অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৮

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

১৮

সুরঞ্জন আর রুদ্র বেরিয়ে যাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই কলিং বেল বাজতে পূরবী একটু অবাক হলেন। সবে চারটে বেজেছে। বিকেলের আলো এখনও খট খট করছে। এইসময় কারুর আসার কথা নেই।

রতন বলে রান্নার লোকটিও আসে আরও কিছুক্ষণ পর, ওকে অবশ্য এখনও রান্নার হেল্পার হিসেবেই ইউজ করছেন পূরবী। আনাজ কুটে দেওয়া, মশলা বেটে দেওয়া, ওই অবধি। খুন্তি ধরতে দেননি।

গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে অলস পায়ে এসে দরজার কি-হোলে চোখ রাখলেন পূরবী। কিন্তু নিকষ কালো অন্ধকার সেখানে। কিছুই দেখা গেল না।

লবিতে তো যথেষ্ট আলো রয়েছে, তবু কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন?

তবে কি যে এসেছে সে ইচ্ছে করে কি-হোলটা চাপা দিয়ে রেখেছে?

একটুক্ষণের জন্য পূরবী একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। উত্তরপ্রদেশ জায়গাটা সম্পর্কে এমনিই একটু কেমন শঙ্কা আছে মনে, তার ওপর বাড়িতে আর কেউ নেই।

দরজার কাছে গিয়ে জোরে একবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কৌন হ্যায়?’

কোনো শব্দ নেই। অথচ বেল বাজল। এবার পরপর তিনবার।

পূরবী এবার আর সাতপাঁচ না ভেবে খুলেই ফেললেন দরজাটা। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

দরজা খুলতেই পূরবীর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। হতভম্ব মুখে তিনি শুধু বলতে পারলেন, ‘ওমা! এ কী!’

প্রিয়ম ট্রলিটাকে ঢোকাচ্ছিল, সঙ্গেসঙ্গে ইশারায় চুপ করতে বলল, তারপর ফিসফিস করল, ‘ও কোথায় মা? ঘুমোচ্ছে?’

পূরবী এবার হেসে ফেললেন। এমা, ছেলেটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এতদূর থেকে ছুটে এল, আর মেয়েটা এখনই বাড়ি নেই? নিজের মেয়ের কাছে এতদিন পরে এসে যতটুকু আনন্দ হয়েছিল, জামাইয়ের আচমকা আগমনে সেই আনন্দ যেন হাজারগুণ বেড়ে গেল।

খুশিতে ডগমগ হতে হতে পূরবী বললেন, ‘রুদ্র আর ওর বাবা তো বেরোল একটু! তুমি বোসো আগে, জল খাও। রুদ্র সকাল থেকে চিন্তা করছে তোমাকে ফোনে পাচ্ছে না বলে, আর তুমি…!’

প্রিয়মের মুখটা মুহূর্তে নিভে গেল, ক্লান্ত শরীরে ও এবার সোফায় বসে পড়ল, ‘যাহ! এইসময়েই বেরিয়ে পড়ল? আমি কাল থেকে ওকে চমকে দেব ভাবতে ভাবতে কত লুকোছাপা করে এলাম!’

পূরবী ততক্ষণে জল এগিয়ে দিয়েছেন, ‘আমার যে কী ভালো লাগছে! আমরাও তো আজই এসেছি। খুব ভালো করেছ প্রিয়ম!’

প্রিয়ম ঢকঢক করে জলটা খেল, ‘হ্যাঁ, ওইজন্যই তো আরও এই সময়ে এলাম। দু-সপ্তাহ আগে ও যখন বলল আপনারা এখন আসছেন আগ্রা, ভাবলাম এমনিতেও ছুটি তো নিই-ই না, আমিও চলে যাই। সবাই মিলে হইহই করা যাবে।’

‘খুব ভালো করেছ!’ আনন্দে পূরবী ফোন করতে যাচ্ছিলেন রুদ্রকে, প্রিয়ম হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘এখন কিছু বলবেন না মা! ও আসুক না! না হলে আর সারপ্রাইজের কিছুই থাকবে না যে!’

পূরবী সঙ্গেসঙ্গে ফোনটা কেটে দিলেন। মনের ভেতর যখন প্রচণ্ড আনন্দ হয় তখন মানুষ কী করবে ভেবে পায় না। ওঁরও সেটাই হচ্ছিল। একবার ভাবলেন এখুনি গিয়ে প্রিয়মের প্রিয় লুচি আর সাদা আলুর তরকারি বানিয়ে ফেলেন, আবার মনে হল, এতটা জার্নি করে এসে কি ওসব খেতে চাইবে?

দিশেহারা হয়ে ফ্রিজ থেকে ফল বের করতে করতে বললেন, ‘তুমি চিনলে কী করে? আগে তো কখনো আগ্রা আসোনি।’

‘ওর এই ঠিকানাটা তো আমার কাছে ছিলই, এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাবে এলাম, ড্রাইভার নিয়ে চলে এল।’ প্রিয়ম হাসল, ‘আপনারা কেমন আছেন বলুন? বাবার শরীর ভালো আছে? কোথায় বেরিয়েছে ওরা?’

.

মুন্না দুপুর দুপুর উঠে বাস ধরে এসে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের পাশের রাবুপুরা বলে এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিল। দুপুরে গরম রুটি, ডিমতরকা আর পেঁয়াজ দিয়ে জম্পেশ খাওয়া হয়েছে। চাঁদনিকে শাকিল কী বলেছে কে জানে, হেব্বি যত্নআত্তি করছে ওর। সঙ্গে রোশনি বলে সেই লেজুড়টা তো আছেই। সে তো পারলে মুন্নার মুখও মুছিয়ে দেয় খাওয়ার পর। সে করুক, মুন্না বেইমান নয়, কারুর থেকে ফ্রি-তে সার্ভিস নেয় না, আজ এখানে পেমেন্ট পেলেই সুদে-আসলে সব পুষিয়ে দেবে।

মুন্না কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পাশেই হাইওয়ে, সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছুটছে প্রায় উল্কার গতিতে। দিল্লি থেকে আগ্রা যাওয়ার এটাই এখন সবচেয়ে ভালো রাস্তা। শুধু রাস্তায় টোলের চার্জ বড্ড বেশি, এই যা। না হলে হু হু করে পৌঁছে যাওয়া যায় আগ্রা। রাবুপুরা বলে এই জায়গাটা একটা গ্রাম, পাশেই যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের টোল বলে এখানে ছোটোবড়ো অনেকগুলো ধাবা গজিয়ে উঠেছে। কৃষিপ্রধান গ্রামের অনেকের জীবিকা হঠাৎই এখন ধাবায় শিফট করেছে। তা ভালো। তাতে মুন্নাদের কারবারেরও সুবিধা হয়েছে।

মুন্না একটা দোকান থেকে গরম চা নিল। এই ঠান্ডায় হাইওয়ের হাওয়াতে হাত-পা কেঁপে যাচ্ছে যেন! দু-তিন চুমুক দেওয়ার পর শরীরে একটু আরাম বোধ হল। আলগোছে এক হাতে কাপ ধরে অন্য হাতে ফোন করল ফজলুলকে, ‘কোথায়?’

‘ওস্তাদ, একটু দেরি হবে। নজফগড়ে আছি। এই মাল এল। তুমি ওয়েট করো। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।’ বিশাল চেঁচামেচির মধ্যে ফজলুলের গলা শোনা গেল।

মুন্না আর কোনো কথা না বলে কেটে দিল। দুপুরেই জেনে গেছে কোন গাড়িতে ওরা আসবে। জি বি রোডের ওই লোকের মুশকো চেলাটা, কী যেন নাম, ওয়াসিম, সে যতই বলুক হ্যান লাগবে ত্যান লাগবে, এত শর্ট নোটিশে বেশি ভ্যারাইটি জোগাড় করা যায় নাকি! তাও মুন্না শেখের চ্যানেল সব জায়গায় বলে কাল রাতে অর্ডার দিয়ে আজ রাতেই ডেলিভারি দিতে পারছে। অন্য কেউ হলে প্রথমেই হাত তুলে দিত। চায়ের কাপটা শেষ হতে পায়ে পায়ে ও এগিয়ে গেল আরও একটা ঘুপচি দোকানের দিকে, ‘অমলেট হবে?’

‘হবে।’ এক ঝলক দেখে সসপ্যানে তেল ছাড়তে ছাড়তে বলল লোকটা।

‘কড়া করে ভেজে দাও তো একটা। আর ঝাল দিয়ো।’ ওকে এখন এখানে কিছুটা সময় কাটাতে হবে।

হিসেবমতো চিন্তার কিছু নেই, প্রতিবারের মতো এবারেও গাড়ির পেটের মধ্যে তেলের ডুপ্লিকেট ট্যাঙ্ক ঢুকিয়ে তার মধ্যে করে আনা হচ্ছে, ওই নিয়ে চাপ নেই। পুলিশের ঠাকুরদার সাধ্য নেই ধরে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। ফজলুল দুপুরে যা বলল সেই অনুযায়ী শুধু ১২ বোরের পিস্তল পাওয়া গেছে, তাও মোটে দু-শোটা, কিছু গ্রেনেড আর কয়েকটা দিশি বন্দুক, যাকে ওদের ভাষায় বলে তামাঞ্চা, আর কিছুই নাকি নজফগড়ের স্টকে নেই।

কাল তো লোকটা বলেছিল আড়াইশো পিস ওয়ান শট পিস্তল আর কুড়িটা মতো কার্বাইন লাগবে, সেখানে কোনোটাই পুরো পাওয়া গেল না। সবই মুঙ্গেরে পড়ে আছে। শালা একদিনও যদি বেশি সময় দিত, মুন্না ঠিক হাসানকে দিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়ে নিত, তখন পেমেন্টটাও বেশি পাওয়া যেত।

গতমাসেই তো মাত্র দু-দিনের মধ্যে আসামে আলফা দলকে সাপ্লাই করল কতগুলো এ কে ৪৭, ভালো ভালো ক-টা রাইফেল, পঞ্চাশ প্যাকেট গ্রেনেড। নর্থ ইস্টের লোকগুলো, কী যেন বলে ওদের, হ্যাঁ চিঙ্কি, বেটাচ্ছেলেরা হেব্বি পিটপিটে, পাশেই চীন থেকে বর্ডার টপকে ভালো ভালো মাল আনায়, দিশি মাল শুনেই প্রথমে নাক সিটকোচ্ছিল, তারপর সেই ওরাই ক-দিন বাদে মুন্না শেখের মালের প্রশংসা তো করেছে! আর সেখানে এবারে একটুর জন্য বড়ো কন্ট্র্যাক্টটা মিস হল, আফশোসে পিচিক করে থুতু ফেলল ও।

অমলেটটা তৈরি হয়ে গিয়েছে, গরম ধোঁয়া ওঠা প্লেটে চামচ বসিয়ে মুখে ঢোকাতেই কাঁচালঙ্কার ঝালে আর গরমে ‘উহ আহ’ করে উঠল ও। আর তখনই চোখে পড়ল, ও যেমন প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এখানে দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে, ওদিকে আরেকটা লোকও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। ছ-টা সমান্তরাল লেনের বিশাল হাইওয়ে, পাশে ধাবাগুলো পরপর হয়ে ছোটো একটা গলি তৈরি হয়ে গেছে, সেই গলির একদিকে মুন্না, অন্যদিকে লোকটা।

কী ব্যাপারটা হচ্ছে? টিকটিকি নাকি?

ও কিছুই দেখেনি এমন ভান করে খেতে লাগল। এখানে তো কোনো শালা বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। গাড়ি চালাতে চালাতে আসে, এখানে দাঁড়িয়ে খায়দায়, পেচ্ছাপ করে, ব্যস চলে যায়, সেখানে এ মক্কেল এতক্ষণ ধরে এখানে কী করছে? মুন্না আসার সময় থেকেই এসেছে, যতটুকু ও খেয়াল করতে পারছে।

পুলিশের লোক হলেও তেমন চাপের কিছু নেই, ফজলুল গাড়ির ভেতরে যেভাবে মাল সিজ করে, কারুর ক্ষমতা নেই ধরতে পারে। শুধু ডেলিভারির আগে এই মালটাকে আউট করে দিতে হবে যেভাবে হোক।

মুন্না ধীরেসুস্থে চিবিয়ে খেতে লাগল।

সকল অধ্যায়

১. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৬
২. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১
৩. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২
৪. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩
৫. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৪
৬. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৫
৭. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৬
৮. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৭
৯. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৮
১০. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৯
১১. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১০
১২. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১১
১৩. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১২
১৪. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৩
১৫. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৪
১৬. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৫
১৭. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৬
১৮. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৭
১৯. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৮
২০. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৯
২১. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২০
২২. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২১
২৩. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২২
২৪. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৩
২৫. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৪
২৬. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৫
২৭. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৭
২৮. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৮
২৯. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৯
৩০. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩০
৩১. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩১
৩২. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩২
৩৩. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৩
৩৪. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৪
৩৫. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৫
৩৬. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৬
৩৭. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৭
৩৮. অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৮

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন