১৮. গীতচর্চা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সাহিত্যের শিক্ষায় ভাবের চর্চায় বাল্যকাল হইতে জ্যোতিদাদা আমার প্রধান সহায় ছিলেন, তিনি নিজে উৎসাহী এবং অন্যকে উৎসাহ দিতে তাঁহার আনন্দ। আমি অবাধে তাঁহার সঙ্গে ভাবের ও জ্ঞানের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতাম-তিনি বালক বলিয়া আমাকে অবজ্ঞা করিতেন না।

তিনি আমাকে খুব-একটা বড়োরকমের স্বাধীনতা দিয়াছিলেন; তাঁহার সংস্রবে আমার ভিরতকার সংকোচ ঘুচিয়া গিয়াছিল। এইরূপ স্বাধীনতা আমাকে আর-কেহ দিতে সাহস করিতে পারিত না– সেজন্য হয়তো কেহ কেহ তাঁহাকে নিন্দাও করিয়াছে। কিন্তু প্রখর গ্রীষ্মের পরে বর্ষার যেমন প্রয়োজন, আমার পক্ষে আশৈশব বাধানিষেধের পরে এই স্বাধীনতা তেমনি অত্যাবশ্যক ছিল। সে সময়ে এই বন্ধনমুক্তি না ঘটিলে চিরজীবন একটা পঙ্গুতা থাকিয়া যাইত। প্রবলপক্ষেরা সর্বদাই স্বাধীনতার অপব্যবহার লইয়া খোঁটা দিয়া স্বাধীনতাকে খর্ব করিতে চেষ্টা করিয়া থাকে, কিন্তু স্বাধীনতার অপব্যয় করিবার যদি অধিকার না থাকে তবে তাহাকে স্বাধীনতাই বলা যায় না। অপব্যয়ের দ্বারাই সদ্‌ব্যয়ের যে শিক্ষা হয় তাহাই খাঁটি শিক্ষা। অন্তত, আমি এ কথা জোর করিয়া বলিতে পারি– স্বাধীনতার দ্বারা যেটুকু উৎপাত ঘটিয়াছে তাহাতে আমাকে উৎপাতনিবারণের পন্থাতেই পৌঁছাইয়া দিয়াছে। শাসনের দ্বারা, পীড়নের দ্বারা, কানমলা এবং কানে মন্ত্র-দেওয়ার দ্বারা আমাকে যাহা কিছু দেওয়া হইয়াছে তাহা আমি কিছুই গ্রহণ করি নাই। যতক্ষণ আমি আপনার মধ্যে আপনি ছাড়া না পাইয়াছি ততক্ষণ নিষ্ফল বেদনা ছাড়া আর কিছুই আমি লাভ করিতে পারি নাই। জ্যোতিদাদাই সম্পূর্ণ নিঃসংকোচে সমস্ত ভালোমন্দর মধ্য দিয়া আমাকে আমার আত্মোপলদ্ধির ক্ষেত্রে ছাড়িয়া দিয়াছেন, এবং তখন হইতেই আমার আপন শক্তি নিজের কাঁটা ও নিজের ফুল বিকাশ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারিয়াছে। আমার এই অভিজ্ঞতা হইতে আমি যে শিক্ষালাভ করিয়াছি তাহাতে মন্দকেও আমি তত ভয় করি না ভালো করিয়া তুলিবার উপদ্রবকে যত ডরাই– ধর্মনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক প্যুনিটিভ পুলিসের পায়ে আমি গড় করি– ইহাতে যে দাসত্বের সৃষ্টি করে তাহার মতো বালাই জগতে আর-কিছুই নাই।

এক সময়ে পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নূতন নূতন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন। প্রত্যহই তাঁহার অঙ্গুলিনৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সুরবর্ষণ হইতে থাকিত। আমি এবং অক্ষয়বাবু তাঁহার সেই সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলাম। গান বাঁধিবার শিক্ষানবিসি এইরূপে আমার আরম্ভ হইয়াছিল।

আমাদের পরিবারে শিশুকাল হইতে গানচর্চার মধ্যেই আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। আমার পক্ষে তাহার একটা সুবিধা এই হইয়াছিল, অতি সহজেই গান আমার সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। তাহার অসুবিধাও ছিল। চেষ্টা করিয়া গান আয়ত্ত করিবার উপযুক্ত অভ্যাস না হওয়াতে, শিক্ষা পাকা হয় নাই। সংগীতবিদ্যা বলিতে যাহা বোঝায় তাহার মধ্যে কোনো অধিকার লাভ করিতে পারি নাই।

সকল অধ্যায়

১. ০১. জীবন স্মৃতি
২. ০২. শিক্ষারম্ভ
৩. ০৩. ঘর ও বাহির
৪. ০৪. ভৃত্যরাজক তন্ত্র
৫. ০৫. নর্মাল স্কুল
৬. ০৬. কবিতা রচনারম্ভ
৭. ০৭. নানা বিদ্যার আয়োজন
৮. ০৮. বাহিরে যাত্রা
৯. ০৯. কাব্যরচনাচর্চা
১০. ১০. শ্রীকণ্ঠবাবু
১১. ১১. বাংলাশিক্ষার অবসান
১২. ১২. পিতৃদেব
১৩. ১৩. হিমালয়যাত্রা
১৪. ১৪. প্রত্যাবর্তন
১৫. ১৫. ঘরের পড়া
১৬. ১৬. বাড়ির আবহাওয়া
১৭. ১৭. অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী
১৮. ১৮. গীতচর্চা
১৯. ১৯. সাহিত্যের সঙ্গী
২০. ২০. রচনাপ্রকাশ
২১. ২১. ভানুসিংহের কবিতা
২২. ২২. স্বাদেশিকতা
২৩. ২৩. ভারতী
২৪. ২৪. আমেদাবাদ
২৫. ২৫. বিলাত
২৬. ২৬. লোকেন পালিত
২৭. ২৭. ভগ্নহৃদয়
২৮. ২৮. বিলাতি সংগীত
২৯. ২৯. বাল্মীকিপ্রতিভা
৩০. ৩০. সন্ধ্যাসংগীত
৩১. ৩১. গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ
৩২. ৩২. গঙ্গাতীর
৩৩. ৩৩. প্রিয়বাবু
৩৪. ৩৪. প্রভাতসংগীত
৩৫. ৩৫. রাজেন্দ্রলাল মিত্র
৩৬. ৩৬. কারোয়ার
৩৭. ৩৭. প্রকৃতির প্রতিশোধ
৩৮. ৩৮. ছবি ও গান
৩৯. ৩৯. বালক
৪০. ৪০. বঙ্কিমবাবু
৪১. ৪১. জাহাজের খোল
৪২. ৪২. মৃত্যুশোক
৪৩. ৪৩. বর্ষা ও শরৎ
৪৪. ৪৪. শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী
৪৫. ৪৫. কড়ি ও কোমল

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন