দাউদাউ আগুন – ৪

সমরেশ মজুমদার

চার

ছাতি মাথায় হাঁটছিলেন বনবিহারী। মাঝেমধ্যে একটা কি দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছে হাইওয়ে দিয়ে। তাদের যাওয়ার সময় অনেকটা সরে দাঁড়াতে হচ্ছিল চাকা থেকে ছিটকে আসা কাদাজল থেকে বাঁচতে। এখন বৃষ্টি পড়ছে ঝিমিয়ে, ফেটে যাওয়া রেকর্ডে পিন ঘষে যাওয়ার মতো। পড়ছে তো পড়ছেই।

এখন গঞ্জের রাস্তায় লোক নেই। একে দুপুরের শেষ তার ওপর বৃষ্টি। দূর থেকেই বনবিহারী দেখতে পেলেন তাঁর চেম্বারের দরজা অর্ধেক ভেজানো। তিনি দুপুরে বাড়িতে খেতে গেলে লোটনবাবু ওখানে দিবানিদ্রা দেন। মোড়ের চায়ের দোকানে কাজ করে ছোকরা। তার ওপর দায়িত্ব দোকান খোলার, পরিষ্কার রাখার। দুটো চাবির একটা বনবিহারীর পকেটে থাকে। বেশি রাত হয়ে গেলে লোটনকে পাওয়া যায় না। সে বড্ড ঘুমকাতুরে। তাই তালা বন্ধ করতে হয় বনবিহারীকেই।

ছাতা মুড়ে দরজার পাশে রেখে ভেতরে ঢুকলেন বনবিহারী। লোটন ঘুমিয়ে আছে লম্বা বেঞ্চিতে। ঘরে ঘন ছায়া। তিনি দরজা ভালো করে খুলে দিলেন। তার আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল লোটন, ‘এই বৃষ্টিতে এলেন?’

‘কেন? না এলে তোর ঘুমের সুবিধে হত?’

উঠে দাঁড়াল লোটন, ‘সকাল থেকে মাত্র দুজন এসেছিল। আমি চায়ের দোকান থেকে চেঁচিয়ে বলেছি আপনি নেই।’

‘কারা? নিজের চেয়ারে বসলেন বনবিহারী।

‘একটা বুড়ো। পি ডব্লু ডি অফিসে কাজ করে। নাম জানি না। আর একটা ছেলে, কোনওদিন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না!’ লোটন বলল।

‘আশ্চর্য! সারাদিন চোখ বন্ধ করে থাকিস নাকি? এইটুকুনি জায়গা অথচ তুই কাউকে ভালো করে চিনিস না।’ বনবিহারী বিরক্ত।

‘আজ কখন বন্ধ করবেন?’

‘কেন?’

‘এই বৃষ্টিতে কেউ আসবে বলে মনে হয় না। আমি সন্ধের পরে এসে বন্ধ করে দেব।’ লোটন দরজায় গিয়ে বলল, ‘আপনার ছাতাটা নিয়ে যাচ্ছি।’

বনবিহারী কিছু বলার আগে সে ছাতা মাথায় রাস্তায় নেমে পড়ল।

হাসলেন বনবিহারী। ছেলেটিকে তিনি স্নেহ করেন। এই গঞ্জে আর কেউ ওর মতো তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সাহস পায় না। জেনেশুনেই বনবিহারী ওকে প্রশ্রয় দেন।

বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বনবিহারী বৃষ্টি দেখতে-দেখতে অন্য ভাবনায় গেলেন। কুন্তীকে নিয়ে কি করা যায়? ব্যাপারটা সবাইকে বলা যাবে না। আর এইটেই তাঁকে পীড়িত করছে। মনে হচ্ছে জেনেশুনে তিনি একটা অপরাধ লুকিয়ে রাখছেন। কিন্তু আর কোনও পথ তো তাঁর সামনে খোলা নেই।

কুন্তী কথা বলতে পারে না বটে কিন্তু লিখতে পারে। যেভাবে ও নিজের নাম লিখতে বলার সময় শম্ভুর দেওয়া নাম কুন্তী লিখেছিল সেই হাতের লেখা বলে মেয়েটা পড়াশুনা করেছে। ওর ওপর চাপ দিলে বাধ্য হবে নিজের সঠিক ঠিকানা লিখতে। কিন্তু এই চাপ দেওয়ার কাজটা করতে পারে পুলিশ। ওর বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় কোনও অভিযোগ আছে কিনা তিনি জানেন না বা থাকলে শুধু উগ্রপন্থীদের সঙ্গে ছিল এই অভিযোগে পুলিশ কতটা শাস্তি দিতে পারে তা তিনি জানেন না। কিন্তু যদি ওর বাবা-মায়ের ঠিকানা জানতে পারা যায় তাহলে শিশুটির একটা হিল্লে হয়ে যাবে। ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে সে। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ভাবনা মাথায় এল। কুন্তীর বাবা-মা মেয়ের সম্পর্কে যদি খুব বিরূপ থাকেন তাহলে শিশুটিকে গ্রহণ নাও করতে পারেন। কুন্তীর সঙ্গে কারও বিয়ে হয়েছিল কিনা তাও তিনি জানেন না। উগ্রপন্থীদের সঙ্গে জঙ্গলে পাহাড়ে লুকিয়ে বেড়ানো মেয়েটির বিয়ে কীভাবে হল? তার সাক্ষী কে? থাকলেও এই মুহূর্তে তাদের কেউ বেঁচে নেই। প্রমাণ করার কোনও পথ নেই।

শব্দ করে শ্বাস ফেললেন বনবিহারী। চোখ বন্ধ করলেন খানিক। যা হয় হবে, তিনি পুলিশকে পুরো ব্যাপারটা জানাবেন। অন্তত শিশুটির ভালোর জন্যে তাঁকে পুলিশের কাছে যেতে হবে। চোখ খুললেন তিনি। খুলতেই অবাক হলেন। দরজায় একটি তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। ওর জামাপ্যান্টের অনেকটাই ভিজে চপচপ করছে, মাথার চুল নেতিয়ে আছে ভিজে।

‘কি ব্যাপার?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আপনি ডাক্তারবাবু?’

‘হ্যাঁ।’ বনবিহারী বললেন, ‘একদম ভিজে গেছেন ভাই। ছাতা নিয়ে বেরুবেন তো!’

‘ছাতা না থাকলে ভিজতেই হয়।’ ছেলেটি উলটো দিকের চেয়ারে বসল।

‘বলুন। কি হয়েছে?’

‘পেটে যন্ত্রণা।’

‘কবে থেকে?’

‘কয়েকদিন হয়ে গেল।’

‘কোনখানে?’

ছেলেটি হাসল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘ওই বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ুন। শার্টটা খুলে ফেলুন। শুকিয়ে যাবে।’

ছেলেটিকে অবাধ্য বলে মনে হল। যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই বেঞ্চিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।

‘শার্টটা না খুললে দেখব কি করে?’

‘খোলা যাবে না। অসুবিধে আছে।’

বনবিহারী চেয়ার ছেড়ে বেঞ্চির পাশে গিয়ে পেটে হাত দিলেন। ‘ঠিক কোন জায়গায় ব্যথা তা বলবেন। খেয়েছেন কখন?’

‘গতকাল বিকেলে।’

‘কেন?’ আঙুল সরিয়ে সরিয়ে পেট টিপছিলেন বনবিহারী।

‘খাবার জোগাড় করতে পারিনি!’

‘সেকি? কেন?’ হঠাৎ বনবিহারীর আঙুল থেমে গেল। শক্ত কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলেন আঙুলের ডগায়। আঙুল সরাতে সরাতে বুঝলেন বস্তুটি লম্বাটে। ছেলেটি জামা সরাল, গেঞ্জিও। বনবিহারী সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ছেলেটার পেটের পাশে প্যান্টের ভেতর গোঁজা রয়েছে একটা রিভলভার। তিনি চাপা গলায় বলে উঠলেন, ‘একি?’

ছেলেটি সোজা হয়ে বসল, ‘রিভলভার।’

‘তুমি কে?’

‘আপনি আমার পরিচয় দিলে চিনতে পারবেন?’

‘তু-তুমি কি সেই রাত্রে জঙ্গলে ছিলে?’

‘হ্যা। আপনার গাড়িতে টিনাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে আমি সাইকেলে অনুসরণ করেছিলাম। গাড়িকে সাইকেল ফলো করতে পারে না। কিন্তু আমার ওপর দায়িত্ব ছিল আপনি থানায় গিয়েছেন কিনা! থানার কাছাকাছি গিয়ে আপনার গাড়ি দেখতে না পেয়ে যখন ফিরছিলাম তখন অনেকগুলো গাড়িকে আসতে দেখে রাস্তার পাশে লুকিয়ে পড়ি। ওগুলোতে পুলিশ আছে বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারিনি। ওরা জঙ্গল ঘিরে ফেলে আত্মসমর্পণের কোনও সুযোগ না দিয়ে গুলি করে আমার সঙ্গীদের মেরে ফেলে! বিচার ছাড়া ভারতের সংবিধানকে কলুষিত করতে একটুও দ্বিধাও করেনি ওরা। আমি বেঁচে গিয়েছিলাম কারণ স্পটে ছিলাম না।’ ছেলেটি খুব গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলল।

‘তারপরেও কি তুমি এদিকে এসেছিলে?’

‘হ্যাঁ! আপনার সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল। সুযোগ পাচ্ছিলাম না!’

‘কেন? কাল রাত্রেও তো আমি একাই বাড়ি ফিরেছি।’

‘কাল রাত্রে এদিকে আসা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’

নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন বনবিহারী, ‘আমার কাছে কেন এসেছ?’

‘আপনি টিনাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার পর আজ আমি সেখানে গিয়েছিলাম তার দেখা পাইনি। আপনার কাছে অনুরোধ টিনাকে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওকে বাড়িতে রেখে দেবেন।’

‘সুস্থ হওয়ার পরে?’

‘তখন আপনার আর দায়িত্ব থাকবে না।’

‘শিশুটি?’

কোনও অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেবেন।’

চমৎকার! একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। ওই শিশুটির বাবা কে? তুমি?’ সরাসরি তাকালেন বনবিহারী।

দ্রুত মাথা নাড়ল ছেলেটি, ‘না। সে সেই রাত্রে মারা গেছে।’

‘তাহলে তুমি এত চিন্তিত কেন?’

‘এটা আমাদের দলের ব্যাপার। টিনা কথা বলতে পারে না বটে কিন্তু পুলিশের হাতে পড়লে তারা জোর করলে ওকে দিয়ে অনেক গোপন কথা লিখিয়ে নিতে পারে। তাই ওকে নিয়ে আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই।’ ছেলেটি উঠে দাঁড়াল, ‘এখন পর্যন্ত আপনাকে বিশ্বাস করছি। মনে রাখবেন বিশ্বাসঘাতককে আমরা ক্ষমা করি না। আচ্ছা, চলি।’

বনবিহারী দেখলেন দরজার ওপাশে দাঁড় করানো সাইকেলে চেপে বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে ছেলেটি চোখের আড়ালে চলে গেল।

সন্ধের পরে আর চেম্বারে বসলেন না বনবিহারী। ডুয়ার্সের এইসব এলাকায় একবার বৃষ্টি শুরু হলে দু-তিনদিনেও তার আয়ু শেষ হয় না। সন্ধের মুখে একজন পেশেন্ট এসেছিলেন। তিনি মুখার্জিদের মেজবাবু। বয়স পঞ্চান্ন। গাড়িতে এসে ড্রাইভারের সাহায্যে ছাতা মাথায় চেম্বারে ঢুকেছিলেন, ‘ডক্টর মুখার্জি, একটা কিছু করুন।’

‘আপনার স্ত্রীকে পরীক্ষা করাতে বলেছিলাম!’

‘করিয়েছি। একদম নর্মাল। সমস্যাটা তো আমার।’ ভদ্রলোক চেয়ারে বসে দামি সিগারেট ধরালেন।

‘দেখুন, আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। প্রথম পক্ষের দুটি ছেলে রয়েছে। আর কি দরকার!’ ডক্টর বনবিহারী কথাটা না বলে পারলেন না।

‘দরকার না থাকলে কি আপনার কাছে আসতাম! ওর বয়স মাত্র বত্রিশ। মা হওয়ার জন্যে ছটফট করছে অথচ আমার শরীর সাড়া দিচ্ছে না। এখন তো কীসব ট্যাবলেট বেরিয়েছে। সেগুলো প্রেসক্রাইব করুন না।’ মেজ-মুখার্জি বললেন।

‘ওগুলো এখানে পাবেন না। আপনি বরং কলকাতায় চলে যান। ওখানকার ডাক্তাররা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।’

‘বলছেন?’

‘হ্যাঁ। সেটাই ভালো হবে। স্ত্রীকে নিয়েই যান।’

‘হু। আসলে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী বলেই এত ভয়। কখন কার সঙ্গে কি করে বসবে আর আমাকে সেটা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে। ঠিক আছে, কলকাতায় যাব। তারপরেও যদি কিছু না হয় একটা শিশু দত্তক নেব। ও হ্যাঁ, আমার এই ব্যাপারটা এখানকার কাউকে বলেননি তো?’ মেজ-মুখার্জি উঠে দাঁড়ালেন।

‘যে-কোনও ডাক্তার একজন পেশেন্টের গোপনীয় ব্যাপার অন্যজনকে বলেন না।’

ছাতা মাথায় বাড়ির পথে হাঁটছিলেন বনবিহারী। ডান হাতে ছাতার হাতল বাঁ-হাতে টর্চ। জুতোটা ভিজে চপচপ করছে। রাস্তা অন্ধকার। হঠাৎ তাঁর মনে এল, মেজ-মুখার্জি যদি দত্তক নিতে চায় তাহলে—! হ্যাঁ, কুন্তী যদি সুস্থ হয়ে চলে যায় তাহলে ওর ছেলেকে কোনও অনাথ আশ্রমে না দিয়ে মুখার্জিকে দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বাচ্চাটা যে তাঁর বাড়িতে আছে একথা কেউ জানে না। মুখার্জি হয়তো জানতে চাইবে কোত্থেকে এল বাচ্চাটা, হয়তো কেন চাইবেই, তখন সত্যি ঘটনাটা ওকে বলে দিলেই হল। ধনী পরিবারে বেশ যত্নের সঙ্গে বড় হবে ছেলেটা।

কিন্তু এসব তখনই সম্ভব যখন কুন্তী ওর বাচ্চাকে ফেলে রেখে চলে যাবে। যদি যায় তাহলে—! নাঃ! কালই মুখার্জির সঙ্গে কথা বলতে হবে। ওর যা কেস তা কলকাতায় কোনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পক্ষেও সারানো সম্ভব হবে না। শুধু যাতায়াত আর খরচই সার হবে। হঠাৎ কীরকম হালকা লাগল বনবিহারীর।

বারান্দায় উঠতেই দরজা খুলল কালীচরণ।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেয়েটা কি করছে?’

কালীচরণ মাথা নাড়ল, ‘বাপের জন্মে এমন মা আমি দেখিনি।’

‘কি করেছে ও?’

জলখাবার দিয়েছিলাম তাই খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে সন্ধে থেকে। বাচ্চাটা পড়ে রইল, কেঁদে ককিয়ে খিদের জ্বালায় মাকে ডাকল অথচ ওর ঘুম ভাঙল না। আমি গিয়ে কত ডাকলাম। ডাকলে আবার বিরক্ত হয়। বোবার ভাষায় গরগর করে রাগ দেখায়।’ কালীচরণ তার অসন্তোষের কথা জানাল।

‘বাচ্চাটার কি অবস্থা!’

‘কি আর করব! গরম জলে যে কৌটোর দুধ এনেছিলেন তাই গুলে দু’তিন চামচ মুখে দিতেই শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।’

‘খুব ভালো করেছ। কিন্তু বাটি-চামচগুলো গরম জলে ধুয়ে নিয়েছিলে তো?’

কালীচরণ মাথা নাড়ল, ‘না তো!’

‘উঃ! একটা শিশু, এতকাল মাতৃগর্ভে ছিল, এই পৃথিবীর সবকিছু তার অজানা। এইসময় মায়ের বুকেই সে নিশ্চিন্ত থাকে। আস্তে আস্তে তার শরীরে সহ্যক্ষমতা তৈরি হয়। তুমি বাটি গরম জলে না ধুয়ে তাতে দুধ গুলে খাইয়ে দিলে! ওই বাটিতে যদি কোনও জীবাণু থাকে তাহলে বাচ্চাটা হজম করতে পারবে? কি জানি কি সর্বনাশ হয়ে গেল।’ নার্ভাস হয়ে পড়লেন বনবিহারী।

মাথা নাড়ল কালীচরণ, ‘কিছুই হবে না। যে বাচ্চা জন্মাবার পর মায়ের আদর পায় না সে নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নেয়।’

হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক বদলালেন বনবিহারী। তারপর মা এবং শিশুর ঘরে ঢুকলেন। শিশু ঘুমাচ্ছে মশারির মধ্যে। মা শুয়ে আছে মশারির বাইরে।

বনবিহারী কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলেন, ‘এই যে মেয়ে, ওঠো।’

একবার ডাকতেই চোখ খুলে গেল। সামনে বনবিহারীকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করতেই বনবিহারী বললেন, ‘টিনা, তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’

সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে গেল। ঝট করে উঠে বসল কুন্তী অথবা টিনা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল বনবিহারীর দিকে।

‘তোমার আসল নাম টিনা, তাই তো? একথা আগে লেখোনি কেন?’

মুখ ঘুরিয়ে নিল টিনা। ঠোঁট কাঁপল।

‘টিনা, তুমি তোমার সবকিছু লুকিয়ে রাখতে চাও। চাও তো? কিন্তু ওই বাচ্চাটার কি হবে? ও তো তোমার রক্ত-মাংসে তৈরি হয়েছে। ওকে তো তুমি লুকিয়ে রাখতে পারবে না! আমি বলি কি, তুমি তোমার বাবা-মায়ের কাছে ওকে নিয়ে ফিরে যাও।’ বনবিহারীর খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বললেন।

‘সঙ্গে সঙ্গে দু-দিকে মাথা ঘোরাতে লাগল টিনা, না, না।’

‘কেন? হাজার হোক ওঁরা তোমার মা-বাবা। তুমি যদি ওঁদের অবাধ্য হয়েও থাকো তবু সন্তান বলেই তোমাকে ওঁরা ক্ষমা করে নেবেন। বেশ, ঠিকানা দাও, আমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলব।’

এবার তাকাল টিনা। হঠাৎ জল জমতে লাগল চোখের কোণে। শেষ পর্যন্ত সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বনবিহারী গলা তুলে বললেন, ‘কালীচরণ, আমাকে একটা কলম আর খাতা এনে দাও। তাড়াতাড়ি।’

জামার হাতায় চোখ মুছছিল টিনা। বনবিহারী লক্ষ করলেন এখন ওর পরনে সালোয়ার আর কামিজ। একদম পালটে গিয়েছে ওর আদল। সেই রুক্ষভাবটা আর নেই।

কালীচরণ ওগুলো এনে বনবিহারীর হাতে দিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। বোধহয় টিনাকে কাঁদতে দেখে একটু অবাকও হল।

কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘ওদের ঠিকানাটা লিখে দাও।’

একটু ভাবল টিনা। তারপর কলম তুলে কাগজে লিখল, ‘মা-বাবা মরে গেছে দুর্ঘটনায়। মামার বাড়িতে ছিলাম দশ বছর বয়স থেকে।’

লেখাটা পড়লেন বনবিহারী। একটু মুষড়ে পড়লেন। বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে যে ঔদার্য আশা করা যায় তা মামা-মামীর ক্ষেত্রে যায় না। তবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওদের ঠিকানা?’

‘আমার কাছে ওরা মরে গেছে।’ ঝটপট লিখল টিনা।

সেটার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘একটা কথা আমার জানা দরকার। তোমার পুরো নাম কি?’

আবার লেখা হল, ‘টিনা সেনগুপ্ত।’

‘তোমার কি বিয়ে হয়েছিল?’

‘ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল। উত্তরটা লিখল না টিনা।

‘ওর বাবা কোথায়? কি নাম?’

এবার টিনা লিখল, ‘কি দরকার?’

‘যে-কোনও শিশুর জানা উচিত তার বাবার নাম কি?’

টিনা লিখল, ‘আমার নাম জানলেন এটা জানলেন না।’

‘না।’

‘আমাদের দলের একজন।’ টিনা কাগজটা সরিয়ে দিল।

বনবিহারী আর কথা বাড়াতে চাইলেন না। প্রথম রাতের পক্ষে এই যথেষ্ট। আরও কিছুদিন যাক। ঘনিষ্ঠতা তৈরি হোক, আপনা থেকেই খোলস খুলে যাবে টিনার। তিনি উঠে দাঁড়াতেই ছেলেটার কথা মনে এল। সেই সুযোগ যদি ওই ছেলেটি না দেয়! যদি ও টিনাকে নিয়ে আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়?

তিনি বললেন, ‘আর একটা কথা, তুমি কি ওকে ফেলে চলে যাবে?’

টিনা বাচ্চার দিকে তাকাল। মুখ শক্ত হল।

‘তোমার সঙ্গীরা যদি বলে তাদের সঙ্গে চলে যেতে হবে, কি করবে? ওকে কোনও অনাথ আশ্রমে ফেলে দিয়ে আসতে বলে যদি ওরা?’

সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত মাথা নেড়ে না বলল টিনা।

বনবিহারী আর দাঁড়ালেন না। টিনার এই নির্বাক উত্তর তাঁর কাছে একটা বড় পাওয়া বলে এই মুহূর্তে তাঁর মনে হল।

ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে বনবিহারী প্রসন্ন হলেন। ঝকঝকে রোদ উঠেছে আজ। আকাশে এক বিন্দু মেঘও নেই। এখানকার নিয়মই এই। যখন বৃষ্টি পড়বে, পড়েই চলবে। তারপর যেই থামল অমনি শুনশান আকাশ। যতক্ষণ না এই পৃথিবীটা তেতে উঠবে ততক্ষণ বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাবে না। বনবিহারীর মনে হল, রোজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গঞ্জের চেম্বারে যান; আজ এই ভোরে একটু উলটো দিকে হাঁটলে কেমন হয়।

তৈরি হয়ে কালীচরণকে ডেকে দরজা বন্ধ করতে বলতে সে অবাক হল, ‘এই সাতসকালে কোথায় যাচ্ছেন?’

‘মর্নিং ওয়াকে।’

‘সেকি! আগে তো কখনও দেখিনি! কালীচরণ অবাক।

কথা না বাড়িয়ে বনবিহারী বাড়ির বাইরে চলে এলেন। ভালো বৃষ্টি হওয়ায় চারধারের গাছপালা এখন রোদ্দুর মেখে আরও সুবজ হয়ে উঠেছে। উলটো দিকে হাঁটলে খানিকটা পরে চায়ের বাগান শুরু। তার পাশ দিয়ে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর ঝরনার ধারে পৌঁছে থামলেন তিনি। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটা হয়ে গেছে। বহুকাল এদিকে আসা হয়নি। চায়ের বাগান, শেড ট্রি, ঝরনার জল আর ওপাশের ফরেস্ট দেখতে দেখতে বুঝলেন কিছু পালটায়নি। মানুষের, শুধু মানুষ কেন যে-কোনও প্রাণীদের বয়স বাড়ে এবং সেই বাড়াটা তার শরীরে প্রকট হয়। কিন্তু মানুষের শিকার না হলে প্রকৃতি নিজের চেহারাটায় বয়সের ছাপ তেমনভাবে পড়তে দেয় না। এরকম ভেবেই হেসে ফেললেন। সামনেই যে গাছটা দাঁড়িয়ে তার যে বয়স হয়েছে এখন বোঝা যাচ্ছে। সামনের কালবৈশাখী হয়তো ওকে মাটিতে শুইয়ে দেবে। কিন্তু যতই বয়স হোক ওর ডালে এখনও সবুজ পাতা দোলে।

‘আরে! ডাক্তারবাবু? আপনি এখানে?’

মুখ ফিরিয়ে তিনি হরিহর এবং সুপ্রভাতবাবুকে দেখলেন। এঁরা চায়ের বাগানে কাজ করতেন একসময়। অবসর নেওয়ার পর ওঁদের ছেলেরা এই বাগানে চাকরি পাওয়ায় আর কোয়ার্টার্স ছেড়ে চলে যেতে হয়নি।

‘হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম এদিকে। আপনারা?’

‘আমরা তো রোজই হাঁটতে বেরোই। ওয়াকিং হল সবচেয়ে ভালো ওষুধ।’ হাসলেন হরিহরবাবু ‘তাই অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি।’

সেটা তো খুবই ভালো।’

সুপ্রভাতবাবু বললেন, ‘তবে এদিকে আর আসা যাবে না বলে মনে হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘একটা বড় হাতির দল ওই জঙ্গলে এসেছে। জঙ্গলে খাবার না পেলেই ঝরনা ডিঙিয়ে এদিকে চলে আসবে ওরা। আর যাই হোক, ওদের সামনে পড়া মোটেই ভালো কথা নয়। এই বয়সে তো ছুটতে পারব না।’ হাসলেন সুপ্রভাতবাবু।

‘বয়সের কথা বলবেন না মশাই।’ হরিহরবাবু মাথা নাড়লেন,’ওই মেজ-মুখার্জি, আমারই বয়সি, একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল বউ মরার মাস ছয়েক পরে। তাও তো বছর দুয়েক হয়ে গেল।’

‘লজ্জাজনক ব্যাপার। বউমারা যখন এ নিয়ে কথা বলেন তখন সামনে থাকতে পারি না।’ সুপ্রভাতবাবু বললেন, ‘কবে শুনব এই বয়সে বাবা হয়ে গেছেন।’

হে হে হে শব্দে হাসলেন হরিহরবাবু, ‘চার্লি চ্যাপলিন শুনেছি আশির ঘরে পৌঁছে বাবা হয়েছিলেন। রবিশঙ্কর তো উনসত্তর বছর বয়সে আবার বিয়ে করলেন।’

‘ছাড়ুন ওসব কথা। আমাদের ডাক্তারবাবু তো ব্রহ্মচারী হয়েই রইলেন সারাজীবন।’ সুপ্রভাতবাবু বনবিহারী বাবুর দিকে তাকালেন।

‘আবার আমাকে নিয়ে কেন? ব্রহ্মচারী হওয়া কি মুখের কথা! আর ওসব নিয়ে কোনও চিন্তা আমার মাথায় কখনও আসেনি।’ বনবিহারী বললেন, ‘আচ্ছা, আপনারা এগোন, আমি এবার ফিরব।’

হরিহরবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা আপনার সংসারী হতে বাসনা হয়নি?’

‘আমি তো সংসারী। আপনাদের সবাইকে নিয়ে সংসারেই তো আছি।’ বনবিহারী আর দাঁড়ালেন না।

হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মনে হল মানুষের এটাও একটা ধরন। যত বয়স বাড়ে, যৌবন চলে যায় অথবা স্ত্রীর বয়স বেড়ে গেলে, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে, নিজেকে যখন সংযত রাখতে বাধ্য হয় তখন তার প্রগলভতা বেড়ে যায়। মুখ আলগা হয়। কিছু লোক এই বয়সে কুৎসা শুনতে খুব পছন্দ করে। আজ এঁরা মেজ-মুখার্জিকে নিয়ে বদ রসিকতা করছেন কিন্তু এঁরা যদি সুযোগ পেতেন তাহলে মেজ-মুখার্জির মতো বিয়ে করতে আপত্তি করতেন না। আচ্ছা, এঁরা যদি খবর পান তাঁর বাড়িতে একটি সদ্যজাত শিশুকে নিয়ে অল্পবয়সি মা রয়েছে তাহলে কি প্রতিক্রিয়া হবে? বুঝতে অসুবিধে হল না, এঁরা কুৎসার বন্যায় চারধার ভাসিয়ে দেবেন। ওই মেয়েটির সঙ্গে তাঁকে জড়িয়ে ফেলতে দ্বিধা করবেন না।

বাড়ির সামনে পৌঁছে তিনি জিপটাকে আসতে দেখলেন। ওটা পুলিশের জিপ। তাঁর পাশে জিপ এসে দাঁড়াল। থানার বড়বাবু জিপ থেকে নেমে বললেন, ‘নমস্কার ডাক্তারবাবু। সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন?’

হ্যাঁ। আপনি এদিকে?’

‘বাধ্য হলাম আসতে। আচ্ছা, কাল বিকেলে বৃষ্টির মধ্যে কোনও ছেলে কি আপনার চেম্বারে গিয়েছিল?’ দারোগা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়লেন বনবিহারী।

‘কী নাম? কোথায় থাকে?’

‘নাম বলেনি। পেটের ব্যথার ওষুধ নিতে এসেছিল। আমি ওষুধ বিক্রি করি না। প্রেসক্রিপশন লিখতে যেয়ে নাম জিজ্ঞাসা করাতে বলল, থাক, লাগবে না। বলে চলে গেল। কেন বলুন তো?’ বনবিহারী প্রাণপণে মুখের অভিব্যাক্তি ঠিক রাখলেন।

‘ছেলেটি উগ্রপন্থী। যদি আবার আসে চেষ্টা করবেন আটকে রেখে আমাকে খবর দিতে। আচ্ছা, চলি।’ জিপ চলে যেতে বনবিহারী দেখলেন কালীচরণ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। তিনি পা বাড়াতে সে বলল, ‘কাল রাত্রে আপনি কি যে বলেছেন, ওই মেয়ে এখন কিছুতেই বাচ্চাকে কোল থেকে নামাতে চাইছে না। বাথরুমেও যায়নি।

সকল অধ্যায়

১. দাউদাউ আগুন – ১
২. দাউদাউ আগুন – ২
৩. দাউদাউ আগুন – ৩
৪. দাউদাউ আগুন – ৪
৫. দাউদাউ আগুন – ৫
৬. দাউদাউ আগুন – ৬
৭. দাউদাউ আগুন – ৭
৮. দাউদাউ আগুন – ৮
৯. দাউদাউ আগুন – ৯
১০. দাউদাউ আগুন – ১০
১১. দাউদাউ আগুন – ১১
১২. দাউদাউ আগুন – ১২
১৩. দাউদাউ আগুন – ১৩
১৪. দাউদাউ আগুন – ১৪
১৫. দাউদাউ আগুন – ১৫
১৬. দাউদাউ আগুন – ১৬
১৭. দাউদাউ আগুন – ১৭
১৮. দাউদাউ আগুন – ১৮
১৯. দাউদাউ আগুন – ১৯
২০. দাউদাউ আগুন – ২০
২১. দাউদাউ আগুন – ২১
২২. দাউদাউ আগুন – ২২
২৩. দাউদাউ আগুন – ২৩
২৪. দাউদাউ আগুন – ২৪
২৫. দাউদাউ আগুন – ২৫
২৬. দাউদাউ আগুন – ২৬
২৭. দাউদাউ আগুন – ২৭
২৮. দাউদাউ আগুন – ২৮
২৯. দাউদাউ আগুন – ২৯
৩০. দাউদাউ আগুন – ৩০
৩১. দাউদাউ আগুন – ৩১
৩২. কাঠকয়লার আগুন – ১
৩৩. কাঠকয়লার আগুন – ২
৩৪. কাঠকয়লার আগুন – ৩
৩৫. কাঠকয়লার আগুন – ৪
৩৬. কাঠকয়লার আগুন – ৫
৩৭. কাঠকয়লার আগুন – ৬
৩৮. কাঠকয়লার আগুন – ৭
৩৯. কাঠকয়লার আগুন – ৮
৪০. কাঠকয়লার আগুন – ৯
৪১. কাঠকয়লার আগুন – ১০
৪২. কাঠকয়লার আগুন – ১১
৪৩. কাঠকয়লার আগুন – ১২
৪৪. কাঠকয়লার আগুন – ১৩
৪৫. কাঠকয়লার আগুন – ১৪
৪৬. কাঠকয়লার আগুন – ১৫
৪৭. কাঠকয়লার আগুন – ১৬
৪৮. কাঠকয়লার আগুন – ১৭
৪৯. কাঠকয়লার আগুন – ১৮
৫০. কাঠকয়লার আগুন – ১৯
৫১. কাঠকয়লার আগুন – ২০
৫২. কাঠকয়লার আগুন – ২১
৫৩. কাঠকয়লার আগুন – ২২
৫৪. কাঠকয়লার আগুন – ২৩
৫৫. কাঠকয়লার আগুন – অন্তিম পর্ব

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন