বাণী বসু
রবি যেদিন প্রথম এসে বলল—’মা আমার সেলস ট্রেনীর চাকরিটা হয়ে গেল। ভাগ্যিস মোটরবাইকটা কিনেছিলুম!’ ঠিক সেই দিনই রাত্তিরবেলায় শুতে গিয়ে আমার হঠাৎ মনে হল আমি রাতটাকে একটা মানুষের মতো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বেশ নীল রঙের কেষ্টঠাকুরের মতো, যদিও তার হাত পা চোখ মুখ ইত্যাদি অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ কোথায় কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলতে পারব না। কালচে নীল রঙ, চাঁদ ওঠেনি। আকাশময় তাই তারার ঝকমকানি। কেষ্টঠাকুরটি রাজকুমার হলেও তো গোপরাজকুমার! তারাগুলো কি আর চিরকিশোর সেই মূর্তির অলঙ্কারের মণি—মাণিক্য হবে? এত কথা আমার মনে এল। কেন না আমি আজকাল কিছু বললেই আমার তিন ছেলে মেয়ে বলে ওঠে—’কেন? কেন? কেন?’ এই কেনর জবাব দেবার ক্ষমতা সব সময়ে আমার থাকে না। তাই মনে কোনও কথা উঠলেই তার কার্য কারণটা ভেবে রাখবার চেষ্টা করি। কেন যে কেষ্টঠাকুরের কথা মনে এল! কী জবাব এর? ভেবে ভেবে জবাব বার করি—আসলে এই সব পুরাণ কথা দেবদেবী আমাদের মধ্যে এমনভাবে ঢুকে বসে আছে যে আর অন্যভাবে আমরা ভাবতে পারি না। হ্যাঁ, কী বলছিলুম? রাতটাকে আমি একটা বিরাট পুরুষের মতো দেখতে পেলুম! বিরাট, অসীম শক্তিধর, কিন্তু কিশোর। কালপুরুষটা জ্বলজ্বল করছে। কালচে নীলার মতো মখমল আকাশে। অন্ধকারের কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ আছে, টের পেলুম। তোমরা বলবে রাতে কতরকম ফুল ফোটে তারই গন্ধ পেয়েছো। হবেও বা। কিন্তু রাতের কয়েকটা ফুলের গন্ধ তো আমি চিনি! এ সেরকম না। এ যেন কিরকম একটা রহস্যময়, বিশাল, অজানার গন্ধ। গন্ধটা বাইরে থেকে আমার ভেতরে ঢুকে গেল, আচ্ছন্ন করে দিল আমাকে। যেন আমি আর আমি নেই, আমার ভেতরে যেন আর কেউ এসে আস্তে আস্তে বসছে। অনেকক্ষণ আমাদের বাড়ির একফালি ছাতে পায়চারি করতে করতে সেই রাত—কিশোর, সেই অজানার গন্ধ, সেই নিজের ভেতরে অন্য কারুর পা টিপে—টিপে প্রবেশ সব বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলুম। উপভোগও করতে লাগলুম। তারপর যখন মনে হল এইভাবে আমি একেবারে হারিয়ে যাচ্ছি, তখন হঠাৎ যেন খেলা ভেঙে দিয়ে হেরো খেলুড়ির মতো দুড়দাড় করে নিচে নেমে এলুম। দুড়দাড় করে বললুম বটে কিন্তু সেটা আমার ভেতরের তাড়ার কথা ভেবে। আসলে আমার পায়ের শব্দ হয় না। শব্দ না করে কীভাবে চলতে হয়, নিঃশব্দে কীভাবে হাসতে হয়, বা খুব বেশি হাসি পেলে আঁচল দিয়ে তাকে আড়াল করতে হয়, কীভাবে না চেঁচিয়ে কথা বলতে হয় এ আমার হিতৈষিণীরা কতদিন ধরে শিখিয়েছিলেন।
নিচে নেমে দেখি ওরা তিনজনে মিলে খুব গল্প আরম্ভ করে দিয়েছে। ওদের খেয়াল নেই ঘড়ির কাঁটা এগারটার দিকে যাচ্ছে। খুব তর্ক—বিতর্ক হচ্ছে। যদিও তার মধ্যে রাগারাগি নেই, কিন্তু বেশ তীব্রতা আছে। রবি, বিলু আর রিণি।
বললুম—’কি রে, খাবি না?’
—’এই তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম। তাড়াতাড়ি তোমার খাওয়া—দাওয়ার পাট চুকোও তো! আজ একটা দারুণ লেট নাইট ফিল্ম আছে।’
—আমার গলায় উদ্বিগ্ন প্রতিবাদ উঠে এল, ভেতরে যেটা খুব উদ্বিগ্ন, বাইরে অবশ্য সেটা খুব নরমভাবে বেরোয়। ছবিটা আমি জানি, বড্ড বেশি এ—মার্কা। তিন ভাইবোনের একসঙ্গে বসে দেখবার নয়। থাকতে পারলুম না, বলে ফেললুম—’ওই ছবিটা আর না—ই দেখলি!’
ওরা তিনজনে হেসে উঠল সমস্বরে। রবি, বিলু আর রিণি। আমার তিন ছেলেমেয়ে। বড় রবি বাইশ। মেজ বিলু কুড়ি। আর ছোট রিণি সতেরো। রবি, নতুন—চাকরি—পাওয়া রবি বললে—’মা, তুমি এখনও ছেলেমানুষ আছ! খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়।’ শোনো কথা, আমি রবির প্রায় ডবল—বয়সী, আমি হলুম গিয়ে ছেলেমানুষ, আমাকে অ্যাডাল্ট ছবির আওতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। আর ওঁরা তিনজন পূর্ণবয়স্ক বাইশ, কুড়ি, সতেরো নিশ্চিন্তে রাত দেড়টা কি দুটো পর্যন্ত ছবিতে নর—নারীর জীবনের যতেক গোপনতার উদঘাটন দেখবেন বসে বসে। খাবার জন্যে যে ছোট্ট জায়গাটা রান্নাঘরের সামনে রয়েছে সেইখানেই ছোট্ট টিভিটা বসানো আছে। আমি ওদের রুটি আর ডিমের ঝোল বেড়ে দিয়ে নিজের খাবারটা নিয়ে টিভির দিকে পেছন ফিরে বসলুম। খেতে খেতেই বোধহয় ছবিটা আরম্ভ হবে। গোড়াতেই একটা বেড—রুম সিন দিয়ে আরম্ভ। যাই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খেয়ে নিয়ে ছেলেমানুষ আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। জানি না কখন রিণি এসে আমার পাশে শোবে। হয় ফিল্ম শেষ হলে, নয় তার আগেই, ওর যদি ভাল না লাগে।
শুয়ে শুয়ে আমার ঘোর আসতে লাগল, আর ঘোরের মধ্যে আমি রবির গলা শুনতে লাগলুম,—সামান্য একটু হাসি মেশানো গলা ‘মা তুমি এখনও ছেলেমানুষ আছ!’ মা এখনও তুমি ছেলেমানুষ…ছেলেমানুষ কথাটা আমাকে ধাক্কা দিতে লাগল। আমি কখনও ছেলেমানুষ ছিলুম, যে ছেলেমানুষ থাকবো! হঠাৎ মনে পড়ে গেল মামার বাড়ি গিয়ে খাটের তলায় শুয়ে ‘ক্রৌঞ্চ—মিথুন’ বলে একটা বই পড়ে আমার কী বমি পেয়েছিল, তারপর আমার মাসতুতো বোন যে নিয়মিতি নিষিদ্ধ বইয়ের সরবরাহ করে যেত, সে আমার অবস্থা দেখে বেরসিক বলে বই দেওয়া বন্ধ করল। আমিও বেঁচে গেলুম। কিন্তু আরও একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমার এক স্কুল—টিচার দিদি আমাদের ভাল ভাল গল্প, উপন্যাস, রম্য রচনা পড়ে শোনাত। কিন্তু যতবড় উপন্যাসই হোক আমাদের হাতে কখনও ছাড়ত না। আমি আর আমার এক বোন মিলে শেষকালে ঠিক করলুম দিদির অনুপস্থিতিতে বই খুলে দেখতে হবে—কেন! তক্কে তক্কে রয়েছি। দিদি স্কুলে চলে গেছে। দুপুর বেলা দিদির আলমারির চাবি যোগাড় করে বার করলুম সেই বই—’ঝিন্দের বন্দী’। পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি, অবশেষে আমার বোন বলে উঠল—’পেয়েছি।’ গৌরীশংকর আর কস্তুরীর প্রেমের দৃশ্য। একটুখানি। সেইটুকু দিদি সাবধানে বাদ দিয়ে গেছে। তখন আমাদের চোদ্দো—পনের বছর বয়স। দুজনে হেসে কুটিকুটি। এইভাবে ‘ইছামতী’র নিস্তারিণীর অবৈধ প্রেমকাহিনী এবং ‘ভবানী তখন তিলুকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিলেন গোছের একটা লাইনও খুঁজে বার করেছিলুম। আর হেসে কুটোপাটি হয়েছিলুম।
একদিন আমার মেজছেলে বিন্দু এসে বলল—’মা হাজার পাঁচেক টাকা পাবো?’
—’কেন রে?’
‘আমরা কয়েক বন্ধু, তুমি তাদের চেনো অলক, সামন্ত, টুটুল আর রুমি ছবি করব ঠিক করেছি।’
—’ছবি করবি? ছবি?’
—’মানে ফিল্ম, ডকুমেন্টারি করে সেল করব।’
—’সে কি রে? কোনদিন এ সব বিষয় কিছু জানলি না, হঠাৎ ফিল্ম অমনি করলেই হল? তাও আবার পাঁচ হাজার টাকা! পাঁচ হাজারে ফিল্ম হয় নাকি?’
—’ওহ, মা, য়ু নো নাথিং। আমার বইয়ের র্যাকে যে ম্যাগাজিন আর বইগুলো আছে একটু উল্টে পাল্টে দেখো? টুটুল আর রুমির পুনের ট্রেনিং আছে। অলক রবীন্দ্র ভারতীর ফুল কোর্স করছে। সামন্তর অনেক টাকা। আমার ইম্যাজিনেশন। তা ছাড়া যে যেরকম পারি টাকা দেবো। আমি তো জানি তুমি পাঁচ হাজারের বেশি চাইলে হার্ট ফেল করবে তাই…’
—’তো কিসের ওপর ছবি করবি!’
—’শের।’
—’সে কি রে? চিঁড়িয়াখানার বাইরে কোনদিন বাঘ সিঙ্গি দেখেছিস? বাঘের ওপর ছবি করবি কি রে? মাথা খারাপ। ও সব মতলব ছাড়ো বিলু।’
বিলু বলল—’উঃ, মা, তুমি একটা ইমপসিবল, শের মানে উর্দু কবিতা, আজকাল হায়েস্ট ফ্যাশন, অর্ডার অব দ্য ডে। সেই কবিতার ওপর করব! হয়েছে তো? দাও এবার টাকাটা দাও। তুমি বড্ড ব্যাকডেটেড মা!’
পাঁচ হাজার টাকা ওকে দিলুম। টাকাটা জলে দিচ্ছি ভেবেই দিলুম। কিন্তু মাস ছয়েক পরে ও টাকাটা আমাকে ফেরত দিল। ভীষণ ব্যস্ত গলায় বলল—’এবার মা কেরলের দিকে যাব, ট্যুরিজমের একটা কাজ পেয়েছি। ট্যুরিজমের একটা কাজ যদি ভালো করে করতে পারি তো একেবারে চেইন! পর পর পর পর পেয়ে যাব! এইবার প্রফিট আসতে শুরু করবে!’
‘ছেলেটা আমার বি—এসসি পাশ করে বসেছিল। এম—এসসিতে চান্স পায়নি বলে কয়েক মাস খুব গোমসা মুখে ঘোরাফেরা করত। আমি মনে মনে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। তারপর কবে যে কি সব যে ট্রেনিং ফেনিং নিল, বন্ধুদের সঙ্গে মিলে পরামর্শ করতে আরম্ভ করল খেয়ালই করিনি। আমি বললুম—’হ্যাঁ রে পরের বছর এম—এসসি’র জন্যে চেষ্টা করবি তো?’
বিলু বলল—’ওহ মা, কারেন্ট ইয়ারের ছেলেরাই চান্স পাচ্ছে না। তার আগের বছর! ও সব ছাড়ো তো! তুমি না বড্ড ব্যাকডেটেড। এম—এসসি পড়ে কী হয়? কিস্যু হয় না।’
সুটকেস গুছিয়ে, রুকস্যাক ঘাড়ে নিয়ে পরদিনই দেখি বেরিয়ে যাচ্ছে—মা কবে আসব বলতে পারছি না!
বললুম—’সে কি রে? এই কোত্থেকে এতদিন পর ঘুরে এলি। এক্ষুনি আবার চলে যাচ্ছিস? কদিন একটু জিরিয়ে গেলে পারতিস।’
‘বিলু টান—টান হয়ে উঠে দাঁড়াল জুতোর ফিতে বেঁধে। তারপর বলল—’পান চিবোতে চিবোতে পকেটে টিফিনকৌটা নিয়ে ধীরে—সুস্থে আপিস যাবার দিন চলে গেছে মাম্মি। য়ু আর হোপলেসলি ব্যাকডেটেড।’ গটগট করে বিলু চলে গেল।
কথাটা ওর মুখে কয়েকবারই শুনলুম—ব্যাকডেটেড, ব্যাকডেটেড। টু ব্যাকডেটেড। হোপলেসলি ব্যাকডেটেড।
একটা লম্বা বারান্দা আমাদের চলে গেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। বড্ড সরু। কাপড় শুকোতে দেবার জন্যে ব্যবহৃত হয়। আর রাজ্যের পায়রা ওপর থেকে বকম বকম করে বারান্দাটা নোংরা করে। ঝুলঝাড়া দিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করলেও যায় না। তখনকার মতো চলে গেলেও আবার রাতে ফিরে এসে বক বকুম, বকুম, কুম, বকুম কুম করতে থাকে। সকালবেলায় বারান্দাটার আগাপাশতলা আমায় ধুতে হয়। পায়রাগুলো ফিরে আসলে আমার ভাল লাগে। কি রকম ঘুমপাড়ানিয়া, সুখজাগানিয়া পায়রার ডাক। বাকুম, কুম, কুম, বাকুম বাকুম। যেন ডাকটা মুখ ফুটে বেরোয় না। গলার কাছেই আটকে থাকে। আমার ভাল লাগে। আমাদের বাড়িতে অমনি পায়রা ভিড় করে থাকবার জায়গা ছিল। দুপুরে সারা দুপুর ঝটপট ঝটপট, বাকুম, বাকুম রাত্তিরেও ঝটপটাপট মাঝে মাঝে, আর কুম কুম কুম। যদি ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করে—পায়রার ডাক তোমার ভাল লাগে কেন? ওরা ফিরে এলে খুশি হও কেন? কেন? কেন? তা হলে কি বলব? জবাবটা ভেবে রাখতে গিয়ে এইসব কথা আমার মনে এসে যায়। ওরা স্মৃতিজাগানিয়া পায়রা। সুখস্মৃতি। যখন মা বাবা, ভাই বোন। যখন স্কুল, গান, মুগ্ধ দিদিমণি, যখন দিদিমা, আদর, পান মুখে দিয়ে ধীরে—সুস্থে অফিস যাওয়া—টিফিনে আজ লুচি, আলুর দম, তোদের চিংড়ি মাছ দিয়ে পেয়াজকলির চচ্চড়ি আছে। কি আনবো অফিস—ফেরতা? কি আবার আনবে, ফলফুলুরি যদি কিছু সুবিধের পাও। পেয়ারা পাতায় নুন তেল দিয়ে দাঁত মাজ, ঝকঝকে হবে। হাসলে দাঁত ঝিকঝিকিয়ে উঠবে, রেলগাড়ি চলে গেল—ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক কু…উ…উ। তাই আমি পায়রাদের ফিরে—আসা পছন্দ করি। আমার তো ভবিষ্যৎ নেই। আছে শুধু রোমন্থনের অতীত। আর বর্তমান। বর্তমান! বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে আকাশটাকে, শহরের রাস্তাঘাট, বাড়ি—টাড়ি কেমন কাটা—ছেঁড়া লাগে। যেন অপারেশনের রুগী। কাটা ছেঁড়া হয়েছে, সেলাই এখনও হয়নি। কোনদিন হবে কি না জানিও না। আমাদের গলিটা আঠার ফুট মতন। মাঝে মাঝে হাঁড়ল গর্ত। দু—তিনটে বাড়ি বাদ দিয়ে এক এক জায়গায় আবর্জনার স্তূপ জমে আছে—তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, ছেঁড়া কাগজ, ন্যাতা ক্যাঁতা, আরও সব জঘন্য নোংরা, অদূরে মানে বড় রাস্তার ওপর বেশ কয়েকটা লম্বা বাড়ি উঠেছে। ছ তলা, আট তলা। ফলে আরও দূরের দিকে তাকিয়ে যে বড় রাস্তায় গাড়ি চলা, মানুষজনের অবিরাম চলাফেরা, দোকানের আলো এ সব দেখতে পাব তার জো নেই। ঝকঝকে বাড়িগুলো। পিনু মানে পিনাকী, আমার মামাত দেওর, ওদের বাড়িটা আর দেখা যায় না। আমার এক ননদ কাছেই থাকেন, ওঁদের উঠোনে লম্বা তারে ধুতি শাড়ি শুকনো তা—ও আর দেখা যায় না। উঁচু, ঝকমকে বাড়িগুলোর পাশে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যেতে চাইছে, মিয়োনো, দোতলা—তেতলাগুলো। শ্যাওলা ধরা, গাছ—গজানো, জানলার পাল্লাগুলো খাপছাড়াভাবে রং করা। ও মা! একটা ছ’ তলা তো রুবিদের বাড়ির ওপরই উঠেছে মনে হচ্ছে, তা হলে রুবিরা কোথায় গেল? যাঃ, আজকাল কেউ কারও খেয়াল রাখে না। কবে যে রুবিদের ওপর অমনি তেধেড়েঙ্গে একটা বাড়ি উঠল আমি জানিই না। খুব ব্যস্ত হয়ে ডাকি ‘রিণি রিণি’, রিণি ঘরের ভেতর কি ম্যাগাজিন পড়ছিল, উঠে এসে বলল—’কি মা? কী হয়েছে?’
—’রুবিরা কোথায় গেল? রুবিদের বাড়ির ওপর…?’
—’কী আশ্চর্য! রুবিরা ওখানেই আছে! ওর ভেতরেই ওদের ফ্ল্যাট দিয়েছে। বড় রাস্তার দিকে মুখ করে ওদের ফ্ল্যাটটা তো তাই দেখতে পাও না।’
—’এত ভাববার কী আছে! তুমি না…’
‘আমি একটা বিশেষণের জন্যে অপেক্ষা করি। কিন্তু রিণি তার কথা শেষ করে না।’ না বলে একটা টান দিয়েই অসমাপ্ত ম্যাগাজিনের কোলে ফিরে যায়। নাঃ। আমার সামনে লম্বা লম্বা বাড়ি। দৃষ্টি রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে তাকিয়েও কোনও লাভ নেই। আশপাশে হাঁড়ল গর্ত।
আবর্জনা, মোটরবাইকের গরগর, রুকস্যাক, চকচকে ম্যাগাজিনের মধ্যে রক্তের ফোয়ারা নগ্নপ্রায় নারী, ভিখারী শিশুর পাঁজরের ছবি। তাহলে আমি পায়রাদের দিকে ফিরব না কেন? বাক বাকুম, বাকুম, কুম, কুম,—উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রার পিঠে চড়ে আমি সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে কেন নিচু আকাশ দিয়ে ছেৎলাপড়া, বেমানান রঙের বাড়ি আর বহুতলের অ্যানটেনা সঙ্কুল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাবো না চঞ্চল পাখনায় যেখানে মুগ্ধ দিদিমণি, সব পেয়েছির আসর, ডালে সম্বরার গন্ধ আর কু ঝিক ঝিক, ঝিক ঝিক, ঝিক…। শুধু যদি ওরা বারান্দাটা এমন করে নোংরা না করত!
রিণি বলল ‘মা তুমি চা—টা খুব ভাল করো। কিন্তু কফিটা ঠিক এসপ্রেসো হয় না। তুমি সরো। আমি করে নিচ্ছি।’
ডিমগুলো ও আগেই ভেজে রেখেছে। কী সুন্দর টোপর হয়ে ফুলছিল ওমলেটগুলো। বেকিং পাউডার দিল। ডালের কাঁটা দিয়ে খুব করে ফেঁটানো, ভেতরে পেঁয়াজকুচি, চীজের টুকরো আর টোম্যাটো কুচি দিয়ে কী সুন্দর ভাঁজ করে ফেলল। নন—স্টিক প্যানে কী চটপট হয়ে গেল। একটু হলদেটে সাদা। যেন কাঁটালি চাঁপার রঙ। প্যানটা রবি প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই কিনে এনেছে। কী রকম দৃষ্টি দেখ। জামা না, শাড়ি না, একটা নন—স্টিক প্যান। কী সুবিধেই যে আমার হয়েছে! আমার ছেলে, তালে—গোলে যে বড় হয়ে উঠেছে সে এইরকম বিবেচক হবে আমি ধারণাই করতে পারিনি!
আমি সরে এলুম। দেখলুম রিণি প্রত্যেকটা কাপে কফি চিনি সঙ্গে সামান্য দুধ—মেশানো জল দিয়ে প্রাণপণে ফেটাচ্ছে, কেমন সুন্দর ওপর থেকে গরম দুধ—জল ঢালছে চামচ নাড়তে নাড়তে, আর আধ ইঞ্চি করে ফেনা উঠছে কাপের ওপর। ঠিক দোকানের মতো। কাপ—প্লেটগুলোও খুব সুন্দর, পাতলা, বিলু যাবার সময়ে কিনে দিয়ে গেছে। মিষ্টি না, শাল দোশালা না, একটা চমৎকার টিসেট। রিণি ট্রে বয়ে নিজেই নিয়ে গেল, আজ ওর ক’জন বন্ধু এসেছে। তারা ঝুপঝাপ মাসি—মাসি করে আমায় পেন্নাম—ঠুকলো, একজন খুব বাবার সঙ্গে বিদেশে ঘোরে সে গালে চকাস করে চুমু খেল। তারপর ওরা গল্পে মেতে গেল। পিরভা করণ, ইকোলজি, অলটারনেটিভ এনার্জি, সুষীম চৌধুরীর ডাঁট ভাঙতে হবে। উইকলিটা দারুণ। ইসস শেরগিলের লাইফ…। ‘এই সমস্ত ছেঁড়া—ছেঁড়া কথা আমার কানে এল। কিচ্ছুই বুঝতে পারলুম না। কিন্তু রিণিটা আগে রান্নাঘরের ধার মাড়াত না। আজকাল এত ভাল পারছে ও এসব! আজ ওর খুন্তি ধরা, প্যান ওল্টানো, ওমলেট ভাঁজ করবার কায়দা, কফির জল একবার নামানো একবার বসানোর ধরন, গ্যাসের নবটা চট করে সিম করে দেওয়া আবার বাড়িয়ে দেওয়া—এ সব দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলুম। যে রিণিটা…। আজ এত ভাল পারছে! আশ্চর্য! কোনও আলাদীনের দৈত্যকে তো আমি পুরনো পিদিম ঘষে ডাকিনি! বলিনি ওদের স্বাবলম্বী করে দাও। ওদের বিবেচক, বুঝদার করে দাও! বলিনি তো আমি আর পারছি না। জীবনের এতগুলো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতে পারিনি, হে দৈত্য আমায় মুক্তি দাও। ‘গুপী গাইন, বাঘা বাইন’—এর হুল্লার রাজার মতো আমার ছুটি—ছুটি—ছুটি..ছুটি করে বাড়িময়, ছাতময়, রাস্তাময়, ময়দানময়, পৃথিবীময় এলোপাথাড়ি ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে করল।
এতক্ষণ রিণির বন্ধুরা এসে বসে, রিণিকে সাহায্য করতে হবে বলে গা ধুতে যেতে পারিনি। এবার গেলুম। বাথরুমে দাড়ি কামানোর সুবিধের জন্যে রবি একটা বড় আয়না লাগিয়েছে। তাইতে আমার বুক পর্যন্ত পুরোটা দেখা যায়। মুখখানা ভাল করে দেখলুম। অন্যদিনও দেখি। চুল বাঁধতে দেখি, দাঁত মাজতে দেখি, মুখে সাবান দিয়ে সাবান ধুয়ে দেখি। রোজকার অভ্যেসের দেখা। কিন্তু আজকের দেখাটা অন্যরকম। দেখতুম একজন প্রাপ্তবয়স্ক তিন ছেলেমেয়ের প্রৌঢ়া বিধবা মাকে। আজ দেখলুম তেতাল্লিশ বছরের একজন মানুষকে, যে প্রকৃতির কোন রহস্যময় খেলায় বা নিয়মে মানুষ মেয়ে। এবং আবারও জীবনের কোনও অমোঘ চাঞ্চল্যকর নিয়মে বা খেলায় যে একই সঙ্গে ছেলেমানুষ এবং ব্যাকডেটেড। দেখলুম আমার আধা—ফর্সা রঙে একটা কালচে ছোপ পড়েছে। শীতকালে যেমন সমস্ত গাছপালার ওপর পড়ে, চুলগুলো আমার এখনও, অনেক অযত্নেও অনেক, অনেক। পাকা—টাকা দেখতে পেলুম না। আমার যে বয়স তার থেকে মাত্র চার বছর বেশি বয়সে ঠাকুমা আপাদমস্তক বুড়ি হয়ে মারা গিয়েছিল। গরমের ছুটির দুপুরে তাঁর পাকা চুল তোলার কথা আমার খুব মনে পড়ে। আমার চিবুকের ডানদিকে একটা তিল। যারা তিলতত্ত্ব জানত, তারা মুখ গম্ভীর করে মাথা নেড়ে বলত ডানদিকে না হয়ে যদি ওটা বাঁদিকে হত তাহলে ওর ভাগ্য খুলে যেত। কিন্তু দক্ষিণ অঙ্গে তিল স্ত্রীলোকের ঠিক…। কিন্তু চিবুকটা দেখে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ষোল বছর বয়সে তোলা (নিশ্চয়ই বিয়ের জন্য) আমার একটা ছবি দেখে আমার বাবা এই চিবুকটা নেড়ে দিয়ে বলেছিলেন ছবিতে চিনুমার চিবুকটা ঠিক আসেনি। এই চিবুকটাই ওকে চিরকাল ষোল বছরের করে রেখে দেবে। এসব কথার গুরুত্ব তখন বুঝতুম না। মেয়ে নিয়ে বাবারা অনেক আদিখ্যেতা করে থাকেন। আমার সমগ্র মুখে—চোখে নাকে, চুলে, কোথাও কিছু বলবার মতো না পেয়ে বাবা হয়ত আদরের মেয়ের চিবুকটা নিয়েই পড়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখলুম,—না, বাবা তাঁর পরিণত দৃষ্টি দিয়ে ঠিকই দেখেছিলেন। আদিখ্যেতা করেননি। চিবুকটা সত্যি ঠিক তেমনি আছে। তিনকোনা। তলার দিকটা সামান্য একটু গোল ভাব ছুঁয়ে গেছে। মাঝখানে ভাঁজ। অতিরিক্ত মাংস জমেনি আশপাশে, তলায় কোথাও আর ডানদিকে শুকতারার মতো ফুটফুট করছে সেই অশুভ তিল যা নাকি বাঁদিক ঘেঁষে হলে চিনুর ভাগ্য খুলে যেত। ডান অঙ্গে তিল স্ত্রীলোকের ঠিক…। চিবুকটা তেমনি আছে। ষোল বছরের চিবুক। কিন্তু মুখটা? সমস্ত মুখটা মলিন, চিন্তিত, কেমন বুড়োটে। আমার শোবার ঘরের আলমারিতেও একটা লম্বা আয়না আছে। রিণিই এটা বেশি ব্যবহার করে, শাড়ি পরবার সময়। পাট পাট করে কুঁচি দেবে। লম্বা আঁচল ভাঁজে ভাঁজে ঝুলিয়ে দিয়ে পিন করবে। তারপর পায়ের গোড়ালি দিয়ে টেনে টেনে এ দিকের শাড়ি ওদিকের শাড়ি সব সমান করবে। তো আমি আজ তার সামনেও গিয়ে দাঁড়ালুম। দেখি আয়না কী বলে? আয়না তো স্নো—হোয়াইটের সৎমাকে অনেক কিছু বলেছিল, বলত। দেখি সে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি, বড়াইবুড়ি, ছেলেমানুষ, ব্যাকডেটেড চিনুকে কী বলে? আয়না বলল—’চিনু তুমি রোগাও নয়, মোটাও ঠিক নও, তুমি বাপু কেমন থপথপে। কোনও খাঁজ—খোঁজ নেই, আকার নেই তোমার, সত্যি বলছি। কোনও গতি নেই শরীরটার মধ্যে।’ অথচ সেই ষোল বছর বয়সে যখন আমার থুতনি নেড়ে আদর করেছিলেন তখন আমি রোজ স্কিপিং করতুম। চু—কিত—কিত খেলার সময় বিরোধী দলের কবল থেকে এমনভাবে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বেরিয়ে আসতুম যে খেলুড়িরা আমার নাম দিয়েছিল—কই মাছ। আমি নাকি এমন পেছল যে হাজার বেড়াজালেও আমাকে ধরা যায় না। অথচ অথচ …এমনি মজা যে জীবনের প্রথম জালেই আমি ধরা পড়ে গেলুম। পরের বছর মা মারা গেলেন। বাবা তার পরের বছরই দিশেহারা হয়ে আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। পরের বছর, রবি, দু বছর বাদে বিলু, তিন বছর বাদে রিণি। আর তার পাঁচ বছর বাদেই ঠিক যেমন আমার মা দুম করে চলে গিয়েছিলেন, রবি—বিলু—রিণির বাবাও তেমনি বিনি নোটিশে দুম করে চলে গেলেন। তারপর সংসার ভাগ হল, ভাসুর দেওররা, আমার বাড়ির ভাগ, শাশুড়ির গয়নার ভাগ, দেশের জমির ভাগ সব বুঝিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিলেন। এই সব, আর আমার স্বামীর জমানো কিছু টাকা, ইনসিওরের টাকা, ক্ষতিপূরণের টাকা এই সব দিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে ঘাড় গুঁজে তিনটি শিশু নিয়ে এতকাল কাটিয়ে এসেছি। কীভাবে এতগুলো বছর চলে গেছে টের পাইনি। তাই যখন রবি একদিন এসে বলল—’মা, সেলস ট্রেনির চাকরিটা আমার হয়ে গেছে’, বিলু যখন ছবি করবার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আবার সেটা ফেরত দিল, আর হাতে সুটকেস, পিঠে রুকস্যাক নিয়ে গট গট করতে করতে বেরিয়ে গেল, রিণি যখন কফির কাপের ওপর আধ ইঞ্চি ফেনা তুলতে লাগল তখন আমার আলাদীনের দৈত্যটার কথা মনে পড়েছিল। আমি কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে জেগে উঠলুম। যেন আমার জ্বর—বিকার হয়ে অনেকদিন কোমা ছিল, সবে জ্ঞান ফিরে এসেছে। রিণি যখন ফেনাগুলো তুলছিল জানতুম, চুপসে যাবে, কিন্তু যতক্ষণ ফেনাটা থাকে বুদবুদগুলো দেখতে মজা, চুমুক দিতেও মজা। আমারও ওই ফেনার দশা হবে না তো। এই ক’মাস আগে সামনের বাড়ির প্রীতিদি বিয়ে করলেন। ছোটভাইবোনদের মানুষ করে। তাদের বিয়ে—থা দিয়ে তারপর নিজের এক সহকর্মীকে বিয়ে করলেন। পাড়াময় সব কী হাসি! সমালোচনা! মাথায় ফুল দিয়েছিলেন বলে টিটকিরি। আমার খারাপ লাগেনি। সত্যি বলতে কি, প্রীতিদির জন্যে ভালবাসায়, শুভকামনায় মনটা ভরে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হল প্রীতিদি আমার চেয়েও দু’বছরের বড়। তবে কি আমি সত্যি ছেলেমানুষ! সত্যি ব্যাকডেটেড!
আমাদের বাড়ি একটু অলি—গলি দিয়ে শর্টকাট করলে লেকের বেশ কাছেই। চিলড্রেন্স পার্কের দিকটা দিয়ে ঢোকা যায়। যদি কোনওদিন ভোরবেলা রিণিকে নিয়ে যেতুম তো দেখতুম অনেকে হন হন করে হাঁটছে, অনেকে আবার ছুটছে। কিছু কিছু তরুণ যুবক অল্পবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমাবার উদ্দেশ্যে আবার শরীর ফিট রাখবার জন্যেও ওই সময়ে বেরিয়ে পড়ে। রথ দেখা, কলা বেচা দুইই হয়। আমি রিণিকে একদিন জিজ্ঞেস করলুম—’ওই যে সব লম্বা কিরকমের ড্রেস পরে ছুটছে ওগুলোকে কী বলে রে?’ রিণি বলল ‘ট্র্যাক স্যুট।’ ক’দিন পরেই এরা দু ভাই—বোন কলেজ অফিস বেরিয়ে গেলে আমি দোকান খুঁজে ওইরকম এক ট্র্যাক স্যুট আর একজোড়া ক্যামবিসের জুতো কিনে আনলুম। আর তার পর দিন ট্র্যাক স্যুটটা পরে তার ওপর একটা তোয়ালে আর চাদর চাপিয়ে হন হন করে হাঁটতে লাগলুম লেকের দিকে। পৌঁছেও হাঁটছি, হন হন করে হাঁটছি, হাঁপিয়ে পড়লে একটু বসছি, আবার হাঁটছি। যত বেলা বাড়ছে, পরিচিত মুখগুলোও বাড়ছে। আমি হয়ত চিনি না, কিন্তু তারা আমাকে চেনে। মাসিমা, হাঁটতে বেরিয়েছেন?’ ‘মাসি ডায়বিটিস নাকি? ডাক্তার বলেছে?’ জগিং করুন, জগিং করুন।’ এইসব কথা আমার হনহন হাঁটার তালে তালে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে—যাওয়া হাওয়ার মতো পৌঁছয়, আমি সবেতেই কোনমতে ঘাড় নেড়ে, গটগট করে বেরিয়ে যাই। অর্থাৎ হ্যাঁ, আমি হাঁটতে বেরিয়েছি, হ্যাঁ আমার ডায়াবেটিস হয়েছে, হ্যাঁ ডাক্তার বলেছে, ঠিক আছে আমি জগিং করব। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরে যাই। তোয়ালে দিয়ে ঘামগুলো বেশ করে মুছে ফেলি, একটু বিশ্রাম নিই। তারপর যখন ছেলেমেয়েরা ওঠে, দেখে আমি লম্বা ভিজে চুল মেলে মেঝের এক প্রান্তে বসে আনাজ কুটছি।
তারপর দেখলুম একটু দেরি হয়ে গেলেই বড্ড চেনা মুখের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। মাসি, কাকি, চিনুদি আরে! কখনও তো দেখিনি! দ্যাটস ভেরি গুড! ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া আমার পায়ের পেশীগুলো বেশ টাইট হয়ে গেছে। আমার এখন দৌড়তে ইচ্ছে করে। টেনে দৌড়। কিন্তু ওই ভাইপো—ভাইঝি, ভাগ্নে—ভাগ্নি, বোনপো—বোনঝি, ছোটভাই—ছোটবোনদের সামনে দৌড়তে আমার কেমন যেন কেমন—কেমন লাগে। এদের মধ্যে কেউ একজন রবি—রিণিকে বলে দিয়ে এলেই হল তোদের মা’র মাথাটা দেখা। গোলমালের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তাই একদিন সবচেয়ে ভোরবেলার বাসে চড়ে আমি প্যাঁ পোঁ করে ভিক্টোরিয়ায় পৌঁছে যাই। সে—ও একরকম দৌড়। খালি রাস্তা পেয়ে বাস—ব্যাটা বোঁ, বন বন করে ছোটে, আমার কানের পাশের চুলগুলো শাঁ শাঁ করে পেছনে উড়তে থাকে, মুখের ওপর দুরন্ত দস্যি হাওয়ার ঝাপট, মাঝে মাঝে অতর্কিত ব্রেক কষার জন্যে একটু সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। ভোরের বাস, যাত্রী বিশেষ নেই। কন্ডাক্টর এগিয়ে এসে বলে, ‘দিদি লাগল না তো! এই ডেরাইভার, শালা রঘুনাথ, থোড়া দেখকে চালা না বাবা, দিদির যে লাগল।’
ভিক্টোরিয়ায় ভারি অদ্ভুত দৃশ্য। ঠিক হিপোপটেমাসের মতো একটি দুটি মাংসপিণ্ড, স্পোর্টস গেঞ্জি আর শর্টস পরে, ম্যামথের শুঁড়ের মতো থাই নাচিয়ে নাচিয়ে দৌড়চ্ছেন। ছোটার তালে তালে থাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জায়গার অতিরিক্ত মেদ চর্বিগুলোও কত্থক নাচছে, দুনি তালে। বেশ কিছু মহিলাকে দেখলুম একদম সীলমাছের মতো, কি সিন্ধুঘোটকের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে দৌড়চ্ছেন আর দরবিগলিত ঘর্মধারা মুছে যাচ্ছেন। এঁদের কাছে আমি শিশু। হিমালয়ের পাশে নেংটি ইঁদুরের ছানা। সুতরাং এক নং পুকুর, অর্থাৎ ক্যাথিড্রাল রোডের দিকের পুকুরটার পাশ দিয়ে মোটামুটি বেড় দিয়ে দৌড়তে থাকি, এক পাক দৌড়ে অশ্বারোহী মূর্তির তলায় বসি, আবার দৌড়ই। আমার পাশ দিয়ে নতুন ওঠা ঘাস আর জলের গন্ধ বয়ে হাওয়া শনশন করে আমার পাশে পাশে দৌড়য়। বলে চিনু, চিনু, আর একটু জোরে, আর একটু … তোমার উড়ন তুলোর গুছিগুলো পেয়ে গেলেও যেতে পারো। আর যদি আরও জোর পারো, তাহলে একেবারে চাঁদের মা বুড়ির দেশে তোমায় পৌঁছে দিয়ে আমি সত্যি সত্যি হাওয়া হয়ে যাব। তারপর দুই ডুবে তুমি কী নেবে না নেবে সে তোমার ব্যাপার! তুলোর পেঁটরা চাও না অলঙ্কারের প্যাঁটরা চাও না রাজজকুমারের প্যাঁটরা চাও সে তোমার ব্যাপার! আমি দৌড়তে দৌড়তে বলি, আগে তো ছোটার জন্যে ছুটি, তারপর হাওয়া তোমার সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতাহীন প্রতিযোগিতা, কেন না তোমাকে তো আমি সত্যি—সত্যি হারাতে পারব না। তবে তুমি যদি একটু ভালেবেসে আমার সহ দৌড়বাজ হও তো চাঁদের মা বুড়ির তুষারশীতল, মন—প্রাণ—ঠান্ডা করা শান্তির দেশে একমাত্র জীবিত মানুষ হয়ে উজ্জীবিত কিশোরী হয়ে আমি প্রবেশ করলেও করতে পারি বটে। তারপর বর, প্যাঁটরা ও সব আমার ব্যাপার। একটা মুশকিল হতে লাগল, অন্য যাঁরা দৌড়তে আসেন—বেশিরভাগই গাড়ি চড়ে। কাজেই অদ্ভুত বেশে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাঁদের কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু ফেরবার সময়ে ট্র্যাকস্যুট পরে আমার ট্রামে—বাসে একটু অসুবিধে হয়। আর একটা মুশকিল আমার মোটা বেণীটা, ছোটবার সময়ে শপাং শপাং করে আমার পিঠে চাবুক মারে। ভেবে—চিন্তে চুলটা কেটে অর্ধেক করে ফেললুম। পেছনে শক্ত করে একটা ঝুঁটি বেঁধে নিই। একজন বয়স্ক মহিলা আসেন মূর অ্যাভেন্যু থেকে। অশ্বারোহীর তলায় বসে তাঁর সঙ্গে ভাঙা হিন্দি আর ভাঙা ইংরেজিতে ভাব জমিয়ে ফেললুম। ফেরবার সময়ে তিনিই আমায় আমার গলির মোড়ে ছেড়ে যান। ভদ্রমহিলার মহা চিন্তা। ডাক্তার দু—স্লাইসের বেশি রুটি দিচ্ছে না। ক্লিয়ার চিকেন স্যুপ। দু—টুকরো চিকেন, কচি মাছ পঞ্চাশ গ্রাম, বাঁধাকপি আর জল খেতে বলেছে। খিদে পেলেই জল। নো চকলেট, নো আইসক্রিম, নো ফ্রুটস বাট কিউকামবার, অ্যান্ড টী উইদাউট মিল্ক অ্যান্ড শুগার। আই অ্যাম সো ফন্ড অফ পোট্যাটোজ—ইন এনি ফর্ম। হী ডাজনট লেট মী হ্যাভ ইভন এ হ্যান্ডফুল অফ গ্রেপস। হাই মেনি টাইমস ক্যান ওয়ান হ্যাভ প্রেপফ্রুট জুস? ভদ্রমহিলা ককাতে থাকেন। সবেতেই নাকি প্রচুর প্রচুর ক্যালোরি। তাঁর ব্লাড শুগার তিনশ পঁয়ত্রিশ। হার্টে মেদের চাপ পড়ছে। ডাক্তার বলেছে ইদার য়ু ফলো দিস রেজিমেন অর য়ু ডাই। ভদ্রমহিলা আমার পরামর্শ চান কোনটা গ্রহণ করবেন। আমি দ্বিতীয়টা অপছন্দ করি না। কিন্তু সে কথা তো তাঁকে বলা যায় না। তাঁকে প্রাণপণে বোঝাতে থাকি শাক খান, শাকে মিনার্যালস আর ভিটামিন আছে। তিনি নিশ্চয় রোগা হবেন। ব্লাড শুগার কমবে, প্রেশার কমবে। একটু—আধটু আলুভাজা, আম, আঙুর, এইসব তাঁর প্রিয় জিনিস খেতে পারবেন। তবে হ্যাঁ বুঝেসুঝে।
আর একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। কোন বড় কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমাকে বললেন আই টেক ইনসপিরেশন ফ্রম ইউ। তুমিও নিশ্চয়ই একদিন আমারই মতো ছিলে ডাক্তারের পরামর্শমতো খেয়ে আর ছুটে ছুটে এখন এত সুন্দর স্লিম হয়ে গেছ। ইয়োর স্কিন ইজ গ্লোয়িং। য়ু আর লুকিং লাইক আ বাডিং অ্যাথলিট।
আমি ভদ্রলোকের ভুল ভাঙিয়ে দিই না। আমি যে কোনদিনই তাঁর মতো কুমড়োপটাশ ছিলুম না, শুধু ছিলুম কিছুটা আকারহীন, থপথপে থলথলে, সেটা তাঁর কাছে ভাঙি না। চুপ করে হেসে যাই। তিনি অবশ্য দূরের দিকে দুঃখিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন—’বাট ইউ আর ইয়াং। লেট টোয়েনটিজ কি আর্লি থার্টিজ—এ পারা যায়, তা কি আর ফিফটিজ—এ হয়?’ আমি চমকে উঠলুম। গ্লোয়িং স্কিন, বাডিং অ্যাথলিট, লেট টোয়েনটিজ, এসব আমায় চমকে দিল। কিন্তু এখনও আমায় আরও দৌড়তে হবে।
আলমারির গায়ে লম্বা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। শায়া, ব্লাউস, ধনেখালি সরু পাড় শাড়ি, না কুঁচিয়ে পরা, তা সত্ত্বেও আকার বোঝা যাচ্ছে। মুখের চামড়া, টান টান হয়ে আছে, যেন পাতলা করে কিছু ক্রিম মেখেছি। চুলগুলো, দাঁত সব ঝকঝকে করছে। চলতে ফিরতে পারি যেন হাওয়ায় ভেসে, বাঁক নিতে উঠতে বসতে কোনও কষ্ট নেই। একদিন দরজায় বেল শুনে তুরতুর করে নেমে দরজা খুলতে যাচ্ছি দেখে, রিণি মন্তব্য করল—’মা তোমার কী হল? হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবার একটা কাণ্ড করবে দেখছি?’ আমি তাড়াতাড়ি সামলে নিই।
এরপর আমি যোগ আর সাঁতারে ভর্তি হই। সেই সঙ্গে লাইব্রেরিতে। সাঁতার আমি চিৎ উপুড় সব জানি। ওসব আমায় শেখাতে হবে না। যোগও আমার অল্পবয়সে অভ্যেস ছিল। সাধা গলায় গান তুলে নেবার মতো, এতেও কোনও অসুবিধে হয় না। শুধু দৌড়টা সম্পূর্ণ করবার জন্যে এসব করি।
তারপর একদিন দোকানে গিয়ে দরকারমতো কিছু কেনাকাটা করি। সুটকেস গুছিয়ে নিই। হাতব্যাগ গুছিয়ে নিই। রাত্তিরবেলায় ছেলে মেয়েকে খেতে দিয়ে, নিজে খেতে খেতে বলি,—’রবি চেকবইটা রাখ। হঠাৎ যদি দরকার হয় তুলবি। রিণি, দুজনের মতো একটু রান্না করে নিতে পারবি না? রবিও সাহায্য করবে।’ ওরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায় বলে—’কেন? কী ব্যাপার? তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
—হ্যাঁ, কাল ভোরের ট্রেনেই।
—সে কি? কে সঙ্গে যাবে? একা একা কোথায়… কেন! নিরুদ্দেশ হচ্ছো নাকি? কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে? টিভি—তে ছবি? কী করেছি আমরা?
আমি হেসে বললুম—’এতগুলো প্রশ্নের জবাব কি করে দিই বল তো? আমার সঙ্গে কাউকে যেতে হবে না। আমি একাই পারবো। না, নিরুদ্দেশ হচ্ছি না। বড় জোর মাস ছয়েক। নিয়মিত চিঠি দিয়ে যাব। ভাবিস না। না তোরা কিছু করিসনি। আবার করেছিসও। ভাল করেছিস। কোথায় যাচ্ছি?’
—’বলব না।’
—’এত রহস্য কেন? মা তুমি কি চুপিচুপি কাউকে খুনটুন করে পালাচ্ছো?’ রিণি বলল।
—’মা, ডোন্ট মাইন্ড, ইলোপ—টিলোপ করছ না কি কোনও মামু কাকুর সঙ্গে?’
—রবি বলল।
আমি বললুম—’যতই কেন আমায় ক্ষেপাও আর তাতাও, আর একটা কথাও আমার মুখ দিয়ে বার করতে পারবে না। এইটুকু শুধু বলছি ভাবনার কিছু নেই। মাস ছয়েকের মধ্যে ফিরে আসব। চিঠি পাবে। তোমাদের যদি কিছু বিপদ—আপদ হয়, বাংলা কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে। না হলে আমি সময় হলেই ফিরে আসব।’
লেকের কিছু কিছু গাছ চিনতুম। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার বাগানে প্রায় কোন গাছই চিনতুম না—সর্বজয়া বা ক্যানার ঝাড় ছাড়া। গাছ প্রদীপের মতো দুধারে লালচে শক্ত শক্ত পাতা মেলে দাঁড়িয়ে থাকত ও কী গাছ? জানা ছিল না। গাছটা দেখলেই আমার মনের মধ্যে শত শিখায় প্রদীপ জ্বলে উঠত। গুঁড়ি গুঁড়ি পাতায় কুয়াশার মতো ওটাই বা কী গাছ? যেন রহস্যের ঘেরাটোপ পরে আমায় ডেকেই যাচ্ছে। ডেকেই যাচ্ছে। ডাকও নয় হাতছানি? কিন্তু এখানকার সব গাছপালা আমি মোটামুটি চিনি। সকলেই চেনে। কোথায় এসেছি? বলব না । এমন কি কোন ইস্টিশান থেকে কোন ট্রেন ধরে এসেছি সে সবও বলব না। তোমরা ভীষণ চালাক ধরে ফেলবে। অজ্ঞাতবাসের সময়ে পাণ্ডবেরা কী করেছিলেন? নিজেদের পুরনো পরিচয় মুছে ফেলে অন্য মানুষ হয়ে গেছিলেন না? কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিয়েছিলেন নিজেদের গতিবিধি? নিজেদের পরিচয়? ভীম নিরুপায় হয়ে প্রায় ধরা দিয়ে ফেলেছিলেন আর কি! যাই হোক কোনও সূত্র আমি কাউকে দেব না। শুধু এইটুকু বলি যে কু ঝিকঝিক করে যাওয়া হল না। ভোঁ করে দেবদত্ত কী পাঞ্চজন্যের পিলে চমকানো আওয়াজ চড়ে গিয়েছিলুম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন