বাণী বসু
কত কত দিন হয়ে গেছে, তবু আমি এ জায়গায় অন্ধিসন্ধি চিনি। গলির মুখে জোড়া নিমগাছ। পাশ দিয়ে সরু একটা নোংরা গলি বেরিয়ে গেছে। গলির মুখে একটা টিউবওয়েল হয়েছে দেখছি। ডান দিকে অশথ গাছের তলায় গোল একটা পাথর তার ওপর কিছু ফুল বেলপাতা। একটু সাদা সাদা কস গড়াচ্ছে। অর্থাৎ দুধও ঢেলেছে কেউ। যতদিন যাচ্ছে মানুষের দেবতায় ভক্তি ততই বেড়ে যাচ্ছে। জীবনটা বড্ড অনিশ্চিত হয়ে গেছে তো! ওই তো ইস্টিশানের রেলিং—এর ধার ঘেঁষে মস্ত বড় শিরীষ গাছ। ইসস ঠিক তেমনি আছে। হাতির শুঁড়ের মতো কালো নল বেঁকে আছে, ওইখান থেকে এক্সপ্রেস মেল ট্রেনরা জল নেয়। মাথায় করে ছোট ছোট ঝুড়িতে কয়লা বয়ে ডেঁয়ো পিঁপড়ের মতো ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে এক সারি কয়লাকুড়ানি। শিরীষ গাছটার পেছন থেকে রিকশা স্ট্যান্ড আরম্ভ হয়েছে। একটা রিকশাতে উঠে বসে গন্তব্য বলে দিলুম। অমনি হাওয়ায় উড়তে লাগল খোকাটা। আমার বিলুর বয়সী হবে হয়ত।—’এখখুনি পৌঁছে দিচ্ছি ছোড়দি।’
নির্দিষ্ট বাড়িটার কাছে এসে আমি অবাক। পলেস্তারা খসে গেছে। যেখান সেখান থেকে গাছ বেরিয়েছে। দরজা জানলায় রঙ নেই। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তবু কড়া নাড়লুম। বেশ কিছুক্ষণ নাড়ার পর এক দশাসই চেহারার মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। খুলেই বললেন—’আমাদের কিছু কেনার নেই, সাবান, পাউডার, ধূপ, সিঁদুর কিছু না। আপনি আসতে পারেন।’ দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। আমি বললুম—’এটা ব্রজনাথ সিংঘির বাড়ি না?’
ভদ্রমহিলা একটু থতিয়ে গেলেন। বললেন—হ্যাঁ, তো কি?’
—’আসলে আমি একটা ঘর ভাড়া খুঁজছিলুম। শুনলুম ব্রজনাথ সিংঘির বাড়ি অঢেল জায়গা। আমার একটু স্থান হতে পারে।’
—’তুমি ক্যা?’
—’আমার নাম চিন্ময়ী চক্রবর্তী। আমি কলকাতায় চাকরি করি। তা ওখানে কোনও হোস্টেলে জায়গা পেলুম না। তাই এই মফস্বল টাউনে এসেছি। একটু থাকবার জায়গা, আর খাবার ব্যবস্থা যদি হয়। মাসে এক হাজার টাকা করে দেবো।’
—’কি বলল্যা? হাজার?’ মহিলার মুখ হাঁ হয়ে গেল। বুঝলুম এখনও এই টাউনে টাকার দাম বেশিই আছে। আমি তাড়াতাড়ি বললুম—’আমি কলকাতায় খুঁজছি। পেলেই চলে যাব। মাস ছয়েকের মধ্যেই একটা পাওয়ার কথা আছে।’
—’না না সে কথা বলছি না। বলছি আমাদের ঘর দুয়োর তোমার পছন্দ হবে কেন গো মেয়ে, আমাদের খাওয়া—দাওয়া…’
‘আমি বললুম—’এখনও তো দেখিইনি, একটু যদি দেখান।’
—’তুমি কী কর, মেয়ে?’
চিন্ময়ী চক্রবর্তীর পরনে গোলাপি রঙের সালোয়ার আর সাদার ওপর গোলাপি বুটির কামিজ। একটা সাদা ওড়না বাঁ কাধ থেকে ভাঁজ করা অবস্থায় ঝুলছে। চুলগুলো মাথায় ঝুড়ির মতো হয়ে আছে, কপালে ছোট্ট একটা গোলাপি টিপ। নখ সুন্দর করে কাটা। পায়ে কালো স্যান্ডাল।
আপাদমস্তক দেখে নিয়ে প্রশ্নটা করলেন মহিলা। চিন্ময়ী বলল—’আমি জার্নালিজম করি। মানে সাংবাদিকতা।’
ভদ্রমহিলা হাঁ করে রইলেন।
বললুম—’খবরের কাগজে লিখি। খবরের কাগজের কাজ করি।’
—’ওরে বাবা, ও পুঁটু, ধানু, জংলু খবরের কাগজের লোক এয়েছে রে।’
মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির ভেতর থেকে এক দঙ্গল ছেলে বার হয়ে এল, এবং একটি মেয়ে। রোগা, পাকানো চেহারা উল্টোপাল্টা জামাকাপড় পরা কিন্তু চোখগুলো জ্বলছে, মুখগুলোও বেশ উজ্জ্বল।
—’কী চান। কী চান!’ —একজন বলল।
আরেকজন বলল—’তুই সর বে, কে আমি দেখছি, কোন সালী, কোন বাঞ্চোৎ।
চিন্ময়ী হাত তুলে থামাতে ইঙ্গিত করল ওদের। তারপরে বলল, ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকবার জন্য এসেছিলুম। এ বাড়িতে অনেক জায়গা আছে, কে একজন মহিলা ভাল রান্না করতে পারেন শুনে। তা আপনাদের এত আপত্তি থাকলে আমি চলে যাচ্ছি।’
পেছন ফিরতে ফিরতে চিন্ময়ী বুঝতে পারল মহিলা ছেলে মেয়েগুলোকে চুপি চুপি কিছু বলছে। মেয়েটিও কোমরে হাত দিয়ে ডাকল ‘এই যে শুনছেন?’
ফিরে দাঁড়িয়ে চিন্ময়ী বলল, ‘কী?’
—খাওয়া থাকার জন্যে দিমাকে আপনি হাজার টাকা দেবেন বলেচেন?’
—’বলেছি।’
—’তো থেকে যান!’
—’এখানে আমার পোষাবে না মনে হচ্ছে—’ চিন্ময়ী আবার ফিরে দাঁড়াল।
—কেন? তিন—চারটে মিশ্রিত গলায় শোনা গেল।
চিন্ময়ী বলল—’এইরকম বে—টে, শালী—টালি, মারমুখো ভাব এসব আমার চলবে না। কে জানে ভেতরে কিসের আড্ডা। মস্তানি—টস্তানি; ড্রাগ—ট্রাগ; সাট্টা—ফাট্টা। থাক আমি অন্য কোথাও খুঁজে নিচ্ছি। অনন্ত ঠাকুরমশায়ের বাড়িটাও তো আছে?’
ছেলেমেয়েগুলো সব পেছন থেকে এক দৌড়ে সামনে এসে চিন্ময়ীর পথ রোধ করে এসে দাঁড়াল।—’অনন্ত ঠাকুরের ছেলের বউ মরে গেছে। ছেলে হাত পুড়িয়ে খায়। বাড়িতে তিনটে খোকা—খুকু সব সময়ে খাই—খাই করচে। তোমাকে আস্ত গিলে খেয়ে নেবে।’ একজন বলল।
—আর একজন বলল—’হুঁঃ ড্রাগ! ফ্যান ভাত জুটলে বেঁচে যাই, শাক সেদ্ধ আর আলুসেদ্ধর সঙ্গে, আবার ড্রাগ! আর সাট্টা—ফাট্টা রিকশঅলারা খেলে—আমাদের রেস্ত কোথায়?’
চিন্ময়ীর রিকশাঅলাটা তখনও বোধহয় মজা দেখতে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটা কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল, ‘এই মদনা, তুই সাক্ষী দে না আমরা সাট্টা খেলি না তোরা খেলিস!’—উত্তরে মদনা এবার সাইকেলে প্রাণপণে প্যাডেল করতে করতে বেরিয়ে গেল।
—’দেখলেন তো!’ মেয়েটা তেমনি কোমরে হাত দিয়ে বিজয়িনীর ভঙ্গিতে বলল।
চিন্ময়ী বলল—’ওই সব শালী—টালি চলবে না আমার।’
—’সরি ম্যাডাম’—একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল—’ও সব আমাদের নিজেদের মধ্যে আদরের ডাক। আর বাইরের পার্টিকে ভড়কাতে খুব কাজে লাগে।
—’ভড়কাতে হয় কেন?—চিন্ময়ী একটু কঠোর গলায় বলল।
—’ভড়কাতে …মানে…হয়… এই আরকি!’ ছেলেটা স্পষ্ট করে কিছুই বলে উঠতে পারল না। তখন মহিলা এগিয়ে এসে বললেন—’ও হতভাগারা বলতে পারবে নে। আমি বলচি। সিঙ্গি মশাইয়ের ছেলে আমাকে এই বাড়ি দেকাশোনার ভার দিয়ে চলে গেল। বিদেশ থেকে মাসে মাসে ট্যাকা পাঠায়। এই পুঁটুটা আমার বোনঝির মেয়ে, পটলটা ভাইপোর ছেলে। ওদের কেউ নেই তাই ঠাঁই দিয়েছি। সে কতা তো আর বাবু জানে না। আর এই সব বাকিগুলো সব হাড়—হাভাতের দল। ছোটলোকের বাচ্চা, সর্বক্ষণ এখানে পড়ে আচে। সোনার নাতি—নাতনি আমার সঙ্গদোষে বজ্জাত হয়ে যাচ্চে মা। তুমি এখানে থাক। বিনিবামনীর রান্নার সুখ্যাত শুনে যখন এয়েচ!”
‘ছোটলোকের বাচ্চা’ পর্যন্ত শুনেই বাকি ছেলেগুলো আহত অভিমানে অস্বাভাবিক গম্ভীর করে চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে একজন বলল—’চোর বাটপাড় থেকে বাঁচাতে হলে বোলো দিমা, খুব বাঁচাব।’
চিন্ময়ী চে�চিয়ে ডাকল—’এই ছেলেরা শুনে যাও।’ ওরা দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু কাছে এল না।
চিন্ময়ী বলল—’আমি এ বাড়িতে থাকলে তোমাদের আপত্তি আছে? আমার যখন—তখন কাজ, বেরিয়ে যাই। জিনিসপত্র থাকবে। তোমরা একটু পাহারা না দিলে…। আমাকে অবশ্য কেউ কাবু করতে পারবে না। আমি কারাটে কুংফু সব জানি…।’ বলে সে ডান পাটা সোজা উঁচুর দিকে ধাঁই করে ছুঁড়ল।
—’স—ব?’ পুঁটু এগিয়ে এল—’আমায় শিখিয়ে দেবেন!’
—’শেখা কি অত সহজ? শরীরটা আগে দুরস্ত করতে হবে পিটে পিটে!’ সঙ্গে সঙ্গে বলা নেই, কওয়া নেই, পুঁটু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সটান পেছন দিকে হেলে হেলে চাকা হয়ে গেল। তারপর আবার অবলীলায় উঠে পড়ে হাত দুটো নামিয়ে হাতে ভর দিয়ে পা দুটো ওপর দিকে তুলে পীকক হয়ে গেল, তার ফ্রকের ঘের তলার দিকে ঝুলে পড়েছে, লাল সালুর ঝালর দেওয়া ইজের বেরিয়ে পড়েছে। সে দু—হাতে হন হন করে চলতে লাগল। ওদিকে পটলা পাক খেয়ে গোরুর গাড়ির চাকা হয়ে অন্তত বিশগজ চলে গেছে। তারপর আবার চক্রাকারে ফিরে সে বলল—’মাসকুলগুলো দেখুন!’ হাত ভাঁজ করে সে তার বাইসেপস ট্রাইসেপস দেখাতে লাগল, দু’জনেই বলল—এতে হবে না?’
‘হবে, হবে’—হেসে ফেলল চিন্ময়ী, ‘তবে সব কি আর শেখাতে পারব? কয়েকটা মোক্ষম প্যাঁচ শিখিয়ে দিতে পারি। কি হল? ধানু জংলু তোমরা বললে না তো কিছু?’
—’পটলার দিমার ট্যাঁক ভারী হবে, তো আমাদের ছোটলোকের বাচ্চাদের কী বলবার আচে?’ এই সময়ে দিমা এগিয়ে এসে বললেন—’আর ঢঙে কাজ নেই। অনেক ঢঙ দেখিয়েচ। বিকেলে মুড়ি ভেজে রাকবো, তেলেভাজাগুলো নিয়েসো দয়া করে। আপনি আসুন মা।’
ভেতরে ঢুকেই চিন্ময়ী একটা শক খেল। উল্লাসের শক, আবার আঘাত পাবার শক। চেনার ধাক্কা, চেনাকেও না চেনার ধাক্কা। সেই চতুষ্কোণ উঠোন। চারপাশে উঁচু দাওয়া। দাওয়ার ওপর সারি সারি লম্বা চওড়া দরজা। ওই তো রান্নাঘর। তার পাশেই খাবার ঘর, তারপর খানিকটা ফাঁক, চওড়া সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। তার পাশে জ্যাঠামশাইয়ের চেম্বার—ঘর, তারপর এজমালি বৈঠকখানা। দাওয়ার উত্তর দিকে একটা দরজা। দুপাশে দুটো কলঘর। তার পাশে বামুনঠাকুর আর টেকন চাকরের আস্তানা। শুদ্দুরের সঙ্গে থাকতে হচ্চে বলে নীলকণ্ঠর বড্ড আফশোস ছিল। মাঝখানের দরজা দিয়ে ওপারে গেলেই, আর একটা মহল। ঠিক এই রকম ক্যরামবোর্ডের মতো আর একটা উঠোন। সিংঘিবাবুদের। মেজদা বলত ‘সিঙ্গিমশাই, সিঙ্গিমশাই মাংস যদি চা—ও।’ অমনি জেঠিমা বেরিয়ে এসে বলতেন ‘কী হচ্ছে ভুতু, উনি তো আমাদের কোনও ক্ষতি করেননি! গুরুজনদের নামে ছড়া—কাটা আমি পছন্দ করি না।’ মেজদা হেসে বলত—’বা রে, অমনি গোঁপ আর এমনি ঘ্যাঁক করে আওয়াজ করলে যদি আমার ছড়া মনে আসে! ছড়া তো ভাল জিনিস। ছড়া থেকে পদ্য, পদ্য থেকে কবিতা আর কবিতা থেকে রবীন্দ্রনাথ!’ জেঠিমা হাতের খুন্তিটা নীরবে নেড়ে, চোখ পাকিয়ে একটা রাগত ভঙ্গি করে রান্নাঘরে ঢুকে যেতেন। কচুর শাক রান্না হচ্ছে, কষতে কষতে জান বেরিয়ে যাবে তবে সেই অমৃতময় স্বাদ বার হবে।
সিংঘিবাবুদের উঠোনটার চারপাশে চারটে নর্দমার গর্ত ছিল। ছোড়দি বলত—’দ্যাখ এটা হল দৈত্যদের ক্যারামবোর্ড।’ চিনু বা ছোটরা জিজ্ঞেস করত—’দৈত্যরা কখন খেলে ছোড়দি!’ ছোড়দি বলত—’অবশ্যই রাতে, সব্বাই, বিশ্বসংসারের স—ব ঘুমিয়ে পড়লে!’ চিনু বলত ‘ঘুঁটি কই? দৈত্যদের?’ ছোড়দি পাল্টা প্রশ্ন করত ‘বল দিকিনি, পারিস কি না!’ অনেক ভেবে, নিজের কল্পনাকে অনেক দূর টেনে—হিঁচড়েও দৈত্যদের ঘুঁটির খবর চিনু বার করতে পারত না। তখন ছোড়দি রহস্যময় হেসে বলত ‘আরে বোকা, আমরা, আমরা সবাই। সিংঘি জ্যাঠার ছেলেমেয়েরা কালো ঘুঁটি, আমরা সাদা ঘুঁটি। আর চিনু তুই রেড। তোকে নিয়ে সে কী লড়ালড়ি হয় তা যদি জানতিস!’ চিনু ভয়ে কাঁটা হয়ে যেত, দৈত্যদের ঘুঁটি হওয়াই যথেষ্ট ভয়াবহ। তার ওপর রেড, যার ওপর দু—দলেরই ঝোঁক। সারারাত তাকে নিয়ে লড়ালড়ি হয়? সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করত—’স্ট্রাইকার কই, ছোড়দি।’ ছোড়দি তখন এমন সোডার বোতল খোলার মতো হেসে উঠত, যে উত্তরটা বোঝাই যেত না। অবশেষে তার চোখের জলে নাকের জলে অবস্থা থেকে অনেক কষ্টে বার হত স্ট্রাইকার হলেন সিংঘিমশাই আর আমাদের জ্যাঠামশাই।
—’আমরা কেউ বুঝতে পারি না তো!’ চিনুর বোন মিনুর প্রশ্ন।
—’বুঝতেই যদি পারবি তো আর দৈত্যদের কাণ্ডকারখানা বলেছে কেন। ঘুমের মধ্যে আমরা সব গুটিয়ে গোল হয়ে চাকতি মতো ঘুঁটি হয়ে যাই। তবে চিনু একটু একটু বুঝতে পারে।’
—’কই পারি না তো?’
‘ঘুমের মধ্যে চেঁচাস না?’
সত্যি ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে—ওঠা, বিড়বিড় করে কথা বলা এইসব চিনুর অনেকদিন পর্যন্ত অভ্যেস ছিল। মা তার জন্যে একটা নোয়া পরিয়েছিলেন। জ্যাঠামশাই ওষুধ দিতেন। অব্যর্থ প্রমাণ। ঠিক ডমরুধরের কোমরে কুমীরের দাঁত পরিয়া থাকার মতো অব্যর্থ।
আপাতত সিংঘিবাবুদের সেই ক্যারামবোর্ড দেখা যাচ্ছে না। চক্কোত্তিদের অংশেরটা দেখা যাচ্ছে। ঝোপ, ঝাড় শ্যাওলা, পেছল, কতদিনের আবর্জনা, সব সব। যাচ্ছেতাই। এইখানে তারা ব্যাডমিন্টন খেলত। শাটলককটা একদিন মাছের ঝোলের মধ্যে পড়ে গেছিল সেই থেকে রোববার সকালে ব্যাডমিন্টন বন্ধ। বড়দা দুদিকে দুটো দুশ ওয়াটের বালব লাগিয়ে দিয়েছিল। বিকেল থেকে সন্ধে, অনেক সময় রাত্রে, রান্না হয়ে যাবার পর রান্নাঘরে শেকল তুলে খেলা হত।
তার মুখ কুঁচকে উঠেছে দেখে দিমা ভয়ে ভয়ে বললেন—’কী মা, পছন্দ হচ্ছে না?’
—’এত নোংরা! পরিষ্কার করা যায় না!
—’কেন যাবে না?’ পটলা এগিয়ে এল—’দুদিন সময় দিন, একেবারে মোজাম্বিক করে দোব।’
—’দিও। এখানে তো ব্যাডমিন্টন খেলা যায়। তা দিমা আপনি কোথায় থাকেন?’
—আমি মা পটলা আর পুঁটুকে নিয়ে ওই ও—ই ঘরটায় থাকি।’
জ্যাঠামশায়ের চেম্বারটি এখন তাহলে দিমার দখলে। রাশভারি জ্যাঠামশাই, দজ্জাল দিমা।
—’ওপরের ঘরগুলো কী হয়?’
—’তালা দেওয়া আছে মা। ব্যাভার করার হুকুম নেই।’
—’আমার তো দোতলার দক্ষিণ—পুবের ঘরটা ছাড়া হবে না।’
—’তালা তোড় দেগা’—জংলু বলল।
দিমা বলল—’তার দরকার হবে না। চাবির থলো আমার কাছে নুকোনো আছে, এই জংলু খবদ্দার কথাটা পাঁচ কান করিসনি। ওতে সব ফার্নিচার রয়েচে কি না! তা তুমি ছ’মাসের জন্যে থাক, তার মধ্যে কি আর সিংঘিবাবুর ছেলে দিল্লি থেকে আসবে? আসবে না কো!’
—তবে আমি ওপরেই থাকব। ফার্নিচার না হলে আমার চলবে কেন? বলতে বলতে চিন্ময়ী ওপরে উঠতে লাগল। সিঁড়িময় ধুলো, বেড়ালের কম্মো, ইঁদুরের নাদি। চিন্ময়ী চক্কোত্তির পেছন পেছন উঠতে থাকে ছেলেমেয়েদের দল এবং দিমা। চিন্ময়ী লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, আর ‘ইস কী করে রেখেছে?’ বলছে মাঝে মাঝেই। পটলাও লাফাতে লাফাতে চলেছে আর বলছে ‘স—ব মোজাম্বিক করে দেবো।’
পুব—দক্ষিণের ঘরটাতে বেশ হাওয়া আসে, ফ্যানও ঝুলছে একটা সিলিং থেকে। আলোও জ্বলে একটা। সিঙ্গল বেড খাট, ভাল বিছানা, মোটা—রঙচটা সতরঞ্চি দিয়ে ঢাকা, একদিকে একটা আলমারি। চাবি দেওয়া, দেয়ালে র্যাক কয়েকটা। একটা আয়না ধূলিধূসরিত, একটা টেবিল, দুটো গদিমোড়া চেয়ার। একটা কোল পেতে—বসা ভালুকের মতো কৌচ।
দিমা বললেন—’পাশেই কলঘর আছে মা।’
চিনু জানে। এটা আসলে জ্যাঠামশাইয়ের ঘর। তাদের ভাইবোনেদের অসম্ভব লোভ ছিল এই ঘরটার ওপর। জ্যাঠামশাই যখন নিচের চেম্বারে রুগী দেখতে ব্যস্ত সেই সময়ে চিনুরা ক’ ভাইবোন হুড়মুড় করে ঘরটাতে ঢুকে, কেউ খানিকটা জানলা ধরে বাঁদরের মতো ঝুলে নিত। কেউ বাথরুমে গিয়ে খামোকা বেসিনে মুখ ধুয়ে নিত। কেউ আবার কাচের আলমারিতে বইয়ের সারির দিকে অভিনিবেশ সহকারে দেখত কিছুক্ষণ। কেউ চট করে টেবিলের ওপর—রাখা মেমসাহেব—নাচা ঘড়িটাতে অ্যালর্মের দম দিয়ে দিত, অমনি মেমসাহেবটা নাচতে আরম্ভ করত টুং টাং বাজনার সঙ্গে সঙ্গে। এসব জিনিস জ্যাঠামশায়ের রুগীদের উপহার। তা ঠিক সেই সময়ে টেকন চাকর কাঁধে লাল গামছা নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে এসে ঘরে ঢুকত—’কী করছি? অ মা, এ মিনিদিদি, অ চিনিদিদি, নুটুদাদা, যাও, যাও বলুচি।’
—’হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমাকে বেলুচিস্তানে পাঠিয়ে দিয়ে যাব’ বলতে বলতে তিন ভাই বোন দৌড় দৌড়।
ঘরটার মাঝখানে ধুলোর মধ্যে চটিশুদ্ধ পায়ের ছাপ ফেলে চিনু দাঁড়িয়ে রইল। সেই ঘর, যার জন্যে ছোটবেলা থেকে আকণ্ঠ লোভ। সেইখানে অবশেষে চিনু থাকতে পাবে। ঘরটা আর ঠিক সেই ঘর নেই। নেই সেই মেমসাহেব পুতুলঅলা ঘড়ি। সেই হাফ—সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর ঝকঝকে কাচের নিচে নানা দেশের সুন্দর সুন্দর ছবি। কাচের আলমারিতে পরপর সাজানো বাঁধানো বই। দেয়ালে বাবা—জ্যাঠামশায়ের—বাবা—মা’র যুগল তৈলচিত্র। ছোট্ট ঠাকুমা নাকে নোলক, বেনারসী সামলাতে পারছেন না, এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। গুঁফো ঠাকুর্দা টোপর হাতে চেয়ারে বসে। গোঁফের ফাঁকে সামান্য হাসি। নিশ্চয়ই নতুন—বউ—প্রাপ্তির। কিছু নেই। সবই বদলে গেছে। তবু সবই আছে। স—ব এনে ফেলতে চিনুর অসুবিধে হবে না। অসুবিধে হলে সে এত করে এত দূর দৌড়ে আসবে কেন? সে টেবিলের ওপর নিজের হালকা সুটকেসটা নামিয়ে রাখল, তারপর বলল—’দিমা, এই আমার জিনিস রইল, কলকাতায় যাচ্ছি। ফিরতে হয়ত বিকেল হবে, তার মধ্যে এইসব গুছনো ফিটফাট চাই। এই নিন আপাতত একশো টাকা। আজকে মুরগী হবে, রাত্তিরে। এরা সবাই খাবে। আর আমাকে তুমি বললেই হবে। এই ছেলেমেয়েরা তোমরা আমাকে চিনুদি বলবে। তরতর করে সে নেমে গেল। দু—তিন কদমে রাস্তায়। তারপর চলতি একটা রিকশায় চড়ে ইস্টিশান।
কোথায় গেলাম? বলব না। আচ্ছা আচ্ছা বলব। সারা দুপুর একটা চমৎকার লাইব্রেরিতে কাটিয়ে, শেষ দুপুরে একটা কোর্স নিচ্ছি, তার ক্লাস করলুম। মাঝখানে একটা মাদ্রাজি রেস্তোরাঁয় একটা মহাকায় মশলা ধোসা আর কফি খেয়ে দুপুরের ভোজন সারলুম, বিকেলের দিকে এক গ্লাস ফলের রস খেয়ে কাজুবাদাম কিনে ট্রেনে উঠলুম। রিকশাতে উঠে সিংঘিবাবুর বাড়ি আসতে আসতেই দূর থেকে দেখলুম দোতলার পুব—দক্ষিণের ঘরে খুব ঝকঝকে আলো জ্বলছে। খুশি—খুশি মনে কড়া নাড়তেই পুরো বাহিনীসহ দিমা দরজা খুলে দিলেন। ঢুকতেই উঠোনটা দেখলুম আধা সাফ হয়েছে, কিন্তু দাওয়া, সিঁড়ি, ওপরের চকমিলোনো বারান্দা, এবং সর্বোপরি আমার থাকবার ঘরটি ঝকঝক করছে।
পুঁটু বলল—’এত দেরি কেন?’
পটলা বলল—আমাদের মুড়ি—তেলেভাজা খাওয়া হয়ে গেল। তেলেভাজা ঠান্ডা হয়ে গেল।’
চিনু বলল—’আমার শুধু চা হলেই চলবে। গা ধুয়ে নিই।’
রাত্তিরবেলা খাবার সময়ে হল মুশকিল। দিমা বললেন—’আমি বামুনের মেয়ে মা, মুরগী ছুঁই না, তাই পাঁঠার মাংস করেছি।’
চিনু বলল—’বেশ তো।’ কিন্তু প্রথম গ্রাস মুখে দিয়েই সে হড়হড় করে বমি করে ফেলল। বমি সামলাতে চলে গেল উঠোনে। মুখে—চোখে জল দিল, তবু বমি ভাব যায় না।’
দিমা বললেন—’কি রে ধানু বোকা পাঁঠা আনলি না কি?’
ধানু বলল—’ইসস, দিলেই হল। ধানুকে ফজল বোকা পাঁঠা দেবে! ঘাড়ে ক’টা মাথা! তাছাড়া খেতে তো ফাস্টো কেলাস হয়েচে।
দিমা অপ্রস্তুত গলায় বললেন—’ওমা, মেয়ে বোধহয় পাঁঠা খেতে পারে না গো, তাই মুরগীর কতা বলেছিল।’
ততক্ষণে চিনু নিজেকে সামলে নিয়েছে। আসলে বারো বছর সে মাংস খায়নি। এরকমটা যে হতে পারে তা তার মনে আসেনি। ছেলেমেয়েদের তো প্রায়ই রান্না করে দিয়েছে, এরকম গা—বমি তো করেনি! সে বললে—’রান্না খুব ভাল হয়েছে দিমা। আমার শরীরটা কেমন খারাপ খারাপ লাগছে।’
—’তা হলে কি খাবে মা?’
—’কিছু না খাওয়াই তো ভাল, বমি যখন হয়ে গেল। আপনার কি রান্না করেছেন?’
—’আমি বেগুন পুড়িয়ে নিয়েছি মা। আর এখো গুড় আচে। খাবে?’
—’না, না। গা—বমি করছে তো।’
—’রাত—উপুসী থাকবে মা!’
চিনু মনে মনে ভাবল একটা হরলিকস—টিকস কিনে রাখা দরকার।
যেদিন সত্যি—সত্যি উঠোনখানা মোজাম্বিক হয়ে গেল, এবং ওপর থেকে চিনুদিদি ব্যাডমিন্টনের নেট, শাটল কক আর র্যাকেট নিয়ে নেমে এল, সেদিন পটলা ধানু জংলু পুঁটুর মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। একবার এ চাকা হয়ে যাচ্ছে, একবার ও। জংলু বলল—’জাল খাটাবার খুঁটি কোথায় পোঁতা হবে দিদি?’
চিনু বলল—’দেখ ভাল করে। মাঝখান বরাবর দু’পাশে গর্ত পেয়ে যাবি।’
—’সত্যি তো! কী করে তুমি জানলে দিদি?’
—’আমি কিছু কিছু ম্যাজিক জানি।’
—’ম্যাজিক? আমায় শেকাবে?’—কোমরে হাত দিয়ে পুঁটু এগিয়ে এল।
—’কত কি তুই শিখবি? কারাটে কুংফু। ম্যাজিক। আপাতত ব্যাডমিন্টনটাই শেখ।’
তারপর কিছুদিনের মধ্যেই দুর্দান্ত খেলা আরম্ভ হয়ে গেল।
মিক্সড ডাবলস। এদিকে চিনু আর ছোড়দা। ওদিকে মিনু আর মেজদা।
ছোড়দা বলল—’তোর ব্যাকহ্যান্ডটা ভাল। ফোরহ্যান্ড হোপলেস। নইলে মিনুর ওই সোজা শটটা তুলতে পারলি না? একটু ছুটে সামনে এগিয়ে গেলেই…’
মেজদা অর্থাৎ ভুতু স্ম্যাশের পর স্ম্যাশ করে যাচ্ছে। মিনু টুকটুক করে ড্রপ শট। মেজদা আর মিনুর জুটি জিতে গেল। চারপাশে দাওয়ার ওপর ভিড় করে দাঁড়িয়েছে বড়দা, ছোড়দি, সিঙ্গিমশাইয়ের বাড়ির ছেলেমেয়েরা। সবাই মিলে হল্লা করছে। এদের গেমটা হয়ে গেলেই আরও চারজন নামবে। কোনও দলকেই বেশি চান্স দেওয়া হবে না। নইলে অতজন খেলা শেষ করবে কী করে? দিমার রান্নাঘরের শেকল তোলা। পিঁড়ির ওপর পা ছড়িয়ে বসে দিমা খেলা দেখছে, আর মাঝে মাঝে হাই তুলতে তুলতে টুসকি দিচ্ছে। চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে জ্যাঠামশাই দু’দণ্ড জিরিয়ে খেলা দেখে গেলেন। মন্তব্য করলেন—’তোমাদের ঠিক ব্যালান্সড টিম হয়নি ভুতু। চিনুটার তাকত নেই, দম নেই। ব্যাডমিন্টন দমের খেলা। মেয়েটা খেতে পারে না। রাতে বিড়বিড় করে।’
—’কিরমি আছে, কিরমি আছে। তাই মেয়েটা বাড়তে পারছে না।’ মা মাথায় ঘোমটাটা তুলতে তুলতে বলল—’ওষুধ দিন না বটঠাকুর।’
—’ওষুধ তো দিচ্ছি। মেয়েটাকে একটু তেতো খাওয়াতে পারছো না?’
—’কী করব? ওয়াক তুলে ফেলে যে! আর জানেন তো, শুধু হাতে গুড়ের নাগরি থেকে মুঠো মুঠো গুড় তুলে চেটে চেটে খায়।’
—’খাবেই! কৃমি ওকে ঘাড় ধরে খাওয়াবে বউমা। ওর দোষ কি?’
—গো—হারান হেরে চিনুদি দাওয়ায় উঠতে উঠতে বলল—’হ্যাঁ, আমি সারাদিন কোথায় না কোথায় ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকতা করে বেড়াই, আর তোরা খেলে খেলে সে সময়ে হাত দুরন্ত করে ফেলিস।’ ‘হেরো! হেরো! হেরো!’ জংলু আর পুঁটু দুয়ো দিতে থাকে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চিনু বলে—’এটা কিন্তু নিয়ম নয়। নিয়ম হল খেলার শেষে হেরো পার্টি আর জেতা পার্টি হ্যান্ডশেক করবে, এই এমনি করে’—এগিয়ে গিয়ে সে দেখিয়ে দিল। তারপর বলল—’খেলা মানে আনন্দ, খেলা মানে ব্যায়াম, খেলায় হার—জিত আছেই। হেরে গেলেই হারা নয়, আবার জিতে গেলেই জেতা নয়।’
সারা সন্ধে একেক দিন গপ্প হয়। গঙ্গায় বাইচ খেলার গপ্প বলে ওরা, চিনু বলে ক্যাসিয়াস ক্লের মহম্মদ আলি হওয়ার গল্প, মারাদোনার ভাঙা পা নিয়ে মরণপণ খেলার গল্প, ফ্যারাডের বিজলি—বাতি আবিষ্কারের গল্প। বিদ্যাসাগরের দুধ খাওয়া ছাড়ার গল্প, খবরের কাগজের হকার এডিসনের ল্যাবোরেটরি তৈরি করার গল্প। শুনতে শুনতে খাওয়ার কথা মনে থাকে না। শুধু ওরা নয়। আরও জুটেছে ন্যাংলা, পচা, খেঁদি, কেষ্টা, ঝুমু, বালিশ। ভীষণ গাবদা গোবদা বলে ওর নাম বালিশ। দিমা এসে বলে—’আজ কিন্তুক শুদ্ধু ছোলার ডাল, রুটি আর দুধ। এতগুলি রাবণের গুষ্টিকে খাওয়াতে হলে মা আমার দ্বারা এর চে বেশি হবে নে।’
চিনু বলে—’ডালে কুচি কুচি করে নারকেল দিয়েছো তো? ও দিমা!’
জ্যাঠাইমা বলে—’ওঃ মেয়ের যেমন তেমন হলে চলবে না, সব যার যেটি তার সেটি চাই। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যখন কুমড়োর ঘ্যাঁট খেতে হবে, তখন?’
চিনু বলে—ঘ্যাঁট কেন? কুমড়ো দিয়ে, আলু দিয়ে পটল দিয়ে, ছোলা দিয়ে কুমড়োর ছক্কা আর লুচি। নীলকণ্ঠ ঠাকুর করবে, তোমরা হাত দেবে না।’
বটুয়া থেকে পান বার করে মুখে পুরতে পুরতে নীলকণ্ঠ মহাগর্বের হাসি হাসছে।
দিমা বলল—’ভাল হয়েচে তালে? আমি বলি কি জানি শহরের ফ্যাশনেল মেয়ে…’
—’বাঃ, আমি তো তোমার রান্নার কথা শুনেই আরও—দিমা কচুর শাক খাওয়াবে?’
—’কচুর শাক? তার জন্যে এত আহিংকে? ওমা, আমি কোতায় যাব গো! এই জংলু, তুলে আনিস তো কাল। নারকেলের তো অভাব নেই মা! তা নিরিমিষ্যি খাবে, না ইলিশমাছের মুড়ো দিয়ে?’
—’নিরিমিষ্যি, নিরমিষ্যি!’ চিনু চেঁচিয়ে বলে ওঠে।
ধানু গম্ভীরভাবে বলে—ইলিশ মাছ আলাদা হবে, একেবারে ঘাট থেকে নিয়ে আসব।’
পুঁটু বলে—’মুড়োটা আর ন্যাজাটা দিয়ে অম্বল কোরো দিমা। ন্যাজার লালগুলো সব আমার! মা করত!’
—’ইসস, আগে অম্বল চাই? মেয়ের রকম দেখ! টক আর মিষ্টি পেলে আর কিছু চাই না!’
মিনু আড়চোখে চাইল—’দিদি, আর ঝাল?’
দুজনে মিলে ছুটির দুপুরবেলা তেঁতুল, লঙ্কা আর গুড় দিয়ে আচ্ছা করে জরিয়ে আঙুল চেটে চেটে খাওয়া আর হুস হাস। নাকের জলে, চোখের জলে। উঃ কি ঝাল দিয়েছিস রে দিদি! ঝাল না হলে জমে। মেজদা নামতে নামতে বলছে—’হ্যাঁ, নামবে যখন তখন টের পাবি কিরকম জমে! পুরো ইনটেসটিন জ্বলিয়ে দিয়ে নামবে। তখন বলিস হে তেঁতুলের দেবতা, হে লঙ্কার দেবতা, আর করব না, আর করব না।’
মস্ত বড় কলেজের ঘাসে—ছাওয়া মাঠে নীল জিনস আর আলগা শার্টপরা একটি মেয়ে বসে। মাথায় ঝুঁটি। ওর কি কোনও বন্ধু নেই? ফাইল খুলে একমনে পড়ছে? না পড়ার ভান করছে? পাশ দিয়ে একদল ছেলেমেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
—’ওঃ পি. কে. সি. আজ যা পড়ালেন না, দুর্দান্ত!’
—’আরে কীটসের ওপরেই তো ওঁর থিসিস। অক্সফোর্ডের। চালাকি নয়।’
—’হ্যাঁরে, নীতা, ফ্যানি ব্রন আর কীটস—কে নিয়ে লেটেস্ট বইটার কী যেন নাম বলছিলেন পি. কে. সি.?
—’আমি খেয়াল করিনি!’
—’কী খেয়াল করিস তোরা? পি. কে. সি.—র ডোরাকাটা শার্ট, আর গ্যাবার্ডিনের পেন্টুল?’
—’ভালো হবে না ঋত্বিক। টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি শেষ হতে চলল এখন কীটস নিয়ে আর কে মাথা ঘামায় রে! যত্ত সব!’
—’তো কী নিয়ে মাথা ঘামাবি! অ্যালেন গিনসবার্গ! লোকটা শেমলেসলি গে জানিস তো? ওই জন্যে অস্কার ওয়াইল্ড বেচারির জেল হয়ে গেল আর এখন সব যে যত পার্ভাটেড, আর তত নামডাক!’
—’মেয়েদের মধ্যেও আছে, পুরনোকালে স্যাফো, ইদানীং এর মধ্যে মার্টিনা। কী রকম ডাঁটে থাকে!’
দলটা পাশ দিয়ে চলে গেল। একবারটি আড়চোখে তাকিয়ে দেখল জীনস—পরা মেয়েটি। দলের মধ্যে কোনটা কোনটা মেয়ের কথা, কোনটা ছেলের কথা বোঝবার জো নেই!
জ্যাঠামশাই বলছে—’না। কিছুতেই না। কো—এডুকেশনে দিলে মেয়ে বখে যাবে। নমুও তো মেয়ে—কলেজেই পড়েছে, ওর শিক্ষা—দীক্ষা কিছু কম হয়েছে? বাবা বলছেন—মেয়েটা অত ভাল রেজাল্ট করল দাদা, অত শখ…আর দেখুন বাবা গলা খাটো করে বললেন—এখানেও তো এত ছেলের সঙ্গে মিশেছে, সিঙ্গিবাবুর সুকৃতির সঙ্গে তো হলায় গলায়। গণ্ডগোল হলে তো এখানেও হতে পারে!’
—’তা অবশ্য।’ জ্যাঠামশাইয়ের চিন্তিত গলা। বাইরে আড়িপাতা দলের ফিসফিসে হাসি।
য়ুনিভার্সিটির ক্লাস নতুন আরম্ভ হয়েছে। ব্লু জীনস, আলগা শার্ট, মাথায় ঝুঁটি ঢুকে পড়েছে। নোটস নিচ্ছে। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে। ‘তুমি কোন কলেজ থেকে এসেছে ভাই!’ পাশের মেয়ে জিজ্ঞেস করছে।—’শ্রীরামপুর কলেজ।’
—’সে কী? আমিও তো শ্রীরামপুর কলেজ থেকেই এসেছি। তোমায় চিনি না তো!’
সেরেছে। আরে আমি তোমাদের থেকে অনেক সিনিয়র। মাঝখানে নানা কারণে পড়া বন্ধ হয়ে গেল। ‘তাই বলো!’
—’য়ু দেয়ার হুইচ দা শর্টেস্ট ট্র্যাজেডি অফ শেক্সপীয়র?’
ব্লু জীনস উঠে দাঁড়াচ্ছে।—’ইজ ইট ম্যাকবেথ সার?’
বহু আষাঢ়ের ওপার থেকে উত্তরটা ভেসে আসছে। মেঘের আড়ালে আবছা হয়ে। সো য়ু হ্যাভ ডাউটস! সীট ডাউন অ্যান্ড ডোন্ট টক।’
পাশের মেয়েটি বললে—’সরি। ভাই, আমার জন্যে তুমি বকুনি খেলে।’
আজকের কত লাইব্রেরির কাজ সারা। ধোঁয়া কাটাতে কাটাতে গোলাপি বুটির সালোয়ার কামিজ, খোলা চুল, ঢুকে যাচ্ছে। একটাও পুরো খালি টেবিল নেই। একটাতে একটি মাত্র ছেলে বসে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। সামনে আধ—খাওয়া কফির কাপ।
গোলাপি কামিজ বলল ‘এক্সকিউজ মি প্লিজ, আপনি কি কারও জন্যে অপেক্ষা করছেন?’
‘ওহ নো, নট অ্যাট অল। আই ক্যান ওনলি ওয়েট ফর গোদো, হু আই নো উইল নেভার অ্যারাউভ!’
‘বসবার জায়গা পাচ্ছি না। বসতে পারি?’ ভড়কানো প্রশ্ন।
‘নো অবজেকশন।’
কফির অর্ডার। পকোড়া। ছোট ছোট কামড়। অল্প স্বল্প চুমুক। কোলের ওপর একা পত্রিকা নিয়ে অভিনিবেশ সহকারে পড়া। পত্রিকা ছাড়া গতি নেই।
‘ডোন্ট মাইন্ড, আপনি কি রিসার্চ স্কলার?’ ছেলেটির প্রশ্ন।
‘খানিকটা।’
‘খানিকটা মানে!’
রহস্যময় অথবা বোকা—চালাকির হাসি—’আপনি?’
‘আমি কেউ না। কিছু না জাস্ট একটা ভয়েড।’
‘সে কী? আপনি ভূত নাকি?’
‘ভূতই বটে!’ ছেলেটির মুখে আত্মবিদ্রূপের হাসি—’গোস্ট অফ দিস কনজিউমারিস্ট সোসাইটি, গোস্ট অফ দিস ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ডেড বাই দা ড্যাজলিং র্যাভেজেস অফ সায়েন্স। গোস্ট অফ দিস মকারি অফ এ সিভিলাইজেশন!’
‘রাগী যুবকরা তাহলে এখনও আছে’, গোলাপি সালোয়ার আত্মগত বলল।
‘কিছু বললেন?’ ছেলেটি বলল, তারপর চোখ ঘুরিয়ে বলল—’এই তো দেখছেন টেবিলে টেবিলে গণ্ডা গণ্ডা যুবক—যুবতী বসে আছে। আড্ডা দিচ্ছে। জাস্ট আড্ডা সপ্লেনডিড আনকনর্সান!’
‘ডু দে থিংক হোয়ার দিস মকারি অফ ডেমোক্র্যাসি ইজ হেডিং ফর? ডাজ ওয়ান থিংক?’
‘আপনি কি বিপ্লবী?’
‘বিপ্লবী? হাসলেন! অল দা রেভোলিউশনস অফ দিস ওয়ার্ল্ড হ্যাভ এডেড দা ওয়ার্স্ট টাইপ অফ অটোক্র্যাটস। ফ্রম রোবস পীয়ের টু স্ট্যালিন অ্যান্ড চাওসেসকু। দা ভেরি কনসেপ্ট অফ রেভল্যুশন হ্যাজ বীন গিলোটিন্ড।’
‘আপনি তাহলে কে? কী?’ গোলাপি সালোয়ার ভয়ে ভয়ে বলল।
‘কেন কবে, কোথায় গুলো জিজ্ঞেস করলেন না?’
‘ভয় করল। একটা দুটোর উত্তর দিলেই বর্তে যাব।’
তখন ছেলেটি সিগারেট ফেলে দিয়ে দম ছেড়ে হো হো হা হা করে হাসল।
তারপর বলল আমার নাম শ্রীমান সুশান্ত তালুকদার, এই হল কে। আমি একজন ফ্রি—লান্স জার্নালিস্ট—এই হল কী এম—এসসি ইন ইকনমিক্স, লো সেকেন্ড ক্লাস, ‘গরিবি হঠাও’—এর ওপর একটা বিস্ফোরক প্রবন্ধ লিখেছিলুম বলে খুব সম্ভব। পছন্দসই চাকরি পাইনি—এই হল কেন।
উনিশশ ঊনষাট, বারোই জুলাই এই হল কবে। আর কোথায় হল—হট্টমন্দির।
‘ফ্রিলান্স জার্নালিস্ট, ফ্রিলান্সটা কী?’
‘আপনি কোন যুগে বাস করেন? নাকি মঙ্গলগ্রহ থেকে আসছেন? এখন তো ফ্রিলান্সেরই যুগ! সব কিছু নিজস্ব উদ্যোগ। গম্মেন্ট আমাদের স্বাবলম্বী হতে বলছে না?’
‘আপনি নিজে নিজেই খবর যোগাড় করে বেড়ান? লেখেন? ছাপায়?’
‘হ্যাঁ, আমি নিজে নিজেই খবর বা স্টোরি যোগাড় করে বেড়াই। লিখি, ফটো তুলি। কখনও ছাপে, কখনও ছাপে না।’
‘তাতে আপনার চলে? কিছু মনে করবেন না!’
‘ওই জন্যেই তো বললুম হট্টমন্দিরে থাকি। একটা অবসলিট মেসে। ম্যানেজারবাবুর আমার ওপর বড্ড মায়া। একটি বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। বড্ড দজ্জাল! কাউকে গছাতে পারছেন না। চিতাবাঘ যেমন ঝোপের পেছনে গুঁড়ি মেরে থাকে, শিকার কখন পাল্লার মধ্যে এসে যাবে তার অপেক্ষায়, তিনিও তেমনি বসে আছেন।’
চিনুর ভীষণ হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। সে কফির কাপ মুখে তুলে বিষম খেল।
‘আপনার পরিচয় কিন্তু আমি এখনও পেলুম না’—যুবক বলল।
‘আমি সত্যিই মঙ্গলগ্রহের লোক আপনাদের গ্রহে বেড়াতে এসেছি। নাম চিন্ময়ী চক্রবর্তী। আমিও ফ্রি—লান্স জার্নালিস্ট।
সুশান্ত তালুকদারের মুখ গোল—হাঁ হয়ে গেল—তাহলে ফ্রি—লান্স জার্নালিস্ট মানে জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন?’
‘আসলে হতে চাই। এখনও হইনি। আপনি যদি একটু অন্ধি—সন্ধিগুলো বাৎলে দ্যান।’
‘নিজে পায় না শুতে আবার শংকরাকে ডাকে। সুশান্ত ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আমার নাম সুশান্ত হলেও আমি কিন্তু আসলে খুব অশান্ত। টের পেয়েছেন আশা করি।’
‘মোক্ষম! তবে পথগুলো আপনি বেশি রাগ না করে বাৎলে দেবেন তা—ও বুঝতে পেরেছি।’
আবার সিগারেট নামিয়ে হো হো হা হা।
এমন সময়ে ডান চোখের পাশ দিয়ে গোলাপি সালোয়ার একটি ভীষণ চেনা মেয়ে মুখ দেখে প্রায় টেবিল উল্টে উঠে পড়ল। বলল—’আমি চললুম। টাকা রাখলুম, বিলটা প্লিজ মিটিয়ে দেবেন। চেনা মুখ আপাতত ডান দিকের শাখায় চলে গেছে। চিনু হুড়মুড় করে নিচে নেমে আবার হ্যারিসন রোডের দিকে হুড়মুড় করে ছুটল। রিণি কি দেখতে পেয়েছে? হঠাৎ দেখতে পেলে পরিষ্কার চিনতে পারবে না। কিন্তু সন্দেহ হবে। বাস স্টপে ভীষণ ভিড়। উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে, পেছন থেকে আচমকা প্রশ্ন হল—’বৎসে, তুমি কি বাড়ি হইতে পলায়ন করিয়াছ?’ চমকে পেছন ফিরে চিনু দেখল সুশান্ত। সুশান্ত বলল, ‘না কি কোনও ভদ্র যুবককে সদ্য—সদ্য ল্যাং মারিয়াছ?’
এক সপ্তাহ পরে সুশান্ত তালুকদার ও চিন্ময়ী চক্রবর্তী দুজনে মিলে একজন নাম করা অর্থনীতিবিদ—এর সাক্ষাৎকার নিতে গেল। অর্থনীতি সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো সুশান্তর, জীবন জগৎ সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো চিন্ময়ীর। সাক্ষাৎকারটি একটি বিখ্যাত বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয় সংখ্যায় বেরোল। দক্ষিণাটা অর্ধেক করে চিন্ময়ীকে দিতে গেলে চিন্ময়ী বলল, ‘আমার ভাগটা এবারের মতো তোমায় দিয়ে দিলুম, সুশান্ত, গুরুদক্ষিণা।’
‘ঘুষ নয় তো?’ সুশান্ত অশান্ত চোখে চেয়ে বলল।
‘ঘুষ কী?’ ওঃ চিনুদি, য়ু আর সামথিং আই মাস্ট অ্যাডমিট’ সুশান্ত বলল।
এইভাবেই চলছিল কিন্তু, একদিন সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরতে, দিমা নিঃশব্দে দরজা খুলে দিয়ে বললে
‘ওমা আমি কোতায় যাব গো মেয়ে! দিল্লি থেকে সুককিতিবাবু এয়েচে গো! আমার ওপর কী চোটপাট! আমাকে বোধহয় ছাইড়ে দেবে গো মা! শোনো টাকাকড়ির কতা আমি কিছু বলিনি, শুধু বলেছি ভদ্দরলোকের মেয়ে বড় আতান্তরে পড়েছিল…।’ দিমার সহজে চোখে জল আসে না, কিন্তু এখন কাঁদো—কাঁদো অবস্থা। চিনু বলল—’পথ ছাড়ো দিমা। আমি দেখছি।’
‘ওমা কী সব্বনেশে মেয়ে গো, সে যে একেবারে রেগে বাঘ হয়ে আছে।’
‘সিঙ্গি হয়ে আছে বল?’ পটলা আর পুঁটু ফিকফিক করে হেসে ফেলল।
তোদের আর কি নংকাপোড়া। হেসে দিলেই হল। দিমা আছে, দিমা ঠিক খাওয়াবে। পরাবে। ভিক্ষে করে হোক, সিক্ষে করে হোক।’
চিনু বললে—’দিমা, আমার জন্যেই তো তোমাদের এই অবস্থা। আমি খবরের কাগজের লোক। কাউকে ভয় পাই না। আমি বোঝাপড়া করে নিচ্ছি। কোনও ভয় নেই।’
আজকে তার পরনে হালকা বেগনি প্রিন্টের একটা শাড়ি। হাতে মস্ত বড় ব্যাগ। প্র্যাকটিস করবার জন্যে একটা ক্যামেরা তাতে, ভরে দিয়েছে সুশান্ত। দিমার যা গতর তাকে সহজে ঠেলা যায় না, তবু একরকম ঠেলে ঠুলেই ওপরে উঠল চিনু। চটির বেশ শব্দ করে জানান দিয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ভালুক কৌচের কোলে বসে জনৈক ভদ্রলোক খুব মনোযোগ সহকারে চিনুর রেখে যাওয়া একটা ম্যাগাজিন পড়ছেন। চটির শব্দ তুলে তাকিয়েই তিনি চিত্রার্পিত হয়ে গেলেন।
এ কি? ‘চিনু না! তুই কোত্থেকে?’
‘আমি না হলে তোমার মতো সিঙ্গি মশাইয়ের ঘরে হুজ্জোতি করে ঢোকবার সাহস কার হবে বল? তার ওপর দিমার মতো ওই রকম জাঁদরেল পাহারা। …তা মাথাটা কী করেছো!’
বেলের মতো মাথাটাকে হাত বুলিয়ে সুকৃতি সিংহ বললেন, ‘কি জানিস! টাক হলে টাকা হয় ছোট্ট থেকে শুনে আসছি। তাই চেষ্টা চরিত্তির করে টাকটা করেই ফেললুম।’
‘তাহলে আগে যা ছিল তার চেয়েও এখন আরও অনেক টাকা হয়েছে?’
‘হয়েছে। বোনগুলো সব বাইরে পড়ল। দুটো দাদা বিদেশে পটাপট শেষ হয়ে গেল। বাবা কাকা সব্বারই সব তো এখন আমার!’
‘তবে!’
‘তবে কী?’
‘তবে, সিংঘিবাড়ির এমনি দশা কেন যে আমি কোনকালের ভাড়াটের মেয়ে আমাকে দুযুগ পরে এসে মোজাম্বিক করাতে হয়।
‘মোজাম্বিক? কী বকছিস?’
‘নিচের উঠোন, ঘরদোর, দালান—বারান্দা, সিঁড়ি কলঘর সব দেখা হয়েছে? মোজাম্বিক হয়নি? পটলা আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল দুদিন সময় দিলেই সব মোজাম্বিক করে দেবে। তা দিয়েছে। রোজ পালিশ করছে। এই রকম লাল—সবুজ পেটেন্ট স্টোনের মেঝে ইদানীংয়ের মধ্যে দেখেছ? পটলা পুঁটু, জংলু, ধানু দিমা এরা করেছে…।
ও হো হো হো সুকৃতি বুঝতে পারার হাসি হাসতে লাগলেন ‘তা পটলা, পুঁটু, এরা কারা?
‘এরা কারা? জ্যাক অ্যান্ড জিল ওয়েন্ট আপ দা হিল, জানো তো?’
‘তা তো জানি কিন্তু…’
এরা সেই জ্যাক অ্যান্ড জিল। জ্যাকেরা পড়ছে। ডাউন দা হিল। মাথাগুলো বিগড়ে যাচ্ছে, আর জিলরাও পেছন পেছন হুড়মুড় করে পড়ছে তো পড়ছেই।
‘তুই তা হলে এখনও ধাঁধা ভালবাসিস? ঠিক সেই আগেকার মতো?’
সামনের আয়নায় এতক্ষণে দুজনের ছায়া পড়েছে। হঠাৎ সুকৃতি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আরে চিনু, তোকে আমি উনিশ বছর বয়সের পর থেকে দেখিইনি! তোকে আমি কি করে এত দিন পরে চিনতে পারলুম বল তো? তুই তো খুব বেশি বদলাসনি। খালি কেমন ডাগর—ডোগর গেছো টাইপের হয়ে উঠেছিস। কিন্তু আমি তো দেখছি বুড়ো হয়ে গেছি। মাথায় বেল, উদরে ডাব, মুখ ময় থলে? তুই আমার চেয়ে ক’ বছরের ছোট ছিলি? কাকাবাবু এখান থেকে আসানসোল বদলি হয়ে গেলেন, তার পরেই শুনলুম কাকিমা নাকি? তোর আর মিনুর নাকি এক লগ্নে, তোর নাকি তিনটে…ভুতুর কাছ থেকে শুনছিলুম…।
—’সব নাকিগুলোই ঠিক শুনেছো। আবার যা নিজের চোখে দেখছ তা—ও ঠিক। আমি ভূত নই।’
—’তবে কি তুই ভবিষ্যৎ?’
চিনুর চোখে এবার স্বপ্ন চিকচিক করছে। সে বলল—’বলছো? সত্যি বলছো? থ্যাংক ইউ। কিন্তু তোমার ইতিবৃত্ত আমি কিছুই জানি না সুকুদা।’
—’সে তো অনেক কথা! ভুতু তোকে কিছু বলেনি?’
—’ভুতু কোত্থেকে বলবে? সে তো জার্মানিতে ইন্ডিয়ার ভূত!’
সুকৃতি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—’আমিও তো ওয়েস্ট জার্মানিতেই ছিলুম। সেখান থেকে সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং—এর ইয়াবড় ডিগ্রি নিয়ে সুইডেন গেলুম। আমার চে’ একহাত লম্বা সুইডিশ মেমসাহেব বিয়ে করলুম। তারপর একদিন ঝগড়ার মুখে সে আমার সেই কোঁকড়ানো কালো চুলগুলো ধরে আচ্ছা করে ঝাঁকিয়ে বললে—’হোয়াই কান্ট য়ু বি ব্লন্ড! ব্লন্ড! ব্লন্ড!’ বলে আমায় ছেড়ে চলে গেল। ব্লন্ডের খোঁজে। এখানে কিছুদিন হল ফিরে এসে দিল্লিতে নিজের ফার্ম খুলে বসেছি। তখন চুলগুলো সবে উঠতে শুরু করেছে। আবার একটা বিয়ে করেছিলুম পাঞ্জাবি। তো সেটাও টিকল না। সেও একদিন ঝগড়ার মুখে বললে—হোয়াই আর য়ু সো শর্ট! শর্ট! শর্ট! সে—ও টলের খোঁজে চলে গেল। তার পরেই টাক। আর ছপ্পড় ফুঁড়ে টাকা!’
—’কী গুলতাপ্পিই দিতে পারো, বাববা! তা এখানে কি করতে হানা দিয়েছো!’
—’ভাবছি এই হানাবাড়িটা বিককিরি…’
—’খবরদার!’ চিনু বসে ছিল। সটান উঠে দাঁড়াল,—’খবর্দার, এই বাড়ি বিক্রি করতে পারবে না। এ বাড়ি আমি অধিগ্রহণ করব, এ আমার মিউজিয়াম, এইখানে আমার ছোটবেলা, এইখানে আমার কৈশোর, এইখানে আমরা দুটো বিশাল উজ্জ্বল সুখী পরিবার, এইখানে আমরা প্রতাপ—শৈবলিনী, এখানে এসে আমি সব ফিরে পেয়েছি। এই বাড়ি আমি যা বলবো, তাই করতে হবে। পটলা ধানুদের ওপর আমি একটা স্টোরি করছি, যদি এতটুকু বেচাল দেখি, তো তোমাকে ভিলেন বানিয়ে দেব। পেছনে ল্যাজ, উল্টোবাগে পা।’
—’আর বেচাল না দেখলে?’
—সান্টাক্লজ, ফারের পোশাক, রুপোর টুপি।’
—’তো তুই এ বাড়িটা নিয়ে কী করবি?’
—’দিমার তত্ত্বাবধানে এদের গড়ে তুলব। মারাদোনা, গাভাসকর, কাপ্রিয়াতি, স্টেফি গ্রাফ, ব্রুস লি…’
—’বলে যা, বলে যা থামলি কেন? স্বপ্নে পোলাও খেলে ঘি বেশি করে ঢালতে হয়।’
—’আমি একা ঢালছি না আজ্ঞে। তোমাকেও ঢালতে হবে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছোটাছুটি…’
—’তো বদলে আমি কী পাব?’
—’লবডঙ্কা। তবে তেমন লেগে থাকতে পারলে নোবেল প্রাইজ ফর পিসটা পেতে পার। প্রচারে আমি আর সুশান্ত তালুকদার সাহায্য করব।’
—’তথাস্তু। তা শৈবলিনী কি চন্দ্রশেখরের কাছে ফিরে যাবে?’
—’চন্দ্রশেখর নেই।’
—’তাহলে কি প্রতাপের কাছে থেকে যাবে?’
—’প্রতাপও নেই।’
—’ওই বেটা সুশান্ত তালুকদার লরেন্স ফস্টর ও—ই তবে এখন প্রতাপ হয়ে গেছে?’
—’লরেন্স ফস্টরও নেই।’
সুকৃতি খুব দুঃখিতভাবে মাথার টাকটায় আস্তে আস্তে হাত বুলোতে লাগলেন। যেন টাকটাই যত অনর্থের মূল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন