্ছে না। আচ্ছা, এক কাজ করা যাক। ভদ্রলোক- ভদ্রলোক না বলে, লোকটাকে আব্রাহাম বলে ডাকি। খাওয়া শেষে যখন বিল দেওয়ার সময় এলো, তখন বেচারা পড়ল বিপদে। নাহ, বিল বেশি আসেনি…এই পঞ্চাশ বা পঁচাত্তর ডলার হবে। সমস্যা হলো, আব্রাহামের সঙ্গে ওয়ালেট নেই! ওটা সে ফেলে এসেছে এক বন্ধুর বাড়িতে। বাড়িটা কাছেই, তাই একটু সময় পেলে নিয়ে আসতে পারবে। ম্যানেজার সাহেব, বলল আব্রাহাম। গ্যারান্টি হিসেবে আমার এই বেহালাটা রাখতে পারেন। আমার জীবিকা এটা থেকেই আসে। 

ওয়েট্রেসকে আসতে দেখে ওয়েনসডের চেহারায় যে হাসিটা দেখা গেল, সেটা কেবল মাংসের খোঁজ পেলে মাংসাশী প্রাণিই হাসতে পারে। ‘আহ! গরম চকলেট! আমার ক্রিসমাসের দেবী নিজ হাতে নিয়ে এসেছে! ভালো কথা প্রিয়ে, সময় পেলে আমাকে আরেকটু রুটি এনে দিতে পারবে?’ 

ওয়েট্রেসের বয়স বেশি হলে ষোলো হবে, ভাবল শ্যাডো। মেঝের দিকে তাকিয়ে গাল লাল করল মেয়েটা। কাঁপা কাঁপা হাতে চকলেটের মগ রেখে দিয়ে ঘরের অন্য দিকে চলে গেল। রেস্তোরাঁর পাইয়ের কালেকশন যেখানে ডিসপ্লেতে রাখা আছে, সেখানে এসে একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ওয়েনসডের দিকে তাকাল। এরপর ঢুকে পড়ল রান্নাঘরে। 

‘বেহালার কথা বলছিলাম। জিনিসটার যে বয়স হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কয়েকটা জায়গায় চলটা ওঠাও হতে পারে। ওটাকে ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়ে আমাদের গোবেচারা আব্রাহাম চলে গেল তার ওয়ালেট আনতে। ঠিক সেই সময় আরেকজন স্যুট-বুট পরা ভদ্রলোক, যিনি এই মাত্র খাওয়া শেষ করেছেন, উঠে এলেন ম্যানেজারের কাছে। পুরো ব্যাপারটাই দেখছিলেন তিনি। এবার অনুরোধ করলেন আব্রাহামের রেখে যাওয়া বেহালাটা দেখার। 

‘ম্যানেজারের না করার প্রশ্নই ওঠে না। এই দ্বিতীয় ভদ্রলোক, যার নাম ধরা যাক ব্যারিংটন, বাদ্যযন্ত্রটা হাতে নিয়েই হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। এরপর সম্বিত ফিরে পেয়ে নব-উদ্যমে ওটা পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। তার হাবভাব দেখে মনে হলো কোনো যাজক তার নবীর হাড় ধরে দেখার সুযোগ পেয়েছে! ‘এটা…’ অবিশ্বাসের সুরে বললেন তিনি। ‘…এটা তো দেখি…নাহ, তা কী করে সম্ভব! কিন্তু…তাই তো! এটাই তো সেই…আমার বিশ্বাসই হতে চাইছে না!’ বেহালার ভেতরে বাদামি কাগজে লেখা প্রস্তুতকারীর নামটা দেখালেন তিনি। তবে ওটা না হলেও এই যন্ত্রের কাঠ, বার্নিশের রঙ-এসব দেখেই নির্মাণকারীর হাতের কাজ চিনতে পারতেন বলে জানালেন। 

‘পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা দামি বিজনেস কার্ড বের করে আনলেন ব্যারিংটন। তিনি যে দুষ্প্রাপ্য, অ্যান্টিক বাদ্যযন্ত্রের ডিলার-সেটা ঘোষণা করছে কার্ডটা। ‘এই বেহালাটা তাহলে দুষ্প্রাপ্য?’ জানতে চাইল ম্যানেজার। ‘অবশ্যই,’ জানালেন ব্যারিংটন। চেহারা থেকে এখনও বিস্ময় যায়নি। ‘ভুল না করে থাকলে, এর দাম এক লাখ ডলারের চাইতেও বেশি। তবে চোখ বন্ধ করেই পঞ্চাশ…নাহ, পঁচাত্তর হাজার নগদে দিতেও আপত্তি নেই। আমার হাতে এমনও ক্রেতা আছে যে না দেখেই জিনিসটা কিনে নেবে।’ পরক্ষণেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চেহারা কালো হয়ে গেল ব্যবসায়ীর। ‘আমার ট্রেনের সময় হয়ে গেছে,’ বলল সে। ‘এখন রওনা দিলেও ধরতে পারব কি না সন্দেহ! দয়া করে এই অমূল্য বাদ্যযন্ত্রের মালিক এলে তাকে আমার কার্ডটা দেবেন।’ বলে বিদায় নিলো ব্যারিংটন। সময় আর ট্রেন যে কারও জন্য অপেক্ষা করে না-সেটা তার ভালো করেই জানা আছে। 

‘এদিকে ম্যানেজার কিন্তু স্থম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহল আর লোভ আস্তে আস্তে দখল করে নিচ্ছে ওর মন-মনন। নতুন একটা পরিকল্পনা ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে মনে। এদিকে সময় বয়ে চলছে, আব্রাহামের পাত্তা নেই। অনেকক্ষণ পর হাঁপাতে-হাঁপাতে এলো লোকটা, ওয়ালেটটা উঁচু করে ধরে আছে। পোশাকের মতো ওয়ালেটের অবস্থাও খুব একটা ভালো না, কোনো দিন একশ ডলারের বেশি কিছু ওতে ছিল বলে মনে হয় না। টাকা বের করে খাবারের দাম চুকিয়ে দিল সে, হাত বাড়াল বেহালা নেবার জন্য। 

‘বেহালা ফিরিয়ে দিল ম্যানেজার। আব্রাহাম এমনভাবে ওটাকে জড়িয়ে ধরল, যেভাবে ছোটো বাচ্চাকে তার মা জড়িয়ে ধরে। ‘আচ্ছা, বলল ম্যানেজার, বুক পকেটে রেখে দিয়েছে দামি বিজনেস কার্ডটা, যেটার মালিক চাইলেই ওকে পঁচাত্তর হাজার ডলার দিতে পারে। ‘এরকম একটা বেহালার দাম কত হবে? আমার ভাতিজি চেয়েছে, ওর জন্মদিনও সামনে।’

‘এই বেহালার দাম জানতে চাইছেন?’ বলল আব্রাহাম। ‘আমি তো এটা জান গেলেও বিক্রি করব না। বিশ বছর ধরে এই দেশের প্রতিটা স্টেটে আমি একে নিয়ে গান শুনিয়েছি। যখন কিনেছিলাম, তখন গুণতে হয়েছিল মাত্র পাঁচশ ডলার।’

‘মনের হাসি মুখে ফুটে উঠতে দিল না ম্যানেজার। ‘পাঁচশ ডলার? যদি এখন নগদে এক হাজার ডলার দিতে চাই, তাহলেও বেচবেন না?’ 

‘বেহালা-বাদককে প্রথমে আনন্দিত মনে হলো, এরপর বিমর্ষ। বলল, ‘আমি বেহালা বাজাই, এছাড়া আর কোনো কাজ জানি না। এই বেহালা আমাকে চেনে, আমাকে ভালোবাসে। প্রেমিকার দেহের চাইতেও ভালোভাবে এর প্রতিটা বাঁক আমার চেনা। চোখ বন্ধ করেও বাজাতে বেগ পেতে হবে না। এরকম আরেকটা পাব কোথায়? এক হাজার ডলার বেশ বড়ো একটা অঙ্ক। কিন্তু নিজের জীবিকার কথাও আমাকে ভাবতে হবে। এক কেন, পাঁচ হাজার ডলার দিলেও বিক্রি করব না। 

‘লাভের অঙ্ক যে কমে আসছে, তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে ম্যানেজার। কিন্তু নাই মামার চাইতে, কানা মামা ভালো না? আর তাছাড়া, টাকা খরচ করা ছাড়া কি টাকা বানানো যায়? ‘আট হাজার ডলার দেব,’ বলল সে। ‘জানি, দামটা মাত্রাতিরিক্ত বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জিনিসটা আমার পছন্দ হয়েছে। ভাতিজিকে দেব যখন, পছন্দের জিনিসটাই দিই।’ 

‘ভালোবাসার যন্ত্রটাকে হারাতে হবে বলে কান্নায় যেন ভেঙে পড়বে আব্রাহাম। কিন্তু আট হাজার ডলারকে না বলার সামর্থ্য নিয়ে জন্মায় কজন? লোকটার এই অবস্থা দেখে ওর চোখের সামনেই দেয়ালের সেফ থেকে আট না…নয় হাজার ডলার বের করল ম্যানেজার! ‘আপনি আসলে মানুষ নন,’ ধন্যবাদ জানাতে জানাতে যেন মুখে ফেনা তুলে ফেলবে আব্রাহাম। ‘ফেরেশতা! কথা দিন, আমার বেহালার খুব যত্ন নেবেন!’ এই বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেহালা তুলে দিল ম্যানেজারের হাতে।’ 

‘যদি ম্যানেজার সৎ হয়?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘আব্রাহাম ফিরে আসামাত্র ওকে ব্যারিংটনের কার্ড দিয়ে দেয়?’ 

তাতেই বা এমনকী ক্ষতি? দুইটা ডিনারের খরচই তো যাবে পকেট থেকে।’ বললেন ওয়েনসডে। তরকারির অবশিষ্টাংশটুকু রুটি দিয়ে খেলেন তিনি। 

‘আব্রাহাম এরপর নয় হাজার ডলার নিয়ে চলে যাবে, ট্রেন স্টেশনের পার্কিং লটে সে আর ব্যারিংটন ভাগাভাগি সেরে নেবে,’ বলল শ্যাডো। ‘এরপর ব্যারিংটনের গাড়িতে চড়ে বিদায় নেবে শহর থেকে। যে গাড়ির বুট সম্ভবত একশ ডলার দামের বেহালা দিয়ে ভরতি!’ 

‘আমি বেহালা প্রতি পাঁচ ডলারের চাইতে বেশি খরচ করার পক্ষপাতী নই। ফিরে আসা ওয়েট্রেসের দিকে ফিরলেন ওয়েনসডে। ‘আচ্ছা প্রিয়ে, আমাদেরকে সুন্দর করে বলো তো, ডেজার্ট হিসেবে কী কী বিক্রি করো তোমরা?’ এমনভাবে মেয়েটার দিকে তাকালেন তিনি, যেন ডেজার্ট হিসেবে তাকেই চাচ্ছেন। কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করল শ্যাডো। পুরো দৃশ্যটাকে মনে হচ্ছে যেন কোনো শিকারি পশুর খাবার ধরার দৃশ্য…হিংস্র নেকড়ে যেন তাকিয়ে আছে বাচ্চা একটা হরিণের দিকে। আর বেচারা হরিণ ভয়ে নড়ার সাহসটা পর্যন্ত পাচ্ছে না। 

আবারও লাল হয়ে গেল মেয়েটা, আপেল পাই আছে বলে জানাল ওদেরকে। এক দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ওয়েনসডে জানালেন-ও যা দেবে, তিনি তাই খাবেন। শ্যাডো মানা করল, কিছু লাগবে না ওর। 

‘প্রতারণার ইতিহাসে,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘ফিডল গেম অনেক পুরানা খেল। ঠিক মতো পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারলে আমেরিকার যেকোনো স্টেটে টাকা কামানো সম্ভব। তবে আমার সবচেয়ে পছন্দেরটা হলো দ্য বিশপ গেম। কী নেই ওতে? উত্তেজনা, ধোঁকাবাজি, সম্ভাবনা আর চমক, সব আছে। একটু গুছিয়ে নিলে এখনও মাঝে-সাঝে…’ কী যেন ভাবলেন তিনি, তারপর মাথা নাড়লেন। ‘নাহ, এখন আর ওসব চলবে না। যদি সালটা হতো ১৯২০, তাহলে মোটামুটি আকারের শহর যেমন শিকাগো বা নিউ ইয়র্কে…আচ্ছা, খুলেই বলি। 

‘আমরা বেছে নেব একটা জুয়েলারির দোকান। যাজকের পোশাক পরিহিত এক লোক প্রবেশ করল দোকানে। যেন-তেন যাজক না কিন্তু, একজন বিশপ খুব সুন্দর দেখতে একটা হীরার নেকলেস বেছে নিলো সে। দাম চুকালো একশ ডলারের কড়কড়ে এক ডজন নোট দিয়ে। 

‘একদম ওপরের নোটটার সবুজ কালি কিছুটা উঠে গেছে। দোকান মালিক তাই বারবার ক্ষমা চেয়ে নোটটা নিয়ে গেল পাশের ব্যাংকে; জাল কি না-তা পরীক্ষা করে দেখতে চায়। কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে এলো দোকানের কর্মচারী। ব্যাংকের মতে যে একটাও নকল না, সেটা জানাল। দোকান মালিক ক্ষমা চাইল আবার, কিন্তু বিশপ হাসল শুধু। এরকমটা হতেই পারে! বর্তমান দুনিয়ায় এমন অনেকেই আছে, যারা আইনকে থোড়াই তোয়াক্কা করে। বাজে মহিলাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। নরক থেকে উঠে আসা দানবরা দখল করে নিয়েছে সবকিছু। কথা বলতে বলতে নেকলেসটা কেসে ঢুকিয়ে রেখেছে দোকান-মালিক। একজন বিশপ কেন বারোশ ডলার দামি নেকলেস কিনতে চাইবে, তা মাথায় ধরছে না ওর! আর কিনলেও কেনই বা নগদ টাকা দিয়ে কিনবে? 

‘হাসিমুখে বিদায় নিলো বিশপ। কিন্তু রাস্তায় নামার সাথে সাথে কাঁধে চেপে বসল ভারী একটা হাত। ‘আরে সোপি, আবার চুরি-চামারি শুরু করেছ?’ ঘাড় ঘুরিয়ে এক পুলিসকে দেখতে পেল সে। দেখে আইরিশ মনে হয়, বিশপকে সাথে নিয়ে আবার জুয়েলারির দোকানে প্রবেশ করল লোকটা। 

‘বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি।’ বলল পুলিস অফিসার। ‘এই লোকটা কি কিছু কিনেছে?’

‘না, কিনিনি। বিশপ বলল। ‘ঠিক বলেছি না?’

‘অবশ্যই কিনেছেন,’ বলল জুয়েলার। ‘একটা হীরার নেকলেস নগদ টাকা দিয়ে কিনেছেন।’

‘নোটগুলো আছে?’ জানতে চাইল পুলিস। 

‘দোকান মালিক তাই বারোটা একশ ডলারের নোট বের করে আনল। আলোর বিপরীতে নোটগুলো ধরে মাথা নাড়ল। ‘সোপি, সোপি,’ বলল সে। ‘এত ভালো এর আগে বানাতে পারোনি। আসলেই, দক্ষ প্রতারক তুমি।’ 

‘বিশপের চেহারায় সন্তুষ্টির হাসি ফুটে উঠল। ‘তুমি কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না,’ বলল লোকটা। ব্যাংকও বলেছে, আমার কাজ ওদের সমমানের। ওগুলো আসল।’

‘বলেছে হয়তো,’ একমত হলো পুলিস। ‘কিন্তু ওরা তো আর জানে না যে সোপি সিলভেস্টার এখন শহরে। ডেনভার আর সেন্ট লুইসে তুমি যে জাল নোটগুলো আসল বলে চালিয়ে দিয়েছ, সেগুলোও দেখেনি।’ হাত বাড়িয়ে বিশপের পকেট থেকে নেকলেস বের করে আনল পুলিস। ‘পঞ্চাশ সেন্ট দামের কাগজ আর কালির বিনিময়ে কিনেছ বারোশ ডলার দামি নেকলেস! তার উপর ধরেছ বিশপের ভেক! তোমার লজ্জা হওয়া উচিত।’ এই বলে নকল বিশপের হাতে পরিয়ে দিল হাতকড়া। টাকা আর নেকলেস, দুটোই একটা ব্যাগে ভরে নিলো। তবে চলে যাবার আগে দোকান মালিককে রশিদ দিল একটা। জানাল-প্রমাণ হিসেবে সব নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কাজ শেষ হলেই ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’ 

‘টাকাগুলো কি আসলেই জাল?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘একদম না! ব্যাংক থেকে সদ্য তোলা নোট হবে ওগুলো। আঙুলের সাথে থুথু মাখিয়ে একটু ঘষব কেবল।’ 

কফির কাপে চুমুক দিল শ্যাডো। জেলখানার কফিও এত খারাপ ছিল না। ‘পুলিসটাও নকল, সেটা তো বুঝতেই পারছি। নেকলেসের কী হবে?’ 

‘ওটা তো প্রমাণ!’ মুচকি হাসলেন ওয়েনসডে। লবণের পাত্রটার মুখ খুলে, কিছু লবণ ফেললেন টেবিলে। ‘দোকান মালিকের ধারণা, সোপির কেসটা আদালতে উঠলেই নেকলেস ফিরে পাবে। এরইমাঝে কীভাবে রসিয়ে রসিয়ে গল্পটা সবাইকে বলবে, সেটা ভাবতে শুরু করেছে সে। এদিকে বিশপ আর পুলিস অফিসার বের হয়ে যাবে দোকান থেকে, সাথে থাকবে বারোশ ডলার আর একটা হীরার নেকলেস!’ 

টেবিল পরিষ্কার করার জন্য ফিরে এলো ওয়েট্রেস। ‘আচ্ছা প্রিয়,’ জানতে চাইলেন ওয়েনসডে, ‘তুমি কি বিবাহিতা?’ 

মাথা নেড়ে না করল মেয়েটা। 

‘কী আশ্চর্য! তোমার মতো সুন্দর মেয়ে এখনও অবিবাহিতা থাকে কী করে!’ টেবিলের ফেলা লবণের উপর ঘুরে-বেড়াচ্ছিল তার হাত। এটা-সেটা আঁকছিলেন তিনি, রুনের মতো দেখাচ্ছিল সেগুলো। ওয়েট্রেস মেয়েটা দাঁড়িয়ে রইল পাশে। 

ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন ওয়েনসডে, ‘তোমার শিফট শেষ হয় কখন?’

‘নয়টায়,’ ঢোক গিলতে গিলতে বলল মেয়েটা। ‘দেরি হলে সাড়ে-নয়টায়।’

‘এখানকার সবচেয়ে ভালো মোটেলের নাম কী?’ 

‘মোটেল সিক্স আছে।’ 

মেয়েটার হাত আলতো করে স্পর্শ করলেন ওয়েনসডে, লবণের কয়েকটা দানা পড়ল হাতে। ওগুলো মোছার চেষ্টাই করল না ওয়েট্রেস। ‘আমাদের জন্য,’ এমন স্বরে বললেন ওয়েনসডে যে শোনাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। ‘মোটেল সিক্স হবে সুখের প্রাসাদ।’ 

একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল মেয়েটা। এরপর ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়ল একবার। পরক্ষণেই পালিয়ে গেল রান্নাঘরে। 

‘মেয়েটা তো বাচ্চা!’ বলল শ্যাডো। ‘ওর সাথে শোয়াটা মনে হয় না আইন অনুমোদন করবে।’ 

‘আইন নিয়ে আমি খুব একটা মাথা ঘামাই না,’ ওয়েনসডে বললেন। ‘আর তাছাড়া আমার মেয়েটাকে দরকার। আসলে ঠিক মেয়েটাকে না, দরকার একজন কুমারীকে। দেহে রক্তের বান ডাকতে কুমারীর জুড়ি নেই। সকালের আগে আমাকে বিরক্ত করো না।’ 

ইগল’স পয়েন্টের মোটেল কর্মচারী মেয়েটাও কি কুমারী ছিল? ভাবল শ্যাডো। ‘আপনার ভয় হয় না? রোগ-শোক হয়ে যেতে পারে।’ জানতে চাইল ও। ‘অথবা যদি মেয়েটা পেট বাঁধিয়ে ফেলে? যদি ওর কোনো ভাই থেকে থাকে?’ 

‘না,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘আমি রোগ-টোগকে ভয় পাই না। ওসব আমার হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমার মতো যারা আছে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘অনুর্বর’ হয়ে থাকে। তাই পেট বাঁধাবার ঝুঁকিও কম। আগে অনেক হতো, এখন প্রায় অসম্ভব। আর অনেক মেয়েরই বাপ-ভাই থাকে। তাতে কী? প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওরা যখন আমাকে খুঁজতে আসে, তখন আমি শহরেই নেই!’ 

‘এখানে তাহলে আমরা রাত কাটাচ্ছি?’ 

‘আমি মোটেল সিক্সে থাকব,’ বলে কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা তামাটে রঙের চাবি বের করলেন। একটা ঠিকানা লেখা আছে ওতে: ৫০২, নর্থরিজ রোড, অ্যাপার্টমেন্ট ৩। ‘তোমার জন্য অনেক দূরের একটা শহরে, এই অ্যাপার্টমেন্টটা অপেক্ষা করছে।’ ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করলেন ওয়েনসডে। কী যেন ভেবে বললেন, ‘গ্রেহাউন্ড বাস আসবে আর বিশ মিনিট পর। গ্যাস স্টেশনে থামবে ওটা। এই নাও তোমার টিকিট।’ একটা ভাঁজ করা টিকিট বের করে টেবিলের উপর রাখলেন তিনি। ওটা তুলে নিয়ে দেখল শ্যাডো। 

‘মাইক আইনসেল কে?’ টিকিটে লেখা নামটা পড়ে জানতে চাইল ও ‘তুমি। মেরি ক্রিসমাস।’ 

‘লেকসাইড আবার কোন জায়গা?’ 

‘যেখানে তুমি সামনের কয়েকটা মাস বড়ো আনন্দে কাটাবে। আর যেহেতু সুখবর দল বেঁধে আসে…’ পকেট থেকে একটা প্যাকেজ বের করে ওর দিকে ঠেলে দিলেন তিনি। সুন্দর করে ফিতা বাঁধা হয়েছে প্যাকেজটাতে, যেন কারও জন্য উপহার। কিন্তু শ্যাডো হাত বাড়াল না। 

‘কী হলো?’ 

অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্যাকেজটা নিলো শ্যাডো, ভেতর থেকে বের হলো ব্যবহৃত একটা বাছুরের চামড়া নির্মিত ওয়ালেট। জিনিসটা যে অন্য কারও, সেটা বুঝতেই পারছে। ভেতরে শ্যাডোর ছবিঅলা একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স, নামের জায়গায় লেখা-মাইকেল আইনসেল। ঠিকানা হিসেবে দেওয়া মিলওয়াকির একটা বাড়ি, একটা মাস্টারকার্ডও আছে। সেই সাথে আছে বিশটা পঞ্চাশ ডলারের কড়কড়ে নোট। ওয়ালেট বন্ধ করে পকেটে ভরল শ্যাডো। 

‘ধন্যবাদ। 

‘ক্রিসমাস বোনাস হিসেবে ধরে নাও। এসো, তোমাকে বাসে তুলে দিই।’ রেস্তোরাঁর বাইরে চলে এলো ওরা, গত কয়েক ঘণ্টায় তাপমাত্রা আরও অনেক কমে এসেছে। এখন এতটাই ঠান্ডা যে তুষারপাত হওয়াটাও সম্ভব না। 

‘আছা, ওয়েনসড়ে। আপনার বলা দুই প্রতারণার দুটাতেই দুই জন লোক দরকার। আগে পার্টনার ছিল নাকি?’ শ্যাডোর নিশ্বাস যেন বের হবার আগেই বাষ্পে পরিণত হচ্ছে। নিজেকেই শোনাল, লেকসাইডে পা রেখেই প্রথমে সবচেয়ে মোটা আর সবচেয়ে উষ্ণ কোট কিনতে হবে। 

‘হ্যাঁ,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘পার্টনার একজন ছিল। আমার তুলনায় বয়সও কম ছিল ওর। কিন্তু আফসোস, সেগুলো অতীতের স্মৃতি। যাই হোক, আমরা গ্যাস স্টেশনে এসে পড়েছি। ভুল না দেখলে, ওই যে ওখানে তোমার বাস দাঁড়িয়ে আছে।’ বাসটা এরইমাঝে ছাড়ার সংকেত দিচ্ছে। ‘ঠিকানা চাবির সাথেই লেখা আছে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তো বলবে, আমি তোমার চাচা। আমার নাম এমারসন বোরসন। এবার যাও, লেকসাইডে আরাম করে আস্তানা গেঁড়ে বসো, ভাতিজা আমার। আমি এক সপ্তাহ পর আসছি। তারপর আবার একত্রে ভ্রমণ শুরু হবে আমাদের। এই কটা দিন মাথা নিচু করে থেকো।’ 

‘আমার গাড়ির কী হবে?’ 

‘আমি দেখে-শুনে রাখব,’ হাত বাড়িয়ে দিলেন ওয়েনসডে। করমর্দন করল শ্যাডো। লোকটার হাত মৃত লাশের চাইতেও বেশি ঠান্ডা বলে মনে হলো ওর। 

‘হায় ঈশ্বর,’ বলল শ্যাডো। ‘আপনি তো জমে যাচ্ছেন!’ 

‘তাহলে যত তাড়াতাড়ি মোটেল সিক্সের বিছানাটা ওই কুমারী মেয়ে দিয়ে গরম করাতে পারি, তত ভালো।’ বলে অন্য হাত দিয়ে শ্যাডোর কাঁধে আলতো করে চাপ দিলেন তিনি। 

দ্বৈত-দৃষ্টি পেয়ে বসল শ্যাডোকে। সামনে একজন বয়স্ক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে, ওর কাঁধে হাত দিয়ে চাপ দিচ্ছেন। আবার একই সাথে শত শত শীতকাল ও ধূসর চুলের হ্যাট পরা এক বৃদ্ধকেও দেখতে পেল। লোকটা হাতে ছড়ি নিয়ে এক বসতি থেকে অন্য বসতিতে যাচ্ছেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছেন আগুন, দেখছেন এমন এক জীবনের নাট্যায়ন যা কখনও স্পর্শ…কখনও উপভোগ করতে পারবেন না। 

‘যাও,’ বললেন ওয়েনসডে, হুংকারের মতো শোনার তার কণ্ঠ। ‘সব ঠিক আছে, ছিল আর সামনেও থাকবে।’ 

বাস-চালক মহিলাকে নিজের টিকিট দেখাল শ্যাডো। ‘খুব বাজে দিনে বাইরে বেরিয়েছেন।’ বলল মহিলা। এরপর দিনটার তাৎপর্যের কথা মনে পড়তেই হেসে বলল, ‘মেরি ক্রিসমাস।’ 

বাসটা মোটামুটি ফাঁকাই। ‘আমরা কখন লেকসাইডে পৌঁছাব?’ 

দুই ঘণ্টা, একটু বেশিও লাগতে পারে।’ উত্তর দিল মহিলা। ‘খুব ঠান্ডা পড়েছে।’ বলে একটা সুইচ টিপল সে, হিসহিস শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। বাসের মাঝামাঝি গিয়ে বসল শ্যাডো, সিটটা যথাসম্ভব পেছনে ঠেলে দিল। বাসের উষ্ণতা আর হালকা দুলুনিতে ঘুম পেয়ে গেল ওর। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে টের পাবার আগেই হারিয়ে গেল ঘুমের অতলে। 

.

দুনিয়ায়…তবে দুনিয়ার অভ্যন্তরের সেই জায়গাটায় আবিষ্কার করল শ্যাডো নিজেকে। দেয়ালের চিহ্নগুলো দেখে ভেজা লাল কাদা বলে মনে হচ্ছে। হাতের ছাপ, আঙুলের ছাপ আর এখানে সেখানে অদক্ষ হাতের আঁকা পশু, পাখি ও মানুষের ছবি পড়ছে নজরে। 

এখনও জ্বলছে অগ্নিকুণ্ড, এখনও ওটার ওপাশে বসে আছে মহিষ-মানব। বড়ো বড়ো চোখে শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঠোঁটগুলো লোম দিয়ে ঢাকা। মহিষ-মানব কথা বলে উঠলেও, নড়ল না ওগুলো। ‘এখন বিশ্বাস হয়েছে তো? 

‘আমি ঠিক জানি না,’ বলল শ্যাডো। ওর ঠোঁটও নড়েনি কথা বলার সমায়, ব্যাপারটা ধরতে পারল। দুজনের এই আলাপচারিতায় বাক্য বিনিময় হচ্ছে না। ‘তুমি কি আসল?’ 

‘বিশ্বাস রাখো,’ কেবল এতটুকুই বলল মহিষ-মানব। 

‘তুমি কি…’ ইতস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলল শ্যাডো। ‘দেবতা?’ 

আগুনের ভেতর এক হাত বাড়িয়ে দিল মহিষ-মানব, বের করে আনল উত্তাপে লাল হয়ে যাওয়া একটা ব্র্যান্ড। তালুর ঠিক মাঝখানে ধরে রেখেছে ওটাকে, নীল আর হলদে আগুন উড়ছে তার লালচে হাতকে ঘিরে। তবে কিছু জ্বালাচ্ছে বলে মনে হলো না। 

‘এই দেশটা দেবতাদের জন্য নয়।’ বলল সে। কিন্তু নাহ, মহিষ-মানব নয়, শ্যাডোর স্বপ্নে কথা বলে উঠেছে খোদ অগ্নিকুণ্ড। ‘এক সাঁতারু একে সমুদ্রের তলদেশ থেকে তুলে এনেছে। একে বানিয়েছে এক মাকড়সা, এতে মলত্যাগ করেছে এক দাঁড়কাক। এই দেশ আসলে একটা পতিত পিতার দেহ, যার হাড়গুলো হলো পাহাড় আর যার চোখগুলো হ্রদ। 

‘এই দেশ, স্বপ্ন আর আগুনের দেশ।’ আগুন জানাল ওকে।

আগুনের ভেতর ব্র্যান্ডটাকে আবার রেখে দিল মহিষ-মানব। 

‘আমাকে এসব বলছ কেন?’ প্রশ্ন করল শ্যাডো। ‘আমি তো গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই। আমি একেবারে তুচ্ছ। এককালে ছিলাম ব্যায়ামবিদ, এরপর ছিঁচকে চোর। স্বামী হিসেবেও নিজেকে খুব একটা সফল বলে দাবি করতে পারি না…’ মিইয়ে এলো ওর কণ্ঠ। 

লরাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি আমি?’ আচমকা মহিষ-মানবের কাছে জানতে চাইল শ্যাডো। ‘আবার বাঁচতে চায় সে। বলেছিলাম, আমি সাহায্য করব। এটুকু অন্তত ওর প্রাপ্য।’

কিছুই বলল না মহিষ-মানব। গুহার ছাদের দিকে ইঙ্গিত করল সে, শ্যাডোও তাকাল সেদিকে। ছাদের একটা ছোটো গর্ত দিয়ে হালকা আলো ভেসে আসছে। 

‘ওখানে?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘ওখানে যেতে হবে? 

আচমকা স্বপ্নটা ভিন্ন দিকে মোড় নিলো। পাথর আর মাটি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল শ্যাডো, যেন ও আসলে ছুঁচো! বার বার চেষ্টা করছে মাটি সরিয়ে উঠে আসার। যেন সে আসলে ব্যাজার, চাইছে মাটি ভেদ করে উঠে আসছে। অথবা ভালুক, যে দুহাতে ঠেলে সরাতে চাইছে মাটি। তবে পৃথিবী অবলা নারী নয়; শক্ত, ঘন মাটি আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরছে ওকে। শ্যাডো বুঝতে পারছে, অচিরেই মারা যাবে সে। দুনিয়ায়…তবে দুনিয়ার অভ্যন্তরে কোথাও রচিত হবে ওর কবর 

যথেষ্ট শক্তি নেই ওর দেহে, আস্তে আস্তে কমে আসছে প্রতিরোধ। সে জানে—এখন যদি দম নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মারা যাবে পৃথিবীর বুকে চলতে থাকা বাসে বসা ওর দেহটাও। 

বৃথা প্রচেষ্টা চালাল আরও কয়েকবার, কিন্তু প্রতিবারই আরও কমে আসছে তার প্রচণ্ডতা। প্রতিটা নড়াচড়া খেয়ে নিচ্ছে অমূল্য বাতাস। ফাঁদে আটকা পড়েছে ও, না যেতে পারছে সামনে আর ধরতে পারছে ফিরতি পথ 

‘দর কষাকষি করবে না?’ শ্যাডোর মনের ভেতর বলে উঠল কেউ।

‘কী নিয়ে করব?’ পালটা প্রশ্ন করল শ্যাডো। ‘দেওয়ার মতো তো আমার কিছু নেই।’ মাটির স্বাদ এখন মুখে অনুভব করতে পারছে ও। ‘কেবল নিজেকে বাদে। 

দম বন্ধ করে বলল সে, ‘আমি নিজেকেই উৎসর্গ করলাম।’

ফল পাওয়া গেল সাথে সাথে। চারপাশের পাথর আর মাটি এমন জোরে চাপ দিতে শুরু করল যে ফুসফুস থেকে শেষ বাতাসটুকুও বেরিয়ে গেল পলকেই। চারপাশের চাপ এখন ব্যথায় পরিণত হয়েছে। কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল শ্যাডো, আর সহ্য করা সম্ভব না। ঠিক সেই মুহূর্তেই কমে গেল চাপ, বুক ভরে মিষ্টি বাতাস টেনে নিলো সে। ছাদের থেকে আসা আলোটা আরও উজ্জ্বল…আরও বড়ো হয়ে উঠেছে। 

ভূ-পৃষ্ঠের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ওকে। 

পরবর্তী চাপের সাথে তাল মেলাবার প্রয়াস পেল শ্যাডো, সফলও হলো।

এবারের চাপটা নিয়ে এলো আগের চাইতেও তীব্র ব্যথা। শ্যাডোর মনে হলো যেন কেউ ওকে নিয়ে খেলছে। হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিচ্ছে সর্বশক্তিতে, দেহের প্রতিটা হাড় যেন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে, মাংসের তালে পরিণত হবে আরেকটু হলেই। ওর মুখ আর মাথাটা গর্ত থেকে বের হওয়া মাত্র ফুসফুসের সবটুকু বাতাস খরচ করে চিৎকার করে উঠল শ্যাডো, ব্যথায়…ভয়ে।

চিৎকার করতে করতেই ভাবল, বাসে বসা ওর দেহটাও কি চিৎকার করছে?

আরেকবার চাপ দিয়ে মাটি উগড়ে দিল শ্যাডোর দেহটাকে, হাত দিয়ে লাল মাটি আঁকড়ে ধরল বেচারা। কোনোক্রমে নিজেকে টেনে তুলল, চেহারা থেকে হাত দিয়ে মুছে ফেলল মাটি। আকাশের দিয়ে তাকিয়ে দেখে, এখন গোধূলি। তারা একে একে উঁকি দিচ্ছে। এমন উজ্জ্বল তারা আগে কখনও দেখেনি শ্যাডো। 

‘অচিরেই,’ আগুনের গমগমে কন্ঠ পেছন থেকে ভেসে এলো। ‘এদের পতন হবে। তারার মানুষের সাথে দেখা হবে মাটির মানুষের। তাদের মাঝে জন্ম নেবে বীরেরা, জন্ম নেবে দানব-হত্যাকারী মানব, চোখ খুলে দেখবে জ্ঞানীরা। এদের কেউ কিন্তু দেবতা হবে না। এই দেশটা দেবতাদের জন্য নয়।’

.

এক দমকা বাতাস, তীব্র ঠান্ডায় যা অবাক করে দেয়, শ্যাডোর চেহারা স্পর্শ করল। মনে হলো বরফ-শীতল পানিতে চুবিয়েছে কেউ! চালকের কণ্ঠ শুনতে পেল ও, পাইনউডে এসেছে। ‘কারও যদি সিগারেট খাবার বা একটু হাঁটাহাঁটি করার দরকার হয়, তাহলে করে নিন। আমরা এখানে মিনিট দশেক থামব।’ 

বাস থেকে নামল শ্যাডো। অবিকল আগেরটার মতোই একটা গ্রাম্য স্টেশনে এসে থেমেছে বাসটা। চালক দুজন টিনেজ মেয়েকে বাসে উঠতে সাহায্য করছে। ওদের লাগেজগুলো গুছিয়ে রাখছে লাগেজ কম্পার্টমেন্টে। 

‘এই,’ শ্যাডোকে দেখে বলল চালক। ‘আপনি তো লেকসাইডে যাচ্ছেন?’

মাথা নাড়ল শ্যাডো, চোখ থেকে এখনও ঘুম যায়নি। 

‘জায়গাটা ভালো,’ বলল মহিলা। ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে লেকসাইডে গিয়ে থিতু হই। অনেকদিন হলো আছেন নাকি?’ 

‘নাহ, প্রথমবারের মতো যাচ্ছি।’ 

‘তাহলে ম্যাবেলের প্যাস্টি খেতে ভুলবেন না, বুঝেছেন?’ 

ব্যাখ্যা জানতে চাইল না শ্যাডো। ‘আচ্ছা,’ বরঞ্চ ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল। ‘ঘুমাবার মাঝে কি আমি কথা বলছিলাম?’ 

‘কে জানে!’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জবাব দিল মহিলা। ‘বললেও আমি শুনতে পাইনি। এবার বাসে ফিরে চলুন। লেকসাইডে পৌঁছে আপনাকে আমি ডাকব।’ 

পাইনউডে ওঠা দুই টিনেজ মেয়ে শ্যাডোর ঠিক সামনের সিটেই বসেছে। বয়স টেনে-টুনে চোদ্দো হবে। ওদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে, মেয়ে দুটো বান্ধবী-আত্মীয়া নয়। এদের মাঝে একজনের যৌনতার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই, তবে পশু-পাখি সম্পর্কে জ্ঞান অনেক। অন্যজনের আবার পশু- পাখির ব্যাপারে আগ্রহ নেই। তার পূর্ণ মনোযোগ যৌনতার দিকে। আলকা- সেল্টজার ট্যাবলেট ব্যবহার করে কীভাবে মুখ-মেহনের সর্বোচ্চ আনন্দ উপভোগ করা যায়, তার বিস্তারিত বর্ণনা না চাইতেও শুনতে হলো শ্যাডোকে। 

চোখ বন্ধ করে বাস চলার আওয়াজের দিকে মন দিল শ্যাডো। এখন সামনে বসা দুজনের টুকরা-টুকরা কথা কেবল ভেসে আসছে কানে। কিছুক্ষণ পরেই ব্রেক কষে থামল বাসটা, শ্যাডোর কানে এলো মহিলা চালকের চিৎকার, ‘লেকসাইড!’ সেই সাথে হিসহিস শব্দে খুলে গেল বাসের দরজা। মেয়ে দুটোর সাথে নামল শ্যাডোও। একটা ভিডিয়ো স্টোর-কাম-ট্যানিং স্যালন-কাম গ্রেহাউন্ড স্টেশনের পার্কিং লটে পা রাখল ওরা। বাতাস হাড় জমিয়ে দেওয়ার মতো ঠান্ডা, তবে তাজা। এক লহমায় ঘুম বিদায় নিলো। দক্ষিণে আর পশ্চিমে দেখতে পাচ্ছে শহরটার আলো। আর পুব থেকে ঝিলিক দিচ্ছে জমে যাওয়া একটা হ্রদ। 

মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে লটে, পা ঠুকছে আর ফুঁ দিয়ে হাত গরম রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। দুজনের মাঝে যে ছোটো, সে আড়চোখে তাকাল শ্যাডোর দিকে। যখন বুঝতে পারল ওর এই মনোযোগ ধরা পড়ে গেছে, তখন লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। 

‘মেরি ক্রিসমাস,’ বলল শ্যাডো। 

‘হুম,’ অন্যজন উত্তর দিল। প্রথম জনের চাইতে বয়স দুই-এক বছর বেশিই হবে এর। ‘আপনাকেও ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা। এই মেয়েটার মাথায় গাজর-রঙা চুল, ছোটো নাকটার চারপাশে শত-সহস্র ফুটকি। 

‘দারুণ শহর।’ বলল শ্যাডো। 

‘আমাদের ভালোই লাগে।’ ছোটোজন উত্তর দিল। এই মেয়েটাই পশু-পাখি ভালোবাসে, হাসতেই দাঁতের নীলচে ব্রেসগুলো দেখা গেল। ‘কার মতো যেন লাগছে দেখতে,’ বলল মেয়েটা। ‘তুমি কি কারও ভাই বা ছেলে বা ওরকম কিছু?’

‘হায়রে অ্যালিসন,’ বান্ধবী বলল। ‘সবাই কারও না কারও ভাই, নইলে ছেলে নইলে ওরকম কিছু। 

‘আমি সেটা বোঝাতে চাইনি।’ আচমকা ওদের চোখে এসে লাগল উজ্জ্বল সাদা আলো। সেই আলোর পেছনে যে একটা স্টেশন ওয়্যাগন লুকিয়ে আছে, সেটা টের পেতে একটু দেরি হলো শ্যাডোর। এক মা চালাচ্ছেন গাড়িটা। ওটা দেখা মাত্র সবকিছু গুছিয়ে নিলো দুই মেয়ে। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল, শ্যাডো একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে পার্কিং লটে। 

‘তোমাকে সাহায্য করতে পারি?’ ভিডিয়ো স্টোরের মালিক, বুড়ো এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন। ‘ক্রিসমাসে তো দোকান খোলা থাকে না। তবে আমি বাসটাকে দেখতে আসি, যদি তোমার মতো কোনো বেচারা একা দাঁড়িয়ে থাকে আরকি!’ হাসি মুখে জানালেন তিনি। 

বয়স্ক চেহারাটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে শ্যাডো, তৃপ্ত একটা চেহারা। এমন একজন ওই চেহারার মালিক, যে ছাই ওড়াতে গিয়ে অমূল্য রতন পেয়েছে। 

‘স্থানীয় ট্যাক্সি কোম্পানির নম্বরটা পেলেই চলবে।’ বলল শ্যাডো। 

‘দেওয়া যাবে,’ সন্দিগ্ধ সুরে বললেন বৃদ্ধ। ‘তবে রাতের এই সময়টায় টম ঘুমিয়ে থাকে। যদি ওকে জাগাতেও পারো, মনে হয় না এখানে টেনে আনাটা সম্ভব হবে। সন্ধ্যায় ওকে খুব হাসি-খুশি দেখেছিলাম…একটু বেশিই হাসি-খুশি, মাতাল না হলে অমন হয় না। কোথায় যাবে?’ 

চাবিতে লিখে রাখা ঠিকানাটা দেখাল শ্যাডো। ‘হুম,’ বললেন বৃদ্ধ। ‘এখান থেকে দশ…অথবা বিশ মিনিট দূরত্বে। কিন্তু এই ঠান্ডায় হাঁটতে একদম ভালো লাগার কথা না। আর অজানা গন্তব্যে যাবার দূরত্বটাকেও কেন জানি বেশি বলে মনে হয়। প্রথমবার অনেক সময় লাগে, অথচ এরপর বলতে গেলে চোখের পলকে পৌঁছানো যায়!’ 

‘সত্যিই তাই,’ বলল শ্যাডো। ‘অবশ্য আমি এভাবে কখনও ভাবিনি।’ 

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, হাসিতে আবারও ভরে উঠল তার মুখ। ‘ধুর ছাই, ক্রিসমাস আজ। চলো, তোমাকে টেসিতে করে পৌঁছে দিয়ে আসি। 

শ্যাডোর আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। বৃদ্ধের পিছুপিছু রাস্তায় চলে এলো ও, একটা বিশাল রোডস্টার গাড়ির দিকে এগোলেন তিনি। দেখে মনে হয়, সেই ১৯২০ সালের দিকে এসবেরই কোনো একটায় চড়ে ঘুরে বেড়াত মাফিয়ার পাণ্ডারা। রঙটা একটু গাঢ়, তবে সোডিয়াম ল্যাম্পের আলোয় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ‘এই হচ্ছে টেসি,’ পরিচয় করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বললেন বৃদ্ধ। ‘দারুণ সুন্দরী না?’ আদর করার ভঙ্গিতে চাপড় বসালেন গাড়িতে। 

‘সুন্দরী কেন? সুন্দর হতে অসুবিধা কী?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘ওর মডেল হচ্ছে ওয়েন্ড ফনিক্স। ওয়েন্ডকে সেই একত্রিশ সালের দিকে ক্রাইসলার কিনে নিয়েছিল। এখন আর ওয়েন্ড বানানো হয় না। কোম্পানিটার গোড়াপত্তন করেছিল হার্ভি ওয়েন্ড, স্থানীয় এক ছেলে। একচল্লিশ কি বেয়াল্লিশ সালে আত্মহত্যা করে।’ 

গাড়ির ভেতর থেকে চামড়া আর পুরাতন সিগারেটের গন্ধ ভেসে আসছে—নতুন বলা যাবে না কোনোক্রমেই। আসলে এতদিন ধরে মানুষ ওতে চড়ে ধূমপান করেছে যে গন্ধটা সিটের কাপড়ের অংশ বনে গেছে। প্রথম চেষ্টাতেই খুক খুক করে কেশে উঠল টেসি। 

‘আগামীকাল,’ শ্যাডোকে বললেন বৃদ্ধ। ‘ওকে গ্যারেজে তুলে রাখব। ভালো একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেব ওকে, বসন্ত আসার আগ পর্যন্ত শীত-নিদ্রায় থাকবে। আসলে এখনই ওকে রাস্তায় বের করাটা ঝুঁকি পূর্ণ হয়ে গেছে। বরফ পড়ছে বলে।’ 

‘কেন? বরফে সমস্যা হয়?’ 

‘সমস্যা হয় না। কিন্তু এখন রাস্তায় লবণ ঢালা হচ্ছে। এমন মরচে ফেলায় ওই লবণ যে তা আর বলার না। সরাসরি অ্যাপার্টমেন্টে যেতে চাও? নাকি শহরটা একটু ঘুরে দেখবে?’ 

‘আপনাকে ঝামেলায় ফেলতে চাই না—’ 

‘আরে, ঝামেলা কীসের! আমার বয়সে একটু-আধটু ঘুমাতে পারলেই সবাই কৃতজ্ঞবোধ করে। এখন রাতে যদি পাঁচ ঘণ্টা ঘুম হয়, তাহলে আনন্দে বুক ভরে যায়! জাগ্রত অবস্থায় মন শুধু দৌড়াতেই থাকে…দৌড়াতেই থাকে। ইস, নিজের পরিচয়ই তো এখনও দেইনি তোমাকে। আমি হিনজেলমান। করমর্দন করতাম, কিন্তু দুই হাত স্টিয়ারিং-এ বলে পারছি না। টেসি খুব দুষ্ট, সম্পূর্ণ মনোযোগ না পেলে গাল ফুলিয়ে বসে।’ 

‘মাইক আইনসেল,’ বলল শ্যাডো। ‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, হিজেলমান।’ 

‘তাহলে চলো, হ্রদটাসহ পুরো শহর দেখিয়ে আনি।’ বললেন হিনজেলমান।

শহরের প্রধান সড়কটা বেশ সুন্দর, এমনকি এই রাতেও তাই মনে হচ্ছে। শহরের দুটো রেস্তোরাঁ চিনিয়ে দিলেন হিনজেলমান (একটা জার্মান আর অন্যটা বৃদ্ধের ভাষ্যমতে আংশিক গ্রিক আর আংশিক নরওয়েজিয়ান)। শ্যাডো চিনে নিলো বেকারি, বইয়ের দোকান (বইয়ের দোকান ছাড়া আবার শহর হয় নাকি—এমনটাই মত হিনজেলমানের); লাইব্রেরির পাশ দিয়ে যাবার সময় টেসির গতি একটু কমালেন তিনি, শ্যাডোকে ভালোমতো ওটা দেখে নেবার সুযোগ দিলেন। দালানটার দরজায় প্রাচীন গ্যাস লাইট জ্বলজ্বল করছে। ‘সেই ১৮৭০ সালে জন হেনিং, স্থানীয় ব্যারন বানিয়েছিলেন দালানটা,’ গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন তিনি। ‘তার ইচ্ছা ছিল, এটাকে হেনিং মেমোরিয়াল লাইব্রেরি নাম দেবেন। কিন্তু তিনি মারা যাবার পর সবাই একে লেকসাইড লাইব্রেরি বলে ডাকা শুরু করল। দারুণ না?’ ভাবখানা এমন যে নিজ হাতে ওটাকে বানিয়েছেন তিনি। দালানটাকে দেখে কেন যেন দুর্গের আদলে গড়া বলে মনে হলো শ্যাডোর। ‘ঠিক ধরেছ,’ ব্যাপারটা হিনজেলমানকে বলতেই তিনি একমত হলেন। ‘একসময় তো টারেটও ছিল। আসলে হেনিং চেয়েছিল: বাইরে থেকে যেন লাইব্রেরিটাকে দেখতে তেমনই লাগে। ভেতরে কিন্তু আধুনিক ডিজাইনের পাইন কাঠের তাক আছে। মিরিয়াম সুল্টজ চায় পুরোটাকে ভেঙে আবার নতুন করে তুলতে। কিন্তু দালানটা ঐতিহাসিক স্থানের মর্যাদা পেয়েছে বলে কিছু করতে পারছে না।’ 

গাড়ি চালিয়ে হ্রদটার দক্ষিণ পাশে চলে এলো শ্যাডোরা। শহরটা ঘিরে আছে হ্রদটাকে, রাস্তার থেকে প্রায় ত্রিশ-ফুট নিচে পানি। সাদা বরফের ফাঁকে ফাঁকে পানির ঝলক দেখতে পেল যুবক 

‘জমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে,’ বলল ও। 

‘এক মাস হলো জমে গেছে, থ্যাংক্স গিভিয়ের পরপরই। এক রাতে জমে এই অবস্থা। আইস ফিশিং করো নাকি, মি. আইনসেল?’ 

‘কখনও করিনি। 

‘একজন পুরুষ এরচেয়ে ভালো আর কোনো কাজ পাবে না। মাছ ধরাটা বড়ো ব্যাপার না, দিন শেষে যে মানসিক প্রশান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা যায় সেটা আর কোনোভাবে মেলে না।’ 

‘মনে থাকবে আমার,’ টেসির জানালা দিয়ে হ্রদের দিকে তাকাল শ্যাডো। ‘হাঁটা যাবে বরফের উপর দিয়ে?’ 

‘যাবে। চাইলে গাড়িও চালানো যাবে। তবে ঝুঁকিটা নিতে চাই না। শহরে শীত নেমেছে ছয় সপ্তাহ হলো।’ বলল হিনজেলম্যান। ‘কিন্তু উইসকনসিনের উত্তরে আর কোথাও এত দ্রুত ঠান্ডা নামে না। এক শীতের গল্প বলি শোনো। হরিণ শিকারে বেরিয়েছি, ত্রিশ…নাহ, চল্লিশ বছর আগের কথা। একটাকে গুলি করলাম, লাগাতে পারিনি। ভয় পেয়ে বেচারা জঙ্গলের দিকে দৌড় দিল। হ্রদটা পার হতে পারলেই, মুক্তি! তুমিও কিন্তু ওদিকের একটা অ্যাপার্টমেন্টেই উঠছ, মাইক। যাই হোক, এরকম স্বাস্থ্যবান হরিণ আগে দেখিনি। ছোটোখাটো একটা ঘোড়ার সমান বিশাল হবে। তখন বয়স ছিল কম, রক্ত গরম। আগের বছর হ্যালোইনের আগেই বরফ জমতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই বছর থ্যাংক গিভিয়ের সময়ও শীতের কোনো চিহ্ন নেই। মাটিতে জমে থাকা তুষারে পরিষ্কার দেখতে পেলাম ওটার পদচিহ্ন। 

‘বোকা না হলে কেউ হরিণের পিছু ধাওয়া করে না। কিন্তু তখন…ওই যে বললাম…বয়স ছিল কম! আমি পিছু নিলাম। লেকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পেলাম ওটাকে, আট কি নয় ইঞ্চি গভীর পানিতে। চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইল ওটা। ঠিক সেই সময় সূর্যকে ঢেকে ফেলল মেঘ। ঠান্ডাও নামল সাথে সাথে। দশ মিনিটের মাঝে ত্রিশ ডিগ্রি নেমে গেল তাপমাত্রা, সত্যি বলছি! বেচারা প্রাণিটা দৌড়াতে চাইল, কিন্তু পারল না। পানি বরফ হয়ে গেছে যে! 

‘আমি ধীর পায়ে হেঁটে গেলাম ওটার কাছে! বোঝাই যাচ্ছিল, পালাবার আপ্রাণ প্রয়াস চালাচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমার কথা আর কি বলব, অসহায় একটা প্রাণিকে গুলি করি কীভাবে বলো? তাই শটগানটা ওপরের দিকে তাক করে একটা গুলি ছুঁড়লাম! 

‘গুলির আওয়াজে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল হরিণটা। এমনভাবে লাফ দিল যে চামড়া খুলে এলো ওটার। পা বরফে জমা বলে চামড়া আর শিং সাথে নিতে পারল না। তবে হ্যাঁ, সে দফা জঙ্গলে পালিয়ে যেতে পেরেছিল ওটা। দূর থেকে হরিণটার গোলাপি মাংস দেখে মনে হচ্ছিল যেন সদ্যজাত ইঁদুরছানা পালাচ্ছে! তার উপর ঠান্ডায় কাঁপছিল ঠক ঠক করে। 

‘বেচারার জন্য এত মন খারাপ হয়েছিল যে লেকসাইডের সেলাই-ফোঁড়াইতে দক্ষ মহিলাদেরকে দিয়ে একটা ভেড়ার লোমের পোশাক বানিয়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য আমাদেরই উলটো শায়েস্তা করেছিলেন তারা। পুরো পোশাকটা বানিয়েছিলেন কমলা সুতা দিয়ে। সেসময় শিকারিরা ভুল বোঝাবুঝি না হবার জন্য কমলা রঙের পোশাক পরে শিকার করত।’ কী ভেবে যেন যোগ করলেন তিনি। ‘যদি ভাবো যে এসব কথার একটা বিন্দুও মিথ্যা তো বলো। এখনও ওটার শিং আমার দেয়ালে ঝুলছে। 

হাসিতে ফেটে পড়ল শ্যাডো। বৃদ্ধের মুখে দেখা গেল সন্তুষ্টির ছাপ। লাল ইটের বানানো একটা দালানের সামনে এসে থামল গাড়িটা। ‘ওই যে, পাঁচশ দুই নম্বর দালান,’ বললেন হিনজেলমান। ‘তোমার অ্যাপার্টমেন্ট সম্ভবত একেবারে ওপরের তলায়, হ্রদের দিকে মুখ করে। বিদায়, মাইক।’ 

‘ধন্যবাদ, মি. হিনজেলমান। তেলের জন্য কিছু টাকা দিলে কি রাগ করবেন?’

‘মিস্টার-ফিস্টার বলা লাগবে না। শুধু হিনজেলমান বললেই চলবে। আর এক পেনিও দরকার নেই। আমার আর টেসির তরফ থেকে মেরি ক্রিসমাস।’ 

‘আসলেই নেবেন না? 

থুতনি চুলকালেন বৃদ্ধ। ‘এক কাজ করা যায়। সামনের সপ্তাহে আমি কিছু টিকিট বিক্রি করতে আসব, আমাদের এখানে র‍্যাফেল ড্র হয়। এখন গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ো।’

‘মেরি ক্রিসমাস,’ হাসল শ্যাডো। ‘হিনজেলমান।’ 

হাত মেলালেন বৃদ্ধ। ‘সাবধান, সিঁড়িগুলো কিন্তু পিচ্ছিল। ওই যে, দালানে ঢোকার দরজা। আমি এখানেই আছে, তুমি দরজা খুলে আমাকে ইঙ্গিত দিয়ো। বুঝে নেবো যে সব ঠিক আছে।’ 

সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠে অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলল শ্যাডো, হিনজেলমান ইঞ্জিন চালু রেখে অপেক্ষা করলেন ততক্ষণ। অ্যাপার্টমেন্টের দরজাটা হাট হয়ে খুলে যেতেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সব ঠিক আছে বোঝাল শ্যাডো। তখন বৃদ্ধ লোকটা আর টেসি নামের ওয়েন্ডটি রওনা দিল বাড়ির দিকে। 

সামনের দরজাটা বন্ধ করে দিল শ্যাডো। শীতে যেন জমে আছে ঘরটা। ভেতর থেকে আসছে অগণিত মানুষের গন্ধ, যারা এখন আর বাস করে না অ্যাপার্টমেন্টে। থার্মোস্ট্যাটটা খুঁজে বের করে তাপমাত্রা সত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত তুলে দিল। ছোটো রান্নাঘরটায় গিয়ে দরজাগুলো খুলে দেখল, এরপর নজর দিল অ্যাভোকাডো রঙের ফ্রিজটায়। ওতে নেই কিছুই! তবে হ্যাঁ, ভেতরটা পরিষ্কার। 

ছোটো একটা শোবার ঘর আছে অ্যাপার্টমেন্টে, খালি একটা ম্যাট্রেস রয়েছে কেবল। রান্নাঘরের পাশে এত ছোটো একটা বাথরুম যে দেখে মনে হয় একটা স্টল! টয়লেটে পড়ে আছে এক টুকরা সিগারেট, বাদামি বানিয়ে দিয়েছে পানি। ফ্ল্যাশ করে সেটাকে বিদায় জানাল শ্যাডো। 

ক্লজিট খুঁজে চাদর আর কম্বল বের করল ও, বিছানা গুছিয়ে পা থেকে খুলে নিলো জুতো। কেবল জ্যাকেট আর ঘড়ি খুলে পোশাক পরেই ঘুমিয়ে পড়ল বিছানায়। গরম হতে কতক্ষণ লাগবে, ভাবল সে। 

বাতি নেভানোই আছে, আওয়াজ বলতে কেবল ফ্রিজের মৃদু গুঞ্জন। ওহ আর সেই সাথে দালানের ভেতর থেকে ভেসে আসছে একটা রেডিয়োর গান। অন্ধকারে শুয়ে রইল শ্যাডো, ভাবল ঘুমটা বোধ হয় গ্রেহাউন্ড বাসেই ঘুমিয়ে নিয়েছে। 

ওয়েনসডে কতদিন পর নিতে আসবেন তাকে? একদিন? নাকি এক সপ্তাহ। সময়টা যাই হোক না কেন, ব্যস্ত থাকার মতো কিছু একটা বেছে নিতে হবে। আবার ব্যায়াম শুরু করবে? হ্যাঁ, সেটাই ভালো। সাথে পয়সার খেলাগুলো অনুশীলন করলেও মন্দ হয় না। 

যাই হোক, শহরটা বেশ ভালো। আপাতত তেমনটাই মনে হচ্ছে ওর। স্বপ্নটা নিয়ে ভাবল শ্যাডো, এরপর কায়রোতে কাটানো প্রথম রাতটা নিয়ে। যরিয়ার কথাও মনে পড়ল তার…কী যেন নাম? পলু…? 

মেয়েটার কথা ভাবা মাত্র যেন ওর মনের ভেতর একটা জানালা খুলে গেল, ‘মাঝরাত্রীর’ বোনকে দেখতে পেল সে। কীভাবে…কে জানে? এরপরই দেখতে পেল লরাকে। 

ইগল’স পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, ওর মায়ের বাড়ির পেছনের উঠোনে।

ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আছে বেচারি, এখন অবশ্য নতুন করে শীত লাগছে না লরার। ঠান্ডা যে ওর চিরসঙ্গী। এই বাড়িটা তার বাবা, হার্ভি ম্যাককেব ১৯৮৯ সালে মারা যাবার পর, ইনস্যুরেন্সের টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল। জানালায় হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, দেখছে ওর মাকে…ওর বোনকে আর বোনের পরিবারকে।

চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করল শ্যাডোর, বিছানার উপর কাত হলো সে।

নিজেকে অনাহুত গুপ্তচর বলে মনে হচ্ছে, চিন্তার লাগাম টেনে ধরল তাই। মনোযোগ নিজের উপর ফিরিয়ে আনতেই দেখতে পেল জমাট বাঁধা হ্রদটাকে। ধীর হয়ে আসছে ওর নিশ্বাস। বাতাস বইবার শব্দ শুনতে পাচ্ছে, হাহাকার করছে যেন সে বাড়িটাকে ঘিরে। 

জায়গাটা মন্দ নয়-ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল শ্যাডো মুন। 

কোনো এক কথোপকথন 

ডিংডং… 

‘মিয কো?’ 

‘বলছি।’

‘মিজ সামান্থা ব্ল্যাক কো?’ 

‘হ্যাঁ।’

‘আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই, আশা করি কিছু মনে করবেন না ম্যাম।’

‘আপনারা কে? পুলিস?’ 

‘আমার নাম টাউন, আর ইনি মিস্টার রোড। আমাদের দুজন সহকর্মীর আকস্মিক অন্তর্ধানের তদন্ত করছি।’ 

‘নাম কী ছিল তাদের?’ 

‘দুঃখিত?’ 

‘আপনার দুই সহকর্মীর নাম জানতে চাইছি, তাহলে সাহায্য করলেও করতে পারি।’

‘…ঠিক আছে। ওদের নাম ছিল মিস্টার স্টোন আর মিস্টার উড। এবার আমরা কিছু প্রশ্ন করতে পারি?’ 

‘আপনারা কি চোখের সামনে যেটা দেখতে পান, সেটাকেই নাম হিসেবে ব্যবহার করেন? তোমার নাম মিস্টার ফুটপাত, তোমার মিস্টার কার্পেট। আর তুমি হলো মিস্টার বিমান—এরকম?’ 

মজার কথা বলেছেন, ম্যাম। আমাদের প্রথম প্রশ্ন: এই লোকটাকে আগে দেখেছেন? ছবিটা হাতে নিয়ে দেখুন, অসুবিধা নেই। 

হোয়া! সবই আছে দেখছি…পাশ থেকে তোলা ছবি, নিচে আবার নম্বরও আছে! কী করেছে লোকটা?’ 

‘চালক হিসেবে ব্যাংক ডাকাত দলে ছিল। বেশ কয়েক বছর আগের কথা সেটা। দলের দুজন ওকে লুটের ভাগ না দিয়ে নিজেরাই সব মেরে দিতে চেয়েছিল। রেগে-মেগে ওই লোক দুজনের বেহাল অবস্থা করে ছেড়েছে। আরেকটু হলে খালি হাতেই মেরে ফেলত। আহত দুজনের সাথে চুক্তি করে সরকার: ওরা এই লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। তিন বছর জেল খাটতে হয়েছে লোকটাকে। আমার মতে, এধরনের মানুষের আজীবন জেলে পচে মরাই ভালো।’

‘টিভি ছাড়া সত্যি সত্যি কাউকে এধরনের কথা বলতে শুনিনি আমি।’

‘কোন ধরনের কথা, মিষ ক্রো?’ 

‘লুট’। সাধারণ মানুষ এভাবে কথা বলে না। কেবল অভিনেতারা চলচ্চিত্রে বলে। 

‘এখানে চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন হচ্ছে না, মিয ক্রো।’

‘ব্ল্যাক ক্রো। মিয ব্ল্যাক কো নাম আমার। তবে বন্ধুরা স্যাম বলে ডাকে।’

‘বুঝতে পেরেছি, স্যাম। দেখো–’ 

‘আপনারা তো আমার বন্ধু না। আমাকে মিয ব্ল্যাক কো বলে ডাকবেন।’

‘বেয়াদব মেয়ে-’ 

‘চুপ করো তো, মিস্টার রোড। স্যাম-ক্ষমা চাইছি, ম্যাম-মিয ব্ল্যাক কো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক। নিশ্চয়ই আমাদেরকে সাহায্য করতে চাইবেন তিনি। 

‘দেখুন ম্যাম, আমরা জানি আপনি শ্যাডোকে চেনেন। ওকে সাহায্য ও করেছেন। একটা সাদা শেভি নোভায় আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখা গেছে। সে আপনাকে গাড়িতে করে এগিয়ে দিয়েছে, এমনকি রাতের খাবারও খাইয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ওর মুখে কি এমন কিছু শুনেছেন, 

যেটা থেকে আমরা কোনো সূত্র খুঁজে পেতে পারি? আসলেই আমাদের দুই সহকর্মী লাপাত্তা।’

‘আমি একে কখনও দেখিনি।’

‘দেখেছেন। আমাদেরকে বোকা ভাবার ভুল করবেন না দয়া করে, আমরা বোকা নই। 

‘উম, দেখে থাকতেও পারি। আসলে অনেকের সাথেই তো দেখা হয়। যাই হোক, ভুলে গেছি সব।’

‘ম্যাম, আমাদেরকে সহায়তা করাই আপনার জন্য ভালো হবে। 

‘নইলে কী? আপনাদের দুই বন্ধু মিস্টার হাতুড়ি আর মিস্টার পেন্টাথলের[১০] সাথে মোলাকাত হবে আমার?’ 

[১০. ট্রুথ সিরামের দিকে ইঙ্গিত।]

‘ম্যাম, আপনি কিন্তু নিজের জন্যই ব্যাপারটা আরও কঠিন করে তুলছেন। ‘ইস-সি-রে। ভয় পাচ্ছি। আর কিছু জানতে চাইবেন? উত্তরটা না হলে আপনাদেরকে ‘বাই-বাই’ জানিয়ে আমি দরজা বন্ধ করে দিতে চাই। এরপর সম্ভবত আপনারা মিস্টার গাড়ির ঘাড়ে করে চলে যাবেন। তাই না? 

‘আপনার অসহযোগী মনোভাবের কথা আমাদের রিপোর্টে উল্লেখ করা থাকবে।’ 

‘বাই-বাই।’

ক্লিক।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন