যে গল্পের শেষ হল না

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ট্রেনটা স্টেশানে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ৷ কেন দাঁড়িয়ে আছে, কিসের জন্য দেরি, তা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ বাবা খুব মন দিয়ে একটা মোটা ইংরিজি বই পড়ছেন, কিন্তু বিকু কী করবে? সে দুটো মাত্র গল্পের বই এনেছিল, অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে৷

ট্রেন চলতে থাকলেই ভালো লাগে, বেশিক্ষণ থেমে থাকা তাকে মানায় না৷

স্টেশানটা বেশ ছোট, দেখবার কিছু নেই৷ লোকজনও কম৷ ট্রেনটা শুধু শুধু সময় নষ্ট করছে৷

বিকুদের কামরার সামনেই একটা পুরি আর তরকারির দোকান৷ আর একটা লোক বিক্রি করছে ভাঁড়ের চা৷ আর বেশ খানিকটা দূরে একটা দোকানে কোলড ড্রিংকস আর চানাচুর-বিস্কুট পাওয়া যায় মনে হল, তার সামনের দিকে একটা দড়িতে ঝুলছে কয়েকটা পত্র-পত্রিকা৷ বিকুর মনে হল, ওখানে ছোটদের পত্রিকাও পাওয়া যেতে পারে, একটা কিনে আনলে তো হয়৷

সে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে ডাকল৷

বাবা বই পড়াতে এমনই মগ্ন যে শুনতেই পেলেন না৷

বিকু আবার ডাকল, বাবা!

এবার তিনি বই থেকে চোখ তুলে বললেন, কী রে?

বিকু বলল, এখানে একটা বইয়ের দোকান আছে৷ একটা বই কিনে আনব? আমার বই ফুরিয়ে গেছে৷

বাবা এবারে চারদিকে তাকিয়ে বললেন, বই কিনবি? এঃ, এই ট্রেনটা কতক্ষণ ধরে থেমে আছে! কখন যে যাবে! যা, নিয়ে আয় একটা বই৷

বাবা কোটের পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করলেন৷ তার ভেতরটা দেখতে দেখতে বললেন, খুচরো টাকা যে নেই দেখছি৷ একটা একশো টাকাই নিয়ে যা৷ ওরা ভাঙিয়ে দেবে৷

বাবা আবার ফিরে গেলেন বইয়ের পাতায়৷

বাবার কাছ থেকে নোটটা নিয়ে বিকু কামরা থেকে নেমে এল প্ল্যাটফর্মে৷ দূরে দেখা যাচ্ছে, ট্রেনের ইঞ্জিনের কাছে ভিড় করে আছে একদল লোক৷ আরও একজন-দু’জন লোক সব কামরা থেকেই নেমে এসেছে৷ চা খাচ্ছে কেউ কেউ৷ একটা টিউবওয়েল থেকে বোতলে জল ভরছে কয়েকজন, ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হচ্ছে সেই টিউবওয়েলে৷

বিকু চলে এল সেই দোকানটায়৷ দড়িতে ঝুলছে কয়েকটা পত্র-পত্রিকা, তার মধ্যে একটা বাংলা আর একটা ইংরিজি শুধু ছোটোদের৷ বিকু ম্যাগাজিন দুটো হাতে নিয়ে দেখল, দুটোই আগের মাসের পুরোনো৷ কিন্তু বিকু এই দুটো পড়েনি, সে তাই দুটোই কিনবে বলে বাড়িয়ে দিল একশো টাকার নোট৷

দোকানদারটি নোটটি হাতে নিয়ে বলল, বত্রিশ রুপিয়া৷ আপকা পাশ দো রুপিয়া হ্যায়?

বিকুর বেশ মজা লাগল৷ তার ভালো নাম বিক্রম, তার বয়েস এখন ঠিক বারো বছর পাঁচ দিন৷ ঠিক পাঁচ দিন আগেই তার জন্মদিন হয়ে গেল৷ কিন্তু এখনও তো তাকে কেউ আপনি বলে না৷

তা ছাড়া হিসেবটাও সে ঠিক বুঝতে পারল না৷ সে একশো টাকা দিয়েছে, আরও দু’টাকা তাকে দিতে হবে কেন? সে-ই তো অনেক টাকা ফেরত পাবে৷ একশো থেকে বত্রিশ বাদ দিলে হয় আটষট্টি টাকা৷

সে দোকানদারকে বলল, দো রুপিয়া নেহি হ্যায়৷

দোকানদার বলল, তব তো মুশকিল৷ মেরা পাশ খুচরা নেহি৷

তারপর সে কাকে যেন হাঁক মেরে জিজ্ঞেস করল, এ লছমনিয়া, তেরা পাশ দো রুপিয়া হ্যায়?

দোকানের পেছন থেকে কেউ একজন উত্তর দিল, দেখতা হ্যায়৷

দোকানদার হাত তুলে বিকুকে একটু অপেক্ষা করতে বলল৷

বিকু জিজ্ঞেস করল, দোকানদারজি, ট্রেনটা এখানে এত দেরি করছে কেন?

দোকানদার বলল, কেয়া মালুম৷ লাইনমে কুছ গড়বড় হুয়া৷

তারপর মুচকি হেসে বাংলায় বলল, কত্ত দেরি হোবে, কুছ ভি ঠিক নেহি৷ যত দেরি, তত আমার লাভ৷ আমার দোকানে বিক্রি বেশি হবে৷ আপনি আউর কুছ লিবেন না?

বিকু বলল, ঠিক আছে, এক প্যাকেট বিস্কুট দিন৷

বেশি খরচ করে ফেললে বাবা যদি রাগ করেন৷ আগের স্টেশনেই সে একটা ডাব খেয়েছে, তাতে অনেক জল ছিল৷ এখন আর তার কোলড ড্রিংক খাওয়ার ইচ্ছে নেই৷

দোকানদারটি বলল, বত্রিশ আউর দশ, বেয়াল্লিশ৷ ফির দো রুপিয়াকা চক্কর!

এই সময় ট্রেনটা একটা জোর হুইশল দিল৷

বিকু পেছন ফিরে দেখল, প্ল্যাটফর্মে যে-সব লোক ছিল, তারা টপাটপ উঠে পড়ছে ট্রেনে৷

বিকু ব্যস্ত হয়ে দোকানদারকে বলল, কই, আমার টাকা দিন৷

দোকানদার আবার হাঁক দিল, এ লছমনিয়া, দো রুপিয়া দে যানা—

পেছন থেকে উত্তর এল, মেরা পাশ নেহি হ্যায়৷

ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে৷

টাকার চিন্তা বিকুর মাথায় উঠে গেল৷ সে আর দেরি না করে দৌড়োল ট্রেনের দিকে৷

বিকু খেলাধুলোয় ভালো, জোরে দৌড়তেও পারে৷ কিন্তু তাদের কামরাটা অনেকটা দূরে৷ আর ট্রেনটা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে, হঠাৎ চলতে শুরু করেই এত স্পিড নেওয়ার কোনো মানে হয়?

ট্রেনটা এর মধ্যেই প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেছে৷ বিকু দেখল, তাদের কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে একজন লোক হাত নেড়ে কী যেন বলতে চাইছে, বিকু শুনতে পেল না৷ খুব জোরে দৌড়েও বিকু পৌঁছতে পারল না ট্রেনের কাছে৷ প্ল্যাটফর্ম ফুরিয়ে গেছে, শুধু লাইনের ওপর দিয়ে সে কতক্ষণ দৌড়োবে৷

বিকুর বুক ধড়ফড় করছে, চোখ ফেটে জল বেরুতে চাইছে৷ বাবা তাকে ফেলে চলে গেল? না, বাবা ফেলে যায়নি, ট্রেনটা বাবাকে নিয়ে চলে গেল, বিকুকে গ্রাহ্যই করল না৷

এখন সে কী করবে? না, সে কিছুতেই কাঁদবে না৷ কান্নার বয়েস সে পেরিয়ে এসেছে৷ এখন চিন্তা করতে হবে৷

সে ফিরতে লাগল প্ল্যাটফর্মের দিকে৷

সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দোকানদারটি৷ সে কপালে চাপড় মেরে বলল, হায় রাম! ট্রেন নেহি পাকড়ায়া৷ আরে আরে, ছি ছি ছি ছি৷

বিকু বলতে গেল, আপনি টাকা দিতে দেরি করেছেন বলেই তো…

কিন্তু বলতে পারল না৷ গলার কাছে কী রকম যেন করছে৷ এখন কিছু বলতে গেলেই কান্না কান্না ভাব এসে যাবে৷

দোকানদারটি বলল, এই নিন আপনার টাকা৷ এই বেঞ্চে এসে বসুন৷ সব ঠিক হো যায়গা৷

দোকানদারটি বিকুর হাতে একগাদা খুচরো টাকা তুলে দিল৷

বিকু দৌড়োবার সময় ম্যাগাজিন দুটো হাতে রেখেছিল, কিন্তু বিস্কুটের প্যাকেটটা ফেলে এসেছিল৷ দোকানদার সেটাও সঙ্গে এনেছে৷

বিকু ধপাস করে বসে পড়ল একটা বেঞ্চে৷ তার বুকটা ধড়ফড় করছে এখনো৷ কী হবে?

আস্তে আস্তে সেখানে ভিড় করে এল অনেকে৷ একটা ছেলে ট্রেনে উঠতে পারেনি, সেজন্য সবাই চিন্তিত৷ এক একজন এক একরকম কথা বলছে৷ স্টেশান মাস্টারমশাই তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে খোকা? তোমার কোথায় যাবার কথা?

বিকু শুকনো গলায় বলল, জামসেদপুর৷ সেখানে আমার মামার বাড়ি৷

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার সঙ্গে যাচ্ছিলে? তোমার টিকিট তোমার কাছে আছে?

বিকু বলল, বাবার সঙ্গে যাচ্ছিলাম৷ টিকিট বাবার কাছে৷

তিনি বললেন, এই রে! এখন তুমি জামসেদপুর যাবে কী করে? তোমার কাছে টাকা আছে?

বিকু তার হাতের টাকাগুলো দেখাল৷

উঁকি মেরে দেখে নিয়ে স্টেশান মাস্টার বললেন, ও টাকায় তো হবে না৷ তোমার বাবা কী করছিলেন? তিনি টের পেলেন না?

বিকু বলল, বাবা বই পড়ছিলেন৷

অন্য একজন বলল, তিনি চেন টানলেই তো পারতেন, তা হলে ট্রেন থেমে যেত৷

আর একজন বলল, হয়তো ভদ্রলোক বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন৷ জেগে উঠে হায় হায় করবেন৷

একজন কমবয়েসি ছেলে, বোধহয় কোনো কলেজে পড়ে, সে স্টেশান মাস্টারকে বলল, দাদা, ওর জামসেদপুরে যাবার টিকিট কাটতে যে-কটা টাকা কম পড়বে, সেটা আমরা চাঁদা তুলে দিয়ে দিতে পারি না?

স্টেশান মাস্টার বললেন, তা তো দেওয়া যেতেই পারে৷ কিন্তু এই ছোট স্টেশানে তো বেশি ট্রেন থামে না৷ জামসেদপুর যাবার ট্রেন পাওয়া যাবে ভোর রাত্রে৷ ততক্ষণ ও কী করবে? ও খোকা, তুমি জামসেদপুরে তোমার মামার বাড়ির ঠিকানা জানো?

বিকু একটু চিন্তা করে বলল, ঠিকানা…না, তা তো জানি না৷ লাল রঙের বাড়ি, আমার বড়মামার নাম জয়ন্ত রায়৷

একজন বলল, এই রে, লাল রঙের বাড়ি বললে কি ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়? জামসেদপুর বড় শহর, সেখানে বাঙালিও অনেক, শুধু নাম শুনে কেউ চিনতে পারবে না৷

এবার একজন বয়স্ক মানুষ সামনে এগিয়ে এসে বললেন, তোমরা সবাই মিলে ছেলেটাকে ঘাবড়ে দিও না৷ ওর আর কোথাও যাবার দরকার নেই৷ এইখানে চুপটি করে বসে থাকুক৷ ওর বাবা তো জানেন যে ছেলে কলার ভেলা—বাজি পোড়া স্টেশানে ট্রেন থেকে নেমে আর উঠতে পারেনি? উনি প্রথমেই এখানে খুঁজতে আসবেন৷ যেমন ভাবেই হোক আসবেনই৷

অন্য দু’একজন অন্য কথা বলতে যাচ্ছিল, তাদের থামিয়ে দিয়ে স্টেশান মাস্টার বললেন, না, না, হেমন্তদা ঠিক কথাই বলেছেন৷ এখানেই বসে থাকুক৷ স্টেশানে তো ভয়ের কিছু নেই৷

আর একজন বলল, আমি ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতাম৷ কিন্তু ওর বাবা কখন আসবেন, তা তো জানি না৷ উনি গাড়ি ভাড়া করেও আসতে পারেন৷

অন্য সবাই মত দিল যে, না, না, না, ওর এখন স্টেশান ছেড়ে কোথাও যাওয়া উচিত নয়৷

সেটাই ঠিক হবে৷ আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে গেল ভিড়৷ বেঞ্চের ওপর বসে রইল বিকু৷

এই স্টেশনের নামটা বেশ অদ্ভুত৷ কলার ভেলা—বাজি পোড়া৷ এর মানে কী? তাদের এক্সপ্রেস ট্রেনটার এরকম ছোট্ট স্টেশানে থামার কথাই ছিল না, সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল৷ এই স্টেশানের নাম বাবার মনে থাকবে তো?

ট্রেন না থাকলেই এই সব স্টেশান একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়৷ একটু পরে স্টেশান মাস্টারও তাঁর ঘর তালাবন্ধ করে চলে গেলেন৷ খাবারের দোকানটা ঝাঁপ ফেলে দিল, চা-ওয়ালাকেও আর দেখা গেল না৷

সন্ধে হয়ে এল, তখন প্ল্যাটফর্মে আর দেখা গেল না একজনও মানুষ৷ বিকু বসে আছে একা৷

না, বিকু ভয় পায়নি, কিন্তু তার বুকের মধ্যে কেমন যেন করছে৷ একটু একটু কান্না পাচ্ছে, চলেও যাচ্ছে আবার৷

একটা ম্যাগাজিন এর মধ্যে বিকুর পড়া শেষ হয়ে গেল৷ আর একটা সে খুলছে না, সেটাও যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে সে কী করে সময় কাটাবে?

একটু বাদে হঠাৎ বিকু চমকে উঠল৷ সে উল্টোদিকের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেখানে কয়েকটা বড় বড় গাছ, একটা গাছে ঝিকমিক করছে কয়েকটা জোনাকি৷ বিকু একবার ঘাটশিলায় বেড়াতে এসে জোনাকি দেখেছিল, সে পাঁচ-ছ’বছর আগে, তারপর তো সে আর জোনাকি দেখেইনি৷

একটা গান শুনে সে ডানদিকে তাকাল৷

কখন দুটি ছেলেমেয়ে সেখানে এসে মেঝেতে বসে পড়েছে, তা সে টেরও পায়নি৷ ছেলে আর মেয়ে দুটি বিকুর চেয়ে তিন-চার বছরের বড় মনে হয়, দুজনেরই ন্যাড়া মাথা৷ ওরা বসেছে একটা মাদুর পেতে৷

ছেলেটি গাইল,

 আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল

 সকলি ফুরায়ে যায় মা

মেয়েটি গাইল,

 জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে

 কোলে তুলে নিতে আয় মা

তারপর দুজনে একসঙ্গে গাইল,

 সকলি ফুরায়ে যায় মা!

সেই গানটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আর একটা গান শুরু করল৷ সেটাও মা দিয়ে, একটা লাইন এইরকম: মা মা বলে ডাকি, বারবার ডাকি, কেন বা যে ডাকি, তা জানি না৷

তারপর আবার একটা৷ সেটাও মায়ের গান৷

বিকুর বেশ মজা লাগল৷ ওরা কাকে গান শোনাচ্ছে? নাকি, এইসময় রেল স্টেশান ফাঁকা থাকে বলে ওরা এখানে গান প্র্যাকটিস করতে আসে!

কয়েকটা গান গাইবার পর ওরা মাদুর গুটিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল৷

বিকুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছেলেটি বলল, তুমি আমাদের গান শুনলে, পয়সা দাও!

বিকু টাকাগুলো পকেটে রেখে দিয়েছিল, সেগুলো আবার বার করল৷

মেয়েটি বললে, না, না, পয়সা দিতে হবে না৷ গান তোমার ভালো লেগেছে?

বিকু মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ৷

ছেলেটি হেসে বলল, আমি সত্যি সত্যি পয়সা চাইনি৷ আমরা কারুর কাছ থেকে পয়সা নিই না৷

তারপরই তারা চলে গেল৷

বিকু আবার বসে পড়তেই দেখল, রেললাইনের দিক থেকে কে যেন একজন আসছে৷ তার হাতে একটা বড়, গোল, বেতের ঝুড়ি৷ ঢাকনা দেওয়া৷ লোকটা একটা আলখাল্লা পরা, সারা মুখে দাড়ি-গোঁফ৷ দেখলে একটু ভয় ভয় করে৷

লোকটি বিকুর একেবারে কাছে এসে বিড়বিড় করে বলল, উফ, বড্ড পরিশ্রম গেছে৷ এখানে একটু বসি৷

কাছেই আর একটা বেঞ্চ আছে, তবু সে বসে পড়ল বিকুর পাশে৷

বিকু একটু সরে বসল৷

লোকটি বলল, কী দাদাভাই, ভয় পাচ্ছ নাকি? ভয় নেই, ভয় নেই, বিষদাঁত উবরে নিয়েছি গো৷

বিকু কিছুই বুঝতে পারল না৷ কিসের বিষদাঁত! উবরে মানে কী?

লোকটি বলল, দেখবে? দেখবে?

সে বেতের ঝুড়ির ঢাকনা খুলে ফেলতেই বিকু দেখল, তার মধ্যে রয়েছে তিনটে সাপ৷ তার মধ্যে একটা সাপ ফোঁস করে ফণা তুলল৷

বিকু এবারে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে পালাতে যেতেই লোকটি খপ করে তার একটা হাত চেপে ধরে বলল, যাচ্ছ কোথায়? বললুম নে, ভয় নেই গো! অমন যখন-তখন ভয় পেতে নেই গো দাদাভাই৷ এই দ্যাখো৷

সে খপ করে সাপটার ফণাটা চেপে ধরে টেনে তুলল৷ তারপর সেটাকে মুখের কাছে এনে একটা চুমু খেয়ে বলল, বিষ নেই তার কুলোপানা চক্কর৷ ঘটাং করে ভেঙে দিইচি৷

সাপটাকে আবার ঝুড়িতে রেখে দিয়ে সে বলল, উফ, কম খাটিয়েছে! সেই দুপুর থেকে খুঁজতেছি৷ মাত্তর তিনখান পেলাম!

বিকু এবার চোখ বড় বড় করে বলল, আপনি এই সাপ ধরলেন এখন?

লোকটি বলল, ইয়েস, নো, ভেরি গুড! সাপ ধরাই তো আমার কাজ৷ সাপ বিককিরি করে আমি খাই৷ রেললাইনের ধারে ধারে অনেক সাপ থাকে৷ তুমি একখান নেবে? সস্তায় দিতে পারি৷

বিকু দু’দিকে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না, না, চাই না, চাই না৷

লোকটি বলল, ইয়েস, নো, ভেরি গুড৷ ঠিকই তো৷ তুমি সাপ নিয়ে কী করবে? তুমি তো বাঁশি বাজাতেও জানো না৷ জানো?

বিকু বলল, না৷ আপনি বিস্কুট খাবেন?

লোকটি বলল, বিস্কুট? সেটা আবার কী জিনিস?

বিস্কুটের প্যাকেটটা বিকু এগিয়ে দিল লোকটির দিকে৷

সে দু’খানা বিস্কুট তুলে নিয়ে প্রথমে গন্ধ শুঁকল৷ তারপর বলল, গোকুল পিঠে? খাই? ক্ষুধা পেয়েছে বটে৷

কচর-মচর করে বিস্কুট দুটো খেতে খেতে সে বলল, মন্দ নয়৷ ইয়েস, নো, ভেরি গুড৷ কিন্তু দাদাভাই, কী খাওয়ালে আমারে৷ গলা যে শুকায়ে গেল৷ এখন পানি খেতে হবে৷ দেখি, পানি কোথায় পাই৷

বিকু আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই তো টিউবওয়েল৷

সে কথা না শুনে, লোকটি ঝুড়িটা তুলে নিয়ে বাইরে চলে গেল৷

তখন সেই দোকানদারকে দেখা গেল এদিকেই আসতে৷ তার হাতে একটা শালপাতার ঠোঙা৷

সে বলল, গরমাগরম কচৌরি আউর হালুয়া, খা লিজিয়ে৷ ট্রেন কখন আসবে ঠিক তো নাই৷

কচুরির বেশ ভালো গন্ধ বেরিয়েছে৷ বিস্কুট আর কত খাওয়া যায়! ঠোঙাটা হাতে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কিৎনা দাম?

সে বলল, আরে রাম রাম৷ দাম দিতে হোবে না৷ এ তো আমরা নিজের খাওয়ার জন্য বানিয়েছি৷ খেয়ে লিন৷ আরও লাগলে দিব৷

বিকু বলল, না, না, আর লাগবে না৷

সে বলল, আমি একটু বাজারে যাচ্ছি৷ জলদি ফিরে আসব৷

বিকু কচুরি আর হালুয়া খেতে লাগল মন দিয়ে৷ বেশ ভালো৷

এতক্ষণ তবু দোকানদারটি ছিল৷ এখন আর কেউ নেই৷

প্ল্যাটফর্মের আলো মিট মিট করছে৷ সামনের দিকটা, লাইনের ওপারে পুরো অন্ধকার৷ জোনাকিও আর দেখা যাচ্ছে না৷

হঠাৎ দেখা গেল, দূরে তীব্র আলো, এগিয়ে আসছে এদিকেই৷

সেটা যে একটা ট্রেন, তা বিকু প্রথমে বুঝতে পারেনি৷ সে তো আর আগে কোনোদিন একা একা খালি একটা স্টেশানে বসে দূর থেকে ট্রেন আসা দেখেনি৷

ট্রেনটা কোন দিক থেকে আসছে, কোন ট্রেন, তা বিকু জানে না৷ তবু তার মনে হল, এই ট্রেনেই বাবা আসছে৷

সে উঠে দাঁড়াল৷

ঝমঝম শব্দ করে ট্রেনটা এসে পড়ল, কিন্তু থামল না৷ গতিও কমল না৷ সেটা একটা মালগাড়ি৷ বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সেটা পার হয়ে গেল স্টেশান৷

বিকু আবার বসে পড়ল৷ না, সে কাঁদবে না, কিছুতেই কাঁদবে না৷

ট্রেনটা চলে যাবার পরেই দেখা গেল তিনজন লোককে৷ তারা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে চলে এল এ পাশে৷

একজন চেঁচিয়ে বলল, এই তো পেয়েছি৷ শ্রীমান এখানে বসে আছে৷

সে বিকুর থুতনিতে আঙুল দিয়ে মুখটা উঁচু করে তুলে বলল, হ্যাঁ, ঠিক মিলে গেছে৷

অন্য একটি লোক বলল, এই তুই এখানে বসে আছিস যে! তোর বাড়ির লোক হন্যে হয়ে তোকে খুঁজছে৷ ওঠ, ওঠ৷

আর একটি লোক বলল, তোর মা কত কাঁদছে৷ স্টেশানে এসে বসে আছিস, কোথাও পালাবি বুঝি ভাবছিলি?

প্রথম লোকটা বিকুর হাত ধরে টেনে বলল, শিবু, ওঠ!

বিকু প্রথমটায় ঘাবড়ে গিয়েছিল৷ এবার বলল, আমার নাম তো শিবু নয়৷ আমার নাম বিক্রম৷

সেই লোকটি ধমক দিয়ে বলল, ওসব বিক্রম-ফিক্রম জানি না, তোর ডাক নাম তো শিবু! চল, চল৷

বিকু এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, না, আমি শিবু নই৷ আমি বিকু৷

সেই লোকটি চোখ রাঙিয়ে বলল, ফের বাজে কথা! বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে এখন নামটাও বদলে ফেলেছিস! দেখি, দেখি তোর নাকটা? হ্যাঁ, এই তো ঠিক আছে৷ ডান দিকে একটুখানি ব্যাঁকা৷ চল, চল, ওঠ, ওঠ৷

সেই লোকটি জোর করে বিকুকে টেনে তুলল৷

বিকু বলল, আমি শিবু না! শিবু না! আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! আমার বাবা আমাকে খুঁজতে আসবে!

লোকগুলো হো-হো করে হেসে উঠল৷ একজন বলল, তোর বাবা তো হাসপাতালে শুয়ে আছে রে৷ হাঁটুতে ব্যথা হয়েছে খুব৷ একেই তো উনি ভালো চোখে দেখতে পান না, প্রায় অন্ধই বলতে গেলে, তার ওপর আবার এই হাঁটুতে ব্যথা৷

বিকু বলল, না, আমার বাবা চোখে খুব ভালো দেখতে পান!

ওর কথা আর গ্রাহ্য না করে সেই তিনজন ওকে টেনে নিয়ে চলল বাইরের দিকে৷

এই সময় আর একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে বলল, এই, এই, তোরা কাকে নিয়ে যাচ্ছিস? শিবুকে তো পাওয়া গেছে একটু আগে৷ সে একটা বাঁশগাছের জঙ্গলে ঘাপটি মেরে বসে ছিল৷

এদের একজন বলল, তা হলে এ ছেলেটা শিবু নয়?

সেই লোকটি বলল, না, না, শিবুর তো নাক অনেকখানি কাটা৷ তোরা একে ধরেছিস কেন? তোদের যেমন বুদ্ধি!

একজন বলল, শিবু বাঁশগাছের জঙ্গলে বসেছিল কেন?

সেই লোকটি বলল, তা আমি কী জানি! চল, চল!

তখন অন্যরা বিকুকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল!

বিকুর আবার বুক ধড়ফড় করছিল, সে আবার বেঞ্চটায় ফিরে এসে বসে পড়ে উফ উফ করে হাঁপাতে লাগল৷

ভাগ্যিস পরের লোকটা ঠিক সময়ে এসে পড়ল৷ নইলে অন্য তিনজন তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে শিবু বানিয়ে দিত৷ বাবা এসে আর বিকুকে খুঁজে পেতেন না!

আসল শিবুটা কোথায় থাকে?

তার নাক কেন কাটা? কেন সে লুকিয়ে থাকে বাঁশবনে? বাঁশবন কেমন দেখতে হয়!

বিকু নিজের নাকে হাত বুলোতে লাগল৷ ওদের একটা লোক কেন বলল যে বিকুর নাক ব্যাঁকা? মোটেই তার নাক ব্যাঁকা নয়৷

এরপর কতটা সময় কেটে গেল কে জানে! বিকু সেখানে বসেই রইল৷ কোনো ট্রেন এল না৷ আর কোনো লোকও এল না৷

একটু বাদে সে নরম গলায় ডাক শুনল, বিকু! বিকু!

বিকু দেখল, একজন সতেরো-আঠেরো কিংবা উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে নাম ধরে ডাকছে৷

বিকু তার দিকে তাকাতেই সে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, কী রে, বিকু, আমাকে চিনতে পাচ্ছিস না? আমি তো রিনা মাসি!

বিকুর তো একজনই মাসি৷ সেই বড়মাসি তো মায়ের চেয়েও বড়৷ রিনা মাসি বলে তো কারুকে সে কখনো দেখেনি৷

রিনা মাসি বলল, এখনো চিনতে পাচ্ছিস না তো? তা চিনবি কী করে, তুই যখন খুব ছোট, বোধহয় তিন-চার বছর বয়েস, তখনই তো আমি আকাশে চলে যাই!

বিকু বুঝতে না পেরে বলল, আকাশে চলে যাও? কেন?

রিনা মাসি বলল, আমার না এই পৃথিবীতে থাকতে আর ভালো লাগছিল না৷ এখানে বড্ড মাকড়সা আর আরশোলা৷ ওদের দেখলেই আমার ঘেন্না হয়৷ তাই আমি আকাশে উড়ে বেড়াই৷ আকাশটা কী পরিষ্কার! একদম ধুলো-ময়লা নেই!

বিকু বলল, তুমি আকাশে কী করে উড়ে বেড়াও? তুমি তো মানুষ?

রিনা মাসি বলল, এই দ্যাখ না, আমার দুটো ডানা আছে৷ আমি এখন পরি হয়ে গেছি! তবু মাঝে মাঝে মাটিতে নেমে আসি৷ তুই যাবি আমার সঙ্গে আকাশে বেড়াতে? আমি তোকে নিয়ে যেতে পারি৷ যাবি তো চল৷

বিকু অবাক হয়ে রিনা মাসির দিকে তাকিয়ে রইল৷ সত্যিই তো ওর পেছন দিকে ডানা গোটানো ছিল, এখন সামনে এসে গেছে৷ রিনা মাসি তাকে আকাশে নিয়ে যেতে চাইছে৷

বিকু তবু বলল, কিন্তু, আমি কী করে যাব! বাবা যে আমাকে এখানেই খুঁজতে আসবে৷ বাবা আমাকে খুঁজে না পেলে আমি জামসেদপুর যাব কী করে?

রিনা মাসি বলল, তোর বাবা মানে বীরু জামাইবাবু তো? তোর অত চিন্তার কী আছে! আমি তোকে জামসেদপুরে নিয়ে যাবো৷ ওটা তো আমাদেরই বাড়ি৷ কিংবা, তোকে এক্ষুনি পৌঁছে দেব না৷ বেশ কিছুক্ষণ তুই আর আমি আকাশে উড়ে বেড়াব৷ তোর বাবা, আমার দিদি খুব চিন্তা করবে৷ খুব মজা হবে৷ তারপর হুস করে একসময় ওদের সামনে তুই নেমে আসবি আকাশ থেকে৷ কী রে শুনে কেমন লাগছে? যাবি?

বিকু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ যাব৷ চলো, চলো, বেশ মজা হবে৷

তখনই কেউ বিকুর গায়ে ঠেলা মেরে বলল, খোকা! ওঠ!

দু’বার এরকম ঠেলা খাবার পর বিকু চোখ মেলে তাকাল৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা আর বড় মেসোমশাই৷

বড় মেসোমশাই বললেন, উঃ, কী দুশ্চিন্তাই হয়েছিল! যদি এখানেও না পেতাম! আমরা প্রত্যেকটা স্টেশান দেখতে দেখতে আসছি৷

বাবা বললেন, আমি ঠিক জানতাম৷ বিকু এখানেই বসে থাকবে৷ অন্য কোথাও যাবে না৷

বাবাকে দেখা মাত্র বিকুর যতটা আনন্দ হবার কথা, তা হল না৷ সে এদিক-ওদিক তাকাল৷ কোথায় গেল রিনা মাসি? নেই তো? এদের দেখেই চলে গেল?

বাবা আর বড় মেসোমশাই আর একটু দেরি করে এলেই পারতেন, তা হলে বিকুর বেশ আকাশে উড়ে আসা হত কিছুক্ষণ৷

বড় মেসোমশাই একসঙ্গে অনেক কথা বলতে লাগলেন৷ তোর খিদে পেয়েছে? তুই ভয় পাসনি তো? কেঁদে ফেলেছিলি? কেউ তোকে বিরক্ত করেছে? ফাঁকা স্টেশানে অনেকসময় গুন্ডা-বদমাশদের উৎপাত হয়….

বাবা বললেন, চল, বিকু, বাইরে আমাদের গাড়ি রয়েছে৷

বিকু ওঁদের সঙ্গে হাঁটতে লাগল আর ফিরে তাকাতে লাগল পেছন দিকে৷ রিনা মাসি কেন লুকিয়ে পড়ল, কিংবা ওটা কি স্বপ্ন? না, না, স্বপ্ন কি ওরকম একেবারে সত্যির মতন হয়! রিনা মাসি একবার তার হাত ছুঁয়েছিল৷

ওই দুটি ছেলে-মেয়ে কি রোজ এই স্টেশানে গান গাইতে আসে? আর ওই যে লোকটা সাপ ধরে?

বিকু মনে মনে ভাবল, আবার কখনো সে একা একা কোনো স্টেশানে নেমে পড়বে৷ সেখানে বসে থাকবে সারারাত৷

সকল অধ্যায়

১. কে দেখা দিল না
২. আমাদের জিপসি
৩. বন্দিনী
৪. একটি হাঁসের পালক
৫. নাম বদল
৬. কঠিন শাস্তি
৭. যদি
৮. তেপান্তর
৯. গঙ্গার ধারে চৌধুরী বাড়ি
১০. ছবি পাহাড়
১১. চার নম্বর ডাকাত
১২. চায়ের দোকানের সেই ছেলেটি
১৩. রেললাইনের পাহারাদার
১৪. বিল্টুর বন্ধু
১৫. ছোটমাসির মেয়েরা
১৬. ভরত ডাক্তারের ঘোড়া
১৭. উলটো কথা, কিন্তু সত্যি
১৮. ভূতুড়ে ঘোড়ার গাড়ি ও কালো বাক্স
১৯. পরি? না পরি না?
২০. পানিমুড়ার কবলে
২১. রাত্তিরবেলা, একা একা
২২. ভূত-ভবিষ্যতের গল্প
২৩. একটি মেয়ে, অনেক পাখি
২৪. বিল্টুদের বাড়ির সবাই
২৫. যে গল্পের শেষ হল না
২৬. তিনটি ছবির রহস্য
২৭. সোনামুখির হাতি ও রাজকুমার
২৮. সময় যখন হঠাৎ থেমে যায়
২৯. নিয়তি পুরুষ
৩০. ক্ষতিপূরণ
৩১. ডাকবাংলোর হাতছানি
৩২. ভয়ংকর প্রতিশোধ
৩৩. মানিকচাঁদের কীর্তি
৩৪. মায়াবন্দরের ঐরাবত
৩৫. পুপলু
৩৬. রাক্ষুসে পাথর
৩৭. দুর্গের মতো সেই বাড়িটা
৩৮. পিরামিডের পেটের মধ্যে
৩৯. হিরে উধাও রহস্য
৪০. রায়বাড়ির কালো চাঁদিয়াল
৪১. সেই অদ্ভুত লোকটা
৪২. মাঝরাতের অতিথি
৪৩. হুপা
৪৪. জল চুরি
৪৫. মহাকাশের যাযাবর
৪৬. যাচ্ছেতাই ডাকাত
৪৭. সুশীল মোটেই সুবোধ বালক নয়
৪৮. সত্যিকারের বাঘ
৪৯. পার্বতীপুরের রাজকুমার
৫০. চোর আর সাধু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন