অযোধ্যা নিয়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতাও প্রকট। অযোধ্যার বিষয়টি বিচারাধীন। হিন্দু-পরিষদ বা ঐ জাতীয় প্রষ্ঠিানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যা ‘বিশ্বাসের বিষয়’তাতে বিচারালয়ের হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছনীয়। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা হিন্দুপরিষদের যুক্তি না মেনে বিচারের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার পক্ষপাতী। নিজেদের দাবির স্বপক্ষে হিন্দুপরিষদ অযোধ্যায় বিতর্কিত ভূখণ্ডে মন্দিরের অস্তিত্বের কথা বললেও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। আদালত যখন মন্দিরের দাবির সত্যতা খুঁজে দেখবার জন্য সঙ্গত কারণেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে মাটি খুঁড়ে দেখতে বলেছেন, তখন স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ ইরফান হাবিব কিংবা রোমিলা থাপার সদলবলে ওখানে গিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পরার আশঙ্কায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করে আগেই দেখিয়ে দিলেন যে সত্যের মুখোমুখি হবার জন্য তাঁরা আদৌ উৎসাহী নন। একে গণতন্ত্র কিংবা সত্যতার বিরুদ্ধে ধষ্টামো ছাড়া আর কি-ই বা বলা যেতে পারে?
সন্ত্রাসবাদী এই অভিযোগে ধৃত সৈয়দ আবদুল রহমান জিলানীকে আদালত শাস্তি দিলেন। এই শাস্তির আদেশের বিরুদ্ধে নিজেদের দ্বিমত পোষণ করতে গিয়ে রজনী কোঠারী, অরুন্ধতী রায় প্রমুখ এমনকী বিচারকের রায় ভুল বলেও মন্তব্য করলেন। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করার নানা উপায় থাকা সত্বেও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যকে কেন আদালত অবমাননা বলে ধরা হবেনা? সাধারণ মানুষ এরকম বললে তার কি অবস্থা হতো?
ইদানীং উগ্র (Ultra) ধর্মনিরপেক্ষদের কাছে এমনকী প্রগতিশীল ও বামপন্থী বলে পরিচিত শিল্পী-সাহিত্যিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না। ঋত্বিক ঘটক সাবেক পূর্বপাকিস্তানের থেকে উৎখাত হওয়া উদ্বাস্তুদের নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী করেছেন তাতেও অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পেয়ে নাসিকা কুঞ্চন করছেন। ঋত্বিক ঘটক তাঁর নির্দেশিত চলচ্চিত্রে হিন্দু আইকন (?) ব্যবহার করেছেন এমন অনুযোগ করেছেন এক বন্ধুস্থানীয় লেখক তাঁর রচনায়। (যুক্তি-তর্ক-ঋত্বিক-সুগত সিংহ)
কেউ হিন্দুসমাজের ছবি আঁকলে মুসলমানদের বঞ্চনা করছেন, সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট হচ্ছেন। মুসলমান সমাজের ছবি আঁকতে গিয়ে কোন কুশ্রীতা নির্দিষ্ট করলেও সাম্প্রদায়কি আখ্যা পাচ্ছেন! এ যে হীরের ধারের অবস্থা!
আসলে এসবই মুসলমান তোষণের এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আদর্শ, কর্মপ্রণালী নিয়ে মতভেদ আছে। বহু বিষয়ে এদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। এমনকী অতি সম্প্ৰতি সংগঠনটির সর্বোচ্চ পদাধিকারী এদেশের জনভারসাম্য বজার রাখার জন্য হিন্দুদেরকে বহু সন্তান জন্ম দেবার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাকে কেউ যদি ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’ বলে চিহ্নিত করতে চান, তাহলেও তাকে এককথায় নিন্দুক বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। বস্তুত জনসংখ্যাধিক্যের যে সমস্যা মুসলমানদের পশ্চাদগামিতার অন্যতম কারণ, হিন্দুদেরকেও তা আঁকড়ে ধরতে বলা কিছুতেই, এমনকী কোনো গভীর সমস্যারও, প্রতিবিধান হতে পারেনা। এবিষয় নিয়ে বাদানুবাদ চলবেই। কিন্তু গান্ধী হত্যার সঙ্গের রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘকে জড়িয়ে নিন্দামন্দ করার যৌক্তিকতা কোথায়? ‘The Statesman’ পত্রিকার সম্পাদক ইরানীকে তাঁর পত্রিকায় গান্ধী হত্যার সঙ্গে অর.এস.এসকে জড়িয়ে সম্পাদকীয় লেখার জন্য আদালতের নির্দেশে ক্ষমা চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছে। যদি বলা হয় যে আদালতের চুলচেরা বিচারের ফাঁকে আর.এস.এস রেহাই পেয়েছে, তাহলেও বিষয়টি নিয়ে এখন অন্তত আর কোন বিতর্কের অবকাশ থাকে না বিশেষত বিশিষ্ট গবেষক ডঃ আশিস নন্দীর গবেষণা প্রকাশিত হবার পর
প্রসঙ্গত আশিস নন্দী কি বলেছেন তা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা যাচ্ছে না। নচেৎ আর.এস.এস-এর ধ্বজা ওড়ানোর অভিযোগ ওঠার সম্ভাবনা প্রবল।
গান্ধী হত্যাকাণ্ডের নায়ক নাথুরাম গডসের সম্পর্কে শ্রীনন্দী লিখেছেন :-“আর.এস.এস. যথেষ্ট জঙ্গী বলে মনে হয়নি তার, সে জন্য বছর খানেকের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন সংগঠন “হিন্দু রাষ্ট্র দল’ গঠন করেন।” (গান্ধী পরিক্রমা, পৃ-৩৮৪)
ডঃ নন্দী, আর.এস.এস কিংবা তার ধারে কাছে রয়েছে এমন কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এমন কথা সম্ভবত তাঁর পরম শত্রুও বলতে পারবেন না।
গত ৬.৩.২০০৩ এ আনন্দবাজার পত্রিকায় ধান্দাবাজ রাজনৈতিক পিগমীদের হাতে এটাই ভবিতব্য শিরোনামে সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় যখন লেখেন :-গোধরার জঘন্য ঘটনার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের নিন্দাও কেবলই কেতাবি। ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে যেসমস্ত কংগ্রেস নেতা ধরা পড়েছেন, রাজ্য বা কেন্দ্রের দলের নেতৃত্ব তাদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত রা কাড়েননি পাছে সংখ্যালঘু ভোট নষ্ট হয়ে যায়” তখন অন্তত এইজন্যও তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয় যে মূল সমস্যার লেজ ধরে সামান্য টানটুকু অন্তত তিনি দিয়েছেন। অবশ্য সুমনবাবুও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সত্যান্বেষী সাংবাদিকদের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেননি তা তার অন্যান্য লেখাতেই স্পষ্ট।
পাছে ‘হিন্দু’—এই অপবাদে কোণঠাসা করা হয় এ ভয়ও আজ অনেকের মনে বদ্ধমূল হয়েছে।
শুধু যে মিথ্যাচার করেই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অথবা সাংবাদিকরা ক্ষান্ত হচ্ছেন তা নয়, অযৌক্তিক তোষণ নীতি চালাতে গিয়ে এমন সব কাণ্ড করছেন যার প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেতে বাধ্য।
অতি সম্প্রতি আচার্য নন্দলাল বসুর আঁকা ছবির বিশ্লেষণ করে একদল সাম্প্রদায়িকতা আবিষ্কার করেছেন। নন্দলাল বসুর আঁকা ছবিতে যথেষ্ট মুসলমান চরিত্র নেই—এই হাস্যকর অভিযোগ করতেও লজ্জিত হচ্ছেন না এরা।
এইভাবে ভারতীয় শিল্পী-সহিত্যিকদের মধ্যে কত সাম্প্রদায়িকতা আছে তা প্রমাণ করার জন্য এরা যেন ‘কার আগে প্রাণ কে করিবে দান।’
ছৌ নাচ বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে ‘গণেশ বন্দনা’ সরিয়ে দিয়ে তাকে খণ্ডিত করার বিষয়টি আগেই উল্লিখিত হয়েছে। ইসলামের নামে যে সব অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে ভারতবর্ষে সে সমস্ত ইতিহাসের বই থেকে সরিয়ে দেবার জন্য ১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে (সারকুলার নং এস.ওয়াই.এল /৮৯ / ১ তারিখ ২৮.৪.৮৯)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস বদল করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচীতে জয়প্রকাশ নারায়ণের আদর্শবিষয়ক ৫০ নম্বরের বদলে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহমেদের চিন্তাধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। (যুগের ডাক-১৬.৩.২০০২)
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে সৈয়দ আহমেদের হিন্দু-মুসলমানবিষয়ক দ্বিজাতি-তত্বের ইতিহাস অগ্রাহ্য করা হবে কেন?
সাংবাদিক অনিন্দ্য জানা আনন্দবাজারে “সাইফিজ আহমেদ? মুসলমান? প্রবলেম আছে ভাই, হলনা” লিখে হিন্দুবাড়িতে মুসলমানকে বাড়ি ভাড়া দেবার ব্যাপারে অনীহার কথা লিখেছেন।
‘মুসলমান’ হিন্দুর কাছে অন্তত শহরে অচ্ছ্যুৎ, বিশেষত কলকাতার মতো শহরে একথা শতকণ্ঠে শ্লোগান তুললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। নিজাম সিরাজ, আমিনিয়ায় ক’জন হিন্দু খেতে যায় এবং ক’জন মুসলমান খেতে যায়, সেই পরিসংখ্যান অনিন্দ্যবাবুর নেওয়া উচিত ছিল। যাইহোক অনিন্দ্যবাবু কিন্তু অনীহার কারণ অনুসন্ধান করতে মোটেও উৎসুক নন। যদিও বেশী গবেষণা করার দরকার নেই। তিনি যে জগতের সঙ্গে যুক্ত অথবা অন্য যে কোন খবরের কাগজে প্রকাশিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের নামগুলির প্রতি (খুব বেশী হলে সাতদিন) যদি নজর দিয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে অপরাধীদের অনুপাতের তুলনামূলক পরিসংখ্যান নেন, তাহলে বুঝতে পারবেন মুসলমানকে বাড়ি ভাড়া দেবার বিষয়ে হিন্দুর অনীহার কারণ।
অনিন্দ্যবাবুর বর্ণিত আপাত দৃষ্টিতে, গোলমেলে নয়, দেখতে-শুনতেও চমৎকার তো দূরস্থান, সমাজে অতি উঁচু জায়গায় রয়েছেন এমন মুসলমানকে হিন্দুদের পক্ষে বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়, যখন তারা দেখেন যাকে একজন প্রতিষ্ঠিত দেশপ্রেমিক বিধায়ক বলে জানতেন তিনি একজন বিদেশী চরের সহায়ক (প্রতিদিন-১২.১২.২০০৩), যাকে মাদ্রাসার এক সম্মানিত প্রধানশিক্ষক বলে জেনেছেন তিনি রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের হোথা (আনন্দবাজার-২৭.৩.০৩), যাকে বহুদিন প্রিয় খোলোয়াড় বলে জেনেছেন তিনি একজন পাকিস্তানি এজেন্ট (প্রতিদিন-৯.১২.০৩) এবং এরা সবাই মুসলমান, তখন হিন্দু বাড়িওয়ালা সম্ভাব্য ঝামেলা এড়ানোর জন্য আপাতদৃষ্টিতে ভালো মুসলমান সাইফিজ আহমেদ কে ভাড়া দিতে অস্বীকার করবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।
এখানে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা রে-রে করে উঠবেন তা বলা বাহুল্য। হিন্দু অপরাধী হয় না? ধর্ষক হয় না? খুনী হয় না?
অবশ্যই হয়, একশো বার হয়। কিন্তু সবচাইতে ঘৃণ্য দেশদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী হন অতি সামান্যই। আসলে এবিষয়টি যথার্থ ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়কেও ভাবতে হবে গুরুত্ব সহকারে।
এদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বাল ঠ্যাকারেকে ফাঁসি দেবার দাবি জানিয়েছেন বহুবার। মইনুল হাসানকে ‘ধর্মদ্রোহী’ বলে লোক খেপিয়ে তুলছেন যে সব ইমামরা তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন কি?
কাশ্মীর থেকে লক্ষাধিক হিন্দু বিতাড়িত হয়ে দিল্লীতে উদ্বাস্তুর জীবনযাপন করছেন। এদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের জন্য একটি লাইনও কোথাও খরচ করেননি তাদের লেখায়। প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত এদের ভালোবাসা মানুষের জন্য? না শুধুই মুসলমানের জন্য?
তথাকথিত প্রগতিশীল হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিশিষ্ট মুক্তমনা প্রবন্ধকার পাঁচু রায় যখন বলেন যে এরা :-“মুসলমানদের চেয়ে বেশী ইসলাম ভক্তি দেখান” (দর্পণে মুক্তমন-শারদসংখ্যা ১৪১২)—তখন বোঝা যায় উদ্দেশ্যমূলক মনোবৃত্তি ক্রমশঃ ধরা পড়ছে।
অতি সম্প্রতি আরও একটি বিষয় নিয়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক বিচিত্র মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি ভারতবর্ষে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরী করার প্রস্তাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
সংবিধানের ৪৪তম ধারায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বলা হয়েছিল ভারতবর্ষের জটিল জাতিব্যবস্থার কথা মনে রেখেই। সংবিধান প্রণেতারা গোড়াতেই এই ধরনের একটি বিধি দেশকে দিতে না পারলেও এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভেবেছিলেন সঙ্গত কারণেই। দেশবিভাগোত্তর ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সমস্যা ও সামাজিক অসাম্য দূরীকরণে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ইদানীং কিছু মানুষ সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় উল্লিখিত প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ ধর্মপালনের অধিকার ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলবার অধিকারের সঙ্গে ৪৪ নম্বর ধারার বিরোধ আবিষ্কার করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির যৌক্তিকতাকেই নস্যাৎ করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। অল ইণ্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সুরে সুর মিলিয়ে এরাও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবিকে সংবিধানের প্রদত্ত মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করছেন। সংবাদপত্রে দু’কলম লেখা উঠতি সাংবাদিকরাই আবার এজাতীয় কুযুক্তিতে বেশী করে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। দু’কলম লেখার সুবাদেই এরা পোড়খাওয়া, বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সংবিধান প্রণেতাদের চাইতেও বেশী বিজ্ঞ মনে করছেন নিজেদেরকে।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী একবার মন্তব্য করেছিলেন :-“সাংবাদিকতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুর্খের পাণ্ডিত্য প্রকাশ।”
এতটা কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা অনুচিত হলেও ঐ সমস্ত উঠতি সাংবাদিকদের যুক্তি শুনলে ভিরমি খেতে হয়।
জনৈকা সেমন্তী ঘোষ গত ৯ই ফেব্রুয়ারী, ২০০৬ এর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ভারতীয় সংবিধানের মূল সুর যে ‘রাষ্ট্রের চোখে প্রতিটি নাগরিক সমান ‘ একথা মেনে নিয়েও বললেন :-“ভারত অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রের থেকে তাই এত আলাদা, অত্যন্ত বিশেষ রকমের,তাই ভারতের ক্ষেত্রে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সোজাসাপটা প্রচলন বিপজ্জনক হতেই পারে।”
শ্রীমতী ঘোষ ‘অত্যন্ত বিশেষ রকমের’ বিশেষণ প্রয়োগ করে অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রের থেকে ভারতবর্ষকে আলাদা বলেছেন তাতে কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু সমগ্র পৃথিবীতে ভারতবর্ষ এই জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে কি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’? তাছাড়া ভারতবর্ষের এই চরিত্র হঠাৎ করে তৈরী হয়েছে এমন নয়। এই চরিত্রের কথা মাথায় রেখে কিছু রাষ্ট্রনেতা বিশেষ সম্প্রদায়কে খিলাফত, পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার যে সব ঘুষ দিয়েছেন তাতেই কি শেষ রক্ষা হয়েছে? চানক্য শ্লোক–“ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি। হবিষা কৃষ্ণবর্থেব ভূয়ঃ একাভিবর্ধতে”, ব্যক্তিজীবনের মতো রাষ্ট্রীয় অধিকার লাভের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযুক্ত। বলা বাহুল্য পাকিস্তান সৃষ্টি এরই জ্বলন্ত উদাহরণ ছাড়া আর কিছু নয়। এরই ফলে শুধুমাত্র মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য কেরালাতে আলাদা জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মায়লাপূরম অঞ্চলকে।
আইন তৈরীর বিষয়টি তো সোজাসাপটাই হবে। শম্বুক গতিতে কোন বিধি কিভাবে তৈরী করা যায়? তাছাড়া যে কোনো দেশে যে কোনো বিধি বা আইন তৈরীর বিরুদ্ধে একদল লোক বিরোধিতার জন্য তো থাকবেই এবং এটিই স্বতঃসিদ্ধ। সতীদাহ তুলে দেবার জন্য লর্ড বেন্টিঙ্ক যে সাহস দেখাতে পেরেছিলেন, স্বাধীন দেশের সরকার তা পারছেন না কারণ এদেশে গণতন্ত্রে কোন সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর ভোট হারাবার ঝুঁকি নেওয়া সহজ নয়।
জনৈকা রুচিরা গোস্বামী গত ২৬শে জানুয়ারী, ২০০৬এ ‘আনন্দবাজার’-এ প্রবন্ধ লিখে প্রশ্ন তুলেছেন :-“কার সমস্যা, কার মাথাব্যথা।” শ্রীমতি গোস্বামী স্পষ্টতই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বি.জে.পি এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলির দাবির প্রতি ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন।
এধরনের মানসিকতা আরও বেশী বিপজ্জনক। রোগের ওষুধ জেনেও যেহেতু আমর শত্রু ঐ ওষুধেই নিদান খুঁজছে, তাই রোগী মরুক কিংবা বাঁচুক শত্রুর পছন্দের ওষুধ কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই জাতীয় মানসিকতা এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার নামে মৌলবাদকে উৎসঙ্গ করে বসে। এরাই বাড়ান অসহিষ্ণুতা এবং এ থেকে ক্রমশঃ তৈরী হয় ধর্মমোহ। ধর্মমোহে মানুষ মানুষকে মারে, নিজেও মরে তাই তো স্বাভাবিক।
সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারা ও ৪৪ নম্বর ধারার মধ্যে বিরোধ তৈরী করে যারা কুট তর্কে ৪৪ নম্বর ধারাকে সংশোধনের মাধ্যমে উৎপাটিত করতে চান, তাদের দাবিকে উদ্বেগজনক’ মন্তব্য করে গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ২০০৬ তারিখে প্রকাশিত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদকীয়টি তুলে ধরা প্রয়োজন। এতে বলা হয়েছে :-“যুক্তির অবতারণা কঠিন কাজ নহে, যে কোন নৈতিক বা রাজনৈতিক অবস্থানকেই যুক্তি, এমনকী সাংবিধানিক যুক্তি দিয়া প্রতিষ্ঠা করাই যায়। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে সে যুক্তি স্যুক্তি। মৌলিক অধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, কিন্তু ঠিক তেমনই, কিংবা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ, ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় চরিত্রটি। ভূমিকা হইতে উপসংহার পর্যন্ত সংবিধানের সর্বত্র এই বিশ্বাস ওতপ্রোত ভাবে প্রোথিত যে, ভারতীয় রাষ্ট্রের চোখে প্রতিটি নাগরিকই সমান, প্রতি নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র সমব্যবহার করিতে বাধ্য। কোনও বিশিষ্ট ধর্ম-সম্প্রদায়ের অংশ হওয়া মানে এই নয় যে রাষ্ট্রের নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের যে মৌলিক ও প্রাথমিক কর্তব্য, সেই কর্তব্যের চৌহদ্দির বাহিরে কেহ অবস্থান করিতে পারেন। যে কোনও আধুনিক দেশেই ‘ল অব দ্য ল্যাণ্ড’ বলিয়া একটি ধারণা আছে, যে কোনও নাগরিককে তাঁহার নিজস্ব ধর্মসম্প্রদায়, ভাষা সম্প্রদায় কিংবা অন্যান্য গোষ্ঠীচেতনার সঙ্গে সঙ্গে যে মৌলিক ধারণাকে স্বীকৃতি দিয়া তবে নাগরিকত্বের মূল্য চুকাইতে হয়। ইহার অন্যথা হইলে যাহা অবশ্যম্ভাবী, তাহার নাম নৈরাজ্য।”
সেমন্তী ঘোষ প্রমুখ এই যুক্তিতে ‘সহজিয়া বি জে পি মার্কা যুক্তি’র তত্বতালাশ– কিন্তু ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ অন্তত বি জে পি’র মুখপত্র তো করতে পারেন নয়ই।
তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতার কথা লিখতে বসলে শেষ টানা সহজ হবে না। বুদ্ধিজীবীদের তোলা কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে কিছু প্রশ্ন তাদের তরফে তোলা হচ্ছে যার যৌক্তিকতা বিচার করাও প্রয়োজন। এমনই একটি বিষয় নিশ্চিতভাবেই মৌলবাদ।
মুসলিম মৌলবাদ বলে একটি শব্দ বরাবরই চালু ছিল। ‘হিন্দু মৌলবাদ বলে একটি শব্দ ইদানিং চালু করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য মুসলিম মৌলবাদের বাস্তব অস্তিত্ব প্রতিপন্ন হবার প্রতিক্রিয়াতেই শব্দটির সৃষ্টি।
মৌলবাদ বা Fundamentalism এর অভিধানিক অর্থ–the strict following of true fundamental activities of any religion or system of thought. মৌলিক কিছু তথাকথিত আপ্তবাক্য সমগ্র গোষ্ঠীর বিশ্বাসের ভিত্তি হয়ে যখন সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে বিচারহীনভাবে সেই খাতে পরিচালিত করে তখনই মৌলবাদের ভিত্তি রচিত হয় বলা চলে। এই জাতীয় বিশ্বাস মোটামুটিভাবে সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয়গোষ্ঠীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সেই অর্থে ইসলাম, খ্রীষ্টান কিংবা আরো কিছু কিছু ধর্মীয়গোষ্ঠীর কিছু মৌলবিশ্বাসের জন্য তারা নিশ্চিতভাবেই মৌলবাদী। কিন্তু ‘হিন্দু’নামে যারা অভিহিত তাদের মৌলিক বিশ্বাস কি? আত্মা-পরলোক ইত্যাদি বিষয়ে হিন্দুর যে মৌল বিশ্বাস তা পৃথিবীর বহু ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষের সাধারণ বিশ্বাস। ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরপুত্র, নবী ইত্যাদি বহু ধর্মে যেমন ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’, ‘হিন্দু’ ধর্মে তেমন নয়। ‘একং সদ্ বিপ্ৰং বহুধা বদন্তি ‘কিংবা ‘সর্বং ঋদ্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানীতি’ উপনিষদের এই তত্ব ও অধিকাংশ হিন্দুর কাছে গুরুত্বহীন। তা সত্বেও কুট তর্কে না গিয়ে যদি ধরে নেওয়া যায় যে হিন্দুদেরও কিছু মৌল বিশ্বাস রয়েছে যা একান্ত হিন্দুদেরই, তাহলে তারাও নিশ্চিতভাবে ‘মৌলবাদী’র পর্যায়ে পড়বেন।
কিন্তু তাতে কি এলো বা গেলো?
নিজের মৌল বিশ্বাসে কেউ যখন বদ্ধ জলাশয়ে হাবুডুবু খান তখন বড়জোর তার সম্পর্কে করুণা হওয়া সম্ভব। কিন্তু মৌল বিশ্বাসে কেউ যখন অপর কোন মানুষকে, প্রয়োজনে তরবারীর সাহয্যে, নিজের বিশ্বাসের প্রতি আস্থাশীল করে তুলতে চান তখনই মৌলবাদ হয়ে ওঠে মানবসভ্যতার বিপদস্বরূপ। পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষই অপর ধর্মের মানুষকে নিজের ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত করতে সচেষ্ট। সেই চেষ্টায় মানুষ যে কখনো কখনো চরম নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতার পরিচয় দেয়নি তা নয়। কিন্তু এই জাতীয় কাজ ইসলামে যেমন ধর্মীয় স্বীকৃতি পেয়েছে তেমন অন্য কোনো ধর্মে ধর্মীয় স্বীকৃতি লাভ করেনি এবং এখানেই অন্য সকল ধর্মের সঙ্গে ইসলামের প্রভেদ সুস্পষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালান্তর প্রবন্ধমালার অন্তর্গত ‘হিন্দু-মুসলমান’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন :-“পৃথিবীতে দুইটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র—সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান ধর্ম। তারা নিজেদের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্য তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোনো উপায় নেই।”
রবীন্দ্রনাথ এই পর্যন্ত বলে থেমে যাননি।
বলেছেন :-“খ্রীষ্টান ধর্মাম্বলীদের সম্বন্ধে একটি সুবিধার কথা এই যে, তারা আধুনিক যুগের বাহন;তাদের মন মধ্যযুগের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। ধর্মমত একান্তভাবে তাদের সমস্ত জীবন পরিবেষ্টিত করে নেই।”
হিন্দুজাতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য :-“….তারা ধর্মের প্রকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয় অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non violent non co-operation।”
খৃষ্টান মিশনারীরা তো বটেই, নোবেল পুরস্কার বিজয়িনী ‘মাদার টেরেসা’ও ও হিন্দুদের ধর্ম পরিবর্তনের কম চেষ্টা করেননি। ছল এবং কৌশল যে এই পরিবর্তনের চেষ্টায় একান্ত সহায়ক হয়নি তা নয়। কিন্তু মানতেই হবে ‘বলপ্রয়োগ’ করা হয়েছে অতি সামান্যই।
ঘৃণার মনোভাব নিয়ে, ধর্মগ্রন্থের কিছু নির্দেশ নিয়ে ইসলাম যেভাবে নিজেদের বিশ্বাস অপরের ওপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে তরবারীর সাহায্য নিয়েছে তা অন্য কোন ধর্মের ক্ষেত্রে ঘটেছে খুব সামান্য।
দেশের অধিকাংশ মানুষ ‘কোরাণ-শরীফ’ পড়বেন না। ফলে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় অবিশ্বাসীদের জন্য ‘আল্লা’র কি নির্দেশ আছে ‘কোরণ-শরীফ’-এ।
১। “অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে অংশীবাদীদের যেখানে পাবে বধ করবে, তাদের বন্দী করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওৎ পেয়ে থাকবে। (সূরা-তওবা, আয়াত ৫)
২। “অতয়েব যখন তোমরা অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধে মোকাবিলা কর তখন তাদের গর্দানে আঘাত কর, পরিশেষে যখন তোমরা ওদের সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করবে তখন ওদের মজবুত করে বাঁধবে। (সূরা-মহম্মদ, আয়াত ৮)
৩। “যাঁরা আল্লাতে ও তাঁর রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না আমি সে সব অবিশ্বাসীদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত রেখেছি। (সূরা-ফাতাহ্, আয়াত ১৩)
এধরনের ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো অসংখ্য আয়াত ‘কোরাণ শরীফ’-এ রয়েছে। একথা অস্বীকার করা যায় না তথাকথিত কিছু হিন্দু শাস্ত্রেও শূদ্র বেদ শ্রবণ করলে তার কানের গহ্বর সীসা দিয়ে বন্ধ করে দেবার কথা বলে ঘৃণা ছড়নো হয়েছে, কিন্তু ঐ শাস্ত্রীয় বিধানকে জাহান্নামে পাঠাবার বিষয়ে অধিকাংশ হিন্দুর মধ্যেই কোন দ্বিমত নেই।
ভারতবর্ষে যারা ইসলামকে সর্বব্যাপী করতে চেয়েছেন তাদের নিজেদের কথা থেকেই আমরা ইসলামীকরণের জন্য নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচারের কথা জানতে পেরেছি। নিজেদের কৃত সেই অত্যাচারের সানুপুঙ্খ বর্ণনায় এরা বিন্দুমাত্র লজ্জিত নন। লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণের মাধ্যমে ধর্মের অনুশাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন এই বিশ্বাস ছিল তাদের দৃঢ়।
সিন্ধু অভিযানের নায়ক মহম্মদ-বিন-কাশিমের একটি চিঠি থেকে জানা যায়-রাজা দাহিরের ভ্রাতুষ্পুত্র, তাঁর সেনানী ও প্রধান সেনাপতিকে বধ করা হয়েছে এবং নাস্তিকদের (হিন্দুদের) হয় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছে, নয়তো হত্যা করা হয়েছে। পুতুলপূজার মন্দিরগুলির জায়গায় মসজিদ তৈরী করা হয়েছে। রাজা দাহিরের ছিন্নমুণ্ড সহ পাঠানো উপরোক্ত চিঠির উত্তরে পারস্যের মুসলমান রাজা তাঁর সেনাপতিকে জানিয়েছেন :-“আল্লা বলেন-নাস্তিকদের বিন্দুমাত্র ক্ষমা না করে তাদের শিরচ্ছেদ কর। এটাই আল্লার আদেশ।”
গজনীর মামুদ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক আল উতবি লিখেছেন :-“তিনি মন্দির ধ্বংস করে ইসলামের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নগরগুলি অধিকার করেছেন, পৌত্তলিক ও বিধর্মীদের হত্য করেছেন…………।”
বখতিয়ার খিলজি বিহার অধিকার করে কিভাবে হিন্দুদের হত্যা করেন তার বর্ণনা রয়েছে তাবাকাত-ই-নাসিরির রচনায়
বাবা সাহেব আম্বেদকার যথার্থই বলেছেন :-“তাদের (মুসলমান শাসক) মধ্যে পারস্পরিক অসূয়া থাকলেও হিন্দুদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে তারা ছিলেন ঐক্যবদ্ধ।”
নরহত্যা হিন্দুধর্মের নামে কখনো হয়নি, এমন অনৈতিহাসিক ধারণা যথার্থ নয়। কিন্তু এই হত্যার জন্য গর্ববোধ করা হিন্দুর পক্ষে সহজ নয়, কারণ হিন্দুসমাজে হত্যাকারীকে ‘হত্যাকারী’র অধিক মর্যাদা দেয়নি। বিধর্মী হত্যা করার জন্য, তার জন্য বেহসতে ‘আনতনয়না শয্যাসঙ্গিনী’সহ কোমল শয্যা রচনা করেনি।
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে মৌলবাদ বহু ধর্মেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য হওয়া সত্বেও ইসলামের মৌলবাদ যেভাবে মনুষ্যত্বের অবমাননা করেছে অন্য যে কোন ধর্মে তার ব্যপকতা ছিল অনেক কম হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে তা প্ৰায় অস্তিত্বহীন।
হিন্দুরা কখনও আক্রমণকারী নন– একথা অন্য কারও নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের।
“অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non violent non co-operation।”–রবীন্দ্রনাথ একথা যখন লেখেন তখন ইতিহাস নির্ভরতা ছাড়া বাস্তব ঘটনা ও সত্য উপলব্ধ আপন অভিজ্ঞতার উপর আদৌ নির্ভর করেননি, সেকথা অন্তত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলার অবকাশ নেই।
ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়লে দেখা যাবে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের পরে হিন্দুধর্মের প্লাবনে বৌদ্ধধর্মকে ভাসিয়ে নেবার যে কথা বলা হয় তা কিন্তু রাজানুগ্রহ কিংবা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাকেই একমাত্র সম্বল করেনি। অজাতশত্রু নেহাতই ব্যতিক্রম এবং তাঁর সম্পর্কেও যে সকল কাহিনী প্রচলিত, বহু ঐতিহাসিক তার যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন।
ইদানীং অবশ্য হিন্দুদের তরফে প্রতিআক্রমণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কেন ভেবে দেখা হবে না স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যে হিন্দুদের সম্পর্কে বলছেন :-“প্ৰয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারেনা।”—সেই হিন্দু আজ প্রয়োজনে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ছে। যেখানে তারা সংখ্যাগুরু, সেখানে পালিয়ে না গিয়ে মার দিতে চেষ্টা করছে। নৈতিকতার মানদণ্ডে প্রশংসাসূচক না হলেও বাস্তবতার মানদণ্ডে বিষয়টি একেবারেই নিন্দনীয় বলা যাবে কি?
এই বিষয়টি লক্ষ্য করেই কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীকে বলতে শোনা যায় “হিন্দুরাও কম নয়।”
যেন কম হলেই ভালো হতো! মার খেয়ে প্রতিরোধ গড়ে না তুললেই হিন্দুর মহানুভবত্ব বজায় থাকতো, এ দায় যেন হিন্দুরই একচেটিয়া!
ইসলামের মৌলবাদ আজ শুধু ভারতবর্ষের নয়, সমগ্র বিশ্বের সামনে সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বহু মসজিদ এবং মাদ্রাসা হয়ে উঠছে মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের আখড়া। (আনন্দবাজার-২২.১.২০০৩ এবং 27.3.2003)
মসজিদ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে নানা ধরনের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। ওগুলি ধর্মাচারণের কোন কাজে লাগে তা বলতে পারবেন একমাত্র তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাই!
পশ্চিমী দেশগুলি তো বটেই এমনকী কমিউনিষ্ট চিনেও মুসলিম মৌলবাদীদের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। এবছরই চিনের জিনজিয়াং অঞ্চলে এক বাসে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ১২জন সাধারণ মানুষকে। একই দিনে উরুমকিতে মুসলিম মৌলবাদীরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করছে দুজনকে।
ভারতবর্ষে ইসলামী মৌলবাদের বাড়বাড়ন্তকে হিন্দুত্ববাদীদের কাজকর্মের প্রতিক্রিয়া বলে ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাতে অভ্যস্ত তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয়ই বলবেন না, চিনে মুসলিম মৌলবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে কমিউনিষ্ট মৌলবাদীদের কাজকর্মের প্রতিক্রিয়ায়।
অবস্থা আজ এমন পর্যায়ে গেছে যে এমনকী চিন সরকার চিরাচরিত সীমান্ত সমস্যা অথবা বাণিজ্যবিষয়ক আলোচনা ছেড়ে ইসলামী মৌলবাদের বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক মতবিনিময় শুরু করেছে। (আনন্দবাজার-২৫শে জানুয়ারী, ২০০৫)
হল্যাণ্ডের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক থিও ভ্যান গঘ তাঁর পরিচালিত ‘সাবমিশন’ ছবিটিতে একজন মুসলিম মহিলাকে জোর করে অসুখী দাম্পত্যের মুখে ঠেলে দেওয়ার বিষয়কে উপজীব্য করায় মুসলিম সম্প্রদায়ের রোষের মুখে পড়েন। ২০০৪ খ্রীষ্টাব্দের ২রা নভেম্বর তাঁকে গুলি করে হত্যা করে মুসলিম মৌলবাদীরা।
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, বৃটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, কমিউনিষ্ট চিন কিংবা মুসলমান প্রধান মিশর, ইন্দোনেশিয়াও আজ ইসলামী মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত।
পৃথিবীর যেখানে ইসলামের নামে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়েছে সেখানেই মুসলিম মৌলবাদীরা অস্ত্র ধরেছে।
সলমন রুশদি, তসলিমা নাসরিন, শাহরিয়র কবীর–এদের ঘটনা ব্যতিক্রম নয়।
মুসলিমদের মধ্যে কোরাণের জেহাদি তত্ব ও অবিশ্বাসীদের প্রতি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে অধিকাংশ মুসলমানদের বিশ্বাস এত বেশী যে মেদিনীপুর জেলায় সি.পি.এম এবং তৃণমূল কংগ্রেস যতই বিবাদ করুন না কেন, তসলিমাকে ঐ শহরে যেতে বাধা দেবার ব্যাপারে সবাই একমত। এবিষয়ে মেদিনীপুরের বামপন্থী পুরপ্রধান কিংবা তৃণমূলী নেতাদের বিবৃতি প্রমাণ করেছে মৌলবাদীদের চিন্তা এখন শুধু ছাপমারা মৌলবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। (আনন্দবাজার-২৮.৪.০৫)
ধর্ম এমনভাবে মুসলমানদের জীবনকে আচ্ছন্ন করে আছে যে সমাজ সংস্কারের কথা বলেলেও ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়। সংস্কারমনস্ক মুসলমানকে ‘মুর্তাদ’ বলে একঘরে করা হয় ধর্মগ্রন্থের বিধি মেনে।
সি.পি.এমের মইনুল হাসানকে ‘অধার্মিক’ বলে নির্বাচনে হারিয়ে দিচ্ছেন একশ্রেণীর মুসলমানেরা। মইনুল হাসানের অপরাধ তিনি ‘মুসলিম সমাজ কয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা’ পুস্তিকায় শরিয়াতি আইন পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন ইরাক, ইরাণ প্রভৃতি মুসলমান দেশের উদাহরণ টেনে এনে।
হিন্দুধর্মের প্রবক্তারা গো-হত্যার বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন কিংবা পূজায় ‘বলি’ বজায় রেখে গো-হত্যা বন্ধের জন্য আন্দোলন নিতান্তই ভণ্ডামী—(অবশ্য ‘বলি’ বন্ধ করা তথাকথিত ধর্মাচারণবাদীদের নিতান্তই রুচির বিষয়, গোহত্যা দেশের সামগ্রিক শান্তিশৃঙ্খলা সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত)—একথা বললে আমার বিরুদ্ধে ফতোয় জারি হবে না। এ বিষয়ে আমার বিশ্বাস ব্যক্ত করলে তথাকথিত হিন্দু মৌলবাদীরা আমার নিন্দা করবেন, অভিসম্পাত দেবেন, কিন্তু ‘শিরচ্ছেদ’ করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করবেন না, এ একেবারে একশো শতাংশ নিশ্চিত
এই যে সুনীল গাঙ্গুলী কৃষ্ণ, কালী, সরস্বতী প্রভৃতি হিন্দু দেব-দেবী নিয়ে আপত্তিকর রচনা লিখে লেখার ব্যবসা ফাঁদলেন তার জন্য সুনীলবাবুর চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে কি তথাকথিত হিন্দুমৌলবাদীদের ফতোয়ায়? ‘হিন্দু’প্রধান দেশে ইসলামের অন্যায়ের সমালোচনা করার জন্য মুসলিমদের বিক্ষোভের ভয়ে তসলিমা নাসরিনের যাতায়াত নিরাপদ করতে পুলিশী পাহারা নিতে হলো।
সরস্বতীর নগ্ন চিত্র আঁকার জন্য মকবুল ফিদা হুসেনের সমালোচনা হলেও তাঁকে পুলিশী পাহারা নিয়ে ঘোরাফেরা করতে হয় না তথাকথিত ‘হিন্দুমৌলবাদী’ অধ্যুষিত আহমেদাবাদ, মুম্বই কিংবা ভোপালে।
সারা পৃথিবী জুড়ে যে ঝড় উঠেছে তা থেকে বাঁচবার জন্য তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বালিতে মুখ গুঁজে নিস্তার পাবেন না। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী যদি ‘হিন্দু মৌলবাদ’ থেকেও থাকে তাহলেও বিশ্বত্রাস মুসলিম মৌলবাদের সঙ্গে একে মিলিয়ে মৌলবাদের প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে মানুষকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করলে তারা তাদের সন্তান-সন্ততিদেরও বিপদগ্রস্ত করবেন।
হিন্দুসমাজে এমনকী বস্তুবাদী নাস্তিক চার্বাক দর্শনের স্থান আছে। হিন্দুধর্ম বলে যা বলা হয় তা মৌলবাদী হলে মূল স্রোত থেকে সরে যাওয়া শাক্যমুনিকে অবতারের মর্যাদা দিতে পারত না। মনে রাখতে হবে আধুনিকতায় বিশ্বাসী একালের খৃষ্টধর্মও প্রোটেস্টান্ট মার্টিন লুথারকে মেনে নেয়নি। ইসলামও বাহাই, সূফিকে ধর্মদ্রোহীতা বলেই চিহ্নিত করেছে।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ইসলামী মৌলবাদ ক্রমশঃ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিলেত কিংবা আমেরিকাকে খুব শীগ্গিরই ‘দার-উল-ইসলাম’-এ পরিণত করার সম্ভাবনা কম। কিন্তু ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থান, সামাজিক অবস্থা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা এ দেশকে ‘দার-উল-হারার্’ থেকে ‘দার-উল-ইসলাম’-এ পরিণত করার জন্য আদর্শ।
এদেশে প্রতিবেশী মুসলিম দেশ থেকে মুসলমান অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের একান্ত অনীহা, ভারতবর্ষের সংবিধানের ৪৪নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সমস্ত নাগরিকের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানী বিধি তৈরীতে মুসলমানদের একটি বড় অংশের বাধাদানে রাজনৈতিক দল ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ইন্ধন জোগানো ছাড়াও প্রকাশ্যে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ চালানোর যে সুবিধা–তা নিশ্চিতভাবে ইসলামী মৌলবাদের বড় সহায়।
রিয়াধ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ আহমেদ টোটেজী তো উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে জামাত-ই-ইসলামের অনুষ্ঠানে তাৎপর্যভাবে উল্লেখ করেছেন যে ভারতবর্ষে মুসলমানরা বিশ থেকে পঁচিশ কোটিতে পৌঁছলে এদেশে ইসলামী আইন স্থায়ী করা কঠিন হবে না।
ধর্মের আফিং-এ বুঁদ হয়ে থাকা ইসলামী মৌলবাদের স্বরূপ বুঝতে হলে ‘কোরাণ শরীফ’ ও ‘হাদিশ শরীফ’-এর আলোচনা অবশ্যম্ভাবী ভাবে চলে আসে। সারা বিশ্বের সর্বত্র মুসলমানরা যেভাবে ধর্মকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছে, তার মুল অনুপ্রেরণা কোথায় তা বোঝার জন্য কোরাণ-হাদিশ-এর পর্যালোচনা প্রয়োজন।
একথা বলা উদ্দেশ্য নয় যে ‘কোরাণ শরীফ’-যা সমগ্র মুসলমান সমাজের ব্যক্তিগত, সামাজিক, ধর্মীয়জীবনের প্রধান প্রেরণা সেই গ্রন্থখানি আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত অগ্রহনীয়
একথা একশ্রেণীর সমালোচকের তরফে বলা বয়ে থাকে যে ‘কোরণ শরীফ’-এর যা কিছু ভালো তা নিতান্তই আপতিক। নবীর মাধ্যমে আল্লার যে বাণীর কথা বলা হয় তা নিতান্তই নবীর ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। পালিত পুত্র জায়েদের স্ত্রী জয়নাবকে বিবাহ করার বিষয়ে নবীর প্রতি আল্লার আধ্যাদেশের বিষয়টি উত্থাপন করে সমালোচকেরা তাঁদের যুক্তির ভিত্তি রচনা করেন। তাঁদের যুক্তি যদি মেনেও নেওয়া যায় তাহলেও একথা কিভাবে অস্বীকার করা যাবে যে একজন এমনকী খুব অসৎ মানুষও যখন ‘ভালো’ রামকে ভালো বলেন তখন তিনি অসৎ বলেই রাম ‘খারাপ’ হয়ে যেতে পারে না। সমালোচনাকেও যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
কিন্তু ‘কোরাণ শরীফ’-এর সমালোচকদের এ বক্তব্যও যথার্থ যে ‘কোরাণ শরীফ’-এ যেভাবে অন্যধর্মের মানুষদের প্রতি ঘৃণার মনোভাব পোষণ করা হয়েছে, তাদের জন্য ইহজগতে তো বটেই, পরজগতেও শাস্তির আয়োজন করা হয়েছে, তা গ্রন্থখানির যাবতীয় ভালোকেও কলুষিত করেছে। ভুলে গেলে চলবে না ভার তবর্ষে খিলাফত আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলন করেও খিলাফতী আলি ভ্রাতৃদ্বয়ের একজন মহম্মদ আলি বলেছেন :-“আমার ধর্ম ও বিশ্বাস অনুসারে আমি একজন ব্যভিচারী ও পতিত মুসলমানকে শ্রী গান্ধীর চেয়ে ভালো বলে মনে করি।”
গান্ধী মুসলমান প্রেমিক হলেও মুসলমান ছিলেন না বলেই আলি গান্ধীকে নিকৃষ্ট বলেছেন।
বলা বাহুল্য মুসলমানের এ মনোভাবের প্রেরণা তো কোরাণ শরীফেই রয়েছে। সুরা ‘বাকারাহ্’ অন্তর্ভুক্ত ২২১ সংখ্যক আয়াতে ইসলামে অবিশ্বাসী স্ত্রী ও পুরুষকে, ইসলামে বিশ্বাসী ক্রীতদাসী ও ক্রীতদাসের চাইতে নিকৃষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করার নির্দেশকে যদি অমুসলমানের প্রতি মুসলমানের মনোভাবের প্রেরণা হিসেবে দেখা হয় তাহলে আদৌ কোনো ভুল হবে কি?
কাজেই যুক্তি দিয়েই ‘কোরাণ শরীফ’ আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। মুসলমান সমাজকেও এবিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের প্রতি যত বেশী অবিশ্বাস, যত বেশী ঘৃণা, মৌলবাদ সেখানেই তত বেশী শক্তিশালী।
একথা সকল ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। তাছাড়া মৌলবাদ যত পুষ্ট হবে মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই। তা যদি মৌলবাদ না-ও হয়, মৌলবাদের চাইতে কম ভয়ংকর কিছু হবে না। কেননা তার ভিত্তি রচিত হবে অবিশ্বাসের ওপর।
হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির দোহাই দিয়ে কিছু তথাকথিত প্রগতিবাদী ও একদেশদর্শী বুদ্ধিজীবী যেভাবে সকল সাম্প্রদায়িক সমস্যার দায় হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন তা শুধু নিন্দাহ-ই নয়, অপরিনামদর্শীতারও চরম নিদর্শন।
হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এদেশে নতুন নয়। মুসলমান হিন্দুকে মারে, ইদানীং হিন্দুও মুসলমানকে মারছে। হত্যাকারী যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, তার শাস্তি হওয়া প্রয়োজন মনুষ্যত্বের স্বার্থেই। হত্যা যখন সংঘটিত হয় তখন হত্যালীলার নৃশংস বর্ণনায় হত্যা অপরাধের মাত্রায় যেমন ইতরবিশেষ ঘটনা, তেমনি ‘হত্যা’র নিরাড়ম্বর বর্ণনায় হত্যা অপরাধ লঘু হয়ে যায় এমন নয়। এদেশের দাঙ্গার বর্ণনায় তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা হিন্দুধর্মাবলম্বী হত্যাকরী কৃত হত্যার অনুপুঙ্খ বিবরণ ধরতে গিয়ে কীভাবে বহু সময় এমনকী মিথ্যা এবং অর্ধসত্যের উদ্ভাবনে নিরত হন, তা ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি। কিন্তু কোন বর্ণনায় হত্যাকরী মুসলমানের কৃত হত্যাবিবরণ স্থান পেতে দেখেছেন কি কেউ? হিন্দুকে নারী ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও মুসলমানরা এবিষয়ে যেন একান্তই অনীহ।! যদিও সমগ্র দেশের সর্বকালের পরিসংখ্যান বিপরীত সাক্ষ্যই বহন করছে।
কোন সংবাদপত্র কিংবা বর্ণনায় তার উল্লেখ থাকে না। কাজেই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই নানা সন্দেহ দেখা দেয় স্বাভাবিক কারণেই। তারা কি চান হিন্দুদেরকেই যাবতীয় নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি করে তুলে মুসলমান মনকে পুরোপুরি বিষিয়ে দিতে? তা না হলে দুই সম্প্রদায়েরই নিষ্ঠুরতাকে তুলে ধরে সামগ্রিকভাবে মনুষ্যত্বের অবনমন, ভুলুণ্ঠণকে চিহ্নিত করাই তো যথার্থ হতো।
অবশ্য এবিষয়গুলি আদপেই হিন্দু বা মুসলমানকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয় নয়। মূল সমস্যা ও তার কারণ অনুসন্ধান না করে একপেশেভাবে হিন্দুর সমালোচনা যে সহনশীল হিন্দুরও সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে দিচ্ছে, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তা বুঝতে চাইছেন না। তাদের অপরিনামদর্শীতা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এক অনিবার্য সংকটের অভিমুখী করে চলেছে। আগামী পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যে দেশবিভাগের সময়কালীন অবস্থা ফিরে এলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পশ্চিমবঙ্গ কিংবা অসমপ্রদেশ সহ দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষকে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যদি উদ্বাস্তু হবার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, তবে তাকে কোন আকস্মিক ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ নিয়মিতভাবেই রোপণ করে দেওয়া হচ্ছে।
একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে সিন্ধু প্রদেশে ইসলামের অভিযানের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষে ধর্মবিস্তারের পথে প্রথম ভারতীয়টি যেদিন ইসলামধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, সেদিন থেকেই ইসলাম ভারতবর্ষের ভাগ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। বস্তুত ইসলামের সিন্ধুবিজয় পলাশী কিংবা ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্যের চাইতেও অনেক বেশী তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী হয়েছে। ইংরেজ ঐতিহাসিক লেনপুল যেভাবে আরবদের সিন্ধু বিজয়কে “An epi-sode in the history and of Islam, a triumph without result.” বলেছেন, তা যথার্থ নয়। “ভারতে সেইদিনই পাকিস্তানের সৃস্টি হয়েছে যেদিন প্রথম হিন্দুটি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল” বলে ১৯৪৪ খ্ৰীষ্টাব্দে তৎকালীন অখণ্ড ভারতের মুসলিম লীগ সভাপতি মহম্মদ আলি জিন্না আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দীক্ষান্ত ভাষণে যে মন্তব্য করেছিলেন তা জিন্নার ইতিহাস সচেতনতার পরিচয় বহন করছে।
আদতে ফারসী শব্দ ‘পাকিস্তান’কথাটির অর্থ মনে রাখলে এবং সামগ্রিকভাবে অ-ইসলামিক দেশ দার-উল-হারাকে পবিত্র দার-উল-ইসলামে পরিণত করার ইসলামিক আদর্শের বিষয়টি জানলে পাকিস্তান সৃষ্টির ইসলামী যৌক্তিকতা খুঁজে পেতে কষ্ট হবার কথা নয়। এদেশে এখনও বেশীরভাগ মুসলমান পাকিস্তানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করেন এবং তা বোঝার জন্য বিশেষ কোনো খেলায় পাকিস্তানের সাফল্যে মুসলমানদের মধ্যে আনন্দের বন্যা, আলোর ফোয়ারার মতো বিশেষ ঘটনামাত্র দেখার প্রয়োজন ঘটে এমন নয়, মুসলমান মহল্লাগুলিতে একটু কান পাতলেই শোনা যায়।
পাকিস্তানের মোহাজিরদের প্রতি সরকারী ঘৃণার মনোভাবের ফলে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে পাকিস্তানে যাবার বিষয়ে কিছু মুসলমানরা যে মাঝে মাঝে অনীহা প্রকাশ করেন তাতে ভারতবর্ষের প্রতি তাদের ভালোবাসা ব্যক্ত হয় না, বাস্তব অবশ্যম্ভাবী অসুবিধার আশঙ্কাই তাতে বেশী ক্রিয়াশীল, তা বুঝতে গেলে নিতান্ত ‘অন্ধ’ কিংবা ‘কালা’ না হয়ে থাকাই যথেষ্ট। ভারতীয় আইন গ্রহণে সাধারণ মুসলমানের অনীহা, শরিয়তি আইন তার সমাজ ও নারীকে যতই ‘বদ্ধ’ করুক না কেন, সে সম্পর্কে এমনকী অতি শিক্ষিত মুসলমানদেরও আকর্ষণ, সাধারণভাবে ইসলামের প্রতি বদ্ধমূল আকর্ষণসঞ্জাত তা বলা বাহুল্য।
এই বিষয়টি এদেশে নেহাৎ নতুন নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির তৎপরতা নিয়ে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল তার মূলেও ছিল দেশের স্বাধীনতার চাইতেও ইসলামিক ঐক্যের প্রতি মুসলমানদের আন্তরিক টান। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু মুসলমান স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন একথা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি তাদের মধ্যেও অনেকেই ইসলামের চুড়ান্ত সাফল্যের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বৃটিশদের ভারতবর্ষত্যাগকে প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন। মহম্মদ আলি কিংবা সৌকত আলি, যাঁরা ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-এ সামিল হয়েছিলেন তাঁদের কাছে খিলাফতই ছিল প্রধান আকর্ষণ। এমনকী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ–কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে যিনি তাঁর ভাষণে স্বীকার করেছেন—“I am one of those who believe revival may be necessity in a religion but in social mat-ters it is a denial of progress.” তিনিও মুসলমানদের গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের আদর্শের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক ইসলামিক ঐক্যের উপর নির্ভর করতে বলেছেন। কংগ্রেসের মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি বলেছেন :-“The power-ful bonds of Islamic brotherhood and equality have protected them to a large extent from the weakness that flowes from so-cial division. It is true that they number only one-fourth of the total population, but the question is not one of the population ratio, but of the large numbers and the strength behind them.”
মৌলানা আজাদ আর এক জায়গায় স্পষ্ট বলেছেন :-“I am Musalman and am proud of that fact. Islam’s splendid tradition of thirteen thousand years are my inheritance. I am unwilling to lose even the smallest part of this inheritance.”
এই ‘inheritance’ এর মধ্যে ‘হাদিশ’ বা অন্য কিছু না থাকলেও ‘কোরাণ শরীফ’ আছে নিশ্চিতভাবে।
১৯৪৭ এর দেশবিভাগের সময় যে সমস্ত মুসলমান ভারতবর্ষের মূল অংশে থেকে গিয়েছিলেন তাদের বেশীরভাগই মৌলানা আজাদের মতোই ইসলামী ঐতিহ্য’কে সম্বল করেছেন। বলা বাহুল্য এই ‘ঐতিহ্যের’ পরিবর্তে ভারতীয় ঐতিহ্যকে আশ্রয় করলে ‘হিন্দু-মুসলমান’ সমস্যার চেহারায় কদর্যতা অনেক কম হতো নিশ্চিতভাবেই।
বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকার তাঁর দূরদর্শীতায় উপলব্ধি করেছিলেন :-“এতে সন্দেহমাত্র নেই যে (ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে) সংখ্যালঘু বিনিময় করাই সাম্প্রদায়িক শান্তি বজায় রাখার একমাত্র সমাধান। (Pakistan or The Position of India পৃষ্ঠা-১১৬)
গান্ধী কিংবা নেহেরু প্রমুখ তাঁদের ভাবালুতায় আম্বেদকারের যুক্তি বুঝতে পারেননি। রাষ্ট্র পরিচালনায় ভাবালুতার স্থান কোন যুগেই ছিল না কারণ বাস্তবতার দায় সেখানে অনেক বেশী এবং সেটিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় কোন মহত্ব থাকতে পারেনা। আজ প্রয়োজনে আবারও দেশভাগ করার দাবি এমনকী জাতীয় আইনসভাতেও উত্থাপিত হচ্ছে, যা তৎকালীন রাষ্ট্রপরিচালকদেরই ভুলের ফল।
এদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতাবাদ মূলতঃ একশ্রেণীর মুসলমানের সক্রিয়তা ও একদলের নীরব সম্মতির মধ্যে দিয়ে মূর্ত হলেও একথা অস্বীকার করা যায় না মহম্মদ করিম চাগলা, আবদুল ওদুদ, রেজাউল করিম কিংবা ফৈয়জ খাঁনের মতো মুসলমানরা ভারতবর্ষের গৌরব। এই মুহূর্তে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা মেনে নিয়েই পনেরো-কুড়ি কোটি মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের কল্পনা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। সেরকম কিছু কল্পনা এই মুহূর্তে আর একবার দেশবিভাগের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলবে মাত্র। মুসলমানকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইলে সে প্রক্রিয়াই তরান্বিত হবে। কাজেই মুসলমানকে ঘরের লোক না করে উপায় নেই। ঘরের লোকের দোষ-ত্রুটি যদি থেকে থাকে তাহলে তা বললেই যদি ঘরের লোক ঘর ভাঙতে উদ্যত হয় তাহলে বুঝতে হবে সে লোক আদতে ঘরের লোক-ই নয়।
তোয়াজী বুদ্ধিজীবীরা এই সত্যটি না মেনে তোয়াজ করাকেই ধ্যেয় করেছেন। অথচ এমনকী এদেশের কোনো কোনো মুসলমানও অন্যরকম ভাবেননি, তা নয়।
ঘরের লোকের দোষ-ত্রুটি নির্দেশ করার কথা বলে সাহিত্য সমালোচক মীজানুর রহমান ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার ‘বুলবুল’ পত্রিকায় যে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন তা উল্লেখ করা সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
মীজানুর সাহেব লিখেছিলেন :-“হিন্দুসমাজের বিবিধ গলদ ও সমস্যা নিয়ে শরৎচন্দ্র যে সকল গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন এবং প্রতিকারের উদ্দেশ্যে তাঁহার সমাজকে যে চাবুক কশেছেন, সদিচ্ছাপ্রণোদিত এমনধারা নির্মম কশাঘাতও মুসলমান সমাজ অম্লানবদলে গ্রহণ করবে তা জোর করে বলতে পারি। বাংলার কথাসহিত্য সম্রাটকে একবার পরীক্ষা করে দেখতে অনুরোধ করি।”
মীজানুর সাহেব বেশী পরিমাণেই আশাবাদী ছিলেন একথা যেমন সত্য, তেমনি একথাও সত্য যে সে পরীক্ষা আদৌ হতে পারেনি। একালের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বিষয়টির গুরুত্ব দেবেননা তা বলা বাহুল্য। মুসলমান ধর্মাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও তো সর্বজনবিদিত। আবদুল ওদুদ কিংবা রেজাউল করিমের মতো সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী আর নেই। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, হোসেনুর রহমান কিংবা অন্যান্যদের ভূমিকা তো তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে তাঁদের অভিমত ও ইমরানা কাণ্ড নিয়ে তাঁদের নীরবতায় ও নিশ্চলতায় সুস্পষ্ট।
মার্কসবাদীরা সর্বক্ষেত্রে প্রগতিবাদী হিসেবে নিজেদের জাহির করলেও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেকার নানা পশ্চাদ্গামীতায় একেবারে নীরব। যদিও কিছু কিছু মার্কসবাদী লেখক ভারত ইতিহাসের শিক্ষণীয় বিষয়গুলিকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। মার্কসবাদী প্রবন্ধকার নন্দগোপাল সেনগুপ্ত লিখেছেন :-“মুসলমানরা অবশ্য স্বকীয় চেষ্টায় পশ্চিম অংশকে মুসলমান ভারতে পরিণত করে নিয়েছেন, পূর্বে তা পারেনি বলে তার জীবনে এখনো একটা সংখ্যালঘু সমস্যা মৃদু আকারে বেঁচে আছে।” (বস্তুবাদীর ভারত জিজ্ঞাসা, পৃ-১৩২)
পশ্চিম বলতে লেখক সম্ভবতঃ পাকিস্তান ও পূর্ব বলতে ভারতরাষ্ট্রকে বোঝাতে চেয়েছেন। সংখ্যালঘু সমস্যাকে ‘মৃদু’ আকারের বললেও তা যে আদৌ ‘মৃদু’ নেই লেখক তা দেখে যেতে পারেননি।
যাইহোক, লেখক সংখ্যালঘু সমস্যার একটি কারণ সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। তিনি লিখেছেন :-“প্রথম কথা, ইসলামিক কেন, কোন সাম্রাজ্য-বিস্তারই তরবারীর সাহায্য ভিন্ন হয়নি। .মুসলীম সম্প্রসারণও হয়েছে ঐ একই ধারায় এবং মুসলমান ইতিহাসকাররা সেকথা জাতীয় গৌরবের কাহিনী রূপে লিপিবদ্ধও করেছেন। তাছাড়া ঐস্লামিক বিশ্বভাবনা এর পরিপন্থী নয়। গোটা জগৎকে তা দার-উল-ইসলাম ও দার-উল-হারাব্ এই দুই ভাগে ভাগ করে। দার-উল-হারাবকে স্বধর্মে আনার জন্য ধর্মশাস্ত্র নির্দেশ দিয়েছে জেহাদের এবং বলেছে তাতে মৃত্যু হলে মৃতজন হবেন শহীদ, জয়ী হলে বিজেতা হবেন গাজী। বলেছে বিধর্মীদের হয় ধর্মন্তরিত করবে, নয় কোতলে আম বা সমূলে নিপাত করবে, আর অসম্ভব হলে তাদের জিম্মি করে রাখবে ও মুণ্ডশুল্ক নেবে। এই শুল্কের নাম জিজিয়া।
মাতৃদেবতা ও পিতৃদেবতাপূজক হিন্দুদের মুল্লুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এর প্রমাণ এত স্পষ্ট ও প্রচুর যে তা মুছে ফেলা সম্ভব নয়।” (বস্তুভাবাদীর ভারত জিজ্ঞাসা পৃ-৫৩)
উপরোক্ত গ্রন্থটি সরকারী পুরস্কারপ্রাপ্ত (রবীন্দ্র পুরস্কার-১৯৮৪)। সেই কারণে ধরে নেওয়া যায় লেখকের উপরোক্ত বক্তব্যে সরকারীক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বামপন্থী দলগুলির সায় রয়েছে কিংবা বিরোধিতা করবার মতো তথ্য হাতে নেই।
মাকর্সবাদী লেখকের উপরোক্ত মন্তব্য থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হলো, প্রথমত এদেশে সংখ্যালঘু সমস্যা রয়েছে এবং তা কিছু সুস্পষ্ট নীতি কার্যকর না করতে পারার কারণে। প্রসঙ্গত কি হতে পারে সেই নীতি?
রবীন্দ্রনাথ কথা প্রসঙ্গে হালকা ভাবে বলেছিলেন :-“আমার অনেক সময় মনে হয় এ সমস্যার সমাধান কেবলমাত্র তা হলেই সম্ভব হয়, যদি সব হিন্দু মুসলমান হয়ে যায় অথবা সব মুসলমান হিন্দু হয়ে ওঠে।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন যা মূলত ভাববাচক। যেখানেই কবির ক্রিয়াবাচক বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে সেখানেই দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছেন যে হিন্দুর পক্ষে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া মুসলমানের সঙ্গে মিলবার অন্য কোন উপায় নেই। (শ্রীযুক্ত কালিদাস নাগকে লেখা পত্র-কালান্তর, )
নন্দগোপাল সেনগুপ্তের লেখায় দ্বিতীয় যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হচ্ছে এই যে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার মূলে রয়েছে দার-উল-হারার্ ভারতবর্ষকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করার ভাবনা ও বস্তুত ইসলামের এই ভাবনা মুসলমানরা বর্জন করেছেন এমন কোন প্রমাণ নেই। অবিশ্বাস রয়ে গেছে। নতুন বিশ্বভাবনার সঙ্গে দার-উল-ইসলাম আর দুর-উল-হারাবের তত্ত্ব আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয় এই কথাটি স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ না করে তোয়াজী বুদ্ধিজীবীরা অবিশ্বাসের মূলে জলসিঞ্চণ করে চলেছেন।
কাশ্মীরে সংখ্যালঘু হিন্দুরা বহু নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানেই মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হয়ে উঠছেন, সেখানেই নানা ধরনের সমস্যা তৈরী হচ্ছে। যেসব দাবি উঠছে যা ভারতবর্ষের সামগ্রিক ঐক্যের পক্ষে বিপদস্বরূপ। ত্রিপুরাতে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামপঞ্চায়েতের সংখ্যাগুরু মুসলমান প্রতিনিধিদের সম্মতি নিয়ে গ্রামটিকে রাতারাতি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করেছিল ভারতবর্ষের অন্নেপুষ্ট সেই গ্রামের মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষেরা। বাংলাদেশের পতাকাও তোলা হয়েছিল গ্রামে। পরে ভারতীয় সেনারা গিয়ে সে পতাকা নামিয়ে দেয়।
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় তো বরাবরই বিচ্ছিন্নতাবাদের এক ঘাঁটি। এ সম্পর্কে অভিযোগ শুধু হিন্দুত্ববাদীদের নয়। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তণ অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষ, যাঁর সম্পর্কে তাঁর প্রবল শত্রুও সম্প্রদায়িকতার অভিযোগ করতে পারবেন না, তিনিও লক্ষ্য করেছেন “এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশীরভাগ ছাত্র ভারত সম্বন্ধে নিরাগ্রহ এবং অল্পসংখ্যক পাকিস্তানী, যারা নিরাগ্রহ তাদের মধ্যে কয়েকজন ছাত্র (এবং শিক্ষক) হালকা রকমের পাকিস্তানী। নানা রকমে পাকিস্তানের প্রতি এদের একটা টান রয়েছে।”
মুসলমান বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল কারণ হিসেবে যারা শুধুমাত্র শিক্ষার অনগ্রসরতাকে মূল উপজীব্য করতে চান তারা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। ইসলামের আইনব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপরিচালনায় যারা যুক্ত তারা নিরক্ষর নন।
সম্প্রতি আরবের আদালতে সে দেশে কর্মরত জনৈক ভারতীয় নাগরিক আবদুল লতিফ নৌশাদের চোখ উপড়ে নেবার আদেশ দিয়েছে। নৌশাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি এক সৌদি নাগরিকের চোখে আঘাত করায় তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। বিচারের নামে এধরনের মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা ইসলামিক দেশগুলিতে যেভাবে চলছে তাতে আতঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এহেন অবস্থা ভারতবর্ষের হিন্দু ও অন্যান্য মানুষের মনে যদি অবিশ্বাস ও সন্দেহ বহন করে আনে এবং মুসলমানদের তরফে ব্যক্তিগত আইন রাখার পক্ষে যুক্তি খাঁড়া করা হয়, তখন শুধুমাত্র হিন্দুদের সমালোচনা করে সমস্যাকে ঠেকানো যাবেনা।
সংরক্ষিত অরণ্যে জীবজন্তু হত্যায় অভিযুক্ত হলে চলচ্চিত্র নায়কদের গ্রেপ্তার করলো পুলিশ অনেক ইতঃস্তত করে। নায়কদের তরফে বলা হলো মুসলমান কলেই তারা হেনস্তার শিকার।
ক্রিকেট খোলোয়াড় দল থেকে বাদ গেলেন খেলাধূলাতে অসদুপায় অবলম্বন করার জন্য। খেলোয়াড় বললেন মুসলমান বলেই তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। এধরনের মনোভাব হিন্দুভাবনাকে আহত করছে তা বলা বাহুল্য। সংখ্যাগুরু বলে তার সকল ভাবনা অগ্রাহ্য করা হবে, হিন্দুরা চিরদিন তা মেনে নেবেন এমন ভাবা ভুল।
তোয়াজী বুদ্ধিজীবীরা যে পথ ধরেছেন সে পথ কখনো সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের সহায়ক নয়। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বাবাসাহেব আম্বেদকর প্রমুখ কেউই এই ধারার মানুষ ছিলেন না। হিন্দুর দোষত্রুটির কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সবাই মুসলমানের দোষ-ত্রুটির উল্লেখ করেছেন-হিন্দু ও মুসলমান দুই-ই তাঁদের কাছে দেশের মানুষ হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছেন বলে।
সম্প্রতি তাই তাঁদের ওপরও আক্রমণ আসছে বিভিন্ন মহল থেকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন