কবিগুরু ও নন্দলাল

সৈয়দ মুজতবা আলী

কবিগুরু ও নন্দলাল

রসাচার্য নন্দলাল বসুর জীবন এমনই বহু বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, তিনি এতই নব নব অভিযানে বেরিয়েছেন যে তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়া অতি কঠিন, শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। তদুপরি তিনি যে পরিচয় দিতে দিতে যাবেন তাঁর সর্বরসসৃষ্টিতে অপর্যাপ্ত কৌতূহল ও সে রস আস্বাদ করার মতো অপ্রচুর স্পর্শকাতরতা থাকার একান্ত, অত্যন্ত প্রয়োজন। মানবসমাজে নন্দলাল ছিলেন স্বল্পভাষী তথা আত্মগোপনপ্রয়াসী– তার নীরবতার বর্ম ভেদ করে তাঁকে সর্বজন সম্মুখে প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা, সে প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় শৈলী ও ভাষার ওপর অধিকার এ-যুগে অত্যল্প আলঙ্কারিকেরই আছে। আমাদের নেই; আমরা সে দুঃসাহস করিনে।

আমরা তাঁকে চিনেছি, গুরুরূপে, রসসৃষ্টির জগতে বহু বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সতত রত স্রষ্টারূপে এবং কবিগুরুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিষ্য ও কর্মীরূপে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বভারতীতে প্রধানত পণ্ডিতদেরই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন– আচার্য বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন, অ্যানড্রুজ, কলিন্স, শ্যামের রাজগুরু, উইনটারনিস, লেভি, গোস্বামী নিত্যানন্দ, জগদানন্দ ইত্যাদিকে। এঁদের কেউই রসস্রষ্টা ছিলেন না, এমনকি যে দিনেন্দ্রনাথ সঙ্গীতে, কাব্যে অসাধারণ সৃজনশক্তি ধরতেন তিনি পর্যন্ত তাঁর নিজস্ব সৃজনশক্তির দ্বার রুদ্ধ করে সব ক্ষমতা নিয়োজিত করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মে। একমাত্র নন্দলালই এই পরিপূর্ণ পাণ্ডিত্যময় বাতাবরণের মাঝখানে অপ্রমত্ত চিত্তের আপন সৃষ্টিকর্মে নিয়োজিত ছিলেন।

রবি-নন্দ সম্মেলন যে মণিকাঞ্চন সংযোগ। এ তত্ত্ব অনস্বীকার্য যে রস কী, চিত্রে প্রাচীগাত্রে তথা দৃশ্যমান কলার অন্যান্য মাধ্যমে তাকে কী প্রকারে মৃন্ময় করা যায় এ-সম্বন্ধে নন্দলাল তাঁর গুরু অবনীন্দ্রনাথের কাছে উৎকৃষ্টতম শিক্ষাদীক্ষা লাভ করেন। তাই নন্দলাল শান্তিনিকেতনে আগমন করার পূর্বেই বঙ্গদেশ তথা ভারতে সুপরিচিত ছিলেন ও পশ্চিমের বহু সদাজাগ্রত রসিকজনের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু কবিগুরুর নিত্যালাপী সখা, সহকর্মী ও শিষ্যরূপে শান্তিনিকেতনে আসন গ্রহণ করার পর তাঁর চিন্ময়ভুবন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধতর হতে লাগল ও রবীন্দ্রাহত পণ্ডিতমণ্ডলীর সংস্পর্শে এসে তিনি এমন সব বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হলেন যেগুলো সচরাচর আর্টিস্টকে আকৃষ্ট করে না। একটি মাত্র উদাহরণ নিবেদন করি; দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা সম্বন্ধে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন, বিশ্বভারতীর সাহিত্যসভায় তথা অন্যান্য জ্ঞানচক্রে শতাধিকবার আলোচনা করেছেন, তর্কবিতর্ক উদ্বুদ্ধ করেছেন। ১৯২১ থেকে পূর্ণ কুড়িটি বৎসর এসব সম্মেলনে নন্দলাল উপস্থিত থাকতেন, কিন্তু আমি তাঁকে কখনও (১৯২১-২৬) এ সবেতে অংশগ্রহণ করতে দেখিনি।

অথচ ১৯৩৬/৩৭-এ বরোদার মহারাজা যখন তাকে সেখানকার কীর্তি-মন্দিরে দেয়ালছবি (মরাল) আঁকতে অনুরোধ করেন তখন তিনি চার দেয়ালে এঁকে দিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা।১. ‘গঙ্গাবতরণ’ (গঙ্গা বিনা যে ভারতে আর্যসভ্যতার পত্তন ও বিকাশ হত না সে কথা বলাই বাহুল্য), ২. ‘কুরুক্ষেত্র’ ৩. ‘নটীর পূজা’, ৪. ‘মীরাবাঈ’ (সন্তন সঙ্গ বৈঠ বৈঠ লোক লাজ খোঈ– চিত্রে) আর্য, হিন্দু, বৌদ্ধ, মধ্যযুগীয় ভক্তি– এই চার দৃষ্টিবিন্দু থেকে নন্দলাল দেখেছেন ভারতের সমগ্র ইতিহাস।

কিন্তু এহ বাহ্য। আসলে যদ্যপি চিত্রের মাধ্যমে রসসৃষ্টি সম্বন্ধে নন্দলাল পরিপূর্ণ শিক্ষাদীক্ষা শুরু অবনীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, সে রস কাব্যে, সঙ্গীতে, নৃত্যে কীভাবে প্রকাশ পায় সেটি তিনি দেখতে পেলেন দিনের পর দিন, বহু বৎসর ধরে শান্তিনিকেতনে। রসের প্রকাশে কোন কলার অধিকার কতখানি নন্দলাল সে সম্বন্ধে পরিপূর্ণ মাত্রায় সচেতন হলেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে। কারণ রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত আলঙ্কারিকের (নন্দনতত্ত্বজ্ঞের) ন্যায় রস নিয়ে আলোচনা করার সময় নিজেকে সাহিত্য, সঙ্গীত বা নাট্যরসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন না। স্বনামধন্যা স্টেলা কামরিশের সঙ্গে তিনি দিনের পর দিন রস নিয়ে যে আলোচনা (হোয়াট ইজ আর্ট) করেন তাতে টলস্টয়ের অলঙ্কারশাস্ত্রও বাদ পড়ত না এবং তিনি বেটোফনের ক্রয়েৎসার সনাটা’র বিরুদ্ধে যে মন্তব্য প্রকাশ করেন সেটিও উভয়ের মধ্যে আলোচিত হত। এসব আলোচনা সাধারণত হত বিশ্বভারতীর সাহিত্যসভায়– এবং নন্দলাল সে স্থলে নিত্য-নীরব শ্রোতা। সে সময় নন্দলালের চিন্তাকুটিল ললাটের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেই স্পষ্ট বোঝা যেত, আর্ট সম্বন্ধে তাঁর যা ধারণা, অভিজ্ঞতা, তাঁর যা আদর্শ সেগুলোর সঙ্গে তিনি এ-সব আলোচনার মূল সিদ্ধান্ত, মীমাংসাহীন জল্পনা-কল্পনা সবকিছু মিলিয়ে দেখছেন।

স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, নৃত্য যতখানি গতিশীল (ডাইনামিক) চিত্র ততখানি হতে পারে না। পক্ষান্তরে নটনটী রঙ্গমঞ্চ থেকে অন্তর্ধান করার সঙ্গে সঙ্গেই তার ভানুমতী থেকে যায় শুধু স্মৃতিতে– বাস্তবে সে অবলুপ্ত। কিন্তু চিত্র চোখের সামনে থাকে যুগ যুগ ধরে এবং চিত্রের মতো চিত্র হলে প্রতিবারেই যে তার থেকে আনন্দ পাই তাই নয়, প্রতিবারেই সেই প্রাচীন চিত্রে নব নব জিনিস আবিষ্কার করি, নিত্য নিত্য নবীন রসের সন্ধান পাই। তাই কোনও নৃত্য-দৃশ্য যদি চিত্রে সার্থকরূপে পরিস্ফুট করা যায়, তবে মঞ্চ থেকে অন্তর্ধান করার সঙ্গে সঙ্গে যে-চিত্রের চিরতরে অবলুপ্ত হওয়ার কথা ছিল, সে হয়ে যায় অজর অমর। কিন্তু চিত্রে সার্থকরূপে পরিস্ফুট করার অর্থ, সে যেন ফটোগ্রাফ না হয় তা হলে মনে হবে, নর্তক-নর্তকী নৃত্যকলা প্রকাশ করার সময় হঠাৎ যেন মুহূর্তের তরে পাষাণ-পুত্তলিকায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। যাঁরাই নন্দলালের ‘নটীর পূজা’ চিত্রটি প্রাচীরগাত্রে দেখেছেন, তারাই আমার সামান্য বক্তব্যটি সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন। সে চিত্র তো স্টাটিক নয়, স্তম্ভিত’ নয়–বস্তুত তার দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, এই বুঝি নটী আরেকখানি অলঙ্কার গাত্র থেকে উন্মোচন করে দর্শকের দিকে, আপনারই দিকে অবহেলে উৎক্ষেপ করবে, এই বুঝি মৃদঙ্গে ভিন্ন তাল ভিন্ন লয়ের ইঙ্গিত ভেসে উঠবে আর সঙ্গে সঙ্গে নটী তার নৃত্য দ্রুততর করে দেবে, লাস্য-নৃত্য তাণ্ডবে পরিণত হবে, মন্দমন্থর ‘নমো হে নমো’ অকস্মাৎ অতিশয় দ্রুত ‘পদযুগ ঘিরে’ চন্দ্রভানুর মদমত্ত নৃত্যে নবীন বেশ গ্রহণ করবে।

বস্তুত আপন মনে তখন প্রশ্ন জাগবে, নন্দলাল মঞ্চে বিভাসিত যে নৃত্য স্বচক্ষে দেখেছিলেন, সে-নৃত্য কি সত্যই এতখানি প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বসিত শান্ত থেকে মন্থর, মন্থর থেকে উন্মত্ত পাবন বেগে ধাবিত ছিল, না তিনি অঙ্কন করেছেন তাঁর নিজস্ব কল্পলোকের মৃন্ময় নৃত্যের আদর্শ প্রকাশ।

***

সুন্দরের পরিপূর্ণ আনন্দ-রূপের ধ্যানের বীজমন্ত্র নন্দলাল গ্রহণ করেন কবিগুরুর কাছ থেকে। এবং তার সর্বোচ্চ বিকাশে সে বীজের যেন কোনও চিহ্নই নেই। সে যেন পত্রপুষ্পে বিকশিত মহীরুহ।

এবং একমাত্র নন্দলালই তাঁর গুরুর ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সকলেই জানেন, পরিপূর্ণ বৃদ্ধ বয়সে কবি রবীন্দ্রনাথ চিত্রের মাধ্যমে আপন সৃজনী-শক্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু কবির প্রভাবে ছবির নন্দলাল তো কখনও কবিতা রচনা করেননি।
১৪।৫।৬৬

সকল অধ্যায়

১. ঐতিহাসিক উপন্যাস
২. কচ্ছের রান
৩. দর্শনাতীত
৪. মা-মেরির রিস্টওয়াচ
৫. অনুবাদ সাহিত্য
৬. বাবুর শাহ
৭. ফের্ডিনান্ট জাওয়ারব্রুখ
৮. হিডজিভাই পি মরিস
৯. ‘আধুনিক’ কবিতা
১০. মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা পণ্ডিতের নিদ্রা শ্রেয়ঃ
১১. আলবের্ট শ্বোয়াইৎসার
১২. মরহুম ওস্তাদ ফৈয়াজ খান
১৩. পঞ্চাশ বছর ধরে করেছি সাধনা
১৪. ইন্টারভ্যু
১৫. অর্থং অর্থং
১৬. অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায় মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবার পায়
১৭. সাবিত্রী
১৮. আধুনিকা
১৯. ফরাইজ
২০. চোখের জলের লেখক
২১. ছাত্র বনাম পুলিশ
২২. রাসপুতিন
২৩. বিষ্ণুশর্মা
২৪. বার্লাম ও য়োসাফট
২৫. রবি-মোহন-এনড্রুজ
২৬. এমেচার ভার্সস স্পেশালিস্ট
২৭. মিজোর হেপাজতি
২৮. গাড়োলস্য গাড়োল
২৯. ভাষা
৩০. কবিগুরু ও নন্দলাল
৩১. খেলেন দই রমাকান্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন