মা-মেরির রিস্টওয়াচ

সৈয়দ মুজতবা আলী

মা-মেরির রিস্টওয়াচ

একদা রম্য রচনা কী রীতিতে উত্তমরূপে লেখা যায়, এই বাসনা নিয়ে কলেজের ছেলের বয়সীরা আমাকে প্রশ্ন শুধাত; অধুনা শুধোয়, ঐতিহাসিক উপন্যাস কী প্রকারে লেখা যায়? আমি বাঙালি, কাজেই বাঙালির স্বভাব খানিকটে জানি– পাঁচু, ভূতো আর পাঁচজন যে ব্যবসা করেন– যথা পাবলিশিং হাউস কিংবা লন্ড্রি– পয়সা কামিয়েছে, সে সেইটেই করতে চায়, নতুন ব্যবসায় ঝুঁকি নিতে সে নারাজ। অতএব হাল-বাজারে যখন ঐতিহাসিক উপন্যাস ছেড়ে দিয়ে কালোবাজারের চেয়েও সাদা-বাজারে লাভ বেশি, তবে চল ওই লালকেল্লা ফতেহ করতে; মা-মেরিতে বিশ্বাস রাখলে কড়ি দিয়েও কিনতে হবে না, সায়েবের মুনশিও ওই আশ্বাস দিয়েছেন।

যারা পণ্ডিত লোক, ইতিহাস জানেন ও উপন্যাস লেখার কায়দাটাও যাঁদের রপ্ত আছে, তাঁরাই ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে পারেন। আমি ও আমার মতো আর পাঁচজন পারে না, আমরা পণ্ডিত নই। কিন্তু পণ্ডিত না হয়েও দিব্য বুঝতে পারি, ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে যাওয়ার বিপদটা কী?–পাখির মতো উড়তে না জেনেও চমৎকার বুঝতে পারি মনুমেন্টের উপর থেকে লাফ দিয়ে পাখির মতো ওড়বার চেষ্টা করলে হালটা মোটামুটি কী হবে।

এই তো হালে একটি সাপ্তাহিক পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অলস নয়নে পড়লুম, ‘তুমি ওমরাহ নও।’

সর্বনাশ! এটা কী প্রকার হল? ‘ওমরাহ’ তো আমিরের সাদামাটা বহুবচন- সে রকম ‘গরিব’ থেকে ‘গুরবাহ’; তাই বলি ‘গরিব-গুরব’। সেই আইনেই বলি ‘আমির-ওমরাহ’ (‘আমির-ওমরো’ও শুনেছি; আকারান্ত শব্দ বাংলায়, ‘এ’ ‘ও’-তে আকছারই পরিবর্তিত হয়, যেমন ‘ফিতে’ ‘জুতো’– এর কোনও পাকা নিয়ম নেই। আরবি বা ফার্সি শব্দের একবচন এবং বহুবচন পাশাপাশি বসিয়ে আমরা অনেক সময় বাংলায় কালেকটিভ নাউন তৈরি করি– যেমন ‘আমির-ওমরাহ’ অর্থাৎ’ আমির সম্প্রদায়’ কিংবা ‘গরিব-গুরবো’ ‘দীনসম্প্রদায়’ ‘দীনজন’। তা সে যাই হোক, ‘ওমরাহ’ কথাটা বরহক বহুবচনেই আছে। কাজেই যে রকম আপনি ‘আমির সম্প্রদায় নন’ ব্যাকরণে ভুল, ‘তুমি ওমরাহ নও’ ভুল।

(ঠিক সেইরকম ‘আলিম’ পণ্ডিতের বহুবচন ‘উলেমা’– জমিয়া-ই-উলাম-ই-হিন্দ; অনেকেই না জেনে ইংরেজিতে লেখেন ulemas)

কাজেই প্রথম চোরাবালি শব্দ নিয়ে। ঠিক ঠিক অর্থ না জানলে আমাদের মতো অপণ্ডিত জন খায় মার। ঠিক সেইরকম গুপ্তযুগের উপন্যাস লিখতে গিয়ে না ভেবে ফুটিয়ে দিলুম রজনীগন্ধা, কৃষ্ণচূড়া– শব্দ দুটো থেকে বিশেষ করে যখন সংস্কৃতের সুগন্ধ বেরিয়েছে– অথচ দুটো ফুলই এদেশে এসেছে অতি হাল আমলে। এবং শুধু শব্দার্থ জানলেই হল না– রূঢ়ার্থে তার ব্যবহার জানতে হয়। তসবি(১)-খানা কথাটির দুটো শব্দ আমরা চিনি–যে ঘরে বসে বাদশা তসবিমালা জপ করেন। মোগল আমলে কিন্তু ওই ঘর ছিল অতিশয় গোপন (top secret) মন্ত্রণালয়।

কেউ যদি লেখেন ‘অতঃপর সম্রাট ঔরঙ্গজেব সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্ত রাত কুরান শরীফ ঘেঁটেও কোনও হদীস পেলেন না’, তবে বাঙালি পাঠক এ-বাক্যে কোনও দোষ পাবেন না। কারণ হদীস বা হদিশ বলতে বাঙালি পাঠক প্রিন্সিডেন্স বা পূর্ব উদাহরণ বোঝে। আমি কুরানে হদীস খোঁজা আর বেদে মনুসংহিতা খোঁজা একই রকমের ভুল। কুরানে আছে পয়গম্বরের কাছে প্রেরিত ঐশী বাণী–আপ্তবাক্য। আর হদীসে আছে পয়গম্বর কীভাবে জীবনযাপন করতেন, কাকে কখন কী করতে আদেশ বা উপদেশ দিয়েছিলেন ইত্যাদি (এগুলোও অতিশয় মূল্যবান কিন্তু আপ্তবাক্য নয়)। কাজেই এগুলোর (হদীসের সন্ধান কুরানে পাওয়া যাবে কী করে? বস্তুত কোনও অর্বাচীন সমস্যা ও তার সমাধান কুরানে না পেলে আমরা হদীসে (শাস্ত্রে ‘স্মৃতি’র সঙ্গে তুলনীয়) যাই। যেখানে না পেলে ইজমাতে এবং সর্বশেষে কিয়াসে। কিন্তু শেষের দুটো স্মৃতিশাস্ত্রের গভীরে ঐতিহাসিক উপন্যাসে প্রতিবিম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যল্প। তা সে যাই হোক, মুসলমান ধর্ম সম্বন্ধে যে কিছুটা জ্ঞান বাঞ্ছনীয় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন, মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে পরিচয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসে সেটা প্রধানত বিস্ময়বোধক বাক্যে। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, ফরাসি উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদে ‘মঁ দিয়ো’ ‘পার ব্ল্য’, ‘ভাঁত্র ব্ল্য’-গুলো ইংরেজ ফরাসিতেই রেখে দেয়; জর্মন উপন্যাসের অনুবাদে ‘মাইন গট’ ‘হ্যার গট’ ‘ডনার ভেটার’ মূলের মতো রেখে দেয়; এগুলোর অনুবাদ সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। অবশ্য স্মরণ রাখা উচিত, মঁ দিয়ো, মাইন গট এবং মাই গড একই জিনিস, একই বাক্য হলেও ইংরেজের পক্ষে মাই গড’ বলা নিন্দনীয়; নিতান্ত বিপাকে না পড়লে ইংরেজ ‘মাই গড’ বলে না। পক্ষান্তরে ফরাসি জর্মন কথায় কথায় ‘মঁ দিয়ো’ ‘মাইন গট’ বলে থাকে। তাই ইংরেজি অনুবাদের সময় মূলের আবহাওয়া রাখবার জন্য অনুবাদক এগুলো অনুবাদ করেন না।

আলহামদুলিল্লা, ইয়া আল্লা, তওবা তওবা, বিসমিল্লা এগুলো অবস্থাভেদে ব্যবহৃত হয়। আপনার ছেলে এম-এ পাস করেছে? তওবা তওবা!’ (বা তোবা তোবা!) বললে যে ভুল হয় সেটা সাধারণ জনও বোঝে। তাই এসব বাক্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে অনেকটা কারও প্রথম বংশধর জন্মালে আপনি যদি উচ্চকণ্ঠে বল হরি, হরিবোল’ বলে ওঠেন তা হলে যেরকম হয়! এসব ভুলে সাধারণ সামাজিক উপন্যাস পাঠক শুধু একটুখানি মুচকি হাসে, কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাস যিনি লেখেন তার কাছ থেকে পাঠক একটু বেশি প্রত্যাশা করে।

‘শার্ঙ্গদেবে’র মতো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গভীরে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরাই জানেন, পাঠান-মোগল যুগের সঙ্গীত তথা এদের আগমনের পূর্বে ভারতীয় সঙ্গীতের প্রকৃত স্বরূপ কী ছিল; এ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের কতখানি ফার্সি ভাষার সঙ্গে পরিচিত হবার। প্রয়োজন। ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিকের অতখানি ফার্সি জানার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তিনি যদি রানি রিজিয়ার দরবারে সেতার বাজাতে আরম্ভ করেন তবে বোধ হয় সঙ্গীতজ্ঞদের অনেকেই আপত্তি জানাবেন। আমি বিশেষজ্ঞ নই, তাই পণ্ডিতেরা যখন কিছু বলেন তখন সেটা মনে রাখবার চেষ্টা করি। মৌলানা আজাদ আমাকে বলেন, ‘সেতার তৈরি করেন আমির খুসরো। এটা বীণার অনুকরণে তৈরি, কিন্তু বীণার চেয়ে সহজ।’

আমি উত্তরে বললুম, ‘আমি আরেক পণ্ডিতের কাছে শুনেছি বাদ্যযন্ত্র-নির্মাতার পক্ষে সেতার-নির্মাণ বীণার চেয়ে কঠিনতর। কিন্তু বাজানেওয়ালার পক্ষে সেতার বাজানো সহজতর। ওই পণ্ডিত আমাকে বলেন, ‘অনেক সময় যে জটিল বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ করা হয় সেটা বাজানেওলার পক্ষে বাজানো সহজ করে দেবার জন্য”।’ (শার্ঙ্গদেব হয়তো খাঁটি খবর রাখেন।)

এসব ঝামেলার মাঝখানে পাঠান বা মোগল দরবারের গানের মজলিস বর্ণনা করা যে বিপদসঙ্কুল, সে কথা পাঠকমাত্রেই বুঝতে পারবেন।

ঠিক তেমনি মোগল আমলের ফিস্টির বর্ণনা। কোরমা, কালিমা, কোফতা, কবাব (শিক্ কবাব প্রাক-মুসলিম যুগেও ছিল–শূল্যপক্ব মাংস– কিন্তু সেটা আঁকাবাঁকা শিকের ভেতর ঢুকিয়ে করা হত, না শূলের ডগায় ঝুলিয়ে ঝলসানো হত, তা জানিনে) যে সব কটাই যাবনিক খাদ্য তা জানি, কিন্তু মোগল ফিস্টিতে বাঁধাকপির পাতার ভিতর কিমা দিয়ে যে দোলমা তৈরি হয়, সেটা কি চলবে? কপি-জাতীয় জিনিস এদেশে এল কবে? এমনকি যে সিম জিনিসটা ঘরোয়া বলে মনে হয় সে সম্বন্ধেও একখানি চিরকুটে দেখি ঋষিতুল্য দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রীকে শুধোচ্ছেন, ‘সংস্কৃতে আপনি সিম জিনিসটার উল্লেখ পেয়েছেন কি?’

মোগল ছবিতে তাদের জামাকাপড় গয়নাগাঁটি পরিষ্কার দেখতে পাই। কিন্তু সব কটার নাম তো জানিনে। মা-দুর্গার নাকের নথ দেখে দ্বিজেন্দ্রনাথ চিত্রকরকে শুধান, ‘নথ কি মুসলমান আগমনের পূর্বে ছিল?’

কিন্তু আপত্তি কী? গদাযুদ্ধে নামার সময় ভীমের পকেটে যদি ফাউন্টেনপেন দেখা যায়, তবে কী আপত্তি! জেরুজালেমের এক মেরি মূর্তির বাঁ-কব্জিতে দেখি ছোট্ট দামি একটি রিস্টওয়াচ! ভক্তের চোখে মা-মেরির বাঁ-হাতখানা বড্ড ন্যাড়া ন্যাড়া দেখাচ্ছিল, তাই। জানিনে, বারোয়ারি দুর্গাপুজোয় মা-দুর্গা নাইলন পরতে আরম্ভ করেছেন কি না!

———-

(১) কত না হস্ত চুমিলাম আমি
তসবিমালার মত,
কেউ খুলিল না কিস্মতে ছিল
আমার গ্রন্থি যত!

 অর্থাৎ তসবিমালা জপ করে এক সাধু অন্য সাধুর হাতে তুলে দেন, কিন্তু কেউই দয়া করে মালার সুতোটি কেটে মুক্তোগুলোকে মুক্তি দেন না।

সকল অধ্যায়

১. ঐতিহাসিক উপন্যাস
২. কচ্ছের রান
৩. দর্শনাতীত
৪. মা-মেরির রিস্টওয়াচ
৫. অনুবাদ সাহিত্য
৬. বাবুর শাহ
৭. ফের্ডিনান্ট জাওয়ারব্রুখ
৮. হিডজিভাই পি মরিস
৯. ‘আধুনিক’ কবিতা
১০. মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা পণ্ডিতের নিদ্রা শ্রেয়ঃ
১১. আলবের্ট শ্বোয়াইৎসার
১২. মরহুম ওস্তাদ ফৈয়াজ খান
১৩. পঞ্চাশ বছর ধরে করেছি সাধনা
১৪. ইন্টারভ্যু
১৫. অর্থং অর্থং
১৬. অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায় মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবার পায়
১৭. সাবিত্রী
১৮. আধুনিকা
১৯. ফরাইজ
২০. চোখের জলের লেখক
২১. ছাত্র বনাম পুলিশ
২২. রাসপুতিন
২৩. বিষ্ণুশর্মা
২৪. বার্লাম ও য়োসাফট
২৫. রবি-মোহন-এনড্রুজ
২৬. এমেচার ভার্সস স্পেশালিস্ট
২৭. মিজোর হেপাজতি
২৮. গাড়োলস্য গাড়োল
২৯. ভাষা
৩০. কবিগুরু ও নন্দলাল
৩১. খেলেন দই রমাকান্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন