৩২. দেবতার মূর্তি নিয়ে

সমরেশ মজুমদার

দেবতার মূর্তি নিয়ে কাহুন গেলেন মন্দিরে। পাহাড়ের গায়ে অনেকটা আধাগুহার চেহারার মন্দির। এই বিকেলে তার ভেতরে ঘন ছায়া থাকায় সবটাই দৃশ্যমান নয়। তাপল্যাঙের মানুষ এখন খুশীতে ডগমগ। কেউ লাফাচ্ছে কেউ অকারণে চিৎকার করছে। ওরা চারজন দেখল এরই ফাঁকে সেই অসুস্থ লোকটিকে চোখের আড়ালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। লোকটা ওই মূর্তি চুরি করে যখন পালিয়েছিল তখন বিচারে শাস্তি যা হবে তা কল্পনা করতে অসুবিধে হল না।

এখন চোখের সামনে যে মানুষগুলো হইচই করছে তাদের পিছন থেকে দেখলে নেপালি বলে কিছুতেই মনে হবে না। ওরা বাঙালিদের থেকেও লম্বা। মুখে মঙ্গোলিয়ান ছাপ স্পষ্ট। অনেকটা তিব্বতীদের সঙ্গে সিকিমিজ চেহারা মিশলে এই রকম চেহারা হয়। অথচ ওরা নেপালির কাছাকাছি ভাষায় কথা বলে। মানুষগুলো অবশ্যই দরিদ্র, এদের পোশাকে অবশ্যই সেটা স্পষ্ট। পাহাড়ি মানুষের একটা মজবুত শারীরিক গঠন থাকে কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের দেখে বোঝা যাচ্ছিল নিয়মিত আহারের সংস্থান হয় না। অথচ দেবতার মূর্তি পাওয়ার পর থেকেই এদের উচ্ছ্বাস দেখার মত। সেখানে কোন আড়ষ্টতা নেই। এই সময় ওরা লক্ষ্য করল কিছু কিছু মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। বিস্মিত চোখ মেলে তারা দাঁড়িয়ে আছে দূরে, কাছে আসছে না কেউ। ক্রমশ ভিড়টা এদিকে বাড়তে লাগল। আনন্দরা পা ছড়িয়ে বসেছিল। অত্যন্ত ক্লান্তিতে বোধহয় খিদেও চলে যায়। আনন্দ এবার গ্রামের মোড়লকে আশা করছিল। সেই লোকটা এসে নিশ্চয়ই খুব জেরা করবে। করুক। কিন্তু এখন তাদের একটা আশ্রয় চাই। চোখের সামনে ছড়ানো পাহাড়ের গায়ে যে কাঠের বাড়িগুলো সেখানে কি খালি ঘর আছে? কারণ মানুষের সংখা অনুযায়ী যে বাসস্থান আশা করা যায় তা চোখে পড়ছে না। আনন্দ একটি লোককে এগিয়ে আসতে দেখল। কাছাকাছি হতে পালদেমকে চেনা গেল।

পালদেম বলল, অন্ধকার নেমে এলে অসুবিধে হবে। তোমরা আজ যেখানে থাকবে সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছি চল। এখানে অন্ধকার নেমে এলে কেউ ঘরের বাইরে যায় না। তোমরাও নিয়মটা মেনন।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, নিয়মটা হয়েছে কেন? অন্ধকারে বাইরে কি হয়?

পালদেম মাথা নাড়ল, কি হয় আমরা জানি না। তবে আমাদের বাপঠাকুর্দারা যেত না, আমরাও যাই না।

পালদেম আরও জানাল মালপত্র ওরা এখানেই রেখে যাক, গ্রামের লোক পৌঁছে দেবে। কথাটা ওদের খুশী করলেও আনন্দ বিশেষ ব্যাগটা সঙ্গে নিল। কারণ যারা বহন করবে তারা যদি সচেতন না থাকে তাহলে বিস্ফোরণ অসম্ভব নয়। ওরা পালদেমের পেছনে হাঁটছিল। গ্রামবাসীরা কাছে আসছে না। বেশ দূরত্ব রেখে ওরা অনুসরণ করছিল। হাঁটতে হাঁটতে পালদেম বলল, এই গ্রামে কখনও বিদেশীদের রাত কাটাতে দেওয়া হয়নি। যেহেতু তোমরা আমাদের উপকার করেছ নিজেদের অজান্তে হলেও, আর একজন মেয়ে তোমাদের সঙ্গে রয়েছে তাই তোমাদের থাকতে দিচ্ছি আমরা। কিন্তু কাল সকালেই চলে যাবে তোমরা। ওয়ালাং চাঙে যাওয়ার পথ আমি তোমাদের চিনিয়ে দেব।

ওরা কিছুটা ঢালুতে নেমে আবার উঠতে লাগল। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, এই গ্রামের প্রধান কে? তুমি?

পালদেম মাথা নাড়ল, এখানে কোন প্রধান ট্রধান নেই। আমাদের নিজস্ব রীতিনীতি আছে, আমরা সেইমত চলি। কেউ যদি সেই নিয়ম না মানতে চায় তাহলে তাকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়। আসলে আমরা খুব গরীব মানুষ। গরীব মানুষদের আবার প্রধান থাকে নাকি!

গ্রামের ঠিক শেষ সীমায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ওদের নিয়ে এল পালদেম। পাহাড়ের গায়ে কাঠ গুঁজে এটিকে তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য বাড়ি বলতে যা বোঝায় তার ধারেকাছে নয় আস্তানাটা। কাঠের মেঝে ভেঙে গেছে। দেওয়ালটায় অনেকখানি ফাঁক। তবে ছাদটা সম্ভবত অটুট আছে। কোন আসবার নেই, কিন্তু একটা বোঁটকা গন্ধ সমস্ত ঘরে চেপে বসে আছে। সুদীপ দেখেশুনে বলল, এখানে থাকার চেয়ে তাঁবু টাঙিয়ে থাকা ঢের ভাল। কি গন্ধ, বাপরে বাপ!

আনন্দ বলল, বাইরে তাবুতে শুলে ঠাণ্ডা সহ্য হবে না। একবার জোরে বাতাস বইতে শুরু করলেই টের পাবি। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এখানেই কোনমতে কাজ চালাতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল এখানে কোন বাথরুম বা ল্যাট্রিন নেই। স্নান করার প্রশ্নও ওঠে না এই ঠাণ্ডায়। কিন্তু ও দুটোর জন্যে।

ওরা যখন এইসব আলোচনা করছিল তখন ওদের মালপত্র পৌঁছে গেল। দুটো লোক অবলীলায় ওইসব ওজন বয়ে নিয়ে এল অথচ তাদের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়। কল্যাণ পালদেমকে বলল, এখানে জল পাওয়া যাবে কোথায়? আমরা বাঙালিরা খুব জল খাই।

পালদেম কল্যাণকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। সেখান থেকেই দেখা যায় একটা ছোট জলের ধারা নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের শরীর বেয়ে। সে জিজ্ঞাসা করল, এই ঘরে কে থাকত?

কেউ না। গ্রামের কারও অসুখ হলে এই ঘরে এসে থাকে। আবার বিয়ের পর যতদিন নতুন ঘর তৈরি না করতে পারে ততদিন এই ঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়। তোমরা অতিথি বলে এই ঘরে থাকতে দেওয়া হল। ঠিক আছে, আমি এখন যাচ্ছি। তোমাদের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। আমার বাড়ি থেকে তোমাদের খাবার দিয়ে যাবে। আমরা খুব গরীব। ভাল খাবার দিতে পারব না। সত্যি বলতে কি, তোমাদের এক বেলা খাওয়াচ্ছি বলে আমাদের একজনের চার বেলার খাওয়া কমে যাবে। পালদেম যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। তখনও অন্তত জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে খানিকটা দূরে বসে এই বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল। পালদেম তাদের চিৎকার করে কিছু বললেও কোন প্রতিক্রিয়া হল না।

কল্যাণ পালদেমকে ডাকল, শোন, তোমাদের খাবার কমে যাবে না। আমরা তোমাকে টাকা দিচ্ছি।

টাকা? এখানে টাকা দিয়ে কি হবে? টাকা দিয়ে জিনিস পাওয়া যায় চ্যাঙথাপুতে। সেখানে যেতে গেলে অনেক ঝামেলা। তা ছাড়া অতিথিদের কাছ থেকে টাকা নিলে লোকে আমায় বলবেটা কি! ও হ্যাঁ, তোমাদের সঙ্গে কি তোম্বা কিংবা ছাং আছে? যদি দরকার হয় তাহলে সেটা পাঠিয়ে দিতে পারি।

পালদেম প্রস্তাবটা জানাতে সুদীপ বেরিয়ে এল, হ্যাঁ, ওগুলো দিলে তো খুব ভালই হয়।

পালদেম চলে গেলেও দর্শকরা নড়ল না। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, জিনিস দুটো কি রে?

মদ। একদম দিশি মতে তৈরি। সুদীপ নিচে নামল। ওপাশে খুব দ্রুত কুয়াশা আসছে। হিমালয়ের কোন চুড়ো দেখা যাচ্ছে না। যেন ভালুকের মত সন্ধ্যা নেমে আসছে।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কল্যাণ চিৎকার করল, এই মদ খাবি? হাই অলটিচুডে ড্রিঙ্ক করলে হার্ট অ্যাটাকড় হয়, জানিস না?

তাহলে এরা কেউ বেঁচে থাকত না। কথাটা বলে কাছে যেতে বাচ্চাগুলো উঠে দাঁড়াল। ওদের সঙ্গে যে দুজন বয়স্ক রয়েছে তাদের দিকে তাকাতে গলগণ্ড দেখতে পেল সুদীপ। বেশি বয়স্কজনের গলায় ফুটবলের মত ঝুলে আছে। দ্বিতীয়জনের বোধ হয় সবে শুরু হয়েছে। বাচ্চাগুলোর প্রত্যেকের পা খালি। এবং সেগুলো ফেটে এমনভাবে শক্ত হয়ে গেছে যে দেখলে শিউরে উঠতে হয়। তারপরেই সুদীপের চোখ পড়ল মেয়েটার ওপরে। মুখের একপাশ থেকে বিশ্রী ঘা প্রায় গলা পর্যন্ত নেমেছে। মাঝে মাঝে রস গড়াচ্ছে তা থেকে। অথচ মেয়েটির মুখের গড়ন খুব মিষ্টি। অন্য পাশটায় তাকালে মুগ্ধ হতে হয়। কিন্তু মুখ ফেরালেই বীভৎস ক্ষত মেয়েটিকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। অথচ মেয়েটি এমন সরল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে যে ওই ক্ষতের কষ্ট ওকে পীড়া দিচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সে আঙুল তুলে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মুখে ওটা কি হয়েছে?

ব্যবধান বড় জোর বারো ফুটের, প্রশ্নটা শোনামাত্র মেয়েটির চোখের কৌতূহল উড়ে গেল। এবং সেই সঙ্গে অন্য বাচ্চাদের হাসির শব্দ কানে এল। সুদীপ আবার জিজ্ঞাসা করল, কতদিন হয়েছে ওটা? এবার মেয়েটি এমনভাবে মুখ ফেরাল যাতে ক্ষত না দেখা যায়। একটি বাচ্চা নেপালিতে বলে উঠল তড়বড় করে। সুদীপ কথাগুলোর পুরোটা বুঝতে না পারলেও অনুমান করল বাচ্চাটা ক্ষত সম্পর্কেই বলছে এবং সেই বলার মধ্যে বেশ ঠাট্টা মেশানো রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য বাচ্চারাও হেসে উঠল শব্দ করে। মেয়েটি কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তারপর চিৎকার করে বাচ্চাগুলোকে ধমক দেবার চেষ্টা করল। বাচ্চারা হঠাৎ তাকে ঘিরে নাচতে লাগল ছড়া কাটতে কাটতে। মেয়েটি যখন কেঁদে ফেলেছে তখন সুদীপ মর্মোদ্ধার করল। বাচ্চারা বলছে, পাহাড় থেকে ভালুক এসে ওর মুখে চুমু খেয়েছে।

সুদীপ এগিয়ে গিয়ে খপ করে মেয়েটার হাত ধরে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বেঁকেচুরে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল। সেটায় সক্ষম হতে না পেরে সে মাটিতে বসে পড়ে পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করল। দৃশ্যটা দেখে অন্য বাচ্চারা ঠাট্টা বন্ধ রেখে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সুদীপের জেদ চেপে গিয়েছিল। নিজের পায়ের ব্যথা সামলে সে মেয়েটাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু মেয়েটা প্রায় শুয়ে পড়ার ভঙ্গি করতে তা সম্ভব হচ্ছিল না। এই চিৎকার চেঁচামেচিতে আনন্দরা বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। জয়িতা নেমে এল কাছে, ওকে ধরেছিস কেন? কি করেছে ও? ছেড়ে দে সুদীপ ওকে। ইস, ওর মুখে কি হয়েছে?

পুরুষের পোশাকে মেয়েলি গলা শুনে মেয়েটি এক মুহূর্ত স্থির হল। তখনও তার হাত সুদীপের মুঠোয় ধরা। সুদীপ বলল, এরকম বীভৎস ঘা কোথাও দেখেছিস? এখনই ওষুধ না পড়লে মেয়েটা মরে যাবে।

তা ঠিক, কিন্তু ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তুই ওষুধ দিবি ধরে বেঁধে! জয়িতা খেপে গেল, আমরা এখানে একটা রাত কাটাতে এসেছি, ওদের জন্যে আমাদের না ভাবলেও চলবে।

ঠিক তখনই একটি মহিলার পিছু পিছু আরও কয়েকজনকে ছুটে আসতে দেখা গেল। সবাই চিৎকার করছে। ওদের ভঙ্গি দেখে সুদীপ হাত ছেড়ে দেওয়ামাত্র মেয়েটি ছিটকে সরে গিয়ে দৌড়তে লাগল। মহিলার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল মেয়েটা। সঙ্গে সঙ্গে মারমুখী হয়ে মহিলা তার দলবল নিয়ে ছুটে এল। ওরা চিৎকার করে যে দ্রুত কথা বলছে তা যে গালাগালি এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। পারলে মহিলা যেন সুদীপকে মেরেই ফেলে। জয়িতা ওকে আটকাবার চেষ্টা করছিল। আনন্দ সুদীপকে বলল, চটপট ঘরে চলে যা। ব্যাপারটার অন্যরকম মানে হয়েছে ওদের কাছে।

আরও লোক ছুটে আসছে দেখে কল্যাণ বারান্দায় ডেকে আনল সুদীপকে। নবাগতদের মধ্যে পালদেমকেও দেখা গেল। সে উত্তেজিত মহিলার কাছে অভিযোগ শুনে আনন্দর সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, ওই লোকটা এতটুকু বাচ্চার হাত ধরে টানছিল কেন? ও তো এখনও বাচ্চা, মেয়েও হয়নি। তোমাদের সঙ্গেই তো একজন মেয়ে আছে তাহলে এই মতলব হল কেন?

আনন্দ পালদেমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজেকে সংবরণ করল। এখন সব চিৎকার থেমে গেছে। জমে ওঠা জনতা সাগ্রহে অপেক্ষা করছে একটা বিহিতের জন্যে। আনন্দ লক্ষ্য করল পালদেমের মুখের চেহারা পালটে গেছে। অপমানিত এবং নিষ্ঠুর দেখাচ্ছে তাকে এখন। উত্তেজিত পালদেম বলল, তোমাদের কাছে বন্দুক আছে বলে ভেবেছ যা ইচ্ছে করবে? ওই বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকাওনি? ঘাটা গলা ছাড়িয়ে গেলেই ও মারা যাবে। এর আগে ওই অসুখে তিনজন মরে গেছে। এসব দেখেও তোমাদের ইচ্ছে হল?

জয়িতা এগিয়ে এল পালদেমের সামনে, তোমরা ওকে ভুল বুঝেছ! মেয়েটা ওরকম বীভৎস ঘা-এ কষ্ট পাচ্ছে দেখেই আমাদের বন্ধু ওকে ডেকেছিল ওষুধ দেওয়ার জন্যে। ওইটুকুনি বাচ্চার অন্য কোন ক্ষতি করার মত মতলব ওর নেই। ওষুধ দিলে যদি মেয়েটার উপকার হয় তাহলে ও মারা যাবে না। এখানে আমাদের কথা আর কে বুঝতে পারে জানি না, কিন্তু ওই বাচ্চাটা ভয় পেয়ে না বুঝে চিৎকার করেছে। আমি তো একটা মেয়ে, আমার কথা তুমি বিশ্বাস করো।

ওষুধ? বাজে কথা! যারা প্রাণ-হত্যা করার জন্যে বন্দুক রাখে তাদের কাছে ওষুধ থাকবে কেন? এসব এখন তোমরা বানিয়ে বলছ। তোমরা, শহরের লোকরা অত্যন্ত ধান্দাবাজ।

এবার আনন্দ কথা বলল, তুমি আমাদের যা ইচ্ছে ভাবতে পার। কিন্তু আমাদের কাছে যে ওষুধ আছে তা দিলে ওই মেয়েটি ভাল হয়ে উঠতে পারে। আজেবাজে কথা না বলে তুমি ওর মাকে জিজ্ঞাসা কর যে আমাদের ওষুধ দিতে দেবে কিনা!

আনন্দর গলার স্বরে এমন একটা কর্তৃত্ব ছিল যে পালদেম কিছুক্ষণ ইতস্তত করল। তারপর সে মহিলার কাছে এগিয়ে গেল। মহিলা তখন মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিল। পালদেম তাকে সব কথা বলে চুপ করে দাঁড়াল। মহিলা প্রথমে দ্রুত মাথা নাড়তে লাগল। আনন্দ সুদীপকে বলল ওষুধের বাটা বারান্দায় নিয়ে আসতে। পালদেম এবার আনন্দর কাছে এসে বলল, ওর মা রাজী হচ্ছে না। বলছে ওষুধ লাগালে ওর মেয়ে আজ রাত্রেই মরে যাবে।

আনন্দ বলল, কি অদ্ভুত কথাটা! তুমি তো বুঝতে পারছ ব্যাপারটা। ওকে বল, ওষুধ না লাগালে তো মেয়েটা আর বেশিদিন বাঁচবে না। আমরা ওর শত্রু নই ও কথা বল। প্রথমে যে ধারণা তৈরি হয়েছে সেটাই মনে থেকে যাবে।

পালদেম বলল, তাও আমি বলেছি। ও বলল আজ রাত্রে মরার চেয়ে যে কদিন বেঁচে থাকে সে কদিনই তো লাভ। তোমরা ওর হাত ধরে টেনে ভাল করেনি। এখন কেউ বিশ্বাস করছে না তোমাদের অন্য কোন মতলব ছিল না। মেয়েটিকে ওর বাবার মত ছাড়া ওষুধ দিতে মা পাঠাবে না।

ওর বাবা কোথায়? তাকে ডাকো। আনন্দর মনে হল এ ব্যাপারে একটি পুরুষকে বোঝানো ঢের সহজ। মেয়েটির ঘা-এ ওষুধ না দিতে পারলে ওদের ধারণা পালটাবে না। তার ফলে আর কোন সাহায্য এই গ্রামে পাওয়া অসম্ভব হবে।

পালদেম বলল, আপনাদের কি দরকার গায়ে পড়ে মানুষের উপকার করার! এখানে যাতে রাত কাটিয়ে চলে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

এই সময় মহিলা চিৎকার করে কিছু বলতে আরম্ভ করল। আনন্দ দেখল একটি কিশোর গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসছে এবং মহিলা তার উদ্দেশ্যেই কথা বলছে। কিশোর কোমরে হাত দিয়ে ওদের কথা শুনল। তারপর চট করে ঘুরে আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর তার গলায় আওয়াজ উঠল। বোঝা যাচ্ছিল সে পালদেমকে গালাগালি করছে। বোধহয় আক্রান্ত হতেই পালদেম আত্মরক্ষার জন্যে পালটা গলা তুলল। কিছুক্ষণ এইরকম চলার পর পালদেম বলল, ওরা কেউ তোমাদের কথা বিশ্বাস করছে না। কিভাবে ওই মেয়েটির মুখের ঘা সারাতে চাইছ তোমরা? ওর শরীরে হাত না দিয়ে যদি সেটা সম্ভব হয় তাহলে–।

আমরা ওর শরীরে হাত দেব না। আনন্দ চটপট ওকে থামিয়ে বলল, ওর ভাইকে বল কাছে নিয়ে আসতে।

পালদেম বলল, কাকে ভাই বলছ? ছেলেটি মেয়েটার বাবা। না জেনে কোন কথা বলতে যেও না। তারপর সে চিৎকার করে কিশোরের উদ্দেশ্যে কিছু বলল। আনন্দ এতটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।

জয়িতা এগিয়ে এল পালদেমের কাছে, কি যা-তা বলছ! ওইটুকু ছেলে ওই মেয়ের বাবা? ওরা তো নির্ঘাৎ ভাইবোন!

পালদেম এবার হাসল, দেখাচ্ছে বটে তাই কিন্তু এটাই সত্যি। ওরা মা মেয়ে আর এই ছেলেটা হল মেয়েটির মায়ের স্বামী। আমাদের কাছে বাপ্যারটা অবাক হওয়ার নয়। যে দেশের যা নিয়ম।

জয়িতার মুখে কথা নেই। সে কোন বিশ্বসেই কাছাকাছি আসতে পারছে না। মহিলার বয়স যদি পঁয়ত্রিশও হয় ছেলেটা যে যোল পার হয়নি তাতে সে নিঃসন্দেহ। অবশ্য পাহাড়ি ছেলেদের বয়স চট করে ধরা মুশকিল কিন্তু এক্ষেত্রে ওকে যুবক ভাবাই যাচ্ছে না।

দেখা গেল পালদেমের কথা শুনে মেয়েটিকে নিয়ে তার মা খানিক এগিয়ে এসে বসেছে। আনন্দ জয়িতাকে নির্দেশ দিতে সে এগিয়ে গেল। জয়িতা কাছে গিয়ে বলল, তুমি ভয় পেও না। আমরা তোমার উপকার করতে চাই। কিন্তু খুব একটা প্রতিক্রিয়া হল না। শুধু মহিলার মুখে এবার একটু হাসি ফুটল। জয়িতা দেখল ক্ষত বেশ পুরোনো এবং তা চামড়ার নিচেও বিস্তৃত হয়েছে বলে তার বোধ হল। আনন্দর কথায় সুদীপ স্টোভ জ্বেলেছে। এই গ্রামে আসামাত্র যে কাণ্ডটা ঘটল তার আতঙ্ক এখনও তাকে ছেড়ে যায়নি। মনে হচ্ছিল লোকগুলো তাকে মেরেও ফেলতে পারে। অথচ সে মেয়েটার অবস্থা দেখে। পাশের ঘরটা থেকে আনা জল গরম করতে গিয়ে তার এবার আরাম লাগছিল। এই ঠাণ্ডায় স্টোভের আগুন খুব আরামদায়ক।

গরম জল হয়ে গেলে জয়িতা খানিকটা তুলল তাতে ভিজিয়ে মেয়েটির মাকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে। এখন সমস্ত গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে দেখছে কাণ্ডটা। পালদেম আরও বিশদ করে বলার পর মহিলা গরম জলে ভেজানো তুলোটা নিয়ে মেয়েটার ক্ষতের ওপর চেপে ধরতে সে পরিত্রাহি চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিল মহিলা। দেখা গেল মেয়েটির তুলোয় চাপা জায়গাটা সাদা হয়ে গেছে। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এল। মেয়েটি আর কিছুতেই রাজী হচ্ছে না তার মাকে কাজ করতে দিতে। জয়িতা গ্লাভস খুলল। তারপর মেয়েটির পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, আমাকে হাত দিতে দাও। যদি একটুও ব্যথা লাগে তাহলে তুমি চলে যেও। মেয়েটি তীব্র দৃষ্টিতে জয়িতাকে দেখছিল। জয়িতা ওর মাথার প্রায় জট পাকানো চুলে হাত বুলিয়ে দিল। পালদেম জয়িতার কথাটা অনুবাদ করে দিলে মেয়েটির চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হল। এবার জয়িতা আবার গরম তুললা তুলে খুব আলতো করে ক্ষতের ওপর বোলাতে লাগল। মেয়েটি কাঠ হয়ে বসেছিল যন্ত্রণার আশঙ্কায়, কিন্তু গরম জলের সংস্পর্শে এবং জয়িতার তর্ক আঙুল তাকে একটু একটু করে আরাম দিচ্ছিল। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। জল ঠাণ্ডা হয়ে আসছে কিন্তু বারংবার তুলো সেখানে ডোবাতে তার রঙ পালটে গেছে। অন্তত সোয়া ইঞ্চি ময়লা পুরু হয়ে আটকে ছিল বিরাট ক্ষতের ওপর। গরম জলে ধোওয়া হয়ে গেলে ক্ষতের চেহারা পালটে গেল। কালো হলদেতে মেশা ক্ষতের বদলে এখন পুরোটা লাল দগদগে হয়ে গেল। জয়িতা আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, সাধারণ ঘা, না রে? পাস বেশি নেই। কি ওষুধ দেব?

আনন্দ একটা টিউব এগিয়ে দিল বাক্স থেকে। এই মলম ঘা শুকিয়ে দেওয়ার কাজ খুব দ্রুত করে। কিন্তু আনন্দ অবাক হচ্ছিল জয়িতাকে দেখে। ওরকম ক্ষতে কি অবলীলায় হাত দিচ্ছে জয়িতা! মেয়েটা যেন ঘেন্না শব্দটার সঙ্গে কখনই পরিচিত নয়। একটু একটু করে মলমটা মেয়েটার ক্ষতের সর্বাঙ্গে ভাল করে লাগিয়ে দিল জয়িতা। মেয়েটি এখনও চুপ করে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, এটা ব্যান্ডেজ করতে তো অসুবিধে হবে। অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে।

সুদীপ জয়িতার কাজ দেখছিল, ব্যাভেজের দরকার নেই। ওকে বুঝিয়ে দে যেন ধুলো না লাগায়।

আনন্দ মাথা নাড়ল, না, ভোলা রাখবি না। আলতো করে ব্যান্ডেজ কর। ব্যাপারটা ওদের চোখের আড়ালে রাখা দরকার। ওর চিকিৎসা হচ্ছে এমন মানসিক স্বস্তি দেওয়া দরকার।

জয়িতা জমাট তুলো ক্ষতের ওপর বিছিয়ে তার ওপরে ব্যান্ডেজ করতে লাগল। গলায় অসুবিধে হল না কিন্তু বিপাক হল মুখের কাছে এসে। শেষ পর্যন্ত মুখের অনেকটাই ঢাকা পড়ল। এবার দর্শকদের মধ্যে হাসি শুরু হল। মেয়েটিকে এখন চেনা যাচ্ছে না এইটেই আলোচ্য বিষয়। রমণী মেয়েটিকে প্রশ্ন করতে সে মাথা নেড়ে না বলল। আনন্দ এবার দুটো ক্যাপসুল দিল পালদেমের হাতে।

মেয়েটিকে অনেক জোরজবরদস্তি করে একটা তখনই খাইয়ে দেওয়া হল। দ্বিতীয়টি আগামী ভোরে ঘুম থেকে উঠে খাওয়াতে বলল কিছু খাবার খাওয়ার পর। তার ভয় হচ্ছিল যার পেটে কোনদিন ওষুধ পড়েনি তার কি প্রতিক্রিয়া হয় কে জানে। তাই ইচ্ছে সত্ত্বেও ডোজ কমিয়ে দিল সে। পালদেম মারফৎ মেয়েটিকে বারংবার সতর্ক করে দেওয়া হল কোন অবস্থাতেই ব্যান্ডেজে হাত না দেয়। যেন ওটা খুলে ফেললেই মেয়েটি মরে যাবে। ব্যাপারটা মিটে যাওয়ার পর মহিলাকে খুব অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল। মা হিসেবে বোধহয় সে বুঝতে পারছিল যা করা হল তাতে তার মেয়ের উপকারই হবে। ভিড় এখন মেয়েটিকে ঘিরে। সবাই ওর ব্যান্ডেজে আঙুল ছোঁয়াতে চাইছে আর সে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হঠাৎ দেখা গেল কয়েকজন বৃদ্ধ এবং মাতব্বর ব্যক্তিকে নিয়ে কাহুন এগিয়ে আসছেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাহুন মেয়েটির মাকে কিছু জিজ্ঞাসা করাতে সে গড়গড় করে বলতে লাগল। কাহনের মুখে সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের অনেকগুলো ভাজ ফুটে উঠল। তিনি ঝুঁকে মেয়েটির সঙ্গে কথা বললেন। মেয়েটি বারংবার মাথা নাড়তে আরম্ভ করল। তারপর কাহুন পালদেমকে প্রশ্ন করল জড়ানো গলায়। পালদেম সেটা আনন্দকে শোনাল, কান জিজ্ঞাসা করছেন, কেন মেয়েটির মুখ ঢেকে রাখা হয়েছে? এটা কি কোন মন্ত্রের কারণে?

জয়িতা হেসে ফেলতে আনন্দ তাকে হাত তুলে থামাল। তারপর বলল, ওতে তাড়াতাড়ি অসুখ সারে।

পালদেম সেটা জানিয়ে দিতে কাহুন আবার প্রশ্ন করলেন। সেটা পালদেম জানাল, কাহুন জিজ্ঞাসা করছেন তোমাদের সঙ্গে আসা এই লোকটির হাতেও কি এইরকম ঘা হয়েছে?

কল্যাণ চুপচাপ শুনছিল। প্রশ্নটা শোনামাত্র তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, যাঃ শালা!

আনন্দ কল্যাণের ব্যাপারটা বলল। কান শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর কিছু একটা ঘঘাষণা করে সদলে ফিরে গেলেন। পালদেম বলল, কান হুকুম দিয়েছেন যতক্ষণ না মেয়েটির মুখ থেকে ওটা না ভোলা হচ্ছে ততক্ষণ তোমাদের এই গ্রামে থাকতে হবে। মেয়েটার কিছু হলে তোমরা দায়ী হবে। তখন তোমাদের নিয়ে কি করা হবে তা পরে চিন্তা করবে গ্রামের মানুষ।

আনন্দর মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, কাহুনের আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু তুমি বলেছিলে এই গ্রামে কোন মোড়ল নেই। মোড়লকে তোমরা কি বল?

পালা। না নেই। কাহুন পালা নয়। কিন্তু কাহুন আমাদের ধর্ম বাঁচিয়ে রাখেন। তাই আমাদের জীবন সম্পর্কে তিনি যা বলেন তা আমরা শুনি। তোমরা এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করো না। সেরকম হলে তোমাদের বিপদ হবে আর আমিও ছাড়া পাব না। তোমাদের সঙ্গে যে বন্দুক আছে তা আমি গ্রামের লোকদের বলে দিয়েছি। পালদেম চলে গেল। ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কোন মানুষ আর এখানে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। এইসময় হাওয়া শুরু হল। সান্দাকফুতে যে বাতাস ওরা পেয়েছিল তার থেকে অনেক ধারালো, এত গরমজামা প্রায় ভেদ করে ফেলছে। ওরা চটপট ঘরে ফিরে এল। মোমবাতি জ্বেলে আনন্দ আর সুদীপ প্রথমে হাত লাগাল ফাঁকগুলো ঢাকতে। মোটামুটি ভদ্রস্থ করার পরও ঘর থেকে গন্ধটা দুর হল না। সুদীপ আবার স্টোভ জ্বেলেছে। চায়ের জল গরম করার সময় ওরা স্টোভটাকে ঘিরে বসল। কল্যাণ বলল, অতিরিক্ত স্মার্ট হলে কি হয় তার প্রমাণ আজ সুদীপ দিল। আর একটু হলে গণধোলাই-এ প্রাণ বেরিয়ে যেত।

সুদীপ কিছু বলতে গিয়েও বলল না। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কেরোসিন তেল কতটা আছে?

সুদীপ বলল, আর একবার ভরা যাবে। ওকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল।

আনন্দ বলল, সুদীপ কাজটা না করলে কাল সকালে ওরা আমাদের চলে যেতে বাধ্য করতো। এখন ভাগ্যগুণে কদিন সময় পাওয়া গেল। মেয়েটার ব্যান্ডেজ তাড়াতাড়ি খোলা যাবে না।

কল্যাণ আঁতকে উঠল, তুই এখানেই থেকে যাবি নাকি? আমাদের তো ওয়ালাং চাঙে যাওয়ার কথা।

আনন্দ উত্তর দিল, ওয়ালাং চাও যে ফুল ছড়ানো হবে তা তোকে কে বলল? যে কোন নতুন গ্রামে গেলে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে ভাব জমাতে হয় থাকতে গেলে। এটা এখানে শুরু হয়েছে।

কল্যাণ বলল, শুরু হয়েছে? ওরা প্রথমে আমাদের মারতে এল, তারপর শাসিয়ে গেল। আর তুই বলছিস–?

ঠিকই বলছি। এই গ্রামটার নাম আমি ম্যাপে দেখিনি। আমাদের পক্ষে এখানে থাকাটাই সুবিধেজনক। এর আগে কোন বিদেশী এখানে রাত কাটায়নি। খুব কম মানুষের চ্যাঙথাপু পর্যন্ত নিয়মিত যাতায়াত আছে। আমাদের খবর ফালুটের পুলিশ ফাড়িতে পৌঁছাতে সময় লাগবে, আর পেীছালেও তারা তাদের এক্তিয়ারের বাইরে আসবে বলে মনে হয় না। আমরা বিদেশী রাষ্ট্রে রয়েছি এখন। সুদীপের বাড়ানো চায়ের কাপ আর বিস্কুট নিয়ে চুমুক দিল আনন্দ। দিয়ে বলল, আঃ, অমৃত।

কল্যাণ চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল, চিনি লাগবে।

ওরা চুপচাপ কিছুক্ষণ কাটাল। চা বিস্কুট খাওয়ার পর খিদেটা যেন আরও চাগিয়ে উঠেছে। স্টোভ নিবিয়ে ফেলার পর ঠাণ্ডাটা আরও বেড়ে গেল। কাঠের দেওয়ালে বাতাসের শব্দ হচ্ছে। কান পাতলে মনে হয় যেন বুনো মোষ তেড়ে আসছে। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল আচমকা, আমরা কবে ফিরে যাচ্ছি?

আনন্দ অবাক হয়ে বলল, কোথায়!

কল্যাণ বলল, কলকাতায়। আমরা চিরকাল এখানে থাকতে আসিনি।

আনন্দ অন্যমনস্ক গলায় বলল, যাব, তবে এখনই নয়।

কল্যাণ বলল, এখানে থাকলে আমাদের পুলিশের ভয় থাকবে না, জেলে যেতে হবে না। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডায় থাকলে তো মরেই যেতে হবে। পুলিশ যদি সমস্যা হয় তাহলে আমরা চুপচাপ কলকাতায় ওসব না করে থেকে যেতে পারতাম।

আনন্দ বলল, মাথা ঠাণ্ডা রাখ কল্যাণ। তুই জয়িতার কাছে আফসোস করেছিলি আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিস বলে। আমরা সবাই জানতাম যা করেছি তা করে দেশের অবস্থা পালটানো যায় না। কিন্তু আমরা নাড়া দিতে চেয়েছিলাম। সাধারণ মানুষ যদি আমাদের কাজকর্মে থ্রিলারের আনন্দ পায় সেটা আমাদেরই অক্ষমতা। কিন্তু এসব আমরা জেনেশুনেই করেছিলাম। তোকে কেউ জোর করেনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে না। কলকাতাকে একটু শান্ত হতে দে। ধরা পড়লে আমাদের তো কিছুই করার থাকবে না। ধর যদি কলকাতায় ধরা পড়তাম তাহলে আজ বিকেলে এই মেয়েটির চিকিৎসা হত না। এভাবে সমস্যা বাড়িয়ে দিস না।

কল্যাণ এসব কথা শোনার পরও খুব সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল না। সে ঠাট্টার গলায় বলল, অসুখে সেবা করাই যদি লক্ষ্য হয় তাহলে ওসব করার কি দরকার ছিল, মাদার টেরেসার সঙ্গে কাজ করলেই তো হত।

হঠাৎ জয়িতা প্রশ্ন করল, তুই তো খুব বড় বড় কথা বলছিস। আজই যদি আমরা কলকাতায় ফিরে গিয়ে কোন অ্যাকশান করি এবং সেটা করতে গিয়ে আমাদের একজন মারা যায় এবং সেই সম্মানে তোকে সম্মানিত করি তাহলে তুই রাজী আছিস?

কল্যাণ বলল, আমাকে কেন?

জয়িতা বলল, দেন স্টপ ইট। খামোকা মেজাজ নষ্ট করে দিচ্ছিস। সুদীপ ভাত রাঁধবি? হেভি খিদে পেয়ে গেছে।

বিকেলের ঘটনাটার পর সুদীপ খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। এখন বলল, নো প্রব্লেম।

আনন্দ মনে করিয়ে দিল, পালদেম খাবার দিয়ে যাবে বলেছে।

জয়িতা বলল, তাহলে ওয়েট কর। আচ্ছা, এরা কি খায়? সোর্স অফ ইনকাম কি?

আনন্দ বলল, চাষ হয় দেখলাম। পাহাড়ে আর কত ফসলই বা হবে? গ্রামের বাইরে যায় না। বোঝাই যাচ্ছে অবস্থা খুব খারাপ। এখানকার জঙ্গলে ফলটলও হয় বলে মনে হয় না। মুরগী আর ছাগল দেখেছি। আমি জানি না এরা কিভাবে বেঁচে আছে।

ওই সময় পালদেম এল। একটা পাত্রেই খাবার এনেছে সে। বোঝা যাচ্ছে ঠায় তারও কাঁপুনি আসছিল। জয়িতা খাবার নিয়ে তাকাল। মারাত্মক দেখতে কয়েকটা রুটি আর তরকারি। তরকারিটা কিসের তা বুঝতে পারল না সে। কোন কথা না বলে পালদেম চলে গেলে ওরা খাবার নিয়ে বসল। আলু বলে যা মনে হয়েছিল তা যে আলু নয় মুখে দিয়েই মালুম হল। এত কুৎসিত স্বাদ ওরা কখনও পায়নি। রুটি ছিড়তেই কষ্ট হচ্ছিল এবং তাতে মোটামোটা দানা রয়েছে। জয়িতা লক্ষ্য করল মন্তব্য করতে করতে সবাই খাবারটা শেষ করল। করে কল্যাণ বলল, এই খেলে আর বাঁচব না।

আনন্দ বলল, কাল থেকে নিজেরাই চেষ্টা করব।

হাওয়ার তেজ আরও বাড়ছিল। এখন ঝড়ের মত শোনাচ্ছে। শীত থেকে বাঁচার জন্যে ওরা ব্যাগের ভেতরে ঢুকে গেল। জয়িতা এবার ট্রানজিস্টারটা বের করল। মোমবাতি নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্ধকারে সে স্টেশন ধরার চেষ্টা করছিল। তিব্বত না চীন বোঝা যাচ্ছে না। হংকং কিনা তাই বা কে জানে। কোন ভারতীয় স্টেশন সে ধরতে পারছিল না। শুধু একটার পর একটা দুর্বোধ্য ভাষার গান বেজে যাচ্ছিল। এবং হঠাৎই সে বাংলা শব্দ শুনতে পেল। বাংলা শব্দ কিন্তু বলার ধরন অন্যরকম। কলকাতা কিংবা ঢাকা নয়। তারপরেই কানে এল বি বি সি-র সংবাদপাঠকের পরিচয়। আন্তর্জাতিক খবর দেওয়ার সময় স্টেশনটা হঠাৎ উবে গেল। নিজেদের কথা শোনার সুযোগ নেই বলে সে রেডিওটা অফ করল। এই সময় কল্যাণ বলল, আনন্দ, কাল আমার হাতের গয়নাটা খুলে দিবি?

আনন্দ বলল, দেব।

আর তখনই ঝড়ের শব্দের সঙ্গে আর একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার মিশে গেল। যেন দূরে এভারেস্টের গায়ে কেউ কাঁদছে থেমে থেমে। সেটা কান্না না আর্তনাদ তা টের পাওয়ার উপায় নেই অবশ্য, কিন্তু সেই অপ্রাকৃত শব্দ ওদের নিঃসাড় করে দিল।

সকল অধ্যায়

১. ০১. টেলিফোনটা বাজছিল
২. ০২. জয়িতার সঙ্গে কথা
৩. ০৩. সুদীপকে ছেড়ে দেবার পর
৪. ০৪. ঘুম থেকে উঠেই কল্যাণের মনে হয়েছিল
৫. ০৫. বিছানায় গা এলিয়ে
৬. ০৬. অপারচুনিস্ট
৭. ০৭. ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে
৮. ০৮. ব্যাগ থেকে গ্লাভস বের করে
৯. ০৯. চাপা গলায় কল্যাণ বলল
১০. ১০. ভোরবেলায় কলকাতার রাস্তা
১১. ১১. শ্মশান থেকে বাড়িতে ফিরে
১২. ১২. ঘুম ভাঙল একটু বেলা করে
১৩. ১৩. ব্যাপারটা বেশ মজার
১৪. ১৪. সীতা রায় দুই ভ্রূ এক করে
১৫. ১৫. সকাল বেলায় আনন্দ আর কল্যাণ এল
১৬. ১৬. সত্যনারায়ণ পার্কের ঠিক উলটোদিকে
১৭. ১৭. ট্যাকসি দাঁড় করিয়ে
১৮. ১৮. সুদীপ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিল
১৯. ১৯. খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে
২০. ২০. বড়বাজারে উগ্রপন্থীদের আক্রমণ
২১. ২১. জয়িতা দরজায় দাঁড়িয়ে
২২. ২২. অবনী তালুকদার বলছিলেন
২৩. ২৩. নানুভাই তখন তিনজন লোকের কাছে
২৪. ২৪. ঘুম থেকে উঠে সুদীপ বেরিয়ে গিয়েছিল
২৫. ২৫. চারটে পিঠে-বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাগে
২৬. ২৬. আজ কলকাতার প্রতিটি খবরের কাগজ
২৭. ২৭. শুকনা পর্যন্ত গাড়ি ছুটেছিল
২৮. ২৮. সুখিয়া পোখরিতে জিপ থামেনি
২৯. ২৯. ঘোড়ার নালের মত রাস্তাটায় বাঁক
৩০. ৩০. পাখিরা যেমন
৩১. ৩১. মাঝরাতের পর আকাশে
৩২. ৩২. দেবতার মূর্তি নিয়ে
৩৩. ৩৩. প্রথম চোখ মেলল জয়িতা
৩৪. ৩৪. যতটা সাহস এবং উৎসাহ
৩৫. ৩৫. ঠায় সাত ঘণ্টা এক জায়গায়
৩৬. ৩৬. মানুষগুলো নেমে যাচ্ছে নিচে
৩৭. ৩৭. সুদীপের মাথায় ব্যাপারটা
৩৮. ৩৮. কল্যাণ যখন ডাক্তারের গেট পেরিয়ে
৩৯. ৩৯. গত রাত হাওয়ার রাত ছিল
৪০. ৪০. জয়িতা হতভম্ব
৪১. ৪১. এখন দুপুর
৪২. ৪২. চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল
৪৩. ৪৩. রোবট দ্যাখেনি জয়িতা
৪৪. ৪৪. দুপুর না গড়াতেই এখানে অন্ধকার
৪৫. ৪৫. সারারাত ঘুমোতে পারেনি জয়িতা
৪৬. ৪৬. দরজা খুলতেই কাটার চাবুকের আঘাত
৪৭. ৪৭. শীত এখন তুঙ্গে
৪৮. ৪৮. দুবার বরফ গলে গেল
৪৯. ৪৯. ওরা ফিরে এল দিন আটেক বাদে
৫০. ৫০. লা-ছিরিঙ আর জয়িতা
৫১. ৫১. নবজাতকের সুতীব্র চিৎকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন