৪৪. শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দ্বিতীয়বার বিলাত যাইবার জন্য যখন যাত্রা করি তখন আশুর সঙ্গে জাহাজে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পাস করিয়া কেম্‌ব্রিজে ডিগ্রি লইয়া ব্যারিস্টর হইতে চলিতেছেন। কলিকাতা হইতে মাদ্রাজ পর্যন্ত কেবল কয়টা দিন মাত্র আমরা জাহাজে একত্র ছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, পরিচয়ের গভীরতা দিনসংখ্যার উপর নির্ভর করে না। একটি সহজ সহৃদয়তার দ্বারা অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি এমন করিয়া আমার চিত্ত অধিকার করিয়া লইলেন যে,পূর্বে তাঁহার সঙ্গে যে চেনাশোনা ছিল না সেই ফাঁকটা এই কয়দিনের মধ্যেই যেন আগাগোড়া ভরিয়া গেল।

আশু বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিলে তাঁহার সঙ্গে আমাদের আত্মীয়সম্বন্ধ স্থাপিত হইল। তখনো ব্যারিস্টরি ব্যবসায়ের বূহ্যের ভিতরে ঢুকিয়া পড়িয়া ল-য়ের মধ্যে লীন হইবার সময় তাঁহার হয় নাই। মক্কেলের কুঞ্চিত থলিগুলি পূর্ণবিকশিত হইয়া তখনো স্বর্ণকোষ উন্মুক্ত করে নাই এবং সাহিত্যবনের মধুসঞ্চয়েই তিনি তখন উৎসাহী হইয়া ফিরিতেছিলেন। তখন দেখিতাম, সাহিত্যের ভাবুকতা একেবারে তাঁহার প্রকৃতির মধ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার মনের ভিতরে যে-সাহিত্যের হাওয়া বহিত তাহার মধ্যে লাইব্রেরি-শেল্‌ফের মরক্কো-চামড়ার গন্ধ একেবারেই ছিল না। সেই হাওয়ায় সমুদ্রপারের অপরিচিত নিকুঞ্জের নানা ফুলের নিশ্বাস একত্র হইয়া মিলিত, তাঁহার সঙ্গে আলাপের যোগে আমরা যেন কোন্‌-একটি দূর বনের প্রান্তে বসন্তের দিনে চড়িভাতি করিতে যাইতাম।

ফরাসি কাব্যসাহিত্যের রসে তাঁহার বিশেষ বিলাস ছিল। আমি তখন কড়ি ও কোমল-এর কবিতাগুলি লিখিতেছিলাম। আমার সেই-সকল লেখায় তিনি ফরাসি কোনো কোনো কবির ভাবের মিল দেখিতে পাইতেন। তাঁহার মনে হইয়াছিল, মানবজীবনের বিচিত্র রসলীলা কবির মনকে একান্ত করিয়া টানিতেছে, এই কথাটাই কড়ি ও কোমল-এর কবিতার ভিতর দিয়া নানাপ্রকারে প্রকাশ পাইতেছে। এই জীবনের মধ্যে প্রবেশ করিবার ও তাহাকে সকল দিক দিয়া গ্রহণ করিবার জন্য একটি অপরিতৃপ্ত আকাঙক্ষা এই কবিতাগুলির মুলকথা।

আশু বলিলেন, “তোমার এই কবিতাগুলি যথোচিত পর্যায়ে সাজাইয়া আমিই প্রকাশ করিব।” তাঁহারই ‘পরে প্রকাশের ভার দেওয়া হইয়াছিল। “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’– এই চতুর্দশপদী কবিতাটি তিনিই গ্রন্থের প্রথমেই বসাইয়া দিলেন। তাঁহার মতে এই কবিতাটির মধ্যেই সমস্ত গ্রন্থের মর্মকথাটি আছে।

অসম্ভব নহে। বাল্যকালে যখন ঘরের মধ্যে বদ্ধ ছিলাম তখন অন্তঃপুরের ছাদের প্রাচীরের ছিদ্র দিয়া বাহিরের বিচিত্র পৃথিবীর দিকে উৎসুকদৃষ্টিতে হৃদয় মেলিয়া দিয়াছি। যৌবনের আরম্ভে মানুষের জীবনলোক আমাকে তেমনি করিয়াই টানিয়াছে। তাহারও মাঝখানে আমার প্রবেশ ছিল না, আমি প্রান্তে দাঁড়াইয়া ছিলাম। খেয়ানৌকা পাল তুলিয়া ঢেউয়ের উপর দিয়া পাড়ি দিতেছে, তীরে দাঁড়াইয়া আমার মন বুঝি তাহার পাটনিকে হাত বাড়াইয়া ডাক পাড়িত। জীবন-যে জীবনযাত্রায় বাহির হইয়া পড়িতে চায়।

সকল অধ্যায়

১. ০১. জীবন স্মৃতি
২. ০২. শিক্ষারম্ভ
৩. ০৩. ঘর ও বাহির
৪. ০৪. ভৃত্যরাজক তন্ত্র
৫. ০৫. নর্মাল স্কুল
৬. ০৬. কবিতা রচনারম্ভ
৭. ০৭. নানা বিদ্যার আয়োজন
৮. ০৮. বাহিরে যাত্রা
৯. ০৯. কাব্যরচনাচর্চা
১০. ১০. শ্রীকণ্ঠবাবু
১১. ১১. বাংলাশিক্ষার অবসান
১২. ১২. পিতৃদেব
১৩. ১৩. হিমালয়যাত্রা
১৪. ১৪. প্রত্যাবর্তন
১৫. ১৫. ঘরের পড়া
১৬. ১৬. বাড়ির আবহাওয়া
১৭. ১৭. অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী
১৮. ১৮. গীতচর্চা
১৯. ১৯. সাহিত্যের সঙ্গী
২০. ২০. রচনাপ্রকাশ
২১. ২১. ভানুসিংহের কবিতা
২২. ২২. স্বাদেশিকতা
২৩. ২৩. ভারতী
২৪. ২৪. আমেদাবাদ
২৫. ২৫. বিলাত
২৬. ২৬. লোকেন পালিত
২৭. ২৭. ভগ্নহৃদয়
২৮. ২৮. বিলাতি সংগীত
২৯. ২৯. বাল্মীকিপ্রতিভা
৩০. ৩০. সন্ধ্যাসংগীত
৩১. ৩১. গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ
৩২. ৩২. গঙ্গাতীর
৩৩. ৩৩. প্রিয়বাবু
৩৪. ৩৪. প্রভাতসংগীত
৩৫. ৩৫. রাজেন্দ্রলাল মিত্র
৩৬. ৩৬. কারোয়ার
৩৭. ৩৭. প্রকৃতির প্রতিশোধ
৩৮. ৩৮. ছবি ও গান
৩৯. ৩৯. বালক
৪০. ৪০. বঙ্কিমবাবু
৪১. ৪১. জাহাজের খোল
৪২. ৪২. মৃত্যুশোক
৪৩. ৪৩. বর্ষা ও শরৎ
৪৪. ৪৪. শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী
৪৫. ৪৫. কড়ি ও কোমল

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন