বাণী বসু
বিলু খুব উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে বলল—’মা—ও বলল, তোরাও অমনি যেতে দিলি? হোপলেস! প্যাক অব ফুলস! একটা মধ্যবয়সী মহিলা, জীবনে কোনদিন নিজের চৌহদ্দির মধ্যে থেকে বেরিয়েছে কি না সন্দেহ! মাসে একটা দুটো করে চিঠি পাস—’ভালো আছি, কিছু হলে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিস!’ বাস! ছি! ছি! ছি! চিঠিগুলোর পোস্টগুলোর পোস্ট অফিসের ছাপগুলোও তো দেখবি!’
—’দেখেছি! দেখেছি! রবি বলল—’তুই দ্যাখ, এক একটা এক এক জায়গা থেকে পোস্ট করা। শ্যামবাজার, কলেজ স্ট্রিট, পার্কসার্কাস, গড়েহাট। দ্যাখ, আমিও তো মোটরবাইক নিয়ে সারা কলকাতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। দুটো চোখ সব সময়ে খোলা রাখি। কোথাও ভদ্রমহিলার টিকিটিও দেখতে পাই না। অথচ চিঠি আসছে সব কলকাতারই ভিন্ন ভিন্ন পোস্ট অফিস থেকে!’
—স্ট্রেঞ্জ! মানে মা ভদ্রমহিলা স্রেফ ইচ্ছে করে লুকিয়ে আছে, বলছিস! আমি যখন ছিলুম না তখন তোরা মাকে কে কী বলেছিস! নিশ্চয়ই মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। কিছু একটা করেছিস!’ বিলুর উত্তেজিত পায়চারি আরও তেজোদৃপ্ত হয়ে ওঠে। ‘শী ইজ এ কোয়ায়েট টাইপ, কিন্তু ভীষণ অভিমানী!’
—’অন গড ছোড়দা। আমরা কেউ কিছু বলিনি। কিচ্ছু করিনি!’
—’তোদের কিছু না করাটাই একটা করা। তোরা মার দিকে কোনদিন চেয়ে দেখেছিস! সেই কোন ছোটবেলায় বাবা মারা গেল। জ্যাঠা—কাকারা নিজেদেরটা গুছিয়ে দূর করে দিল। মুখ বুজে এতগুলো বছর একটা বাচ্চা মেয়ে, উঃ, আমি ভাবতে পারছি না। কোনদিন আমরা চেয়ে দেখেছি মা কী খায়? কী পরে! কী করে সময় কাটায়? নিজেদের বন্ধু—বান্ধব নিয়েই মত্ত! এখন কী হবে?’
হঠাৎ রিণি ভীষণ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল—’দাদা, ছোড়দা, মা সেই রসময়ীর রসিকতার মতো করেনি তো। কাউকে দিয়ে আগে থেকে লেখা চিঠিগুলো পোস্ট করাচ্ছে। মা হয়তো আর…’
বিলু বলল—’স্টপ ইট রিণি, স্টপ ইট আই সে। ঠিক আছে ছ’মাসের জায়গায় আট মাস পার হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপন দেওয়া যাক।’
রবি বিষণ্ণ মুখে বলল—’ড্রাফটটা তুই—ই কর বিলু। আমার মাথাটা কেমন…!’
বিলু বলল, ‘রিণি তুই কর।’
একটু পরে রিণি কাঁপা কাঁপা হাতে তার খসড়াটা এগিয়ে দিল। বিলু পড়ল—’মা, তোমার এ কেমন রসিকতা! তোমার ছ’মাসের মেয়াদ অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। আমরা তিনজনে খুব চিন্তিত। ফিরে এসো।’ পড়ে বিলু বলল—’ওয়ার্থলেস। কেউ যদি একটা কাজ ঠিক করে পারিস। অভিমানে একটা মানুষ বাড়ি ছেড়ে গেল, তাকে অ্যাকিউজ করছিস! রসিকতা! খুব ফিরে আসবে!’ তারপর সে নিজেই খসখস করে লিখল লিখে পড়ে শোনাল—মা, তোমার বিলু কেরালা থেকে জীর্ণ—শীর্ণ হয়ে ফিরে এসেছে। লাংস ক্যান্সার। মৃত্যুশয্যায়। শেষ দেখা যদি দেখতে চাও তো অবিলম্বে ফিরে এসো।’
এমন সময়ে হাতে সুটকেস, পিঠে রুকস্যাক, সাদার ওপর নীল ছাপ শাড়ি পরে, মাথার ঝুঁটি বেঁধে রবি—বিলু—রিণির মা চিন্ময়ী চক্রবর্তী সিঁড়ি দিয়ে টকাটক উঠে এলেন।
বললেন—’কার লাংস ক্যান্সার? কে মৃত্যুশয্যায়? নিচের দরজা খোলা কেন? বাড়ির জিনিসপত্তর সব ঠিকঠাক আছে তো? আমার ননস্টিক প্যান? বোন চায়নার টি—সেট? না চুরি ডাকাতি হয়ে গেছে?’ তিনজনেই সমস্বরে বলে উঠল—’মা!’
চিন্ময়ী বললেন—’দ্যাখো বাপু, আমার হাতে বেশি সময় নেই। চান করে, রিণি যদি কিছু রেঁধে—টেঁধে থাকে তো খেয়ে, নইলে না খেয়ে বেরিয়ে যাব। একজন ভীষণ খিটখিটে সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিতে যাব। তারপর পার্কস্ট্রিটে যাব ফটোগুলো নিতে। আমাতে আর সুশান্ততে মিলে ‘আর্চিনস অর ফলিং আর্কএঞ্জেলস!’ বলে একটা স্টোরি করেছি। এ—ক্লাস ম্যাগাজিনে বেরোচ্ছে—পিকস মৃন্ময়ী চক্রবর্তী। দেরি হতে পারে, ভেবো না।’
‘মা’—রবি ভয়ে ভয়ে বলল—’সুশান্ত কে?’
চিন্ময়ী হেসে বললেন—’সে এক ভীষণ অশান্ত তালুকদার। আমরা দুজন ফ্রিলান্স জার্নালিজম করছি! আসবে এখন চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে, দেখিস!’
বিলু বলল—’তুমি সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিতে যাবে? স্টোরি করছ? ফ্রিলান্স? আর্চিন্স অর… কি ব্যাপার বল তো?’
রিনি বলল—’জানি তোমার আজকাল একটু একা একা লাগত। তাই বলে এই বয়সে…’ বলে রিণি হঠাৎ গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে থেমে গেল। সে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল—’মা মা, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান টু ইয়োরসেলফ! হাউ ডু য়ু ম্যানেজ টু লুক সো ইয়াং…’
বিলু আর রবি পর পর বলল—’কোথায় গেছিলে? এতদিন কোথায় ছিলে?’
চিন্ময়ী হেসে বললেন—’টাইম মেশিন পড়েছিস? এইচ. জি. ওয়েলসের? সেই টাইম মেশিনে চড়ে ছিলুম। তারপর দীর্ঘযাত্রা।
পেছনে, অনেক পেছনে।
আবার সামনে, অনেক সামনে।
যাতে তোদের পেতে গিয়ে সময়টা শূন্য হয়েছিল
সেটা ঠিকঠাক ভরাট করে
আবার তোদের সঙ্গে সমানতালে
দৌড়তে পারি।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন