অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৯

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

১৯

সুরঞ্জন এক মুহূর্তের জন্য খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বিনা অনুমতিতে ম্যানুস্ক্রিপ্টটায় হাত দেওয়ার জন্য। অঘোরেশ এমনিই একটু অন্যরকম, দুম করে রেগে যায়, এই ব্যাপারে ওর প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা আন্দাজ না করেই সুরঞ্জন বলে ফেললেন, ‘কী রে, এত দেরি হল কফি আনতে? তোর কালেকশন দেখছিলাম আর কি, ঘুরে ঘুরে!’

কিন্তু অঘোরেশ কিছু মনে করলেন না, কফির একটা কাপ সুরঞ্জনের দিকে বাড়ালেন, অন্যটা রুদ্রর হাতে দিলেন, তারপর খসখসে গলায় বললেন, ‘বেশ করেছিস। তোর সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা করব বলেই তো ডেকেছি।’ তারপর একটু থেমে একটা চিনির ডিব্বা এগিয়ে ধরলেন, ‘চিনির কৌটোটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই দেরি হল।’

সুরঞ্জন কিছু বললেন না। একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন অঘোরেশের স্ত্রী কি ভেতরেই আছেন? খুব অসুস্থ না হলে একবার আলাপ করতেন। কিন্তু না, কথাটা গিয়ে ফেললেন। চুপচাপ কফির কাপটা হাতে নিয়ে স্তূপাকৃতি বইয়ের পাশে কার্পেটে বসে পড়লেন।

হঠাৎ করেই ঘরের মধ্যে যেন অস্বাভাবিক একটা নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে।

রুদ্র চুপচাপ লক্ষ করছিল। অঘোরেশ লোকটা ওরা আসার পর থেকে একবারের জন্যও রুদ্রর সঙ্গে কথা বলেননি, এমনকী রুদ্রর দিকে তাকাননি। মনে হচ্ছে সুরঞ্জন একাই যেন রয়েছেন ঘরে। ও-ও কিছু না বলে কফির কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখল।

অঘোরেশই মুখ খুললেন, পাণ্ডুলিপিটার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওটা দেখলি?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘হ্যাঁ।’ চিনিসর্বস্ব কালো কফিতে চুমুক দিয়ে তাঁর মুখ বিস্বাদ হয়ে উঠল। নির্ঘাত অঘোরেশ নিজেই কফিটা বানিয়েছে!

অঘোরেশ পাণ্ডুলিপিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘আবদুল হামিদ লহরীর লেখা শাজাহানের বায়োগ্রাফি বাদশাহনামা।’

সুরঞ্জন কিছু না বলে চেয়ে রইলেন অঘোরেশের দিকে।

অঘোরেশ বলে চললেন, ‘তোকে পুরো ব্যাপারটা খুলেই বলি। তুই তো আমাকে বহুদিন ধরেই চিনিস। মোনোটোনাস জীবন আমার একদম পছন্দ নয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়াতাম ঠিকই, কিন্তু সবসময় নতুন কোনো কিছু জানার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। বেশ কিছু বছর যাবৎ আমি এমন একটা জিনিস নিয়ে কাজ করছি যেটা জানলে তুই আশ্চর্য হয়ে যাবি।’

সুরঞ্জন বললেন, ‘সেদিন তো বললি, শাজাহানের সময়ের পিনাল কোড, ল। এসব নিয়ে তো?’

অঘোরেশ ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন, ‘ধুর! ওটা তো ওপর ওপর লোককে বলেছি। আসল টপিকটা এখনই কাউকে জানাতে চাই না। তবে আমার কাজ কয়েকদিনের মধ্যেই সারা পৃথিবী জানবে, তখন প্রতিটা ইতিহাস বই আবার নতুন করে লিখতে হবে।’

রুদ্র হঠাৎ বলে ফেলল, ‘ড নিজামুদ্দিন বেগও তো এই নিয়েই গবেষণা করছিলেন। আপনি তাঁকে চিনতেন?’

অঘোরেশ যেন থমকে গেলেন, গভীরভাবে তাকালেন রুদ্রর দিকে, ‘তুমি কী করে চিনলে ওঁকে?’

রুদ্র চোখে চোখ রেখে বলল, ‘উনি নিরুদ্দেশ, গোটা আগ্রা জানে। এখনও ওঁর বাড়িতে হামলা হয়ে চলেছে।’

অঘোরেশ জোরে জোরে মাথা নাড়লেন দু-দিকে, ‘না, আমি চিনি না। ওই নামে আমি কাউকেই চিনি না!’ তারপর সুরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই নিশ্চয়ই জানিস, শাজাহান তাঁর ঠাকুরদা আকবরের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। ঠাকুরদার জীবনী আকবরনামার মতোই শাজাহানও চেয়েছিলেন তাঁরও একটা সম্পূর্ণ জীবনী লেখা থাকুক। তিনি মুঘল দরবারে রাজত্ব করেছিলেন প্রায় ত্রিশ বছর। প্রথমে মহম্মদ আমিন কাজভিনি বলে একজন তাঁর জীবনী লিখতে শুরু করেন, তারপর মোট দুটো খণ্ডে কাজটা সম্পূর্ণ করেন আবদুল হামিদ লহরী। লহরী সায়েবকে শাজাহান নিজের সভায় একটা গুরুত্বপূর্ণ পদও দিয়েছিলেন।’

সুরঞ্জনের এই তথ্যগুলো জানা এবং অদ্ভুত কাকতালীয়ভাবে আজ সকালে রুদ্রর সঙ্গে গল্পও করেছিলেন এই নিয়ে। বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে তাঁর স্পেশালাইজেশন থাকলেও মাস্টার্সে মধ্যযুগের ইতিহাসও তাঁর সাবজেক্ট ছিল। তিনি সংক্ষেপে বললেন, ‘জানি।’

রুদ্র দু-জনের কথোপকথন শুনছিল, শুনতে শুনতেই ও জানলার পাশটায় গেল একবার, এবারেও পাল্লা না খুলে ফাঁক করল, না, কেউ নেই। ফাঁকটা বন্ধ করতে যেতেই ওর চোখে পড়ল দূরে চায়ের গুমটিটা, সেখানে একভাবে বসে রয়েছে লোকটা, তাকিয়ে আছে এইদিকেই।

রুদ্র চিন্তিতভাবে ঘরের ভেতরে তাকাল, অঘোরেশ উজ্জ্বল মুখে সুরঞ্জনকে বলছিলেন, ‘আচ্ছা একটা কথা বল, শাজাহানের নিজের সভাসদের লেখা এই বায়োগ্রাফিতে আমরা যদি এমন কোনো ইনফরমেশন বা ঘটনা পাই, যেটা শাজাহানের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে না, সেটা তো তাহলে সত্যি হবেই, তাই না? মানে, এই বায়োগ্রাফিটা নিশ্চয়ই বাদশা নিজে ভেরিফাই করে তারপর গ্রিন সিগনাল দিয়েছিলেন জনসমক্ষে আনার, তারপরেও এমন ঘটনা লেখা রয়েছে মানে সেটা সত্যিই ঘটেছিল, ঠিক কি না?’

সুরঞ্জন ওপরনীচে মাথা নাড়লেন। অঘোরেশ ঠিকই বলছেন। স্তাবকের লেখা বায়োগ্রাফিতে থাকা ভালো ঘটনাগুলো মিথ্যে না হলেও বহুমাত্রায় অতিরঞ্জিত থাকে, কিন্তু খারাপ কিছু লেখা থাকলে সেটা সত্যি হতে বাধ্য।

অঘোরেশ বললেন, ‘গুড!’ এবার পাণ্ডুলিপিটার একটা পৃষ্ঠা খুলে এগিয়ে দিলেন সুরঞ্জনের দিকে, ‘এটা ৪০৩ নম্বর পৃষ্ঠা। একুশ নম্বর লাইন থেকে জোরে জোরে পড়।’

সুরঞ্জনের ভ্রূ কুঁচকে গেল। ফার্সি-আরবি মেশানো ন্যাস্টালিক ক্যালিগ্রাফি তিনি পড়বেন কী করে! অঘোরেশের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের ওপরেই পড়াশুনো, কিন্তু সুরঞ্জনের তো তা নয়! অতি উত্তেজনায় মনে হয় অঘোরেশের মাথা কাজ করছে না, ‘আমি কী করে পড়ব। তোর সাবজেক্ট। আমি পড়তে জানি নাকি! তুই পড়, আমি শুনি।’

অঘোরেশ সঙ্গেসঙ্গে ফেরত নিয়ে এলেন, ‘ও হ্যাঁ তাই তো! ঠিক আছে, আমি পড়ছি। উর্দুর মতোই, ডান দিক থেকে শুরু করে বাঁ-দিকে পড়তে হয়। শুধু পুরোনো ফার্সির প্রভাব আছে এতে। যাই হোক, আমি হিন্দিতে ট্রান্সলেট করে পড়ছি, তুই শোন।’

সুরঞ্জন একটু উশখুশ করে রুদ্রর দিকে তাকালেন, কিন্তু রুদ্র তাঁকে ইশারায় ধৈর্য ধরতে বলল।

সুরঞ্জন মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। আরও দেরি হলে পূরবী চিন্তা করবেন। কিন্তু, অঘোরেশের আসল দরকারটা তো এখনও বোঝা যাচ্ছে না! তিনি ঠিক করলেন আর কুড়ি মিনিটের মধ্যে তাঁকে উঠতেই হবে।

অঘোরেশ থেমে থেমে হিন্দিতে ট্রান্সলেট করে পড়তে শুরু করলেন, ‘শুক্রবার, ১৫ জুমাদিল আওয়াল, পরলোকগতা রানি মুমতাজ-উল-জামানির সেই পবিত্র মরদেহ, যা বুরহানপুরে অস্থায়ীভাবে কবরস্থ করা হয়েছিল, তা রাজধানী আকবরাবাদে আনা হল। সঙ্গে এলেন যুবরাজ শাহ সুজা বাহাদুর, ওয়াজির খাঁ এবং রানির খাস দাসী সতিউন্নেশা খানম।

‘সম্রাট আদেশ দিলেন যে, প্রত্যহ দীন-দুঃখী ও পির-ফকিরদের মধ্যে জাকাত বিতরণ করা হোক। শহরের দক্ষিণে, যেখানে সবুজ তৃণগুল্মে আচ্ছাদিত বিশাল উদ্যান, যার মধ্যবর্তী স্থানে সেই বিশাল সাদা ইমারত, যা পূর্বে রাজা মানসিংহের সম্পত্তি ছিল এবং যার বর্তমান মালিক তাঁর পৌত্র রাজা জয়সিংহ, সেই প্রাসাদেই জন্নতবাসী রানিকে কবরস্থ করা হবে স্থির করা হল। যদিও রাজা জয়সিংহ তাঁর পূর্বপুরুষের সেই সম্পত্তিকে অতিশয় মূল্যবান মনে করতেন, তথাপি সম্রাট শাজাহানকে তা বিনামূল্যে ছেড়ে দিতে রাজি হলেন। কিন্তু ধর্মীয় নিয়মাবলি ও মৃতার প্রতি মর্যাদার কথা চিন্তা করে সতর্ক সম্রাট সেই প্রাসাদ বিনামূল্যে অধিগ্রহণ করাটা যুক্তিযুক্ত হবে না বিবেচনা করে শরিফাবাদ নামক স্থানে রাজা জয়সিংহকে পুনর্বাসন দিলেন। কাজেই সেই বিশাল প্রাসাদের বদলে জয়সিংহকে সরকারি জমি দান করা হল। শবদেহ আগ্রায় পৌঁছোবার পর, সেই শোভন শবদেহকে সেখানে চিরবিশ্রামে শায়িত করা হল। আকাশচুম্বী সেই সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত রাজধানীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সরকারি নির্দেশে, সেই পুণ্যবতী রমণীর মরদেহকে সাধারণের দৃষ্টির আড়াল করল এবং সেই গাম্ভীর্যপূর্ণ, শীর্ষদেশে জয়সিংহের গম্বুজ শোভিত বিশাল প্রাসাদ রানি মুমতাজ-উল-জামানির এক অসাধারণ স্মৃতিসৌধে পরিণত হল। সমগ্র কাজের জন্য ৪০ লক্ষ অর্থ ব্যয় করা হল।’

অঘোরেশ এই পর্যন্ত পড়ে থামলেন, বললেন, ‘জুমাদিল আওয়াল হল ইসলামিক ক্যালেন্ডারের পঞ্চম মাস। প্রথম মাস মহরম দিয়ে শুরু করে বারোটা মাসে শেষ হত ওই ক্যালেন্ডার। মুমতাজ-উল-জামানি হলেন শাজাহানের স্ত্রী মুমতাজ। আসল নাম অবশ্য ছিল আরজুমান্দ বানু। আর ওই যে বলছে রানির মরদেহ আকবরাবাদে আনা হল, ওটা হল আগ্রারই তখনকার নাম। আর জাকাত মানে তো বুঝতেই পারছিস দানখয়রাত করা।’

সুরঞ্জন চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন, অঘোরেশ থামতে একটু কনফিউজড হয়ে বললেন, ‘মানে, এতে লেখা রয়েছে শাজাহানের স্ত্রী মুমতাজকে রাজা মান সিং-এর এক প্রাসাদকে স্মৃতিসৌধে পরিণত করে কবরস্থ করা হল?’

অঘোরেশের চোখ জ্বলজ্বল করছিল, নিজের ঊরুর ওপর হাত চাপড়ে বললেন, ‘ইয়েস!’

সুরঞ্জন বললেন, ‘কিন্তু, তা কী করে হয়! শাজাহান তো তাজমহল বানিয়েছিলেন মুমতাজের স্মৃতিসৌধ হিসেবে! তুই ঠিক পড়ছিস তো? এরকম তো কোনো প্রাসাদের কথা শুনিনি।’

অঘোরেশ চট করে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর ফর্সা মুখ টকটকে লাল রং ধারণ করেছে, চোখগুলো যেন জ্বলছে, চিৎকার করে বললেন, ‘তোদের মতো লোকেদের জন্য ইতিহাস কোনোদিনও সত্যি কথা বলে উঠতে পারল না। তোদের চোখ থেকেও নেই, তোরা অন্ধ!’

সুরঞ্জন কড়া গলায় বললেন, ‘কী বলতে চাইছিস ঠিক করে বলবি কি? না হলে আমি এবার উঠি, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার!’

অঘোরেশ অমনি কাছে এসে সুরঞ্জনের হাত চেপে ধরলেন, ‘লিটল বুদ্ধা, খোদ শাজাহানের সরকারি বায়োগ্রাফিতে লেখা আছে যে তাজমহল শাজাহান বানাননি, রাজা মানসিংহের একটা প্রাসাদ, যাতে শিবমন্দির ছিল, সেটাকেই রেনোভেট করে তাজমহল নাম দিয়েছিলেন। আর ইতিহাসে এই কথাটা পুরো চেপে যাওয়া হয়েছে। আমি অনেক প্রমাণ পেয়েছি।’

সুরঞ্জনকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অঘোরেশ আরও জোরে হাত ঝাঁকালেন, ‘আর শোন, আমি শুধু প্রমাণ পেয়েই ছেড়ে দিচ্ছি না। সারা পৃথিবীর সামনে আমি সত্যিটা তুলে ধরব। সেরকমভাবেই আমরা এগোচ্ছি।’

সুরঞ্জন বললেন, ‘এই একটামাত্র কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটা কী করে প্রমাণ হচ্ছে? শোন, দেড়-দু-হাজার বছর হলে একরকম ছিল, এই তো চার-পাঁচশো বছর আগেকার কথা, এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, শাজাহানের সময়কার আরও অনেক এভিডেন্স আছে, সেগুলো দেখলেই তো পাওয়া যাবে। সব কি চেপে যাওয়া যায় নাকি! তাজমহল বানাতে কুড়ি বছর সময় লেগেছিল, অত হাজার হাজার লেবার, তাদের পারিশ্রমিক, ম্যানেজমেন্ট, সব কিছুরই নিশ্চয়ই হিসাব…।’

অঘোরেশ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, সব কিছুই চেপে যাওয়া হয়েছে। কত লেবার ছিল সে-ব্যাপারে কোনো জায়গাতেই সেরকম ক্লিয়ারলি কিচ্ছু বলা নেই। কোথাও বলা হয়েছে কুড়ি হাজার, কোথাও চল্লিশ হাজার, কোথাও আবার তারও বেশি। এরকম আর একটা ইম্পর্ট্যান্ট জিনিসের তো হিসাবের খাতাতে পরিষ্কার হিসেব থাকা উচিত, তাই না! শাজাহানের যথেষ্ট ভালো ভালো সব অ্যাকাউন্টেন্ট ছিল। আর তা ছাড়া শাজাহানের ত্রিশ বছরের শাসনকালে বাদশাহনামা ছাড়াও আরও অনেক বই লেখা হয়েছে। ইজায়েত খাঁ লিখেছিলেন শাজাহাননামা, বখতিয়ার খাঁ-র মিরাত-ই-আলম, মুফাজ্জাল খাঁ-র তারিখ-ই-মুফাজ্জালি, এত বড়ো একটা জিনিস তৈরি হচ্ছে কুড়ি বছর ধরে, সে-ব্যাপারে কোথাও কোনো উল্লেখ নেই কেন?’

সুরঞ্জন থতোমতো খেয়ে রুদ্রর দিকে তাকালেন।

এতক্ষণ বাদে রুদ্র মুখ খুলল, ‘একজন মাত্র সভাসদ, তাঁর লেখা একটা অনুচ্ছেদ থেকেই আপনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তাজমহল শিবমন্দির ছিল? তাহলে তাজমহলের গায়ে কোরানের বাণী খোদাই করা আছে কেন? এত বড়ো বড়ো ইতিহাসবিদ, তাঁরা কি সব ভুল লিখেছেন?’

অঘোরেশ এবার রুদ্রর দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টি একবার জ্বলেই আবার নিভে গেল, বললেন, ‘দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাসের যে ক-টা প্রামাণ্য বই লেখা হয়েছে, সেগুলো সবই একপেশে, পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। সত্যি কথা ক-টা লেখা হয়েছে? নেতাজির পেছনে কেমনভাবে চক্রান্ত করা হয়েছিল, লেখা আছে কোথাও? শয়ে শয়ে রাজপুত প্রাসাদকে কীভাবে মুসলমানরা নিজেদের হারেমে, নিজেদের মসজিদে পরিণত করেছিল, কোথাও বলা আছে? তোমরা সব এখনকার ছেলেমেয়েরা তো সেই ইতিহাসই পড়ছ! তাই, তোমরা সত্যিটা হজম করতে পারছ না।’ তিনি একটা লম্বা শ্বাস নিলেন, ‘যাই হোক, তুমি আরও জানতে চাইছ বলে বলছি, শোনো তাহলে। শাজাহান যখন দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গেই ছিলেন স্ত্রী মুমতাজ, সেখানেই ১৬৩১ সালে তিনি চোদ্দো নম্বর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। বুরহানপুরে তাঁকে অস্থায়ী কবর দেওয়া হয়। এদিকে পরের বছরই লহরী সাহেব লিখছেন, তাঁর কবর তুলে নিয়ে এসে সমাধিস্থ করা হয় তাজমহলে। তাজমহল তৈরি করতে লেগেছিল নাকি প্রায় একুশ বছর, ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ সাল অবধি, তাহলে মাঝের কুড়িটা বছর বুরহানপুর থেকে তুলে নিয়ে মুমতাজের কবরকে কি খোলা মাঠে রাখা হয়েছিল? আর যে প্রাসাদ সবে তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে, তাতে মাত্র একবছর বাদেই কেন মুমতাজের কবর নিয়ে চলে আসা হবে যদি না শাজাহান একটা রেডিমেড প্রাসাদ আগে থেকেই পেয়ে থাকেন?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘এগুলো তো অনুমান!’

‘অনুমান? কী করে অনুমান হচ্ছে? আচ্ছা, তাহলে আরও শোন।’ অঘোরেশ সামনে থেকে ধূলিধূসরিত একটা বই তুলে নিলেন, ‘শাজাহানের সময়ে ১৬৪১ সালে টাভার্নিয়ার নামে একজন ফ্রেঞ্চ অলংকার ব্যবসায়ী ভারতে আসেন। তিনি প্রায় পঁচিশ বছর সুরাট, আগ্রা এইসব জায়গায় ছিলেন। টাভার্নিয়ার লিখে গেছেন ভারতে আসার পরই তিনি শাজাহান পত্নীর বিখ্যাত সমাধিটি দেখতে যান।’ অঘোরেশ বইয়ের একটা পাতা খুলে সামনে এগিয়ে দিলেন, ‘তিনি লিখে গেছেন, জায়গাটা ছিল তাসি মকানের মাঝখানে, তাসি মকান তখন আগ্রার বিখ্যাত তুলোবিক্রির বাজার, পুরো বাজারটায় বেচাকেনার জন্য ছোটো ছোটো দোকান ছিল, আর পুরো তাজমহলের বাইরেই তখন ইট দিয়ে বিশাল পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়েছিল, ফলে তিনি ভেতরে গিয়ে কিছু দেখতে পাননি, কিন্তু ভারা বাঁধার কাজে নাকি সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছিল।’

‘তো?’ রুদ্র বলল, ‘এ থেকে কী প্রমাণ হচ্ছে?’

‘প্রমাণ হচ্ছে এটাই যে, তাজমহল বহুমূল্য পাথর দিয়ে তৈরি, সেখানে এতরকমের খরচের মধ্যে ভারা বাঁধার খরচ সবচেয়ে বেশি এমন উদ্ভট কথা টাভার্নিয়ার বলবেন কেন? তার কারণ, শাজাহান শুধু হিন্দু প্রাসাদটির চারপাশে ভারা বেঁধে কোরানের বাণী উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন আর কবরটা বানিয়েছিলেন। তা ছাড়া তাজমহলের তিন পাশে সার দিয়ে যে ছোটো ছোটো ঘর রয়েছে, সেটাই সেই তাসি মকান, হিন্দু রাজার আমলের তুলো বিক্রির বাজার।’

‘তাজমহলের পাশের ছোটো ছোটো ঘরগুলো তো যে শ্রমিকরা বানিয়েছিল, তাদের থাকার ঘর ছিল!’ রুদ্র বিমূঢ়ভাবে বলে উঠল, ‘মানে, গাইডরা তো তাই বলে!’

‘গাইডরা তো সব জেনে উলটে দিয়েছে, না! কোন কবরখানার চারপাশে শ্রমিকদের থাকার জায়গা করা আছে, একটু বলবে? দুনিয়ার কোথাও দেখেছ যে কোনো বিখ্যাত স্থাপত্যের চারপাশে শ্রমিকদের থাকার জায়গা? শ্রমিকদের কথা কে ভাবে?’

রুদ্র একটু ইতস্তত করে বলে উঠল, ‘মিশরের দানবীয় পিরামিডগুলো যখন তৈরি হয়েছিল, তখন কিন্তু তার আশেপাশেই সব শ্রমিক আবাসন তৈরি হয়েছিল।’

‘সেগুলো এত সুন্দর নয়।’ অঘোরেশ বললেন, ‘ইতিহাসবিদ কিন নিজে লিখে গিয়েছেন যে তাজমহলের শ্রমিকদের খুব কম অর্থের বিনিময়ে প্রচণ্ড খাটানো হত। আর তাজমহলের দু-পাশে দুটো যমজ প্রাসাদ, একটা মসজিদ, অন্যটা নাকি অতিথিশালা। কবরের পাশে অতিথিশালাই-বা কোথায় থাকে? তাজমহলের ডান পাশের মেহমানখানাটা আসলে সেই হিন্দু প্রাসাদের অতিথিভবন ছিল। আরও অনেক অনেক প্রমাণ আছে এর স্বপক্ষে।’

সুরঞ্জন নির্বাক। একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘পুরো ব্যাপারটাই কেমন জোর করে সাজানো মনে হচ্ছে!’

অঘোরেশ চোখ সরু করে কেটে কেটে বললেন, ‘তুইও দেখছি ব্রিজেশ মাথুরের মতো কথা বলছিস! তোরা আসলে সেট করে রাখা গতানুগতিক কাঠামোর বাইরে কিছু ভাবতে পারিস না!’

রুদ্র চমকে উঠল। ব্রিজেশ মাথুর ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। বাবার কাছে ওঁর নাম অনেকবার শুনেছে। দেশে-বিদেশে অসংখ্য সমাবেশে সমাদৃত হয়েছেন উনি।

কিন্তু রুদ্রর চমকে ওঠা সেইজন্য নয়। এই ব্রিজেশ মাথুরই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সেই প্রফেসর নিজামুদ্দিন বেগের কলামকে ‘বিকৃত কল্পনা’ বলে হেয় করেছিলেন, কাগজে পড়েছিল ও।

তার মানে অঘোরেশ ভাট আর নিজামুদ্দিন বেগের মধ্যে যোগাযোগ আছে এটা ধরে নেওয়া যায় কি?

রুদ্র শুনতে শুনতে ক্রমাগত ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছিল নাহুম খানকে।

ভদ্রলোক গেলেন কোথায়?

সকল অধ্যায়

১. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৬
২. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১
৩. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২
৪. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩
৫. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৪
৬. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৫
৭. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৬
৮. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৭
৯. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৮
১০. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৯
১১. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১০
১২. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১১
১৩. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১২
১৪. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৩
১৫. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৪
১৬. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৫
১৭. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৬
১৮. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৭
১৯. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৮
২০. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৯
২১. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২০
২২. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২১
২৩. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২২
২৪. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৩
২৫. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৪
২৬. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৫
২৭. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৭
২৮. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৮
২৯. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৯
৩০. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩০
৩১. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩১
৩২. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩২
৩৩. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৩
৩৪. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৪
৩৫. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৫
৩৬. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৬
৩৭. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৭
৩৮. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৮

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন