৪৫. ডেভিডের পুত্র

ইশতিয়াক খান

অধ্যায় ৪৫ – ডেভিডের পুত্র

খ্রিস্টপূর্ব ১০৫০ থেকে ৯৩১ সালের মধ্যে হিব্রু রাজত্বের উদ্ভব হয় এবং মিশর তার শক্তিমত্তা ফিরে পায়।

মিশরের বিরুদ্ধে যেসব ‘সমুদ্র থেকে আসা’ গোত্র মুহুর্মুহু আক্রমণ চালাচ্ছিল, সেসব যাযাবর গোত্রদের মধ্যে একটি ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি জায়গায় থিতু হয়েছিল। জায়গাটি ছিল পশ্চিমের সেমাইটদের ভূমির খুব কাছাকাছি। তাদের ছোট ছোট বসতিগুলো ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তরিত হয়। এরপর শহরগুলোর মাঝে তৈরি হয় একধরনের ঢিলেঢালা মৈত্রী। এই মৈত্রীর সবচেয়ে শক্তিশালী শহরগুলো ছিল : গাজা, আশকেলন, আশদদ, গাথ ও একরন। সামগ্রিকভাবে এদেরকে ‘পেন্টাপোলিস’ বলা হোত। মিশরীয়রা তাদেরকে পেলেসেত ডাকতেন, আর তাদের প্রতিবেশীরা ডাকতেন ‘ফিলিস্তিনি’ বলে।

প্রাচীন ফিলিস্তিনিরা লিখতে জানত না, যার অর্থ হচ্ছে তাদের ইতিহাস আমরা শত্রুদের লেখনী থেকে জানতে পেরেছি। এ কারণেই খুব সম্ভবত তাদের অভদ্র আচরণ ও অসভ্য কার্যকলাপ নিয়ে এত কথা বলা হয়েছে। তবে তাদের রেখে যাওয়া প্রাচীন নিদর্শন থেকে একটা বিষয় মোটামুটি নিশ্চিত, এবং তা হল, তাদের ঐতিহ্য বা কৃষ্টি বস্তুত অন্যদের থেকে ধার করে আনা। ফিলিস্তিনিদের মাটির কাজ মাইসেনীয়দের স্টাইলে করা। তাদের মূল ভাষায় ক্যানানাইটদের উচ্চারণভঙ্গির আধিপত্য। এমনকি, মিশরে চালানো ব্যর্থ হামলাতেও অন্যদের প্রভাব বোঝা যায়। তারাও তাদের মৃতদের মিশরীয় প্রক্রিয়ায় কফিনে মুড়িয়ে রেখেছিলেন। এমনকি, এই মিশরীয় প্রকৃতির কফিনগুলোতে হিয়েরোগ্লিফিক্স খোদাই-করা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এমন কেউ এগুলো খোদাই করেছিলেন, যিনি অসংখ্যবার এই লেখনী দেখেছেন, কিন্তু বর্ণগুলোর অর্থ বোঝেননি। এ কারণে ফিলিস্তিনিদের হিয়েরোগ্লিফিক্স লেখনীর কোনো মাথামুণ্ডু নেই।

প্রত্যেকে নিজ শক্তিতে বলীয়ান হলেও পেন্টাপোলিসের ৫ শহরের পশ্চিমের সেমাইটদের ভূখণ্ডে কোনো ধরনের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল না।

এসব অঞ্চলে বসবাস শুরুর পর থেকেই তাদের সঙ্গে ভূখণ্ডের দখল নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন আব্রাহামের বংশধররা।

মিশর ছেড়ে যাওয়ার পর হিব্রুরা কয়েক দশকের জন্য আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে গেছিল। তাদের নিজেদের বর্ণনায়, তারা প্রায় ৪০ বছর ধরে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই সময়টায় নতুন এক প্রজন্মের আবির্ভাব হয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় অদৃশ্য হলেও, ধর্মীয় দিক দিয়ে এই বছরগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। বুক অব এক্সোডাস মতে, ঈশ্বর সিনাই পর্বতের সকল হিব্রুদের জড়ো করে তাদেরকে ১০টি ঐশ্বরিক আজ্ঞা দেন। এই আজ্ঞাগুলো দেওয়া হয়েছিল ২টি পাথরের ট্যাবলেটের মাধ্যমে। এখানে ঈশ্বর নিজেকে হিব্রুদের থেকে এগিয়ে রাখেন।

এ ঘটনাকে হিব্রুদের জাতীয় পরিচয়ের আঁতুড়ঘর হিসেবে অভিহিত করা যায় এবং এখান থেকেই তাদের রাজনৈতিক পুনর্গঠন শুরু হয়। হিব্রুরা অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের পূর্বসূরি হিসেবে আব্রাহাম ও তার ১২জন নাতিদের চিহ্নিত করে এসেছে। এরপর, ঐশ্বরিক নির্দেশ অনুযায়ী, তাদের নেতা মোজেস একটি জনশুমারি পরিচালনা করলেন এবং সব গোত্র ও পরিবারের তালিকা তৈরি করলেন। তাদেরকে ১২টি গোত্রে বিভক্ত করা হল। প্রতি গোত্রের আদি-পিতা হিসেবে আব্রাহামের একজন আত্মীয়কে নির্বাচন করা হল। জুদাহ গোত্র ছিল সবচেয়ে বড়। তাদের ছিল প্রায় ৭৫ হাজার যুদ্ধ-করতে-সক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য। সবচেয়ে ক্ষুদ্র গোত্র মানাশেহ’র ছিল প্রায় অর্ধেক সদস্য।

এই ১২টি গোত্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল পরবর্তী উদ্যোগের প্রস্তুতি। একসঙ্গে ৩টি ঘটনা ঘটেছিল। হিব্রুরা পশ্চিমের সেমিটিক ভূখণ্ডের একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে এসে পৌঁছেছিল, মোজেসের প্রয়াণ ঘটেছে এবং তার সহকারী ও সাহায্যকারী জশুয়া তাদের নতুন অধিনায়ক হয়েছেন। জয়ার নেতৃত্বে হিব্রু গোত্রগুলো ‘লেবানন থেকে ইউফ্রেতিস পর্যন্ত সমগ্র হিট্টিট ভূখণ্ডের’ ওপর কর্তৃত্ব দাবি করেছিল, যেটি পশ্চিমের মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

৪৫.১ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা

জশুয়া তার অনুসারীদের নিয়ে পদযাত্রা করে মৃত সাগরের পূর্বদিকে গেলেন। জর্ডান নদী পেরিয়ে সাগরের উত্তরাঞ্চলের সর্বোচ্চ ভূমিতে তারা এসে পৌঁছালেন। এটাই ছিল তৎকালীন পশ্চিমা সেমাইট রাজত্বের আনুষ্ঠানিক সীমানা। তারপর তিনি আদেশ দিলেন, সকল হিব্রু পুরুষের খতনা করাতে হবে। মরুভূমিতে প্রায় ৪ দশক ঘুরাঘুরি করার সময় এই ধর্মীয় আচার পালনে খুব বেশি জোর দেওয়া হয়নি বিধায় এহেন আদেশ। তবে দীর্ঘ সময়ের পদযাত্রা শুরুর ঠিক আগে এ- ধরনের উদ্যোগ ঠিক কতটুকু যৌক্তিক, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে জশুয়া কাজ ছিল তার অনুসারীদের বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানো। ‘কানান’-এর অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল আব্রাহামের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। ৬০০ বছর আগে প্রথম ইহুদি ধর্মাবলম্বী হিসেবে তিনি তার পুত্রসন্তানদের খতনা করিয়েছিলেন।

তাদের মূল সামরিক লক্ষ্যবস্তু ছিল জেরিকো—জর্ডান নদীর পশ্চিমে অবস্থিত একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ, যার চারপাশ ঘিরে ছিল প্রতিরক্ষা মিনার ও দৃঢ় প্রাচীর। বাইবেলের ‘বুক অব জশুয়া’র বর্ণনামতে, টানা ৬ দিন ১ বার করে জেরিকোর প্রাচীরের চারপাশে হিব্রুরা পদযাত্রা করার পর যুদ্ধের অবসান ঘটে। সপ্তম দিনে তারা এ শহরের চারদিকে ৭ বার আবর্তন করে এবং ট্রাম্পেট বাজাতে শুরু করে। এতে প্রাচীরগুলো ধসে পড়ে। হিব্রুরা ভেঙে পড়া প্রাচীর ভেদ করে ভেতরে চলে যায়, আর সকল প্রাণীকে হত্যা করে, যার মধ্যে নারী, পুরুষ, শিশু, গরু, ভেড়া ও গাধা, সকলেই অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পুরো শহর ধ্বংস ও লুট করার পর জেরিকোর প্রতি অভিশাপ ছুড়ে দেন। ২০০ বছর পরেও সে অভিশাপের জের ধরে শহরটি পরিত্যক্ত থেকে যায়। এর আগে, প্রায় ৬ হাজার বছর ধরে জেরিকোর বাসিন্দারা শহরের উঁচু মিনারগুলো থেকে তাকিয়ে এমন এক অপ্রতিরোধ্য শত্রুর অপেক্ষায় ছিলেন, যারা এর প্রাচীরগুলোকে ভেদ করার দুঃসাহস দেখাবে।

অবশেষে যখন শত্রু এল, প্রাচীরগুলো কোনো প্রতিরোধ না-গড়েই ভেঙে পড়ল! প্রায় সারাজীবন পদযাত্রা করে বৃদ্ধবয়সে জশুয়ার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। ততদিনে হিব্রুদের বসবাস দক্ষিণের বীরশেবা থেকে উত্তরের কিন্নেরেখ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। এমনকি, পশ্চিমের রামোথ-গিলিয়াদ পর্যন্তও তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যেত। দখল-করা ভূখণ্ড বিভিন্ন গোত্রের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। জওয়ার প্রয়াণের পর শাসক হিসেবে কোনো রাজাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি, বরং বেশ কয়েকজন প্রধান বিচারপতি এ দায়িত্ব পান। তারা একইসঙ্গে বিচারক ও ধর্মীয় নেতার ভূমিকা পালন করতেন। তারা হিব্রু গোত্রদের, যারা আধুনিক কালের ‘ইসরায়েলের’ বাসিন্দা, তাদেরকে জানাতেন ঈশ্বর ঠিক কী চাইছেন।

তবে তখনো কানানের বেশ বড় একটি অংশ দখল করা হয়নি। ফিলিস্তিনিরা তখন একরন থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমিতে বসবাস করছিলেন। তারা নবাগতদের জন্য এক ইঞ্চি জমিও ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। যে সময়টা ইসরায়েল বিচারকদের দ্বারা শাসিত হচ্ছিল, সেসময় তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধে অংশ নেয়।

জশুয়ার নেতৃত্বে হিব্রুদের পশ্চিমের সেমিটিক ভূখণ্ডে ‘অভিযানের’ সঠিক সময়সীমা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এমনকি, যে বছরগুলোতে বিচারকদের নেতৃত্বে হিব্রুরা পেন্টাপোলিসের সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়েছে, সেগুলোকেও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায় না।

এই বিচারকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন অতিমানবীয় শক্তিধর স্যামসন। তিনি খুব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১০৫০ সালে এই পুরো অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করছিলেন। সেসময় মিশরে চলছিল তৃতীয় মধ্যম পর্যায়, মেসোপটেমিয়া আরামিয়ানদের আধিপত্য ও আরও পূর্বে ঝৌদের রাজত্ব।

স্যামসন তার আমলে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড দখল করতে পারেননি। এমনকি, তারা ইসরায়েলের কিছু ভূখণ্ড দখল করে নেয়। দক্ষিণে এই দুই গোত্রের লোকজন মেলামেশা শুরু করে। এমনকি, স্যামসন এক ফিলিস্তিনি নারীকে বিয়েও করেন। এতে তার পিতা-মাতা যারপরনাই বিস্মিত হন। তারা বলেন, “কেন! আমাদের নিজেদের মানুষের মাঝে কোনো উপযুক্ত নারী নেই? কেন তোমার ‘খতনা’ হয়নি এমন জাতির মধ্য থেকে স্ত্রী খুঁজে পেতে হল?”

এই ফিলিস্তিনি নারীকে বিয়ে করার বিষয়টি স্যামসনের জন্য বড় ভুল হিসেবে দেখা দিল। শ্বশুরের ওপর রাগ করে স্যামসন ফিলিস্তিনিদের বড় একটি আঙুরক্ষেত ও ফসলি জমিতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। তার দেশের মানুষ ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে আসা ‘পরিণামের’ ভয়ে চরম ভীত হল। তারা স্যামসনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি জানেন না ফিলিস্তিনিরা আমাদেরকে শাসন করে? আপনি কী করছেন বলে আপনার ধারণা?’।

এই বর্ণনা থেকে মনে হতে পারে এই দুই জাতির খুবই অস্বস্তিকর সম্পর্কে ফিলিস্তিনিরা শক্তিমত্তার দিক দিয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে ছিল। তবে তারা কখনোই প্রকৃত অর্থে ইসরায়েলি ভূখণ্ড শাসন করেনি। স্যামসন নিজে ইসরায়েলের ‘বিচারক’ ছিলেন। এসময় বিভিন্ন সময় রাগে অন্ধ হয়ে তিনি শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছেন। তবে কখনোই প্রতি-আক্রমণ করার মতো শক্তিশালী ছিল না ফিলিস্তিনিরা। যুদ্ধের পরিবর্তে তারা তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য এক পতিতাকে নিয়োগ দিলেন। ডেলাইলা নামের এই মহিলা সোরেক উপত্যকায় থাকতেন। এ অঞ্চলটি ছিল ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সীমান্ত এলাকায়। ডেলাইলার চাতুর্যে স্যামসনকে তার শত্রুরা আটক করতে সমর্থ হলেন। এরপর তারা তার দুই চোখ নষ্ট করে অন্ধ করে দিলেন। তাকে পেন্টাপোলিসের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী শহর গাজায় নিয়ে যাওয়া হল। মূল দেবতা দাগনের (মৎস্য দেবতা—যার মাধ্যমে এই জাতির সমুদ্র থেকে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হয়) উদ্দেশে নিবেদিত এক উৎসবে ফিলিস্তিনিরা অন্ধ স্যামসনকে সবার সামনে উপস্থাপন করলেন। কিন্তু, স্যামসন তার প্রবল শক্তিমত্তা ব্যবহার করে দাগনের মন্দিরকে তার মাথার ওপর তুলে ৩ হাজার শত্রুসেনার ওপর নিক্ষেপ করতে সক্ষম হলেন। দ্য বুক অব জাজেস আমাদেরকে জানায়, ‘অর্থাৎ, জীবিত অবস্থায় যত জনকে হত্যা করেছেন, মরার সময় তার চেয়েও অনেক বেশি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যান স্যামসন।’

ফিলিস্তিনিদের ওপর এ-ধরনের কষ্টার্জিত জয় একটি বিষয়ই প্রমাণ করে, যা হল, দুই দেশের যুদ্ধে প্রকৃত অর্থে কেউই বিজয়ী হতে পারেনি।

ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি গ্রামে লুটতরাজ চালাত, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি জমি পুড়িয়ে দিত—উভয় পক্ষই প্রতিপক্ষের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শিকারি দলগুলোকে ধরে হত্যা করত। কিন্তু কারো জয়ই নিরঙ্কুশ ছিল না। রাজনৈতিক দিক দিয়ে, উভয় জাতি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা নেতৃত্বের সংকটে ভুগছিল। কোনো ফিলিস্তিনি সামন্তপ্রভু পেন্টাপোলিসের ৫ শহরের সেনাদলকে একত্রিত করতে পারেনি এবং ইসরায়েলের বিচারকদের ধর্মীয় ক্ষমতা ছিল আরও অনেক বেশি দুর্বল। বুক অব জাজেস-এর পাতায় পাতায় একটি কথা বারবার লেখা হয়েছে, যা হল, ‘সে আমলে ইসরায়েলের কোনো রাজা ছিল না। এবং ইসরায়েলে সবাই যে- যার মতো যা ভালো বুঝতেন, তা-ই করতেন।’

অবশেষে, অতিষ্ঠ হয়ে ইসরায়েলিরা একজন রাজার দাবি জানালেন, যাতে তারা ‘অন্যান্য দেশের’ মতো হতে পারে। তাদের মনে সম্ভবত মিশরের বিষয়টি কাজ করছিল। রাজ-অধ্যুষিত এই দেশের রাজা ফিলিস্তিনিদের পিটিয়ে বিদেয় করতে পেরেছিলেন। তারা বেঞ্জামিন বংশের একজন অতিশয় লম্বা ব্যক্তি সাউলকে তাদের রাজা ও সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে চাইলেন যাতে তিনি তাদের সামরিক বিজয় এনে দিতে পারেন।

স্যামুয়েল নামের একজন অতিশয় বৃদ্ধ ও অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন ‘শেষ বিচারক’। তিনিই ইসরায়েলের প্রথম রাজা হিসেবে সাউলের অভিষেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তবে তিনি ইসরায়েলিদের সতর্ক করেন, ‘তিনি আপনাদের সন্তানদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করবেন। তিনি তাদেরকে তার নিজের ক্ষেত চাষ করতে নিয়ে যাবেন এবং তার সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র বানানোর কাজে নিয়োগ দেবেন। তিনি আপনাদের কন্যাসন্তানদের দিয়ে কাজ করানোর জন্য রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবেন। তিনি আপনাদের আবাদের সেরা অংশ, আঙুরবাগানের সেরা ফল, আপনার সকল শস্য, ভেড়ার পাল, গরু ও চাকরদের এক-দশমাংশ নিজের ব্যবহারের জন্য নিয়ে যাবেন। আপনারা আপনাদের নির্বাচন করা রাজার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করবেন।’

তবে তার সতর্কবাণী উপেক্ষা করেই সাউলকে রাজা ও সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে হামলার আয়োজন শুরু করেন।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইসরায়েলের ওপর ফিলিস্তিনিদের আধিপত্য তখন এমন একপর্যায়ে গেছে যে, বলতে গেলে অস্ত্রের ব্যবহারই নিষেধ হয়ে গেছে। বুক অব জাজেস মতে, যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের জন্য ‘ইসরায়েলের কোথাও কোনো কামার খুঁজে পাওয়া যায়নি’।

স্যামুয়েল আমাদেরকে জানান, ‘কারণ ফিলিস্তিনিরা জানতেন যে এরকম না করলে ইসরায়েলিরা তলোয়ার ও বর্শা তৈরি করবে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা লোহা নিয়ে কাজ করার অধিকারকে শুধু তাদের নিজেদের মাঝে সীমাবদ্ধ করে রাখে। সুতরাং, কোনো ইসরায়েলি ব্যক্তির যদি লাঙল বা ধারালো কুঠারের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে তাদেরকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে এসে একজন ফিলিস্তিনি কামারকে অর্থ দিয়ে এ কাজ করিয়ে নিতে হত।’

ফলে সাউল তার নতুন রাজত্বের আওতায় অসংখ্য যোদ্ধা একত্রিত করতে পারলেও শুধুমাত্র তিনি আর তার ছেলে জোনাথানের কাছে তলোয়ার ছিল। বাকিদের কাছে ছিল শুধু জমি চাষ করার নিড়ানি ও পিচফর্ক। অপরদিকে, ফিলিস্তিনিরা ৩ হাজার রথ, ৬ হাজার রথচালক (একজন চালাবেন, আরেকজন যুদ্ধ করবেন। দ্বিতীয় জনকে ঘোড়ার রাশ টানতে হবে না) এবং এত বেশি পদাতিক সেনা যে, তাদের গুনে শেষ করা যায় না। বর্ণনা মতে, ‘সমুদ্রতটে বালুকণার সমান’ সেনা। ইসরায়েলি বাহিনী এই সুবিশাল প্রতিপক্ষের কাছে পুরোপুরি পরাস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। অনেকেই পালিয়ে গেলেন। অবশিষ্ট ৬০০ সেনা নিয়ে সাউল জেরিকোর উত্তরে গিলগালে অবস্থান নিলেন। তার রাজত্বের বাকি সময়টা ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে পার করে।

ইলাহ উপত্যকায় এ-ধরনের একটি অমীমাংসিত যুদ্ধ চলছিল। জুদাহ অঞ্চলের পশ্চিমপ্রান্তের এই যুদ্ধ এত বেশিদিন ধরে চলছিল যে ফিলিস্তিনিরা এই সংঘর্ষ মেটাতে এক ভিন্ন ধরনের যুদ্ধের প্রস্তাব দিল

দুই দেশের দুই চ্যাম্পিয়ন যুদ্ধ করবেন, আর বিজয়ী সেনা পরাজিত বাহিনীর দেশের দখল পাবেন।

ফিলিস্তিনিরা আশা করলেন, ইসরায়েলের নতুন নেতা সাউল এই চ্যালেঞ্জের উত্তর দেবেন। ফিলিস্তিনিদের চ্যাম্পিয়ন ছিল ৩ মিটার উঁচু এক দানব। কিছু বর্ণনায় ৯ ফুট নয়, তাকে ৭ ফুট লম্বা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সাউল নিজেও অনেক লম্বা ছিলেন। আপাদমস্তক বর্মে সজ্জিত ‘গোলিয়াথ’কে নির্বাচন করে ফিলিস্তিনিরা তাদের আধিপত্যের প্রমাণ দেয়। যুবা বয়স থেকেই বিভিন্ন দ্বৈরথে লড়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন গোলিয়াথ।

তবে সাউলের এ দ্বৈরথে অংশ নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। তার পরিবর্তে ডেভিড নামের অপর এক যুবক চ্যালেঞ্জের উত্তর দেয়। জুদাহ থেকে এসে সাউলের বাহিনীতে যোগ দেওয়া ৩ যোদ্ধা ভাইয়ের সবচেয়ে কনিষ্ঠ ভাইয়ের নামই ছিল ডেভিড। ডেভিড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে ঈশ্বর তার সঙ্গে আছেন। তিনি একটি গুলতি হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন এবং তীক্ষ্ণ লক্ষ্যভেদী হামলায় গোলিয়াথের মাথায় পাথরের আঘাত হানতে সক্ষম হন। এরপর তিনি তার নিজের তলোয়ার দিয়ে দানব গোলিয়াথের মাথা কেটে ফেলেন। স্যামুয়েল বলেন, ‘যখন ফিলিস্তিনিরা দেখলেন তাদের বীরের মৃত্যু হয়েছে, তারা উলটোদিকে দৌড়ে পালাতে লাগলেন। এরপর ইসরায়েল ও জুদাহর বাসিন্দারা চিৎকার করে ফিলিস্তিনিদের গাথ শহরের প্রবেশ দ্বার ও একরনের ফটক পর্যন্ত ভাগিয়ে দিলেন।’

তাদের মৃতদের গাথ থেকে একরন পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তার ওপর ফেলে রাখা হল। এই বিজয়ে ডেভিড এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন যে সাউল তাকে ‘সরিয়ে ফেলার’ সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বভাবতই, তিনি তার সিংহাসনের প্রতি ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছিলেন।

নিজের জীবন রক্ষার উদ্দেশে ডেভিড ফিলিস্তিনি অঞ্চলে পালিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি একজন গুপ্তচরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি দূরবর্তী ফিলিস্তিনি শহরগুলো লুট করতে লাগলেন। এরপর তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে এসে ‘কাল্পনিক’ ইসরায়েলি শহর ও গ্রাম ধ্বংস করার মিথ্যে গল্প শুনিয়ে তাদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নিতেন। অবশেষে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এক সহিংস যুদ্ধে সাউলের মৃত্যু হলে ডেভিড নিজ দেশে ফিরে এসে সিংহাসন দখল করলেন।

উল্লিখিত ১২টি গোত্রকে শুধু জাতি নয়, বরং একটি রাজত্বে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন ডেভিড। রাজা হিসেবে তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল জেরুজালেম শহরে হামলা চালানো। এই শহরটি বাইবেলের বর্ণনা মতে ‘জেবুসাইট’দের দখলে ছিল। এরা ছিলেন পশ্চিমের ক্যানানাইট জাতি—পশ্চিমের সেমাইট ও আরব দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসা বিভিন্ন যাযাবর অভিবাসীর সংমিশ্রণে তৈরি একটি অনিশ্চিত জাতিসত্তা। শহরের প্রাচীরের নিচের পাথরগুলোতে পানি ঢোকার উপযোগী সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এক অভিনব কৌশলে নৌপথে হামলা চালিয়ে জেরুজালেমের পতন ঘটান ডেভিড।

১২টি গোত্রের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর তিনি তার দেশের বিস্তার বাড়াতে মনোযোগ দিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব দিকের এডোমাইটদের পরাস্ত করলেন তিনি। এরপর মৃত সাগরের অপরপ্রান্তের মোয়াব গোত্র, উত্তরে জর্ডানের কাছাকাছি অবস্থিত আম্মোনদেরও হারিয়ে পরিশেষে তিনি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেন। যখনই তারা জানতে পেরেছিলেন ডেভিড ইসরায়েলের সিংহাসনে বসেছেন, তখন তারা তাদের ‘গোয়েন্দার’এহেন বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালাতে এগিয়ে আসে। তবে ডেভিডের কাছে হেরে যায় ফিলিস্তিনিরা; এবং শক্তিশালী রাজত্ব হিসেবে তাদের ১০০ বছরের বেশি সময়ের গৌরবময় ইতিহাসের এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে।

ডেভিডের রাজত্বের বৈশিষ্ট্য ছিল পশ্চিমা সেমাইটদের প্রায় সমগ্র ভূখণ্ডের ওপর ইসরায়েলি আধিপত্য। এছাড়াও তিনি এমন একটি বিষয় অর্জন করতে সমর্থ হন, যেটি দেশটির আগের কোনো নেতৃবৃন্দ সফল করতে সমর্থ হয়নি—তিনি অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেন।

তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল টিরের রাজা হিরামের সঙ্গে। ভূমধ্যসাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত টির (আধুনিক লেবাননের অংশ) ছিল একটি শক্তিশালী শহর। এ শহরের বাসিন্দারা পশ্চিমা সেমাইট গোত্রের রাজধানী সিডন থেকে পালিয়ে এসে এখানে বসতি গড়েছিলেন। মূলত ‘সমুদ্র থেকে আসা মানুষরা মিশর ও তাদের শহরে হামলা চালাচ্ছিল, তখনই তারা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ‘সিডোনিয়ান’ জাতি এবং এইজিয়ান সাগরের কিছু হামলাকারী এসে টিরে বসতি গড়ে। টিরের মন্দিরগুলোও ফিলিস্তিনিদের মতো মৎস্যদেবতা দাগনের উপাসনায় নিয়োজিত ছিল। ডেভিডের আমলে সিডন একটি পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে গেছে এবং সিডনের আদি বাসিন্দারা শুধু টির ও সিডনেই নয়, প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র বিবিলোসেও তারা বসতি গড়েছে ততদিনে। এইজিয়ান ও পশ্চিমা সেমাইটদের মিশ্রণে তৈরি এই বিশেষ জাতি ফিনিশীয় নামে পরিচিতি পায়।

৪৫.২ ইসরায়েল ও এর আশেপাশের রাজত্বগুলো

তখনো ফিনিশীয়া বলে কোনো দেশ ছিল না। এমনকি ফিনিশীয় রাজা বলেও কেউ ছিলেন না। উপকূলীয় স্বাধীন শহরগুলো একই ঐতিহ্য ও ভাষার মাধ্যমে একীভূত হয়েছিল। তাদের লেখনীতে প্রথমবারের মতো বর্ণমালার প্রচলন হয়। এর পাশাপাশি, তাদের ছিল সে আমলের মূল্যবান বাণিজ্য-উপকরণ সিডার কাঠের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য। তারা পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে এই উৎকৃষ্ট মানের কাঠ কেটে মিশর, ইসরায়েল ও আরও দূরদূরান্তে রপ্তানি করতেন। সামান্য রক্তপাতের বিনিময়ে ডেভিডের ছেলে সলোমন তার পিতার রাজত্বের দখল নেওয়ার পর টিরের সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক থেকে ইসরায়েলিরা বিশেষ ফায়দা লুটতে সমর্থ হয়—সে-যুগের সবচেয়ে বড় নির্মাণপ্রকল্পের দেখা মেলে পশ্চিমা সেমাইটদের আদি ভূখণ্ডে।

বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, সলোমন ছিলেন একজন সম্মানিত ব্যক্তি, যিনি সবসময় আরও প্রজ্ঞাবান হওয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি ডেভিডের রাজত্বকে ১২টি প্রশাসনিক জেলায় বিভক্ত করেন। তিনি কোনো প্রথাগত গোত্রীয় সীমানা নির্ধারণ করেননি। তিনি চাইতেন গোত্রে-গোত্রে সংঘাতের পুরনো ঐতিহ্যকে ভেঙে একটি সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে। তিনি কর-ব্যবস্থার সংস্কার করেন এবং রাজত্বের সীমানাকে সর্বোচ্চ পরিমাণে বিস্তৃত করেন। পাশাপাশি তিনি এক সুবিশাল মন্দিরও নির্মাণ করেন। এটি ছিল ৪৫ ফুট উঁচু। এর নির্মাণে ব্যবহৃত পাথরগুলো বহুদূর থেকে আনা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল খোদাই-করা ও যতটুকু সম্ভব স্বর্ণখচিত সিডার কাঠ। কাঠের ভেতর বিভিন্ন দামি ঐশ্বর্য পুরে দেওয়া হয়েছিল। ইসরায়েলের ঈশ্বরের উপাসনার জন্য মন্দিরের প্রয়োজন ছিল এবং সলোমন তার জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির নির্মাণে নিয়োজিত হন।

সাধারণত এভাবেই কাজ করতেন সলোমন। তিনি একেবারেই তার বাবা ডেভিডের মতো ছিলেন না। ডেভিড ছিলেন একজন রুক্ষ ও তেজস্বী যোদ্ধা। নেতা হিসেবে তার ছিল অনেক কারিশমা এবং তিনি তার নিজের হাতে শত শত মানুষকে হত্যা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাসঘাতকতার একেবারে চূড়ান্ত প্রমাণ হাতে না-পাওয়া পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি করতেন না। তিনি হার্প বাজাতেন, জনসম্মুখে কিছুটা বিব্রতকর উদ্দাম নৃত্যে মেতে উঠতেন। তার এই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে মানুষ পাগলাটে পর্যায়ের রাগ এবং পক্ষে অবিচল বিশ্বস্ততা দেখাতেন। কথিত আছে, ডেভিডের তিন অনুসারী একবার তাদের জীবন ও স্বাধীনতাকে বাজি রেখে ফিলিস্তিনিদের দখলে থাকা অঞ্চলের একটি কুয়া থেকে তার জন্য পানি নিয়ে এসেছিলেন—কারণ সে গ্রামে ডেভিডের জন্ম হয়েছিল!

সলোমন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ ছিলেন। তার কার্যধারা ছিল কিছুটা একালের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তাদের মতো। সবকিছু ‘বড়’ করে করার প্রতি তার এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। যা-ই করতেন, তার মধ্যে চেষ্টা থাকত তার বিখ্যাত বাবাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। তিনি বাবার রক্তে ঝরা রাজত্বকে একটি আরামদায়ক ও সুসংহত সাম্রাজ্যে রূপান্তর করার চেষ্টায় রত হলেন। আধুনিক মার্কিন শাসকদের মতো, সলোমন বিশ্বাস করতেন যে তার ‘প্রতিষ্ঠানের’ ব্যাপ্তি ও প্রাচুর্য হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদের চাক্ষুষ প্রমাণ। সলোমনের পর ইসরায়েলিদের ওপর আর কোনো রাজা এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি, তবে কেউ কখনোই সলোমনের প্রতি অনুরাগ দেখিয়ে নিজের জীবনের ঝুঁকিও নেননি।

সলোমনের আস্তাবলে ১২ হাজার ঘোড়া ছিল এবং তার সুবিশাল সভাসদরা দৈনিক ১৮৫ বুশেল (৮ গ্যালনে এক বুশেল; শস্য পরিমাপে ব্যবহৃত একক) ময়দা সাবাড় করতেন। তিনি মিশরীয় ফারাওদের মতোই শক্তিশালী ছিলেন। এমনকি, এককালে মিশরীয়দের দখলে থাকা পশ্চিমের সেমাইট অঞ্চলের পুরোটাই তার রাজত্বের অংশ ছিল। সলোমন এক মিশরীয় রাজকন্যাকেও বিয়ে করতে পেরেছিলেন। তখন আর মিশরীয়দের সেই সুদিন নেই—তারা চাইলেও নিজেদের রাজকন্যাদের বিয়ে করে ভিনদেশে চলে যাওয়া ঠেকাতে পারছিলেন না। সলোমন ডেভিডের কূটনীতিকে ছাড়িয়ে গিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করলেন। টিরের হিরামের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি তিনি বিবলোসে নিজস্ব নৌবহর তৈরিতে মনোযোগ দিলেন।

যাদেরকে পরাভূত করতে পারেননি, তিনি তাদের সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে সন্ধিচুক্তি করেন; যেমন দূরবর্তী ক্যানানাইট গোত্র। সুদূর আরব থেকেও তার সঙ্গে দেখা করার জন্য এক বিশেষ প্রতিনিধিদল এসেছিল, যার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন প্রাচীন আমলের প্রখ্যাত এক রানী।

প্রাচীন ইতিহাসে কুইন অব শেবা বা শেবার রানী হচ্ছেন আরব উপদ্বীপ থেকে উঠে আসা একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় চরিত্র। তখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পশ্চিমা সেমাইটদের রাজত্বে বাণিজ্য-কাফেলার আসা-যাওয়া ছিল। খুব সম্ভবত এরকম এক কাফেলার অংশ হিসেবে শেবার রানি সলোমনের রাজত্বে এসে হাজির হন। তার সঙ্গে ছিল মশলা, স্বর্ণ ও বিভিন্ন মূল্যবান পাথর। এই বাণিজ্যে তিনি ‘যা যা চেয়েছেন, সবই পেয়েছেন’, বলে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

নিশ্চিতভাবেই আরব উপদ্বীপে ধাতব উপকরণ ও সেলাই-করা কাপড়ের বাণিজ্য চলছিল দীর্ঘদিন ধরে।

দুই হাজার বছর আগে থেকেই মেসোপটেমীয় রাজারা উপসাগরের অগ্রভাগ থেকে যাত্রা করে আরবের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের মাগানে তামার পর্বতে এসেছিলেন। আরও উত্তরে, আরবীয় উপকূলের বন্দরগুলো মেসোপটেমিয়া থেকে ভারতীয় বন্দরের মাঝে বাণিজ্যপ্রক্রিয়াকে আরও সুগম করেছিল। বন্দরগুলোকে ঘিরে বেশকিছু শহর গড়ে ওঠে।

৪৫.৩ আরব

আরবের দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা আরও কম জানি, কারণ সেখান থেকে যেসব প্রাচীন লেখা উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলোর দিন-তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে খুব সম্ভবত দক্ষিণ আরবের সাবিয়ান রাজত্ব থেকেই সলোমনের কাছে রাজকীয় প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছিল। জর্ডান নদীর ঠিক পশ্চিমে একটি প্রাচীন বেদিতে আরবি হরফে কিছু কথা লেখা আছে। তবে শেবার রানীকে নিয়ে প্রচলিত সব গল্প আরও অনেক পুরনো। হয়তো তিনি একইসঙ্গে সাবিয়ানদেরও রানী ছিলেন। কিন্তু কোনো গল্প থেকেই আমরা সাবিয়ানদের বিষয়ে তেমন কিছু জানতে পারি না।

সলোমনের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবিস্তারের উদ্যোগে অবশেষে পুরো রাজত্বে সংঘাত দেখা দেয়, যার শেষ পরিণাম হিসেবে এটি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়ে।

মন্দির ও রাজপ্রাসাদ নির্মাণের জন্য সলোমন ৩০ হাজার ইসরায়েলি পুরুষকে মজুর হিসেবে নিয়োগ দেন। এই মজুররা তাদের কাজের জন্য বেতন পেতেন, কিন্তু তাদের হাতে কোনো বিকল্প ছিল না। তারা প্রতি ৩ মাসের মধ্যে ১ মাস রাজার জন্য কাজ করতে বাধ্য ছিলেন। ইতোমধ্যে, ছিল নিজ নিজ ফসলি জমি ও আঙুর-বাগানেরও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করবেন তারা—এটাও ছিল রাজার প্রত্যাশা। প্রতিটি জেলার দায়িত্ব ছিল রাজার বিশাল কলেবরের সভাসদদের (সঙ্গে হাজারো রাজকীয় ঘোড়া, গরু, ভেড়া, ছাগল, হরিণ ও মুরগী) প্রতি বছর এক মাসের খাবারের ব্যবস্থা করা। রাজসভার আকার যত বড় হতে লাগল, জেলাগুলোর জন্য এই বড় আকারের দেনা মেটানো তত ঝামেলাপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ হতে লাগল।

কিছু কিছু এলাকার বাসিন্দাদের রাজার বাধ্যবাধকতা পূরণে ৬ মাস কাজ করতে হতো। বাকি ৬ মাস তারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহে ব্যয় করতেন।

সলোমনের সভা এত বড় হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল বিয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করার প্রবণতা। তার ঘটনাপঞ্জি লেখকের বর্ণনা মতে, সলোমনের ছিল ৭০০ জন ‘রাজকীয় রক্তের’ স্ত্রী, যাদেরকে তার কাছে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। তবে এর বাইরেও তার ৩০০ রক্ষিতা ছিল, যাদের উপস্থিতির পেছনে তেমন কোনো অকাট্য যুক্তি নেই। রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, বরং এতে সলোমনের অসীম পর্যায়ের নারীপ্রীতিই প্রকাশ পেয়েছে শুধু।

তার এই ‘বিশাল কলেবরের’ প্রতি অনুরাগ ইসরায়েলকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সাম্রাজ্যে পরিণত করে এবং দূরদূরান্ত থেকে এখানে সফর করতে আসেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। তবে এই প্রবণতা একইসঙ্গে ইসরায়েলের পতনেরও বীজ বপন করেছিল। সলোমনের বড় বড় নির্মাণপ্রকল্পগুলো তাকে বড় আকারের দেনায় ফেলেছিল, বিশেষত টিরের ফিনিশীয় রাজা হিরামের কাছ থেকে তিনি অনেক ধার করেছিলেন। হিরামের কাছ থেকে আমদানি করা সিডার, পাইন ও স্বর্ণের দাম মুদ্রায় মেটাতে না পেরে তিনি তার রাজত্বের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত ‘গ্যালিলি অঞ্চলের ২০টি শহর’-এর মালিকানা তাকে দিয়ে দেন।

এই সমাধান কারও জন্যই ভালো হয়নি। হিরাম এই শহরগুলো পরিদর্শন করে তাদের নাম দেন : ‘যে ভূখণ্ড কোনো কাজের নয়।’ এতে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা রাগে ফুঁসে ওঠেন। সলোমন ছিলেন দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা রাজা। তিনি ছিলেন দক্ষিণের শক্তিশালী ও বড় গোত্র জুদাহ’র সদস্য। উত্তরের শহরের বাসিন্দাদের অভিমত ছিল, সলোমন তার সক্ষমতার চেয়ে বেশি নির্মাণ করেছেন, অনেক বেশি কর আদায় করেছেন এবং তার প্রজাদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়েছেন। এখন ঝামেলায় পড়ার পর তিনি নিজের অঞ্চলে (দক্ষিণে) হাত না দিয়ে উত্তরের ২০টি শহর বিলিয়ে দিয়ে সে সমস্যা মেটানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।

সলোমনের অধীনস্থ এক কর্মকর্তা, উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা জেরোবোয়ামের নেতৃত্বে বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। ইফরেইমের এক ধর্মনেতা জেরোবোয়ামকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলে সলোমন তার বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে যাওয়া বিদ্রোহের আভাস পান। তিনি জেরোবোয়ামের পেছনে একদল আততায়ীকে লেলিয়ে দিলেন। ফলে বিদ্রোহী নেতা মিশরে পালিয়ে বাঁচলেন। ইতোমধ্যে বয়োবৃদ্ধ সলোমন ৪৩ বছর দেশ শাসন করার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে জেরোবোয়াম দেশে ফিরে আসেন। মৃত্যুকালে সলোমন একটি সুবিশাল, ধনাঢ্য, বিভাজিত ও অসুখী জাতিকে রেখে গেলেন।

জেরোবোয়াম ফিরে আসার পরপরই সলোমনের উত্তরাধিকারী রেহোবোয়ামের কাছে প্রতিনিধি পাঠিয়ে কিছু প্রস্তাব দিলেন। তিনি তাকে বললেন কর কমাতে এবং শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে। রেহোবোয়াম তার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কাছে উপদেশ চাইলেন। এই একই সংসদীয় ব্যবস্থা সেই গিলগামেশের আমল থেকে প্রচলিত ছিল। যুগে যুগে শাসকদের বিপদ থেকে বের করে এনেছে এই ব্যবস্থা, আবার অনেকের পতনেরও কারণ এই সভাসদরাই। বয়স্কদের সমন্বয়ে গঠিত অভিজ্ঞ সাংসদরা ছিলেন সতর্ক। তারা সলোমনের নীতি বর্জন করতে বললেন। তাদের ভাষায়, রেহোবোয়ামকে সম্রাট থেকে মেষপালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার বুদ্ধি দিলেন তারা। তবে তরুণদের সংসদ থেকে এল সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিমত। তারা তাকে তার ক্ষমতার বিস্তার প্রদর্শনের আর্জি জানালেন। তারা বললেন, ‘তাদেরকে বলুন যে, আপনার কনিষ্ঠ আঙুলটিও আপনার পিতার শিশ্নের চেয়ে বেশি মোটা।’

এই উপদেশটিই বেশি মনে ধরল রেহোবোয়ামের। তারপর যখন প্রতিনিধিরা ফিরে এলেন, তিনি খুব সম্ভবত তৎকালীন পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে হঠকারী রাজনৈতিক বক্তৃতাটি দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার পিতা আপনাদের ওপর বড় বোঝা চাপিয়েছিলেন। কিন্তু আমি একে আরও ভারী করে তুলব।’ এই বক্তব্যের রাজনৈতিক প্রভাব তিনি প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই টের পেলেন।

উত্তরের গোত্রগুলো তাদের নেতা জেরোবোয়ামকে রাজা হিসেবে মেনে নিল। শুধুমাত্র তার পূর্বসূরিদের গোত্র জুদাহ ও বেঞ্জামিন নামের একটি অতি ক্ষুদ্র গোত্র তার প্রতি বিশ্বস্ততা দেখাল। অর্থাৎ, ইসরায়েলের শক্তিশালী রাজত্ব মাত্র দুই প্রজন্ম টিকে ছিল।

এই রাজত্বের নড়বড়ে অবস্থার বিষয়টি মিশরীয়দের নজর এড়ায়নি। তারা তখন একধরনের পুনর্জাগরণের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল।

১০৭০ সালের আশেপাশের সময়কাল থেকে মিশরের তৃতীয় মধ্যম পর্যায়ে চরম গৃহযুদ্ধ চলছিল। হেরিহরের নেতৃত্বে আমুনের শীর্ষ পূজারিরা দক্ষিণের শহর থেবেসে বসে দেশের একাংশ শাসন করতেন। অপরদিকে, ২১তম রাজবংশের ফারাওরা বদ্বীপ শহর তানিস থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল শাসন করতেন। তানিসের ফারাওদের ছিল রাজকীয় রক্ত। তবে শীর্ষ পূজারিদের কাছে ছিল অগাথ ধনসম্পদ, যার জন্য তারা আগের ফারাওদের বদান্যতাকে ধন্যবাদ দিতেন। আগের ফারাওদের কাছ থেকে পাওয়া বিশাল পরিমাণ জমিজমার কারণে আমুনের মন্দিরের পূজারিরা এতটাই ধনবান ছিলেন যে, এমনকি ইলিয়াডেও তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

পূজারিরা এই বিশাল ধনসম্পদের কিছুটা অংশ দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার পেছনে ব্যয় করেন। তারা তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য লিবিয়া থেকে ভাড়াটে সৈন্য জোগাড় করেন। লিবিয়া থেকে আগত এই ‘পুলিশ বাহিনীর’ নাম ছিল মেশওয়েশ। প্রায় ৯৫০ সদস্যের এই বাহিনীর নেতা ছিলেন শেশোঙ্ক নামের এক যোদ্ধা। তার নিজেরও এখানে কিছু স্বার্থ জড়িত ছিল। তিনি উত্তরের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন, কিন্তু ইতোমধ্যে তিনি তানিস শহরের শাসক, ফারাও সুসেনেস দ্বিতীয়র এক কন্যাকে বিয়ে করে দক্ষিণের সঙ্গেও মিত্রতা তৈরি করেছিলেন। এই ফারাও শাসকের ১৪ বছরের শাসনামল সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। তবে সুসেনেসের মৃত্যুর পর শেশোঙ্ক বিবাহসূত্রে তানিসে মিশরের সিংহাসনের দাবিদার হিসেবে নিজেকে সামনে নিয়ে আসেন।

থেবেসের পূজারিদের শক্তিমত্তার প্রতীক ছিলেন শেশোঙ্ক। সুতরাং মিশরের অপর রাজধানীর ওপরও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তার খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।

সাময়িকভাবে মিশরের দুই অংশ একীভূত হওয়ার ফলে দেশটিতে একধরনের স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শেশোঙ্ক মিশরের কিছু ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেন। যেহেতু ইসরায়েল ও জুদাহ গোত্র বেশ দুর্বল অবস্থায় ছিল, শেশোঙ্ক পশ্চিমের সেমাইট ভূখণ্ডের দিকে নজর দিলেন।

রেহোবোয়াম রাজার শাসনামলের পঞ্চম বর্ষে শেশোঙ্ক দুর্বল ফিলিস্তিনের ভেতর দিয়ে এসে জেরুজালেমে হামলা চালালেন। তিনি মন্দির ও রাজপ্রাসাদের সব ধনসম্পদ লুট করে নিয়ে গেলেন।

তিনি সবকিছুই নিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি, রাজা সলোমনের বানানো স্বর্ণের তৈরি ঢালগুলোও। ফলে পরবর্তীতে রাজা রেহোবোয়াম ব্রোঞ্জের ঢাল তৈরি করে এগুলো প্রতিস্থাপন করতে বাধ্য হন।

জেরুজালেমের প্রাচীরগুলো অক্ষত ছিল। অর্থাৎ, অন্যভাবে বলতে গেলে, রেহোবোয়াম তার হামলাকারীকে মন্দিরের ধনসম্পদ দিয়ে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ‘আর্ক অব কভেন্যান্ট’ ছাড়া প্রায় সবকিছুই মিশরের হাতে চলে যায়। আর খুব সম্ভবত তাকেও মিশরের রাজার ‘প্রতিনিধি’ (পড়ুন ‘প্রজা’) হিসেবে শাসন করার প্রক্রিয়া মাথা পেতে মেনে নিতে হয়।

শেশোঙ্কের নিজ বর্ণনা থেকে জানা যায়, এরপর তিনি আরও উত্তরে অগ্রসর হতে শুরু করেন। জেরোবোয়াম একসময় মিশরের বদান্যতা উপভোগ করলেও এবার টের পেলেন তার পালাবার আর কোনো পথ নেই। শেশোঙ্ক ১ হাজার ২০০ রথ ও ৬০ হাজার সেনা জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগই এসেছিল লিবিয়া থেকে। সে তুলনায় জেরোবোয়ামের সেনা-সামর্থ্য খুবই অকিঞ্চিৎ ছিল।

জেরোবোয়াম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠটান দিয়ে প্রাণে বাঁচলেন। শেশোঙ্ক ইসরায়েলের মধ্যদিয়ে মেগিদ্দো পর্যন্ত এগিয়ে তারপর থামলেন। তিনি যা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তা করতে পেরেছিলেন। প্রায় ৫০০ বছর আগে তুথমোসিস দ্বিতীয় যতটুকু অঞ্চল শাসন করতেন, তিনিও ঠিক ততটুকু এলাকা দখল করে আর আগালেন না। তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন। তার মৃত্যুর পরও তার বংশধররা বেশ কয়েক বছর উত্তর ও দক্ষিণকে দখলে রাখতে পেরেছিল।

শেশোঙ্কের হামলার ফলাফল—একটি অনুপ্রেরণাহীন ও ভীত জাতি এবং বিভক্ত রাজত্ব। পরবর্তী কয়েক শতকে ডেভিডের বংশধররা দক্ষিণের জুদাহ রাজত্বের দখল নিলেন আর উত্তরের রাজত্ব, যেটি সমষ্টিগতভাবে ‘ইসরায়েল’ নামে পরিচিত ছিল, সেটি পুরোপুরি অস্থিতিশীল অবস্থায় থেকে যায়। একের পর এক শাসকের বদল হতে থাকে সেখানে।

সকল অধ্যায়

১. ৩০. চীনের শ্যাং রাজবংশের রাজধানীগুলো
২. ৩১. গ্রিসের মাইসেনীয় জাতি
৩. ৩২. দেবতাদের সংঘর্ষ
৪. ৩৩. যুদ্ধ ও বৈবাহিক সম্পর্ক
৫. ৩৪. অতি প্রাচীনকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ
৬. ৩৫. ট্রয়ের যুদ্ধ
৭. ৩৬. চীনের প্রথম ঐতিহাসিক রাজা
৮. ৩৭. ঋগ্বেদ
৯. ৩৮. যখন আবারো ইতিহাসের চাকা ঘুরল
১০. ৩৯. নতুন রাজত্বের অবসান
১১. ৪০. গ্রিসের অন্ধকার যুগ
১২. ৪১. মেসোপটেমিয়ার অন্ধকার যুগ
১৩. ৪২. শ্যাংদের পতন
১৪. ৪৩. স্বর্গ থেকে আসা আদেশ
১৫. ৪৪. ভারতের যুদ্ধ
১৬. ৪৫. ডেভিডের পুত্র
১৭. ৪৬. আবারও পশ্চিম থেকে পূর্বে গেল ঝৌরা
১৮. ৪৭. অ্যাসিরীয়ার রেনেসাঁ
১৯. ৪৮. নতুন জনগোষ্ঠী
২০. ৪৯. বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও উপনিবেশ
২১. ৫০. পুরনো শত্রুরা
২২. ৫১. অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনের রাজারা
২৩. ৫২. চমকপ্রদ পরাজয়
২৪. ৫৩. চীনের ক্ষয়িষ্ণু রাজা
২৫. ৫৪. মিশরের অ্যাসিরীয়রা
২৬. ৫৫. মেদেস ও পারস্যবাসীরা
২৭. ৫৬. বিজয় ও স্বৈরাচার
২৮. ৫৭. একটি রাজত্বের শুরু ও শেষ
২৯. ৫৮. একটি সংক্ষিপ্ত সাম্রাজ্য
৩০. ৫৯. সাইরাস দ্য গ্রেট
৩১. ৬০. রোম প্রজাতন্ত্র
৩২. ৬১. রাজত্ব ও সংস্কারকামীরা
৩৩. ৬২. দায়িত্ববোধ, ক্ষমতা ও ‘আর্ট অব ওয়ার’
৩৪. ৬৩ – পারস্য সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তার
৩৫. ৬৪. দ্য পার্শিয়ান ওয়ারস : পারস্যের যুদ্ধ
৩৬. ৬৫. পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ
৩৭. ৬৬. রোমে প্রথম লুটপাট
৩৮. ৬৭. চি’ইনের জাগরণ
৩৯. ৬৮. মেসিডোনিয়ার বিজেতারা
৪০. ৬৯. রোমের বজ্রআঁটুনি
৪১. ৭০. আলেকজান্ডার ও উত্তরাধিকারীদের যুদ্ধ
৪২. ৭১. মৌর্য সভ্যতার পরিণতি
৪৩. ৭২. প্রথম সম্রাট, দ্বিতীয় রাজবংশ
৪৪. ৭৩. পুত্রদের যুদ্ধ
৪৫. ৭৪. রোমান স্বাধীনতাকামী ও সেলেউসিদ দখলদার
৪৬. ৭৫. পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে
৪৭. ৭৬. প্রচলিত ব্যবস্থার বিনির্মাণ
৪৮. ৭৭. উন্নয়নের সমস্যাগুলো
৪৯. ৭৮. নতুন মানুষ
৫০. ৭৯. সাম্রাজ্য
৫১. ৮০. অমাবস্যা ও পুনর্জাগরণ
৫২. ৮১. উত্তরাধিকারের সমস্যা
৫৩. ৮২. রোমান সাম্রাজ্যের কিনারায়
৫৪. ৮৩. সিংহাসনে শিশুরা
৫৫. ৮৪. উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ক্ষমতার ভ্রান্তি
৫৬. ৮৫. সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন