বিষ্ণুশর্মা

সৈয়দ মুজতবা আলী

বিষ্ণুশর্মা

মিশরের পসারি–গন্ধবণিক– যেরকম ভারতের শঙ্খচূর্ণ(১) এবং অগুরু আতর বিক্রি করে, ঠিক তেমনি কাইরোর পুস্তক-বিক্রেতা বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্র’ ও বুদ্ধজীবনী বিক্রি করে। কিন্তু সে ‘বুদ্ধজীবনী’ কে লিখেছেন, কেউ জানে না।

অবশ্য পঞ্চতন্ত্র সেখানে অন্য নামে পরিচিত। আরবিতে বলে ‘কলীলা ওয়া(২) দিমনা’। এ দুটি–কলীলা ও দিমনা– দুই শৃগালের নাম। সংস্কৃতে করকট ও দমনক। কোনও কোনও পণ্ডিত বলেন, গোড়াতে পঞ্চতন্ত্রের ওই নামই ছিল। পরবর্তী যুগে ওটিকে পাঁচভাগে বিভক্ত করে পঞ্চতন্ত্র নাম দেওয়া হয়। পাঁচ সংখ্যায় কেমন যেন একটা ম্যাজিক আছে কিংবা চোখের সামনে আপন হাতের পাঁচটা আঙুল যেন কোনও ইতস্তত প্রক্ষিপ্ত তথ্য, গল্প, প্রবাদ-সমষ্টিকে পচের কোটায় ফেলতে চায়। বাইবেলের ‘প্রাচীন নিয়মে’ (ওল্ড টেস্টামেন্ট) হয়তো সেই কারণেই ‘পেন্টাটিয়েশ’= পঞ্চগ্রন্থ আছে। ইদানীং আমরা পাঁচ-শালার পরিকল্পনা করি।

তা সে যাই হোক, আমাদের এই তৃতীয়/দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত পঞ্চতন্ত্র ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রাচীন ইরানে পেলেভি (সংস্কৃতে পহলভি) ভাষাতে অনূদিত হয়। তার একটা বাইরের কারণও ছিল। প্রাচীন ইরানের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিস-রোমের সম্পর্ক বহুকালের। কখনও যুদ্ধের মারফতে, কখনও শান্তির। শান্তির সময় উভয়ে একে অন্যের ওপর সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু দ্বিতীয়/তৃতীয় শতাব্দীতে ইরানিরা গ্রিসের ওপর বিরক্ত হয়ে (ফেড় অপ) পুবের দিকে মুখ ফেরালে। ফলে ষষ্ঠ শতাব্দীতে পঞ্চতন্ত্র রাজা খুসরৌ অনুশিরওয়ানের(৩) আমলে পহলভিতে এবং অল্পকালের ভিতরই পহলভি থেকে সিরিয়াকে অনূদিত হল।

এই প্রথম– সর্বপ্রথম কি না বলা কঠিন– একখানা আর্যভাষায় লিখিত পুস্তক আর্যেতর ভাষায় অনূদিত হল(৪), কারণ সিরিয়াক ভাষা হিব্রু, আরাময়িক ও আরবির মত সেমিতি ভাষা। ইরাক সিরিয়া অঞ্চলে প্রচলিত এই সিরিয়াক ভাষা ও সাহিত্য (৩য় থেকে ১৪ শতাব্দী পর্যন্ত এর আয়ু) বরাবরই ইরানের সঙ্গে লেনদেন রাখত বলে পলভিতে কোনও উত্তম গ্রন্থ অনূদিত হলে সেটি সিরিয়াকেও অনূদিত হত। (পঞ্চতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে আরেকখানি ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাংশ পহলভি হয়ে সিরিয়াকে অনূদিত হয়, এর পরবর্তী যুগে মধ্যপ্রাচ্য ও ইয়োরোপে পঞ্চতন্ত্রের চেয়ে ঢের বেশি সম্মান পায় তার কথা পরে হবে।)

বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্রের কপাল ভালো। পহলভিতে যিনি এ পুস্তক অনুবাদ করেন তিনি ছিলেন রাজ-বৈদ্য, অতএব সুপণ্ডিত। সিরিয়াকে যিনি তস্যানুবাদ করেন তিনিও জ্ঞানীজন, কারণ এ-গ্রন্থ অনুবাদ করার পূর্বেই তিনি কিয়ৎপরিমাণ গ্রিক দর্শন ও কৃতিত্বসহ সিরিয়াকে অনুবাদ করেছিলেন।

পহলভি অনুবাদটি লোপ পেয়েছে। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীতে অনূদিত সিরিয়াকে অনুবাদটি (“কলিলগ ও দমনগ”) এখনও পাওয়া যায়।

এর প্রায় দু শো বৎসর পর মোটামুটি হজরৎ মুহম্মদের জন্মের দেড়শো বৎসর পর জনৈক আরব আলঙ্কারিক পঞ্চতন্ত্র আরবিতে অনুবাদ করেন। আরবি সাহিত্যের তখন কৈশোরকাল। এই পুস্তক অনুবাদ করার সময় অনুবাদক আব্দুল্লা ইবন্ অল্-মুকাফফার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তরুণ আরব সাহিত্যিকদের শৈলী বা স্টাইল শেখানো বিশেষ করে যারা ‘ব্যাল-ল্যাৎর’, রম্যরচনায় হাত পাকাতে চান।(৫) পহলভি সিরিয়াক হয়ে আরবিতে পৌঁছতে গিয়ে বিষ্ণুশর্মা নামটি কিন্তু এমনিই রূপান্তরিত হয়ে যায় যে আরবরা ভাবে, ইনি বিদ্যাপতি, এবং সেই অনুসারে তাঁর নাম লেখা হয় বীদবা বীদপা বীদপাই (আরবিতে ‘প’ অক্ষর নেই, কিন্তু মাঝে মাঝে কাছাকাছি অন্য দুই অক্ষর দিয়ে ‘প’ ও ‘চ’ বোঝাবার চেষ্টা করা হয়)। আরবি অনুবাদ হয় অষ্টম শতাব্দীতে এবং তার হিব্রু অনুবাদ দ্বাদশ শতকে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জনৈক ক্যাথলিক কার্ডিনালের জন্য এটি লাতিনে ডিরেক্টরিয়ুম ভিট্যে হুমান্যে’ (অর্থাৎ মোটামুটি ‘মানবজীবনের জন্য হিতোপদেশ’–‘পঞ্চতন্ত্র’ ও ‘হিতোপদেশ’ যে সংশ্লিষ্ট সে-কথা মধ্যপ্রাচ্যে জানা ছিল) নাম নিয়ে ইয়োরোপে প্রচারিত হয়, এবং এই অনুবাদের ওপর নির্ভর করে পরবর্তীকালে ইয়োরোপের প্রায় তাবৎ অর্বাচীন ভাষাতে ‘বীদপাই-এর নীতিগল্প’ বা ‘কলীলা ও দিমনা’ রূপে অনূদিত হয়ে প্রখ্যাতি লাভ করে।

‘জাতক’, ‘পঞ্চতন্ত্র, ‘হিতোপদেশে’র বিজয়যাত্রা সম্বন্ধে মৌলিক গবেষণা করেছেন স্বর্গত ঈশান ঘোষ। তাঁর অতুলনীয় জাতক অনুবাদের ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘পঞ্চতন্ত্রের কথাগুলি পৃথকভাবে কথিত নহে। এক একটি তন্ত্রে এক একটি কথাকে কেন্দ্রীভূত করিয়া তাহার আশেপাশে অন্য বহু কথা সংযোজিত হইয়াছে। উত্তরকালে অস্মদ্দেশে বেতাল পঞ্চবিংশতি ও হিতোপদেশ প্রভৃতি আরবে নৈশোপাখ্যানমালা এবং য়ুরোপে Decameron, Pentameron, Heptameron, Canterbury Tales প্রভৃতি গ্রন্থের রচনাতেই এই পদ্ধতি অনুসৃত হইয়াছে। পঞ্চতন্ত্রের কথাগুলি উক্তরূপে একসূত্রে নিবদ্ধ না থাকিলে বোধ হয় দেশদেশান্তরে ভ্রমণের সময় ছত্রভঙ্গ হইয়া যাইত।’ এ অনুচ্ছেদ ঈশান ঘোষ শেষ করেছেন এই বলে—‘হিন্দুই হউন, বৌদ্ধই হউন, পঞ্চতন্ত্রকার অতি শুভক্ষণে লেখনী ধারণ করিয়াছিলেন। লোকমুখে বা গ্রন্থাকারে তাঁহার কথাগুলি সভ্য অসভ্য সর্ব দেশে যেরূপভাবে পরিজ্ঞাত হইয়াছে, পৃথিবীতে অন্য কোনও পুস্তকের ভাগ্যে সেরূপ ঘটে নাই।(৬)’

অজহর বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে যে পুস্তক-বিক্রেতা আমাকে ‘কলীলা ওয়া দিমনা’ বিক্রি করে, সে ইঙ্গিত দেয়, আরেকখানি ভারতীয় পুস্তক কপ্ট খ্রিস্টানরা (এঁরা নিজেদের ফারাওয়ের বংশধর বলে দাবি করে। কিছুদিন পূর্বে আরবিতে পুনঃপ্রকাশ করেছেন।

তখন কপ্ট বন্ধুদের কাছে অনুসন্ধান করে জানতে পারি, এর আরবি নাম ‘সুৎরহ বার্লাম ওয়া য়ুআসফ’ এ পুস্তকের প্রধান নায়ক দু জন খ্রিস্টধর্মে সেন্টরূপে স্বীকৃত হয়েছেন ক্যাথলিক উভয়কে স্মরণ করেন ২৭ নভেম্বর ও য়ুআসফকে গ্রিক চার্চ স্মরণ করেন অগস্ট (সেন্টস্ ডে)।

তখন অনুসন্ধান করে দেখি, ‘য়ুআসফ’ নাম এসেছে ‘বোধিসত্ত্ব’ থেকে ও ‘বার্লাম’ এসেছে ‘বুদ্ধ ভগবান’-এর ‘ভগবান্’ থেকে!

এ পুস্তকের কাহিনী পঞ্চতন্ত্রের চেয়েও বিস্ময়জনক–
২/8/৬৬

———-

১. এই শঙ্খচূর্ণ নিয়ে কয়েক বৎসর পূর্বে এদেশে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যায়। যেসব শাঁখারি পূর্ববাংলা থেকে এসে পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নিয়েছে তাদের দরকার শখের। শঙ্খ প্রধানত বিক্রি হয় মাদ্রাজ অঞ্চলে এবং তার অন্যান্য খরিদ্দার আরব দেশ, মিশর ইত্যাদি। তারা শাঁখ গুঁড়ো করে ওষুধ বানায়। আমাদের গরিব শাঁখারিরা যে দাম দিতে প্রস্তুত ছিল (সোজাসুজি, না পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মারফৎ, আমার ঠিক মনে নেই) আরবরা তার কিঞ্চিৎ বেশি দাম দিতে রাজি ছিল বলে মাদ্রাজ তাবৎ শঙ্খ বিক্রি করে দেয় ওদের। ফলে বহু শাঁখারি বেকার হয়ে যায়।

২. কোনো কোনো পণ্ডিতের ধারণা আরবির এই ‘ওয়া’= ‘অ্যান্ড’= এবং থেকে বাংলা ‘ও’ এসেছে।

৩. এই খুসরৌর আমলেই চতুরঙ্গ খেলা ভারত থেকে ইরানে যায়।

 ৪. তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে, এই সর্বপ্রথম সেমিত্রি জগতে ভারতীয় সাহিত্য পরিচিত হল। বস্তুত এর অনেক পূর্বেই জাতকের বহু গল্প কাফেলা ক্যারাভান] ও চট্টির কথকদের স্টরি-টেলার] মারফতে গ্রিস রোম পর্যন্ত চলে গিয়েছে। বৌদ্ধ শ্ৰমণরা খ্রিস্ট-জন্মের পূর্বেই মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তারও পূর্বে লোহিত সমুদ্রের কূল ধরে ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, এমনকি প্রাচীনতম মোনজোদড়োর সঙ্গে ইরাকের সম্পর্ক ছিল সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু উপস্থিত এগুলো আমাদের আলোচনার বাইরে। এবং বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রবেশ করলে যেসব গ্রন্থ অনূদিত হয় সে-ও এ আলোচনার বাইরে।

৫. অধীন এই উদ্দেশ্য নিয়েই বছর ষোল পূর্বে পঞ্চতন্ত্র’ সিরিজ ‘দেশ’ পত্রিকায় আরম্ভ করে। নইলে বিষ্ণুশর্মার অনুকরণ করার মতো দম্ভ আমার কখনও ছিল না। এর অল্প পরেই Indian Council for Cultural Relations-এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকাকালীন মরহুম মৌলানা আজাদের নেতৃত্বে আমরা, একখানা আরবি ত্রৈমাসিক (‘সকাফৎ-উল-হিন্দ’ ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’) প্রকাশ করি ও ওই সময় মিশরাদি একাধিক দেশ থেকে অনুরোধ আসে যে, যেহেতু অদ্যকার ‘কলীলা ওয়া দিমনা’ ও ‘পঞ্চতন্ত্রে’ প্রচুর তফাৎ, অতএব আমরা যেন একখানি নতুন অনুবাদ প্রকাশ করি। আমরা সে-কাজ। সানন্দে প্রাগুক্ত পত্রিকায় আরম্ভ করি।

৬. ঈশান ঘোষের বাংলা জাতক কি জর্মন, কি ইংরেজি, কি হিন্দি সব জাতকানুবাদের চেয়ে শতগুণে শ্ৰেষ্ঠ। অসাধারণ পরিশ্রম ও অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ঈশান এই অনুবাদ সম্পন্ন। করে বঙ্গবাসীকে চিরঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। এ অনুবাদ প্রকাশিত হলে পর পালিপাণ্ডিত্যে আরেক ধনুর্ধর বিশ্বভারতীর অধ্যক্ষ বিধুশেখর শাস্ত্রী এর সমালোচনা করেন। পরম লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় ঈশানের অনুবাদ বহু বৎসর পূর্বে নিঃশেষ হওয়া সত্ত্বেও এর পুনর্মুদ্রণ হয়নি। শুনতে পাই, সাহিত্য আকাঁদেমী স্বর্গত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা কোষ পুনর্মুদ্রণ করেছেন। তাঁরা যদি (বিধুশেখরের আলোচনাসহ) এই গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণে সহায়তা করেন তবে গৌড়জন তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।

সকল অধ্যায়

১. ঐতিহাসিক উপন্যাস
২. কচ্ছের রান
৩. দর্শনাতীত
৪. মা-মেরির রিস্টওয়াচ
৫. অনুবাদ সাহিত্য
৬. বাবুর শাহ
৭. ফের্ডিনান্ট জাওয়ারব্রুখ
৮. হিডজিভাই পি মরিস
৯. ‘আধুনিক’ কবিতা
১০. মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা পণ্ডিতের নিদ্রা শ্রেয়ঃ
১১. আলবের্ট শ্বোয়াইৎসার
১২. মরহুম ওস্তাদ ফৈয়াজ খান
১৩. পঞ্চাশ বছর ধরে করেছি সাধনা
১৪. ইন্টারভ্যু
১৫. অর্থং অর্থং
১৬. অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায় মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবার পায়
১৭. সাবিত্রী
১৮. আধুনিকা
১৯. ফরাইজ
২০. চোখের জলের লেখক
২১. ছাত্র বনাম পুলিশ
২২. রাসপুতিন
২৩. বিষ্ণুশর্মা
২৪. বার্লাম ও য়োসাফট
২৫. রবি-মোহন-এনড্রুজ
২৬. এমেচার ভার্সস স্পেশালিস্ট
২৭. মিজোর হেপাজতি
২৮. গাড়োলস্য গাড়োল
২৯. ভাষা
৩০. কবিগুরু ও নন্দলাল
৩১. খেলেন দই রমাকান্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন