ঈশ্বরের বাগান – ১০

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

।। দশ।।

প্রথমেই মনে হল একটা চৌকো মতো মুখ তার চোখের সামনে ঘুরে গেল। তারপর বাঘের মতো একটা ডোরা কাটা মুখ। অতীশ চোখ রগড়াল। জিভ ভারি হয়ে আসছে। মাথা বেশ ঝিমঝিম করছে। হাসিরানীর ভ্রু প্লাক করা। নাকে ফলস নথ। কাবুলবাবু লেমন জিন নিয়েছে। চুকচুক করে খাচ্ছে। কুম্ভবাবুর হুইস্কি ছাড়া পছন্দ না। ওকেও পীড়াপীড়ি করেছিল। কিন্তু সে বলেছে, অনেকদিন অভ্যাস নেই। আপনাদের অনারে সামান্য বিয়ার খাব। হাসিরাণীর গ্লাসে খুবই সামান্য লেমন জিন। সে বেশি খায় না। কখনও খায় না কেবল দাদার অনারে সে যেন নিয়ম রক্ষা করছে। সব কিছুই এভাবে অনারে হচ্ছিল, যখন প্লেট ভর্তি চিলি চিকেন, যখন অতীশ একবার ইতিমধ্যেই বাথরুম থেকে ঘুরে এসেছে তখনই চোখে একটা ডোরাকাটা বাঘ উঁকি দিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল না এত নেশা লাগছে কেন। জিভ এত ভারি ঠেকছে কেন। এক বোতল বিয়ারে এমন ত হবার কথা না। সে গ্লাসটা তুলে চোখের সামনে নিয়ে এল—না কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তারপর মনে হল দীর্ঘদিন অনভ্যাসের ফল—অথবা কলকাতায় আসলে বিয়ারের বদলে হুইস্কিই দেওয়া হয়। সে অনেক খবর রাখে কিন্তু এই শহরের কোনও খবরই রাখে না। এক মাসেই বুঝেছে, তার শেকড়বাকড় আলগা হয়ে যাচ্ছে ফের।

কাবুলবাবু বলল, আর একটা নিন।

অতীশ মাংস চিবুচ্ছিল। কেমন গা বমি বমি ভাব। এটাও তার কখনও হয়নি। সে বলল, না আর পারব না।

কুম্ভ হোহো করে হেসে উঠল। বলল, দাদা এই আপনার দৌড়। হাসি তো আপনার চেয়ে বেশি টানতে পারে?

—তা পারে। আমি পারি না।

—বাবা বাড়ি আছেন বলে না হলে দেখতেন।

হাসিরানী বলল, না দাদা আমি খাই না। ও মিছে কথা বলছে।

কুম্ভ বলল, খেলে দোষের কি! বউরাণীও খায়। তার জন্য বউরাণীকে চরিত্রহীন বলতে হবে। খারাপ মেয়ে-মানুষ বলতে হবে। কি কাবুল বলিস নি। কাবুল চুপ করে থাকল। অতীশের কোথায় যেন চড়াৎ করে লাগল। অমলাকে নিয়ে কথা বলছে কুন্তবাবু। কুম্ভর কথাবার্তা কাবুল ঠিক রেলিশ করছে না। রাজবাড়ির আদর্শ বলতে কুমারবাহাদুর এবং বউরাণী। এরা যখন খায় তখন এটা একটা আধুনিকতার লক্ষণ। এদের কথাবার্তায় বুঝেছে কুমারবাহাদুর দামী দামী ইংরেজী রেকর্ডে গান শুনতে ভালোবাসে –কুম্ভবাবুর বাড়িতেও সেই গানের রেকর্ড। কুমারবাহাদুর নীল রঙের টাই পরতে ভালবাসেন, কুম্ভবাবুও মাঝে মাঝে নীল রঙের টাই পরে। কুমারবাহাদুর পাইপ টানে, অফিসে মাঝে মাঝে কুম্ভকে পাইপ টানতেও দেখেছে। মাঝে মাঝে কুম্ভ রজনীগন্ধার ঝাড় কিনে নিয়ে যায়। ঘরটায় তাকে একদিন নিয়ে গেছিল—বসতে দিয়েছিল, দেয়ালে তার ও রাজা বাহাদুরদের ফটো, নিজের ফটো। সমুদ্র তীরের ফটো—শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছাতে চায়। কাবুল সে আর হাসিরাণী হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সংসারে সে হাসিরাণীর স্বপ্নের মধ্যে সাঁতার কাটে। তারপরই চিন্তার সূত্র এলোমেলো। কেমন ঝিমঝিম মাথা। গা ভারি ভারি। দাঁড়াতে গিয়ে বুঝল বেশ টলছে—মানুষজন অস্পষ্ট এবং দু’জন হয়ে যাচ্ছে। আসলে কি এরা বিয়ারে কিছু মিশিয়েছে এই যেমন হুইস্কি—এতে তার এলার্জি

আছে। সে কখনও খায় না।

অতীশ বলল, আপনারা খান! আমি আর খাচ্ছি না।

হাসিরাণী বোধহয় মানুষটার জন্য ভেতরে কোনোও অনুরাগ বোধ করে থাকবে, সে বলল, তোমরা দাদাকে আর দেবে না, দিলে খুব খারাপ হবে।

হাসিরাণীর কথায় কুম্ভ এবং কাবুল দুজনেই কেমন সচকিত হয়ে গেল। বলে না দেয়! অতীশ টের পাবে তাকে মাতাল করার জন্যই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। অতীশবাবুর মনে সংশয় দেখা দিলে—তাকে নিয়ে ওরা যতদূর যেতে চায়, আর যেতে পারবে না।

কুম্ভ বেয়ারাকে ডেকে বিল মিটিয়ে দিল। অতীশকে বলল, ধরব?

—না ধরতে হবে না। চলুন।

সবার পেছনে হাসিরাণী। এই মানুষটার পেছনে ওরা এত লেগেছে কেন? বউরাণীর খুব পছন্দ বলে, কুমারবাহাদুরের খুব বিশ্বাসী বলে! হাসিরাণীর কেন জানি মনে হল, একদিন গিয়ে সে দাদাকে সতর্ক করে দেবে গোপনে। দাদা এদের সঙ্গে যাবেন না। এরা আপনাকে বিপদে ফেলতে চায়। এবং তখনই কেন জানি ইচ্ছে হয়, এই মানুষটার সঙ্গে হেঁটে গেলে সে আরাম বোধ করবে। কাবুল দরজা খুলে ধরলে হাসিরাণী বলল, আসুন ভিতরে।

—কুম্ভবাবু কোথায়?

—পান কিনছে।

হাসিরাণী হাসল। বলল, বাড়িতে গন্ধ পাবে না!

—কি হয় গন্ধ পেলে?

—কি ভাববে সবাই। দাদা মদ খায়। মান মর্যাদা বলে কথা!

—মদ খাওয়াটা খারাপ হবে কেন। এতে কাজের ক্ষমতা বাড়ে। অতীশ কথাগুলি জড়িয়ে জড়িয়ে বলছে। কথা জড়ালেই খারাপ। কথা জড়ালেই মাতাল। তখন অনিয়মে পড়ে যাওয়া। সে দেখল আরও চার-পাঁচজন বের হয়ে আসছে। একটা লোক বেহালা বাজিয়ে পয়সা চাইছে। গরীব ভিখারীর হাত লম্বা হয়ে আসছে। সে পকেট থেকে তুলে রেজকিগুলো দিয়ে দিল। হাসিরাণী গাড়ির ভেতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি অতীশকে যেন ভিতরে ঢুকিয়ে নিল। বলল, চুপ করে বসুন। মাথাটা এলিয়ে দিন, আরাম পাবেন।

অতীশ বলল, হাসি একটা কথা বললে, রাগ করবে না বল!

—রাগ করব কেন?

—বাড়িতে তোমার লক্ষ্মীর পট নেই। আমার খুব ইচ্ছে একটা পট কিনে দেব। লক্ষ্মীর পট। পাঁচালি। কিনে দিলে নেবে ত?

—ওর এসব পছন্দ না। আপনার ভাই কালীভক্ত।

—তাহলে দেব না। স্বামীর অবাধ্য হতে আমি তোমাকে বলব না। স্বামীর অবাধ্য হওয়া ভাল না।

তখন কুম্ভ এসে দেখল হাসিরাণীর পাশে অতীশ গা লেপ্টে বসে আছে। কুম্ভর ভেতরটা গরগর করে উঠল। কিন্তু কিছু না বলে একটা পান এগিয়ে দিল অতীশের দিকে। বলল, খান। গন্ধটা মরবে। অতীশের মনে হল সেই ডোরাকাটা বাঘটা চোখের সামনে লাফিয়ে পড়ছে।

হাসিরাণী বলল, আমারটা কৈ?

—তোমার মুখে গন্ধ কোথায়, তুমি যে খাবে!

অতীশ বলল, আচ্ছা কুম্ভবাবু আপনি কি আর জন্মে বাঘ ছিলেন? না, আই মিন বাঘের বাচ্চা। কাবুল চোখ টিপল। কুম্ভ এর বিয়ারের সঙ্গে তিন তিনবার হুইস্কি মিশিয়েছে। আর একটু হলেই কাবু করে আনতে পারত। কিন্তু হাসিরাণীর বাধা ছিল। কুম্ভ বলল, আপনি কি টের পান, মানুষ কোন জন্মে কি থাকে?

—কি যেন হয় মাথার মধ্যে। এই দেখুন না কখন থেকে একটা জন্তুর মুখ আমাকে কেবল তাড়া করছে। কখনও বাঘের মনে হয়, কখনও শেয়ালের, কখনও মানুষের মুখ—হিজিবিজি দাগ কাটা, টলতে টলতে আসছে। আমাকে ধরতে আসছে।

অতীশের পাশে কুম্ভ বসে পড়ল। গাড়ি চালাচ্ছে কাবুল। কাবুলের কাছে অতীশবাবুর মুখোশ যত খুলে ধরা যায়। কারণ কাবুল, রাজার এবং বউরাণীর এজেন্ট, অতীশবাবু যে ধোওয়া তুলসীপাতা নয়, সুযোগ সুবিধে মতো কাবুলই পারে বউরাণী কিংবা রাজার গোচরে আনতে। সবই সে করছে হাসিরাণীর জন্য, তুমি যে কেমন মেয়েছেলে বাব্বা বুঝি না। নিজের ভালটাও বোঝ না। তুমি জান না এই লোকটা আমার তোমার সব সুখ কেড়ে নিতে এসেছে।

কুম্ভ ভেবেছিল মদ খাওয়ার ঘোরে অতীশবাবু রাজার দুমুখো স্বভাব নিয়ে কিছু বলবে—এই ভুলচুক কথাবার্তা, সঙ্গে বেফাঁস দুটো-একটা বের হয়ে গেলেই কাজ দেবে। নবর চাকরির প্রসঙ্গও তুলেছিল। কিন্তু অতীশবাবু ভারি সেয়ানা, শুধু ঘাড় নেড়ে গেছে। নিজের কথা বলে নি। বউরাণী তাকে ডেকে কি বলেছে, তাও সে বিন্দুমাত্র ওগলায়নি। মদ খেলে তো মানুষ সোজা সরল হয়ে যায়—অথচ এত খাওয়ার পরও রাজার সম্পর্কে একটা বেফাঁস কথা বলে নি। এ-ছাড়া কুম্ভর মাথা নানা রকম ফন্দি খেলা করে বেড়ায়। কোথা দিয়ে কোন রন্ধ্রপথে ঢোকা যাবে, কাকে কিভাবে জড়িয়ে দেওয়া যায়—এটাই তার মাথায় থাকে। সে ইচ্ছে করেই খাবার টেবিলে বউরাণীর কথা টেনে এনেছিল। অন্দর মহলের গোপন খবর কাবুল রাখে। আসলে সে অতীশবাবুর কাছে কাবুলকেও জড়িয়ে রাখল। যেভাবে রাজবাড়ির প্রভাব প্রতিপত্তি কমছে-বাড়ছে তাতে করে কাবুলের ফ্রন্টকেও দুর্বল করে রাখা দরকার। যখনই কাবুল তেরিয়া হয়ে উঠবে তখনই হাতের অস্ত্র, বউরাণী মদ খায়। কাবুলবাবু খবরের উৎস। কুম্ভ চায় এক সঙ্গে দুটো ফ্রন্টকেই ঘায়েল করতে। হাসির বুদ্ধি কম। সে বুঝছেই না, এতগুলি টাকা গচ্চা এমনি সে দেয় নি। কাবুলের নামে পার্টি দিয়ে সে দু’ফ্রন্টে লড়াই জমিয়ে তুলতে চায়। কিন্তু এত করেও অতীশবাবুর মুখ থেকে রাজবাড়ির কোনও নিন্দা প্রশংসাই বের করতে পারল না। ভেতরে ভেতরে সে টাকার জ্বালায় জ্বলছিল। তবে এখন এটাই সুখ, কাবুল অন্দরমহলের গোপন খবর বাইরে বের করে দেয়। অদ্ভুত কাবুলের সামনে অতীশের কাছে বউরাণী মদ খায় প্রকাশ করতে পেরে মনে মনে কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করছে।

গাড়িটা তখন রাজবাড়ির মুখে বাঁক নেবে। ওরা সবাই দেখল ঠিক ঢোকার মুখে সেই পাগল ঊর্ধ্ববাহু হয়ে দাঁড়িয়ে। কাবুল গলা বার করে বলল, এই হরিশ পাগল পালা। দাঁড়া এক্ষুনি পুলিশে খবর দিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে কাজ। হরিশ দৌড়ে পাশের দেবদারু গাছটার নিচে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল।

আর কিছু পরেই ঢুকছে বউরাণীর গাড়ি। রাস্তা থেকে গাড়ির হর্নেই টের পায় তিনি আসছেন। কিন্তু মাঝপথে যেন গাড়ি আটকে গেল। হরিশ ঊর্ধ্ববাহু হয়ে আবার দাঁড়িয়ে আছে। এই পাগলের উৎপাতে আর শহরে থাকা যাবে না। শঙ্খ দরজা খুলে লাফিয়ে নামল। তারপর একটা ব্যাটন নিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু হরিশ নড়ল না। সে ব্যাটনটা চেপে ধরল, লাঠিটা যেন পেয়ে গেছে। দম মাধা দমের লাঠিটা রাজবাড়ির লোক তাহলে চুরি করেছে। সে ব্যাটনটা চেপে ধরল। এবং ঈযং গন্ডগোল হচ্ছে ভেবেই দারোয়ান দৌড়ে গেল। টের পেয়ে অন্য পাইকরা দৌড়ে গেল। ঠেলেঠুলে থাবড়া মেরে হরিশকে বসিয়ে দিল সবাই। হরিশ সেই কখন থেকে খুঁজছে। পেয়েও পেল না। সে রাজবাড়ির দিকে মুখ করে দাঁড়াল। তারপর থুতু ছিটাতে থাকল, শেষে নুনু বের করে হিসি করে দিল।

তখন অতীশ সিঁড়ি ভেঙে উঠছে। যেন সে অন্ধকারে ধাপ খুঁজে পাচ্ছে না। হাতড়ে হাতড়ে উঠে যাচ্ছে। অন্ধকারে বোধহয় চামচিকে উড়ছিল। একটা চামচিকে অন্ধকারে নাকে মুখে গোত্তা খেয়ে পড়ল—সে কোনরকমে বলল, যা পালা। তারপর আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকল।

অন্ধকারে অতীশ ভারি সতর্ক—কেউ দেখে ফেলতে পারে, সে টলে টলে উঠেছে। বাইরে থেকে আলো পড়ছে—সিঁড়িটা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পা টেনে টেনে সে উঠে এল। মানসদা দেখে ফেললে ভারি অস্বস্তিতে পড়ে যাবে। এই মানুষটাকেই সে এখন এ-বাড়িতে একমাত্র সমীহ করে। আর সবাইকে কেন জানি মনে হয় সকাল সন্ধ্যা কেবল ধান্ধায় ঘুরছে। তালা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকতেই দেখল, একটা চিঠি—নীল খামের চিঠি মেঝেতে পড়ে আছে। নির্মলা চিঠি লিখেছে। বড়ই ছেলেমানুষের মত চিঠিটা তুলে নিল। ঘাম হচ্ছে—জবজবে ভিজা শরীর। ফুল স্পীডে পাখা চালিয়ে সে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। সারা শরীরে ক্লান্তি। চোখ বুজে আসছে—কেমন অসাড় লাগছে। তার জুতো মোজা খোলার পর্যন্ত যেন শক্তি নেই। অথচ চিঠিটা পড়া দরকার। বাড়ির খবরের জন্য দুঃশ্চিন্তায় ছিল। টুটুল মিণ্টুর কথা মনে হলেই সে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। এত প্রিয় চিঠিটা পর্যন্ত পড়ার সে কেন জানি আকর্ষণ বোধ করছে না। মেজাজটা কেমন বোঁদা মেরে আাছে। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে পারলে ভাল হত। স্নান করলে সে আরাম পেত। এমন আলস্য শরীরে যে তার এক পা উঠে গিয়ে কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এত প্রিয় চিঠি সে এখনও অবহেলায় ফেলে রেখেছে। এভাবে কতক্ষণ ছিল সে জানে না, সহসা দরজায় খুটখুট শব্দ হতেই ওর যেন হুঁশ ফিরে এল—কে! কে!

—আমি নব।

অতীশ বুঝতে পারল সারা দিন এই ভয়টাই তাকে তাড়া করেছে। নব আসবে। নবর বাবাকে সে কথা দিয়েছে। নব এলে কি বলবে! নব বিশ্বাস করবে না, সুরেন বিশ্বাস করবে না চাকরি দেবার কোনও ক্ষমতা তার নেই। রাজবাড়ির সে একজন ক্রীতদাস। এই ভয়ংকর তাড়না তাকে শেষ পর্যন্ত চাঙোয়ায় নিয়ে গেছে। নবর কাছ থেকে পালিয়ে যাবার এছাড়া তার যেন কোনও উপায় ছিল না। না কি সে বুঝতে পারছে, নিয়তি তাকে এই বড় শহরে টেনে এনেছে। জীবনের এক পরিমন্ডল থেকে এখন অন্য এক পরিমন্ডলে। মানুষের নিয়তি এই রকমের, বিশ্বাস করতে পারলে তার কষ্ট থাকত না, এর জন্য সেই দায়ী—এবং এসব ভাবনা আরও তাকে পেয়ে বসলে, নব ফের ডাকল, স্যার সুখবর দিতে এলাম, দরজাটা খুলুন।

নবর জীবনে সুখবর! এযে এক আশ্চর্য ঘটনা! সে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে সরে দাঁড়াল। মুখে মদের গন্ধ পেতে পারে। সে বিছানায় এসে বসল। নবকে অন্য সময় হলে বলতে পারত, এখন না কাল এস, কিন্তু সকাল থেকেই সে নবর কাছে একটা বড় রকমের কথার খেলাপ করে অপরাধী সেজে বসে আছে। তার মুখে বড় কথা শোভা পায় না। ছোট কথাও না। সে বলল, কি খবর নব?

.

নব বসল না। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই কাঁচুমাচু মুখে বলল, দশটা টাকা সাহায্য দেবেন স্যার। সাহায্য কথাটা যেন খুবই কৃপাপরবশ হয়ে নব বলল। সোজা বললেও যেন দোযের হত না। দশটা টাকা ছাড়ুন তো। কেরামতি অনেক দেখা গেল। দশটা টাকা এখন দরকার। দিন।

অতীশের কাছে দশটা টাকা অনেক। এখানে সে খুব টিপে টিপে চলছে। দশটা টাকা চাইলেও হুট করে দিতে পারে না। কিন্তু যেন যখের মত নব দরজায় ঠান্ডা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ স্থির। ভয়ে ভয়ে সে বলল, নব কাল নিলে চলে না। এখন তো টাকা নেই।

—কালই দেবেন স্যার। শনিপূজা করব। মূলধনের অভাব। বাবা বললেন, নতুন স্যারকে বলেছি, তোকে যেতে বলেছে। আমি কিন্তু স্যার গেলাম না। রাজার কারখানা সব লাটে উঠছে। ভাঙা কপাল, আর ভাঙতে চাই না স্যার। তাছাড়া বামুনের ছেলে, পূজাপার্বণে লেগে থাকাই ভাল। সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলছি। মোট ত্রিশ টাকা দরকার। একটা পুরোহিত দর্পণ, শনির পাঁচালী, বলে নব এগিয়ে এল। তাঁর বিজনেস প্রজেটের খাতাটা খুলে দেখাল, বিশ্বাস না হয় দেখুন, এ ছাড়া আতপ চাল, কলা, বাতাসা দুখানা সন্দেশ, এক কেজি দুধ, চালের গুঁড়ো সিন্নি প্রসাদের জন্য, ফুল-ফল আমের পল্লব, ঘট হরিতকি তামা তুলসী এসবে মোট খরচ আঠার টাকা বাষট্টি পয়সা। একটা আসন, মূর্তি গড়া, ঢাকের খরচ বাবদ সাতটা টাকা। মিসলেনিয়াস খরচ আরও পাঁচ টাকা। ত্রিশ টাকা মূলধনে বিজনেস। কনসার্নের নাম নবর শনিপূজা। আমহার্স্ট স্ট্রীটের মোড়ে। রোজ শনিবার। শনি ঠাকুরকে সব শুয়োরের বাচ্চা ভয় পায় স্যার। মোক্ষম লাইন ধরেছি। কি বলেন স্যার। বলে নব কাছে ঘেঁষে আসতে চাইলে, অতীশ সরে বসল। বলল, তুমি ওখান থেকেই বল। হ্যাঁ হ্যাঁ সব বুঝছি। ভাল ব্যবসা।

—আপনার দশ টাকা শেয়ার। বাবার দশ টাকা শেয়ার, হামুবাবু দেছেন পাঁচ টাকা, দু টাকা মতিপিসি, এক টাকা নধরবাবু, এক টাকা রাধিকাদাদু। এই ছজন শেয়ার হোল্ডার। আর চারজন শেয়ার হোল্ডার টাকা দিচ্ছে না। যার দোকানের সামনে ফুটপাথ, সে একটা শেয়ার চাইছে। বাকি তিনটে শেয়ার নিজের। আমি স্যার অ্যাকটিং পার্টনার। আপনি ভাল মানুষ বলে দশ টাকার শেয়ার দিচ্ছি।

নব তাকে মুক্তি দিয়েছে ভাবতে গিয়ে অতীশের চোখে কেন জানি জল এসে গেল। বলল, আমি এক্ষুনি দিচ্ছি। তুমি নিয়ে যাও নব। তোমার ভাল হোক।

—ভাল আমার হবেই স্যার। আমি এই দিয়েই বিপ্লবের কাজটা শুরু করব। আতঙ্কে ঘুম আসবে না চোখে। শনিঠাকুর বলে কথা—হাজার হাজার মানুষ শিয়ালদায় নেমে অফিসে যাচ্ছে আবার ফিরছে। পাঁচ পয়সা দশ পয়সা দিলে তখন ভেবে দেখুন কত পয়সা। একটুও ব্লাফ দিচ্ছি না স্যার। তারপর পরামর্শ নেবার মত গলা বাড়িয়ে আরও কাছে আসতে চাইলে অতীশ আবার দূরে সরে একেবারে খাটের কোণায় চলে গেল। তারপর এগোলে তাকে দেয়ালে ঠেস দিতে হবে।

—আচ্ছা স্যার, কার্ড ছাপলে কেমন হয়। নবর শনি পূজা। স্বপ্নে পাওয়া। তিনি জাগ্রত, মানুষের দুঃখ দুর্দশায় বিচলিত হয়ে নবর আশ্রয়ে হাজির। এমন সব বিজ্ঞাপন দিয়ে একটা কার্ড ছাপালে কেমন হয়?

অতীশ বলতে পারত—কিছু হয় না। আবার হয়ও। কিন্তু কথা বললে কথা বাড়বে। সে বালিশের নিচে থেকে মানিব্যাগ বের করে দশটা টাকা দিয়ে সারা দিনের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে চাইল। নব বলল, স্যার আপনি দেখবেন, কি করি! সারা শহরটা শনির আখড়া বানিয়ে ছাড়ব। দরকার হলে পার্টনারশিপ থেকে প্রাইভেট লিমিটেড, ব্যবসা বড় হলে পাবলিক লিমিটেড করে ফেলব। উত্তর কলকাতা, মধ্য কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতায় আমরা অফিস খুলব। পাড়ায় পাড়ায় সমাজসেবা কেন্দ্র খুলব। ভিখারীদের জন্য লঙ্গরখানা। অনেক স্বপ্ন স্যার, আশীর্বাদ করবেন যেন সার্থক হয়।

মদের ঘোরে অতীশ বলল, তোমাকে আশীর্বাদ করছি নব। আমার বাবা এখানে থাকলে তিনিও তোমাকে আশীর্বাদ করতেন। ভারত জননী বেঁচে থাকলে তিনিও তোমায় আজ আশীর্বাদ করতেন। তুমি এবারে যাও। শুভ কাজ ফেলে রেখ না।

নব চলে যাবার পরই অতীশ কেমন হাল্কা হয়ে গেল। শরীরে জড়তা নেই। সে কেমন মুক্ত পুরুষ। তার চান করা দরকার। সে চান করে এল।

খুব ফ্রেস লাগছে শরীর। ঘড়িতে দেখল এগারটা বেজে গেছে; পাশের ঘরগুলি থেকে কেউ দেখে না ফেলে, সেজন্য সে বারান্দার জানালা-দরজা বন্ধ করে রেখেছে। পেছনের জানালা খুলে দিয়েছে। খুলে দিলেই বড় একটা ডুমুর গাছ আর তার পাশে সেই অতিকায় জেলখানার পাঁচিল। পলেস্তারা খসে পড়ার শব্দ, কীট-পতঙ্গের শব্দ। তখনই মনে হল নির্মলার চিঠি। তার দুই জাতক, বাবা-মা ভাইদের খবর, বাবার অনুমতির খবর সবই এই চিঠিতে থাকার কথা। পড়লে জানতে পারবে।

খাম খুলে সে দুটো চিঠি পেল। একটি বাবার, একটি নির্মলার। নির্মলার চিঠি খুলে দেখল; কয়েক লাইন মাত্র লেখা। টুটুলের জ্বর সেরেছে। বাবার খুব ইচ্ছে নয় আমরা কলকাতায় যাই। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! তোমাকে ছেড়ে একদন্ড থাকতে পারব না। তাহলে মরে যাব। দাদাকে ফোন করেছিলে কিনা জানিও।

বাবার চিঠি খুবই দীর্ঘ। লিখেছেন, পরমকল্যাণবরেষু। বাবা অতীশ, তোমার পত্রে সব অবগত হলাম। বউমাদের নিয়ে যেতে চাইছ। তুমি জানিয়েছ সেখানে তোমার বিনা পয়সায় একটি থাকবার বাসস্থান মিলেছে। বউমার ইচ্ছা যায়। আমারও অমত নেই। তবে বড় আশঙ্কা তুমি না আবার দ্বিতীয়বার ছিন্নমূল হও। সংসার থেকে মানুষ আজকাল বিচ্ছিন্ন হতে ভালবাসে। এটাই রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। নাড়ির টান ছিঁড়ে গেলে মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা বাড়ে। মানুষের মহত্ত্ব ছোট হয়ে যায়। ওরা চলে গেলে বাড়িটা খালি হয়ে যাবে এই কষ্টটা বাজছে। যাইহোক, আমার কোনও অমত নেই। তাছাড়া আর একটা দিকও আছে। সেটাও ভেবে দেখলাম। বউমা কাছে থাকলে তোমার বাইরের আকর্ষণ কমবে। আমার নাতি নাতনী কাছে থাকলে তুমি অসাধু কাজ করতে ভয় পাবে। নিজের আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে এজন্যই ঘনিষ্ঠ থাকা দরকার হয়ে পড়ে। অশুভ প্রভাব থেকে এই ঘনিষ্ঠতা মানুষকে বাঁচায়।

বাবা কি টের পেয়েছেন, সে কখনও কখনও অশুভ প্রভাবে পড়ে যাচ্ছে। বাবা তো বলেন, তিনি সব টের পান। বউরাণী অমলাকে দেখে তার ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে এটা কি বাবা ধরে ফেলেছেন! কিংবা বাবা কি তারপরের চিঠিতে লিখবেন, অতীশ তুমি প্রলোভনে পড়বে না। হাসিরাণীর নথ যে তোমাকে নাড়া দিচ্ছে। বাবার এই ধরনের সাধুবাক্যের প্রতি তার সহসা কেন জানি ভারি উষ্মা জন্মাল। যত্ত সব। যত না বউরাণীর জন্য, তার চেয়ে বেশি বাবার এই চিঠিটা তাকে পাগলা ঘোড়ার মত তাড়া করতে থাকল। কখনও মনে হয়েছে বোকামি, কখনও মনে হয়েছে না সে ঠিকই করেছে। ইস্কুলের কাজটা ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় এসে সে ঠিকই করেছে। কাজের ক্ষেত্রে কোন সরল বিশ্বাসের ক্ষেত্র থাকবে না সে ভাবতে পারে না। অতীশ পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে বয়সেরই দোষ এটা। অথবা বাবার জীবন যাপন—অঋণী অপ্রবাসী থাকতে চেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কিন্তু প্রবাসে তাঁকে আসতেই হয়েছে। ঘাড়ধাক্কা খেয়ে প্রবাসে এসেছেন। প্রবাসে এসেও অঋণী থাকার কি হাস্যকর প্রচেষ্টা। চিঠিটা পড়তে পড়তে বাবার ওপর কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে গেল এসময়। বাবা সামান্য অসাধু হলে পৃথিবীর আর কতটা ক্ষতি হত। আর এরই নাম বোধ হয় রক্তে বীজ বপন করা। বাবার সব সংস্কার সে রক্তে ধারণ করে আছে। মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিয়েছে—বাড়তি কিছু ফেলেও দিয়েছে।

যেমন তার খুব শৈশবে উপনয়ন হয়েছিল। আহ্নিক করা, দু বেলা আহার একাদশীর দিনে শুধু ফলমূল আহার—তাকে কিছুটা সংশয়ে ফেলে দিয়েছিল। জীবনে এটা বড় কৃচ্ছ্র তার দিকে। বড় হবার বয়সে সে মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিত—বাবা তখন আরও ধার্মিক হয়ে যেতেন। তাকে কাছে ডেকে প্রাচীন ঋষি পুরুষদের কথা বলতেন। তাঁদের কাম লোভ মোহ সম্পর্কে জাগতিক সরল ব্যাখ্যা দিতেন। এভাবে বর্ণাশ্রম থেকে আরম্ভ করে ঋষি যাজ্ঞবন্ধে চলে আসতেন। শ্লোক উচ্চারণ করতেন গম্ভীর গলায়। বেদ উপনিষদের সব গুহ্য কথা আওড়ে যেতেন। ধর্ম মানুষকে বড় করে দেয়। ছোট করে না। এ-সবও বলতেন। তবু সে কেন জানি নিজের বিবেকের সঙ্গে ঠিক ঠিক সমঝোতা না হওয়ায় জাহাজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উপবীত ত্যাগ করেছিল, শরীরে অপ্রয়োজনীয় বাড়তি কিছু রাখা আদপেই কেন জানি তখন তার পছন্দ হত না। জাহাজ থেকে ফিরে এসে বাবার সঙ্গে প্রথম খটাখটি সেই নিয়ে। এভাবে এক অদৃশ্য খাণ্ডবদহন পিতা-পুত্রের মধ্যে চলছিল।

কিন্তু তার মনে হয় বাবাই শেষ পর্যন্ত জিতে গেছেন। এই যে সে কিছুকাল আগে স্কুলের কাজে ইস্তফাপত্র দিল, তারও মূলে বাবা। আসলে তার অহংকার, সততার অহংকার, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা কেন যে বললেন, না, কিছু না কিছু মানুষকে অসাধু হতেই হয়। এবং মানুষ এই অসাধু হবার প্রবৃত্তি থেকে রেহাই পায় না।

এসব কারণেই বাবার যৌবনকাল সম্পর্কে সে উদাসীন থাকতে পারত না। বাবার সঙ্গে যখন মুখোমুখি হবার বয়স, তখন বাবার ঠিক যৌবনকাল ছিল না। খুব প্রৌঢ়ও নন। বাবার ঠিক যৌবনের কোনও আচরণেরই সে সাক্ষী থাকে নি। থাকলেও মানুষের সেই কূট রহস্য বোঝার বয়স তার হয়নি। তা না হলে বুঝতে পারত কোনও প্রলোভনে পড়ে গেছিলেন কিনা তিনি। হঠকারী এমন কি কিছু ঘটনা নেই, যা মানুষের বেঁচে থাকার পক্ষে অতীব প্রয়োজনীয়—মানুষ কখনও না কখনও হঠকারী কিছু করেই থাকে—সব বাবাদের জীবনেই এটা ঘটে থাকে এবং সব বাবারাই পরে সাধুপুরুষ সেজে যান। সে এ নিয়ে মাঝে মাঝে মার সঙ্গে কথা বলবে ভেবেছে। কিন্তু সেটা এখনও হয়ে ওঠে নি। এমনিতেই মা, বাবার ওপর খড়্গহস্ত—একরোখা রক্ষাকালীর মতো সব সময় জিভ ব্যাদান করে আছে। কেন এটা হয় বুঝতে পারে না। তার দিকে তাকিয়ে একদিন মা কেঁদেই ফেলেছিল, তোর বাবার সব সহ্য হয়—কিন্তু এমন নিস্পৃহ স্বভাবের মানুষকে কেউ সহ্য করতে পারে না। ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ হওয়ায় বাবার কর্মক্ষমতায় যেন কোথায় ঘুণ ধরেছিল। এবং ঈশ্বর সম্পর্কিত চিন্তা, ভাবনায় যত মশগুল হতে জানতেন কাঠখড় কেরোসিনের ব্যাপারে তত তিনি অনাগ্রহী। কৈশোর থেকেই পিতাপুত্রের এজন্য লাঠালাঠি। সে যতবার খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে চেয়েছে বাবা ততবার হাত ধরে নিয়ে গেছেন ঘরে। বাবার যৌবনকালের কোন অসাধু আচরণের খবর পেলে সে অন্তত হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারত। কিন্তু বহু চেষ্টায়ও সে সেটা পারে নি। আর পারে নি বলেই এখনও পিতার কাছে নতজানু হতে তার ভাল লাগে।

চিঠিটা খোলা পড়ে আছে। খুব জড়ানো লেখা। পড়তে পড়তে তার অভ্যাস হয়ে গেছে বলে কোনও কষ্ট হয় না, সে চিঠিটা ফের তুলে দেখল, বাবা লিখেছেন, তোমার কুষ্ঠী সুবলকে দেখিয়েছি। সে বলল, এখন তোমার গ্রহ সন্নিবেশ খুব ভাল নয়। সাবধানে থাকবে। পারো তো হাতে একটা গোমেদ নেবে। এ-সবে অবশ্য তোমার বিশ্বাস কম, তবু এটা করবে, না পার একটা লোহার আংটি পরবে। তাতেও যদি আপত্তি থাকে ওটা কোমরের তাগাতে বেঁধে রাখবে। এতে জানবে গ্রহের প্রকোপ কমবে। এঁরা শান্ত থাকলে জীবন শুভ হয়।

তার কেন জানি মনে হল আসলে বাবা খুবই একা পড়ে গেছেন। মেজ জ্যাঠামশাই বড় জ্যাঠিমা ছোট কাকা সবাই আলাদা হয়ে গেছে। বড়দার কাছে মেজ জ্যাঠামশাই আছেন। অন্তত মেজ জ্যাঠামশাই বাবার কাছে থাকলে বোধ হয় এত ভীতু হয়ে পড়তেন না। সংসারে বড় বৃক্ষের একটা প্রয়োজন থাকে। এখন যেমন বাবা তার কাছে বড় বৃক্ষের মতো তেমনি জ্যাঠামশাই বাবার কাছে ছিলেন। এদেশে এসে সব ছত্রাখান হয়ে গেল। বাবার ভরসা বলতে গৃহদেবতা। আর বালিশের নিচে কিছু ফুল বেলপাতা রয়েছে। শুকিয়ে কাঠ। তার ডাইরিতেও বাবা ফুল বেলপাতা গুঁজে রাখতে বলেছেন। সে এসব মানুক না মানুক তাকে সবই রাখতে হয়েছে।

তারপর বাবার চিঠিতে, আছে বাড়ির সব খবর। ধলীর একটা বাঁটে কি হয়েছে—দুধ দোওয়ানো যাচ্ছে না। উত্তরের জমিতে বীজধান পুঁতে দেওয়া হয়েছে। প্রহ্লাদের স্ত্রীর অসুখ। সে ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে। দুটো বেড়ালের একটার কদিন থেকে খোঁজ নেই। হাসু-ভানু পড়াশোনা করছে না। কেবল মাছ ধরে না হয় ক্লাব-ঘর বানায় এমন সব অভিযোগ। মার শরীর ভাল যাচ্ছে না। অলকা ফিরে এসেছে। ঘরের চালে দুটো কুমড়ো ফলেছে, আমের কলম করেছেন কটা, প্রতি বছরই তিনি তাঁর গাছগুলোর কলম বানান এবং যজমানদের বাড়ি বাড়ি বিলিয়ে দেন। এই সব খবর লেখার পর পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন, এটা শ্রাবণ মাস, পারত সন্ধ্যের অন্ধকারে আকাশের দক্ষিণে যে তারামন্ডল আছে তা দ্যাখো। এটির নাম বৃশ্চিক রাশি। গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে মানুষের যোগ অমোঘ। ওকে অবহেলা কর না। রাশিটির উত্তরে ঠিক মাঝ আকাশে সামান্য পশ্চিম ঘেঁষে আছে স্বাতী। তার উত্তরে সাতটি তারা নিয়ে সপ্তর্ষি আর ধ্রুবতারা নিয়ে শিশুমার। পশ্চিম দিকে তাকালে বড় একটা গ্রহ দেখতে পাবে। এটা শনিগ্রহ। ওটা আছে সিংহ রাশিতে। এই সব গ্রহলোক অবলোকনে তোমার শরীর ভাল থাকবে। মন প্রসন্ন হবে। অশুভ প্রভাব থেকেও রক্ষা পাবে—ইতি আং তোমার পিতৃদেব।

অতীশ চিঠি দুটো ভাঁজ করে তোশকের নিচে ফেলে রাখল তারপর মাথার জানলা খুলে দিল। সারা রাজবাড়িটা নিঝুম। রাস্তায় আলো জ্বলছে। প্রাসাদের গাড়িবারান্দায় বলের মতো আলোটা বাতাসে দুলছে। শ্রাবণী পূর্ণিমা আসছে। কোথাও মাইকে গান ভেসে আসছিল। বাবা তারকনাথের মাথায় জল দিতে যাবে, নতুন গামছা, সাদা প্যান্ট পরনে ছেলে-ছোকরারা মাইকে হল্লা জুড়ে দিয়েছে। বড় বিশ্রী এবং বিরক্তিকর—মানুষের তীর্থযাত্রার আগে এই উল্লাস কেমন তাকে পীড়িত করছিল। আর এ-সময়ই মনে হল জ্যোৎস্নায় প্রাসাদের ছাদে কোন নারী উর্ধ্বমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন গ্রহ- নক্ষত্র দেখছে। এত দূর থেকে স্পষ্ট নয়—তবু অমলার মত লম্বা কোন যুবতী, কোনও দূর গ্রহলোকে দৃষ্টি এবং স্থির—অতীশ ভাবল অমলাই হবে। এই প্রাসাদে আর কে আছে, রাণীমা এখানে নেই তিনি কাশীতে থাকেন। এক মাসে সে যা খবর জেনেছে তাতে করে সে জানে এই প্রাসাদে অমলা বাদে আর কোন যুবতী বিচরণ করে না। এই পরিবার সম্পর্কে নানা রকম রহস্যময়তা জড়িয়ে আছে। মানসদা এ বাড়ির প্রতিপক্ষ শুনে সে প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছিল। কুম্ভবাবুই আজ খবরটা দিয়েছে। সে প্রশ্ন করতে পারত, তিনি একা কেন, তালাবন্ধ অবস্থায় থাকেন কেন? মাথার গোলমাল দেখা দেয় কেন? কিন্তু সে কোনও প্রশ্নই করে নি। কারণ কাবুলবাবু এ-সব পছন্দ নাও করতে পারে। বাড়ির কেচ্ছা কাহিনী কে সামনে বসে শুনতে ভালবাসে!

এ-ছাড়া আরো যা খবর, তাতে সে অমলা সম্পর্কে কেমন আবেগ বোধ করছে। গুজব অমলা রাজেনদার ধর্মপত্নী না হয়েও এ-বাড়ির বউরাণী। রাজেনদার ধর্মপত্নী আত্মহত্যা করার পরই অমলা এ-বাড়িতে আসে। বাড়ির আনাচে কানাচে এমন খবর ছড়িয়ে আছে। একটু সতর্ক থাকলেই কানে আসে। খুব সাদামাটা একটা রেজিস্ট্রেশন, তারপর পার্টি এবং অমলা এ-বাড়ির বউরাণী। এ বাড়িতে অমলার পাঁচ বছর কেটে গেছে। অমলা এখনও নিঃসন্তান। অমলা এবং রাজেনদার ওপর কিছুটা বিরক্ত হয়েই রাণীমা প্রাসাদ ত্যাগ করেছেন! এখন রাণীমার মহলে কিছু দাসীবাঁদি থাকে। রাণীমা অমলাকে এ-বাড়ির বউরাণী স্বীকার করে নিতে পারেন নি। অমলাকে এ-বাড়িতে এনে বংশের ঐতিহ্যে রাজেন চিড় ধরিয়েছে। বড় অসুখী রাণীমা। রাজবংশের প্রতিপত্তি এভাবে একজন সাধারণ রমণীর কাছে বিকিয়ে যাওয়ায় তিনি রাজেনকে কুলাঙ্গার ভেবেছেন। এবং এই বিরোধ থেকেই তাঁর কাশীবাস। অতীশ কান পাতলে এ-সব উড়ো খবর শুনতে পায়। রাণীমার সহ্য হবে কেন! শুভাশুভ বলে কথা! কোন মন্ত্রপাঠ নেই, অগ্নিসাক্ষী নেই। বউরাণী করে ঘরে নিয়ে এলেই হল। কোথাকার কোন এক পরিবার তার কি ঐতিহ্য, তার বংশাবলী কি, কোন ঘরানার কিছুই বাছবিচার নেই! এ-বাড়ির বউরাণী হয়ে আসা কি চাট্টিখানি কথা। খানদানী বংশ দেখে বেছে বেছে এ-বাড়ির বউরাণী করা হয়েছে। আর তুই কিনা রূপ দেখে মজে গেলি। বংশের মুখে চুনকালি দিলি।

অতীশ বুঝতে পারে না, এতে ব্যভিচারের কি আছে। তবু খটকা থেকে যায়, অতীশ বারান্দা থেকে এবার ঘরে চলে এল। এই নিয়ে সে এত ভাবছে কেন? অমলা তাকে আর ডাকে নি, কিছু বলেও নি আর। তবু তার মনে হয় এই তাড়াতাড়ি কোয়ার্টার পাওয়ার পেছনে অমলার হাত আছে। অমলা তাকে চিঠিতে কি লিখেছিল? সেই চিঠি, সেই কবেকার চিঠি, সে তখন ভাল করে বুঝতেও পারত না এ-সব। তারপরই কেমন একটা বিভ্রমে পড়ে যায়। চিঠিটা কমলা দিয়েছিল না অমলা। সেই শ্যাওলাধরা ঘরটায় অমলা নিরিবিলি জড়িয়ে ধরেছিল না কমলা। কত দূর অতীতের স্মৃতি। সে ঠিক বুঝতে পারছে না। কখনও মনে হয় কমলা, কখনও মনে হয় অমলা। মাথার ভেতরে তার সেই ঘন্টা বাজছে। বিভ্রমে পড়ে গেলেই এই ঘন্টা বাজতে শুরু করে। সে যতবার ভাবে এ-নিয়ে আর কিছু ভাববে না তত কেন জানি বার বার ঘড়ির দোলকের মতো দুলতে থাকে, কমল না অমল। এদিকে এলে অমলা, ওদিকে গেলে কমলা। অমলের চুল নীল, না কমলার চুল নীল। কার চুল সোনালী ছিল? বড় ফ্রক পরা মেয়েটার না, ছোট ফ্রক পরা মেয়েটার? এত আভিজাত্য ছিল ওদের অথচ এ-বাড়িতে অমলা আসায় সবাই কেমন রুষ্ট।

অতীশ আলো নিবিয়ে উপুড় হয়ে শুল। পাখা চালিয়ে সে শোয় না। অভ্যাস নেই বলে, দু-এক রাতে চালিয়ে সে বেশ কষ্ট পেয়েছে। সারা শরীরে কেমন হাড় মুড়মুড়ি ব্যথা হয় পাখার হাওয়ায়। কিন্তু ভ্যাপসা গরম। তাছাড়া মাথাটা গরম হয়ে গেছে। বাবার চিঠি, নবর শনিপুজো, রাস্তায় মাইকের হল্লা, প্রাসাদের ছাদে কোনও রমণীর ছবি তাকে কেমন কাতর করে রেখেছে। সে চোখ বুজে পড়ে থাকল। তার কিছুতেই ঘুম আসছে না।

সকল অধ্যায়

১. ঈশ্বরের বাগান – ১
২. ঈশ্বরের বাগান – ২
৩. ঈশ্বরের বাগান – ৩
৪. ঈশ্বরের বাগান – ৪
৫. ঈশ্বরের বাগান – ৫
৬. ঈশ্বরের বাগান – ৬
৭. ঈশ্বরের বাগান – ৭
৮. ঈশ্বরের বাগান – ৮
৯. ঈশ্বরের বাগান – ৯
১০. ঈশ্বরের বাগান – ১০
১১. ঈশ্বরের বাগান – ১১
১২. ঈশ্বরের বাগান – ১২
১৩. ঈশ্বরের বাগান – ১৩
১৪. ঈশ্বরের বাগান – ১৪
১৫. ঈশ্বরের বাগান – ১৫
১৬. ঈশ্বরের বাগান – ১৬
১৭. ঈশ্বরের বাগান – ১৭
১৮. ঈশ্বরের বাগান – ১৮
১৯. ঈশ্বরের বাগান – ১৯
২০. ঈশ্বরের বাগান – ২০
২১. ঈশ্বরের বাগান – ২১
২২. ঈশ্বরের বাগান – ২২
২৩. ঈশ্বরের বাগান – ২৩
২৪. ঈশ্বরের বাগান – ২৪
২৫. ঈশ্বরের বাগান – ২৫
২৬. ঈশ্বরের বাগান – ২৬
২৭. ঈশ্বরের বাগান – ২৭
২৮. ঈশ্বরের বাগান – ২৮
২৯. ঈশ্বরের বাগান – ২৯
৩০. ঈশ্বরের বাগান – ৩০
৩১. ঈশ্বরের বাগান – ৩১
৩২. ঈশ্বরের বাগান – ৩২
৩৩. ঈশ্বরের বাগান – ৩৩
৩৪. ঈশ্বরের বাগান – ৩৪
৩৫. ঈশ্বরের বাগান – ৩৫
৩৬. ঈশ্বরের বাগান – ৩৬
৩৭. ঈশ্বরের বাগান – ৩৭
৩৮. ঈশ্বরের বাগান – ৩৮
৩৯. ঈশ্বরের বাগান – ৩৯
৪০. ঈশ্বরের বাগান – ৪০
৪১. ঈশ্বরের বাগান – ৪১
৪২. ঈশ্বরের বাগান – ৪২
৪৩. ঈশ্বরের বাগান – ৪৩
৪৪. ঈশ্বরের বাগান – ৪৪
৪৫. ঈশ্বরের বাগান – ৪৫
৪৬. ঈশ্বরের বাগান – ৪৬
৪৭. ঈশ্বরের বাগান – ৪৭
৪৮. ঈশ্বরের বাগান – ৪৮
৪৯. ঈশ্বরের বাগান – ৪৯
৫০. ঈশ্বরের বাগান – ৫০
৫১. ঈশ্বরের বাগান – ৫১
৫২. ঈশ্বরের বাগান – ৫২
৫৩. ঈশ্বরের বাগান – ৫৩
৫৪. ঈশ্বরের বাগান – ৫৪
৫৫. ঈশ্বরের বাগান – ৫৫
৫৬. ঈশ্বরের বাগান – ৫৬
৫৭. ঈশ্বরের বাগান – ৫৭
৫৮. ঈশ্বরের বাগান – ৫৮
৫৯. ঈশ্বরের বাগান – ৫৯
৬০. ঈশ্বরের বাগান – ৬০
৬১. ঈশ্বরের বাগান – ৬১
৬২. ঈশ্বরের বাগান – ৬২
৬৩. ঈশ্বরের বাগান – ৬৩
৬৪. ঈশ্বরের বাগান – ৬৪
৬৫. ঈশ্বরের বাগান – ৬৫
৬৬. ঈশ্বরের বাগান – ৬৬
৬৭. ঈশ্বরের বাগান – ৬৭
৬৮. ঈশ্বরের বাগান – ৬৮
৬৯. ঈশ্বরের বাগান – ৬৯
৭০. ঈশ্বরের বাগান – ৭০
৭১. ঈশ্বরের বাগান – ৭১
৭২. ঈশ্বরের বাগান – ৭২
৭৩. ঈশ্বরের বাগান – ৭৩
৭৪. ঈশ্বরের বাগান – ৭৪
৭৫. ঈশ্বরের বাগান – ৭৫
৭৬. ঈশ্বরের বাগান – ৭৬
৭৭. ঈশ্বরের বাগান – ৭৭
৭৮. ঈশ্বরের বাগান – ৭৮
৭৯. ঈশ্বরের বাগান – ৭৯
৮০. ঈশ্বরের বাগান – ৮০
৮১. ঈশ্বরের বাগান – ৮১
৮২. ঈশ্বরের বাগান – ৮২
৮৩. ঈশ্বরের বাগান – ৮৩
৮৪. ঈশ্বরের বাগান – ৮৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন