রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি, বড়লোকের কবি বলা হয়েছে। এমনকী মার্কসবাদী তাত্বিক নেতা হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তো রবীন্দ্রনাথকে জারজ সংস্কৃতির (Bustered Culture) প্রতিনিধিও বলেছেন। ইদানীং রবীন্দ্রনাথকেও সাম্প্রদায়িকও বলা হচ্ছে। কিছু তোয়াজী বুদ্ধিজীবী তো বটেই, সাংবাদিকেরাও রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টির আচ্ছন্নতা খুঁজে পাচ্ছেন।
২০০৩এর ১৭ই অক্টোবর তারিখের ‘দেশ’ পত্রিকাতে অশ্রুকুমার শিকদার বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক প্রশান্তকুমার পাল রচিত রবিজীবনী (৯ম খণ্ড) গ্রন্থের সমালোচনা (Review) করেছেন। অশ্রুবাবু, প্রশান্ত পালের রচনার সমালোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকেও একহাত নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দিয়েছিলেন, এই উপলক্ষ্যে উপস্থিত রাজন্যবর্গের কাছ থেকে অর্থ আমদানির প্রত্যাশায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এ হেন অশ্রদ্ধেয় মন্তব্য করেছেনন অশ্রুকুমার। কালিদাস নাগকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি অশ্রুবাবুর এই ধারনার কারণ হলেও মনে রাখা প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ কোন গড়পড়তা মানুষ ছিলেন না।
অশ্রুকুমার লিখেছেন :-“এই সব সংসর্গের ফলে হয়তো হিন্দুজাতির বর্তমান অবস্থা ও উন্নতি বিষয়ে তিনি লিখেছেন। আর তাতে হিন্দু মহাসভা উৎসাহিত হচ্ছে।”
বলা বাহুল্য হিন্দুজাতির উন্নতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে কিছু লিখেছেন অশ্রুকুমারের তা ভালো লাগেনি। কিন্তু একথা বলতে গিয়ে অশ্রুকুমার এমনকী রবীন্দ্রনাথের সংসর্গদোষ আবিস্কার করেছেন!
অশ্রুবাবুর সমালোচনা পড়লে বুঝতে অসুবিধা হয়না হিন্দুদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা তাঁর মনোপীড়ার কারণ।
প্রশান্তবাবু ‘রবিজীবনী’তে তৎকালীন সমাজকে অনুধাবন করতে গিয়ে সামাজিক সমস্যাকে এড়িয়ে যাননি। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কবিষয়ক নানা বিষয়ও তাঁর আলোচনায় এসেছে। ভারতবর্ষে মুসলিম রাজনীতি যে হিন্দু-বিরোধিতাকে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে আছে এই ঐতিহাসিক সত্যটি উল্লেখ করায় অশ্রুবাবু, প্রশান্তবাবুর প্রাসঙ্গিক মন্তব্যকে সাম্প্রদায়িক, কট্টরপন্থী ও অপ্রাসঙ্গিক বলে বিশেষিত করেছেন। বস্তুত ঠিক এখানেই ‘রবীন্দ্রনাথের সংসর্গদোষ’ আবিস্কারের পেছনে অশ্রুবাবুর মনোভাব আঁচ করা যায়।
‘দেশ’ পত্রিকাতেই অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, নিত্যপ্রিয় ঘোষ সংকলিত “হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক :’রবীন্দ্র সংগ্রহ’ গ্রন্থটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন মন্তব্য, বক্তৃতার অংশ, চিঠিপত্র ইত্যাদি থেকে কিছু উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছেন। আলোচনার জন্য সেগুলি জানা বিশেষ প্রয়োজন।
১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠিতে লেখেন :-“সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ভারতবর্ষেই ভগবানকে পূজার ক্ষেত্রে জাতের বেড়ায় বিভক্ত করে রাখা হয়েছে—অর্থাৎ যেখানে শত্রুরাও মেলবার অধিকার রাখে, হিন্দুরা সেখানেও মিলতে পারে না।”
রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি যদি এপর্যন্ত হতো তাহলে হয়তো অনির্বাণবাবুর আপত্তি হতো না। অনির্বাণবাবুর ভাষায় :-“জাতি-বর্ণের ভেদাভেদ বৈষম্য আর বিরোধে জর্জরিত হিন্দুসমাজের সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ আজীবন কতখানি অবিচল ও অনলস ছিলেন, সমস্ত মানুষের মিলনের কথা তিনি কতবার বলেছেন, সে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।”
কিন্তু অনির্বানবাবুর ভাগ্যে শেষরক্ষা ঘটেনি। কারণ ঐ চিঠিরই একস্থানে রবীন্দ্রনাথ, “এই মর্মান্তিক বিচ্ছেদে হিন্দুরা পদে পদে পরাভূত, তারা সর্বজনের ঈশ্বরকে খর্ব করে নিজেদেরই পঙ্গু করেছে।” বলে যে বাক্যটি লিখেছেন অনির্বাণ তাতেই আবিস্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথের প্র্যাগমাটিসম্ (Pragma tism)—কৌশলী বাস্তববুদ্ধি।
অনিবার্ণবাবুর ভাষায় :-“মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্য অনৈতিক বলেই নিন্দনীয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবল সেই কারণে চিন্তিত নন। ‘এই মর্মান্তিক বিচ্ছেদ’ হিন্দুদের দুর্বল করে ফেলেছে. এই কারণেই তিনি উদ্বিগ্ন।”
স্পষ্টতই অনির্বাণ যে ইঙ্গিত করতে চাইছেন তা তথাকথিত সম্প্রীতিবাদী বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকদের পক্ষে স্বাভাবিক। ‘হিন্দু’ সম্পর্কে যে কোন ভাবনা যে অতীব নিন্দনীয় তা আজ আর কার অজানা? অনির্বাণ তাই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িক হিন্দু’কে খুঁজে পেতে চেষ্টা করবার সময় রবীন্দ্রনাথের হিন্দু-মুসলমান-বিষয়ক ভাবনার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের ধারকাছ দিয়ে যাননি
অনির্বাণবাবু তাঁর এই পর্যালোচনাতেই একস্থানে রবীন্দ্রনাথের মতামত উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি বলছেন :-“ “আভ্যন্তরিক বলে বলি’ হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বাঙালি মুসলমান হিন্দু বাঙালির চেয়ে অনেক বিষয়ে পশ্চাৎপদ, সেখানে তাকে সমান হয়ে নিতে হবে।”
রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ বলেই এ-ও লক্ষ্য করেছেন :-“মুসলমান যে স্বাধীনতার দাবী নিজে করছে, ঠিক সেই স্বাধীনতা অপরকে দিতে কেন নারাজ?”
এদেশে যদি একজনও এমন মানুষ থেকে থাকেন যিনি বিশ্বসংসারের যাবতীয় বিষয়ে বিচারশীল ভাবনার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, তিনি নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’ নিজের রচিত এই গানটির মতোই যে কোনো চিন্তা-ভাবনাই তাঁর কাছে আপেক্ষিক সত্যের রূপ ধরে এসেছে। ফলে কোন বিষয়ই একতরফা নিন্দা কিংবা নির্বিচার স্তুতি লাভ করেনি তাঁর কাছে। আমরা রবীন্দ্রনাথের সকল রচনায় তার প্রমাণ পেয়েছি। উদাহরণ হিসেবে ‘রাশিয়ার চিঠি’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। রাশিয়াতে যা দেখেছেন কবি তার অনেক কিছুই তাঁর ভালো লেগেছে, কিন্তু সে বিষয়ে শেষকথা বলার সময় আসেনি এমন কথা বলেছেন সর্বত্র। রবীন্দ্ররচনার এই বৈশিষ্ট্য আপাতভাবে অনেকের কাছে পরস্পর বিরোধী বলে মনে হলেও, বস্তুত রবীন্দ্ররচনার যদি না-ও হয়, রবীন্দ্রভাবনার সর্বোচ্চ শক্তি এটিই। একজন যথার্থ যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে কোনো বিষয়ে তাঁর ‘ফতোয়া’ দিতে চাননি কবি মানুষ সম্পর্কে–শ্রদ্ধাবোধই এর কারণ।
রবীন্দ্রনাথ হিন্দুর জন্য ভেবেছেন, মুসলমানের জন্যও ভেবেছেন। হিন্দুর দোষত্রুটি জানাতে দ্বিধা করেননি, মুসলমানের দোষত্রুটি ঢেকে গা বাঁচাতে চাননি মজার বিষয় এই যে, অনির্বাণবাবুর মতো মানুষদের কাছে হিন্দুর জন্য রবীন্দ্রনাথের ভাবনা তাঁর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচায়ক, মুসলমানের জন্য ভাবনা যথার্থ। বুঝতে অনুবিধা হয়না ‘Charity begins at home’, প্রাথমিক পর্যায়ে শেখা এই ইংরেজী প্রবাদটিতে যাদের একান্ত অনীহা অনির্বাণবাবু তাঁদেরই একজন।
১৩০৫ বঙ্গাব্দে আবদুল করবি রচিত ‘ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের পর্যালোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :-“ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হন নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে।”
রবীন্দ্রনাথের এই ইতিহাসবোধ অনির্বাণবাবুর পছন্দ নয়। তিনি লিখেছেন :-“সেই ঐতিহাসিক আমল থেকে আজ পর্যন্ত প্রবল মুসলমানের হাতে দুর্বল হিন্দুর পরাজয়ের এই ‘ঐতিহাসিক’ স্মৃতি আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।”
এই বক্তব্যে অনিবার্ণবাবু কি বলতে চাইলেন তা স্পষ্ট নয়। হয় তিনি এই স্মৃতিকে মিথ্যে বলতে চেয়েছেন, নতুবা এই স্মৃতি নিয়ে তাড়িত হবার অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে চেয়েছেন।
অনির্বাণবাবু যদি প্রথমে উল্লিখিত ভাবনাটির কথা বলে থাকেন, তবে তাঁর সাথে তর্ক বৃথা। শুধু এটুকু বলা যাক যে সুলতান মামুদ তাঁর তিরিশ বছরের রাজত্বকালে এক-আধবার নয়, সতেরো বার ভারতবর্ষ লুণ্ঠন করেছিলেন আর জয়পালরা আত্মহত্যা করেছেন অথবা নিহত হয়েছেন—ইতিহাসের এই তথ্য এমনকী মার্কসবাদী ইতিহাসবিদরাও অস্বীকার করতে পারেননি। হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে এমন ঘটনা সম্ভব হতো?
অনির্বাণবাবু যদি স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাহলেও বিশ্বের নানা ঘটনা থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকার সামিল হয়। ইতিহাসের শিক্ষা ভুললে কি হতে পারে ভারতবাসীর থেকে তা বেশী কে জানে? প্রতিদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি। হিন্দু দুর্বল বলেই দেশভাগের পর পাকিস্তান প্রায় হিন্দুশূন্য হয়ে গেছে, বাংলাদেশ শনৈঃ শনৈঃ সে পথে এগিয়ে চলেছে। হিন্দুপ্রধান ভারতবর্ষে উল্টোটা হয়নি। এদেশে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে না এই তত্বে দুয়ো দিয়ে অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জবানিতেই জানা গেছে যে পশ্চিমবঙ্গের অন্তত তিনটি জেলায় মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং পূর্ব দিনাজপুর মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হিসেবে নির্দিষ্ট হয়েছেন। যদিও বেসরকারী বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী নদীয়া, দক্ষিণ ২৪পরগণা এবং উত্তর ২৪পরগণাতেও মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশ অতিক্রম করবে খুব শিগ্গিরই। মুসলমানরা এদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জোর খাটাতে পারছেন। মুসলমান প্রধান জেলা হচ্ছে, মাদ্রাসায় রাষ্ট্রবিরোধী ঘাঁটির অস্তিত্ব জেনেও সরকারকে চোখ বুজে থাকতে হচ্ছে, শাহবানু মামলায় বিচারব্যবস্থার ইতিবাচক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের ক্ষোভে প্রলেপ দিতে নানা রঙের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কলকাঠি নাড়া এবং বিচারব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন অনির্বাণবাবুরা নীরবে সহ্য করছেন তো প্রবল মুসলমানের ভয়েই। ভয় দেখিয়ে অথবা উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমেই তো মানুষের মুখ বন্ধ করা যায়, অনির্বাণবাবুরা নিশ্চয়ই উৎকোচ পাননি।
রবীন্দ্রনাথ যখন হিন্দুদের ‘প্রবল’ হয়ে উঠতে বলেন তখন তিনি তা মুসলমানদের মহড়া নেওয়ার জন্যই বলেন, অনিবার্ণবাবু এমন কথাও বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ মুসলমানের মহড়া নেবার কথা কদাচ বলেননি। যদি ধরেও নেওয়া যায় অনির্বাণবাবুর ধারণা ঠিক তাহলেও নিশ্চিতভাবে রবীন্দ্রনাথ তা বলেছেন দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যের স্বার্থেই। লিখেছেন :-“ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তা হলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সেই সমকক্ষতা তাল-ঠোকা পালোয়ানির ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয় পক্ষের সামাজিক শক্তির সমকক্ষতা।”
দুর্বলের সঙ্গে সবলের ঐক্য সম্ভব নয়, এই সাধারণ জ্ঞানটুকুও রবীন্দ্রনাথের থাকা অনুচিত ছিল বলে মনে করেন অনিবার্ণবাবু!
“কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন ঘটলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। তার কারণ এ নয় যে মুসলমানের গায়ে জোর আছে, হিন্দুর নেই।”–রবীন্দ্রনাথের এ জাতীয় ভাবনা তাঁর দীর্ঘ ও অভিজ্ঞতাবহুল জীবনে বিশেষ বদলায়নি। এমনকী প্রায় শেষ পর্যায়ে হেমন্তবালা দেবীকে দুঃখ করে লিখেছেন :-“হিন্দুসমাজের ভবিষ্যৎ তোমার ছেলেমেয়েদের দুর্বল স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়ে একদিন তুমি চলে যাবে। কিন্তু সে কী ভবিষ্যৎ, ভেবে দেখো।”
মুসলমান আধিপত্য, রাজনৈতিক বা সামাজিক যাই হোক না কেন, কায়েম হলে ঘন্টা নেড়ে পূজা বন্ধ হবার ভয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিতভাবেই বিচলিত ছিলেন না। রাজদরবার যতই প্রাচুর্যের ছটায় উজ্জ্বল হোক না কেন, মুসলমান সমাজ যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্ধকারের সাধনায় নিমগ্ন থেকেছে রবীন্দ্রনাথ তা যথার্থই অনুধাবন করেছিলেন। সেই কারণেই আপাত তুচ্ছ বিষয় ধর্মান্তঃকরণ সম্পর্কে বলেছেন :-“সামাজিক অসম্মান থেকে বাঁচবার জন্যে প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃষ্টান হতে চলেছে কিন্ত ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রমণ্ডলীদের মুসলমান যখন জোর করে কলমা পড়াবে তখন পরিতাপ করবারও সময় থাকবে না।” (হেমন্তবালা দেবীকে লেখা পত্র, ১৬ই অক্টোবর, ১৯৩৩)
রবীন্দ্রনাথ যখন একথা লেখেন তখন হিন্দুসমাজের দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথের উদ্বেগের গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। অনিবার্ণবাবু সম্ভবত ইচ্ছে করেই সেই রবীন্দ্রনাথকে ভুলতে চেয়েছেন যিনি তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে হিন্দুর পক্ষে মুসলমানকে গ্রহণ করার বিষেয়ে যাবতীয় বাধার বিরুদ্ধে বলেছেন। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ভালো হওয়া প্রয়োজন উভয়ের স্বার্থে, শুধুমাত্র একথা না বলে মনুষ্যত্বের জন্য, নৈতিকতার জন্য তা হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও তিনি জানতেন এই কাজ কত দুরূহ। তাই লিখেছেন :-“ভারতবর্ষে হিন্দুতে মুসলমানে প্রতিনিয়তই পরস্পর রফানিস্পত্তির কারণ ঘটবে।” (রবীন্দ্ররচনাবলী, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃ-৩১৮)
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিস্তৃত কর্মবহুল জীবনে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে মতামত ব্যক্ত করলেন, অনিবার্ণবাবু কলমের জোরেই তা নস্যাৎ করতে চান? রবীন্দ্রনাথ নিজের অভিজ্ঞতার বিপরীত কথা ফলাও করে ব্যক্ত করে মিথ্যাচার করবেন বলে আশা করেন অনির্বাণবাবুরা? বস্তুত তা েেকরেননি বলেই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ, বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা সাংবাদিক নন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সকল রচনা সম্পর্কেই একথা বলতে পারেন :-“আমি যাহা দিবার যোগ্য মনে করিয়াছি তাহাই দিয়াছি। লোকে যাহা দাবি করিয়াছে তাহা যোগাইতে চেষ্টা করি নাই।”
অনির্বাণবাবুর ব্যাখ্যায় যা দাঁড়িয়েছে তাতে বোঝা যায় যে তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক হয়েও বৃহত্তর সামাজিক চেতনার স্তরে পৌঁছতে পারেননি।
অনিবার্ণবাবু বলেছেন :-“এ বিষয়ে আমরা রাজনীতিকদের অনেক সময় সমালোচনা করি, ব্যক্তিগত আচরণে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক নেতা কীভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমুদ্র মন্থন করে ক্ষমতার অমৃত আহরণ করেন তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে।”
অর্থাৎ অনির্বাণবাবুর মতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্ষমতালোভী নেতাদের ভাবনা-চিন্তার কোন ফারাক নেই। রবীন্দ্রনাথও যখন ‘ওরা’ আর ‘আমরা’র দল থেকে বের হতে পারেননি রামা-শ্যামাদের মতোই তখন রামা-শ্যামাদের মতো রবীন্দ্রনাথকেও কুলোর বাতাস দিয়ে উড়িয়ে দেবার সময় বোধহয় সুদূর পরাহত নয়।
দুর্বল হিন্দু ও সবল মুসলমান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নানা ভাবনায় অনিবার্ণবাবু তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) দৃষ্টির অস্বচ্ছতা লক্ষ্য করেছেন। অথচ মার্কসবাদী আলোচক নন্দগোপাল সেনগুপ্ত বলছেন :-“কে না জানেন দ্বাদশ শতকে যে মুসলীম অভিজেতারা ভারতে এসে শাসন কর্তৃত্ব অধিকার করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন মুষ্টিমেয়। এদেশের মানুষকে ধর্মান্তরিত করেই তাঁরা মুসলীম সংহতি তৈরী করেন এবং বিশ শতকে আমরা দেখলাম তাঁদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট কোটি। আর দেখলাম স্বতন্ত্র ধর্ম ও সংস্কৃতির দাবীদার রূপে পৃথক একটি দেশ গড়ে নিলেন।” (বস্তুবাদীর ভারত-জিজ্ঞাসা, পৃ-৫ )
রবীন্দ্রনাথকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অনির্বাণবাবু লিখেেেছন :-রবীন্দ্রনাথের মতো এমন সজাগ সচেতন মানুষের দৃষ্টিকেও আচ্ছন্ন করতে পারে এবং তার ফলে ইতিহাসের বিচারে বা সমকালীন ঘটনার বিশ্লেষণে অনেক বিপজ্জনক ভুল হয়ে যেতে পারে।”
অনিবার্ণবাবু রবীন্দ্রনাথকে সজাগ-সচেতনও বলেছেন, আবার তাঁর দৃষ্টি আচ্ছন্নও বলেছেন। স্বভাবতই বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যে কি রকম শোচনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সজাগ হয়েও দৃষ্টি আচ্ছন্ন হলে সজাগ থাকার সকল আয়োজনই তো ব্যর্থ—-অনির্বাণবাবুর রবীন্দ্রচর্চা শেষ পর্যন্ত এখানেই কলুর বলদের মতো নিজের বিশ্বাসের চারপাশেই ঘুরে বেড়ায়।
মালাবারের মোপলা বিদ্রোহ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়াকে তাঁর ‘দৃষ্টির আচ্ছন্নতা’ বলে বর্ণনা করে অনিবার্ণবাবু লিখেছেন যে শঙ্করাচার্য নিয়োজিত হিন্দুমহাসভার বালকৃষ্ণ মুঞ্জের রিপোর্টের ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথ ঘটনার ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।
অনির্বাণবাবু বিদ্রোহের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারার একটিকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে একে নেহাতই অর্থনৈতিক এক সংগ্রাম হিসেবে চালতে চান। মোপলা বিদ্রোহের লক্ষ্য যেদিকে পরিচালিত হয়েছিল তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে উৎসুক অনির্বাণবাবু বলবেন কি তিনি যে মোপলা বিদ্রোহকে, হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে মোপলাদের অর্থনৈতিক লড়াই বলছেন তাতে সাধারণ হিন্দুদের হত্যা করা হলো কেন?
মুঞ্জে রিপোর্টের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। বাবাসাহেব আম্বেদকার কি বলছেন দেখা যাক। আম্বেদকার তাঁর ‘Pakistan or Partition of India’ গ্রন্থে লিখেছেন :-“ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহের কারণ বোঝা যায়, কিন্তু যা বোঝা যায় না তা হল মালাবারের হিন্দুদের ওপর মোপলাদের ব্যবহার। মোপলাদের ভয়াবহ শিকার হল হিন্দুদের ভাগ্য। দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেনাবাহিনীকে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে নিয়োগ না করা পর্যন্ত হিন্দুদের ওপর মোপলাদের চরম অত্যাচার, যেমন-গণহত্যা, ধর্মান্তরকরণ, মন্দির ধ্বংস করা, নারীনিগ্রহ, গর্ভবতী রমণীদের পেট চিরে দেওয়া, লুঠতরাজ, ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ড ইত্যাদি চরম পাশবিক বল্গাহীন অত্যাচার চলল। এটা হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা নয়। এটা সৰ্বাত্মক ধ্বংসকাণ্ড। কত হিন্দু নিহত, আহত বা ধর্মান্তরিত হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে সংখ্যাটি বিশাল অঙ্কের সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।”
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অনিবার্ণবাবু কিংবা বর্তমান গ্রন্থের লেখকের মতো পুঁথি-পুস্তক ঘেঁটে মোপলা বিদ্রেহের স্বরূপ উপলব্ধি করেননি। স্বয়ং মালাবারে গিয়ে দেখে এসেছেন কীভাবে “চল্লিশ লাখ হিন্দু এক লাখ মুসলমানের ভয়ে মারাত্মক রকমে অভিভূত।”
এই প্রসঙ্গেই কবি বলেছিলেন :-“আমি বিশ্বাস করতে পারিনা, মালাবারে ইংরেজের জবর শাসনের অধীনে থেকে যা সম্ভবপর হয়েছে, ইংরেজের শাসন অপসৃত হবার দরুণই তা আর সম্ভবপর হবে না।”
অনির্বাণবাবুদের কথা মতো মোপলা বিদ্রোহ শুধুই ‘অর্থনৈতিক’হলে সেখানে মুসলমান জমিদাররা কেন আক্রমণের শিকার হলেন না?
অনিবার্ণবাবুর ইতিহাস সচেতনতা ‘অর্থনীতির’ গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খায় বলে আর একটু এগিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেনা।
আসলে মোপলাদের বিদ্রোহ মূলত একটি ধর্মান্ধ আন্দোলন হয়ে উঠেছিল। মোপলা বিদ্রোহের সময়কালটি বিবেচনা করলে বিষয়টি আর একটু স্পষ্ট হয়। বাবাসাহেব আম্বেদকার উল্লেখ করেছেন কীভাবে কিছু খিলাফৎ নেতা মোপলাদের বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বললেন :-“ধর্মের স্বার্থে মোপলারা যে সাহসিকতাপূর্ণ লড়াই চালাচ্ছিল তাকে অভিনন্দন।”
খিলাফৎ নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়াকে নিছক হাল্কা ভাবে দেখা যাবেনা। নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মোপলারা যে কত অবিচল ছিল তা পরবর্তী ঘটনাসমূহ থেকে প্রমাণিত হয়। মোপলারা জনৈক আলি মুদালিয়াকে রাজা ঘোষণা করে খিলাফৎ পতাকা উত্তোলন করে এবং এরনাদ ও ওয়ালুরানাকে খিলাফৎ রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
ইসলামের ‘জেহাদী’তত্ত্ব জানা থাকলে মোপলা বিদ্রোহকে নিছক ‘অর্থনৈতিক’ বলে চালাতে পারা যাবে না।
অনির্বাণবাবু রবীন্দ্রনাথকে ‘সাম্প্রদায়িক’ প্রমাণ করতে গিয়ে অদ্ভুত এক যুক্তি খাঁড়া করেছেন :-“সুদূর মালাবার অঞ্চলের একটি বিরোধের সম্পূর্ণ চিত্র রবীন্দ্রনাথ জানবেন কি করে? না জানাটা অপরাধ নয়। কিন্তু এমন একটি গুরুতর বিষয়ে এমন একটি মন্তব্য করার আগে জানার চেষ্টা করা জরুরী ছিল। আসলে একটা পূর্বনির্ধারিত ধারণা নিয়ে কোনও ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গেলে হয়তো সব দিক জানার তাগিদ থাকে না।”
বাঃ! অনির্বাণবাবুর এ মন্তব্যে রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে একটি মজার গল্প মনে পড়ছে।
একসময় রবীন্দ্রনাথ নাকি পরলোকচর্চা অর্থাৎ আমরা যাকে প্ল্যানচেট বলি, তাতে আগ্রহী হয়ে পরলোকগত জনৈক পরিচিত জনকে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন যে পরলোকটি কেমন? উত্তরে সেই পরলোকগত ব্যক্তিটি নাকি জবাব দিয়েছিলেন :-“ভারি মজাতো, আমি মরে যা জেনেছি তুমি না মরেই তা জানতে চাও?”
ঘটনার সময় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জীবিত থেকে, সুদূর মালাবারে গিয়ে যা জানতে পেরেছেন, অনির্বাণবাবু আজ ঘটনার এত কাল পরে, এত দূরে থেকেই তা জেনে গেলেন! অবশ্য অনিবার্ণবাবু জানার চেষ্টা অন্তত করেছেন আর নিজেই তো বলে রেখেছেন :-“না জানাটা অপরাধ নয় জানার চেষ্টা করা জরুরী, ………।”
রবীন্দ্রনাথ মালাবারের ঘটনাকে ‘হিন্দু-মুসলমানের অসমকক্ষতা’ বলে যে মন্তব্য করেছেন তা বাস্তব। তা না হলে মালাবারে হিন্দুর সংখ্যা মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশী হওয়া সত্বেও সেখানে “খিলাফৎ’রাজ্য হওয়া সম্ভব ছিল?
রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু’র আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর বাংলার বাতাসে মন্দ্রিত হতে দেখলে অনির্বাণবাবুর ‘ইতিহাস সচেতনতা’ সম্পর্কে বলার কিছু নেই।
‘ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু’র কথা বলে অনির্বাণবাবু বর্তমানে যে সংবাদপত্রে ‘মসি’ ও রবীন্দ্রনাথকেও ছিন্নবিচ্ছিন্ন করবার জন্য ‘অসি’ চালনা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন, সেই সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রতি ‘ব্যঙ্গোক্তি’ বর্ষণ করলেও, ১৯২৬ সালে ওঠা একটি বিতর্কের বিষয় উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা সম্পর্কে ভেবে দেখতে বলব।
নিতান্ত হাস্যকর বিতর্ক হলেও এর মধ্যে দিয়ে ‘প্রবল মুসলমান’ কি ভাবে ‘ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু’কে আতঙ্কিত করতে চাইছে শুধু তা নয়, ‘বর্ধিষ্ণু মুসলমান’-এর মনেও শ্লাঘার সূচনা করছে তা-ও বোঝা যাবে।
১৭৬১তে অনুষ্ঠিত পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এক বিতর্কের সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর তিন-এর দশকে। মুসলমানদের মত ছিল এই যুদ্ধে আহম্মদ শা আবদালি মাত্র একলক্ষ সৈন্য নিয়ে চার-পাঁচ লক্ষ মারাঠা সৈন্যকে পরাজিত করেছিলেন। অপরদিকে হিন্দুরা মনে করতেন এই যুদ্ধে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ছাড়া মারাঠাদের কোনোরকম জাতীয় বিপর্যয় ঘটেনি এবং যুদ্ধের এক দশকের মধ্যেই মারাঠারা উত্তরভারতে বিলুপ্ত শক্তি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দুদের যুক্তি না মেনে, মুসলমানেরা যে হিন্দুদের চাইতে উৎকৃষ্ট তা প্রমাণ করবার জন্য মৌলানা আকবর শা খান, মদনমোহন মালবীয়াকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন।
মৌলানা বলেন :-“মালব্যজি, পানিপথের ফলাফলের মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা যদি আপনি করেন তো (পরীক্ষার্থে) আমি, আপনকে একটি সহজ ও চমৎকার উপায় দেখাব। আপনার সুবিদিত প্রভাবকে কাজে লাগান এবং কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কোনও বাধা ছাড়া পাণিপথের চতুর্থ যুদ্ধ লড়ার জন্য অনুমতি দিতে ব্রিটিশ সরকারকে প্রভাবিত করুন। হিন্দু ও মুসলমানদের সৌর্য ও যোদ্ধৃ মানসিকতার একটি তুলনামূলক পরীক্ষা দিতে আমি প্রস্তুত। যেহেতু ভারতে ৭ কোটি মুসলমান রয়েছেন। নির্ধারিত তারিখে ভারতে সাত কোটি মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী সাতশো মুসলমানকে নিয়ে আমি পাণিপথের সমতলে পৌঁছব। আর যেহেতু ভারতে ২২ কোটি হিন্দু রয়েছেন আমি আপনাকে বাইশশো কিন্তু আনতে দেব। সঠিক ব্যাপার হবে কামান, মেশিনগান বা বোমা ব্যবহার না করা। শুধু তরবারী, বর্শা ও বল্লম, তীর-ধনুক এবং ছুরি ব্যবহার করা যায়। হিন্দু বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ যদি আপনি গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে সদাশিব রাও বা বিশ্বেশ্বর রাও (পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধে এঁরা ছিলেন মারাঠাদের পক্ষে সামরিক সেনাপতি)-এর কোনও উত্তরাধিকারীকে আপনি সেই পদ দিতে পারেন যাতে তাদের বংশধররা ১৭৬১তে তাদের পূর্বপুরুষদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পায়। কিন্তু যেভাবেই হোক একজন দর্শক হিসাবে আসুন, কারণ যুদ্ধের ফলাফল দেখে আপনার মতামত পরিবর্তন করতে হবে। আর আমি আশা করি তখন দেশে বর্তমান বিরোধ ও লড়াইয়ের অবসান ঘটবে। উপসংহারে আমি বিনীতভাবে পেশ করতে চাই যে আমি সাতশো লোককে আনব তাদের মধ্যে যে পাঠান বা আফগানদের সম্পর্কে আপনারা মারাত্মকভাবে ভীত তাদের কেউ থাকবে না। তাই আমি আমার সঙ্গে শরিয়তের কঠোর অনুসারি ভাল পরিবারের ভারতীয় মুসলমানদেরই শুধু আনব।” (বাবা সাহেব ডঃ আম্বেদকার রচনা-সম্ভার, ভারত সরকার, পৃ-৩২৫)
রবীন্দ্রনাথ যখন ‘প্রবল’ মুসলমানের কথা বলেন তখন তাঁর সময়কার প্রাত্যহিক উদাহরণের বাইরে গিয়ে তত্বকথা প্রচার করতে চাননি—অনির্বাণবাবু রবীন্দ্রনাথের এই অকপটতাকেও ‘ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু’র আতঙ্ক বলেছেন।
রবীন্দ্রনাথ কারও মন জুগিয়ে কথা বলেননি কখনো। রবীন্দ্রনাথ নিজে সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বলেছেন :-“আমার রচনায় অপ্রিয় বাক্যও আমি অনেক বলিয়াছি এবং অপ্রিয় বাক্যের যাহা নগদ-বিদায় তাহাও আমাকে বার বার পিঠ পাতিয়া লইতে হইয়াছে। ……….. … কিন্তু যাহাকে আমি সত্য বলিয়া জানিয়াছি তাহাকে হাটে বিকাইয়া দিয়া লোকপ্ৰিয় হইবার চেষ্টা করি নাই।”
অনির্বাণবাবুরা রবীন্দ্রনাথকে এখন যে দক্ষিণা দিয়ে চলেছেন তাতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও নগদ লাভের কোন সম্ভাবনা না থাকলেও, জাতির পৃষ্ঠে তা বাহিত হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
অনির্বাণবাবু রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র এবং প্রবন্ধ সাহিত্য ছাড়া গল্প-উপন্যাসের চরিত্র ও তাদের সংলাপ নিয়েও রবীন্দ্রনাথকে কটাক্ষ করেছেন।
বলেছেন :-”গোরা উপন্যাসের ‘ঋষিপ্রতিম’ পরেশবাবুর সুসমাচার স্মরণীয়।” রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। এ সম্পর্কে কবি স্বয়ং যা বলেছেন তা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে দেওয়ার অবকাশ অনিবার্ণবাবু স্বয়ং করে দিয়েছেন।
অনিবার্ণবাবু ‘ঋষিপ্ৰতিম’ পরেশবাবুর কথায় রবীন্দ্রনাথের অনেক ভাবনার মিলও যদি পান তাহলেও রবীন্দ্রনাথ যে পরেশবাবু নন অথবা পরেশবাবু রবীন্দ্রনাথ নন, তা না বোঝার মতো অবিবেচক অনিবার্ণবাবু অন্তত নন। কিন্তু গোরা উপন্যাসের ‘খষিপ্রতিম’ পরেশবাবুর কথা উদ্ধৃত করলেও ‘ঘরে বাইরে’-র মানবপ্রতীম’ নিখিলেশের কথা উদ্ধৃত করলে দেখতে পেতেন সেখানে অন্তত এমন একটি বক্তব্য “………পরের ধর্মের উপর আমাদের হাত নেই।…………. মুসলমানকেও নিজের ধর্মমতে চলতে দিতে হবে”–রয়েছে, যা ‘ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু’র আতঙ্ক নয়, হৃদয় ও মস্তিষ্কের চলিষ্ণুতার দ্যোতক!
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্প-উপন্যাস কিংবা কাব্যসাহিত্যের চরিত্রের মুখের কথায় রচনাকারের ‘মনস্তত্বের’ অনুসন্ধান সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন :-”এদেশের কোন পরিচিত লোককে যদি নিন্দা করতেই হয়, নিন্দার অহেতুক আনন্দেই হোক্, অথবা কোনো উদ্দেশ্যমূলক কারণেই হোক, অন্তত সেটা বিশ্বাস্য হওয়া চাই, নইলে বুদ্ধির প্রতি দোষ আসে।”
সমালোচনাকারীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন :-”আমি সাহিত্য বিচার সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে তাঁকে এই উপদেশটুকু দেব যে, কাব্যে নাটকে পাত্রদের মুখে যে সব কথা বলানো হয়, সে কথাগুলিতে কবির কল্পনা প্রকাশ পায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবির মত প্রকাশ পায় না। প্যারাডাইস লটে ‘The Arch Fiend’ বলেছেন :-
“To do aught good never will
but ever to do ill our sole
be our task
delight.”
সন্দেহ নেই কথাগুলো উদ্ধতভাবে সুনীতিবিরুদ্ধ।
কিন্তু আজপর্যন্ত কোন ছাত্র বা অধ্যপক, কোন মাসিকপত্রের সম্পাদক বা পাঠক মিল্টনকে এ বলে অনুযোগ করে নি যে, পাঠকের মনে দুর্নীতি ও ঈশ্বর-বিদ্রোহ বদ্ধমূল করা কবির অভিপ্রেত ছিল। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকের তালিকা থেকে প্যারাডাইস লস্টকে উচ্ছেদ করবার প্রস্তাব এখনো শোনা যায়নি, কিন্তু বাঙ্গালা দেশে কখনোই শোনা সম্ভব হতে পারে না, জোর করে এমন কথা বলার মুখ আর আজ রইলো না।”
রবীন্দ্রনাথ এজাতীয় সমালোচনার একটা কারণও অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন। লিখেছেন :-“……….তবে কি বাংলা দেশের পঙ্কিল মাটিকেই দায়ী করব? প্রাকৃতিক কারণ ছাড়া কোনো রকম নৈতিক কারণ অনুমান করতেও সাহস করিনে।”
আদতে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনায় এক নতুন ধারা স্পষ্ট হচ্ছে, অনির্বাণবাবুর রচনা সে ধারারই প্রকাশ। শিল্পী-সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকারদের সৃষ্টি নিক্তিতে মেপে দেখা হচ্ছে সেখানে কটি মুসলমান চরিত্র রয়েছে, মুসলমানের দোষত্রুটিকে উল্লেখ না করে সর্ববিষয়ে তাকে কত মহৎ করেক তোলা হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন রচনায় হিন্দু সমাজের পক্ষে মুসলমানকে গ্রহণের যাবতীয় বাধাকে তীব্র কশাঘাত করেছেন। লোকহিত প্রবন্ধে লিখেছেন :–“হিন্দু মুসলমানের পার্থক্যটাকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশী-প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই।”
নিজের জমিদারির সেরেস্তায় ব্রাহ্মণ ম্যানেজার যে তক্তপোষের গদিতে বসে দরবার করেন, সেখানে একধারে জাজিম তোলা অংশে মুসলমান প্রজাদের বসবার স্থান নির্ধারিত করার বিষয়টি উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু সমাজের সমালোচনা করেছেন।
অবশ্য এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, হিন্দুর দ্বারা মুসলমানের স্পর্শ এড়িয়ে চলার চেষ্টা যে আদতে হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথারই অঙ্গ এবং অনেক তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুর মতো মুসলমানের প্রতিও সম্প্রসারিত, তা উল্লেখ করেননি।
এবিষয়টি উপলব্ধি করবার জন্য বিপিনচন্দ্র পাল রচিত তাঁর আত্মজীবনী ‘সত্তর বৎসর’ গ্রন্থটির প্রতি নজর দেওয়া যেতে পারে।
বিপিনচন্দ্র হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথার আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন :-“শ্রীহট্ট সাহা-প্রধান স্থান। শহরে সাহারাই ধনসম্পদে হিন্দুসমাজের শ্রেষ্ঠ। ………শহরের ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকেরা ইঁহাদিগের সঙ্গে পানাহার করিতেন না। …….ইহারা কর্মোপলক্ষ্যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরে আসিলে যতক্ষণ ফরাস হইতে হুঁকো না সরান হইয়াছে, ততক্ষণ তাহাতে বসিতেন না। মুসলমানদের জন্য যেমন ফরাসের সম্মুখে স্বতন্ত্র চেয়ার বা কেদারা সাজান থাকিত, সাহাদের জন্যও সেই ব্যবস্থা ছিল।” (সত্তর বৎসর, পৃ-৬৯-৭০)
শুধু সাহারাই নন, বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন কিভাবে চর্মকার কিংবা ডোম ইত্যাদির কথা তো বাদই দেওয়া গেল, এমনকী সুবর্ণবণিক, যোগী ইত্যাদিরাও হিন্দুসমাজে অস্পৃশ্য ছিলেন।
এভাবেই ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ সমগ্র হিন্দুসমাজকেই গ্রাস করেছিল এবং তার শিকার হয়েছিল বিভিন্ন শ্রেণীর হিন্দু এবং মুসলমানরা আলাদা করে শুধু মুসলমানরা নয়। সমাজগবেষকরা এই বিষয়টির প্রতি নজর দিতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের যাবতীয় বিষয় নিয়ে লিখে যাবেন এমন আশা করা যায় না। কিন্তু যেখানে যা কিছু লিখেছেন তার পিছনে তাঁর বিচার এবং বিশ্লেষণ ক্রিয়াশীল থেকেছে। দু’কলম লিখেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তা বা মতকে নস্যাৎ করার আগে বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপট শুধু হিন্দু আর মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত না রেখে, মানবিক মূল্যবোধগুলিকেও গুরুত্ব দেওয়া সঙ্গত।
মুসলমান বিচ্ছিন্নতার মূলে রয়েছে মুসলমান পশ্চাদগামিতা। ইসলামের দর্শন যে এই পশ্চাদগামিতার বড় কারণ বহু বিশিষ্ট মুসলমান পণ্ডিত তা অনুধাবন করতে পারেন। বহুপূর্বে বেগম রোকেয়া মুসলমান মহিলাদের মধ্যে শিক্ষাাবস্তারের কাজ করতে গিয়ে, রোকেয়ার কথাতেই কুড়িয়েছেন “কাঠ মোল্লাদের অভিসম্পাত”।
ধর্মমোহকে সম্মান জানানোর কোনো কারণ নেই—এ যেমন হিন্দুধর্মের বিষয়ে সত্য, মুসলমানধর্মের বিষয়েও তার অন্যথা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু তথাকথিত হিন্দুয়ানীর বিরোধিতা করতে গিয়ে যেভাবে, এমনকী মুসলমান ধর্মান্ধতাকেও উৎসঙ্গিত করা হচ্ছে, তা যে একান্তই আত্মঘাতী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তা বোঝেন না, এমন নয়। কিন্তু অহেতুক (!) সত্যকে স্বীকার করে রাষ্ট্রীয় ও অন্যবিধ নগদ বিদায়ের সম্ভাবনা নষ্ট করাকে বাস্তববুদ্ধি বলে মনে করেন না। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের তা প্রয়োজন ছিল না বলে এখন তাঁরাও সাম্প্রদায়িকভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলেন বলা হচ্ছে।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন