২৫. চারটে পিঠে-বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাগে

সমরেশ মজুমদার

চারটে পিঠে-বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাগে প্রত্যেকের জিনিসপত্র ধরে গেল। গতকাল সুদীপ আর আনন্দ সমস্ত কলকাতা চষে প্রায় সব কিছুই পেয়ে গেছে। বিকেলবেলায় ওরা চারজন ছাদের ঘরে বসে ব্যাপারটা ঝালিয়ে নিচ্ছিল। ওষুধপত্রের স্থূপ দেখে কল্যাণ খুব হেসেছিল। সুদীপও স্বীকার করেছে। উত্তেজনায় পরিমাণটা বেশি হয়ে গিয়েছে। জয়িতা বলেছিল ওটা একটা মাঝারি হাসপাতালের এক মাসের রসদ। জয়িতার হাতে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের টিকিট দুটো দিল আনন্দ। কল্যাণ কখনও প্লেনে ওঠেনি। স্বভাবতই সে টিকিট দুটো দেখে উত্তেজিত হল এবং বলেই ফেলল, সত্যি কথা বলতে কি, আজ কাগজ পড়ার পর থেকেই মনে হচ্ছে কত তাড়াতাড়ি কলকাতা ছাড়া যায়!

আজকের কাগজের প্রথম পাতার খবর তারাই। আহত ছেলেটির কাছ থেকে স্টেটমেন্ট পাওয়ার পর পুলিশ গতকাল দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের বয়স একুশের মধ্যে। কলেজের ছাত্র। এর আগে কখনও কোন অ্যাকশন করেনি। যে ধরা পড়েনি সে-ই নাকি বোমার ব্যবস্থা করেছিল। খবরের কাগজ দুটো অপারেশন এবং রেসকোর্সের ওপর হুমকির খবর পেয়ে তারা উত্তেজিত হয়েছিল। তাদের মনে হয়েছিল শুধু হুমকি দিলেই কাজ হবে না। যারা হুমকি দিয়েছিল তারা যে কাজটা করতে পারেনি তারা সেই কাজটা করে দেখাতে চেয়েছিল। মাঝারি মানের ছাত্র হওয়ায় তাদের সামনে কোন ভবিষ্যৎ ছিল না রাজনৈতিক দলগুলোর কাজকর্মের সঙ্গে তাদের মতের কোন মিল নেই। কিন্তু এখন তারা দুঃখিত। ঘোড়াগুলো যে মরে যাবে তা তারা চিন্তা করেনি। আর যে দুজন প্রহরী মারা গিয়েছে তারা পলাতক বন্ধুর আক্রমণের শিকার হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ স্বীকার করেছে, এই ঘটনার সঙ্গে প্যারাডাইস এবং বড়বাজারের ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই। ওই দুটো ঘটনার আসামীদের ধরবার জন্যে পুলিশ ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছে। পুলিশের এক মহলের সন্দেহ, আততায়ীরা পাঞ্জাবের দিকে চলে গেছে। প্রতিটি কাগজই অবশ্য কাল দুপুরের টেলিফোনের কথাটাও লিখেছে। টেলিফোনে আক্রমণকারীরা তাদের জানিয়েছে যে হেস্টিংসের ঘটনা তারা সমর্থন করে না। তারা জনসাধারণের কাছে আবেদন জানিয়েছে অযথা উত্তেজিত হয়ে এমন কিছু না করে বসেন যা প্রতিক্রিয়াশীল শব্দটির প্রচলিত ব্যাখ্যা অকেজো হয়ে গেছে। শ্রেণীসংগ্রামের নাম করে, মার্কস অথবা ক্যুনিজমের ইজারা নিয়ে এদেশীয় বুর্জোয়া এবং সামন্ততান্ত্রিক শোষকসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিগির তোলাই যাদের অস্তিস্ব রক্ষার একমাত্র উপায় ছিল। তারাই সীমিত ক্ষমতা হস্তগত করে জনতাকে ব্যবহার করছেন নিজেদের স্বার্থে। যে-দেশের মানুষের গড় দৈনিক আয় মাত্র কয়েক পয়সা সেই দেশে লক্ষপতিকেও এঁরা সর্বহারা বলতে দ্বিধা করেন না। আমাদের বলতে কোন দ্বিধা নেই এই নব্য প্রতিক্রিয়াশীলরা পুরোনো প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়ে অনেক বেশি মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। আমরা দেশের মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর সংস্থা বা মানুষকে চূর্ণ করতে কোন হুমকির কাছে মাথা নোওয়াব না। সংবাদপত্রগুলো জানিয়েছে এই ফোনে সংবাদদাতা তাদের আগামী পরিকল্পনার কোন হদিশ দেয়নি।

আবহাওয়া খুব গরম হয়ে গেছে। এখন কলকাতায় থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। কল্যাণ টিকিট দুটো হাতে নিয়ে দেখছিল। দমদম থেকে বাগডোগরা। তার পরেই ওর মনে হল যদি এয়ার পোর্টে তাদের পুলিশ ধরে ফেলে! অথবা প্লেনে বসে থাকার সময়? তাহলে তো পালাবার কোন সুযোগ থাকবে না। কথাটা বলতেই আনন্দ হাসল, প্লেনে তোরা অনেক সেফ। সঙ্গে এমন কিছু নিবি না যা সিকিউরিটি চেকিং-এর সময় অসুবিধে সৃষ্টি করে। কোনরকম আর্মস তোদের সঙ্গে নিয়ে তোরা প্লেনে উঠতে পারবি না। জাস্ট ট্যুরিস্ট হিসেবে তোরা যাচ্ছিস। সুদীপ, তুই কখন বের হবি?

সুদীপ ঘড়ি দেখল, ঘণ্টাখানেক বাদে। তোরা রবীন্দ্রসদনের সামনে সাতটার সময় অপেক্ষা করবি। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব। আমার জিনিসপত্র তোরা নিয়ে যাস।

জয়িতা বলল, অতদূরে কেন? আমরা তো সন্ধ্যের আগে এখান থেকে বের হচ্ছি না। তুই গাড়ি নিয়ে ট্রাম ডিপোর সামনে চলে আয়।

আনন্দ বলল, সেই ভাল। কিন্তু কাল দুপুরে ফ্লাইট। তোরা অতক্ষণ কোথায় থাকবি?

এই সমস্যাটাই বড় হয়ে দেখা দিল। কোন পরিচিত লোকের বাড়িতে থাকতে সাহস পাচ্ছিল না। ওরা। যে কোন মুহূর্তে বিপদ হতে পারে। আনন্দর মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। হঠাৎ তার মনে পড়ল বাবার চিঠিটার কথা। বাবার সেই বান্ধবীর কাছে সাহায্যের জন্যে গেলে কেমন হয়! সঙ্গে সঙ্গে মতলবটা বাতিল করল সে। যাকে কখনও দ্যাখেনি তার কাছে সাহায্য চাওয়াটাই বোকামি, যদিও বাবার চিঠির ভাষা ভদ্রমহিলা সম্পর্কে একটা অন্য রকমের ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে। শেষ পর্যন্ত সুদীপ পথ বাতল। এয়ারপোর্ট হোটেল নয়, আজ সন্ধ্যেবেলায় ওরা সোজাসুজি ভি আই পি রোডে চলে যাক। প্রায় এয়ার পোর্টের কাছাকাছি ভি আই পি রোডের গায়ে একটা রেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে। সাধারণত যারা ফ্লাইট ধরবে বা ধরতে আসে তারাই ওখানে থাকে। চার্জও বেশি নয়।

আনন্দ বলল, তাহলে আমরা একটু ঝুকি নেব। কল্যাণকে এখন কোথাও রেখে যাব না। ও জয়িতার সঙ্গে গাড়িতেই থাকবে। আমরা যদি মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বের হতে পারি তাহলে সোজা ওই রেস্ট হাউসে গিয়ে ওদের নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাব।

হঠাৎ কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, যদি না বের হতে পারিস? তোদের কিছু হলে?

আচমকা একটা হিমবাতাস বয়ে গেল ঘরে। সেটাকে কাটিয়ে উঠল আনন্দই, তা হলে তোরা অপেক্ষা করবি না। আমরা ধরা পড়লেই যে তোদের ধরা দিতে হবে এমন আমি চাই না। সঙ্গে টাকা আছে, এয়ার টিকেট আছে, যেভাবেই হোক নিজেদের বাঁচাবি। আমাদের বাদ দিয়ে যদি তোরা একটাও অ্যাকশন করত পারিস তা হলে সেটাও খুব মূল্যবান হবে।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, বাগডোগরা থেকে কোথায় যাব?

আনন্দ ওদের বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে। যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তা হলে ওরা সেইদিনই একত্রিত হবে। এখন সৌভাগ্য কতটা সেটাই দেখা যাক।

পিঠে-বওয়া-ব্যাগ ছাড়াও দুটো চামড়ার ঝোলা কিনেছে সুদীপ। ঝোলাটা ওয়াটারপ্রুফ। তাতে যাবতীয় লড়াই-এর রসদ রাখা হয়েছে। ওইটে বহন করবে আনন্দ। সুদীপ ঘড়ি দেখল। আজ বৃদ্ধার জ্বর কম, কিন্তু দুর্বল হয়ে আছেন। ওর একবার মনে হল বের হবার আগে বৃদ্ধার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করে আসা দরকার। মায়ের কাজটা যে এ জীবনে করতে পারল না সেটা অবশ্য বলা যাবে না, কিন্তু একটু পাশাপাশি বসলে খুশী হবেন উনি। ও নিচে নেমে গেল।

জয়িতার কেবলই মনে হচ্ছিল কলকাতা থেকে চলে যাওয়ার আগে রামানন্দ রায়ের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু বাড়ির ফোনে পুলিশ আড়ি পেতেছে কিনা কে জানে। রামানন্দ রায়ের অফিসে অবশ্য যাওয়া যেত। সীতা রায় সুদীপকে বলেছিল দরকার হলে সাহায্য চাইতে। এক রাত্রে মা হঠাৎ অমন পালটে গেল কি করে। খুব ছেলেবেলায় যে মাকে সে হারিয়েছিল তাকেই এই মুহূর্তে সে দেখতে পেল। তা সত্ত্বেও নিজেকে শক্ত করতে চাইছিল সে। কারণ সে বুঝতে পারছিল অন্য দুই বন্ধুর মনের অবস্থায় খুব ফারাক নেই। আনন্দ বা কল্যাণ এখন নিশ্চয়ই ওদের বাড়ির কথা ভাবছে।

বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলার পর সুদীপ শেষ কথাটা বলল, আমি আজ রাত্রে ফিরব না।

কেন? কোথায় যাবে? বৃদ্ধা অবাক হয়ে গেলেন।

কয়েকটা জরুরী কাজ আছে, সারতে হবে।

ও তাই বল। আমি ভাবলাম তুমি অবনীর বাড়িতে যাবে। দ্যাখো, বলছিলাম কি, যদিও আমার গুরু রাড় বাড়ি যায়—তবুও আমার গুরু রামানন্দ রায়। তা বাপ তো গুরুর মতই।

আপনার কথা আমার মনে থাকবে। সুদীপ উঠে পড়ল। এখন গয়া পড়ে গেছে। আকাশে মেঘ থাকায় আলো কমে যাচ্ছে দ্রুত। সে সিড়ি দিয়ে বলে উঠতে উঠতে বাদিকে তাকাল। এখান থেকে সামনের গলির একাংশ দেখা যায় গাছপালার ফাঁকে। সেখানে একটা লোক দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে এপাশে তাকিয়ে। তার ঠিক পাশেই আর একা লোক দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখছে। লোক দুটোর চেহারা দেখে সুদীপের সন্দেহ হল। ওরা পুলিশের লোক না হয়ে যায় না। নিশ্চয়ই ওখানে দাঁড়িয়ে কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে। সে আর ভাবতে পারল না। দৌড়ে ঘরে ঘরে চলে এসে বলল, চটপট জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আয়। মনে হচ্ছে ওরা আমাদের খোঁজ পেয়েছে।

কারা? কল্যাণের মুখ সাদা হয়ে গেল।

আনন্দ বলল, কি করে বুঝলি?

গলির মধ্যে দুটো সন্দেহজনক লোক দাঁড়িয়ে এই বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না। নিজে একটা ব্যাগ তুলে নিয়ে সে ডাকল, চলে আয়।

জয়িতা বেরিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞাসা করল, বুড়ি আমাদের দেখতে পাবে না?

পেলে পাবে। এখন ওসব ভাবার সময় নেই।

প্রায় উবু হয়েই ওরা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এল। উঠোনের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কয়েক সেকেন্ড সময় পাওয়া যাবে ওরা এলে। সুদীপ চারপাশে তাকাল। বৃদ্ধা তার ঘরে শুয়ে আছেন। দরজাটা এড়িয়ে গেলে তিনি দেখতে পাবেন না। ওর মনে পড়ল পেছনের পুকুরধারে আর একটা পথ আছে। সেই পথেও পুলিশ এসে গিয়েছে কিনা জানা নেই। কিন্তু ওই পথ ছাড়া বের হবার কোন উপায় নেই। বুড়িকে ডিঙিয়ে ওরা পেছনের দরজায় চলে এল। সে নিচুগলায় আনন্দকে বলল, তোরা একটু সরে দাঁড়া। সেই বউটা এলে আমি ওর সঙ্গে ঘরের ভেতরে চলে যাব। গল্প করছি দেখলে তোরা ভেতরে ঢুকে ডানদিকের বারান্দার গায়ে একটা দরজা দেখতে পাবি। সেটা খুলে সোজা বেরিয়ে যা। আমি সাতটার সময় চৌরাস্তা নয়, ক্যালকাটা হসপিটালের সামনে তোদের জন্যে ওয়েট করব।

সে কয়েকবার দরজায় শব্দ করতে যুবতীর গলা পাওয়া গেল, কে!

সুদীপ চাপা গলায় বলল, আমি। বলে এপাশের দরজা খুলল।

সঙ্গে সঙ্গে ওপাশের দরজা খুলে গেল। যুবতী সেই হাসিটা ঠোঁটে জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার। আমার কি সৌভাগ্য! আসুন। এতক্ষণ আপনার কথাই ভাবছিলাম।

আমার কথা? কেন? সুদীপ আড়ালে দাঁড়ানো বন্ধুদের দিকে একবারও না তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল দরজা খোলা রেখে।

ঘরে ঢুকে যুবতী বলল, কেন, আপনার কথা বুঝি ভাবতে নেই? আর কার কথা ভাবব বলুন? একজন প্রেমিক ছিল, বিষ খেয়েছি শুনে সে পালাল। আমি না হয় সেই রাত্রে অভিনয় করেছিলাম, কিন্তু আপনি কেন অভিনয় করলেন? কেন বাঁচালেন আমাকে?

কেন বাঁচালাম বলুন তো! সুদীপ আড়চোখে দেখল তিনটে মূর্তি বারান্দার কোণা দিয়ে পার হয়ে গেল। সে প্রশ্নটা করেই এমনভাবে হেসে উঠল যে খাটে বসা যুবতী অন্য দিকে খেয়াল করার অবকাশ পেল না।

যুবতী জিজ্ঞাসা করল, হাসির কি আছে! আহা!

সুদীপ বলল, আসলে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে–।

এই সময় ওপাশে বৃদ্ধার চিৎকার শোনা গেল, কে? কে ওখানে শব্দ করে?

সুদীপ উঠে দাঁড়াল, এই রে, উনি বোধ হয় জানতে পেরেছেন!

যুবতী ওর দুটো হাত ধরল, দাঁড়ান। আপনি যাবেন না। আমি দরজাটা বন্ধ করে আসি। আপনি যে আমার কাছে এসেছেন তা বুড়ির না জানলেই হল।

কিন্তু উনি যদি এখানে আসেন?

তাই? ঠিক আছে। আমি দিদিমাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছি কি হয়েছে? উনি কিছু বললে বলে দেব যে আপনাকে দেখিইনি। আমার তিনি তো রাত নটার আগে ফিরবেন না। ততক্ষণে বেশ গল্প করা যাবে। বসুন। যুবতী দরজা দিয়ে বেরিয়ে বৃদ্ধার অংশে চলে যেতে সুদীপ চটপট বারান্দায় নেমে এল। ওপাশে পুরুষকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। সুদীপ খোলা অথচ ভেজানো দরজা খুলে পুকুরধারে চলে এল। এদিকে পায়ে চলার পথ।

পথটা কোন দিকে যাচ্ছে সে জানে না। যদি ঘুরে ওই গলিতে পড়ে তা হলেই হয়ে গেল। এদিকে মানুষজন এই শেষ বিকেলে নেই। খুব জোরে হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট বাগানের ওপাশে রাস্তা দেখতে পেল সে। একটুও দ্বিধা না করে সে বাগানটা যখন পার হচ্ছে তখন একজন মহিলাকে দেখতে পেল অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছেন। ও যখন রাস্তায় পড়ে গেছে তখন তিনি চিৎকার করলেন, এটা কি রাস্তা? সুদীপ কোন জবাব না দিয়ে খানিকটা হাঁটার পর একটা রিকশা পেয়ে গেল।

 

অবনী তালুকদারের গ্যারেজটা মোটেই বড় নয়। অর্থবান লোক হিসেবে তাঁর বেশ খ্যাতি আছে গ্যারেজে। তিনি জানেন আর সব বিষয়ে মুঠো বন্ধ করলেও গাড়ি সারায় যারা তাদের সন্তুষ্ট রাখা উচিত। নইলে খরচ বাড়বেই। ফলে খ্যাতি হয়েছে খাতিরের কারণেই। সুদীপও বেশ কয়েকবার গ্যারেজে গিয়েছিল। যাতায়াতে তার সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেছে মিস্ত্রিদের। সে যখন গ্যারেজে ঢুকল তখন প্রায় সাড়ে ছটা বাজে। গ্যারেজের মালিক অম্বিকাবাবু ধারেকাছে নেই। হেডমিস্ত্রি ওকে দেখে এগিয়ে এল, কি ব্যাপার দাদাবাবু?

বাবা বলল গাড়িটা আবার গোলমাল করছে।

ও। কিন্তু আজ তো লোক কম আছে। কাল সকালে পাঠিয়ে দেব, যদি দরকার হয় এখানে নিয়ে আসব। গতবারই আমার সন্দেহ হয়েছিল বাকেটটা নিয়ে।

কিন্তু মুশকিল হয়েছে একটা। বাবার একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে। ওখানে ট্যাকসিও পাওয়া যায় না। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতেই হবে। খুব নিরীহ মুখে জানাল সুদীপ।

গাড়ি। মিস্ত্রি একবার চারপাশে তাকাল, ওই অ্যাম্বাসাডারটা নতুন রঙ হবে। এমনিতে গাড়ি রানিং কন্ডিশনে আছে। ওটা নিয়ে যাও, কাল সকালে আমি গিয়ে নিয়ে আসব।

মিনিট পাঁচেক বাদে শিস দিতে দিতে গাড়ি চালাচ্ছিল সুদীপ। অয়েল ইন্ডিকেটার বলছে এখনও কিছুটা দূর যাওয়া যাবে। সে একটা পেট্রল পাম্পে গাড়ি ঢোকাল। পুরো ট্যাঙ্ক তেল ভরে নিয়ে সে ক্যালকাটা হসপিটালের দিকে যেতে যেতে খেয়াল করল তাড়াহুড়োয় ভাঙা ক্যামেরাটা ছাদের ঘরে ফেলে এসেছে। একটু গুম হয়ে গেল সুদীপ। একটা না একটা গোলমাল তার হবেই। ক্যামেরা ছাড়া কি ক্যামেরাম্যান হয়? সার্কুলার রোডের একটা দোকানে ঢুকে তাকে ক্যামেরা কিনতে হল। নিজের পছন্দটা বড্ড চড়া-নইলে এত গচ্চা যেত না।

সাতটার কয়েক মিনিট বাদেই ওরা গাড়িতে উঠে এল। জয়িতা ওর পিঠে হাত দিল, আমাদের খুব ভয় হচ্ছিল তোর জন্যে। ওরা কি সত্যি পুলিশ?

স্টার্ট দিল।

কল্যাণ বলল, ভাগ্যিস তুই দেখেছিলি। এই রকম প্যালপিটেশান জীবনে হয়নি আমার। যে কোন মুহূর্তেই পুলিশের মুখোমুখি হব, হাঁটছি আর মনে হচ্ছে। তারপর ডায়মন্ডহারবার রোড পড়তেই একটা বাসে চেপে বসলাম।

কেউ তোদের কিছু বলেনি?

না। তবে সবাই জয়িতাকে দেখছিল। ছেলে না মেয়ে বুঝতে পারছিল না।

আমিও পারি না। সুদীপ মন্তব্য করতেই জয়িতা পেছন থেকে চড় মারল পিঠে।

আনন্দ বলল, ঠিক বাড়িটার সামনে নিয়ে যাবি। তোরা দুজন পেছনে বসে থাকবি চুপচাপ। যদি দেখিস আমাদের কেউ চেজ করছে তা হলেই চার্জ করবি। যদি না ফিরি তাহলে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে বেরিয়ে যাবি। দশ থেকে বাবো মিনিটের বেশি অপেক্ষা করবি না। সুদীপ, তোর সঙ্গে মাল আছে তো?

আছে। তুই দুটো গ্রেনেড দে। ক্যামেরার ঝোলার মধ্যে রেখে দিই।

ওটা আবার কোত্থেকে এল?

কিনলাম। সেটা ছাদের ঘরে ফেলে এসেছি।

কেয়ারলেস! মন্তব্য করল জয়িতা। সুদীপ কোন জবাব দিল না। মন্ত্রীর বাড়ির কাছাকাছি এসে সে চারপাশে তাকাল। একজন পুলিশ রাইফেল হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে। আর একটা গাড়ি সামনে পার্ক করা। গাড়িটাকে ঠিকঠাক দাড় করিয়ে ওরা নেমে পড়ল।

সন্ধ্যের পর এই অঞ্চলের জৌলুস যেন বেড়ে যায়। মন্ত্রীর বাড়ির সামনে যদিও দোকানপাট নেই তবু রাস্তায় আলোর ফোয়ারা ছুটছে, গাড়ি-রিকশাও কম নেই। কাছাকাছি কোথাও মাইকে হিন্দী ছবির গান বাজছে। জয়িতা আর কল্যাণ পেছনে বসে রইল। আনন্দ লক্ষ্য করল দুজনেই অত্যন্ত উত্তেজিত। গাড়ির কাচের মধ্যে দিয়ে জয়িতাকে মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না একটুকু। পথচলতি কারও নজর পড়বে না তাই। সামনের গাড়ির পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়ে তার স্বাস্থ্য ভাল। লোকটা নিশ্চয়ই ড্রাইভার। সুদীপের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে যে ভঙ্গিতে তাতে ওর বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় গাড়িটায় কাজ চলছিল।

আনন্দ আর সুদীপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল। বেশ পেল্লাই দরজাটা বন্ধ। আনন্দ কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল। দরজার বাইরে মন্ত্রীর নাম এবং ঠিকানা শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা রয়েছে। যে পুলিশটা রাইফেল হাতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সে সতর্ক চোখে ওদের দেখছে, কিন্তু কোন প্রশ্ন করছে না। সুদীপ লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, মন্ত্রীমশাই বাড়িতে আছেন?

হ্যাঁ অথবা না লোকটার মাথা নাড়া দেখে বোঝা গেল না। উলটে সে জানতে চাইল, আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে? না হলে দেখা হবে না। ভিজিটর এসেছে।

দরজাটা খুলে গেল জবাব দেবার আগেই। সাদা প্যান্ট লাল শার্ট পরা একটা কালো লোক জিজ্ঞাসা করল, কি চাই? কোত্থেকে আসছেন? মন্ত্রী কি আপনাদের আসতে বলেছেন? কি নাম?

চার-চারটে প্রশ্ন কিন্তু আনন্দ তার ধার দিয়ে যেতে চাইল না, নানুভাই কি এসে গেছেন?

এবার লোকটির গলা পালটে গেল, আপনাদের নাম?

আনন্দ বলল, বলুন খবরের কাগজ থেকে আসছি। নানুভাই এখন আমাদের আসতে বলেছেন।

লোকটি জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সুদীপ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তাদের গাড়িটা নিরীহ চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দুজনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। খবরের কাগজ শোনার পর রাইফেলধারী পুলিশটা একটু সহজ হল। সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে সারাক্ষণ বকের মত দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয় না আপনার? একটা চেয়ার নিয়ে এসে বসতেও তো পারেন!

লোকটার মুখে দুঃখ-দুঃখ ছাপ ফুটে উঠল, কিন্তু কোন জবাব দিল না। তখনই আগের লোকটা ফিরে এল, আসুন। তবে পাঁচ মিনিটের বেশি থাকবেন না। উনি খুব ব্যস্ত।

কার্পেটে মোড়া করিডোর দিয়ে খানিকটা এগিয়ে লোকটা একটা ঘরের দরজায় ওদের পৌঁছে দিয়ে পর্দা সরিয়ে দিল। প্রথমে আনন্দ পরে সুদীপ ঘরে ঢুকল। নানুভাই একটা লম্বা গদিমোড়া ঘুরন্ত টুলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সামনের সোফায় বসে আছেন মন্ত্রীমশাই। ঘরে আর কেউ নেই। ঢোকামাত্র মন্ত্রীমশাই ব্যস্ত গলায় বললেন, কি ব্যাপার? রাইটার্সেই তো আসতে পার তোমরা। তোমাদের জ্বালায়–

আনন্দ নানুভাই-এর দিকে মাথা নেড়ে হাসল। নানুভাই গম্ভীর গলায় বলল, সেদিন আমি ওদের আসতে বলেছি এখানে। একটা কাগজ যা-তা লিখেছে, উলটোটা লেখা দরকার।

অ। বেশ। কোন্ কাগজ ভাই? মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন।

আনন্দ নামটা বলল। মন্ত্রী কাঁধ নাচালেন। তারপর বললেন, আমি সব সময় সর্বহারার পক্ষে। পার্টি আমাকে মন্ত্রী করেছে কারণ আমি কাজ করেছি, করব। নানু নাকি আমার ডান হাত, আরে বাবা ও আমার ডান হাত হতে যাবে কেন? কিসের অভাব ওর? একজন সৎ ব্যবসায়ীর নামে কেচ্ছা রটালেই হল। আমি সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কিন্তু ভাই স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে বানিয়ে লেখা নয়। আসলে তোমাদের বুর্জোয়া কাগজগুলো তো গল্প তৈরি করতে ভালবাসে। তোমাদের কথা বলছি না, সুতারকিন স্ট্রিটের কাগজটাকে তত আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। যত গালগল্প খবর বলে চালায়। আর পাবলিকও হয়েছে তেমন। আমাদের কেচ্ছা পড়তে পারলে আর কিছু চায় না। কি জানতে চাও বল?

আনন্দ বলল, আপনার সম্পর্কে অভিযোগ এই তল্লাটে অভারতীয়দের আপনি নানুভাই-এর সাহায্যে আশ্রয় দিচ্ছেন, দ্রুত তাদের নামে রেশন কার্ড বের করছেন, ভোটার লিস্টে বেআইনি ভাবে নাম তুলছেন। ব্যাপারটার মধ্যে কতখানি সত্যি আছে?

এক ফোঁটাও না। আমার কি দরকার? এলাকার ভোটাররা আমাকে ভালবাসে। ওসব কাজ আমি করব কেন? মন্ত্রী বললেন, আর নানুভাই-এর সাহায্যে মানে? ও কি গুণ্ডা?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, আপনি কি এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক জিগির বাঁচিয়ে রেখেছেন?

ইডিয়ট! ভারতবর্ষ সেকুলার রাষ্ট্র। আমি যে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করি সেখানে সাম্প্রদায়িক চিন্তার কোন স্থান নেই।

তৃতীয় প্রশ্ন, এই এলাকায় নব্বই ভাগ মানুষ চোরাচালানের ব্যবসায়ে লিপ্ত। তাদের মালিক হল নানুভাই। আর এই নানুভাইকে আপনি শেলটার দেন যাতে পুলিশ কিছু করতে না পারে। লোকে বলে আপনি নাকি এর একটা ভাগ পান।

কে বলেছে? কোন্ শালা? প্রমাণ আছে কিছু? তাহলে আমার পার্টি আমাকে ছেড়ে দেবে?

চতুর্থ প্রশ্ন, এই এলাকায় আপনার জনপ্রিয়তা নির্ভর করছে নানুভাই-এর মর্জির ওপর। তিনিই আপনাকে নির্বাচিত করেছেন। যদি আপনি নানুভাই-এর মতের বিরুদ্ধে যান তাহলে আগামী নির্বাচনে আপনার জামানত জব্দ হবে। এটা কি সঠিক কথা?

এবার রুমালে মুখ মুছলেন মন্ত্রীমশাই। নানুভাই চুপচাপ টুলে বসেছিল। এবার তার ঠোঁটে হাসি ফুটল। মন্ত্রী শেষ পর্যন্ত বললেন, এ প্রশ্নের জবাব আমি কি দেব? নানু এখানে রয়েছে, ও-ই জবাব দিক।

নানুভাই বলল, না না, এটা আপনার ব্যাপার। যা ভাল মনে করেন বলে দিন!

মন্ত্রী বললেন, নানু হল শোষিত মানুষের প্রতিনিধি। আমিও তাই। অতএব দুজনে হাত মিলিয়ে কাজ করতে চাই। আমাদের এলাকার মানুষের জন্যে অনেক কিছু করতে হবে। যদি কেন্দ্র আমাদের সাহায্য করে তাহলে এলাকার মানুষদের কোন দুঃখ রাখব না।

আনন্দ বলল, নানুভাই নামকরা স্মাগলার। কলকাতা শহরের অনেকগুলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উনি বাঁধিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে আপনার সংযোগ পার্টির ইমেজ নষ্ট করছে না?

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন মন্ত্রীমশাই, স্টপ ইট। তোমাকে আমি পুলিশে দেব। তুমি আমার নামে নোংরামি করছ। নানু যদি ইশারা করে তাহলে তুমি এই এলাকা থেকে জীবনে বের হতে পারবে? আমরা যা ইচ্ছে তাই করব, কার বাবার কি?

নানুভাই এবার শান্ত গলায় বলল, বড্ড রেগে যাচ্ছেন আপনি। শুনুন ভাই, মিছিমিছি ঝামেলা করে লাভ নেই। আপনাদের কাগজে ওই খবরের উলটোটা লিখতে হবে। যা যা লেখার তা আপনারা ঠিক করে কাল মন্ত্রীমশাইকে দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। পাঁচ হাজার চলবে?

মন্ত্রী বললেন, ফট করে পাঁচ বললে কেন? এরা কত মাইনে পায় জানি। একেই হত।

নানুভাই বলল, আমার জবান এক। পাঁচ বলেছি পাঁচ।

আনন্দ হাসল, ঠিক আছে। নানুভাই, আপনি মন্ত্রীমশাই-এর পাশে এসে দাঁড়ান। আমার ক্যামেরাম্যান ছবি তুলবে। ছবির নিচে একটা ভাল ক্যাপশন দিতে হবে।

মন্ত্রীর মুখ দেখে মনে হল কথাটা তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু নানুভাই হেলতে দুলতে মন্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সুদীপ ক্যামেরা খুলে রেডি হয়ে বলল, একটু হাসুন স্যার।

মন্ত্রী বললেন, নানু, কাধের কাছ থেকে হাতটা সরাও। পাবলিক ইমেজ নষ্ট হবে।

নানুভাই বলল, বাত একটু সমঝে বলবেন। পাবলিক ইমেজ! একটু বিরক্ত হয়ে নানুভাই মন্ত্রীর দিকে তাকানো মাত্র আনন্দ রিভলভারের ট্রিগার টিপল। অতবড় শরীরটা বেঁকেচুরে পড়তে পড়তে সোফায় যখন আটকে গেল তখন মন্ত্রীমশাই শিশুর মত কেঁদে উঠলেন। আনন্দর দ্বিতীয় গুলিটা মন্ত্রীমশাইকে চিরকালের জন্যে থামিয়ে দিল। গুলির আওয়াজে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল। আনন্দ আর সুদীপ দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে লোকটা ওদের এই ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল সে ভেতরে ঢুকেই আর্তনাদ করে উঠল। ততক্ষণে আনন্দরা করিডোরে চলে এসেছে। এই সময় সেই লোকটাকে রিভলভার বের করতে দেখল সুদীপ। ক্যামেরার ব্যাগ থেকে গ্রেনেড বের করে সে ছুঁড়ে দিতেই মনে হল বাড়িটা ভেঙে পড়বে। দরজার বাইরে এসে ওরা দেখল পুলিশটা রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে। আনন্দ তাকে চটপট জিজ্ঞাসা করল, গুলি আছে ভেতরে?

লোকটা পুতুলের মত মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

গুড। দৌড়ে ভেতরে যান, নইলে মারা পড়বেন। মন্ত্রী ডাকছে। সুদীপ চেঁচিয়ে বলা মাত্র পুলিশটা রাইফেল নিয়ে ভেতরে ছুটল। ওরা ততক্ষণে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসেছে। জয়িতা সামনের দরজা দুটো সঙ্গে সঙ্গে খুলে দিল। আর তখনই চার-পাঁচজন লোক ছিটকে বেরিয়ে এল বাড়ির বাইরে। তারা চিৎকার করছিল ডাকু ডাকু বলে। সুদীপ তখন মরীয়া হয়ে গাড়ি ঘোরাল। আনন্দ দেখল ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ড্রাইভার তার গাড়িতে উঠছে। সে ওইটুকু সময়েই তিনটে গুলি ছুঁড়ল। তার লক্ষ্য ছিল গাড়ির চাকা নষ্ট করা। এই সময় পুলিশটা রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়ল দরজায় দাঁড়িয়ে। ওপর থেকে ছোঁড়ার জন্যেই সম্ভবত গাড়ির ঠিক মাথায় গুলিটা লাগল।

যতটা সম্ভব স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিল সুদীপ। ন্যাশনাল লাইব্রেরির সামনে আসার পর সে একটু ধাতস্থ হল। আনন্দ বলল, আস্তে চালা। আমাদের এই গাড়ির নাম্বার একটা লোক নোট করেছে নিশ্চয়ই। তার ওপর জোরে চালালে পুলিশ এমনিতেই নজর করবে।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এই গাড়ি ছেড়ে ট্যাকসি নিবি?

না। ট্যাকসি নিয়ে কোন লাভ হবে না। সোজা পার্ক সার্কাসের দিকে চ। বাইপাস দিয়ে গিয়ে সন্ট লেক থেকে ভি আই পি ধর।

আনন্দকে এই মুহূর্তে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। তার চোখ জ্বলছিল, কণ্ঠস্বর অসম্ভব স্থির।

কল্যাণ আর কৌতূহল দমন করতে পারল না। জিজ্ঞাসা করল, কি হল ভেতরে?

আনন্দ কল্যাণের দিকে চট করে তাকাল, লোক দুটোকে আমি সরাসরি গুলি করে মারলাম। দুটো ভণ্ড বদমাস, মানুষের শত্রু। জানিস, গুলি করতে আমার হাত একটু কাঁপেনি।

সেম টু মি। সুদীপ হাসল, ছারপোকা মারতেও এর চেয়ে বেশি অস্বস্তি হয়।

কল্যাণ জিভ দিয়ে একটা শব্দ করল, শুধু আমিই কিছু করতে পারছি না। শালা এই হাতটা।

জয়িতার গলা শোনা গেল, আমিও কিছু এখনও করতে পারিনি কল্যাণ। আমাকে বাদ দিচ্ছিস কেন?

আনন্দ বলল, করার সময় এলেই তোরা করবি। কল্যাণ, তোদের এখন আমরা ওই রেস্ট হাউসে নামিয়ে দিয়ে চলে যাব। এখন থেকে তোরা খুব শান্ত ভদ্রলোক। কোনরকম টেনশন রাখবি না। অথবা উত্তেজিত হয়ে এমন কিছু করবি না যাতে তোদের ওপর লোকের নজর পড়ে।

কল্যাণ বিরক্ত হল, তুই শুধু আমাকে বলছিস কেন? আমার সঙ্গে জয়িতাও থাকছে।

আনন্দ বলল, জয়িতার মাথা অনেক ঠাণ্ডা। তাছাড়া যে কোন পরিবেশে ও মানিয়ে নিতে পারে। কিছু মনে করিস না, যার যা প্রশংসা প্রাপ্য তা করছি। তোদের কাছে কোন অস্ত্র আছে?

জয়িতা হাত বাড়িয়ে রিভলভার আর গ্রেনেড এগিয়ে দিল আনন্দর দিকে। তারপর বলল, শুধু জামাকাপড় আর ওষুধপত্র রইল।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোর উইগটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিস?

না। ওটা বিশ্রী। দিনের বেলায় সবাই বুঝতে পারবে ওটা উইগ। আমি ভাবছি, এয়ারপোর্টে রিপোর্টিং টাইমে পৌঁছে যখন ভেতরে ঢুকব তখন কল্যাণের থেকে আলাদা থাকব। যেন কেউ কাউকে চিনি না। একদম বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে তবে কথা বলব। জয়িতা জানাল।

আনন্দ মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। সুদীপ, ওদের হাজার টাকা দিয়েছিস?

সুদীপ বাইপাসের খোলা রাস্তায় তখন স্পীড বাড়াচ্ছিল। সেই অবস্থায় মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

আনন্দ বলল, রেস্ট হাউসের বিল মিটিয়ে টাকাটা দুটো ভাগ করে দুজনের কাছে রেখে দিস। তোদের টিকিটের নামগুলোই রেস্ট হাউসে বলবি। জামসেদপুর থেকে আসছিস, দার্জিলিং যাবি।

ওরা কেউ কথা বলছিল না। দূরে সল্ট লেকের আলোগুলো হীরের মত জ্বলছে। ডান হাতে স্টেডিয়ামটাকে রেখে শেষ পর্যন্ত ভি আই পি রোডে উঠে এসে গতি কমাল সুদীপ। একটা পুলিশ ভ্যান ঠিক মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। অত্যন্ত ভদ্রভাবে ওরা এয়ারপোর্টের দিকে বাঁক নিল। মিনিট দশেক বাদেই রেস্ট হাউসের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল সুদীপ। আনন্দ ইশারা করতে জয়িতা একটা হাত ওর কাধে দুইয়ে বলল, গুড নাইট!

সুদীপ বলল, আমি ওয়েট করছি, বুকিং পেলি কিনা,—ঠিক আছে, তিন মিনিটের মধ্যে না এলে বুঝব ঘর পেয়ে গেছিস।

কল্যাণ আর জয়িতা পাশাপাশি হেঁটে গেল গেট পেরিয়ে মোরামের পথ বেয়ে। রেস্ট হাউসের সাইনবোর্ডের নিচ দিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। তিনের বদলে চার মিনিট অপেক্ষা করল সুদীপ। তারপর ইঞ্জিন চালু করল।

 

বোলপুর স্টেশনের গায়ে যখন ওরা গাড়ি থেকে নামল তখন সকাল আটটা। পথে দুবার গাড়িটা গোলমাল করেছিল। এখন আর হাতের ছাপ মোছর কোন চেষ্টা করল না কেউ। ব্যাগগুলো নিয়ে সোজা স্টেশনে ঢুকে টিকিট কাটল নিউ জলপাইগুড়ির। পনেরো মিনিটের মধ্যেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এখানে আসবে। প্রচণ্ড ক্লান্তি লাগছিল সুদীপের। সারারাত বিভিন্ন রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে, অকারণে থামিয়ে নার্ভের ওপর খুব চাপ গেছে। এখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, চা খাবি?

সুদীপ মাথা নাড়ল, শোব। একটা জায়গা চাই।

ওরা প্রায় কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর ট্রেনটা এল। ট্রেনে উঠে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সুদীপ। গাড়িটা খুব ভোরে হাওড়া থেকে ছাড়ে বলেই বোধহয় এত খালি। গদিওয়ালা একটা সিটে শুয়ে পড়ল সুদীপ। ব্যাগগুলো সিটের তলায় ঢুকিয়ে জানলার কাছে বসতেই ট্রেনটা ছাড়ল। আনন্দর খুব চিন্তা হচ্ছিল কল্যাণের জন্যে। যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে! একবার এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলে মনে হয় ভয়ের কিছু থাকবে না। নিজেকে বোঝাল সে।

চা-ওয়ালা চা নিয়ে এসেছিল। সুদীপ নড়বে না জেনে এক ভঁড় কিনে সামনে তাকাতেই সে দেখতে পেল উলটোদিকের ভদ্রলোক কাগজ ভাঁজ করে রেখে চোখ বন্ধ করলেন। একটু ইতস্তত করে সে বলল, আপনার কাগজটা একটু দেখতে পারি?

লোকটা মুখ নাচাতে সে কাগজটা টেনে নিল। আজ ভোরে হাওড়া স্টেশনে কিনেছেন ভদ্রলোক। প্রথম পাতায় বিশাল অক্ষরে লেখা, অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে মন্ত্রী নিহত। দেহরক্ষীরও মৃত্যু। তারপর দারুণ চাঞ্চল্যকর বিবরণ ছাপা হয়েছে। সমস্ত রাজনৈতিক দল এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছেন। অনুমান করা হচ্ছে মন্ত্রীর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ এই কাজ করেছে। আততায়ীরা গ্রেনেড স্টেনগান ব্যবহার করেছে। তারা সংখ্যায় সাত-আটজন ছিল। গাড়ির যে নাম্বার পাওয়া গেছে তার মালিককে মধ্যরাত্রে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। এর পাশে বক্স করে ছাপা হয়েছে, সম্প্রতি একটি কাগজে মন্ত্রী এবং তার দেহরক্ষীর নামে কিছু অভিযোগ ছাপা হয়েছিল। আততায়ীরা খবরের কাগজের রিপোর্টারের ছদ্মবেশে প্রবেশ করে। একথা অনুমান করা অন্যায় হবে না, প্যারাডাইস এবং বড়বাজারের ঘটনার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কোন মিল থাকতে পারে। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে উক্ত এলাকায় প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।

আনন্দ ধীরে ধীরে কাগজটা ভাজ করে ভদ্রলোকের পাশে রেখে দিল। এই ভদ্রলোক যদি নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠক হন তাহলে সহজেই তাদের চিনে ফেলতে পারেন। এখান থেকে সরে বসতে হবে এমন জায়গায় যেখানে বাঙালি ধারেকাছে নেই। সুদীপটাকে তুলতে হবে নিঃশব্দে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. টেলিফোনটা বাজছিল
২. ০২. জয়িতার সঙ্গে কথা
৩. ০৩. সুদীপকে ছেড়ে দেবার পর
৪. ০৪. ঘুম থেকে উঠেই কল্যাণের মনে হয়েছিল
৫. ০৫. বিছানায় গা এলিয়ে
৬. ০৬. অপারচুনিস্ট
৭. ০৭. ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে
৮. ০৮. ব্যাগ থেকে গ্লাভস বের করে
৯. ০৯. চাপা গলায় কল্যাণ বলল
১০. ১০. ভোরবেলায় কলকাতার রাস্তা
১১. ১১. শ্মশান থেকে বাড়িতে ফিরে
১২. ১২. ঘুম ভাঙল একটু বেলা করে
১৩. ১৩. ব্যাপারটা বেশ মজার
১৪. ১৪. সীতা রায় দুই ভ্রূ এক করে
১৫. ১৫. সকাল বেলায় আনন্দ আর কল্যাণ এল
১৬. ১৬. সত্যনারায়ণ পার্কের ঠিক উলটোদিকে
১৭. ১৭. ট্যাকসি দাঁড় করিয়ে
১৮. ১৮. সুদীপ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিল
১৯. ১৯. খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে
২০. ২০. বড়বাজারে উগ্রপন্থীদের আক্রমণ
২১. ২১. জয়িতা দরজায় দাঁড়িয়ে
২২. ২২. অবনী তালুকদার বলছিলেন
২৩. ২৩. নানুভাই তখন তিনজন লোকের কাছে
২৪. ২৪. ঘুম থেকে উঠে সুদীপ বেরিয়ে গিয়েছিল
২৫. ২৫. চারটে পিঠে-বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাগে
২৬. ২৬. আজ কলকাতার প্রতিটি খবরের কাগজ
২৭. ২৭. শুকনা পর্যন্ত গাড়ি ছুটেছিল
২৮. ২৮. সুখিয়া পোখরিতে জিপ থামেনি
২৯. ২৯. ঘোড়ার নালের মত রাস্তাটায় বাঁক
৩০. ৩০. পাখিরা যেমন
৩১. ৩১. মাঝরাতের পর আকাশে
৩২. ৩২. দেবতার মূর্তি নিয়ে
৩৩. ৩৩. প্রথম চোখ মেলল জয়িতা
৩৪. ৩৪. যতটা সাহস এবং উৎসাহ
৩৫. ৩৫. ঠায় সাত ঘণ্টা এক জায়গায়
৩৬. ৩৬. মানুষগুলো নেমে যাচ্ছে নিচে
৩৭. ৩৭. সুদীপের মাথায় ব্যাপারটা
৩৮. ৩৮. কল্যাণ যখন ডাক্তারের গেট পেরিয়ে
৩৯. ৩৯. গত রাত হাওয়ার রাত ছিল
৪০. ৪০. জয়িতা হতভম্ব
৪১. ৪১. এখন দুপুর
৪২. ৪২. চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল
৪৩. ৪৩. রোবট দ্যাখেনি জয়িতা
৪৪. ৪৪. দুপুর না গড়াতেই এখানে অন্ধকার
৪৫. ৪৫. সারারাত ঘুমোতে পারেনি জয়িতা
৪৬. ৪৬. দরজা খুলতেই কাটার চাবুকের আঘাত
৪৭. ৪৭. শীত এখন তুঙ্গে
৪৮. ৪৮. দুবার বরফ গলে গেল
৪৯. ৪৯. ওরা ফিরে এল দিন আটেক বাদে
৫০. ৫০. লা-ছিরিঙ আর জয়িতা
৫১. ৫১. নবজাতকের সুতীব্র চিৎকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন