৩৮. ছবি ও গান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছবি ও গান নাম ধরিয়া আমার যে-কবিতাগুলি বাহির হইয়াছিল তাহার অধিকাংশ এই সময়কার লেখা।

চৌরঙ্গির নিকটবর্তী সার্ক্যুলর রোডের একটি বাগান-বাড়িতে আমরা তখন বাস করিতাম। তাহার দক্ষিণের দিকে মস্ত একটা বস্‌তি ছিল। আমি অনেক সময়েই দোতলার জানলার কাছে বসিয়া সেই লোকালয়ের দৃশ্য দেখিতাম। তাহাদের সমস্ত দিনের নানাপ্রকার কাজ, বিশ্রাম, খেলা ও আনাগোনা দেখিতে আমার ভারি ভালো লাগিত– সে যেন আমার কাছে বিচিত্র গল্পের মতো হইত।

নানা জিনিসকে দেখিবার যে দৃষ্টি সেই দৃষ্টি যেন আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল। তখন একটি একটি যেন স্বতন্ত্র ছবিকে কল্পনার আলোকে ও মনের আনন্দ দিয়া ঘিরিয়া লইয়া দেখিতাম। এক-একটি বিশেষ দৃশ্য এক-একটি বিশেষ রসে রঙে নির্দিষ্ট হইয়া আমার চোখে পড়িত। এমনি করিয়া নিজের মনের কল্পনাপরিবেষ্টিত ছবিগুলি গড়িয়া তুলিতে ভারি ভালো লাগিত। সে আর কিছু নয়, এক-একটি পরিস্ফুট চিত্র আঁকিয়া তুলিবার আকাঙক্ষা। চোখ দিয়া মনের জিনিসকে ও মন দিয়া চোখের দেখাকে দেখিতে পাইবার ইচ্ছা। তুলি দিয়া ছবি আঁকিতে যদি পারিতাম তবে পটের উপর রেখা ও রঙ দিয়া উতলা মনের দৃষ্টি ও সৃষ্টিকে বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতাম কিন্তু সে-উপায় আমার হাতে ছিল না। কিন্তু কেবল কথা ও ছন্দ। কিন্তু কথার তুলিতে তখন স্পষ্ট রেখার টান দিতে শিখি নাই, তাই কেবলই রঙ ছড়াইয়া পড়িত। তা হউক, তবু ছেলেরা যখন প্রথম রঙের বাক্স উপহার পায় তখন যেমন-তেমন করিয়া নানাপ্রকার ছবি আঁকিবার চেষ্টায় অস্থির হইয়া ওঠে; আমিও সেইদিন নবযৌবনের নানান রঙের বাক্সটা নূতন পাইয়া আপন মনে কেবলই রকম-বেরকম ছবি আঁকিবার চেষ্টা করিয়া দিন কাটাইয়াছি। সেই সেদিনের বাইশবছর বয়সের সঙ্গে এই ছবিগুলাকে মিলাইয়া দেখিলে হয়তো ইহাদের কাঁচা লাইন ও ঝাপসা রঙের ভিতর দিয়াও একটা-কিছু চেহারা খুঁজিয়া পাওয়া যাইতে পারে।

পূর্বেই লিখিয়াছি, প্রভাতসংগীতে একটা পর্ব শেষ হইয়াছে। ছবি ও গান হইতে পালাটা আবার আর-একরকম করিয়া শুরু হইল। একটা জিনিসের আরম্ভের আয়োজনে বিস্তর বাহুল্য থাকে। কাজ যত অগ্রসর হইতে থাকে তত সে-সমস্ত সরিয়া পড়ে। এই নূতন পালার প্রথমের দিকে বোধ করি বিস্তর বাজে জিনিস আছে। সেগুলি যদি গাছের পাতা হইত তবে নিশ্চয় ঝরিয়া যাইত। কিন্তু বইয়ের পাতা তো অত সহজে ঝরে না, তাহার দিন ফুরাইলেও সে টিকিয়া থাকে। নিতান্ত সামান্য জিনিসকেও বিশেষ করিয়া দেখিবার একটি পালা এই ছবি ও গান-এ আরম্ভ হইয়াছে। গানের সুর যেমন সাদা কথাকেও গভীর করিয়া তোলে তেমনি কোনো একটা সামান্য উপলক্ষ লইয়া সেইটেকে হৃদয়ের রসে রসাইয়া তাহার তুচ্ছতা মোচন করিবার ইচ্ছা ছবি ও গান-এ ফুটিয়াছে। না, ঠিক তাহা নহে। নিজের মনের তারটা যখন সুরে বাঁধা থাকে তখন বিশ্বসংগীতের ঝংকার সকল জায়গা হইতে উঠিয়াই তাহাতে অনুরণন তোলে। সেদিন লেখকের চিত্তযন্ত্রে একটা সুর জাগিতেছিল বলিয়াই বাহিরে কিছুই তুচ্ছ ছিল না। এক-একদিন হঠাৎ যাহা চোখে পড়িত, দেখিতাম তাহারই সঙ্গে আমার প্রাণের একটা সুর মিলিতেছে। ছোটো শিশু যেমন ধুলা বালি ঝিনুক শামুক যাহা-খুশি তাহাই লইয়া খেলিতে পারে, কেননা তাহার মনের ভিতরেই খেলা জাগিতেছে; সে আপনার অন্তরের খেলার আনন্দ দ্বারা জগতের আনন্দখেলাকে সত্যভাবেই আবিষ্কার করিতে পারে, এইজন্য সর্বত্রই তাহার আয়োজন; তেমনি অন্তরের মধ্যে যেদিন আমাদের যৌবনের গান নানা সুরে ভরিয়া ওঠে তখনই আমরা সেই বোধের দ্বারা সত্য করিয়া দেখিতে পাই যে, বিশ্ববীণার হাজার-লক্ষ তার নিত্য সুরে যেখানে বাঁধা নাই এমন জায়গাই নাই– তখন যাহা চোখে পড়ে, যাহা হাতের কাছে আসে তাহাতেই আসর জমিয়া ওঠে, দূরে যাইতে হয় না।

সকল অধ্যায়

১. ০১. জীবন স্মৃতি
২. ০২. শিক্ষারম্ভ
৩. ০৩. ঘর ও বাহির
৪. ০৪. ভৃত্যরাজক তন্ত্র
৫. ০৫. নর্মাল স্কুল
৬. ০৬. কবিতা রচনারম্ভ
৭. ০৭. নানা বিদ্যার আয়োজন
৮. ০৮. বাহিরে যাত্রা
৯. ০৯. কাব্যরচনাচর্চা
১০. ১০. শ্রীকণ্ঠবাবু
১১. ১১. বাংলাশিক্ষার অবসান
১২. ১২. পিতৃদেব
১৩. ১৩. হিমালয়যাত্রা
১৪. ১৪. প্রত্যাবর্তন
১৫. ১৫. ঘরের পড়া
১৬. ১৬. বাড়ির আবহাওয়া
১৭. ১৭. অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী
১৮. ১৮. গীতচর্চা
১৯. ১৯. সাহিত্যের সঙ্গী
২০. ২০. রচনাপ্রকাশ
২১. ২১. ভানুসিংহের কবিতা
২২. ২২. স্বাদেশিকতা
২৩. ২৩. ভারতী
২৪. ২৪. আমেদাবাদ
২৫. ২৫. বিলাত
২৬. ২৬. লোকেন পালিত
২৭. ২৭. ভগ্নহৃদয়
২৮. ২৮. বিলাতি সংগীত
২৯. ২৯. বাল্মীকিপ্রতিভা
৩০. ৩০. সন্ধ্যাসংগীত
৩১. ৩১. গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ
৩২. ৩২. গঙ্গাতীর
৩৩. ৩৩. প্রিয়বাবু
৩৪. ৩৪. প্রভাতসংগীত
৩৫. ৩৫. রাজেন্দ্রলাল মিত্র
৩৬. ৩৬. কারোয়ার
৩৭. ৩৭. প্রকৃতির প্রতিশোধ
৩৮. ৩৮. ছবি ও গান
৩৯. ৩৯. বালক
৪০. ৪০. বঙ্কিমবাবু
৪১. ৪১. জাহাজের খোল
৪২. ৪২. মৃত্যুশোক
৪৩. ৪৩. বর্ষা ও শরৎ
৪৪. ৪৪. শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী
৪৫. ৪৫. কড়ি ও কোমল

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন