ভূত-ভবিষ্যতের গল্প

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

‘‘গল্প বলো, গল্প বলো না দাদু!’’ দাদুকে ঘিরে ছোটো ছেলেমেয়েরা যেন কিচির-মিচির করে উঠল৷

‘‘কীসের গল্প?’’ দাদু একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন৷

‘‘ভূতের! ভূতের!’’ সবাই একমত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল৷

‘‘তবে শোন!’’ দাদু বললেন, ‘‘কিন্তু ভূতের গল্প কী শুনবি, ভূত তো আমরা৷ আজ তোদের নিজেদের গল্প বলি—ভবিষ্যতের গল্প, কেমন?’’

‘‘না, সে আবার কী, সে গল্প ভালো না!’’

‘‘হ্যাঁ, ভালো৷ শোন না আগে!’’

‘‘না, হোকগে ভালো, তুমি ভূতের গল্প বলো৷’’

‘‘আচ্ছা তবে তাই শোন৷ চুপটি করে থাকবি কিন্তু সবাই! এক যে ছিল ভূত তার হাত-পাগুলো সরু সরু, চোখ দুটো গর্তের ভেতর ঢোকানো—মুখে একমুখ দাড়ি৷’’ দাড়ির কথা শুনেই ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল৷ একজন বলল, ‘‘যাঃ ভূতের নাকি আবার দাড়ি হয়!’’

‘‘কথা বললে কিন্তু আমি বলব না৷ বলছি না আগে শোন চুপ করে৷’’

‘‘আচ্ছা৷ আচ্ছা৷’’

‘‘হ্যাঁ, তারপর সেই দাড়িওলা ভূতটা যখন যেরকম ইচ্ছে—সেইরকম রূপ ধরতে পারত৷ আর এক-একরকম রূপ এক-এক সময় ধরে মানুষকে ভয় দেখাত৷ এখন একদিন হয়েছে কী, ভূতটা একটা বাড়িতে এসেছে৷ এখন সেই বাড়িতে থাকত একটি লোক৷ সে বেচারির চাকরি নেই বাকরি নেই—বড়ো কষ্ট৷ সকালবেলা দশটার সময় বেরোয় চাকরি খুঁজতে আর সমস্ত দুপুর রোদ মাথায় করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়৷ খিদে পেলে কলের জল খায়৷ যাক সেদিন সন্ধেবেলা লোকটি নিজের ঘরে বসে কত সব কথা ভাবছিল৷ সে ভাবছিল তার এক বন্ধুর কথা৷ সেই বন্ধুটিও তার মতো বি. এ. পাশ করে কিছু চাকরি পায়নি৷ তার ঘরে আবার মা, বোন, ছোটো ভাই আছে৷ তার বাবা মরে গেছে কিছুদিন আগে৷ এদিকে চাকরি-বাকরি পায় না—কী করে যে সংসার চলবে তার ঠিক নেই৷ ভাবনায়-চিন্তায় ছেলেটি প্রায় পাগলের মতো হয়ে উঠল৷ একদিন সকালে দেখা গেল সে আত্মহত্যা করেছে৷ নিজের ঘরের কড়িকাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে সেই দড়ির ফাঁস গলায় বেঁধে সে ঝুলছে৷ চোখ দুটো যেন তার কপালের নীচ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে—কী বিতিকিচ্ছিরি চেহারা৷ এই ঘরের সেই লোকটি এইসব কথাই ভাবছিল৷ আর ভাবছিল তারও ওইরকম অবস্থা হবে নাকি! এদিকে সেই যে দাড়িওলা ভূতটা না, সে তো এসে বসেছিল সেই বাড়িতে৷ সে সব বুঝতে পারল, লোকটা কী ভাবছে৷ অমনি তার মনে দুষ্টু বুদ্ধি গজিয়ে উঠল৷ সে করল কী, এই লোকটার সেই বন্ধুটির মতন রূপ ধরল—তারপর হাতে একটা দড়ি নিয়ে লোকটার ঘরের মধ্যে দাঁড়াল৷ লোকটি প্রথমটা দেখে তো বিশ্বাসই করল না৷ চোখটা রগড়ে নিল৷ তবুও আবার দেখতে পেল৷ ঠিক তার সেই বন্ধুটি—গলায় দড়ির ফাঁস আটকানো—চোখ দুটো বেরিয়ে পড়েছে—জিভটা ঝুলে পড়েছে৷ লোকটা তাই দেখে এত ভয় পেল যে, সেই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু—মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুল না৷ তখন সেই ভূতটি মুখ দিয়ে ঘড় ঘড় করে বিকট আওয়াজ করতে লাগল৷ চোখ দুটো আগুনের গোলার মতো জ্বলতে লাগল৷ হাতের দড়িটা সেই লোকটির দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘আর দেখছিস কী৷ আয় আমার কাছে৷ আমার মতো তুইও ঝুলে পড়৷’ লোকটি সেই কথা শুনে কোনো জবাব দিতে পারল না৷ আস্তে আস্তে পায় পায় তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷…

আর এদিকে আর একটি লোকের কথা বুঝি বলিনি তোদের কাছে! সেও যখন যেরকম ইচ্ছে সেইরকম রূপ ধরতে পারে, তবে কাউকে ভয় দেখায় না৷ সে যখন দেখল ভূতের কাণ্ড, সে করল কী সেই লোকটিরই বাড়ির একজন লোকের রূপ ধরল—তারপর সেই লোকটি যখন ভূতটার কাছ থেকে দড়িটা প্রায় নেবে নেবে—এমন সময় খুব করে ধাক্কা দিতে লাগল তার দরজায়৷ দরজা খুলতেই সে অমনি সেই লোকটিকে বলল, এই দেখুন আজ আপনার চিঠি এসেছে দুপুরে৷ কোন আপিস থেকে যেন৷ লোকটি চিঠিটা খুলেই দেখে একখানা আপিস থেকে এসেছে চিঠিটা—তার চাকরি হয়েছে এক জায়গায়৷ আনন্দের চোটে লাফিয়ে উঠল লোকটা৷ তারপর ঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখল, কোথায় ভূত? ঘর একদম ফাঁকা!’’

একটুক্ষণ চুপচাপ থাকবার পর, একটি ছোটো ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘‘আচ্ছা দাদু, যে লোকটা চিঠি দিল, ভূতটা তাকেও মেরে ফেলতে পারল না?’’

দাদু একটু হেসে জবাব দিলেন, ‘‘দূর বোকা ছেলে, ভূত কখনও ভবিষ্যতের কাছ ঘেঁষতে পারে?’’

সকল অধ্যায়

১. কে দেখা দিল না
২. আমাদের জিপসি
৩. বন্দিনী
৪. একটি হাঁসের পালক
৫. নাম বদল
৬. কঠিন শাস্তি
৭. যদি
৮. তেপান্তর
৯. গঙ্গার ধারে চৌধুরী বাড়ি
১০. ছবি পাহাড়
১১. চার নম্বর ডাকাত
১২. চায়ের দোকানের সেই ছেলেটি
১৩. রেললাইনের পাহারাদার
১৪. বিল্টুর বন্ধু
১৫. ছোটমাসির মেয়েরা
১৬. ভরত ডাক্তারের ঘোড়া
১৭. উলটো কথা, কিন্তু সত্যি
১৮. ভূতুড়ে ঘোড়ার গাড়ি ও কালো বাক্স
১৯. পরি? না পরি না?
২০. পানিমুড়ার কবলে
২১. রাত্তিরবেলা, একা একা
২২. ভূত-ভবিষ্যতের গল্প
২৩. একটি মেয়ে, অনেক পাখি
২৪. বিল্টুদের বাড়ির সবাই
২৫. যে গল্পের শেষ হল না
২৬. তিনটি ছবির রহস্য
২৭. সোনামুখির হাতি ও রাজকুমার
২৮. সময় যখন হঠাৎ থেমে যায়
২৯. নিয়তি পুরুষ
৩০. ক্ষতিপূরণ
৩১. ডাকবাংলোর হাতছানি
৩২. ভয়ংকর প্রতিশোধ
৩৩. মানিকচাঁদের কীর্তি
৩৪. মায়াবন্দরের ঐরাবত
৩৫. পুপলু
৩৬. রাক্ষুসে পাথর
৩৭. দুর্গের মতো সেই বাড়িটা
৩৮. পিরামিডের পেটের মধ্যে
৩৯. হিরে উধাও রহস্য
৪০. রায়বাড়ির কালো চাঁদিয়াল
৪১. সেই অদ্ভুত লোকটা
৪২. মাঝরাতের অতিথি
৪৩. হুপা
৪৪. জল চুরি
৪৫. মহাকাশের যাযাবর
৪৬. যাচ্ছেতাই ডাকাত
৪৭. সুশীল মোটেই সুবোধ বালক নয়
৪৮. সত্যিকারের বাঘ
৪৯. পার্বতীপুরের রাজকুমার
৫০. চোর আর সাধু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন