২৮. সুখিয়া পোখরিতে জিপ থামেনি

সমরেশ মজুমদার

সুখিয়া পোখরিতে জিপ থামেনি। থামল মানেভঞ্জন-এ।

ড্রাইভার বলল, সাহেবরা যদি প্রয়োজন মনে করেন তাহলে এখান থেকেই চাল-ডাল কিনে নিতে পারেন। এর পরে আর দোকান নেই।

মানেভঞ্জন একটি ছোট্ট জনপদ। রামানে হাইড্রো-ইলেকট্রিক তৈরি হবার পর থেকে এখানকার জনসংখ্যা বাড়ছে। ঠাণ্ডা ঘুম-এর থেকে কম। সুদীপ আর কল্যাণ ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র কিনছিল। চাল আলু মশলা থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে সব। আনন্দ সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, এত সব নিচ্ছিস বইবে কে?

সুদীপের মাথায় ব্যাপারটা ঢোকেনি। এখন একটু ফ্যাকাশে হয়ে বলল, এ সবই তো আমাদের লাগবে। কি করা যায়?

আনন্দ বলল, যা নিয়েছিস তা শেয়ার করে ক্যারি করা যাবে। কিন্তু আর নয়।

মানেভঞ্জন থেকেই যেহেতু পদযাত্রা শুরু হত এবং এখনও যারা পায়ে হেঁটে যেতে চায় তারা এখানেই নামে বাস থেকে তাই এক শ্রেণীর লোক ওদের পেছনে লাগল। খুব নিরীহ চেহারার মানুষগুলো বলল তারা পোর্টার। ফালুট পর্যন্ত মাল বয়ে নিয়ে যাবে। ডেইলি তিরিশ টাকা আর খাওয়া। সাহেবরা না হয় গাড়ির রাস্তা হওয়ায় সান্দাকফু পর্যন্ত গাড়িতে যাবেন কিন্তু ফালুট যেতে হলে তাদের সাহায্য নিতেই হবে। আর সাহেবরা যদি তাদের সাহায্য না নেন তাহলে এই অঞ্চলের শেরপারা না খেয়ে মরবে। শেরপা শব্দটি শুনে বেশ রোমাঞ্চিত হল সে। হিমালয়ের যে কোন পর্বতশীর্ষে ওঠার সময় অভিযাত্রীরা শেরপাদের সাহায্য নেন। তেনজিং নিজেও তো শেরপা। বিভিন্ন অভিযানের কাহিনীতে এদের কথা পড়ে পড়ে ওর কাছে শেরপারা নায়ক হয়ে গিয়েছে। সুদীপ লোকগুলোর দিকে তাকাল। এদের দেখতে তার চোখে নেপালি ছাড়া কিছু নয়। সে একটি মিষ্টি দেখতে কিশোরকে কাছে ডাকল, কি নাম তোমার? প্রশ্নটা সুদীপ যতটা সম্ভব ভাল হিন্দীতে করার চেষ্টা করল।

ছেলেটি একগাল হেসে জানাল, ওয়াংদে। বলে দুবার মাথা ঝাঁকাল।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তুমি শেরপা?

জী হজৌর।

শেরপা মানে কি?

এবার ছেলেটি, যার নাম ওয়াংদে তার একটু পরিশ্রম হল। সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে সে শেষ পর্যন্ত জানাল, শের মানে এভারেস্টের ডান দিক আর পা হল মানুষ। শেরপা মানে এভারেস্টের ডানদিকে যেসব মানুষ থাকে তারা।

আনন্দ চুপচাপ শুনছিল। এবার মন্তব্য করল, বাঃ! এই মানেটা আমি জানতামই না। তুই কি ওকে ফালুট পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাস? কিন্তু তারপর? ওকে কি বলে কাটাবি?

টাকা দিয়ে দিলে চলে আসবে। টাকার জন্যেই তো যাচ্ছে। সুদীপ নিচু গলায় কথাগুলো বলে ওয়াংদের দিকে তাকাল, ঠিক হ্যায়। চল আমাদের সঙ্গে। এই মালপত্রগুলো ওই গাড়িতে রেখে এস। ঘোষণা করা মাত্র ভিড়টা সরে গেল। ওয়াংদে তিনবার সেলাম করে মালপত্রগুলো নিয়ে ছুটল গাড়িটার দিকে।

সুদীপ বলল, ওইটুকুনি ছেলে এত মাল নিয়ে হাঁটতে পারবে?

আনন্দ বলল, সেটা ও-ই বুঝবে। কিন্তু দ্যাখ, যেই তুই একজনকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলি তৎক্ষণাৎ অন্যরা পেছন ছাড়ল। ডিসিপ্লিনটা কলকাতায় দেখবি না।

সুদীপ একটু উত্তেজিত স্বরে বলল, কলকাতায় আমরা কিছুই দেখি না। সবাই চোখ বন্ধ করে থাকি। একটা বাঙালি পাবি না যে আর একটা বাঙালির প্রশংসা করছে খোলামনে। ও কেন সুযোগ পাচ্ছে এই ঈর্ষায় সবার বুকে অ্যাসিড জমে যাচ্ছে।

ওয়াংদে ফিরে এসে জানাল, সাহেবরা যদি টেন্ট নিতে চান তাহলে এখনই বলুন, এরপরে ট্যুরিস্টরা এলে আর টেন্ট পাওয়া যাবে না।

টেন্ট? আনন্দ অবাক হল, এখানে টেস্ট পাওয়া যায়?

আগে যেত না। কিন্তু একজন মাড়োয়ারি দোকানদার টেন্ট ভাড়া দিচ্ছে আজকাল। ডেইলি পঞ্চাশ টাকা। কাল বিকেলে টেন্ট জমা দিয়েছি। ওয়াংদ জানাল।

তুমি জমা দিয়েছ! কেন? তুমি কি কোথাও গিয়েছিলে?

হাঁ সাব। পাঁচ দিন আগে একটা ট্রেকিং পার্টির মাল নিয়ে গিয়েছিলাম। সান্দাকফুতে ভিড় না থাকলে টেন্টের দরকার হয় না কিন্তু ফালুটে প্রয়োজন হতে পারে। সুদীপ হাঁ হয়ে গেল। এই কিশোর পাঁচদিন ধরে পাহাড় ভেঙে এসেই আবার পাড়ি দিতে চাইছে! শুধু টাকার জন্যে? সে জিজ্ঞাসা করল, টেন্ট কে বইবে?

আমি সাব।

আনন্দর মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা শোষণের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু সুদীপ জানাল ওরা সবাই ওয়াংদেকে সাহায্য করবে। ওরা মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের দোকানে এল। তেল নুন থেকে সবই এখানে পাওয়া যায়। বয়স হয়েছে ভদ্রলোকের। প্রথমেই অনুযোগ করলেন, আপনারা আমার দোকান থেকে মাল কিনলেন না। আমি মানেভঞ্জনে সবচেয়ে সস্তায় দিয়ে থাকি। হ্যাঁ, টেন্ট দুটো আছে। ডেইলি একশ টাকা। একদম মজবুত টেন্ট। টাঙানোর ঝামেলাও খুব বেশি নেই। তবে জমা রাখতে হবে পাঁচশো টাকা। ফিরে আসার সময় হিসেব করে ঠিক হবে ফেরত পাবেন না দিতে হবে।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ডিপোজিট নিচ্ছেন কেন? এ পথেই তো ফিরতে হবে।

মাড়োয়ারি ভদ্রলোক বললেন, ফিরতে তো হবেই। কিন্তু টেন্ট ছিঁড়ে গেলে তো সারাই-এর খরচ দিতে হবে। ডিপোজিট না রাখলে আপনারা ফেরার সময় দিতে চান না।

দুটো টেন্ট এমন কিছু ভারী নয়। দেখে মনে হল মজবুত। সুদীপ পাঁচশো টাকা জমা দিয়ে গাড়িতে ফিরে এল। টেন্টগুলোকে পেছনে তুলে দিয়ে ওয়াংদে বলল, সাহেবরা যদি আমাকে দশ মিনিট সময় দেন তাহলে খুব ভাল হয়।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কেন?

একবার বাড়িটা ঘুরে আসব। কম্বল আনতে হবে আর মেয়ের সঙ্গে দেখা করব।

সুদীপ ঘাড় নাড়তেই দৌড়ে উধাও হল ওয়াংদে। আনন্দ বলল, ওইটুকুনি ছেলে হলে কি হয় এর মধ্যে প্রেম করে বসে আছে।

ড্রাইভার ফিরে আসছিল, সুদীপ চটপট জয়িতা-কল্যাণকে ওয়াংদের কথা বলে ফেলল। ড্রাইভার এসে জানাল, আর দেরি করা চলবে না। তাকে সন্ধ্যের মধ্যে ফিরতে হবে ঘুম-এ। সুদীপ ওকে ওয়াংদের কথা বলে একটু অপেক্ষা করতে অনুরোধ করল।

ওয়াংদে এল মিনিট পনেরো পরে দুটো কম্বল এবং তারই মত দেখতে একটি মেয়েকে পেছনে নিয়ে। মেয়েটির মুখ খুব বিমর্ষ। নিজেদের ভাষায় কথা বলে ওয়াংদে জিপের পেছনে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে সরল হাসল। জিপ চলতে শুরু করলে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি নাম মেয়েটার?

দ্রিমিট। আমি চলে গেলে ও খুব একা হয়ে যায়। ওয়াংদে বিষণ্ণ গলায় বলল।

সুদীপ হাসল, কি আর করা যাবে! তোমার যা কাজ! প্রেমিকার সম্পর্কে কেউ এত সহজে কথা বলতে পারে শুনে ওর মজা লাগছিল।

হাঁ সাব। ওর মা মারা যাওয়ার পর এই চলছে। ভাল ছেলেও পাচ্ছি না যে বিয়ে দেব। যেন নিজের সঙ্গে কথা বলল ওয়াংদে। আর চমকে উঠল ওরা। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, দ্রিমিট তোমার কে হয় ওয়াংদে?

ওয়াংদে তার কিশোর-হাসি হাসল, আমার মেয়ে হুজুর। সবাই বলে আমার মত দেখতে।

অনেকক্ষণ ওরা কোন কথা বলতে পারল না। শেষ পর্যন্ত সুদীপ চাপা গলায় মন্তব্য করল, আমরা শালা ছোটলোক!

 

এই রাস্তা ধরে বেড়াতে বেড়াতে নরকেও চলে যাওয়া যায়। একটু একটু করে পাহাড়ে যদিও উঠছে জিপ কিন্তু কোথাও খুব খাড়াই নেই। কিছুক্ষণ ন্যাড়া ছিল চারধার এবার গাছ এল। রডোড্রেনডন আর ক্যামেলিয়ায় অপরূপা হয়ে গেল পৃথিবীটা। মানেভঞ্জন থেকে যত এগোচ্ছিল তত নির্জনতা চাপ বাঁধছিল। একটিও মানুষ নেই পথে। এখন রোদ নেই আবার ঘন ছায়াও নেই। সূর্য যেদিকে সেদিকে একটা ঘোলাটে মেঘ আটকে আছে কিন্তু বাকি আকাশটা ক্লিওপেট্রার চোখের মত নীল। এই অবধি ভেবে জয়িতা থামল। তারপর প্রশ্নটা ছুঁড়ল, আচ্ছা ক্লিওপেট্রার চোখের রঙ কি রকম ছিল?

কল্যাণ এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। চমকে জিজ্ঞাসা করল, কার?

ক্লিয়োপেট্রার? জয়িতা হাতড়াচ্ছিল কোথাও বর্ণনা পড়েছে কিনা। নীল তো ভেবে বসল।

আমি দেখিনি। সী ওয়াজ ডেঞ্জারাস ওম্যান। ধরত ছিবড়ে করত আর ছুঁড়ে ফেলত। আমি দেখতে চাই না। কি করে যে এই পরিবেশে ওই নাম মনে পড়ে!

জয়িতা কোন কথা বলল না। মেঘমা থেকে ডান দিকে টংলুর পথ। জিপ বাঁ দিকে গৈরাবাসের দিকে ঘুরল। মেঘমাতে মোটামুটি একটা বসতি আছে। যদিও মানুষ কত আছে তা বোঝা মুশকিল। কালিয়াপোকরি পর্যন্ত কোন অসুবিধে হল না। জায়গাটা সমৃদ্ধ। না হলে এত মানুষ এখানে থাকত না। লামার দোকানে ওরা ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিল। কাঁচা পরোটা আর কাঁচা আলুর ঝোল। সুদীপ চেষ্টা করেও পারল না। জয়িতা চেষ্টাই করল না। আনন্দ একটা খেয়ে হাত গুটিয়ে নিল। কল্যাণ কোনমতে দুটো পেটে চালান করতে পারল। ওয়াংদে খেল ছটা। চা খেয়ে আনন্দ বলল, একটা রান্নার বই নিয়ে এলে ভাল হত।

কালিয়াপোকরি থেকেই বিভীষিকা শুরু হল। যেন স্বর্গের সিঁড়ি হয়ে রাস্তাটা সোজা ওপরে উঠে গেছে। মালপত্র সমেত ওদের শরীর পেছনে গড়িয়ে যাচ্ছিল। আনন্দ শক্ত করে ব্যাগটা আঁকড়ে থাকল। জোরে আঘাত লাগলে জিপসমেত তাদের উড়ে যেতে হবে। সে মুখ ফেরাল। কল্যাণ চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে এক হাতে সিট আঁকড়ে ধরেছে। জয়িতার মুখ রক্তশূন্য। শুধু ওয়াংদে এখনও পা ঝুলিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে। সুদীপের মুখ বাঁ দিকে ফেরানো বলে তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু তার হাতের আঙুলগুলো শক্ত হয়ে আঁকড়ে ছিল সামনের রডটা। এদিকে ক্রমশ রাস্তাটা ছোট হয়ে আসছে। আনন্দর মনে হল এখন যদি ব্রেক ফেল করে কিংবা যদি চাকাটা সামান্য ওপাশে চলে যায় তাহলে আর তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। ড্রাইভারের দিকে তাকাল সে। লোকটার চোখ এখন রাস্তায় সতর্ক। একটু যেন টেনশন। লোকটার সঙ্গী বম্বের হিরো ঘুম ছাড়া ইস্তক কোন কথা বলেননি। এখন চোখ বন্ধ করে তুলছে। একেই বোধ হয় কলজে হাতে করে পাড়ি দেওয়া বলে। এর চেয়ে হেঁটে গেলে অনেক আরাম হত। মাঝে মাঝে পথের কারণে ড্রাইভার যখন ব্রেক কষছিল তখন সমস্ত শরীরে যে ঝাকুনি তাতে অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসার উপক্রম। ক্রমশ আনন্দর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। একটা তৈলাক্ত অনুভূতি ধীরে ধীরে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তার পেটে অস্বস্তি শুরু হল। কোনরকমে মাথা তুলে তাকাতেই দেখল সামনের পাহাড়টা যেন আরও উঁচু আর রাস্তাটা তার গায়ে সিঁড়ির মত আটকানো। সে চোখ বন্ধ করতেই বমির শব্দ পেল। শব্দটা আসছে তার বাঁদিক থেকে। সুদীপের শরীর তারই দমকে বারংবার কাঁপছে। মুহূর্তে সমস্ত শরীর বিদ্রোহ করল। ওই একটি বমির শব্দ যেন তোলপাড় শুরু করল তার নিজের শরীরে। পেট মুচড়ে কিছু ছুটে আসছিল গলায়। কোনরকমে ঢোক গিলে প্রথম ধাক্কাটা সামলাল সে। এই ঠাণ্ডাতেও ঘাম হচ্ছে কপালে। যেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে সমস্ত শরীরে। একটা ঢেঁকুর উঠল যাতে বিদিকিচ্ছিরি পরোটার গন্ধ। এবং তখন ওপাশে আরও দুটো গলায় বমির শব্দ উঠেছে। ড্রাইভার ওরকম বেঢপ জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাতে পারছিল না। আনন্দ প্রাণপণে যুঝে যাচ্ছিল। সে বমি করবে না, কিছুতেই না। প্রতিটি ঢেউ সে ভেতরে ফেরত পাঠাচ্ছিল। কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারছিল তার ইচ্ছের পায়ের তলার মাটি নরম হয়ে আসছে। টাগ অফ ওয়ারে হারবার মুহূর্তে যেমন বোঝা যায়। কল্যাণের আর্তনাদ মেশানো বমির শব্দটাই এই কাজ করল। আনন্দ আরও মনের জোর বাড়াচ্ছিল। না আমি বমি করব না। তার সমস্ত শরীরে এবার কুলকুল ঘাম। নাক জ্বালা করছে। পেটের মোচড় অসহ্য হয়ে উঠেছে। এবং তখন অপেক্ষাকৃত সমতল পেয়ে জিপ স্থির হল। সুদীপ লাফ দিয়ে নিচে নামল। তারপর বলল, আঃ। জয়িতা এবং কল্যাণ টলতে টলতে নেমে দাঁড়াল। জিপের পেছন থেকে একটা বালতি তুলে নিয়ে ওয়াংদে ছুটে গেল পাহাড়ের আড়ালে। ড্রাইভার দাঁত বের করে হাসল, বাঙালিবাবুদের এরকম হয়েই থাকে। তবে আপনি খুব শক্ত আছেন।

সেই মুহূর্তে উঠে আসা ঢেউটা ওই কথার জন্যেই বোধ হয় সামাল দিতে পারল আনন্দ। কল্যাণ মাটিতে বসে পড়েছিল। জয়িতা জিপের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আনন্দ নড়াচড়া করতে ভয় পাচ্ছিল। এই সময় ওয়াংদেকে আবার দেখা গেল। এক বালতি জল এনে জয়িতাদের সামনে দাঁড়িয়েছে। ওরা তাই দিয়ে কোনরকমে মুখ ধুয়ে নিল। এবার ওয়াংদে এল তার কাছে, সাব, পানিসে মুখ সাফা করে নিন। ভাল লাগবে। দেবদূতের মত দেখাচ্ছিল লোকটাকে। আনন্দ জিপ থেকে নামল। সমস্ত শরীর যেন তরল পদার্থে ঠাসা হয়ে গেছে। সে হাত বাড়িয়ে জল নিল। ঘামের গায়ে কনকনে ঠাণ্ডা জল লাগামাত্র স্বর্গীয় আরাম হল। মুখ ঘাড় হাত ধুয়ে মনে হল এর চেয়ে তৃপ্তি আর কিছুতেই নেই। কিন্তু তাকে আরও পাঁচ মিনিট ব্যয় করতে হল শরীরের সবকটা অনুভূতি ফিরিয়ে আনতে। ধীরে ধীরে তৈলাক্ত অনুভূতি কিংবা পেট মোচোনো কমল, মনে হল শরীর জমাট বাঁধছে কিন্তু সেই সঙ্গে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ছিল। যেন খুব বড় লড়াই শেষ করে সে দাঁড়িয়েছে। আর তারপরেই আনন্দর উপলব্ধি হল সে জিতেছে। তার কয়েকটা ইন্দ্রিয়কে অন্তত সে বশ মানাতে পেরেছে। এই খুশি তার আত্মবিশ্বাস চট করে বাড়িয়ে দিল কয়েকগুণ। এবং তার ফলে দুর্বলতা কেটে যাচ্ছিল। সে জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করল, শরীর খারাপ লাগছে?

জয়িতা মাথা নাড়ল। সেটা হ্যাঁ কি না তা ঠিক বোঝা গেল না। কল্যাণ খানিকটা দূরে পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে। সুদীপ বলল, হরি! এরকম স্টিফ পাহাড়ে আমি কখনও উঠিনি। যে-কোন মুহূর্তেই অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। কল্যাণ ঠিকই বলেছে, এর চেয়ে ট্রেকিং ভাল ছিল।

কল্যাণ বলল, আমি আর জিপে উঠছি না। তোরা যা, আমি হেঁটে যাচ্ছি।

ওয়াংদে বাংলা বোঝে বোঝা গেল। কারণ সে এই কথার পর বলল, আর মাত্র পাঁচ মিনিট। তারপর নিচে নামার পালা। তখন আর সাহেবদের কষ্ট হবে না।

কল্যাণ মাথা নাড়ল, ভাল কথা। এই পাঁচ মিনিট আমরা হাঁটব।

ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার পেছনে খাড়া পাহাড়। সামনে অতলান্ত খাদ। খাদের ওপাশে আকাশটা যেন ধনুকের মত নেমে গেছে। ড্রাইভার তাড়া লাগালেও ওদের ওঠার কোন ইচ্ছে দেখা গেল না। আর তখনই ওদের সামনে অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি হল। যে মেঘটা এতক্ষণ আকাশে ঝুলছিল সেটা উড়ে যেতে লাগল। পেজা পেঁজা হয়ে। এবং তার আড়াল থেকে রাজেন্দ্রাণীর মত বেরিয়ে এল কাঞ্চনজঙ্ঘা। সূর্যের আলো তার শরীরে পড়ায় সোনায় রুপোয় মিশেল অহঙ্কারী সুন্দরীর মত পৃথিবীটাকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রইল।

ওরা চারজন নির্বাক। যেন পৃথিবীর শেষ স্তব্ধতা যেখানে অনন্তর শান্তি মেশানো ওদের চারপাশে বলয় রচনা করল। কাঞ্চনজঙ্ঘার ডান দিকে যে খাঁজটা সেখানে রোদ মাখামাখি। কিন্তু তখনই ওয়াংদে বলে উঠল, আগে গেলে এর চেয়ে অনেক ভাল দেখা যাবে। একটি বাক্য সবাইকে চেতনায় ফিরে আনতেই সুদীপ বলল, গ্রেসিয়াস। পাগল হয়ে যেতে হয়।

জয়িতা বলল, মোর দ্যান দ্যাট। আমি ওর দিকে তাকিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারি। গঠনে কিরকম অহঙ্কার তাই না?

সুদীপ বলল, পৃথিবীর সুন্দরী মহিলাদের ধরে নিয়ে একে দেখাতে হয়, দ্যাখো রূপ কাকে বলে! আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। এই প্রথম প্রেমে পড়া যায় এমন সুন্দরীর দর্শন পেলাম।

জয়িতা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, সুন্দরী! তোকে কে বলল কাঞ্চনজঙ্ঘা মেয়ে? পর্বত সবসময় পুরুষ।

কল্যাণ উঠে দাঁড়াল, মেয়ে পুরুষ বুঝি না। কিন্তু চিত্ত আমার হারালো। যেতে ইচ্ছে করছে না এখান থেকে। এমন দৃশ্য পৃথিবীতে আছে।

ড্রাইভার আবার তাড়া দিল। মিনিট পাঁচেকের কাঞ্চনজঙ্ঘা ওদের কাছে যেন ওষুধের মত কাজ করল। আনন্দর মনে হচ্ছে তার শরীরে আর কোন কষ্ট নেই। সব কিছু এখন তার নিয়ন্ত্রণে। এমন কি শেষপর্যন্ত কল্যাণও সম্ভবত কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রভাবেই গাড়িতে উঠে বসল। বিকেভঞ্জন পার হতেই কুয়াশা নেমে এল দল বেঁধে। সামনের পৃথিবীটা আড়ালে পড়ে গেছে। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছিল মাঝেমাঝেই। শেষ পনেরো মিনিট আবার সেই যন্ত্রণা। আবার শারীরিক বিদ্রোহ। যেন ভাসতে ভাসতে ওরা একটা বিশাল মাঠের মত জায়গার পাশ দিয়ে ওপরে উঠে এল। ড্রাইভার বলল, আমরা সান্দাকফুতে এসে গেছি। ওই হল পি ডরু ডি বাংলো। এপাশে ডি আই ইয়ুথ হোস্টেল। আপনাদের কোথায় রিজাভেশন আছে?

আনন্দর কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছিল। সুদীপ হঠাৎ খুব স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে বলল, আমাদের কোথাও রিজার্ভেশন নেই।

তাহলে আপনাদের পি ডর ডি বাংলোর পাশে নামিয়ে দিচ্ছি। ওখানে গণেশ নামে একটা চৌকিদার আছে। দেখুন চেষ্টা করে যদি জায়গা পান। ড্রাইভার কথা বলে একটা দারুণ দেখতে বাংলোর সামনে ওদের পৌঁছে দিল। সন্ধ্যের আগে ঘুম-এ পৌঁছাবার জন্যে যেন ভূতে তাড়া করছে ওটাকে। ওরা যখন কৌতূহল নিয়ে চারপাশে নজর বোলাচ্ছে তখন আনন্দ শব্দ করল। এতক্ষণ শাসনে রাখা তরল পদার্থ এবার তীব্রগতিতে বেরিয়ে আসছে।

সুদীপ মন্তব্য করল, সাবাস! এতক্ষণ একটা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগছিলাম। একযাত্রায় পৃথক ফল হওয়া কি ভাল ব্রাদার!

জয়িতা নিজের মনে বলল, এরই নাম সান্দাকফু। এখান থেকে একশ আশি ডিগ্রিতে হিমালয়কে দেখা যায়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সূর্যোদয় দেখার জায়গা।

কল্যাণ বলল, তা তো হল কিন্তু এখানে লোকজন থাকে না নাকি? ঠাণ্ডাও জব্বর। সত্যি ধারে কাছে কোন মানুষ দেখা যাচ্ছিল না। একটা হিম হিম ভাব সমস্ত জায়গাটার ওপর মশারির মত টাঙানো। দূরের বাড়ি থেকে একটা লোক বাইরে এসে দাঁড়াল এবার। আপাদমস্তক মুড়ি দেওয়া তার। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল সান্দাকফুর ওপর দিয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে হাড় কাঁপতে লাগল চারজনের। এখনও ব্যাগের বাকি শীতবস্ত্র বের হয়নি। আর এই ঠাণ্ডার কারণেই আনন্দ সুস্থ হয়ে গেল। সে এগিয়ে গিয়ে পি ডর ডি বাংলোর দরজায় ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে কোন সাড়া এল না। এই সময় চিৎকার ভেসে এল নিচ থেকে। ওরা দেখল মুড়ি দেওয়া লোকটা হাত নেড়ে কিছু বলছে। ওদের ওখানে দাঁড়াতে বলে ওয়াংদে ছুটে গেল লোকটির কাছে। কথাবার্তা বলে আবার ফিরে এসে বলল, গণেশের অসুখ। বাংলোয় তালা দিয়ে সে কাল দার্জিলিং চলে গিয়েছে। আপনারা ইয়ুথ হোটেলে চলুন। ওটা এখন খালি আছে।

কাঁপতে কাঁপতে ওয়াংদেকে অনুসরণ করে ওরা ইয়ুথ হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল এই আস্তানাটির অবস্থা খারাপ। কিন্তু খোলা আকাশের নিচে ঠাণ্ডায় দাঁড়ানোর চেয়ে সেটা ঢের ভাল। দরজা খোলাই ছিল। ওদের একটু দাঁড়াতে বলে ওয়াংদে একটা ঘর পরিষ্কার করল। দুটো তক্তাপোশ আছে ঘরে। দরজা বন্ধ করার পরও ঘরে হাওয়া ঢুকছে জানলার ফাঁক দিয়ে। কল্যাণ আরাম করে বসতেও পারছিল না ঠাণ্ডার চোটে। এর মধ্যে ওয়াংদে কোথা থেকে কিছু কাঠ ম্যানেজ করে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এবার ওরা চারজনেই আগুনের কাছে সরে এল। খানিকবাদে যেন ধাতস্থ হল সবাই। সুদীপ একটা আঙুল জয়িতার গালে রেখে বলল, তোর এখানটা নীল আর নাকটা লাল হয়ে গিয়েছে।

জয়িতা বলল, ভাল করে ম্যাসেজ করে দে তো। বোধ হয় রক্ত জমে গেছে।

সুদীপ জয়িতার মাথাটা এক হাতে ধরে আঙুলের ডগা দিয়ে ধীরে ধীরে ম্যাসেজ করার চেষ্টা করে বলল, দূর! আরও কালো হয়ে যাচ্ছে। তারপর আগুনের ওপর হাত রেখে হাসল, তুই কি করে গ্রেনেড ছুঁড়েছিস ভেবে পাচ্ছি না!

কেন? জয়িতা চটপট প্রশ্ন করল।

তোর এত নরম চামড়া যে আমার আঙুল সিরসির করছিল।

যে হাত দোলনা ঠেলে সেই তো জগৎ শাসন করে। কথাটা বলে হাসল জয়িতা। তারপর আনন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, একটু চা হলে খুব জমত, না?

কল্যাণ বলল, আমার খিদে পাচ্ছে। কটা বাজে জানিস?

সকলেই ঘড়ি দেখল। দুপুর আড়াইটেতে যে ছায়া ঘনিয়েছে বাইরে তাতে সময় ঠাওর করা অসম্ভব। আনন্দ উঠল। এইভাবে বসে থাকলে চলবে না। সে ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। ব্যবহার হয় কিন্তু যত্ন না থাকায় অত্যন্ত জীর্ণদশা। এখানেও হাওয়া ঢুকছে তবে দুটো তক্তাপোশ রয়েছে এ ঘরেও। তৃতীয় ঘরটিতে আগুন জ্বলছে। আনন্দ দেখল ওয়াংদে এর মধ্যেই উনুন জ্বালিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করছে। তাকে দেখে ওয়াংদে কিশোর হাসি হাসল। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, এখানে জলের কি ব্যবস্থা?

পানি চাহিয়ে? তৎপর হল ওয়াংদে।

না না। আমি জিজ্ঞাসা করছি। লোকটাকে আগুনের সামনে থেকে ওঠাতে খুব খারাপ লাগছিল। এ ঘরে এসে বেচারা কম্বলটাকেও খুলে রেখেছে। এখন একটা হাফহাতা সোয়েটার পরে কাজ করে যাচ্ছে আগুনের সামনে। ওয়াংদে জানাল, দশ মিনিট গেলেই একটা ঝোরা আছে, সারা বছর জল থাকে শুধু শীতের তিনটে মাস ছাড়া। আমি চা করেই আপনাদের বাথরুমে জল এনে দেব।

সামান্য কটা টাকার জন্যে লোকটা এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় পরিশ্রম করছে? মোটেই না। ইচ্ছে করলে ও অনেক রকম কায়দায় ফাঁকি দিতে পারত। তাদের উচিত এই লোকটাকে সাহায্য করা। কিন্তু হঠাৎ বিপরীত প্রাকৃতিক পরিবেশে নতুন এসে সক্রিয় হয়ে ওটা সম্ভব নয়। মানিয়ে নেওয়ার জন্যে সময় দরকার।

ঠাণ্ডা খুব তবু পেছন দিক দিয়ে আনন্দ বাইরে এল। এলোপাথারি হাওয়া বইছে। সামনের উপত্যকায় ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে কুয়াশারা। এই হাওয়া স্পর্শ করা মাত্র যেন রক্ত জমে যাচ্ছে। সান্দাকফুতে গোটা দুয়েক বাড়ি। আপাতত কোন মানুষ চোখে পড়ছে না। এর মধ্যেই অন্ধকার নামব নামব করছে। এখনই এখানে পুলিশের আসার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া পুলিশের আসতে হলে ওই রাস্তা ডিঙিয়ে আসতে হবে। সেটা খুব আরামের ব্যাপার নয়। একমাত্র যদি মিলিটারিদের পাঠায় তাহলে ওদের কাছে পাহাড় কোন বাধাই নয়। কিন্তু প্রথম কথা খবর পেতে হবে, দ্বিতীয়ত পুলিশ মিলিটারিদের সাহায্য চাইবে কিনা এটাও অজানা। আনন্দ আকাশের দিকে তাকাল। জমাট কালো মেঘ নেমে আসছে নিচে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত চরাচর অন্ধকার হয়ে আসছিল। এর মধ্যে দুটো বালতি নিয়ে ওয়াংদে দৌড়ে চলে গেল চোখের আড়ালে। যেভাবে ঘর ঝাট দেওয়া হয় সেইভাবে মেঘগুলো উপত্যকার আলো মুছছিল একটু একটু করে। এত ঠাণ্ডা সত্তেও আনন্দ মোহিত হয়ে গেল। এ রকম দৃশ্যের সামনে দাঁড়ানো এক জন্মে বারংবার সম্ভব হয় না।

ঘরে চলে এসে সে একটু অবাক হল। সুদীপ চা করছে। ওকে দেখে বিব্রত গলায় বলল, অত ব্যাপার। নামাতে না নামাতে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

তুই কখনও চা করেছিস? আনন্দ অন্যমনস্ক গলায় প্রশ্ন করল।

ইয়েস গুরু। তবে এই হাই অল্টিচুডে নয়। কাঠ কম আছে। ওয়াংদে গেছে জল আনতে প্রথমে। তারপর কাঠ। তুই চায়ের গ্লাসটা নে আর ওদের ডাক। সুদীপ একটি গ্লাস এগিয়ে দিতে আনন্দ তার গায়ে উত্তাপ পেল। সাবধানে মুখে দিতে সে আবিষ্কার করল ওটা মোটেই গরম নয়। কয়েক পা এগিয়ে জয়িতাদের ডাকল আনন্দ। কল্যাণের গলা পাওয়া গেল। সে অনুরোধ করছে তার চা ওখানে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে।

আনন্দ বলল, না, যতক্ষণ কেউ অসুস্থ না হচ্ছে ততক্ষণ নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে কল্যাণ। এখানে এসে চা খা।

কল্যাণ হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে জয়িতার পেছন পেছন এল, তোদের প্রাণে সামান্য দয়ামায়া নেই রে। হাতিমারা এই শীতে একটু আরাম করছিলাম তাও তোদের জ্বালায়। এঃ, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে রে!

এই খেতে হবে। সুদীপ গম্ভীর মুখে বলল, যে দেশের যা নিয়ম।

ওয়াংদে জল এনেছে। ডি আই বাংলোর দারোয়ানের কাছ থেকে কাঠও সংগ্রহ করেছে। তারপর খিচুড়ি আর ডিমভাজা বাঁধতে বসেছে। এসব করেছে পা টিপে টিপে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে, যার একটা ফোঁটা গায়ে পড়লে পেরেক ফোঁটার যন্ত্রণা হয়। এখন কলকাতায় ফুটবল খেলা হচ্ছে কিন্তু এখানে মধ্যরাতের অন্ধকার।

এই সময় কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ল। বারো হাজার ফুট উচ্চতা বলেই সম্ভবত তার শব্দ কয়েকগুণ বেশি শোনাল। জয়িতা দুটো হাতে কান চাপা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল। তারপরেই সমস্ত চরাচর ঝলসে দিয়ে গেল বিদ্যুৎ। আনন্দ কাচের জানলার পাশে চোখ রেখে বসেছিল। বারংবার একটা ছেড়া কাপড়ে তাকে কাচ মুছতে হচ্ছে। সে দেখল সমস্ত সান্দাকফু হঠাৎ এক্সরে প্লেটের ছবি হয়ে মিলিয়ে গেল। এবং তখনই শুরু হল ঝমঝমে বৃষ্টি। শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে বাতাসের। কাঠের জানলাগুলো যেন সহ্য করতে পারছে না তার দাপট। হু হু করে হাওয়া ঢুকছে ফাঁক গলে। নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছিল বাকি তিনজনে। একটা তক্তাপোশে কল্যাণ আর সুদীপ দ্বিতীয়টায় জয়িতা। যাবতীয় শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে নিয়েছে আনন্দ। এই বিকেলে শুতে তার একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না।

জয়িতা বলল বোধ হয় প্রকৃতি আই মিন হিমালয়, প্রটেস্ট করছে।

কিসের প্রটেস্ট? কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল।

আমরা এসেছি বলে। জয়িতা নিঃশ্বাস ফেলল, কেমন ভয় ভয় করছে।

দূর! সুদীপ চেঁচিয়ে উঠল, হিমালয় আমাদের রাজকীয় ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বারো হাজার ফুট উঁচুতে এমন দারুণ ঝড়বৃষ্টি, লাইটনিং, ভাবা যায়!

এই সময় ওয়াংদে এসে দাঁড়াল দরজায়। ওরা অবাক হয়ে দেখল ওয়াংদের শরীরে শীতবস্ত্র বলতে সেই হাফহাতা সোয়েটার। কিশোর-হাসিটি হাসল সে, আমার রান্না হয়ে গেছে, যদি সাহেবরা খেতে চান তত দিতে পারি।

সুদীপ মাথা নাড়ল, এই বিকেলে ডিনার? অসম্ভব। খিদে পেলে বলব।

ওয়াংদে মাথা নেড়ে চলে গেল ভেতরে। ঘরে কোন আলো নেই, ফায়ারপ্লেসের আগুনে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাই সম্বল। হঠাৎ সুদীপ উঠে বসল, আচ্ছা, তোদের কি মনে হল ওয়াংদে খুব নর্মাল কথা বলল?

আনন্দ বলল, একটু যেন অন্যরকম। এত শীতে হাফ সোয়েটার পরলে যা হয়।

যতটা সব পোশাক চাপিয়ে সুদীপ নিচে নামল। তারপর নিঃশব্দে ভেতরের দিকে পা বাড়াল। উনুনের পাশে পা ছড়িয়ে আছে ওয়াংদে। ওকে দেখে সেই একই হাসি হাসল। এখন তার চোখ প্রায় বুজে এসেছে। হাতে দিশি মদের বোতল। সুদীপ ওর সামনে উবু হয়ে বসতে ওয়াংদে বলল, এখানে এলে খেতে হয়। না হলে ভগবান খুব রাগ করে। আর তার রাগ হলে ঠাণ্ডাটাকে বহুৎ বেশি বাড়িয়ে দেয়। আর এটা পেটে যাওয়া মাত্র সান্দাকফুটা মানেভঞ্জন হয়ে যায়। কথাগুলো পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে এখন।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি মদ ওটা?

ছাং। সাহেব যদি একটু মুখে দেন তাহলে আমার কথা সত্যি কিনা বুঝতে পারবেন।

সুদীপ মাথা নাড়ল, না না। ওসব আমি খেতে পারব না।

ওয়াংদে হঠাৎ খুব রেগে গেল। তার মুখ লাল ছিল, এবার যেন ফুলে উঠল। সে জোরে জোরে শরীর দোলাল, তাহলে এখানে সাহেবের আসা উচিত হয়নি। সান্দাকফুতে এসে ছাং কাউকে খেতে দেখলে একটু খেতে হয়। না হলে ভগবান রাগ করবে।

সুদীপ হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিতেই ওয়াংদের মুখে সরল হাসি ফিরে এল। গন্ধ নিল সুদীপ। নেহাৎই পচাই বলে মনে হচ্ছে। সে আর একবার চেষ্টা করল, কিন্তু ওয়াংদে, আমি খেলে তোমার ভাগে কম পড়বে, তখন?

কোন অসুবিধে নেই। সাহেব টাকা দিলে আমি ডি আই বাংলোর চৌকিদারের কাছ থেকে আরও বোতল নিয়ে আসব। ও বেশি দামে মদ বিক্রী করে।

এই বৃষ্টিতে তুমি যাবে কি করে?

চলে যাব। সাহেব চিন্তা করবেন না। ওয়াংদের মাথা টলছিল এবার। কৌতূহল হচ্ছিল। সুদীপ বোতলটা মুখের ওপর তুলে এক টোক গিলল। বিদঘুটে গন্ধে গুলিয়ে উঠল শরীর। ওটা কোনমতে পেটে চালান করে দিতেই মনে হল গলা বুক জ্বলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কান ঝা ঝুঁ করে উঠল। এবং সমস্ত শরীরে একটা গরম হাওয়া পাক খেতে লাগল। বোতলটা এগিয়ে দিল সে ওয়াংদের দিকে। ঠোঁট মুছে বলল, তুমি এটা শেষ কর। তারপর না হয় আনানো যাবে।

ঘরে ফিরে আসামাত্র জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে রে?

সুদীপ হাসল, ওয়াংদে ছাং খেয়ে প্রায় আউট!

আনন্দ জানতে চাইল, ছাং কি?

এক ধরনের মদ। ওর সম্মান রাখতে আমাকে এক টোক খেতে হল।

যাঃ! খেতে কি রকম রে? জয়িতা প্রশ্ন করল।

দারুণ। তবে অন্নপ্রাশনের ভাত দেখার চান্স আছে। এখনও আমার কান গরম হয়ে আছে। এই শীতে ওটা টনিকের কাজ করে। সুদীপ কথা শেষ করা মাত্র আনন্দ দ্রুত কাচ মুছতে লাগল। তারপর কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সর্বনাশ!

কি হল? প্রশ্নটা তিনটে গলা থেকেই একসঙ্গে ছিটকে এল।

একটা জিপ আসছে নিচ থেকে। উত্তেজিত হল আনন্দ।

বৃষ্টির জন্যে ওরা বাইরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল না।

আনন্দ চিন্তিত মুখে জানাল, ভাল করে দেখা গেল না। তবে জিপটা যে ভাড়ার গাড়ি নয় এটা পরিষ্কার।

সকল অধ্যায়

১. ০১. টেলিফোনটা বাজছিল
২. ০২. জয়িতার সঙ্গে কথা
৩. ০৩. সুদীপকে ছেড়ে দেবার পর
৪. ০৪. ঘুম থেকে উঠেই কল্যাণের মনে হয়েছিল
৫. ০৫. বিছানায় গা এলিয়ে
৬. ০৬. অপারচুনিস্ট
৭. ০৭. ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে
৮. ০৮. ব্যাগ থেকে গ্লাভস বের করে
৯. ০৯. চাপা গলায় কল্যাণ বলল
১০. ১০. ভোরবেলায় কলকাতার রাস্তা
১১. ১১. শ্মশান থেকে বাড়িতে ফিরে
১২. ১২. ঘুম ভাঙল একটু বেলা করে
১৩. ১৩. ব্যাপারটা বেশ মজার
১৪. ১৪. সীতা রায় দুই ভ্রূ এক করে
১৫. ১৫. সকাল বেলায় আনন্দ আর কল্যাণ এল
১৬. ১৬. সত্যনারায়ণ পার্কের ঠিক উলটোদিকে
১৭. ১৭. ট্যাকসি দাঁড় করিয়ে
১৮. ১৮. সুদীপ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিল
১৯. ১৯. খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে
২০. ২০. বড়বাজারে উগ্রপন্থীদের আক্রমণ
২১. ২১. জয়িতা দরজায় দাঁড়িয়ে
২২. ২২. অবনী তালুকদার বলছিলেন
২৩. ২৩. নানুভাই তখন তিনজন লোকের কাছে
২৪. ২৪. ঘুম থেকে উঠে সুদীপ বেরিয়ে গিয়েছিল
২৫. ২৫. চারটে পিঠে-বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাগে
২৬. ২৬. আজ কলকাতার প্রতিটি খবরের কাগজ
২৭. ২৭. শুকনা পর্যন্ত গাড়ি ছুটেছিল
২৮. ২৮. সুখিয়া পোখরিতে জিপ থামেনি
২৯. ২৯. ঘোড়ার নালের মত রাস্তাটায় বাঁক
৩০. ৩০. পাখিরা যেমন
৩১. ৩১. মাঝরাতের পর আকাশে
৩২. ৩২. দেবতার মূর্তি নিয়ে
৩৩. ৩৩. প্রথম চোখ মেলল জয়িতা
৩৪. ৩৪. যতটা সাহস এবং উৎসাহ
৩৫. ৩৫. ঠায় সাত ঘণ্টা এক জায়গায়
৩৬. ৩৬. মানুষগুলো নেমে যাচ্ছে নিচে
৩৭. ৩৭. সুদীপের মাথায় ব্যাপারটা
৩৮. ৩৮. কল্যাণ যখন ডাক্তারের গেট পেরিয়ে
৩৯. ৩৯. গত রাত হাওয়ার রাত ছিল
৪০. ৪০. জয়িতা হতভম্ব
৪১. ৪১. এখন দুপুর
৪২. ৪২. চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল
৪৩. ৪৩. রোবট দ্যাখেনি জয়িতা
৪৪. ৪৪. দুপুর না গড়াতেই এখানে অন্ধকার
৪৫. ৪৫. সারারাত ঘুমোতে পারেনি জয়িতা
৪৬. ৪৬. দরজা খুলতেই কাটার চাবুকের আঘাত
৪৭. ৪৭. শীত এখন তুঙ্গে
৪৮. ৪৮. দুবার বরফ গলে গেল
৪৯. ৪৯. ওরা ফিরে এল দিন আটেক বাদে
৫০. ৫০. লা-ছিরিঙ আর জয়িতা
৫১. ৫১. নবজাতকের সুতীব্র চিৎকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন