হু ইজ জগমোহন?

অর্পিতা সরকার

পুরোনো আমলের লম্বা বারান্দাওয়ালা এত বড়ো বাড়ি যে এখন আছে কলকাতায়, এটাই রেয়ার ব্যাপার৷ কারণ এই মুহূর্তে বেশির ভাগ বাড়িই প্রোমোটারের দখলে চলে যাচ্ছে৷

পারিজাত বলল, ‘ম্যাডাম, জগুদাদু একবার বেতের বাড়ি দিয়েছিলেন এক প্রোমোটারকে৷ বলেছিলেন, ফের যদি মাছির মতো আমার বাড়ির পাশে ঘুরঘুর করতে দেখি তাহলে মেরে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘এই পারিজাত, আমি ঠ্যাং নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব তো?’

পারিজাত হেসে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার হঠাৎ জগুদাদুকে কী দরকার পড়ল? না মানে সিক্রেট হলে বলার দরকার নেই৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘নিশ্চয়ই বলব৷ আগে আমি জেনে নিই৷’

পারিজাত বলল, ‘নিশ্চয়ই ম্যাডাম৷ নো ইস্যু৷’

প্রায় ছয় ফিট লম্বা, গায়ের রং লালচে বাদামি৷ মাথার চুল বেশির ভাগ সাদা হলেও এককালে কালো ছিল, চিহ্নস্বরূপ কিছু এখনও রয়ে গেছে৷ টিকালো নাকের ওপরে একটা গোল্ডেন কালারের হাই পাওয়ারের চশমা পরে বাগানের বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন জগমোহনবাবু৷ পারিজাত ঢুকেই টক করে প্রণাম করে বলল, ‘জগুদাদু, আজ একা কেন? আমার দাদু গেল কোথায়?’

পারিজাতের মাথায় হাত রেখে বললেন, শোন, শরীরচর্চা করতে হয়, বুঝলি৷ রমেনের মতো বুড়িয়ে গেলে রোজই জ্বর-জ্বালা লেগেই থাকবে৷ রমেন আজ হাঁচছে বলল, অগত্যা একা একাই দাবা খেলতে হবে৷ এই পারিজাত ‘তুই পারিস দাবা খেলতে?’

পারিজাত অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘না দাদু আমি তো পারি না’৷

জগমোহনবাবু বললেন, ‘রমেন নিজের নাতিকেই দাবা শেখাতে পারল’ না, আবার আসে একদিন আমায় হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবে এই আশায়৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘স্যার, আমি পারি৷ যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে এক দান হতেই পারে৷’

জগুদাদুর কৌতূহলী দৃষ্টির উত্তর দিল পারিজাত৷’ দাদু, আমার কলেজের সিনিয়র দিদি৷ আমার মামাবাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম, ভাবলাম, দাদু তোমার বাড়িতে থাকবে তাই সোজা এখানেই এলাম৷’

জগমোহনবাবু বললেন, ‘তা নাম কী?’

লগ্নজিতা বলল, লগ্নজিতা ভট্টাচার্য৷’

জগমোহনবাবু বললেন, ‘সারনেম এক শুনে আমার আলাদা কোনো অনুভূতি হয় না, বুঝলে কিনা৷ এ পৃথিবীতে হাজার হাজার লোক আছে একই সারনেমের৷ তাই একই সারনেম শুনে— ওহ তুমি তো আমার অমুকের তমুক হও— বলা মানুষ আমি নই৷ এনিওয়ে, বসে পড়ো, আমার হাঁটুর বয়সি ছেলে-মেয়েদের আমি তুমি অথবা তুই বলি৷ শিক্ষক পেশায় থেকেই হয়তো এমন বদভ্যাস হয়ে গেছে৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘অবশ্যই তুমি বলুন৷’

সামনের চেয়ারটাতে বসতে নির্দেশ দিলেন৷ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে৷ লগ্নজিতা বার দুয়েক দাবায় ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কলেজ লাইফে৷ এখনও যখন কেস সলভ করতে না পারে তখন দাবার বোর্ডটা নিয়েই বসে নিজের বুদ্ধির গোড়ায় একটু সার দেবার জন্য৷ কিন্তু জগমোহনবাবু যে রীতিমতো প্যাকটিস করেন, সেটা বুঝতে পারেনি লগ্নজিতা৷ ভদ্রলোকের কাছে দাবায় হেরে যাওয়াটা রীতিমতো ইগো হার্ট করার মতো ব্যাপার৷ তাই প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন লগ্নজিতাকে পরাস্ত করার৷ লগ্নজিতা বেশ বুঝতে পারছিল, ভদ্রলোক বুদ্ধি খরচ করতে ভালোবাসেন৷ তাই সহজেই যদি জিতে যান তাহলে জেতার আনন্দ পাবেন না৷ তাই লগ্নজিতা ইচ্ছে করেই খেলাটাকে বেশ দীর্ঘায়িত করছিল৷ জগমোহনবাবুর মুখে-চোখে বেশ উত্তেজনা দেখল লগ্নজিতা, এবারে খেলাটা শেষ করা জরুরি৷ না হলে আবার এম. এল. এ. অফিসে পৌঁছাতে দেরি হবে৷ লগ্নজিতা দেখল, গজ দিয়ে কিস্তি মাত করা যাচ্ছে৷ জগমোহনবাবুও চাল দেবার পরে সেটা বেশ বুঝতে পেরেছেন৷ বুঝেছেন, চালে ভুল হয়ে গেছে৷ জিতা ইচ্ছে করেই নৌকা দিয়ে ওঁর একটা নৌকা কাটল৷ নৌকাটা সরাতেই জিতার রাজাকে পরাস্ত করলেন জগমোহনবাবু৷

পারিজাত বলল, ‘দাদু, তুমি এখনও এমন দুর্দান্ত খেলো?’

জগুদাদুর ঠোঁটে হাসি নেই৷ ম্রিয়মাণ হয়ে বললেন, ‘এই যে ভট্টাচার্য, ধান্দাটা কী? জেতা ম্যাচ হারলে কেন?’

লগ্নজিতা বলল, ‘স্যার, জিতেছেন আপনি৷ আমার একটা ছোটো মিসটেকের জন্য৷ মুহূর্তের অন্যমনস্কতাই তার কারণ যদিও৷ কিন্তু খেলা, যুদ্ধ এসব জায়গায় একটাই কথা চলে— হার না জিত৷ তার কারণটা তো কেউ জানতে যায় না তা-ই না? এক্ষেত্রেও আমার অন্যমনস্কতা আপনাকে জিতিয়ে দিল৷’

দিলদরিয়া হয়ে হেসে উঠলেন জগমোহনবাবু৷ বললেন, ‘ঠিক ঠিক৷ এ খেলায় চোখের পলক ফেললেই শেষ৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘তা’ছাড়া সত্যি বলতে কী আমি আপনাকে এতটাও সিরিয়াসলি নিইনি৷ ভেবেছিলাম আপনি শখের খেলোয়াড়৷ খেলতে গিয়ে বুঝলাম, আপনি রাজার রাজত্বেই বাস করেন৷ তাই সৈন্য থেকে মন্ত্রী আপনার সকলের আপনার বড়ো বাধ্য৷’

জগমোহনবাবু খুশি হয়ে বললেন, ‘তুমিও কিন্তু তুখোড় খেলোয়াড়৷’

পারিজাত বলল, ‘তোমরা গল্প করো, আমি চট করে একবার দাদুর সঙ্গে দেখা করে আসি৷ না হলে আমার দাদু-দিদার অভিমান হবে৷’

পারিজাত বেরিয়ে যেতেই উনি বললেন, ‘চা খাও তো?’

লগ্নজিতা বলল, ওটাই আমার এনার্জি বুস্টার৷’

বাড়ির ভিতরে দু’কাপ চায়ের আবদার জানিয়ে উনি বেশ জমিয়ে বসে বললেন, এবারে বলো দেখি, কী জানতে চাও৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘আপনার কেন মনে হল আমি আপনার কাছে কিছু জানতেই এসেছি৷ এমনি গল্প করতেও তো আসতে পারি৷’

জগমোহনবাবু বললেন, ‘সে তুমি আসতেই পারো৷ কলকাতার রাস্তা থেকে তো খুন, রেপ, ছিনতাই উঠেই গেছে তাই পুলিশরা আড্ডা দিতেই পারে৷’

চমকে উঠল লগ্নজিতা৷ ওর চমকানো দেখে আরেক প্রস্থ হেসে নিলেন জগমোহনবাবু৷ বললেন, যার কাছে খবর সংগ্রহ করতে এসেছ তার স্মৃতির ওপরে এইটুকুও যদি ভরসা না থাকে তাহলে তার দেওয়া খবরের ওপরে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকাই উচিত নয়৷ ডি.সি.পি. মিস লগ্নজিতা ভট্টাচার্য, এ ছাড়াও ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে বেশ নামডাক আছে৷ বছর দুয়েক আগে কলকাতার ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষা করা ভিখারিদের দ্বারা বাচ্চা চুরির একটা কেস সলভ করেছিলে যতদূর মনে পড়ছে৷’

লগ্নজিতা উঠে ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ‘তবে যে লোকজন বলে, বাহাত্তর বছরে ভীমরতি হয়৷ আপনার এমন ক্ষুরধার স্মৃতিশক্তি কী করে?’

জগমোহনবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘সে তো বুদ্ধিকে কোনোদিন বসতে দিইনি, ছুটিয়ে মেরেছি বলে সে-ও ভোঁতা হতে সুযোগ পায়নি৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘আমি সত্যজিৎ ব্যানার্জির কথা বলছি৷ আপনার স্কুলেই পড়াশোনা করেছিল৷’

জগমোহনবাবু চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘১৯৯২ মাধ্যমিক ব্যাচ, ফার্স্ট বয় ছিল৷ কেউই ছিল না সেভাবে৷ আমিই ওর পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলাম৷ আমার বাড়িতেই পড়তে আসত৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘ওর কোনো ট্রিটমেন্ট করাননি আপনি?’

জগমোহনবাবু মাথা নিচু করে বললেন, ‘করিয়েছিলাম৷ তখন সাময়িক সেরে গেলেও আবার হত৷ আমার বাড়ির গোডাউন খুঁজলে এখন ওর প্রেসক্রিপশনের ফাইল পেয়ে যাবে৷ আমার বাড়ি থেকে কখন কাগজের টুকরো বিক্রি করা হয়নি৷

লগ্নজিতা বলল, ‘যদি অনুমতি দেন, আমি খুঁজতে পারি৷’

জগমোহনবাবু বললেন, ‘দ্যাট’স দ্য স্পিরিট৷ এই টুকটুকি, এই ম্যাডামকে একটু আমাদের গোডাউনে নিয়ে যা তো৷ আর তুইও একটু হেল্প করিস৷ দেখেছিস, বলেছিলাম না আবর্জনা নয়, ও ঘরেও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আছে৷ একজন অপরাধীকে ধরতে সাহায্য করবে৷’

লগ্নজিতা বলল, ‘কী করে জানলেন ও অপরাধী?’

জগমোহনবাবু বললেন, ‘না হলে অবাক হব৷ কারণ ওর যে রোগটা ছিল, তাতে ও অপরাধ করতে বাধ্য৷

সকল অধ্যায়

১. ব্যাঙ্কে কান্নাকাটি
২. সক্রেটিসের শিষ্য
৩. হসপিটালে হট টপিক
৪. রাঘব না রাঘব বোয়াল?
৫. মাসি না মডেল?
৬. কৌশিকের মানভঞ্জন
৭. জলধরের জলপান
৮. রিলস সুন্দরী
৯. ফেসবুকে প্রেম
১০. তীরে এসে তরি ডুবল
১১. সুইসাইড না মার্ডার?
১২. অ্যাট্রাকটিভ
১৩. লগ্নজিতার ব্যর্থতা
১৪. শয়তানের কারসাজি
১৫. ফাঁদ
১৬. পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
১৭. ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ
১৮. এ ঘরে মৃত্যুর গন্ধ
১৯. এক মাসে সুন্দরী
২০. অষ্টধাতুর কৃষ্ণমূর্তি
২১. আবার খুন
২২. পার্লারে বোটক্স ট্রিটমেন্ট
২৩. স্বীকারোক্তি
২৪. সম্পর্কের সমাপ্তি
২৫. নামবিভ্রাট
২৬. হু ইজ জগমোহন?
২৭. মিডিয়া কনফারেন্স
২৮. সেলিব্রেশন মুড
২৯. সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ
৩০. গল্পের শ্রোতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন