৬৯. রোমের বজ্রআঁটুনি

ইশতিয়াক খান

অধ্যায় ৬৯ – রোমের বজ্রআঁটুনি

খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭ থেকে ৪৯০ সালের মাঝে কার্থেজ, সিরাকিউসের বিরুদ্ধে লড়তে লাগল এবং রোম তার চারপাশে যে যে আছে, সবার সঙ্গে লড়তে লাগল।

গ্রিকরা একতা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। পেলোপোনেশীয় লিগ, হেলেনিক লিগ, দেলিয়ান লিগের পর এল করিন্থিয়ান লিগ। অপরদিকে, লাশিয়ামের পুরনো শহরগুলো লাতিন লিগ নামে এক জোট সৃষ্টি করল। রোমানরা এই লিগকে নোমেন লাশিয়াম বলে অভিহিত করল এবং প্রায় ১০০ বছর তাদের মাঝে শান্তি বজায় ছিল। সম্ভবত ৪৯০ সাল থেকে এই জোটের জন্ম। তবে রোম কখনো এই জোটে যোগ দেয়নি।

গল-আগ্রাসনের ৩০ বছর চলে গেছে। রোমানরা তাদের শহর পুনর্নির্মাণের কাজে বেশ এগিয়ে গেছে ততদিনে। তারা প্রাচীর তুলেছে, প্রতিবেশীদের হামলা ঠেকিয়েছে এবং আবারও গলদের বিরুদ্ধে লড়তে আনিও নদীতে সেনা পাঠিয়েছে। লাইভি জানান, ‘ভয়ে ভয়ে রোমানরা এই যুদ্ধে যোগ দিলেও এতে হাজারো “বর্বরের” মৃত্যু হয়।’ ইতোমধ্যে আবার প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবিয়ান দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হয় রোম।

৩৬৭ সালে এই সংঘাতের নিরসন হয়। সিদ্ধান্ত হয়, অবশেষে কনসালদের মাঝে স্থান পাবে প্লেবিয়ানরা। সে-বছরই প্রথম প্লেবিয়ান-কনসাল নিয়োগ পান।

এই উদ্যোগে দুই শ্রেণির বিবাদ প্রায় এক দশকের জন্য স্তিমিত রইল। সেই শান্তির সময় কাজে লাগিয়ে রোম সাম্রাজ্যবিস্তারে মনোযোগ দিল।

পরবর্তী ৫০ বছরে রোম চারটি যুদ্ধ ও বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে যায় এবং তাদের খুব কাছেই পঞ্চম একটি যুদ্ধ চলছিল।

লিরি নদীর অপরপারে ‘স্যামনাইটস’ গোত্রের বসবাস ছিল। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও যুদ্ধাস্ত্রের অভাব ছিল না।

৩৪৩ সালে পূর্বের এক চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে স্যামনাইটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রোম। এক্ষেত্রে আধুনিক যুগের ‘মার্কিন’ যুক্তি দেয় রোমানরা। কামপানিয়া নামে এক অঞ্চলে অনর্থক হামলা চালিয়েছে স্যামনাইটরা, তাই তাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিতে রোম তাদের ওপর হামলা চালায়।

এই প্রথম ‘স্যামনাইট যুদ্ধ’ ছিল রোমের সাম্রাজ্যবিস্তারের অভিযানের পরবর্তী ধাপ। ৩৪১ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধে কোনো ফল এল না। দুই পক্ষ সন্ধি করতে বাধ্য হল।

৬৯.১ রোমের শত্রু-মিত্র

দ্বিতয় যুদ্ধের নাম ছিল ‘লাতিন যুদ্ধ’। প্রথম যুদ্ধের রেশ মিলতে-না-মিলতেই এটা শুরু হয়ে যায়।

লাতিন লিগের শহরগুলো বুঝতে পেরেছিল, রোমের আগ্রাসন ঠেকানোর উপায় নেই।

জটিল ও কুটিল রাজনৈতিক কারণে লাতিন শহরগুলো রোমের বিরুদ্ধে হামলা করে বসল। স্যামনাইটরা রোমের পক্ষে যোগ দিল।

এই যুদ্ধ রোমের জন্য অনেক ঝামেলাপ্রদ ছিল, কারণ প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অস্ত্র—কোনোদিক দিয়েই তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। কনসালরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। যারা সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন, তার আশঙ্কা করলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে কে শত্রু, কে মিত্র, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হবে রোমানরা। তাই তাদের ওপর অদ্ভুত এক নির্দেশ এল : নিজ নিজ অবস্থান ছেড়ে শত্রুর ওপর হামলা চালানো যাবে না!

লাতিনদের সঙ্গে রোমান-স্যামনাইটরা কাপুয়া নামে এক জায়গায় এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হল। উভয় পক্ষেই হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। দুই পক্ষে অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর আবারও সংঘটিত হয়ে তারা লড়াইয়ে লিপ্ত হল। কিন্তু এবার রোমানরা বিজয়ী হলেন।

লাতিনদের আত্মসমর্পণের পর অধিকৃত অঞ্চলের বাসিন্দাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী রোম সাম্রাজ্যে স্থান হল। কেউ ভোটাধিকার পেলেন, কেউ ব্যবসা- বাণিজ্যের অধিকার হারালেন, কেউ এমনকি অপর গোত্রের সদস্যদের বিয়ে করার অধিকারও হারালেন। নতুন জনগোষ্ঠী ১২ টেবিলের আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকল, কিন্তু রোমের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তাদের কিছু বলার থাকল না।

খুব দ্রুত রোম সাম্রাজ্য বিস্তার করতে লাগল। কখনো নির্মাণ, কখনো দখল—দুই ভাবেই আগাতে লাগল তাদের এই কার্যক্রম।

৩২৬ সালে স্যামনাইটরা আবারও অস্ত্র ধারণ করে, যার মাধ্যমে এই শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির অবসান ঘটে। রোমানরা আবারও লিরি নদী পেরিয়ে স্যামনাইটদের ভূখণ্ডে উপনিবেশ নির্মাণ করে। ‘দ্বিতীয় স্যামনাইট যুদ্ধ’ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকে।

অপরদিকে, উচ্চাভিলাষী সিসিলিয়ান আগাথোক্লেস উদ্যত হল সাম্রাজ্য বিস্তারে। ৩১৭ সালে তিনি সিরাকিউস দখল করেন এবং একনায়কত্ব কায়েম করেন।

তিনি কার্খাজিনিয়ানদের বাস্তুচ্যুত করেন। তবে কার্থেজও বসে থাকেনি। ৩১০ সাল নাগাদ কার্থেজের নৌবাহিনী সিরাকিউসকে ঘিরে ফেলে। প্রতিক্রিয়ায় আগাথোক্লেস সিরাকিউস থেকে কার্থেজের মূল ভূখণ্ডে বাহিনী পাঠান।

এই অপ্রত্যাশিত হামলায় খেই হারিয়ে ফেলেন কার্খাজিনিয়ানরা। তাদের উপাসকরা তড়িঘড়ি করে দেবতার উদ্দেশে ৫০০ শিশু উৎসর্গ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন।

তবে এই ভয়াবহ তথাকথিত ধর্মীয় আচারেও যুদ্ধে জয় আসেনি। তবে কার্থেজের পতন হয়নি। সিরাকিউসেরও তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। পরিশেষে ৩০৬ সালে দুই পক্ষ সন্ধিচুক্তি সাক্ষর করে।

আগাথোক্লেস সিরাকিউসের সিংহাসন বজায় রাখেন আর কার্থেজ দ্বীপের পশ্চিম অংশের দখল অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়।

৩০৪ সালে, অবশেষে রোমানদের সঙ্গে স্যামনাইটদের একধরনের শান্তি প্রতিষ্ঠা হল।

ছয় বছর পর, ২৯৮ সালে আবারও শান্তি বিঘ্নিত হয়। রোম-জুড়ে একধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। রোমের শত্রুরা—এতরুসকান ও স্যামনাইটরা তাদের সব মিত্রদের একত্রিত করে বড় আকারে সেনাবাহিনী সাজাচ্ছে। উদ্দেশ্য, রোমের বিরুদ্ধে অভিযান। এই রোম-বিরোধী জোটে শুধু স্যামনাইট আর এতরুসকানই ছিল না, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল উত্তর থেকে আসা একদল গল এবং আমব্রিয়ান নামে অপর এক গোত্র।

‘তৃতীয় স্যামনাইট যুদ্ধ’ তিন বছর ধরে চলে। এই যুদ্ধের যবনিকাপাত হয় সেনটিনাম নামের এক যুদ্ধক্ষেত্রে। এটা ছিল আমব্রিয়ার আপেনিনেসের ঠিক ওপারে। এটাই সম্ভবত রোমান সেনাদের সবচেয়ে বেশি দুরত্ব অতিক্রম করে করা যুদ্ধ।

যুদ্ধের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করা হল। পরিকল্পনামতে স্যামনাইট ও গলরা রোমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে আর এই যুদ্ধ চলাকালীন এতরুসকান ও আমব্রিয়ানরা গোপনে রোম-শিবিরে হামলা চালাবেন। কিন্তু তিন দলত্যাগীর কারণে এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তারা রাতের গভীরে গোপনে রোমের সেনাদলের কনসাল ফাবিয়াসের কাছে এসে শত্রুপক্ষের এই পরিকল্পনা ফাঁস করে দেন।

এই চতুর্মুখী জোটের সামনে রোমানরা খুবই অসহায় অবস্থায় ছিল। কিন্তু এই গোপন খবর পেয়ে তারা চাঙা হয়ে উঠল। বাহিনীর এক অংশকে এতরুসকান আর উমব্রিয়ানদের ভূখণ্ডে পাঠানো হল। এই খবর পেয়ে নিজ নিজ ‘দেশের বাড়ি’ রক্ষা করতে জোট থেকে সেনা সরিয়ে নিল এই দুই জাতি। যুদ্ধ যখন শুরু হল, রোমানদের সামনে বাধা ছিল শুধু স্যামনাইট ও গলরা। গলরা যখন রথে করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন স্বভাবতই রোমানরা অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তারা এর আগে এরকম ঘটনা দেখেনি। এক কনসাল দ্রুত মারা পড়লেন। কিন্তু গলরাও কচুকাটা হতে লাগলেন। জমতে লাগল লাশের পাহাড়। একপর্যায়ে স্যামনাইট ও গলদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে পড়ল। জয়ী হল রোমানরা।

সেনটিনামে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হলেও শান্তি তখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি। আরও পাঁচ বছর ধরে চলতে লাগল হামলা, যুদ্ধ, বিদ্রোহ। ২৯০ সালে অপর এক চুক্তির আওতায় এই তৃতীয় স্যামনাইট যুদ্ধের অবসান ঘটল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রোমান সেনারা উত্তরে ও ইতালীয় উপদ্বীপের মধ্যাঞ্চলে প্রতি বছরই অভিযান চালাতে লাগল। রোমান বজ্রমুষ্টি তখন বেশ শক্তিশালী হয়ে দাড়িয়েছে।

সকল অধ্যায়

১. ৩০. চীনের শ্যাং রাজবংশের রাজধানীগুলো
২. ৩১. গ্রিসের মাইসেনীয় জাতি
৩. ৩২. দেবতাদের সংঘর্ষ
৪. ৩৩. যুদ্ধ ও বৈবাহিক সম্পর্ক
৫. ৩৪. অতি প্রাচীনকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ
৬. ৩৫. ট্রয়ের যুদ্ধ
৭. ৩৬. চীনের প্রথম ঐতিহাসিক রাজা
৮. ৩৭. ঋগ্বেদ
৯. ৩৮. যখন আবারো ইতিহাসের চাকা ঘুরল
১০. ৩৯. নতুন রাজত্বের অবসান
১১. ৪০. গ্রিসের অন্ধকার যুগ
১২. ৪১. মেসোপটেমিয়ার অন্ধকার যুগ
১৩. ৪২. শ্যাংদের পতন
১৪. ৪৩. স্বর্গ থেকে আসা আদেশ
১৫. ৪৪. ভারতের যুদ্ধ
১৬. ৪৫. ডেভিডের পুত্র
১৭. ৪৬. আবারও পশ্চিম থেকে পূর্বে গেল ঝৌরা
১৮. ৪৭. অ্যাসিরীয়ার রেনেসাঁ
১৯. ৪৮. নতুন জনগোষ্ঠী
২০. ৪৯. বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও উপনিবেশ
২১. ৫০. পুরনো শত্রুরা
২২. ৫১. অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনের রাজারা
২৩. ৫২. চমকপ্রদ পরাজয়
২৪. ৫৩. চীনের ক্ষয়িষ্ণু রাজা
২৫. ৫৪. মিশরের অ্যাসিরীয়রা
২৬. ৫৫. মেদেস ও পারস্যবাসীরা
২৭. ৫৬. বিজয় ও স্বৈরাচার
২৮. ৫৭. একটি রাজত্বের শুরু ও শেষ
২৯. ৫৮. একটি সংক্ষিপ্ত সাম্রাজ্য
৩০. ৫৯. সাইরাস দ্য গ্রেট
৩১. ৬০. রোম প্রজাতন্ত্র
৩২. ৬১. রাজত্ব ও সংস্কারকামীরা
৩৩. ৬২. দায়িত্ববোধ, ক্ষমতা ও ‘আর্ট অব ওয়ার’
৩৪. ৬৩ – পারস্য সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তার
৩৫. ৬৪. দ্য পার্শিয়ান ওয়ারস : পারস্যের যুদ্ধ
৩৬. ৬৫. পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ
৩৭. ৬৬. রোমে প্রথম লুটপাট
৩৮. ৬৭. চি’ইনের জাগরণ
৩৯. ৬৮. মেসিডোনিয়ার বিজেতারা
৪০. ৬৯. রোমের বজ্রআঁটুনি
৪১. ৭০. আলেকজান্ডার ও উত্তরাধিকারীদের যুদ্ধ
৪২. ৭১. মৌর্য সভ্যতার পরিণতি
৪৩. ৭২. প্রথম সম্রাট, দ্বিতীয় রাজবংশ
৪৪. ৭৩. পুত্রদের যুদ্ধ
৪৫. ৭৪. রোমান স্বাধীনতাকামী ও সেলেউসিদ দখলদার
৪৬. ৭৫. পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে
৪৭. ৭৬. প্রচলিত ব্যবস্থার বিনির্মাণ
৪৮. ৭৭. উন্নয়নের সমস্যাগুলো
৪৯. ৭৮. নতুন মানুষ
৫০. ৭৯. সাম্রাজ্য
৫১. ৮০. অমাবস্যা ও পুনর্জাগরণ
৫২. ৮১. উত্তরাধিকারের সমস্যা
৫৩. ৮২. রোমান সাম্রাজ্যের কিনারায়
৫৪. ৮৩. সিংহাসনে শিশুরা
৫৫. ৮৪. উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ক্ষমতার ভ্রান্তি
৫৬. ৮৫. সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন