স্বীকারোক্তি

অর্পিতা সরকার

পার্লার থেকে ফেরার পথেই ফোনটা এল৷ লগ্নজিতা বলল, ‘বলো সুমন, দেখা করতে চাও? আমি ওয়েট করছিলাম, কবে তুমি নিজে মুখে অপরাধগুলো স্বীকার করবে৷ আসলে তোমায় খুব বিশ্বাস করতাম৷ মনে হত গরিব হলেও সততাটুকুই তোমার সম্পদ৷ কিন্তু আমার ভুল ভাঙল যখন, তখন সত্যিই কষ্ট পেলাম৷ রুদ্রজ্যোতিস্যার বলেছিলেন, সুমন দোষী, ওকে অ্যারেস্ট করুন৷ কিন্তু আমি অ্যারেস্ট না করে অপেক্ষা করছিলাম তোমার ফোনের৷ ভেবেছিলাম, তুমি ফোন করবে৷ স্বীকার করবে নিজের দোষগুলো৷ কিন্তু তপন মহান্তি খুন হবার পরেও যখন তুমি কল করলে না তখন বুঝলাম আমি ভুল৷ আজকে তুমি কল না করলেও পুলিশ যেত তোমার বাড়িতে৷ এসো, আমি অফিসেই যাচ্ছি৷ না না, থানায় নেই এখন৷ অফিসে আছি৷ তুমি ওখানেই এসো৷ ‘লগ্নজিতা নিজস্ব অফিসের কেবিনে বসে রক্তিমার পার্লারের ভিতরের ভিডিয়োটা চালাল৷ রিওয়াইন্ড করে শুনল, রক্তিমা বলছে, ‘বাই প্রফেশন, তুমি কী করো নীহারিকা? নীহারিকা বলল, ‘সেরকম কিছু নয়, ম্যাডাম৷ অনলাইনে শাড়ি-কুর্তি বিক্রি করছি৷’

রক্তিমা বলল, একটা কথা জানবে, রুপসি মেয়েদের কাজের অভাব হয় না৷ ইনকাম করতে চাও? কয়েকটা ছবি তুলবে আর থোক টাকা পাবে৷ দেখো যদি রাজি থাকো৷’

কপালের দু-পাশের শিরাগুলো রাগে টনটন করে উঠল জিতার৷ কীভাবে দিনের পর দিন রূপচর্চার নাম করে মেয়েগুলোকে এভাবে এক্সপ্লয়েট করছে এরা, ভেবেই মাথাটা গরম হচ্ছে৷ দরজায় নক করল সুমন৷ লগ্নজিতা বলল, ‘এসো৷ এই কদিনেই সুমনের চেহারাটা ভেঙেছে৷ চোখের নীচে কালি৷ মনের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর অস্থিরতা দেখে৷ লগ্নজিতা বলল, ‘পিকু মা ছাড়াই বড়ো হয়ে উঠবে৷ কারণ পিকুর মা একজন ড্রাগস এজেন্ট৷ নিজের ছেলেকেও এত ছোটো থেকে এই ব্যাবসায় লাগিয়ে দিয়েছে৷ তাই মা ছাড়া কীভাবে পিকুকে সামলাবে ভাবলে ভুল ভাবছ সুমন৷ বরং ওর মায়ের আওতা থেকে ওকে বের করে আনাটা জরুরি৷’

সুমন দুটো হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে বলল, ‘শুধু ড্রাগস এজেন্ট নয় ম্যাডাম, ও একজন ঠান্ডা মাথার খুনি৷ তপনদাকে ও-ই খুন করেছে ম্যাডাম৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘কিন্তু যে ইঞ্জেকশন দিয়েছে তপনকে, সে লেফটি৷ ইঞ্জেকশনের পজিশন দেখে ডক্টর তা-ই বলেছেন৷’

সুমন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, রিম্পা বাঁহাতি৷ মানে এ এক অদ্ভুত ব্যাপার ওর মধ্যে৷ ও লেখা-লেখি, ইঞ্জেকশন দেওয়া বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাঁ হাতেই করে৷ কিন্তু ওর ডান হাতও খুব সচল৷ ও ডান হাতে খায়৷ ওকে দেখে বোঝা যায় না ম্যাডাম ওর গায়ে খুব জোরও৷ তপনদা যেদিন মারা গেল, সেদিন ও বাড়ি ফিরেছে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ৷ ও বলেছিল, অফিসে কী সব কাজে ফেঁসেছে৷ কিন্তু আমি ওদের হেড শম্পাদিকে ফোন করে জেনেছিলাম, ওদিনও একই সময় ও বেরিয়ে এসেছিল অফিস থেকে৷ দু’দিন আগে দু-ব্যাগ দামি দামি শাড়ি নিয়ে বাড়ি ঢুকেছিল৷ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কে দিল? আমায় বলল, নিজের যখন দেবার মুরোদ নেই তখন এসব প্রশ্ন করবে না৷ আমার সঙ্গে ঝগড়াও হয়েছিল, ম্যাডাম৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘ওইসব জামাকাপড় ওরই কেনা৷ ওগুলো থাকত তপন মহান্তির বাড়িতে৷’

সুমন অবাক হয়ে বলল, মানে?’

‘সুমন, তুমি সকাল আটটায় বেরোতে আর রাত বারোটায় বাড়ি ফিরতে৷ তাই জানতে পারোনি এমন অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে রিম্পা৷ তপন মহান্তির ঘরের এক কপি চাবি থাকত রিম্পার কাছে৷ অত দামি পোশাক বাড়ি থেকে পরে বেরোত না ও৷ পাড়ার লোকজন দেখবে বলে৷ তপনের একটা ফাঁকা গলির মধ্যে ঘর৷ তাই তেমন কোথাও যাওয়ার হলে ও ওখানে গিয়েই ড্রেস চেঞ্জ করত৷ তপনের টেবিলে একটা হাত-আয়না, একটা চিরুণি আর বোরোলিন রাখা ছিল৷ ওটুকুই তপনের সরঞ্জাম৷ কিন্তু রংচটা দেওয়ালে এক-মানুষ সমান ঝকঝকে আয়না লাগানো দেখেই বুঝেছিলাম এখানে মহিলার আগমন ঘটে৷ আয়নার পাশে টিপও লাগানো ছিল৷ ওই স্কোয়্যার টিপ আমি রিম্পার কপালেই দেখেছিলাম৷ ওই পাড়ার দু-একজন বলেছিল, রিম্পা চাবি খুলে ঢোকে, শাড়ি বদলে আবার চাবি দিয়ে বেরিয়ে যায়৷’

সুমন বলল, ‘সত্যি বলছি ম্যাডাম, এটা আমার অজানা ছিল৷ ও যদিও স্বীকার করছে না, এগুলো ও করেছে৷ কিন্তু ম্যাডাম, আমি নিশ্চিত৷ ইঞ্জেকশন দেওয়ার হাতটা ওর তুখোড়৷ আমি পিকুকেও আড়ালে জিজ্ঞাসা করেছি, তুই যে এসব চকোলেট বিক্রি করতিস, মা জানত? পিকু বলেছিল, মা তো নিজেও খায় এই চকোলেট৷ আমায় খেতে বারণ করে৷ বলে, এই চকোলেট খেলে পেটে কৃমি হবে৷ অন্যদের বেচে দিয়ে সেই টাকায় অন্য কিছু খাবি৷ ম্যাডাম, আমার দু-কুঠুরি ঘরের মধ্যে যে এমন অপরাধের সাম্রাজ্য বাসা বেঁধেছে, আমি তো সেটা বুঝতেই পারিনি৷ আমি ওর দামি জিনিসের প্রতি লোভ দেখে ঝগড়া করতাম, বকাবকি করতাম৷ কিন্তু আমার ধারণাও ছিল না, ও এসব শুরু করে দিয়েছে পাকাপাকিভাবে৷ এমনকী পাড়ার অল্পবয়েসি মেয়েরাও দেখতাম, আসছে ওর কাছে৷ ভাবতাম, গল্প করতে আসে৷ একদিন বিজয়ের বউয়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া৷ বিজয়ের বউয়ের বক্তব্য, রিম্পা নাকি ওকে খারাপ ছবি তুলে ইনকাম করার পরামর্শ দিতে এসেছিল৷ বিজয় এমনিতেই খুব মাথা গরম ছেলে৷ সে তো দেখি, রিম্পাকে মারতে আসে৷ আমি আপনার কাছেই আসছিলাম অফিসে৷ ওই সময় ঝামেলা দেখে আমিই বিজয়কে বলেছিলাম, তোর বউ কি বাচ্চা? যার পছন্দ হবে না সে ছবি তুলবে না৷ ছবি তোলার কথার মধ্যে অসভ্য কী দেখলি তুই? বিজয় বলেছিল, চোখটা এবারে খোলো সুমনদা, না হলে বড়ো বিপদ হয়ে যাবে তোমার৷ তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই রিম্পাবউদির অন্য রূপ বেরোয়৷ যতক্ষণ তুমি বাড়িতে থাকো, ততক্ষণ খুব সতী৷ রিম্পা চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যাওয়ায় বিজয় পালিয়েছিল৷ প্রায় একই উঠোন হওয়া সত্ত্বেও ওরা আর কথা বলত না আমাদের সঙ্গে৷ ওই আমি যদি বিজয়কে কিছু জিজ্ঞাসা করতাম তো উত্তর দিত৷ অথচ ওরা কিন্তু আমায় রেসপেক্ট করত, ম্যাডাম৷ কিন্তু পিকুর ব্যাঙ্কে ধরা পড়ার পর থেকেই আমার মনটা কু গাইছিল৷ পিকুর যেকোনো বিষয়ে ওর নজর থাকে, অথচ এই বিষয়ে রিম্পা কিছুই জানে না, এটা হতে পারে না৷ জয়ন্তর বাড়ির কাজের মেয়েটা একদিন ফোন করেছিল রিম্পার ফোনে৷ রিম্পা তখন বাথরুমে ছিল৷ আমি ইচ্ছে করেই ফোনটা রিসিভ করছিলাম৷ হ্যালো বলার আগেই অনীতা বলতে শুরু করল, আমি জানি রিম্পাবউদি, জয়ন্তদাকে দিয়াশাবউদিই মেরে দিয়েছে৷ আমাদের এখন বাঁচাবে কে? পুলিশ তো আমায় থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছিল৷ দিয়াশাবউদি তো ফোনই ধরছে না৷ চলো রিম্পাবউদি, আমরা কদিনের জন্য গা-ঢাকা দিই৷ আমরাও যে ওইসব ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, যদি বুঝে যায়? এটুকু শোনার পরেই আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়েছিল রিম্পা৷ সেদিন অনীতার সঙ্গে ফোনে বেশ হট টক হচ্ছিল ওর৷ পুলিশ ধরলে অনীতাকে ধরবে— রিম্পাকে নয়, এরকম কিছু বলছিল৷ তারপরেই তো অনীতাও খুন হয়ে গেল৷ ম্যাডাম, আমি দুটো ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ পেয়েছি বাথরুমে৷ প্যাকেটে ভরে রেখেছিলাম আমি৷ একটা তপনদা খুনের দিন রাতে ডাস্টবিনে ফেলেছিল রিম্পা, আরেকটা অনীতা খুনের দিন৷ ‘একটা পলিথিন প্যাকেট বের করে সামনে রাখল সুমন৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘তুমি যে এসে সবটুকু স্বীকার করলে, এটাই আমার বড়ো পাওয়া৷ বার বার মনে হচ্ছিল, কেন লুকাচ্ছে সুমন?’

সুমন বলল, ‘ম্যাডাম, পিকুটা যে মা-কে ছাড়া ঘুমাতে পারে না এখনও৷ আমি তো বাইরে বাইরে থাকি, পিকুর মা ওর সব৷ এই একটা ভাবনা মাথায় এলে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম৷ দোটানায় কয়েক রাত চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না৷ আজ অনেক শান্তি৷ আমি জানি, আপনারা রিম্পাকে অ্যারেস্ট করবেন৷ ওর যাবজ্জীবন হবে৷ তবুও আমার আর কিছু করার ছিল না৷ আসছি, ম্যাডাম৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘কাল থেকে কাজে এসো সুমন৷’

সুমন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আসব ম্যাডাম৷’

লগ্নজিতা জানে, ওই সিরিঞ্জ দুটোতে কী পাওয়া যাবে তবুও টেস্ট করতে পাঠিয়ে দিল৷ রাঘবও দুজনের ছবি পাঠিয়েছিল৷ দুই মহিলা দুরকম টাইমে ঢুকেছিল অনীতার বাড়িতে৷ একজন জয়ন্তর স্ত্রী, আরেকজন মহিলার ছবিটা আরেকটু কাল্টিভেট করতে হবে৷ রাঘব লিখেছে, দুজনেই দশ মিনিট করে বাড়ির মধ্যে থেকে পালিয়ে গেছে৷

সকল অধ্যায়

১. ব্যাঙ্কে কান্নাকাটি
২. সক্রেটিসের শিষ্য
৩. হসপিটালে হট টপিক
৪. রাঘব না রাঘব বোয়াল?
৫. মাসি না মডেল?
৬. কৌশিকের মানভঞ্জন
৭. জলধরের জলপান
৮. রিলস সুন্দরী
৯. ফেসবুকে প্রেম
১০. তীরে এসে তরি ডুবল
১১. সুইসাইড না মার্ডার?
১২. অ্যাট্রাকটিভ
১৩. লগ্নজিতার ব্যর্থতা
১৪. শয়তানের কারসাজি
১৫. ফাঁদ
১৬. পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
১৭. ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ
১৮. এ ঘরে মৃত্যুর গন্ধ
১৯. এক মাসে সুন্দরী
২০. অষ্টধাতুর কৃষ্ণমূর্তি
২১. আবার খুন
২২. পার্লারে বোটক্স ট্রিটমেন্ট
২৩. স্বীকারোক্তি
২৪. সম্পর্কের সমাপ্তি
২৫. নামবিভ্রাট
২৬. হু ইজ জগমোহন?
২৭. মিডিয়া কনফারেন্স
২৮. সেলিব্রেশন মুড
২৯. সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ
৩০. গল্পের শ্রোতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন