ঈশ্বরের বাগান – ৬১

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

।। একষট্টি।

সমসের অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছে না গোপেরবাগের ঝিলটা কোন দিকে পড়বে। সে ঝিলের ভেতর দিয়ে যাবে, না পুবপাড়ার ওপর দিয়ে যাবে ঠিক করতে পারছ না। ঝিলটা পার হলেই টোডার- বাগ, গোপেরবাগ, তারপর সোনালি বালির নদীর চর, ঈশমের তরমুজ খেত। একদা চরে ঈশম নামে এক মানুষ বালির প্রান্তরে বিশাল সব তরমুজ ফলাত। সে নেই। বুড়ো হাজি কবেই মারা গেছেন। জমি পার হলেই গোপাট, গোপাট ধরে সাইকেল চালিয়ে গেলে নরেন দাসের বাড়ি। তারা কেউ নেই। ঠাকুরবাড়ি ঝোপ জঙ্গলে ভর্তি। শুধু পুকুর পাড়ের অর্জুন গাছটা ধীরে ধীরে মহীরুহ হয়ে উঠছে। পরে আম জামরুলের বাগান। সে সাইকেলের গতি খুবই কমিয়ে দিল। খুব ধীরে ধীরে সে যাচ্ছে। এটা তাঁতিপাড়া। এত রাতেও তাঁতের খটখট শব্দ দূর থেকে কানে আসছে। তাঁতিপাড়া পার হলে বাঁশের বন, বন পার হলেই পুবপাড়া এবং হাসান পীরের দরগা। দরগায় ঢুকে গেলে কিছুটা নিশ্চিন্তি কাধের রাইফেলটা যেন না থাকলেই ভাল হত। সে একা মানুষ। এটা দেখলেই লোকের সংশয় বাড়বে। তবে রাত গভীর বলে সে পথে কোনও জনমনিষ্যির সাক্ষাৎ পায় নি। এটা আল্লার দোয়াতেই হয়েছে এমন কেন জানি মনে হল তার।

হাসান পীরের দরগার রাস্তায় সে আবার জোরে সাইকেল চালাতে থাকল। আর পাঁচ সাত মিনিটের রাস্তা। এটুকু পার হয়ে গেলেই মঞ্জুদির সেই সুন্দর ছিমছাম বাড়ি। ঠাকুরবাড়ির সামনে সেই অর্জুন গাছটা পর্যন্ত অন্ধকারে সে চিনতে পারল। এত বড় গাছ এ তল্লাটে একটাই আছে। মঞ্জুদির বাবা এ তল্লাটের ডাকসাইটে কবিরাজ ছিল। একেবারে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। ঠাকুরবাড়ির ঝোপ-জঙ্গল, অর্জুন গাছ সব তার দখলে।

সে ডিসপেনসারির বারান্দায় খুব সন্তর্পণে সাইকেলটা রেখে কপালের ঘাম মুছল। কেউ জেগে নেই। এত রাতে জেগে থাকার কথাও নয়। তবু একসময় জব্বার চাচার হামানদিস্তার শব্দ মধ্য রাত্রেও শোনা যেত। সব বনজ গাছপালা নিয়ে রাত জেগে ওষুধ তৈরী করতেন। এখন দুঃসময় বলে কেউ আর বেশি রাত জাগতে সাহস পায় নি বুঝি। কিন্তু আশ্চর্য এত সন্তর্পণে উঠে আসা সত্ত্বেও মনে হল ডিসপেনসারির ভেতর থেকে কেউ যেন বের হয়ে আসছে। তক্তপোশের পায়া নড়বড়ে হলে যা হয়, কেউ উঠে গেলে মচ মচে শব্দ

ডিসপেনসারিতে জব্বার চাচা সেই আদ্যিকাল থেকে আছে। জব্বার চাচা হলে ভয় নেই। যদি অন্য কেউ হয়—সে তাড়াতাড়ি রাইফেলটা পাশের আস্তাবলে ঢুকিয়ে দিল। অবনীর ঘোড়াটা ঘোত ঘোত করে শব্দ করল দুবার। তারপর চেনা মানুষের গন্ধ পেয়েই কেমন কদম দিতে থাকল। জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আভাবে এমনটা সমসেরের মনে হল। আর তখনই দরজা খোলার শব্দ—ক্যাডা, ক্যাডা, খাড়াইয়া আছ মিঞা। কথা কওনা ক্যান।

সে জানে জব্বার চাচা ভারি নির্ভীক মানুষ। চুরি-চামারি করে লোকটা অনেকদিন জেল খেটেছে। এক সময়কার দাগী আসামী। হারমাদ মানুষ জব্বার চাচা যৌবনে নরেন দাসের বোন মালতীকে নিয়ে কোথায় যেন নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন। সে সব গল্পগাথা কিংবদন্তির সামিল। এহেন দাগী আসামীকে মঞ্জুদির বাবা শেষ বয়সে তার নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এবং এখন এই মানুষটাই মঞ্জুদির সংসারে অভিভাবকের মত। সে খুব সতর্ক গলায় বলল, আমি সমসের। চাচা আমাকে চিনতে পারছেন?

জব্বার চাচার এমনিতেই ঘুম কম। অবনীটা আজকাল না বলে কয়ে কোথায় কোথায় যে চলে যায়! মুজিবের ভক্ত মানুষ হয়ে গেছে অবনী। রেডিওর খবরে কেবল খারাপ খারাপ কথা। মানুষের জানের কোনও দাম নাই। রাতে এ-জন্য এখন আর ঘুমাতেও পারেন না। খড়কুটো উড়ে গেলেও টের পান। ফলে জব্বার চাচা বারান্দায় নেমে বললেন, কি কইলা?

এতক্ষণে মনে হল জব্বার চাচা কানে কম শোনে। সে এবার বেশ জোরে বলল, আমি সমসের।

—তুমি সমসের মিঞা—অবনী ফিরল না ক্যান। রাইত জাইগা পইড়া থাকি। অয় আছে কোনখানে?

—অবনী কাল আসবে।

—তা অহনে কি করতে হইব?

—এখানে আজ থাকব ভাবছি। সকালে মঞ্জুদির সঙ্গে কিছু জরুরী পরামর্শ আছে। আর তখনই মনে হল, যেন লন পার হয়ে লাল ইটের বাড়িটায় আলো জ্বলে উঠছে। এতক্ষণে সমসের বুঝতে পারছে, আসলে ওরা কেউ ঘুমিয়ে নেই। সবাই জেগে আছে। সে জানালায় মঞ্জুদির মুখ দেখতে পেল। মঞ্জুদি বলছে, জব্বার চাচা কার সঙ্গে কথা বলছেন। কে এল!

—অবনী না মা। সমসের মিঞা আইছে।

সমসেরের নাম শুনে মঞ্জুর আতঙ্ক ভাবটা মুহূর্তে কেটে গেল। এদিকটায় খান সেনাদের আনাগোনা খুব বেড়ে গেছে। যেকোন মুহূর্তে সংসারে একটা চরম ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কিন্তু সমসের এত রাতে, কোনও যদি দুঃসংবাদ বয়ে আনে! মঞ্জুর আবার কেমন বিহ্বল ভাবটা বেড়ে যাচ্ছে। সে দরজা খুলে বের হতে পর্যন্ত পারছে না। পায়ে জোর পাচ্ছে না মোটেই।

সমসের লনটা পার হয়ে আসছে। পিছনে জব্বার চাচা। মঞ্জু বারান্দায়। ভেতর দিকে একটা নীলবাতি জ্বলছে। একটা ভারি আশ্চর্য নির্জনতা। এমন কি ঝিঁঝিপোকার ডাকও ক্রমে গভীর হয়ে উঠছে।

সমসের লনটা পার হবার সময় মঞ্জুদিকে দেখল। এমন সুন্দর ছিমছাম যুবতী সে সংসারে খুব কমই দেখেছে। কথা বলে কম। আর সব সময় মুখে তার রহস্যময় হাসি। এই হাসি যে যত দেখেছে, তত অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। মানুষ সম্পর্কে সত্যাসত্য সম্পর্কে মঞ্জুদির হাসি তাকে কেমন পীড়া দেয়। যেমন মঞ্জুদি বলতে চায়, তুমি যা বললে সব ঠিক, আবার তুমি যা বললে সব বেঠিক। অর্থাৎ মঞ্জুদি মানুষের রহস্যময় জীবনধারার সঙ্গে মানুষের ক্রুরতাকেও মিশিয়ে ফেলেছে। কোনও মানুষকে সে সরল সত্য মানুষ বলে ভাবতে পারে না যেন। সে বারান্দায় ততক্ষণে উঠে গেছে। এবং বলছে, তুমি এখনও জেগে আছ?

—ওর তো ফেরার কথা ছিল।

—মনে হয় কাল ফিরবে।

—ওকে কোথায় পাঠিয়েছ?

—একটা পেটি নিয়ে গেছে। মিনু আবুল আমিনুল সঙ্গে আছে।—চাচার ওখানে শুয়ে পড়ছি। তুমি এখন ঘুমাও।

সামান্য আলোতে সমসের দেখল সেই রহস্যময় হাসি মুখে। বড় অস্বস্তি। কেমন গায়ে কাঁটা ফুটে ওঠে।

সমসের বলল, নীলু কেমন আছে?

—ও ভাল নেই। একই রকম।

মঞ্জু দরজা খুলে দিল। আবার বলল, ভিতরে এস। হাত মুখ ধুয়ে নাও। কেয়া, কেয়া!

—এখন কেয়াকে ডাকতে হবে না।

বসার ঘরে সমসের ঢুকেই বলল, আলোটা নিভিয়ে দাও। কোথায় কে ওৎ পেতে আছে।

—কোনও ভয় নেই। চা করছি।

—না মঞ্জুদি এখন এসব হাঙ্গামা করো না।

—আবুল মিনুকে কেন পাঠালে?

—উপায় ছিল না।

—গোপেরবাগে আরও এক কোম্পানি সিপাই আসছে।

—কে বলল?

—ওদের লোক। ওর খোঁজখবর নিতে আসে লোকটা। ওর সঙ্গে খুব ভাব।

—ও সেই লোকটা! রাজাবাজারে না কোথায় বাড়ি ছিল যেন। এখন পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন, না সুবাদার কি যেন।

—সে যাই হোক তুমি ওদের পাঠিয়ে ভাল করনি।

সমসের পাশের একটা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিল। ঘুম নেই বলে চোখ কটকট করছে—কেমন জ্বালা চোখে। বড় গভীর চশমার ভেতর দিয়েও দেখা গেল, সমসেরের চোখ লাল। মঞ্জুও চোখে কম দেখে। ছেলেবেলা থেকেই চোখ খারাপ। ভারি লেন্সের চশমা চোখে থাকে সব সময়। মঞ্জু এই নিশীথেও বুঝতে পারল সমসেরের ওপর দিয়ে খুব ধকল যাচ্ছে। সে বলল, তোমার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে সমসের।

মুখে সামান্য খোঁচা খোঁচা দাড়ি—সমসের হাসল। বলল, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

মঞ্জু পাশের ঘরে গেল। কিছু চিরকুট এনে দিল সমসেরের হাতে। গোপালদি থেকে এই চিরকুটগুলি কামাল পাঠিয়েছে। সে বলল, এসে ভালই করেছ। তোমাদের পরবর্তী একসানের কিছু পরিকল্পনা এগুলিতে লেখা আছে। চিরকুটগুলি পড়লে এমনিতে কিছু বোঝা যাবে না। তাতে কিছু গাছ এবং পাখ পাখালির নাম। এই সব নাম থেকেই সবটা আন্দাজ করে নিতে হবে সমসেরকে।

মঞ্জু বলল, কামাল ওগুলি অবনীর কাছে পাঠিয়েছিল। অবনী বাড়ি না থাকলে আমার হাতে দিতে বলেছে। এখন এগুলি তোমাকে দিলাম। যা হয় করবে।

সমসের একটার পর একটা চিরকুট নিবিষ্ট মনে পড়ল। তারপর জেবের ভেতর পুরে রাখল সব কটা চিরকুট। হাত মুখ ধুলে যদি চোখের জ্বালা ভাবটা কমে —সে বলল, মঞ্জুদি হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ব। ঘুম আসবে না, তবু একটু শুয়ে থাকা দরকার বুঝতে পারছি।

মঞ্জু জব্বার চাচাকে তখন বেশ জোরে হেঁকে বলল, সাইকেলটা তুলে রাখুন চাচা। এ বাড়িতে এখন তিনটে প্রাণী জেগে। কেয়া এবং নীলু ঘোমাচ্ছে। এত বড় একটা বিপর্যয় চলছে, নীলু ঠিক ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। সমসের বলল, চল নীলুকে দেখব।

একটা সাদা চাদরের নিচে নীলু, বাচ্চা একটা ছেলে সেই আদ্যিকাল থেকে বিছানায় শুয়ে আছে। সামনে জানালা—দূরে মাঠ এবং এক নিরন্তর সুষমা রয়েছে এই প্রকৃতির ভিতর। নীলু এই জানালায় দেখতে পায় এক অনন্ত আকাশ এবং শীত গ্রীষ্মের পাখিদের। সে এ-ভাবেই বেঁচে আছে। তাকে দেখার জন্য সমসের ভেতরে ভেতরে কেমন আকুলতা বোধ করল।

মঞ্জু আগে সমসের পেছনে। যেতে যেতে মঞ্জু বলল, আজকের রেডিওর খবর শুনেছ?

—জানি।

সুতরাং মঞ্জু আর বলতে পারল না, সর পালাচ্ছে। সব ওপারে চলে যাচ্ছে।

ওরা হিন্দুস্থানের রেডিও খুললেই এখন সব সত্যি খবর জানতে পারে। ঢাকা থেকে কোনও খবরই দেওয়া হচ্ছে না। যেন দেশটাতে এখনও নিরিবিলি শান্তি বিরাজ করছে। বড় বড় হোমরা চোমরা সব আসছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।

মঞ্জু বলল, মুজিবরের নামে একটা গান বাঁধা হয়েছে। ওটা শুনলে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।

—এখন ওইত সম্বল। এই বলে সে তাকাতেই দেখল— সেই রহস্যময় হাসি। অস্বস্তি। আবার অস্বস্তি জড়িয়ে ধরছে। এবং এ-সব দেখলেই মঞ্জুদির সম্পর্কে কেমন সংশয় জাগে। মঞ্জুদি খানসেনাদের চর নয় তো! কিন্তু মঞ্জুদিকে সে অনেকদিন থেকে জানে—কোন কিছুই ভাল চোখে দেখতে চায় না। জীবনে কোথায় যেন কোনও প্রবল তুষারপাত ঘটেছিল একদা, তার ক্ষত রয়ে গেছে অথবা ভুলতে পারছে না।

.

সমসের তখন দেখল নীলু ঘুমিয়ে আছে। ঠিক মঞ্জুদির মতো চোখ মুখ। মঞ্জুদি লম্বা, ছিমছাম গড়ন, দুধে আলতায় মেশানো রঙ গায়ে। এই পরিবারের সবাই নাকি এমন সুষমার অধিকারী, আর মঞ্জুদির গায়ে রয়েছে এক আশ্চর্য সুঘ্রাণ। অনেকদূর চলে গেলেও সেই ঘ্রাণটা এসে নাকে লাগে। সমসের নীলুকে দেখতে দেখতে আবুলের কথা ভাবল। ওরা কোথায় আছে কে জানে। এই নীলু বেঁচে থেকেও, বেঁচে নেই মত। আর আবুল প্রবল প্রাণবন্ত শিশু। নীলুকে দুহাতে এ-সময় সাপটে ধরতে ইচ্ছে করল সমসেরের। আর তখনই মঞ্জু বলল, এস।

সমসের আবার পিছু পিছু এল। হাত মুখ ধুয়ে ইতিমধ্যে মঞ্জুদি চা করে ফেলেছে স্টোভে। কিছু খাবার। সে বলল, না কিছু খাব না। চাটুকু দাও। তারপর তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ মঞ্জুদির দিকে। চোখের নিচটাতে এমনিতেই মঞ্জুদির কেমন একটা কালো ছায়া বিরাজ করত। এখন যেন সেটা আরও গভীর হয়েছে। সমসের চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, তুমি ভাল নেই মঞ্জুদি। তুমি বরং নীলুকে নিয়ে ওপারে চলে যাও।

—এ কথা কেন? মঞ্জু কেমন সহসা চমকে উঠল।

সমসের বলতে পারল না, দেশে একটা অরাজকতা চলছে। তুমি এত সুন্দর মঞ্জুদি, এ সময় তোমার পার পাওয়া কঠিন। দু-মাইলের মধ্যে পল্টনের সিপাইরা। মেজর ক্যাপ্টেন হাবিলদার সুবাদার তারা ঠিক টের পেয়ে গেছে তুমি এখানে আছ। খান সেনারা সব অমানুষ। সব দানব হয়ে গেছে। চারপাশে যখন আগুন আরও ভয়াবহ রূপ নেবে তুমি যাবেটা কোথায়। তোমাকে কেউ ছেড়ে দেবে না।

মঞ্জু বলল, কী তুমি! এ-কথা বললে কেন বল!

—না বলছিলাম, অনেকেই তো চলে যাচ্ছে। তোমরা যদি যাও তবে কি ক্ষতিটা হবে?

—গেলে আগে যাওয়া উচিত ছিল।

—বুঝতে পারছি তখন গেলে ভাল করতে।

—কিন্তু বাবা যান নি।

—অবনী যেতে পারত।

—সেও গেল না। সে তার নিজের দেশ ছেড়ে যাবে না।

সমসের জবাব দিতে পারল না। বুঝতে পারল এই রমণীর দৃঢ়তার কাছে সে খুবই সামান্য। দেশটা ভাগ হওয়ার পরও দুবার দেশের সর্বত্র দাঙ্গা হয়ে গেছে। দাঙ্গা বলা যায় না, সব এক তরফা। হটাও। এই কাফেরদের হটাও। আগুনে ঘর বাড়ি পুড়ে গেছে মানুষের। সমসের বুঝতে পারত এটা পথ নয়, এটা বিপথ তবু তার রা করার সাহস ছিল না। আদমজী জুট মিলের পাশে দু-চার পাঁচশ হিন্দু পুরুষ রমণীর শরীর শকুনে খেয়েছে। দাঙ্গার মূলে অবশ্য ছিল বিহারী মুসলমানরা কিন্তু একদল মানুষ সুযোগ পেলেই অমানুষ হয়ে উঠতে চায়। নিরীহ মানুষের উপর সে নিজের চোখেই দেখছে তখন কি তাণ্ডব। তার নিজের লোকেরাও এ তাণ্ডবে মেতে উঠেছিল। তখন সমসের অবনী আর মঞ্জুদির আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সমসের কামাল মঞ্জুদির ইজ্জতের জন্য নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে তুলেছিল। এখন এই স্বাধীনতার নামে মুক্তিযুদ্ধে মঞ্জুদির ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসিটা ফুটে উঠতেই পারে। সে ভয়ে যেন আর মঞ্জুদির দিকে তাকাতে পারছে না। তাকালেই মঞ্জুদির ঠোটে সেই ভয়ঙ্কর বিদ্রূপ সে বুঝি দেখতে পাবে।

মঞ্জু দেখল সমসের মাথা নিচু করে বসে আছে। কোন কথা বলছে না। সমসেরের সারা মুখে গভীর বেদনার ছাপ। সে জানে সমসের খুবই আবেগ প্রবণ মানুষ। সমসের ভাল লেখে। ওর লেখাতেও আশ্চর্য আবেগ আর প্যাশান মাখামাখি। ওর গোটা তিনেক গল্পের বই তাকে আছে তার। সমসের দুটো উপন্যাসও লিখেছে। মানুষের সত্যাসত্য খোঁজার এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা আছে ওর লেখাতে। সে বলল, সমসের সাব তুমি আর যাই কর, লেখাটা কিন্তু ছেড়ো না। অনেকদিন কোন লেখা পড়ছি না।

লেখার কথায় সমসের যেন কিছুটা স্বস্তি বোধ করল। আসলে এই রমণী না নারী সে ঠিক বুঝতে পারে না, বয়সে তার অনেক বড়ই হবে। অথচ এই রমণী, না নারী তাকে যখন তুমি তুমি করে বলে তখন তার মনে হয় বড় নিকট আত্মীয়ের কাছে সে বসে আছে। আবার মঞ্জুদি যখন দূরের হয়ে যায় তখন বলবে,আপনি কিন্তু সমসের ভাই আবুল মিনুকে নিয়ে একদিন ঘুরে যাবেন। বাসে উঠলে কতক্ষণ বলুন, ঘণ্টা খানেকও লাগে না।

সমসের গভীর চশমার ভেতর চোখ তুলে বলল, মঞ্জুদি তুমি আমাকে খুব ভালবাস। আমার সব কিছু তোমার ভাল লাগে। কি ছাই লেখা তার এত প্রশংসা আর নাই করলে।

—না না সমসের, তুমি ভুল করছ। আমি কখনও মন রাখার জন্য কথা বলি না। আসল মানুষ নকল মানুষ আমি চিনি। তুমি আসল মানুষের খোঁজে আছ। তুমি আর যাই কর, লেখা কিন্তু ছেড়ো না।

—লেখা ছেড়েই বা করবটা কি।

—মানুষের লোভের তো শেষ নেই। সমসের জানে আজকাল লেখার চেয়ে পলিটিক্যাল গ্লামার বেশি। আমার ভয় এই গ্লামার না তোমাকে পেয়ে বসে।

সমসের বলল, দেশটা স্বাধীন হলে এ-সব ছেড়ে দেব।

আর তখনই সেই রহস্যময় হাসি মঞ্জুদির ঠোঁটে।

আবার অস্বস্তি। কাঁটা ফুটে উঠছে গায়ে। মঞ্জুদিকে দেখলে ভয় হয়। ইচ্ছে হয় জানতে, মঞ্জুদি মানুষের প্রতি তোমার এই অবিশ্বাস কেন! তুমি আসল মানুষের খোঁজ পাবে কি করে। মানুষকে বিশ্বাস না করলে আসল মানুষের খোঁজ পাওয়া যায় না মঞ্জুদি।

মঞ্জু বলল, অনেক রাত হয়েছে। এ নিয়ে তর্ক করলাম না। কিন্তু এখন তোমার বিশ্রামের দরকার সমসের। তুমি যাও, শোওগে। মঞ্জু আর একটা কথা বলল না। সোজা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

সমসের তারপরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। ঘরের আলোটার তেজ নেই। ঘরের দেয়ালে মঞ্জুদির পূর্বপুরুষদের ছবি। মঞ্জুদির বাবার ছবিটার দিকে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মানুষটা ধর্মাধর্মের অসহিষ্ণুতা উপেক্ষা করেও এপারে থেকে গেল। মাটি এবং মানুষের টান ছিল প্রবল। নিজের কথা ভাবেনি। তারপরই মনে হল, না কথাটা ঠিক না। এখানে আবাল্য মানুষটা বড় হয়েছে। এই মাটি এবং গাছপালার টানে শেকড় গেড়ে গেছিল। শেকড় উপড়ে অন্য পারে অনিশ্চিত জীবনে ঝাঁপ দেবার সাহস হয় নি। এই পুরুষমানুষটি একদা এ অঞ্চলে কিংবদন্তির মতো ছিল। মানুষের রোগে জরায় ছিল বড় আশ্রয়। তার মেয়ে মঞ্জুদি। সব আত্মীয়স্বজন গাঁয়ের লোক সোনাবাবুর বাবা জ্যাঠারা ওপারে চলে গেল। অথচ মঞ্জুদি থেকে গেল। অবনী নড়ল না। সমসের জানে এ-জন্য মঞ্জুদিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু এবারে কি হবে, সে জানে মঞ্জুদিকে বুঝিয়েও লাভ নেই। এক কথা, কোথায় যাব। কার গলগ্রহ হব। নীলুকে নিয়ে আমার এ-পৃথিবী ছেড়ে আর যাবার জায়গা নেই। যত মূল্য দিতেই হোক শেষ পর্যন্ত দেখব সমসের। আর তারপরই কেন জানি ধর্মাধর্ম ব্যাপারগুলি মানুষের জীবনের পক্ষে বড় খাটো হয়ে গেল তার কাছে। ধর্মাধর্মের শোভন এবং সহিষ্ণুরূপ মানুষের মধ্যে দেখার জন্য সে কেমন আকুল হয়ে উঠল।

শেষ রাতের দিকে সমসের মঞ্জুদিকে বলল, একটা কথা আছে।

মঞ্জুদি বলল, ঘুম হয়েছিল?

সমসের বলল, হয়েছে। তারপর সন্তর্পণে মঞ্জুদিকে সঙ্গে আসতে বলল। আস্তাবলের ভেতর থেকে বের করল রাইফেলটা। সে এটা নিয়ে যেতে শঙ্কা বোধ করছে। সে বলল, কি করি?

রাইফেলটা দেখে মঞ্জু তাড়াতাড়ি বলল, এস। সে সমসেরকে নিয়ে উত্তরের পুকুরে চলে গেল। জায়গাটা খুবই নির্জন। পুরানো আমলের একটা বেহারাদের জন্য ঘর আছে। ঘরটার চারপাশে আছে সব জলা জংলা। এখানটায় রেখে দেওয়াই নিরাপদ হবে ভেবে মঞ্জু বলল, আপাতত এখানে থাক। ও এলে ঠিক জায়গায় নিয়ে রাখবে।

সমসের বলল, মঞ্জুদি আমরা একটা অরাজকতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। কি হবে কিছু বলা যাচ্ছে না। অন্তত শেষ বারের মতো লড়ে মরতে পার ভেবে রেখে গেলাম। আমাদের আগের দোষত্রুটি ক্ষমা করে দিও।

চারপাশে সেই গাছপালা এবং ছিমছাম সেই যুবতীর মুখে সামান্য রহস্যময় হাসিটুকু আবার তেমনি ফুটে উঠতেই সমসের সাইকেল নিয়ে পুবের বাড়ির নরেন দাসের বাড়ি পার হয়ে সোনালি বালির নদীর চরে নেমে গেল। তারপর নদী পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সকল অধ্যায়

১. ঈশ্বরের বাগান – ১
২. ঈশ্বরের বাগান – ২
৩. ঈশ্বরের বাগান – ৩
৪. ঈশ্বরের বাগান – ৪
৫. ঈশ্বরের বাগান – ৫
৬. ঈশ্বরের বাগান – ৬
৭. ঈশ্বরের বাগান – ৭
৮. ঈশ্বরের বাগান – ৮
৯. ঈশ্বরের বাগান – ৯
১০. ঈশ্বরের বাগান – ১০
১১. ঈশ্বরের বাগান – ১১
১২. ঈশ্বরের বাগান – ১২
১৩. ঈশ্বরের বাগান – ১৩
১৪. ঈশ্বরের বাগান – ১৪
১৫. ঈশ্বরের বাগান – ১৫
১৬. ঈশ্বরের বাগান – ১৬
১৭. ঈশ্বরের বাগান – ১৭
১৮. ঈশ্বরের বাগান – ১৮
১৯. ঈশ্বরের বাগান – ১৯
২০. ঈশ্বরের বাগান – ২০
২১. ঈশ্বরের বাগান – ২১
২২. ঈশ্বরের বাগান – ২২
২৩. ঈশ্বরের বাগান – ২৩
২৪. ঈশ্বরের বাগান – ২৪
২৫. ঈশ্বরের বাগান – ২৫
২৬. ঈশ্বরের বাগান – ২৬
২৭. ঈশ্বরের বাগান – ২৭
২৮. ঈশ্বরের বাগান – ২৮
২৯. ঈশ্বরের বাগান – ২৯
৩০. ঈশ্বরের বাগান – ৩০
৩১. ঈশ্বরের বাগান – ৩১
৩২. ঈশ্বরের বাগান – ৩২
৩৩. ঈশ্বরের বাগান – ৩৩
৩৪. ঈশ্বরের বাগান – ৩৪
৩৫. ঈশ্বরের বাগান – ৩৫
৩৬. ঈশ্বরের বাগান – ৩৬
৩৭. ঈশ্বরের বাগান – ৩৭
৩৮. ঈশ্বরের বাগান – ৩৮
৩৯. ঈশ্বরের বাগান – ৩৯
৪০. ঈশ্বরের বাগান – ৪০
৪১. ঈশ্বরের বাগান – ৪১
৪২. ঈশ্বরের বাগান – ৪২
৪৩. ঈশ্বরের বাগান – ৪৩
৪৪. ঈশ্বরের বাগান – ৪৪
৪৫. ঈশ্বরের বাগান – ৪৫
৪৬. ঈশ্বরের বাগান – ৪৬
৪৭. ঈশ্বরের বাগান – ৪৭
৪৮. ঈশ্বরের বাগান – ৪৮
৪৯. ঈশ্বরের বাগান – ৪৯
৫০. ঈশ্বরের বাগান – ৫০
৫১. ঈশ্বরের বাগান – ৫১
৫২. ঈশ্বরের বাগান – ৫২
৫৩. ঈশ্বরের বাগান – ৫৩
৫৪. ঈশ্বরের বাগান – ৫৪
৫৫. ঈশ্বরের বাগান – ৫৫
৫৬. ঈশ্বরের বাগান – ৫৬
৫৭. ঈশ্বরের বাগান – ৫৭
৫৮. ঈশ্বরের বাগান – ৫৮
৫৯. ঈশ্বরের বাগান – ৫৯
৬০. ঈশ্বরের বাগান – ৬০
৬১. ঈশ্বরের বাগান – ৬১
৬২. ঈশ্বরের বাগান – ৬২
৬৩. ঈশ্বরের বাগান – ৬৩
৬৪. ঈশ্বরের বাগান – ৬৪
৬৫. ঈশ্বরের বাগান – ৬৫
৬৬. ঈশ্বরের বাগান – ৬৬
৬৭. ঈশ্বরের বাগান – ৬৭
৬৮. ঈশ্বরের বাগান – ৬৮
৬৯. ঈশ্বরের বাগান – ৬৯
৭০. ঈশ্বরের বাগান – ৭০
৭১. ঈশ্বরের বাগান – ৭১
৭২. ঈশ্বরের বাগান – ৭২
৭৩. ঈশ্বরের বাগান – ৭৩
৭৪. ঈশ্বরের বাগান – ৭৪
৭৫. ঈশ্বরের বাগান – ৭৫
৭৬. ঈশ্বরের বাগান – ৭৬
৭৭. ঈশ্বরের বাগান – ৭৭
৭৮. ঈশ্বরের বাগান – ৭৮
৭৯. ঈশ্বরের বাগান – ৭৯
৮০. ঈশ্বরের বাগান – ৮০
৮১. ঈশ্বরের বাগান – ৮১
৮২. ঈশ্বরের বাগান – ৮২
৮৩. ঈশ্বরের বাগান – ৮৩
৮৪. ঈশ্বরের বাগান – ৮৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন