কবিতার শত্রু ও মিত্র : একটি খোলা চিঠি

বুদ্ধদেব বসু

অনেকদিন তোমাকে চিঠি লিখতে পারিনি। অনেকদিন— যদিও ইতিমধ্যে তোমার দু-খানা চিঠি পেয়েছি, অনেকবার পড়েছি, কৃতজ্ঞ বোধ করেছি আমার ভাগ্যের কাছে যেহেতু তুমি, ছেলেবেলা থেকে আমার বন্ধু, এককালে আমার সাহিত্যিক জীবনের নিত্যসঙ্গী— দূর দেশে ভিন্ন পরিবেশে বাস করেও, অন্য ভাষায় পরিবৃত হয়েও— কখনো রোম, কখনো ন্যুয়র্ক কখনো-বা নাইরোবির বিমানবন্দর থেকে এখনো আমাকে স্নেহের সঙ্গে স্মরণ করো। তুমি ভাবতে পারবে না তোমার চিঠিগুলি কত আনন্দ নিয়ে আসে আমার জন্য— ভিতরে যা আছে শুধু তা-ই নয়, বাইরের লেফাফাটাও— নিয়ে আসে সারি-সারি রঙিন ডাকটিকিটে দূর কোনো সমুদ্রের ঝাপট যেন, গাঢ় কালো কালিতে লেখা ঠিকানায় তোমার হস্তাক্ষরের প্রণয়স্পর্শ। আমি জানি তুমি সুচিন্তিতভাবে ঐ টিকিটগুলোকে বেছে নাও, আমার চোখের ও মনের ক্ষণিক প্রীতিসাধনের জন্য— চিঠি খোলার আগে থেকেই আমার সম্ভোগ শুরু হয়ে যায়। অথচ দ্যাখো, তোমার শেষ চিঠি পাবার পরেও তিন সপ্তাহ কেটে গেলো, এখনো আমি নীরব। রোজ ভাবি লিখবো, রোজ ভাবি আজ থাক। অবশেষে নিজেকে আজ বাধ্য করলাম আরম্ভ করে দিতে, কিন্তু শেষ করতে পারবো কিনা এখনো জানি না। 

আসল কথা, গত চার মাস ধরে—না, প্রায় পাঁচ মাস ধরে— আমি কিছুই লিখছি না, একটি পঙক্তি নয়, একটি বাক্য নয়— মাঝে-মাঝে দু-চার লাইনের ‘কেজো’চিঠিপত্র ছাড়া কিছুই লিখিনি, পারছি না লিখতে, লেখার ইচ্ছেটাই যেন মরে যাচ্ছে আমার। অথচ আমার মনে হয় না আমি নিঃসাড় হয়ে গিয়েছি। এই পাঁচ মাসের মধ্যেও কখনো কোনো চিন্তা আমাকে নাড়া দিয়েছে, কোনো স্বাগতভাষণ ছন্দে বাঁধা পড়েছে হঠাৎ, কারো মুখে শোনা হালকা কোনো কথার মধ্যে চমক দিয়েছে ইঙ্গিতে কোনো কাহিনী— কিন্তু এই সব আকস্মিক উপহার থেকে স্পষ্ট কিছু গড়ে তোলার মতো উৎসাহ আমি নিজের মধ্যে সংগ্রহ করতে পারিনি। এমন নয় যে এ-রকম অবস্থা আগে আমি জানিনি কখনো, অনেকবার জেনেছি— অনেক বন্ধ্য ঋতু, ব্যর্থ দিন, ক্লান্তির ধূসরতা, যাকে বলা যায় আমারই মধ্যে লুকিয়ে-থাকা এক পাতাল, যাতে প্রবিষ্ট হয়েও আবার আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি (যেহেতু শেষ পর্যন্ত আমিই আমার কর্তা)— বহু কষ্টে, হয়তো কিছুটা দৈবের সাহায্যেও ঠিক বিজয়ীভাবে না-হোক, অন্ততপক্ষে সসম্মানে। এমনও নয় যে এটা আমার বয়ঃক্রমজনিত অবসাদ, কেননা ধীরে-ধীরে দেখছি বার্ধক্যও একেবারে দরিদ্র নয় (তুমিও তা বুঝে নিয়েছো সন্দেহ নেই?), অন্তত রিক্ততার কিছুটা ক্ষতিপূরণ তা নিয়ে আসে, আমাদের বিরত করে অপচয় থেকে, আলস্য থেকে, অতি সহজ ও চিন্তাহীন উচ্চারণ থেকে, শিক্ষা দেয় গর্বে ও বিনয়ে, স্বীকরণে ও অতিক্রমণে, হৃদয়ের অবশিষ্ট রত্নগুলির পরিচর্যায়। না, বার্ধক্য নয়, আমার নিজের কোনো অস্বাস্থ্য নয় (তা যদি জানতাম তবু কিছুটা সান্ত্বনা পাওয়া যেতো); যে-কারণে আমার চিন্তাগুলি এখন ছিন্নভিন্ন, যে-কারণে কাগজে কলম ছোঁওয়াতে আমি বার-বার থমকে যাচ্ছি, সেটা আমার অন্তর্ভূত কোনো ঘটনা নয়— এক অন্ধ ঐতিহাসিক শক্তি, দুর্বার এবং দুর্বোধ্য, যার উপর আমার বা তোমার কোনো হাত নেই, মনে হচ্ছে কারোরই কোনো হাত নেই— এবং যা, আমি যাকে আমার জগৎ বলে জানি, তার সুদূরতম পরপারে অবস্থিত হয়েও আমার ক্ষুদ্র নিভৃত অন্তঃপুরটিকে কোনো কুহকের মতো অনির্ণেয় করে তুলছে। তোমার কাছে স্বদেশীয় সংবাদপত্রাদি নিয়মিতভাবে পৌঁছয়, তাই ধরে নিচ্ছি স্থূল তথ্যগুলি তুমি জানো, যদিও তোমার সাম্প্রতিক চিঠিতে সে-বিষয়ে কোনো উল্লেখ করোনি। করোনি— সেটা আমার পক্ষে সুখের কথা; আমি পেলাম এমন দু-একটি সকালবেলাকে, যার বার্তা শুধু কলকাতার বিষাদ নয়, অন্য কোনো সুস্বাদু অনুভব— কোনো ভূদৃশ্য, কোনো দূরত্ব, কোনো রৌদ্রালোকে গুঞ্জনময় আকাশ (আমারই জানলার বাইরে, কিন্তু আমি আর দেখতে পাই না আজকাল)— সেই সঙ্গে আমার সাম্প্রতিক দু-একটি কাব্যকাহিনী বিষয়ে তোমার বুদ্ধিদীপ্ত হৃদয়গ্রাহী অনুমোদন। বিশ্বাস করো, তোমার ফুৎকারে আমার আগুন যেন হেসে উঠেছিলো আবার, নিজেকে মনে হয়েছিলো পুনরুজ্জীবিত, প্রায় কোনো নতুন চেষ্টার জন্য প্রস্তুত— কিন্তু হায়, তাও মুহূর্তের জন্য। কেননা তন্ময়ভাবে কিছু রচনা করতে হলে প্রথমেই চাই আস্থা— আস্থা নিজের উপর, অচেতনভাবে মানব-সংসারের উপরেও, মানুষের মনুষ্যত্ব ও সভ্যতার স্থায়িত্বের উপর— এক কথায়, আমরা যাকে অস্পষ্টভাবে ‘জীবন’বলি তার উপর। আমার চিত্ত অন্যদের পক্ষেও অধিগম্য, আমার চিন্তায় অন্যেরাও স্পষ্ট হতে পারে, আমার বেদনার অন্য বহু অংশীদার সম্ভব (বহু না-হোক, অল্প কয়েকজন; এ-মুহূর্তে না-হোক, ভবিষ্যতে), এই বিশ্বাস— বা যদি মোহ বলতে চাও তবে তা-ই—মনের মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল না-হলে (অর্থাৎ, আমরা যে যা করছি তা করার যোগ্য এ-কথা স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে না-নিলে) মানুষের চেতনা ও কল্পনা কি চিরকাল অপ্রকাশিত থাকতো না? কিন্তু এ-মুহূর্তে আমার মনে সেই মৌলিক আস্থাই দুর্বল হয়ে পড়ছে; আমি যেন বাস্তুভিটায় আর আশ্রয় পাচ্ছি না, নিজেকে অনবরত জিজ্ঞাসা করছি : কেন? কার জন্য? কী হয় এ-সব দিয়ে? তুমি আর আমি যা-কিছু জেনেছি মূল্যবান বলে, যা-কিছু মেনেছি একাধারে প্রিয় ও শ্রেয়, যা-কিছু জীবনকে অর্থ দেয় বলে আমরা ধারণা করেছি— অর্থ দেয়, ঋদ্ধ করে তোলে, দিগন্তের দিকে দরজা খুলে দেয়, আজ মনে হয় সে-সব কিছু নয়— শুধু এক অস্পষ্ট ও মোহময় বিহঙ্গধ্বনি, যা আমরা আধো ঘুমে আধো স্বপ্নে কোনো-এক নির্মল উষায় শুনেছিলাম। আজ যখন আমাদের চারদিকে দেখছি দেশে-দেশে, ভারতবর্ষে, বাংলা দেশে, আর বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ এই কলকাতায়—দেখছি এত অন্যায় ও অবিচার, নৈরাশ্য ও নিষ্ঠুরতা, এত ব্যর্থ উন্মাদনা ও অপব্যয়িত উদ্যম, এত ধ্বংস ও সন্ত্রাস ও আর্তি— তখন আমার মনে প্রশ্ন : কী এসে যায় এ-সবে- রিলকের আর ইয়েটসের কবিতা, টোমাস মান্ আর মার্সেল প্রুস্ত-এর উপন্যাস, রুয়ো রেমব্রান্ট বতিচেল্লির চিত্রকলা, রঁদ্যার মূর্তি, কোণারক আর খাজুরাহো, আর আমাদের উদয়শঙ্কর ও রবিশঙ্করগণ, এমনকি আমাদের নিশ্বাসে-মেশা রবীন্দ্র-সংগীত— এই সৌন্দর্যের আভা, আনন্দের স্পর্শ, মুক্তির স্বাদ, এই উদ্ভাসিত অন্তর্লোক ও জ্যোতির্বিদ্ধ রহস্য—কী এসে যায় এ-সবে, কী করতে পারে এরা আমাদের জন্য, হতে পারে কোন মড়কে চিকিৎসক বা কোন সংকটে দিশারি? আমাদের মানতেই হবে, সে-রকম কিছুই পারে না এরা, আমাদের জরুরিতম সংসারজীবনের প্রধানতম চাহিদা মেটাবার এদের কোনো ক্ষমতা নেই। মানতেই হবে, আজকের এই বিশৃঙ্খল বাংলা দেশে এরা পারে না কাউকে কোনো সুপরামর্শ দিতে, কোনো দিক দিয়ে প্রবৃত্ত বা নিবৃত্ত করতে, যেখানে অসংখ্যের জীবন নিয়ে সংগ্রাম চলছে, সেখানে এরা একেবারেই অক্ষম। বরং উল্টো দিকে এদের কিছু প্রভাব দেখা যায় : মনের মধ্যে কল্পনা-মায়া বিস্তার করে এরা বাস্তব থেকে সরিয়ে আনে মানুষকে, সন্নিকট দায়িত্বগুলিকে ঝাপসা করে দেয়। তাহলে কি বলা যায় না এরা হয় নিষ্ফল, নয় নিন্দনীয়? 

তুমি হাসছো? না কি লজ্জিত হচ্ছো আমার মুখে এই প্রশ্ন শুনে, যে-আমি আজ চল্লিশ বছর ধরে সাহিত্যকর্মে ব্যাপৃত আছি? কিন্তু তুমি তো জানো এই প্রশ্ন কিছু নতুন নয়, আমরাই আমাদের জীবনে আগে অনেকবার শুনেছি। অসহযোগ আন্দোলন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ভারতবর্ষের স্বাধীনতালাভ ও পুনর্গঠনের প্রয়াস— ইতিহাসের প্রতি পদক্ষেপে আমাদের শুনতে হয়েছে কটূক্তি। ‘কবিতা লিখে কী হয়— দেশের কাজ করো! ‘‘গান বন্ধ হোক, এখন যুদ্ধ!’কবিরা যদি সমাজশোধনের যন্ত্রী না হন তাহলে আমরা চাই না তাঁদের।’ এমনকি : ‘দিগন্ত-জোড়া ধানখেতের দৃশ্য পৃথিবীর সব কবিতার চাইতে মূল্যবান—’ এ-রকম একটি আশ্চর্য কথাও শোনা গিয়েছিলো একবার। যেন কবিতা বিনষ্ট হলেই অধিক শস্য উৎপন্ন হবে! যেন কবিরা কোনো জাদুবিদ্যার বলে কৃষিকর্মে ব্যাঘাত ঘটান! এ-সব কথা উড়িয়ে দেয়া যায়, কিন্তু মূল প্রশ্নটি আরো গভীর— চিরকালের। এবং এর উত্থাপনকারীদের মধ্যে অনেকেই আছেন মহামনস্বী। সম্প্রতি, জানো, আমি কিছু পুরোনো পুঁথি আবার পড়ছি— সময় কাটাবার জন্য, আর কিঞ্চিৎ জ্ঞানলাভের উচ্চাশা নিয়েও : আর এখন, উৎপীড়িত ও সংশয়াচ্ছন্ন মন নিয়ে, আমার ইচ্ছে করছে বত্রিশ বছর আগেকার সেই ফাল্গুন মাসে ফিরে যেতে, সেই গুল্মোরের গন্ধ-জড়ানো সন্ধেবেলায় (তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই?) যেদিন রাসবিহারী অ্যাভিন্যুয়ের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে, তারপর লেকের একটি বেঞ্চিতে বসে, তুমি আর আমি কথা বলছিলাম কবিতা নিয়ে— কবিতার ভাগ্য, শত্রু ও মিত্র, জয় ও পরাজয়। সুখী আমরা ছিলাম তখন, অনেক বেশি যুবক ও নিশ্চিন্ত : তাই কিছুটা অনায়াসেই আমাদের দেবীটিকে জিতিয়ে দিতে পেরেছিলাম; তলিয়ে দেখিনি, কী বিশাল ও বিতর্কময় সেই মামলা, যা চলছে তাঁর বিরুদ্ধে যুগের পর যুগ ইতিহাস জুড়ে— শুধু কবিতার নয়, শিল্পকলা সংস্কৃতি বলতে যা-কিছু বোঝায় তার বিরুদ্ধে, কখনো এমনকি উচ্চশিক্ষা ও পরিশীলিত রুচির বিরুদ্ধেও— যা প্রথম (অন্তত আমাদের দলিলপত্র থেকে যতটা জানা যায়)— প্রথম রুজু করেছিলেন আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, আর-কেউ নয়, স্বয়ং প্লেটো, সমগ্র পাশ্চাত্য সভ্যতার আদি- পিতা যিনি। প্রথমে প্লেটো, আটশো বছর পরে সন্ত অগস্টিন, আরো দেড় হাজার বছর পরে রুসো, আবার একেবারে বিশ-শতকের প্রান্তে এসে বৃদ্ধ টলস্টয়— এই মামলার শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম ফরিয়াদি কি এঁরাই নন? ভেবে দ্যাখো— দেশে, কালে, অবস্থায় ও অভিপ্রায়ে কতই না বিচ্ছিন্ন এঁরা : প্লেটো— আদর্শ রাষ্ট্রের প্রবক্তা, রুসো — অরাজতন্ত্রের প্রচারক; সন্ত অগস্টিন— ক্যাথলিক চার্চের স্থপতি, টলস্টয়— গির্জে- ও পুরোহিতবিরোধী ‘আদিম’ খ্রিষ্টান; প্লেটো— এক স্থিতধী ও স্থিরলক্ষ্য আচার্য, রুসো এক ভাবোন্মাদ বাউন্ডুলে; একদিকে প্লেটো ও সন্ত অগস্টিন— যাঁরা মানুষকে কঠিন নিয়মে বাঁধতে চেয়েছেন, আর অন্য দিকে রুসো— ব্যক্তি-মানুষের বন্ধনহীনতা যাঁর অভীষ্ট; একদিকে সন্ত অগস্টিন— যিনি মঠে মন্দিরে অনুষ্ঠানে তাঁর ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠা করলেন, আর অন্যদিকে রুসো ও টলস্টয়— যাঁদের ঈশ্বর এক হৃদয়লব্ধ অনুভূতিগম্য সত্তা :- কত না ভিন্ন-ভিন্ন দিক থেকে আমরা এই চারজনের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈষম্য ও বৈপরীত্য দেখতে পাই। কিন্তু, সবিস্ময়ে ও কিছুটা শঙ্কাকুলভাবে আমরা লক্ষ করি একটি বিষয়ে এঁদের একতা : এঁরা সকলেই, নিজ-নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ও মাঝে-মাঝে প্রায় সমস্বরে, প্রত্যাখ্যান করেছেন বাগদেবীকে, কলালক্ষ্মীদের, আর কখনো আমাদের পরিচিত সেই সভ্যতাকেই, যা বহুলাঙ্গ ও বিচিত্র, শিল্প ও বিজ্ঞানীর দানে বৈভবশালী। কেন এই সম্মিলিত প্রত্যাখ্যান? খুব সহজ উত্তর : যেহেতু এঁরা চেয়েছেন মানুষের ভালো হোক, তাই। যেহেতু চেয়েছেন মানুষ ভালো হোক, তাই। যেহেতু এঁদের দেশকালজাত ভিন্ন-ভিন্ন অবস্থা অনুসারে, এঁরা কল্পনা করেছেন কোনো সর্বাধিপতি রাষ্ট্র, কোনো পরমেশ্বরপুর, অথবা কোনো স্বাভাবিক ভূস্বর্গ যার আশ্রয়ে মানুষ নিষ্কলুষভাবে বাঁচতে পারবে। এবং এই মহান আদর্শের মধ্যে এঁরা শিল্পকলাকে স্থান দিতে পারেননি; অর্থাৎ, শুভ ও সৌন্দর্যের মধ্যে, সদাচার ও আনন্দের মধ্যে একটি অনপনেয় বিরোধ এঁরা অনুভব করেছেন। 

এখনই প্রতিবাদ কোরো না— আরো একটু বলতে দাও আমাকে। আমি ভুলিনি, প্লেটোর ছত্রে-ছত্রে ‘সুন্দর’ কথাটা পাওয়া যায়, আর রুসোর উপাস্য ছিলো আনন্দ। কিন্তু, প্লেটোর ‘সুন্দর’– তা কি সত্যেরই নামান্তর নয়, অথবা নয় প্রজ্ঞার বহিরবয়ব শুধু? আর রুসোর আনন্দের উৎস প্রকৃতি, অরণ্য ও হ্রদের সঙ্গে সহমর্মিতা, বা নিজেরই মধ্যে নির্বাক নিমজ্জন। কিন্তু সেই সৌন্দর্য, যার সংবেদন আমরা পাই শুধু রচিত শিল্পে, সেই আনন্দ, যা বিশেষভাবে শিল্পকলারই উপঢৌকন, তার প্রতি এঁরা সকলেই ছিলেন— না, উদাসীন নিশ্চয়ই নয়, অবস্থাভেদে সন্দিগ্ধ, অসন্তুষ্ট, বা ঘোষিতভাবে বৈরীভাবাপন্ন। প্লেটো গ্রহণ করলেন শুধু সরল সংগীত ও বিধিবদ্ধ ‘প্রশস্তি’ জাতীয় কবিতা– হোমার ও হেসিয়দকে বর্জন করে; প্লেটো ও অগস্টিন প্রায় একই যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেন যে রেটরিক বাগবিদ্যা (ভারতীয় ভাষায় শব্দালংকার)- যার সাহায্য ছাড়া, সকলেই জানে, বাক্য কখনো কাব্য হয়ে ওঠে না— আসলে তা এক দুষ্ট সরস্বতী মাত্র, সত্যান্বেষীর অনুশীলনের অযোগ্য। প্লেটো পরিতপ্ত হলেন মানুষ যেহেতু শ্রুতবিদ্যায় আবদ্ধ না-থেকে লিপি দিয়ে লিখতে শিখেছিলো, মুদ্রাযন্ত্রকে শয়তানের আবিষ্কার বলে চিহ্নিত করলেন রুসো। আর টলস্টয়— সেই ক্রুদ্ধ, গর্জমান আত্মদংশনকারী বৃদ্ধ ব্যাঘ্র, যাঁর তুল্য করুণ ও ভীষণ দৃশ্য বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আর নেই— তাঁর কথায় এক্ষুনি আসছি, আগে অন্য একটা কথা বলে নিই। 

তোমার মনে আছে রুসোর সেই চিঠি, যাতে তাঁর জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ আচরণটির তিনি সমর্থন করছেন? ‘হাঁ, মাদাম,আমি পর-পর আমার পাঁচটি সন্তানকে অনাথ আশ্রমের দরজায় পরিত্যাগ করেছিলাম। কেন জানেন? যেহেতু তাদের ভরণপোষণের ক্ষমতা আমার ছিলো না। যেহেতু তাদের মাতাকে আমি বিবাহ করিনি— করিনি এইজন্য যে বিবাহ আমার মতে অবিচার ছাড়া আর-কিছু নয়— তবু এও চাইনি যে লোকচক্ষে সে কলঙ্কিনী হোক। তাছাড়া, অনাথ আশ্রম শিশুদের পক্ষে উত্তম স্থান; সেখানে তারা সুকুমারভাবে লালিত হয় না, প্রদত্ত হয় যা-কিছু প্রয়োজনীয়, কিন্তু সব বাহুল্য থেকে বঞ্চিত হয়। শেখে— “ভদ্রলোক” নয়, “বাবু” নয়— কৃষক ও শ্রমিক হয়ে উঠতে। এই ধরনের প্রতিপালনে কিছুই নেই, যা আমি আপন সন্তানের জন্য ইচ্ছে করবো না। বেছে নিতে পারলেও আমি তাদের লেখক অথবা কেরানি করে তুলতাম না, আমি চাইতাম তারা লাঙল হাতে নিক, বা ছুতোর-মিস্ত্রি হোক। তারা ভবিষ্যতে পাবে এক সুস্থ ও পরিশ্রমী জীবন, অসাধু উদ্দেশ্যজনিত বিকার থেকে রক্ষা পাবে। সন্দেহ নেই তাদের পিতার চাইতে সুখী হবে তারা।” — চমকপ্রদ যুক্তি, কিন্তু তুমি কি বলবে এটা শুধু এক ক্লিষ্ট বিবেকের আত্ম-প্রতারণা? এর অন্তস্তলে রুসোর একটি গভীর বিশ্বাস কি লুকিয়ে নেই? এবং সেই বিশ্বাসের চরম পরিণতি আমরা কি লোমহর্ষকভাবে দেখতে পাই না টলস্টয়ের শিল্পবিষয়ক প্রবন্ধ পর্যায়ে? যেমন বোদলেয়ার-বর্ণিত নির্বেদ হাই তুলে জগৎটাকে গ্রাস করতে চায়, তেমনি যেন টলস্টয় তাঁর রোষানলে দগ্ধ করতে চেয়েছেন আবহমান শিল্পকলার ঐশ্বর্যকে— শুধু সমকালীন ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রকলা ও বোদলেয়ার ভের্লেন মালার্মের কবিতা নয়, শুধু ইবসেনের নাটক নয়, বাখ্ বাগনার বেঠোফেনের সংগীত নয়, এমনকি মিকেলাঞ্জেলো আর রাফায়েলকেও, দান্তে গ্যেটে মিল্টন শেক্সপিয়র আর ঈস্কিলস সফোক্লেস ইউরিপিদেসকেও! এই সবই, তাঁর মতে, ‘মিথ্যা শিল্প’, গ্রীক কবিরা ‘বর্বর’, মিকেলাঞ্জেলো অবাস্তব, আধুনিকেরা ‘ধর্মবোধহীন’, পুশকিনের প্রেমের কবিতা ‘অশ্লীল’। আর তাঁর নিজের রচনা? টলস্টয় সে-বিষয়েও স্পষ্টবাদী— ‘আমি যা-কিছু লিখেছি সবই কুশিল্প, শুধু একটি গল্প প্রথম শ্রেণীর— “ঈশ্বর সত্যদ্রষ্টা, কিন্তু অপেক্ষমাণ”, আর “ককেশাসে বন্দী” গল্পটিকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ফেলা যায়।’— আমরা কি হো-হো করে হেসে উঠবো, না কি উন্মাদের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেবো এ-সব কথা? না কি বলবো এই আগুন তাঁরই ব্যক্তিগত মনস্তাপের;—যেহেতু বিত্তশালী অভিজাতবংশে জন্ম নিয়ে তিনি দীর্ঘকাল ধরে ভোগপরায়ণ জীবন কাটিয়েছেন, এবং যেহেতু এমন কয়েকটি ‘পাপকর্ম’ করে ফেলেছেন যা তাঁর ললাটেও মহাশিল্পীর কলঙ্কতিলক এঁকে দিয়েছে, তাই, প্রায়শ্চিত্তরূপে, শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলিকে নির্দয়ভাবে মর্দন করেছিলেন? কিন্তু আমরা যা-ই বলি আর যা-ই করি না কেন, আমাদের মামলার একটি প্রধানতম দলিল হিশেবে, প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বিস্তারিত সাক্ষ্য হিশেবে, তাঁর বক্তব্য আমাদের অনুধাবনযোগ্য। আমরা দেখছি যে তিনিও, প্লেটোর মতোই, সরল শিল্পের পক্ষপাতী; কিন্তু প্লেটো যেখানে চেয়েছিলেন শাসকশ্রেণীর উপযোগী দেশাত্মবোধক কবিতা, সেখানে রাষ্ট্রবিরোধী দেশপ্রেমবিরোধী টলস্টয় চাইলেন লোকসাহিত্য—প্রবচন, হেঁয়ালি, রূপকথা ইত্যাদি, যা সর্বজনের বোধগম্য ও ঋজুভাবে উপদেশাত্মক। যেমন প্লেটো ও অগস্টিনের কাছে রেটরিক নিন্দার্হ, তেমনি টলস্টয় যে-কোনোরকম তির্যক ভঙ্গির প্রতিকূল; কিন্তু যে-বিদ্যাকে প্লেটো জানালেন আহবান, সেই শিল্পসমালোচনা, টলস্টয়ের মতে শুধু ‘কুশিল্পে’র যশোবর্ধক ও এই কারণে অনিষ্টকারী। স্পষ্টত, অন্য তিনজনের তুলনায় টলস্টয় অনেক বেশি উগ্র ও অসহিষ্ণু, ন্যূনতম সন্ধিস্থাপনেও অসম্মত। প্লেটো যেখানে, প্ৰথমে অভিনন্দন জানিয়ে, তারপর কবিকে নির্বাসনে পাঠান, সেখানে টলস্টয় বর্ষণ করেন অবিমিশ্র ঘৃণা। যদি কবিতা হয় একাধারে উপকারী ও সুখদায়ক, তাহলে তা প্লেটোর রাষ্ট্রে স্বীকার্য, তাঁর চোখে রমণীয় বলেই অপরাধী নয় কবিতা; কিন্তু টলস্টয়ের জেহাদ ঐ সুখ বা রমণীয়তার বিরুদ্ধে। ‘সেখানে তারা প্রদত্ত হয় যা-কিছু প্রয়োজনীয়, সব বাহুল্য থেকে বঞ্চিত হয়—’ রুসোর এই সূত্রটিকে টলস্টয় যেন তার সর্বশেষ সীমা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন— একেবারে যুক্তিবুদ্ধির পরপারে। বাহুল্য : তার ব্যঞ্জনা কি শুধু দেহভোগ্য সামগ্রীতে, শুধু খাদ্যে বসনে গৃহনির্মাণে আসবাবপত্রে? যদি মানুষকে শুধু নীতিধর্মে দীক্ষিত করাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে উচ্চশিক্ষাও বাহুল্য নয় কি? জ্ঞানের চর্চা বাহুল্য নয়? আর কলুষদুষ্ট কলারসিকেরা যাকে বলে থাকেন সৌন্দর্য, বা আনন্দ তার মতো বিপজ্জনক বাহুল্য আর কী আছে? অতএব বিনষ্ট হোক— রুসোর পরিত্যক্ত পঞ্চসন্তানের পক্ষে যা-কিছু প্রাপণীয় বা ব্যবহার্য হতে পারেনি— সব পার্থিব বিলাসদ্রব্য, আর সেই সঙ্গে সব উন্নত ও সুপরিণত শিল্পকলা, চিত্র সংগীত সাহিত্য নাট্যাভিনয়, পৃথিবী পরিণত হোক এক ঈশ্বরসনাথ অনাথ-আশ্রমে, যেখানে নেই কোনো বেঠোফেন বা মিকেলাঞ্জেলোর চিত্তবিক্ষেপকারী মায়াজাল, কোনো দান্তে বা শেক্সপিয়র বা সফোক্লেসের কল্পনাবিভা। মনোমুগ্ধকর? সুন্দর? ও-সব লক্ষণ— টলস্টয়ের মতে— বেশ্যার পক্ষেই যথোপযোগী, সন্তানধারিনী সাধ্বী স্ত্রীর পক্ষে নিষ্প্রয়োজন। সুখ ও সাধুতা পরস্পরবিরোধী, সুনীতি ও সৌন্দর্য কখনোই সহবাসী হতে পারে না- এ-কথা টলস্টয়ের মতো এমন সবলে ও সদর্পে, এমন অদ্ব্যর্থভাবে ও ক্ষমাহীনভাবে অন্য কেউ কখনো ঘোষণা করেননি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, যা আথেন্সে ছিলো বিতর্কের বিষয়, ইয়াসনায়া পোলিয়ানাতে এসে তা লৌহকঠিন ডা হয়ে উঠলো। 

‘যদি এমন কেউ থাকেন যিনি কাব্যরসিক কিন্তু নিজে কবি নন, তিনি যদি কবিতার সপক্ষে গদ্যভাষায় কিছু বলতে চান, আমরা তাঁকে অনুমতি দিচ্ছি। আসুন তিনি, প্রমাণ করুন কলালক্ষ্মী শুধু সুখদা নন, শুভংকরী।’ লোকে বলে, প্লেটোর এই আহ্বানের উত্তরেই, তাঁর এক মেধাবী ছাত্র, তাঁর মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে একটি কাব্যশাস্ত্র রচনা করেন। কিন্তু আমরা জানি, মূল প্রশ্নটির সামনে দাঁড়ানো দূরে থাক, আরিস্টটল তার উল্লেখ পর্যন্ত করেননি; তাঁর সগর্ভ ও স্বল্পবাক পুস্তিকাটির আলোচ্য হলো কাব্যের রূপশিল্প, নীতিতত্ত্ব নয়। কোন উপায়ে কবিতা আমাদের মর্মস্পর্শী হয় তা তিনি বলেছেন, কিন্তু সেই স্পর্শ হিতকারী কিনা সে-বিষয়ে তিনি নীরব। ‘কাথারসিস’ বা চিত্তশুদ্ধি বিষয়ে তাঁর একটি বিখ্যাত বাক্যাংশ— সেটাকেই টেনে-হিঁচড়ে প্লেটোর বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যায়, তা করাও হয়েছে অনেকবার; কিন্তু তুমি কি বলবে সেটুকুই যথেষ্ট? ‘ভুলে যেয়ো না, গ্লকন, আমরা এক মহৎ প্রশ্নের সম্মুখীন— মানুষ সৎপথে থাকবে কি থাকবে না। কী-লাভ হবে আমাদের— যদি অর্থ অথবা যশের মোহে, বা কাব্যপ্রসূত উত্তেজনাবশত, মানুষ ভুলে যায় নীতিধর্ম ও সদাচার?’ স্বল্পবুদ্ধি গ্লকন কোনো দ্বিরুক্তি করেনি, এমনও আপত্তি তোলেনি যে অর্থলোভ ও যশোলিপ্সার পরেই কাব্যানুভূতি উচ্চার্য নয়; কিন্তু আমরা অনেকেই ধরে নিয়েছি আরিস্টটল ইঙ্গিতে এরই উত্তর দিয়েছিলেন, যেন বাঁকা চোখে গুরুর দিকে তাকিয়ে। চিত্তশুদ্ধি, আবেগের নিষ্কাশনপ্রসূত পবিত্রতাবোধ, তা যদি সাধন করতে পারে কবিতা, তবে কি তা মানুষের পক্ষে কল্যাণকর নয়? কিন্তু এই কথা, যা আরিস্টটল বলেছিলেন অতি মৃদুভাবে, আর তা শুধু তাঁর পরিচিত ট্র্যাজিক কাব্যের সম্পর্কে, তা কি সর্বত্র সবক্ষেত্রে প্রয়োজ্য? ওভিদ পড়ে কোন চিত্তশুদ্ধি হয় আমাদের? বা ‘মেঘদূত’? বা শেক্সপিয়রের সনেটগুচ্ছ? এ-সব স্থলে আরিস্টটলের ‘ত্রাস’ বা ‘করুণা’ কোনোটারই তো স্থান নেই। একমাত্র সম্ভবপর উত্তর : আমরা পাই সৌন্দর্যের অনুভূতি, আর তাতেও চিত্তশুদ্ধি ঘটে; আমরা পাই আনন্দ, আর তাও আনে পবিত্রতাবোধ। বহুবার শোনা গিয়েছে এই কথা, বহু পণ্ডিতের মুখে, বহু ভিন্ন-ভিন্ন দার্শনিক ভূমি থেকে উচ্চারিত। কিন্তু এই উত্তর আ মা দে র— আমরা যারা টলস্টয়কর্তৃক তিরস্কৃত কাব্যরসিক বা নিজেরাই কিঞ্চিৎ কলাকুশলী। ভেবে দ্যাখো, কোনো সমাজহিতৈষী কি কানে তুলবেন কথাটা, কোনো ধর্মগুরুকে ভজাতে পারবেন আরিস্টটল? একবার স্মরণ করো সম্ভ হিয়েরোনিমসকে সেই মরুবাসী ঈশোন্মাদ মহাত্মা, যিনি স্বহস্তে তাঁর সব পুঁথি ভষ্মীভূত করেছিলেন। আর সন্ত অগস্টিন, যিনি যৌবনে ছিলেন ‘অশুচি প্রেমে’র গুঞ্জনমুগ্ধ, বিদ্যার্জনে মনোযোগী, নাট্যকলায় প্রীতিপরায়ণ মনে করে দ্যাখো মঞ্চাভিনয় বিষয়ে তাঁর উত্তরজীবনের মন্তব্য।’কেন এমন হয় যে মানুষ চায় শোকাবহ ঘটনা দেখে বিষণ্ন হতে, যার ভুক্তভোগী সে স্বেচ্ছায় কখনো হবে না? কেন চায় দর্শক হয়ে দুঃখভোগ, আর সেই দুঃখের নাম দেয় আনন্দ? এক অদ্ভুত শোচনীয় উন্মত্ততা ছাড়া আর কী বলা যায় একে? … যখন সে নিজে দুঃখ পায় তখন বলে দুর্ভাগ্য, আর যখন হয় অন্যের সমদুঃখী তখন নাম দেয় করুণা। কিন্তু কেমন সেই করুণা, যার লক্ষ্য শুধু অনুকৃত ও চিত্রিত বেদনাবেগ? কেননা দর্শক কোনো দুঃখলাঘবে আহূত নয়, শুধু দুঃখবোধে আমন্ত্রিত : আর যত প্রবল হয় দুঃখবোধ ততই ও-সব কল্পিত বিষয়ের অভিনেতার সে গুণগান করে। সে চলে যায় বিরক্তিভরে, ক্রন্দন যদি নির্গত না হয়, আর শোকাবেগ জাগলে মোচন করে আনন্দাশ্রু। … আর আমি, আমিও ভালোবেসেছিলাম এই অনুকৃত শোক— আমি, তোমারই আশ্রিত, তবু এই কদর্য রোগে আক্রান্ত। … এমনি ছিলো আমার জীবন, কিন্তু হে আমার ঈশ্বর, এর নাম জীবন হতে পারে কি?’ কতবার— তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম কয়েকটি পরিচ্ছেদে কতবার আমরা শুনি এই বিলাপধ্বনি, তাঁর তৃপ্তিহীন আত্মধিক্কার! ‘কে দুঃখী সেই দুর্ভাগার চেয়েও, যে কাঁদে প্রণয়মুগ্ধা দিদোর মৃত্যুতে, কিন্তু কাঁদে না সে নিজে মৃত বলে— মৃত, যেহেতু তোমার প্রতি তার প্রেম নেই, হে ঈশ্বর, আমার আত্মার জ্যোতি, আমার অন্তরতম আত্মার অন্নজল।’’আমি বিনা-শিক্ষকে অনায়াসে আয়ত্ত করেছিলাম বাগবিদ্যা ও ন্যায়শাস্ত্র, আর জ্যামিতি সংগীত পাটিগণিত, কিন্তু আয়ত্ত করিনি পুণ্যের তত্ত্ব, তাই কদর্যভাবে ভ্রান্ত ছিলাম। … আর এই উন্মত্ততাকেই লোকে বলে থাকে উচ্চশিক্ষা!’— দেখলে তো, এই ঈশ্বরভক্ত সন্ন্যাসী কেমন চূর্ণ করে দিলেন কাথারসিস-তত্ত্বকে, একদা অতি যত্নে অধীত সমগ্র আরিস্টটলকে, কেমন তাঁর অতীত দুষ্কৃতির তালিকায়— বাল্যের একটি চৌর্যকর্ম ও যৌবনের রক্ষিতাগ্রহণের সঙ্গে, একই নিশ্বাসে— অন্তর্ভূত করলেন তাঁর সাহিত্যপ্রীতি, বিদ্যাচর্চা, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ! এই জলদগম্ভীর নির্ঘোষের মধ্যে আরিস্টটলের নম্র কণ্ঠ কি ডুবে যাবে না? টলস্টয়ের ভীম আক্রমণকে কোনো ধীর যুক্তি কি ঠেকাতে পারবে? এমনকি, আমাদের প্রকৃতিপূজক চার্চ-বিরোধী জাঁ-জাঁক, তিনিও— সম্ভবত নিজেরই অজান্তে— পুরোহিতশ্রেষ্ঠ অগস্টিনের প্রতিধ্বনি করে নাট্যকলার নিন্দা রটিয়েছিলেন— যেহেতু অভিনেতারা অন্যের সত্তায় প্রবিষ্ট হন, এবং যেহেতু দর্শকেরা শোকের দৃশ্য দেখে ‘পরকীয় পুণ্য’ উপার্জন করে। আমরা মামলায় হেরে যাচ্ছি, বন্ধু, আমাদের সপক্ষে প্রচণ্ড কোনো উকিল নেই। 

অন্যত্র চেষ্টা করে দেখবো? তাঁদের কাছে গেলে কেমন হয়, যাঁরা দেখাতে চেয়েছেন কবিতা যুগপৎ সুখ ও সুশিক্ষা বিতরণ করে? এই মনোরম প্রস্তাবটির উত্থাপক বোধহয় হোরাস—ইতিহাসের প্রথম কবি-সমালোচক, যাঁর দৃষ্টান্ত অনুসারে, প্লেটোর বিপরীত নির্দেশ সত্ত্বেও, কবিতার তত্ত্বালোচনা কবিদেরও কৃত্য বলে স্বীকৃত হলো। হোরাসের প্রথম উক্তি : কবিতা পড়ে হয় আমরা লাভবান হই, নয়তো আনন্দিত (যার অর্থ দাঁড়ায় আনন্দ কোনো ‘লাভ’ নয়); দ্বিতীয় উক্তি : সেই কবিতাই সবচেয়ে প্রশংসনীয়, যাতে মিশে থাকে সুখের মধ্যেই উপদেশ। কথাটা শোনামাত্র প্রশ্ন ওঠে : কবিদত্ত উপদেশ ঠিক কোন ধরনের? মানুষের সমাজব্যবস্থায় তার উপযোগিতা আছে কি নেই? যদি থাকে—তাহলে প্রশ্ন : কেন কবিকে উপদেষ্টার ভূমিকা নিতে হবে, আর তা নিতে গিয়ে তিনি তাঁর কবিসত্তাকে ক্ষুণ্ণ করেন কি করেন না। হোরাসের সূত্র অনুধাবন করে এ-সব প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজেছিলাম, আর তারই ফলে আরো যেন উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। কেননা হোরাস নিজে যেমন কবি, তাঁর অধস্তন বংশতালিকার মধ্যেও অনেকেই তা-ই, আর সেই কারণে শুধু যে প্রতিপক্ষের চোখে সন্দেহভাজন তা নয়, আমাদের পক্ষেও কিছুটা যেন অনির্ভরযোগ্য। আমরা দেখতে পাই এই বংশের উজ্জ্বল প্রতিনিধিরা, সুবক্তা হয়েও, উৎসাহী হয়েও শেষ পর্যন্ত নৈরাশ্যজনক; তাঁদের নামাঙ্কিত নথিপত্রের মধ্যে বিশেষভাবে চোখে পড়ে কবিতার দুটি ‘জবাবদিহি’ বা ‘সমর্থন’ (হায়, দেবী, চিরকাল তুমি কাঠগড়ায়!), কিন্তু কবিতাকে উচ্চস্থানে বসাতে গিয়ে যা-কিছু বলা হয়েছে, সবই মনে হয় অভিযোগের তুলনায় দুর্বল, বা অপ্রাসঙ্গিক, বা অস্পষ্ট। ফিলিপ সিডনির : ‘দার্শনিকদত্ত সদুপদেশকে চিত্ররূপ দেন কবিরা’, বা শেলির : ‘কবিতা যা সৃষ্টি করেছে নীতিশাস্ত্র তারই ব্যবস্থাপক ও প্রচারক—’ এ-সব কথার কী-অর্থ হয় আমি ভেবে পাচ্ছি না। শেলি কবিতার সার্বভৌমতা প্রচার করেছিলেন, কিন্তু রাজনীতি সমাজনীতি দর্শন ও বিজ্ঞানের সঙ্গে কবিতাকে একীভূত করলে কবিতার গৌরববৃদ্ধি হয় না, বরং তার স্বরূপের অবলোপ ঘটে। আর ‘অস্বীকৃত বিধানকর্তা—’ কী দাম্ভিক অত্যুক্তি বলো তো! আমি মনে-মনে প্লেটোর সঙ্গে শেলির একটি তর্ক সাজাতে গিয়ে আমাদের প্রিয় কবিটিকে দু-মিনিটের বেশি টেকাতে পারিনি। না, বন্ধু, কবিতার নৈতিক মূল্যের ধ্বজা উড়িয়ে আমরা নীতিজ্ঞানীদের টলাতে পারবো না। প্লেটো, ও তাঁর পরে সন্ত অগস্টিন, হোমার বিষয়ে যে-আপত্তি তুলেছিলেন তার কোনো সন্তোষজনক উত্তর আমরা খুঁজে পাইনি এখনো। হোমার-অঙ্কিত দেবকুল ব্যভিচারী, কেউ লম্পট, কেউ অসূয়াপন্ন, কেউ ক্রোধপরায়ণ, তাঁদের দৃষ্টান্ত সমাজের পক্ষে শুভ নয়—ভেবে দ্যাখো! এই যুক্তি কত অবাস্তব, অথচ কত দুর্মরভাবে প্রতিপত্তিশীল। প্লেটো, যিনি স্পষ্ট শাদায়-কালোয় লিখেছিলেন যে শিল্পের উপর “শাসনব্যবস্থা থাকতেই হবে, আর সন্ত অগস্টিন, যিনি কবিতার ভাষাকে বলেছিলেন ‘ভ্রান্তিমদিরার মূল্যবান পাত্রস্বরূপ—’ এঁদেরই ভ্রষ্ট বীজ থেকে কি উৎপন্ন হয়নি পৃথিবীর সব ধর্মান্ধতা ও কর্তৃতন্ত্র, সব সেন্সরশিপ, সব শিল্পনিরোধক আইনকানুন ও পীড়নযন্ত্র? কী বলতে পারি আমরা উত্তরে? শুধু এই : যে প্লেটোর উক্তি তথ্যনির্ভর নয়, শিল্পকলার সংস্পর্শহীন মানুষও রিপুর তাড়নায় দুষ্কর্ম করে থাকে, আর শিল্পরসিকেরা অন্যদের তুলনায় বেশি অপরাধপ্রবণ, এমনও কখনো প্রমাণিত হয়নি। অথবা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে জ়েয়ুস-হেরার সংগমের দৃশ্যে আমরা নিজেরা রতিকাতর হয়ে পড়ি না, অরতি প্রাপ্ত হই তাও নয়—কিন্তু পাই রতি ও অরতির অতীত নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মল একটি অনুভূতি, যা শুধু শিল্পের কাছেই প্রাপণীয়। কিন্তু—কে হলফ করে বলতে পারে যে প্লেটোর আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক? সন্ত অগস্টিনের ভর্ৎসনার কোনো ভিত্তি নেই? যদি জানা যায় সেই কাহিনী শুনে অন্য কেউ কখনো সদাচার থেকে স্খলিত হয়েছে, অন্ততপক্ষে সে-রকম ঘটনা সম্ভব, তাহলে কি আমরা অস্বীকার করতে পারবো যে একবার যা ঘটেছে তা বহুবার ঘটতে পারে, যা সম্ভবপর তা অলীক নয়? আর তখন, আমাদের সেই বিব্রত নীরবতার মুহূর্তে, হয়তো কোনো টলস্টয় গর্জন করে উঠবেন— ‘সব শিল্পকলা লুপ্ত হয়ে যাক তাও ভালো, তবু কোনো চরিত্রনাশক শিল্প যেন না থাকে।’ 

বন্ধু, আমরা অসহায়। 

এক ফরাশি সারস্বত গোষ্ঠী, সময়ের দিক থেকে টলস্টয়ের নিকটতম, তাঁর দ্বারা অভিযুক্ত অগ্রগণ্য আসামির দল-বোদলেয়ার থেকে মালার্মে পর্যন্ত কবিরা—এই তর্ক নিষ্ফল বুঝে নিয়ে গ্রহণ করলেন নির্বাসনদণ্ড; কিন্তু তাঁদের পক্ষে দণ্ড আর রইলো না *সেটা, হয়ে উঠলো স্বেচ্ছায় ও সগর্বে স্বীকৃত স্বাভাবিক অবস্থা। ‘মহোদয়গণ, শুনুন, কবিতাও সুশিক্ষা দিয়ে থাকে, আর সেই শিক্ষা মনোজ্ঞ বলে আরো বেশি জনোপযোগী, অতএব আমাদের মুক্তি দিতে আজ্ঞা হোক—’ এই ধরনের করুণ আবেদনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁরা কবিতার স্বনির্ভর স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। ‘মরগণ চেয়ে দ্যাখো, আমি সুন্দর!’ ‘সেই সুন্দর অবগুণ্ঠিত নয়ন, রৌদ্রালোকে কম্পমান মধ্যাহ্ন!’ ‘সুন্দর, সপ্রাণ অক্ষতকৌমার এই আজ!’ এই আজ, এই মুহূর্ত, এই দ্যুতি, এই রহস্যময় কম্পমান সৌন্দর্য—আর-কিছু নয়, শুধু এই, এ-ই যথেষ্ট, এ-ই চরম। সুনীতি থেকে শিল্পকে এঁরা বিচ্ছিন্ন করে দিলেন : কবিতা একটি স্বতন্ত্র সত্তা, এই মহাসত্য—অন্তত পাশ্চাত্ত্য দেশে—এঁদেরই দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলো। আমরা কৃতজ্ঞ এই কবিদের কাছে; এঁরা আমাদের মনোবল বর্ধিত করেছেন, উপদেষ্টার অস্বস্তিকর ভূমিকা থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন কবিকে। কিন্তু এঁদেরই ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে অস্কার ওয়াইল্ড যখন বলে উঠলেন, ‘শিল্পকলা কখনোই কোনো কাজে লাগে না—’ তখনই আমাদের প্রাচীন শত্রুরা নতুন উদ্যমে ফিরে এলেন; বোঝা গেলো যে আমরাই, আমাদের উৎসাহের আতিশয্যে, তাঁদের হাতে এক নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছি। ‘কোনোই কাজে লাগে না?’ তার মানে-তোমরাই বলছো—নিষ্প্রয়োজনীয়? আর শিল্পী এক পরাশ্রিত জীব? আমরা দাঁড়িয়ে থাকি এই কূটোক্তির সামনে, দ্বিধান্বিত ও নীরব; আমাদের চোখের সামনে মালার্মের মিনার ইংলন্ডের রীডিং কারাগারে রূপান্তরিত হয়। 

আমরা কি ভারতবর্ষীয় অলংকারশাস্ত্রের শরণ নিতে পারি না? সেখানে মনে হয় অনেকেই আমাদের বন্ধু হবেন। হ্যাঁ—নিশ্চয়ই; কিন্তু বড়ো নির্দ্বন্দ্বভাবে বন্ধু, বড়ো একান্তভাবে সহৃদয়। আমাদের সার্থকনামা আনন্দবর্ধন ও অভিনবগুপ্তরা, যাঁরা রসতত্ত্বের সোপান বেয়ে বেয়ে উন্মোচন করেছেন কবির সঙ্গে কবিতার ও কবিতার সঙ্গে ভোক্তার সংযোগরহস্য, সংস্কৃত ভাষার কাব্যরীতির পক্ষে যাঁদের ধ্বনিবাদ একটু চমকপ্রদরূপে আধুনিক, তাঁরা কিন্তু তাঁদের সব অন্তর্দৃষ্টি ও বিশ্লেষণক্ষমতা নিয়ে, কবিতায় নীতি ও দুর্নীতি বিষয়ে উদ্ধৃতিযোগ্য কিছুই বলেননি। কবিতা মূল্যবান ও স্ব-তন্ত্র, আর কবিতালব্ধ আনন্দ এক দিব্যানুভূতি, এ-কথা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিয়ে তাঁরা বিচার করেছেন কাব্যের কলাসিদ্ধি, তার প্রভাবের প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া। সামাজিক হিতাহিতের প্রশ্ন তাঁদের মধ্যে কখনোই ওঠেনি তা নয়, কিন্তু উঠেছে অতি মৃদুভাবে, যেন পরিত্যক্ত হবার জন্যই উত্থাপিত। কাব্যের উপদেশ : ‘রামের মতো হবে, রাবণের মতো হবে না’—এ-কথা দু-একবার উক্ত হলেও অনুসৃত হয়নি; ধীরোদাত্ত বীর রামচন্দ্রকে এক অশ্রুবিহ্বল মূর্ছাপ্রবণ প্রণয়ীজনে পরিণত করে ভবভূতি, বা হরগৌরীর শৃঙ্গারলীলার সানুপুঙ্খ বর্ণনা লিখে কালিদাস কোনো সামাজিক অন্যায় করেছেন কিনা, তা নিয়ে কোনো আলংকারিক কখনো চিন্তিত হননি। আর কবিতা বিষয়ে তাঁদের যা শেষ কথা, তা এক বিশুদ্ধ সোহংবাদ— য়োরোপীয় কলাকৈবল্য যার প্রান্ত শুধু স্পর্শ করে যায়। কাব্যের আস্বাদ্যমানতা ‘ব্রহ্মানন্দসচিব’, ঈশ্বরদর্শনের তুল্য—এত বড়ো দুঃসাহসী ঘোষণা শুধু হিন্দুর পক্ষেই সম্ভব ছিলো। শ্রদ্ধেয়, মনোমুগ্ধকর বচন, আমাদের হৃদয় এতে অনুকম্পিত হয়, কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের মামলায় এই সাক্ষ্য কোনো কাজে লাগবে না, একে বলা হবে একদেশদর্শী, সামাজিক-নীতিবোধহীন। 

আমরা দেখতে পাচ্ছি, হিন্দু সভ্যতা ও য়োরোপীয় সভ্যতা এ-বিষয়ে দুই বিপরীত মেরুতে অধিষ্ঠিত। য়োরোপে মাত্র উনিশ শতকে স্থাপিত হয়েছিলো নন্দনবিদ্যা ও সমাজচিন্তার মধ্যে বিচ্ছেদ—তাও শুধু একটি গোষ্ঠীর মধ্যে, সর্বসম্মতিক্রমে কখনোই নয়। কিন্তু ভারতভূমিতে রসতত্ত্ব ও নীতিধর্ম ছিলো আবহমান পৃথকৃত, অথবা আন্তরিকভাবে নির্ভেদ। এই অর্থে নির্ভেদ যে হিন্দু দর্শনে বা সমাজসংহিতায় এমন কোনো মূলসূত্র নেই যা থেকে উদ্গত হতে পারে সুখ ও সাধুতায় কোনো বিরোধবুদ্ধি, সুনীতি ও সৌন্দর্যে কোনো বৈরিতাবোধ। যে-দেশে সব মানুষকে (এমনকি সব উচ্চবর্ণের মানুষকেও) সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মজ্ঞানীতে পরিণত করার অস্বাভাবিক চেষ্টা হয়নি, যেখানে মানুষে-মানুষে অধিকারভেদ স্বীকৃত, অর্থ কাম সম্মানিত, কামসূত্রের প্রণেতা এক মহর্ষি, এবং মানুষের সব প্রীতিবোধ ও সৃষ্টিপ্রেরণার মূলে ঔপনিষদিক আনন্দ বিরাজমান, সেখানে শিল্পকলা বিষয়ে আপত্তি উঠবে কোন দিক থেকে? একদিকে হিন্দুধর্মের এই প্রসন্নতা, জীবনের প্রতি সম্মতিজ্ঞাপন, আর অন্য দিকে মর‍্যালিটি-নির্ভর, জীবনপ্রত্যাখ্যানকারী খ্রিষ্টধর্ম, যার অঙ্কুর আমরা প্লেটোতেই খুঁজে পাই : এই মৌলিক ভেদ—অনিবার্যভাবেই—দুই ভূখণ্ডের শিল্পদর্শনেও প্রতীয়মান। ভেবে দ্যাখো ভারতবর্ষীয় মায়াবাদ, আর প্লেটোর গুহাবন্দীর রূপক,—দুটোতেই ‘সংসার’কে অসত্য বলা হচ্ছে, কিন্তু কতই না ভিন্নভাবে ও ভিন্ন দিক থেকে। প্লেটোর গুহাবন্দীরা যা দেখছে তা ছায়ামাত্র, কিন্তু সেই ছায়া সত্যেরও নয়, সত্যানুকারী পুত্তলির–অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবের। বেরিয়ে এসে তারা প্রথমে দেখছে শুধু পুত্তলিগুলিকে, পুত্তলির ‘আদর্শ’কে নয়, নয় সেই সূর্যরূপী সত্যকে যা একবার দৃষ্ট হলে তারা আর অলীকের মোহে ধরা দিতে চাইবে না। এখানে এই ‘পুত্তলি’ কথাটা (কাষ্ঠ ও প্রস্তরনির্মিত পুত্তলি) তোমার কি মনে হয় না ইঙ্গিতগর্ভ? পুত্তলি, রচিত মূর্তি, আবার তারই প্রতিফলিত ছায়া, অর্থাৎ ‘অনুকরণের অনুকরণ’—যা প্লেটোর মতে কবিদের নিত্যকর্ম ও আদি অপরাধ—তুমি কি অনুভব করো না এখানেও আছে প্রচ্ছন্ন তিরস্কার, শিল্পী ও শিল্পরসিকদের উদ্দেশে? প্রায় একই ভাষায় সম্ভ অগস্টিনের আর্তনাদ ধ্বনিত হয় : ‘হা ঈশ্বর, আমি ভজনা করেছি গণিত দর্শন কাব্যকলা, যাঁর বিভায় তারা উদ্ভাসিত সেই তোমার দিকে মুখ ফেরাইনি!’ পক্ষান্তরে, ভারতবর্ষীয় মায়াবাদে কোনো স্তরভেদ নেই; তা এক ঝাপটে নিখিলপ্রপঞ্চকে অন্তর্হিত করে দেয় : আর সেই দেশকালব্যাপ্ত মায়ার মধ্যে—কী এসে যায়, যদি বিরাজ করে অন্যান্য ক্ষুদ্রতর মায়া, যেমন কবিতা ও কল্পনাকাহিনী? কবিতার স্বাদ ঈশ্বরদর্শনের তুল্য—সন্ত অগস্টিনের কানে এ যেমন শোনাতো পাপবাক্য, অতি গর্হিত দেবনিন্দা, তেমনি ‘অনুকরণের অনুকরণ’ বা ‘কবিরা মিথ্যাবাদী’, এ-সব কথাও কোনো বৈদান্তিকের মনে হতো বাতুলতামাত্র। জগৎ, এবং মানবচিত্তে জগতের প্রতিফলন—দুটোই যখন সমভাবে মিথ্যা বা মায়া, আর সত্যব্রহ্ম যখন নির্গুণ, তখন কে-ই বা কার অনুকরণ করছে, আর কবিতাকে বিশেষভাবে মিথ্যা বলারই বা সার্থকতা কী? এমন নয় যে আলংকারিকেরা অনুকৃতির উল্লেখ করেননি, কিন্তু তাঁদের কাছে তা ছিলো একটি পদ্ধতিমাত্র, যার ফলাফল বা ভালোমন্দ শুধু শিল্পের আদর্শেই বিচার্য। ‘কবিতাসঞ্জাত আবেগ আমাদের চিত্তবিক্ষেপ ঘটায়—‘ প্লেটোর এই আপত্তিও তাঁদের বোধগম্য হতো না, কেননা তাঁদের দর্শন অনুসারে কাব্যের উৎস বা ফলশ্রুতি, কোনো আবেগ নয়, কোনো লৌকিক ‘ভাব’ নয়, সেই ভাবের দ্রাবণ থেকে উৎপন্ন একটি অনুভুতি–হয়তো অনুভূতি বললেও ভুল হয়, বলা যাক মালার্মের ভাষায় আত্মার একটি অবস্থা, আলংকারিকেরা যার নাম দিয়েছিলেন ‘রস’। যে-তর্কটি তাঁরা তোলেননি, দেখা যাচ্ছে তাঁদের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে তার ভূমি প্রস্তুত ছিলো না। 

মাঝে-মাঝে, কোনো ক্লান্তির মূহূর্তে আমি এ-কথা ভেবে সান্ত্বনা পেতে চাই যে হিন্দু ঐতিহ্যে কোনো শিল্পদহনকারী সাভোনারোলার জন্ম হয়নি, কোনো ধর্মগুরু ধিক্কার দেননি মন্দিরলগ্ন মিথুনমূর্তিকে। কিন্তু তখনই মনে হয় : হয়তো এই দ্বন্দ্ববোধের অভাবেই আমাদের রামায়ণ-মহাভারত পরবর্তী সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্য নাটকীয় সংঘাতে এত দুর্বল, চরিত্রচিত্রণে এমন ক্লান্তিকরভাবে দ্বিরায়তনিক, বিষয়বস্তুতে এত বৈচিত্র্যহীন, আর রচনাশৈলী এত বেশি অলংকৃত, প্রথাবলম্বী, ধর্মাশ্রয়ী বা ধর্মাচ্ছাদিত। আর সেটাই মনে হয় কারণ, যেজন্য আমাদের অলংকারবিদ্যাও এগারো শতকের পরে আর পরিণতি পেলো না, আধুনিক অর্থে সমালোচনার উদ্ভবের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হলো দীর্ঘকাল-একেবারে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত, যখন য়োরোপীয় চিন্তায় প্রহত হয়ে আমরা অনেক পুরোনো মীমাংসার নতুন করে বিচার করছি, এবং অনেক নতুন জিজ্ঞাসাও এড়াতে পারছি না। পূর্বযুগে ভারতীয় মনের প্রশ্ন ছিলো : কবিতা কী? কেমন করে শব্দসমাবেশ কাব্য হয়ে ওঠে? কী সেই বিশেষ অভিজ্ঞতা, যা আমরা আহরণ করি তা থেকে? কিন্তু এবারে অনিবার্যভাবে যুক্ত হলো সেই সব কণ্টকময় প্রশ্ন, যা দিয়ে আমি এতক্ষণ ধরে বিদ্ধ করছি তোমাকে—আর নিজেকেও : কবিতা কি সমাজের পক্ষে হিতকারী? মানুষের পক্ষে মঙ্গলপ্রদ? যাঁরা শিল্পকলার চর্চায় জীবন কাটান, তাঁরা কি নন কোনো মহত্তর কর্তব্য থেকে পলাতক? আর এগুলো নিয়ে আমরা যাঁকে দেখছি সবচেয়ে বেশি ভাবিত—পীড়িত বললেও অত্যুক্তি হয় না—আমাদের সৌভাগ্যক্রমে তিনি রবীন্দ্রনাথ—শতকরা-একশো পরিমাণে কবি, তবু কারো চোখেই সন্দেহভাজন যিনি হতে পারেন না, কেননা এই গুরুভারাক্রান্ত ভারতবর্ষে অন্যতম গুরুদেবও তিনি, এবং একজন ধর্মোপদেষ্টারূপে স্বীকৃত। তাঁর কোনো উক্তি কি নেই যাতে এই তর্কের সমাধান হতে পারে? 

এসো, কিছুক্ষণ ভ্রমণ করি তাঁর সঙ্গে, স্মরণ করি তাঁর প্রতিরোধ-কৌশল, আত্মরক্ষার উপায়সমূহ। যৌবনে তাঁকে দেখছি এক তন্ময় সৌন্দর্যপ্রেমিক, সুনীতি ও সৌন্দর্যের এক সরল সমীকরণে অঙ্গীভূত। ‘সৌন্দর্য আমাদের উপকার করে বলে সুন্দর নয়, সুন্দর বলেই উপকারী।’ কবির কাজ সৌন্দর্যের উদ্রেক, সৌন্দর্য আমাদের হৃদয়ে প্রেম জাগ্রত করে, প্রেম আনে আনন্দ, আনন্দে আমরা বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হই—এমনি করে তিনি কবিতার নীতিগত মূল্য প্রমাণ করেছেন, যদি একে প্রমাণ বলা যায়। আবার কখনো-কখনো সমাজহিতৈষীদের তাড়নায় উত্ত্যক্ত হয়ে, বা তাঁদের প্রতি অভিমানবশত, তিনি কবিতাকে বলছেন ‘বাজে কথা’, ‘অনাবশ্যক’, ‘অহেতুক বাহুল্য’ (প্রায় যেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে গলা মিলিয়ে); যারা কবিতার দ্বারা উপকৃত ও উপদেশপ্রাপ্ত হতে চায়, সেই সব নীতিনিষ্ঠ বস্তুবাদীর উপর, ‘পাকাবুদ্ধি হিসেবি কেজো লোকের উপর তাঁর বিদ্রূপ যেমন অবিরল বর্ষিত হচ্ছে, তেমনি, ‘জগতের যত অকর্মণ্য, ভাবের ভাবুক, রসের রসিক খ্যাপার দল’কে তিনি সসম্মান আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন—অর্থাৎ সংসারী মানুষ ও শিল্পরসিকদের মধ্যে টেনে নিচ্ছেন অতি স্পষ্ট একটি বিচ্ছেদরেখা। কখনো এমনকি—যেমন আমাদের ছেলেবেলার পাগল করা “পাগল” প্রবন্ধে—তিনি প্রণত হয়েছিলেন কবিতার সেই রুদ্র রূপেরও সামনে যা সামাজিক ন্যায়-অন্যায়-অতিক্রান্ত ও লৌকিক নীতিবোধের অতীত— নীটশে যার নাম দিয়েছিলেন দিওনিসীয়। কিন্তু উত্তরতিরিশে, যখন তিনি আরো বেশি খ্যাতিমান ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন, তখন কিন্তু গোতিয়ে-র বিশুদ্ধ সৌন্দর্যচর্চায় সম্মত হতে পারছেন না তিনি; লোকেন পালিতের সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে বার-বার তাঁর আদিভূমি থেকে সরে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র সৌন্দর্যের সূত্র যথেষ্ট নয় অথচ কখনো ত্যাজ্যও নয়, এই ধরনের একটা অনুভূতি থেকে যোগ করলেন সৌন্দর্যের সঙ্গে সংযম : সৌন্দর্য ভালো, কেননা তা ‘সংযমের দিকে আকর্ষণ করে’ আমাদের; সৌন্দর্য ভালো, কেননা তা ‘সত্যকে জানার উপায়’; গোতিয়ের সৃষ্ট সৌন্দর্য ভালো নয়, কেননা তা ‘মরীচিকা— ব্যাপক নয়, স্থায়ী নয়, সেইজন্যেই সত্য নয়’, অথবা ‘সত্য নয় তা নয়, অল্প সত্য’–আর অবশেষে, লোকেন পালিতের অসিচালনা ঠেকাতে গিয়ে (আমাদের পক্ষে দুঃখের বিষয় যা অদৃশ্য)—রবীন্দ্রনাথকে এমন কথাও কবুল করতে হলো যে সৌন্দর্য—যাকে তিনি প্রথম যৌবনে বলেছিলেন ‘স্বর্গমর্ত্যের বিবাহবন্ধন’—তার প্রকাশ সাহিত্যের উদ্দেশ্য নয়, উপলক্ষ মাত্র; ‘জ্ঞান কবিতার বিষয় নয়’, নিজের এই প্রাক্তন উক্তির প্রতিবাদ করে তাঁকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে হলো যে কলালক্ষ্মীরাও সত্যের অভিসারিকা। ‘সত্য’— যার উল্লেখ আমরা অলংকারশাস্ত্রে তেমন একটা পাই না, রবীন্দ্রনাথেরও পূর্ব পর্যায়ে যা লক্ষণীয় নয়—সেই ‘সত্য’ কথাটাকে, মধ্যবয়স থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত, আমরা দেখছি তিনি আঁকড়ে ধরে আছেন, এতটাই নিষ্ঠার সঙ্গে যে ‘আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে’ ইত্যাদি ঔপনিষদিক শ্লোকের মতোই অনবরত, আর অনেক সময় একই সঙ্গে, তিনি আবৃত্তি করছেন কীটসের সেই ছাত্র-শিক্ষকের শিরঃপীড়াজাতক পঙক্তিটি—‘Beauty is truth, truth beauty’। এ-রকম সময়ে রবীন্দ্রনাথের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ঈষৎ যেন অস্বস্তি বোধ করি আমরা—আমাদের মনে পড়ে যায় সেই সাত-বাসি ক্লিশে—‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ যা এককালে অনেক বাঙালি সমালোচক খঞ্জের যষ্টিরূপে ব্যবহার করতেন, অথবা যেন এক চিচিংফাক মন্ত্র হিশেবে, যা আওড়ানোমাত্র জ্ঞানগুহার দ্বার খুলে যাবে। তুমি কি বলতে পারো ধুয়োটা কোত্থেকে উঠেছিলো? কোনো উপনিষদে অন্তত কোনো প্রাচীন ও প্রধান উপনিষদ—এই তিনটি শব্দের সমন্বয় আমি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না; তুমি কি অন্য কোনো উৎস ভাবতে পারো? না এটা ব্রাহ্মসমাজের রচনা, য়োরোপীয় নন্দনবিদ্যা থেকে আহৃত, ‘le bon, le vrai, le beau’, ‘the good, the true, the beautiful’ -এর সংস্কৃত অনুবাদ, যাকে আমাদের ছেলেবেলার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা, মাসে-মাসে তার নামাঙ্কপৃষ্ঠায় মুদ্রিত করে, বিপুলভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছিলো? শেষেরটাই সত্য বলে মনে হয়, কেননা উপনিষৎ-ভক্ত রবীন্দ্রনাথ এই বচন কখনো ব্যবহার করেননি, যদিও এই শব্দযোজনা তাঁরই বক্তব্যের অন্তঃসার। ‘যা সত্য, তা-ই সুন্দর, এবং তা-ই মঙ্গলময়’— এই ধারণাটিরও, আমি যতদূর বুঝি (আমার ভুল হলে তুমি শুধরে দিয়ো), কোনো ঔপনিষদিক উৎস নেই; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই সমাধানেই পৌঁছতে চেয়েছেন বার-বার, আর আমাদের দেশে এর এখনো যেটুকু প্রতিপত্তি আছে, তা রবীন্দ্রনাথেরই জন্য। কিন্তু— কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি? কেমন করে এই তিনটি বিভিন্ন ধারণাকে কবিতার মধ্যে মিলিয়ে দিয়েছিলেন? মেলাতে পেরেছিলেন কি? যতক্ষণ বলছেন ‘সৌন্দর্য’ বা ‘আনন্দ’, ততক্ষণ তিনি—অন্তত তাঁর নিজের দিক থেকে এবং অনেক দূর পর্যন্ত—শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু কবিতার লেখক ও পাঠকেরা আনন্দিত হলে সমাজের কোন কল্যাণ হবে তা কোনো টলস্টয়পন্থীকে বোঝানো যাবে না, আর যে-অর্থে সত্য ও সৌন্দর্যের সমীকরণ সম্ভব, তা শুধু শিল্পরসিকদের পক্ষেই গ্রাহ্য, কোনো একমুখী ঈশ্বরভক্ত বা নীতিবিজ্ঞানীর নয়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের সত্য স্থির নয়, চঞ্চল, প্রসঙ্গভেদে বহুবিধ ব্যঞ্জনা তা ধারণ করে। অনেক সময় মনে হয়, কথাটা তিনি সেই অর্থে ব্যবহার করছেন যাকে আলংকারিকেরা– আমার ক্ষুদ্র মতে আরো যথাযথভাবে—বলতেন ‘ঔচিত্য’; কখনো– যেমন ‘বাস্তব ঘোড়া তথ্য, অঙ্কিত ঘোড়া সত্য’, এই ধরনের মন্তব্যে সত্যকে যেন ‘রসে’রই সমার্থক করে দিচ্ছেন; আবার যখন বলেন, ‘সত্যকে জানার উপায় হচ্ছে সৌন্দর্য’, তখন মনে হয় সত্য এখানে ‘ট্রুথ’ নয়, ঔপনিষদিক সৎ বা অস্তিতা, যা-কিছু আছে তা-ই। এবং এও লক্ষ করি যে সত্যান্বেষী রবীন্দ্রনাথ তাঁর আনন্দবাদ পরিহার করেননি—সেই ‘আনন্দরূপমমৃতম্’-এর অনুভূতি, যা তাঁর কৈশোরক রচনাতেও আমরা পেয়েছি—যদিও সংস্কৃতবর্জিত ও চেষ্টাহীনভাবে উচ্চারিত—তা এখনো তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু যেহেতু এখন তিনি প্রৌঢ়, এবং ইতিমধ্যে নিজেও বহু সমাজচিন্তা করেছেন, তাই কীটসের মতো, বা যুবাবয়সী তাঁর নিজের মতো, তিনি আর সরল প্রত্যয়ে বলে উঠতে পারছেন না, ‘কল্পনা (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হৃদয়-মন) যা সুন্দর বলে গ্রহণ করে তা-ই সত্য’; সেই সঙ্গে অনেক শর্ত তাঁকে জুড়ে দিতে হচ্ছে। ‘কবির কাছে ( বা কাব্যরসিকের কাছে) ইমোজেন যত আনন্দদায়ক, ইয়াগো ঠিক ততটাই—’ এটা রবীন্দ্রনাথের কথাও হতে পারতো— হয়েও ওঠে অনেকবার, যখন সাহিত্যের ইয়াগো শকুনি কৈকেয়ীদের তিনি বলেন প্রত্যক্ষ ও প্রকাশিত, আর প্রকাশকেই ‘ঐশ্বর্য’ বলে ঘোষণা করেন। যখন বলেন, নিশ্চিত দেখতে পাওয়াটাই আনন্দের (দ্রষ্টব্য বিষয় যা-ই হোক না), আর মন যাতে আনন্দিত হয় তা-ই সুন্দর। কিন্তু এর উল্টো কথাও তাঁর মুখে আমরা শুনি না তা নয়; যেন নিজেরই ইচ্ছার বিরুদ্ধে— আরো একবার লোকেন পালিতের প্রত্যুত্তরে—তিনি মেনে নিচ্ছেন যে ‘হ্যামলেটের ছবি সৌন্দর্যের ছবি নয়, মনোহর ছবি; ওথেলো সুন্দর নয়, মানবস্বভাবগত।’ কথাটার অর্থ এই দাঁড়ায় যে সৌন্দর্য স্বপ্রতিষ্ঠ নয়, বিষয়নির্ভর, আর এই কথাটাই, আমরা সখেদে লক্ষ করি, বার্ধক্যে এসে রবীন্দ্রনাথ যেন আরো স্পষ্টভাবে বলতে চেয়েছেন; তাঁর ‘আজন্মসাধনধন’ সৌন্দর্যের সার্বভৌমতা আর মানতে পারছেন না তিনি, অথবা তত্ত্ব হিশেবে মেনে নিয়েও তার প্রয়োগক্ষেত্র সীমিত করে দিচ্ছেন। নয়তো কেমন করে এলিয়টের কবিতাকে তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘বিশ্বের প্রতি কুৎসাজনিত চিত্তবিকার’? মুখে এখনো বলছেন, আর্টের ক্ষেত্রে কাউকেই বাদ দেয়া যায় না, কিন্তু উদাহরণ খুঁজতে গিয়ে বেছে নিচ্ছেন শুধু কবিপ্রসিদ্ধি (গোলাপ ফুল, মেয়ের মুখের সুন্দর হাসি, ইত্যাদি), আর কাব্যের জগৎ থেকে নির্বাসন দিচ্ছেন সজনেফুল বকফুল কুমড়োফুলকে, যেহেতু ‘রান্নাঘর ওদের জাত মেরেছে’! এমনি কতবার —কতবার। একদিকে তিনি প্রেমিক, অন্যদিকে শুচিতাবোধে সংকুচিত; একদিকে তিনি ব্যক্তিত্বনির্ভর শিল্পী (মনে করে দ্যাখো, নিজেকে তিনি ‘ব্রাত্য’ বলেছিলেন), অন্যদিকে তাঁর মূল্যবোধ শিল্পগত নয়, সামাজিক (নয়তো কুমড়োফুল কেন বর্জনীয় হলো?)—এমনি আমরা দেখছি তাঁকে তাঁর উত্তরজীবনে। তাঁর কথায় আমরা কখনো পাই উৎসাহ, কখনো আমাদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তাঁর সামগ্রিক শিল্পালোচনার দিকে বিহঙ্গদৃষ্টিতে তাকালেও মনে হয় না যে ভুল করবো, যদি সাহস করে বলি তিনি শেষ পর্যন্ত নিজেরই মধ্যে বিভক্ত ছিলেন : যা বাস্তব জীবনে তুচ্ছ তাকে শিল্পকলা মহিমা দিতে পারে কিনা; যা বাস্তব জীবনে কুৎসিত, নৈতিক অর্থে ভালো নয়, তা কবিতায় ভালো ও সুন্দর হতে পারে কিনা—এই স্ফিঙ্কসের ধাঁধার উত্তর দিতে গিয়ে মনস্থির করতে পারেননি। আমাদের মামলায় তাঁকে সাক্ষী মানলে তিনি আমাদের সপক্ষে হয়তো পঞ্চাশ কথা বলবেন, কিন্তু প্রতিপক্ষ—নিশ্চিত জানি—তাঁর মুখ থেকে অন্তত একান্নটি বিরুদ্ধ কথা বের করতে পারবে—সম্ভবত আরো অনেক বেশি। এখন বলো, যদি রবীন্দ্রনাথ —যিনি দীর্ঘ জীবন ভরে অবিরল ও অজস্রভাবে সৌন্দর্যসৃষ্টি করেছেন— তিনিও যদি সৌন্দর্যের সঙ্গে সুনীতির সম্বন্ধ স্থাপন করতে গিয়ে বৃদ্ধ বয়সে স্ববিরোধে আক্রান্ত হন, তাহলে আমাদের আশা করবার আর কী রইলো? 

কিন্তু কেনই বা আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে আশা করবো সম্পূর্ণরূপে সুসংগত একটি কাব্যদর্শন, বা কোনো নৈয়ায়িক পদ্ধতি? তিনি তো দার্শনিক নন, কবি—কবিতার বিশ্লেষক নন, আস্বাদনকারী; তাঁর বহুমুখী চিত্তের ভাবপরম্পরা প্রকাশ করাই তাঁর যথাযোগ্য কাজ, এবং তা-ই তিনি করেছেন। আর তাছাড়া, যদি স্ববিরোধের কথা তুলতেই হয় সেটা কি শুধু রবীন্দ্রনাথের লক্ষণ? যাঁরা তত্ত্বজ্ঞানী, ধরো আমাদের মামলার প্রধান অভিযোক্তারূপে এখানে যাঁরা উপস্থিত, তাঁদেরও বিভিন্ন উক্তির মধ্যে, বা উপদেশ ও আচরণের মধ্যে, অটুট সামঞ্জস্য আছে কি? আমরা সকলেই জানি তা নেই : এই মামলার প্রচ্ছন্ন কৌতুকের কথা ভাবলে কখনো মনে হয় আমরা তর্কের টেবিলটাকে তাঁদের দিকেই উল্টে দিতে পারি। বলতে পারি : সন্ত অগস্টিন এজন্যে ও আমাদের নমস্য যে রেটরিক ও কবিতার বিরুদ্ধে এত বিচিত্র রেটরিক ও এমন আবেগস্পন্দিত কবিতাপ্রাণ গদ্য ভাষা তিনি ছাড়া কেউ ব্যবহার করেননি। তাঁর রচনার কাব্যগুণ কি এই কারণেই অপরাধমুক্ত (‘অপরাধ’ কথাটা তাঁরই—আমাদের নয়) যে তা ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত হয়েছে? কিন্তু আমার মতো আরো অনেক পাঠক তো থাকতে পারে—আছে বলেই ধরে নেয়া যায় যারা সন্ত অগস্টিনের গদ্যের কল্লোলে আবিষ্ট হয়ে ঈশ্বর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। তিনি ভুলতে পারেননি সেই ‘দুষ্ট’ বিদ্যাকে, একদা যা অর্জন করেছিলেন বলে তিনি অফুরন্তভাবে অনুতাপকাতর—ভুলতে ইচ্ছে করেননি—প্রভুপাদে প্রার্থনা নিবেদনের জন্যও সেই বিদ্যার সাহায্য তাঁকে নিতে হয়েছে। তুলনায় টলস্টয়কে মনে হয় শিল্পহীনভাবেই শিল্পহননে প্রবৃত্ত, তাঁর সমালোচনার এক-একটি বাক্য যেন লৌহগদাঘাত; কিন্তু তিনি যদি শুধু শিল্পকলার বিরুদ্ধে, ও তামাক সুরা আমিষভোজনের বিরুদ্ধে প্রচারপুস্তিকা লিখে যেতেন, তাহলে আজকের দিনে তাঁর স্থান হতো সমাজহিতৈষী চের্নিশেভস্কি পিসারেভদের সঙ্গে, ঐতিহাসিক ও গবেষক ছাড়া আর কেউ যাঁদের খোঁজ রাখে না। তাঁর নিজেরই মুখে নিন্দিত কিছু রচনার জন্যই টলস্টয় আজ বিশ্বমানসে প্রতিষ্ঠিত। না-হয় ছেড়ে দিলাম তাঁর পূর্বজীবনের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’, ‘আনা কারেনিনা’কে, না হয় ধরে নিলাম তখনও তিনি ‘ধর্মান্তরিত’ হননি; কিন্তু তাঁর উত্তরজীবনেও, ‘ঋষি’ টলস্টয়ের সব তীব্র তিরস্কার ছাপিয়ে শিল্পী টলস্টয় মাঝে-মাঝে আত্মঘোষণা করেছেন। এ-রকম সময় তাঁকে মনে হয় মোপাসাঁর সেই তীরন্দাজের মতো যে তার নিজের দক্ষতার দ্বারা পরাস্ত হয়ে তার অসতী স্ত্রীকে একবারও বাণবিদ্ধ করতে পারলো না। মনে করো টলস্টয়ের ধর্মভাবাপন্ন গল্পগুলি— খাঁটি রূপকথার তুলনায় তা কত বিদগ্ধ, কত আয়োজিত, কত শিল্পচেতন। রূপকথার পুরো জগৎটাই অলৌকিক, সেখানে অসংলগ্নতা স্বচ্ছন্দে স্থান পায়, পশু ও জড় বস্তুও মানুষের ভাষায় কথা বলে, বাস্তবে ও অবাস্তবে কোনো ভেদ স্বীকৃত হয় না। কিন্তু টলস্টয়ের “তিন সন্ন্যাসী”—একটি উদাহরণই যথেষ্ট হবে—এই রোমাঞ্চকর গল্পটির আবহমণ্ডল সম্পূর্ণ বাস্তব, আর তারই মধ্যে অকস্মাৎ ঘটে অলৌকিকের অবতারণা; — তবু যে সেটা আমাদের মনে হয় বিশ্বাস্য ও ‘যুক্তিসংগত’, জলপথে পদাতিক ভ্রমণ অসম্ভব বলে আমরা যে কখনো আপত্তি তুলি না তার কারণ শিল্পের (টলস্টয়ের ভাষায় ‘কুশিল্পে’র) সম্মোহন ছাড়া আর কী হতে পারে। আর নীতি উপদেশ? গল্পটির উপদেশ যদি এই হয় যে শুধু নিরক্ষর ও বুদ্ধিবর্জিতেরাই ঐশ্বরিক বিভূতিলাভের যোগ্য, তাহলে তা স্পষ্টত ব্যর্থ হয়েছে; কেননা ঐ সন্ন্যাসীরাই শুধু নিরক্ষর, টলস্টয় নিজে নন, তাঁর পাঠকেরাও নয়; সন্ন্যাসীদের মহত্ত্ব দেখে আমরা লেখক-টলস্টয়ের ভক্ত হয়ে উঠি—নিরক্ষরতার নয়। তেমনি রুসো—তিনি তাঁর জীবন ও কর্মধারার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে শিক্ষার নিন্দাবাদের জন্যও শিক্ষালাভের প্রয়োজন হয়, সভ্যতার সাহায্য বিনা সভ্যতার শত্রুতাও করা যায় না। এক আশ্চর্য মানুষ, রুসো, বহু পরস্পরবিরোধী ভাবনার এক সমবায় : শিল্পকলা ও বিজ্ঞানচর্চার ফলে মানুষের নৈতিক অবনতি ঘটেছে, এই তত্ত্বের প্রচারক হয়েও জ্ঞানার্জনে অক্লান্ত, পুস্তকরচনায় বিরতিহীন, রচনাশৈলীর সৌষ্ঠবসাধনে যত্নবান— অর্থাৎ, তাঁরই কথিত ‘অধঃপতনে’র সাহায্যকারী। তাঁর দেহজাত সন্তানেরা— যাদের তিনি বাহুল্যবর্জিত ‘সুস্থ ও পরিশ্রমী’ জীবনযাপনের সুযোগ দিয়েছিলেন তারা তাদের অজ্ঞাত পিতার লেখা একটি অক্ষরও পড়েনি হয়তো; কিন্তু তাঁর মনোবীজ থেকে সঞ্জাত হলেন এক আন্তর্জাতিক কবিগোষ্ঠী— দুঃখের বিষয় হলধারী নয়, কলম-নিষ্পেষক মাত্র ‘বাহুল্যে’র স্রষ্টা ও জোগানদার। আমরা সাধারণত বলে থাকি রুসো এক নতুন জগতের জন্মদাতা, কিন্তু সেই জগৎ কি সত্যি তাঁর আদর্শানুগত? তা নয়;– কেননা মানুষ তাঁর কাছে শিখলো— সরলতা নয়, শুধু সরলতার প্রতি অনুরাগ; সভ্যতাকে বর্জন করতে নয়— সভ্যতার সংলগ্ন অবস্থায় প্রকৃতির জন্য পিপাসিত হতে; শিখলো এক নতুন ধরনের ভাবুকতা ও সুখজনক বিষাদবোধ— উনিশ-শতকী কাব্যধারায় যা বিস্তীর্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সন্দেহ নেই, কবিদের সঙ্গেই রুসোর সম্পর্ক সবচেয়ে নিকট, তাঁর ‘নতুন জগৎ’ বিশেষভাবে কবিদেরই বিচরণভূমি; অথচ নীতির দিক থেকে তিনি শিল্পকলার বিরোধী। — কৌতুক নয়? 

একজনের নাম এখনো করিনি। সেই বৃদ্ধ পদাতিক আলাপচারী, জ্ঞানের সন্ধানী ও দাতা, প্লেটোর গুরু ও মুখপাত্র : সক্রেটিস। আমরা জানি যে প্লেটোর রচনার কোনো-কোনো অংশ সক্রেটিসেরই মুখের কথা; তাঁর জীবনের শেষ দিনের বিবরণটি ঐতিহাসিক বলে স্বীকৃত। আর সেই ‘ফীডো’ গ্রন্থেই—কিছুটা চমকপ্রদভাবে- সক্রেটিসের মুখে কবিতার কথা শুনতে পাই আমরা; প্লেটোর কাব্যদর্শনের সঙ্গে তাঁর একটি সম্বন্ধও টানতে পারি। ‘আপনি জীবনে কখনো এক চরণ কবিতা লেখেননি, কিন্তু এখন নাকি কারাগারে বসে ঈশপের কথিকাগুচ্ছকে কাব্যরূপ দিচ্ছেন, স্তোত্র রচনা করছেন আপোলোর উদ্দেশে? এই জনরব কি সত্য?’ তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে সক্রেটিসের উত্তর—তাঁর অদ্ভুত স্বীকারোক্তি— যেন তাঁর সত্তার কোনো গোপন স্থান থেকে উৎসারিত? ‘আমার জীবন ভরে এক স্বপ্ন আমাকে মন্ত্রণা দিয়েছে— বার-বার ভিন্ন-ভিন্নরূপে দেখা দিয়ে একই কথা শুনিয়ে গেছে আমাকে : “সক্রেটিস, গান রচনা করো, সংগীতচর্চায় নিবিষ্ট হও।” আমি ধরে নিয়েছিলাম এই স্বপ্ন আমাকে আমার দর্শনচর্চাতেই আরো উৎসাহিত করে তুলতে চায়, কেননা জ্ঞানের চেয়ে মহৎ সংগীত আর-কিছু নেই। কিন্তু এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি কখনো। এমন যদি হয় আমার স্বপ্ন আমাকে সাধারণ অর্থে গানের কথাই বলেছিলো? তাই আমি মনে-মনে কুণ্ঠিত ছিলাম, আর-সেই কুণ্ঠা কাটাবার জন্যই, ইহলোক ছেড়ে চলে যাবার আগে, দু-একটি কবিতারচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি।’ পড়ামাত্র কত প্রশ্নই না মনে জাগে আমাদের! সক্রেটিসের বক্তব্য কি এই যে কবিতার স্পর্শব্যতিরেকে জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না? না কি তিনি বলতে চান ঐ দুয়ের সংযোগসাধনেই উভয়ের শেষ সার্থকতা? না কি বলছেন কবিতা মোহিনী হলেও প্রজ্ঞাই মানুষের পক্ষে সাধনার যোগ্য? আমরা যে যার প্রবণতা অনুসারে যে-কোনো অর্থ করে নিতে পারি, কিন্তু কোথাও নিশ্চিতি পাই না, যেমন তিনিও পাননি। আরো ধাঁধা লাগে, যখন তাঁর অন্য একটি কথার সঙ্গে এই স্বীকারোক্তিকে মিলিয়ে দেখি। আগে একবার, তাঁর বিচারের সময়, যখন পর্যন্ত ফলাফল অনিশ্চিত ছিলো, তিনি বলেছিলেন যে মাঝে-মাঝে তিনিও পান দৈব নির্দেশ, কিন্তু সেগুলি শুধু নিষেধাজ্ঞা, কোনো প্ররোচনা নয়। কিন্তু এই স্বপ্নটি যা তাঁকে দেখা দিয়েছে একবার নয়, অনেকবার, একরূপে নয়, বিভিন্ন রূপে, শুধু যৌবনে নয়, সারা জীবন ভরে এতে আছে স্পষ্ট একটি প্ররোচনা : ‘গান রচনা করো।’ আর এই গোপন কথাটি তিনি প্রকাশ করলেন কোন সময়ে? যখন তাঁর বিষপানের মুহূর্ত আসন্ন, আর কয়েক ঘণ্টা পরেই জীবনের অবসান হবে। তিনি পালন করেননি তাঁর ‘স্বপ্নে’র, তাঁর অর্ধালোকিত স্বজ্ঞার নির্দেশ; বেছে নিয়েছিলেন জ্ঞানের স্বচ্ছতা, সত্যের নিষ্কম্প্র দীপালোক। অথচ তিনি ‘কুণ্ঠিত’ ছিলেন সেজন্য, আর তাই, সেই কুণ্ঠামোচনের জন্য, জীবনের অন্তিম লগ্নে তাঁর স্বপ্নের আদেশ তাঁকে মেনে নিতে হলো। আমাদের বলে উঠতে ইচ্ছে করে : ‘সক্রেটিস, বৃদ্ধ তপস্বী, তুমিও তাহলে কবিতার প্রেমিক! গোপন, অবৈধ, অবহেলিত সেই প্রেম, তবু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা ভুলতে পারোনি!” 

সক্রেটিসের আর-একটি উক্তিতেও আমি যেন তাঁর ‘স্বপ্নে’র ছায়া দেখতে পাই— অস্পষ্ট, কিন্তু সেইজন্যেই আরো রহস্যময়। ‘প্রেমাস্পদ প্যান, আর এই নিকুঞ্জবাসী অন্য দেবগণ, বর দাও যেন অন্তরে আমি সুন্দর হতে পারি। যা-কিছু আমার বাহ্য সম্পত্তি তা যেন হয় আমার অন্তর্বাসীদের সুহৃদ। দাও আমাকে বিশ্বাস যে শুধু প্রাজ্ঞেরাই ধনবান। আমার সোনার ভাণ্ডার শুধু তা-ই হোক, যা সাধুজন নিজস্ব করে নিতে পারেন—অন্য কেউ নয়।’—’অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে, নির্মল করো উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে।’ রবীন্দ্রনাথের মুখেও এই প্রার্থনা শুনি আমরা, কিন্তু তাঁর নিবেদন কোনো ‘অন্তরতর’ অলক্ষ্য দেবতার কাছে, ধরা যাক ভগবানের কাছেই। আর সক্রেটিস যাঁকে নাম ধরে ডাকলেন তিনি এক মূর্ত দেবতা—আশ্চর্যের বিষয় আপোলো নন, প্যান। সুঠাম, সুন্দর, বীণাধারী সৌরদেব, একাধারে কবি, দৈবজ্ঞ, চিকিৎসক, উপকারী ও সুখদাতা— তাঁকে ভুলে সক্রেটিস কেন স্মরণ করলেন সেই কুখ্যাত অর্ধছাগ-অর্ধদেবতাকে, যাঁর বাঁশি বাজে উন্মাদক সুরে, যাঁর সঞ্চরণে বনস্থলে জাগে আতঙ্ক, যাঁর উগ্র লালসা বনদেবীদের শান্তি দেয় না? সে-মুহূর্তে এক কুঞ্জবনে বসে ছিলেন বলেই কি সক্রেটিসের এই বনচর অজদেবতাকে মনে পড়েছিলো? কিন্তু এক দুর্নীতিপরায়ণ দেবতার কাছে ধর্মবোধের জন্য প্রার্থনা—এ কি অসংগত নয়? বিশেষত সক্রেটিসের মুখে, যাঁর প্রচারিত জ্ঞান ও সদাচারসাধনার বিরুদ্ধে প্যান এক মূর্তিমান বিদ্রোহ? আমি কিন্তু এতে বিশেষ একটি ঔচিত্য দেখতে পাই, কেননা বিপরীতের আকর্ষণকে না-জানলে আত্মজ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না; আর সক্রেটিস যা বর্জন করেছিলেন, শুধু সেই গীতবিদ্যার কারণেই প্যানকে বলা যায় বন্দনাযোগ্য। মনে-মনে সেই বন্য দেবতার বংশীধ্বনি শুনতে পেয়ে, সক্রেটিস যেন ইঙ্গিতে বলে দিচ্ছেন যে সংগীতও আমাদের অন্তরাত্মাকে সুন্দর করে তুলতে পারে, আর গীতস্রষ্টা নীতিচ্যুত হলেও তাঁকে অর্ঘ্যদান আমাদের কর্তব্য। ‘প্রেমাস্পদ প্যান’— বলার সময় তাঁর চোখের তারা কি কৌতুকে ঝিলিক দেয়নি? 

প্লেটোর মুখেও কবিতার বিষয়ে কত না আমরা মনোরম কথা শুনতে পাই! কেমন কোমল হয়ে আসে তাঁর কণ্ঠস্বর, যখন বলেন— ‘আমরাও ঐ মধুরাক্ষীর প্রেমিক, কিন্তু তিনি মঙ্গলসাধিকা না-হলে আমরা তাঁকে পরিত্যাগ করবো, যদিও বিনা দুঃখে নয়। .. আসুন কেউ, প্রমাণ করুন তিনি একাধারে সুখদা ও হিতকারিণী, আমরা তাতে লাভবান হবো সন্দেহ নেই।’ কবিকে নগরদ্বার থেকে বিদায় দিতে হবে, কিন্তু প্লেটোর সেই প্রত্যাখ্যানেও ধ্বনিত হয় অভিনন্দন। ‘যদি সেই অনুকরণদক্ষ পুরুষদের মধ্যে কেউ আসেন এখানে, নিজেকে কাব্যকলায় প্রকাশ করতে চান, আমরা ভূমিতে পড়ে অৰ্চনা করবো তাঁর, তাঁকে বলবো মধুর ও পবিত্র ও আশ্চর্য এক সত্তা, মাল্যচন্দনে ভূষিত করবো তাঁকে, তারপর জানিয়ে দেবো আমাদের রাষ্ট্রে তাঁর মতো কারো স্থান হতে পারে না।’ হতে পারে না? কিন্তু এই নির্দেশ অনুসারে আথেনীয় সমাজ সত্যি কখনো গঠিত হলে, নিশ্চিত বলা যায়, প্লেটো সকলের আগে দেশান্তরী হতেন। তাঁর সঙ্গে থাকতো দু-একখানা কাব্য কোন কবির তা কে না অনুমান করতে পারবে। তাঁর আদর্শ নগরে যে-সব উপদেষ্টা-কবি স্থান পাবেন, প্লেটো তাঁদের নাম পর্যন্ত করছেন না, কিন্তু অনুকরণদক্ষ দেবনিন্দুক নিষিদ্ধ হোমারকে বলছেন ‘মহত্তম কবি’, নীতিকথার উদাহরণরূপেও তাঁরই পঙক্তি উদ্ধৃত করছেন। আমাদের এই বিরুদ্ধবাদীরা, আমি যাঁদের প্রধান ফরিয়াদি বলে উল্লেখ করেছি— এখন দেখছি তাঁরা শিল্পকলার গৌরবঘোষণাই করে গেছেন তির্যভাবে, বা বাণীসিদ্ধির দৃষ্টান্ত রেখে, অভিযোগরচনার ভাষাবিন্যাসে পর্যন্ত। তাহলে কেন বলবো না তাঁদের বৈরিতা সৌহার্দ্যেরই ছদ্মবেশ, কেন বলবো না এই মামলা ভিত্তিহীন? 

আমি মুহূর্তের জন্য উল্লসিত হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু তক্ষুনি মনে পড়লো এই যুক্তি উল্টো দিক থেকেও প্রবল হতে পারে। হোমার-ভক্ত প্লেটো যদি হোমারকে, ভার্জিল-মুগ্ধ সম্ত অগস্টিন ভার্জিলকে, আর টলস্টয় তাঁর স্বরচিত উপন্যাসগুলিকে বর্জন করে থাকেন, তাতেই কি আরো বেশি প্রমাণ হয় না যে শিল্পকলা এক স্বভাবদুষ্ট সামগ্রী? এঁরা মহাত্মা ব্যক্তি, এঁদের সাধুতা তর্কাতীত; অত ভালোবাসা নিয়েও এঁরা যাকে দণ্ড দিয়ে গেছেন, তার নিঃশর্ত মুক্তির প্রস্তাব কোনো সমাজহিতৈষী কানে তুলবেন কেন? আর তাছাড়া, আমরা নিজেরাই জানি আরো কিছু কলঙ্কের কথা, যা শত্রুপক্ষের মুখে কঠিনতর যুক্তি হয়ে উঠতে পারে। ধরো কান্টের বিখ্যাত সূত্র– ‘সৌন্দর্য দেয় বাসনাহীন আনন্দ’ যার উপর ভিত্তি করে আধুনিক নন্দনতত্ত্ব গড়ে উঠলো, দাবি করা হলো শিল্পের জন্য সুনীতি-দুর্নীতির বহির্ভূত এক রাজত্ব—আমরা তো মনে-মনে জানি এটা সাধারণভাবে সত্য হলেও এর ব্যতিক্রম ঘটতে পারে এবং ঘটেও থাকে। মাঝে-মাঝে কবিদের মুখেই এ-বিষয়ে কুটিল মন্তব্য আমরা শুনেছি। বিধবা দিদোর হৃদয়কে যখন সর্বনাশা প্রেম দখল করে নিলো, সেই মুহূর্তটি মনে করে দ্যাখো। সারা রাত ধরে ঈনিয়াসের মুখে ট্রয়-ধ্বংসের কথকতা শুনলো সে, অনুভব করলো বেদনার সৌন্দর্য–কিন্তু দিদোর তাতে ‘চিত্তশুদ্ধি’ হলো না, তার আনন্দ ‘বাসনাহীন’ রইলো না, বরং এক অর্ধোন্মাদ অবস্থায় সে ভুলে গেলো মৃত স্বামীর স্মৃতির প্রতি তার প্রতিশ্রুতি, ভুলে গেলো সেই সব জনহিতকর কর্মানুষ্ঠান, যা সে নিজেই আরম্ভ করেছিলো। এর অব্যবহিত কারণ প্রেম, কিন্তু প্রেম উদ্রিক্ত হবার কারণ মৌখিক কবিতা। এক ধাপ পেছিয়ে গিয়ে আমরা আর-একটি অপরাধীকে আবিষ্কার করি—মন্দিরগাত্রে ট্রয়যুদ্ধের চিত্রপর্যায়, যা দেখতে-দেখতে ‘বিশ্বের অশ্রু’ অনুভব করলেন ঈনিয়াস— তাঁর মন সাম্রাজ্যস্থাপয়িতার পক্ষে অনুপযোগী একটি করুণ রসে আপ্লুত হলো। আর দান্তের পাওলো-ফ্রানচেস্কা (আরো ভালো —মানে, আরো অপরাধব্যঞ্জক উদাহরণ)—এদের অবৈধ প্রণয়ে মালিনী-মাসীর ভূমিকা নিলো প্রত্যক্ষভাবে এক কাব্য-কাহিনী! ‘একদিন আমরা সুখের জন্য পড়ছিলাম লান্সলটের প্রণয়কাহিনী—’। লক্ষ করো ‘সুখের জন্য’ কথাটা —টলস্টয় কেমন ঝাঁপিয়ে পড়তেন ওটার উপর! ‘একা ছিলাম আমরা, অসন্দিগ্ধ, সেই কাব্য আমাদের চোখে চোখ মিলিয়ে দিলো, অনেকবার আমাদের মুখে আনলো ম্লানিমা, আর তারপর—’ থাক, আর প্রয়োজন নেই। এরা ‘অসন্দিগ্ধ’ ছিলো—অর্থাৎ, সেই দেবর-ভ্রাতৃবধূর মন এতদিন ছিলো নিষ্পাপ, সেই সেদিন ঐ কাব্য পড়তে-পড়তে, এবং তারই ক্রমবর্ধমান প্রভাবে, প্রায় নিজেদেরই অজান্তে তারা ভ্রষ্ট হলো। যদি না-পড়তো, যদি অন্তত কাব্যকথিত নায়ক-নায়িকার প্রথম চুম্বনের আগেই থেমে যেতো, তাহলেও রক্ষা পেতো তারা— দান্তে তা-ই বলতে চান বলে মনে হয়। ‘কাব্যের উত্তেজনায় মানুষ তার কর্তব্য ভুলে যায়—’ প্লেটোর এই কথারই চিত্রণ যেন এরা, আর সাহিত্যের নেশায় মানুষ যে তার কাণ্ডজ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলতে পারে, তারই সাক্ষী ছায়াযোদ্ধা দন কিহোতে। এদিকে আমাদেরই ঘরের কাছে এক কনিষ্ঠ কেরানি, সিন্ধু-বারোয়াঁর বাঁশির তানে মজে ভুলে গেলো তার দারিদ্র্য-গ্লানি, এমনকি এই অসম্ভব কথাটাও ভেবে ফেললো যে তার সঙ্গে আকবর বাদশার কোনো ভেদ নেই! অন্যায় নিশ্চয়ই হরিপদ কেরানির এই আত্মপ্রতারণাকে সমাজহিতৈষীরা অন্যায় ছাড়া আর-কিছু বলবেন না, এবং সেই একই নিরিখে গান জিনিশটাও অসাধু, কেননা তা অবিচার দূরীকরণে উদ্বুদ্ধ করলো না হরিপদকে (বা আমাদের কাউকে), বরং সেটাকে এক ছলনার তলায় লুকিয়ে রাখলো। পিগমেলিয়নের কাহিনী মনে রাখলে আমরা কি বাধ্য হবো না নন্দনতত্ত্বের ‘অনাসক্তি’ বিষয়ে সন্দিহান হতে? এগুলো সব বানানো গল্প তা ঠিক, কিন্তু অভিজ্ঞতাগুলি এই অর্থে সত্য যে মানুষের মনে বীজরূপে তা বিরাজমান। আর যদি কল্পনা ছেড়ে ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করি আমরা— সেখানেও নিস্তার পাবো না। যে-সব তীর্থযাত্রী ক্লিন্স দ্বীপের ভিনাস-মূর্তিকে আলিঙ্গনের অর্ঘ্য দিয়েছে, মোনালিসার ছবির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে যারা, যে-সব তরুণ-তরুণী দুঃখী হোর্টের-এর অনুকরণে আত্মহত্যা করেছিলো— ঐ দ্যাখো তারা এগিয়ে আসছে আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে— ম্লান, কিন্তু মূক মুখে নয়। এর পরে কেমন করে বলা যায় যে শিল্পকলা কখনো কুফলপ্রসূ হতে পারে না? অতএব—অতএব নিযুক্ত হোন তত্ত্বাবধায়কের দল, তাঁরা চেষ্টা করুন শিল্পকলাকে আটকাতে চটকাতে মচকাতে দুমড়োতে মুচড়োতে; আর ততক্ষণ আমরা চলো বেরিয়ে পড়ি আদালত থেকে, খোলা হাওয়ায় বসি কোথাও বালিগঞ্জে লেকের ধারে বেঞ্চিতে, বা যদি বলো পিয়াসা নাভোনার কোনো কাফে-র বারান্দায়—কেননা আমরা জামিনে খালাশ আছি অন্তত, শুধু জামিনে মুক্ত, কিন্তু চিরকাল অভিযুক্ত, চিরকাল আক্রান্ত ও অতি সহজে আক্ৰমণীয়—নতুন কিছু নয়, আমরা অনেক আগেই বুঝে নিয়েছি যে এ-ই আমাদের বিধিলিপি। আমরা সব তাস টেবিলের উপর ফেলেছি, আমাদের অপরাধ গলা পর্যন্ত প্রমাণ হয়ে গেছে। এখন এসো ভেবে দেখি একবার— এই সব সাক্ষী জেরা জবানবন্দি কাটাকাটি করে আখেরে আমাদের হাতে কিছু থাকছে কিনা। কোথায় শুরু করি বলো তো? সেখানেই, এই চিঠি যেখানে আরম্ভ করেছিলাম, আর এটা লেখার ফাঁকে-ফাঁকেও যা অনেকবার হানা দিয়েছে আমাকে : আজকের দিনের বাংলা দেশ, তোমার আমার এই কলকাতা শহর। গোঙাচ্ছে, কারাচ্ছে, পড়ে আছে রক্তাক্ত দেহে ছিন্নভিন্ন, অথচ যেন হাসপাতালে নিয়ে যাবারও কেউ নেই, বা হাসপাতালগুলোই উন্মাদভবনে পরিণত হয়েছে। ভেবো না আমি বড্ড বেশি বাড়িয়ে দেখছি ব্যাপারটাকে;–আমি ভুলিনি পৃথিবীতে এতবার এত মহাযুদ্ধ ঘটে গেছে—এত মারী, এত বিস্তীর্ণ হননযজ্ঞ ও ধ্বংসোন্মাদনা যে সে-তুলনায় এটা মানবেতিহাসে একটি ক্ষুদ্র ফুটনোট মাত্র জোগাতে পারে। তবু : এটাই আমার নিকটতম পরিবেশ, এখানেই আমার জীবিকা ও দৈনিক জীবনের সংস্থান; আমি ইচ্ছে করলেও ভুলে থাকতে পারি না; আমি না-চাইলেও আমাকে দেখতে হয় খবর-কাগজে বিষাক্ত হেডলাইন, আর মানুষের মুখে আক্রোশ আর সন্ত্রাস আর হতাশা। দিনের পর দিন দেখছি এ-সব, আর মনে-মনে ভাবছি : এর মধ্যে কোনো সৌন্দর্যমুগ্ধ হৃদয়ের মর্মরধ্বনির স্থান কোথায়? 

বলো তুমি : কী উত্তর দেবে? 

হয়তো শুধু অন্য এক প্রশ্ন তুলবে : ‘স্থান কো থা য়’ নয়, ‘স্থান কে ম ন ক রে হতে পারলো?’ ছবি, কবিতা, সংগীত, নৃত্য–এরা মানুষের মধ্যে আদৌ উদ্ভূত হতে পারলো কেমন করে? কোথায় আরম্ভ কেউ জানে না, কিন্তু যতদূর পর্যন্ত আমাদের চোখ চলে, কোথাও দেখতে পাই না সম্পূর্ণ শিল্পরহিত কোনো অবস্থা— পনেরো হাজার বছর আগেকার মানুষও আল্টামিরার গুহাচিত্রে তার শিল্পিতার স্বাক্ষর রেখে গেছে। নৃতত্ত্ববিদেরা ব্যাখ্যা দেন, মানুষের সাংসারিক প্রয়োজনেই এদের উৎপত্তি। যুদ্ধ ও যৌনতার প্রয়োজনে নৃত্যগীত, ডাইনি-পুরুতের ইকড়িমিকড়ি থেকে কবিতা, মৃগয়া কৃতকার্যতার জন্য চিত্রাঙ্কন—এমনি আরো অনেক কথা আমরা শুনেছি। এই সবই বিশ্বাসযোগ্য, কেননা অকস্মাৎ, ‘আকাশ থেকে’ কিছু পড়ে না, আর আদিম মানুষের জীবন যেহেতু আত্মরক্ষা ও বংশবৃদ্ধিতে আবদ্ধ ছিলো, তাই তার সব ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে ও-দুয়ের যোগ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একদিন মানুষ বুঝতে শিখলো যে গুহাগাত্রে বাইসনের ছবি এঁকে রাখলেই বাইসন-সংহার নিশ্চিত হয় না, মন্ত্রবলে বাঁচিয়ে তোলা যায় না সর্পাহতকে। তার সাংসারিক প্রয়োজন থেকে শিল্পকলা স্খলিত হলো তখন— কিন্তু তার জীবন থেকে নয়; বরং এই বিচ্ছেদের ফলে তার কল্পনা হলো দূরযাত্রী। সভ্যতায় আরো কিছুদূর এগিয়ে আমরা শিল্পকলার ধর্মীয় ‘ব্যবহার’ দেখতে পাই; কিন্তু এই অবস্থাটাও সাময়িক, ইতিহাসের একটি অধ্যায় মাত্র। আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি, কেন মানুষ বংশপরম্পর কল্পনারচনায় প্রবৃত্ত হয়েছে—বিরতিহীন, অক্লান্তভাবে ভাষার মধ্য দিয়ে, বর্ণ ও রেখার মধ্য দিয়ে, ধাতুতে প্রস্তরে অঙ্গভঙ্গিতে ধ্বনিসমন্বয়ে এত ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ও প্রকরণে; কেন উদ্ভাবন করেছে এত বহুবিধ বাদ্যযন্ত্র ও ছন্দবিন্যাস, জড় বস্তুকে রূপ দেবার এত বিচিত্ৰ কৌশল তার জৈব অস্তিত্বের সঙ্গে সে-সবের সম্পর্ক নেই জেনেও, তার দেবার্চনায় তা ব্যবহার্য নয় জেনেও 

যদি না মানবজাতির আবহমান জীবনে শিল্পকলার কোনো মৌলিক প্রয়োজন থাকবে, যদি না সৌন্দর্য হবে তার পক্ষে অন্নজলের মতোই প্রয়োজনীয়? আমরা জানি, অনেক সময় ‘ফরমায়েশি’ শিল্প রচিত হয়েছে— রাজা যোদ্ধা ধনিকের অহমিকা-তৃপ্তির জন্য, ধর্মগুরুর আজ্ঞায়, অথবা আধুনিক যুগে জনতার মনোরঞ্জনের জন্য। জানি, গৃহসজ্জার উপাদান হিশেবে, অবসরবিনোদনের উপায় হিশেবে, এমনকি কোনো সর্বজনীন অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিশেবেও ছবি সাহিত্য সংগীত মানবসমাজে ‘ব্যবহৃত’ হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা শিল্পের উপলক্ষ শুধু হতে পারে, লক্ষ্য কখনোই নয় যে-শিল্প কোনো সাংসারিক-সামাজিক উদ্দেশ্যসাধনের বেশি আর কিছুই করে না, তা সাংবাদিকতার মতোই অচিরস্থায়ী। শিল্পীকুলে নমস্য তাঁরাই, যাঁরা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আরম্ভ করলেও সেটাকে বিপুলভাবে অতিক্রম করে যান। এলিফ্যান্টার ত্রিমূর্তির কথা ভাবো, অথবা এল গ্রেকোর খ্রিষ্ট—এদের সম্মোহন কোনো বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না, বা শৈব অথবা খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হবার জন্যেও এরা আহ্বান করে না আমাদের। রেমব্রান্টের ‘নৈশ পাহারা’র সামনে দাঁড়ালে ছবিটাই আমাদের সমস্ত মন টেনে নেয়; চিত্রিত মানুষগুলি, যাঁরা ছবিটার জন্য ‘ফরমাশ’ দিয়েছিলেন, সেই বণিকবৃন্দের ঐতিহাসিকতা সম্পূর্ণ অবান্তর হয়ে পড়ে। ধরে নেয়া যাক, শেক্সপিয়র জনরঞ্জন ও অর্থোপার্জনের ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে নাটক লিখেছিলেন, তাঁর সমকালীন দৈশিক রুচির সঙ্গে মিলিয়ে-মিলিয়ে;–কিন্তু হ্যামলেট বা লিয়র বা লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রকে কোনো নির্দিষ্ট ভূগোল-ইতিহাসের সীমানার মধ্যে খাপ খাওয়ানো অসম্ভব। তেমনি, সিস্টিন চ্যাপেলে য়িহুদিপুরাণের চিত্রপর্যায় দেখতে-দেখতে আমাদের মনে সন্দেহ থাকে না যে এটা কোনো ‘অলংকরণ’ নয়, শুধু ঈশ্বর-ভক্তির ইস্তাহারও নয়; আমরা বুঝতে পারি, মিকেলাঞ্জেলো পোপের নির্দেশে কাজটি হাতে নিয়ে থাকলেও, করার সময়ে নিজেই তার নিয়ন্তা হয়ে উঠেছিলেন, প্রকাশ করেছিলেন অজস্রভাবে নিজেকেই—স্বপ্রণোদিত স্বাধীন, অথবা শুধু শিল্পবিধানের বশবর্তী। আর তাছাড়া, এমন বহু শিল্পরচনার সঙ্গে আমরা পরিচিত আছি, যার পিছনে কোনো ‘চাহিদা’ মেটাবার উসকোনি ছিলো না (যেমন ছিলো শেক্সপিয়র বা মিকেলাঞ্জেলোর), এবং যা রচনাকালে শিল্পী কল্পনাও করেননি যে এর জন্যে কোথাও কোনো ‘পাব্লিক’ বা পৃষ্ঠপোষক অপেক্ষা করে আছে। সেজ়ান-এর আপেল, ভ্যান গ-র হলুদ-রঙা চেয়ার, হোল্ডার্লিন-এর কবিতা—এগুলি সম্পূর্ণ ‘উদ্দেশ্য’বর্জিত, কোনো নির্জন মানুষের স্বগতোক্তি বা অদৃশ্যের সঙ্গে সংলাপ যার জন্য ‘চাহিদা’ তাঁদেরই মনের মধ্যে ছাড়া বিশ্বজগতে অন্য কোথাও জেগে ওঠেনি। এমনকি আমাদের কালিদাস—তাঁকে সভাকবি বা রাজকবি যা-ই বলো না—তিনি কোনো বিক্রমাদিত্যের মনস্তুষ্টির জন্য তাঁর ‘মেঘদূত’ লিখেছিলেন, তাও আমাদের ধারণার মধ্যে আসে না। যত উদাহরণ আমরা ভাবতে পারি—যে-কোনো ‘স্কুলে’র, যে-কোনো দেশের বা সময়ের হোক তা অভিনেয় নাটক বা পঠিতব্য উপন্যাস বা চিত্র বা গীতিকাব্য — সর্বত্র পাই কিছু-না-কিছু উদ্বৃত্ত—বর্ণিত বিষয় অথবা বক্তব্যকে যা ছাড়িয়ে যায়, এবং যার আবেদন আমাদের চক্ষু, কর্ণ, বিনোদলিপ্সা বা সামাজিক সত্তার প্রতি উদ্দিষ্ট হয় না। সেটাকে বলতে পারি এক উচ্ছলন, এক আশাতীত অনুভূতি, যাকে কোনো সংজ্ঞার মধ্যে বাঁধতে পারি না আমরা, অথচ জানি তারই জন্য রচনাটি মূল্যবান। শিল্পকলার সম্ভোগ : তাও ভোগ্যবস্তুকে জীর্ণ অথবা নিঃশেষ করে ফ্যালে না, তাকে আমাদের মনের মধ্যে এক নতুন জীবন দান করে। সেটা নিশ্চেষ্ট কোনো সম্ভোগ নয়, একটি অভিজ্ঞতাও—নিছক সুখবোধ নয়, আবিষ্কার। শিল্পকলার কাছে আমরা যা পাই, তার সঙ্গে আমাদের বিনিময় চলে, বোঝাপড়া চলে, তা নিয়ে কিছু ‘করতে’ও হয় আমাদের। তাহলে কেমন করে বলা যায় শিল্পকলা আলস্যজীবীর বিলাসিতা, বা উচ্চাঙ্গের কোনো আমোদ-প্রমোদ? অন্য দিকে, ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কথাটাও অর্থহীন, কেননা মানুষ ছাড়া কে-ই বা আছে তার স্রষ্টা বা ভোক্তা স্পষ্টত মানুষের জন্যই শিল্পকলা। স্পষ্টত মানুষের পক্ষে তা প্রয়োজন, যেমন প্রয়োজন ধর্ম ও সমাজনীতি ও বিজ্ঞান তেমনি- কিন্তু ভিন্নভাবে, ভিন্ন কারণে। নীতিশিক্ষা নয়, জ্ঞানলাভ নয়, সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য নিশ্চয়ই নয়, মানুষের আত্মার পক্ষে, দেহ প্রাণ ও মনের সমন্বয়ে রচিত তার সামগ্রিক সত্তার পক্ষে—রহস্যময় অবিচ্ছেদী এক প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনের স্বীকৃতিরূপেই মানুষ শিল্পকলাতে আরোপ করেছে দেবীত্ব, সেইজন্যই সরস্বতী স্বয়ম্ভূ -ব্রহ্মার যুগপৎ কন্যা ও জায়া। আর সেইজন্যই আমাদের ইতিহাসখ্যাত তত্ত্বজ্ঞানীরা, আর তাঁদের অধস্তন অধঃপতিত খরদূষণ বংশাবলি সব পান্ডা পুরুৎ বড়দা মেজদা আমলা দারোয়ান পাহারাওলার দল— এত আইন, এত নিষেধ, এত শাসন, এত পীড়নাস্ত্র নিয়েও দেবীকে কখনো বন্দিনী করতে পারলেন না। মাঝে-মাঝে হয়তো অজ্ঞাতবাস করতে হয়েছে তাঁকে, বেরোতে হয়েছে দীন বসনে বা ছদ্মবেশে, কখনো শীত নেমে এসেছে মূর্ছার মতো, কখনো পায়ের তলায় মরুভূমি বিস্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু তবু তাঁর গতি কখনো থামেনি, সব সীমান্ত তিনি পেরিয়ে গিয়েছেন, ফুটিয়েছেন বসন্তের ফুল বার-বার সব আক্রমণের উত্তরে; ফলিয়ে তুলেছেন বার-বার হেমন্ত ঋতু— সব নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও। আর সেই ফুল-ফলও যুগে-যুগে নতুন, অন্তহীনভাবে বিচিত্র। 

টলস্টয়ের সরল শিল্প? রুসোর অপাপবিদ্ধ আদিম মানুষ? কেমন করে হবে, যদি না মানুষ তার সব উত্তরাধিকার বিস্মৃত হয়; সরল জীবন কোথায় আমরা খুঁজে পাবো, যদি না আমাদের বর্তমান ধ্বংস হয়ে যায়? এই মনস্বীরা কেমন করে ভুলতে পেরেছিলেন যে মানবস্বভাবে কোনো প্রত্যাবর্তন নেই, যে পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র জীব, যে পেয়েছে এক প্রকৃতিদত্ত প্রকৃতিবিরোধী প্রেরণা, যার ফলে পশুত্ব থেকে তার উত্থান, তার অনন্য মানবিক চিত্তের উদ্বোধন ও অভিব্যক্তি? গরিলা-শিম্পাজির বংশোদ্ভূত এই মানুষের দিকে তাকিয়ে সহজেই বোঝা যায় যে একবার অরণ্যে কোনো পাতার চালা তৈরি হলে কোনো-না-কোনোদিন পৃথিবীর মাটিতে মেঘস্পর্শী অট্টালিকা উঠবেই; একবার সমুদ্রে ভেলা ভাসালে চন্দ্রযান থেকে অব্যাহতি নেই; একবার তালে পা ফেললে পাভলোভার উদ্ভব অনিবার্য; একবার কোনো বধ্য পশুকে চিত্রিত করলে পিকাসোকে ঠেকানো যাবে না; কেউ দৈবাৎ একবার ‘ইকড়িমিকড়ি চামচিকড়ি’ বলে উঠলে পৌঁছতেই হবে সহস্ররশ্মি রবীন্দ্রনাথে, দুরবগাহ জীবনানন্দে। সাহিত্যে দুর্বোধ্যতাকে ‘দুর্নীতি’ বলেছিলেন টলস্টয় (যদিও তার উদাহরণস্বরূপ বোদলেয়ারের গদ্যকবিতার মতো প্রাঞ্জল রচনা তিনি কেন উদ্ধৃত করেছিলেন, সেটাই আমাদের কাছে দুর্বোধ্য); দুর্নীতি শুধু এই কারণে যে জনসাধারণের তা বোধগম্য নয়। আর ‘জনসাধারণ’ বলতে তিনি বুঝেছিলেন—সর্বজন নয়, শুধু নির্ধন শ্রমজীবীরা, শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ বোদ্ধাও তারাই; তিনি ভেবে দ্যাখেননি, তারা বাধ্য হয়েই শ্রমজীবী ও নির্ধন–স্বেচ্ছায় নয়; ভেবে দ্যাখেননি যে রসবোধ কোনো সামাজিক বা আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে না, যে অবসরভোগীদের মধ্যেও সকলেই নয় ইম্প্রেশনিস্ট ছবি অথবা সিম্বলিস্ট কবিতার অনুরাগী, যে শিল্পের যারা সম্ভবপর ভোক্তা, তারা শ্রেণী নির্বিচারে সর্বমানব এবং এ-মুহূর্তে যারা অবস্থাবৈগুণ্যে বঞ্চিত, তারাও কেউ-কেউ—বন্ধ দরজা-জানলাগুলো খুলে যাওয়ামাত্র—জটিল অথবা দুর্বোধ্য শিল্পের ভক্ত হয়ে উঠতে পারে। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে চেখভের উত্তর : ‘গোগোলকে জনসাধারণের কাছে নামিয়ে আনা চলবে না, জনসাধারণকে গোগোলের কাছে টেনে তুলতে হবে।’ নিশ্চয়ই তা-ই, কিন্তু চেখভ যাকে ‘টেনে তোলা’ বলছেন, সেটাও এক আবহমান প্রক্রিয়ার অংশমাত্র; মানুষ স্বভাবতই চেয়েছে জড়ত্বের বন্ধন থেকে মুক্তি, নিজেকে ও জগৎটাকে ডপলব্ধি করতে চেয়েছে— শুধু সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয় দিয়ে নয়, তার চৈতন্য দিয়েও সেই উপলব্ধির ভিন্ন-ভিন্ন রূপকেই আমরা বলে থাকি ধর্ম ও সমাজনীতি ও বিজ্ঞান ও শিল্পকলা। বিভিন্ন ব্যক্তিতে চৈতন্যবিকাশের স্তরভেদ আছে নিশ্চয়ই; কিন্তু কোনো-কোনো প্রতিনিধির মধ্য দিয়ে মানুষের চিৎপ্রকৃতি সর্বদা নিজেকে প্রমাণিত করছে, আমরা কোথাও এর সমাপ্তিরেখা দেখতে পাই না। আর যদি বা কোনো দুর্দৈবের ফলে মানুষ তার মননশীলতা হারিয়ে ফেলে কখনো তার ‘আদিম’ অবস্থা সত্যি ফিরে পায়, তাহলে সে হতে পারে নিষ্পাপ নয়, শুধু নির্বোধ, সরল নয় জান্তব গালিভারের ন্যায়পরায়ণ ঘোড়া পর্যন্ত নয়, ইওনেস্কোর অন্ধ অজ্ঞান গন্ডার শুধু। এর চেয়ে, তার সব সমলতা নিয়েও, সভ্যতাই কি ভালো নয়? 

–সভ্যতার অন্যায়? সেই কলঙ্ককাহিনী কে না জানে। ধর্মের কারণে নৃশংসতা, রাষ্ট্রের কারণে শোণিতপ্লাবন, সামাজিক নীতিরক্ষার জন্য দুষ্ক্রিয়া, সংশোধনের জন্য ব্যভিচার— এত শুনেছি, দেখেছি, আর এখনো দেখছি যে তা নিয়ে কোনো আলোচনাও বাহুল্য। এমনকি বিজ্ঞান, যা বাইরে থেকে দেখলে অমন নিরঞ্জন আর অধিকারী বলে মনে হয়, তারই জন্য আজ মানবজাতির ধ্বংস বুঝি-বা আসন্ন। সে-তুলনায় শিল্পকলার কুফল—দুটি-চারটি হোর্টের-ভক্তের আত্মহত্যা, বা কোথাও কারো কাল্পনিক বা বাস্তব চরিত্রস্খলন— তা যেন অণুবীক্ষণ দিয়েও চোখে পড়ে না। শুধু পাওলো-ফ্রান্‌চেস্কাই দৃষ্টান্ত নয়— অন্য দিকে আছে য়িহুদিপুরাণের রাখাল-বালক, যার গান শুনে-শুনে রাজা দায়ুদের বিরাট নির্বেদ কেটে গিয়েছিলো।— কিন্তু এই সবই কুযুক্তি, আর আমাদের মুখে নিতান্ত অশোভন, কেননা আমরা বিশ্বাস করি না— কখনো করিনি— যে সমাজের উপর প্রত্যক্ষ ফলাফল শিল্পবিচারে কোনো নিরিখ হতে পারে। ‘টম খুড়োর কুঠি’ নামক উপন্যাসটি সমাজের পক্ষে তাৎকালিকভাবে সুফলপ্রসূ হয়ে।ইলো, ধরা যাক ‘তরুণ হেবর্টের-এর দুঃখ’ তা হয়নি— কিন্তু এ-দুয়ের মধ্যে কোনো তুলনার কথা মনে আনাও লজ্জার বিষয়। কবিতাকে হোরাসের ধরনে ‘মনোহারিণী শিক্ষয়িত্রী’ বলার চাইতে প্লেটোর হাতে নির্বাসনগ্রহণ আমাদের পক্ষে অনেক বেশি সম্মানজনক। 

কিন্তু আমরা এখানে অন্য একটি কথা তুলতে পারি— কোনো ‘সাফাই’ হিশেবে নয়, তথ্য হিশেবে। সভ্যতার সমগ্র পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে শিল্পকলার একটি বৈশিষ্ট্য তৎক্ষণাৎ ধরা পড়ে; তার প্রভাব প্রগাঢ় হলেও ব্যাপ্ত নয়, তা কাজ করে ব্যক্তি-মানসে, যুগ-মানসে নয়; তা পারে না একই সঙ্গে লক্ষ মানুষকে উন্মাদ করে দিতে, যেমন পারে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাস বা রাষ্ট্রনীতি। এবং তা, রাষ্ট্র বা সমাজ বা আচারনির্ভর লৌকিক ধর্মের মতো, বা বিজ্ঞানপ্রসূত প্রযুক্তিবিদ্যার মতো, মানুষের স্বার্থবুদ্ধির সঙ্গে জড়িত নয়, ইহকাল বা পরকাল-সংক্রান্ত কোনো ‘লাভে’র আশা তা জাগিয়ে তোলে না বা পূরণ করে না— এটাই তার দুর্বলতা এবং এজন্যেই তা নিন্দিত হয়ে থাকে, কিন্তু এজন্যেই তা এক অর্থে বিশুদ্ধ ও নিষ্কাম। ধর্মের যে-অংশ আধ্যাত্মিক, বিজ্ঞানের যে-অংশ জ্ঞান, সমাজনীতির যে-অংশে আছে সুবিচার ও সংযমের ধারণা— সেগুলিকে সংসারজীবনে প্রয়োগ করতে গিয়েই মানুষ তার নির্লজ্জতম পাপাচরণে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু মানুষের যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে শিল্পকলাই একমাত্র, যার কোনো সামাজিক-সাংসারিক প্রয়োগ নেই, যা আমাদের দীক্ষা দেয় না কোনো বিশ্বাস বা মতবাদে, শেখায় না আরো বেশি উপায়নৈপুণ্য বা কার্যকারিতা; একটি কবিতা বা ছবি বা সুরবিন্যাসের সম্পূর্ণ মূল্য তার নিজেরই মধ্যে, সে যা সে তা-ই শুধু, তার নিজত্ব ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় তার নেই। আর তাই, সভ্যতার অন্যান্য বিভাগের তুলনায়, আমরা কোনো দম্ভোক্তি না-করেও শিল্পকলাকে অকলুষেয় বলতে পারি— অন্তত সবচেয়ে কম সংক্রমণপ্রবণ। একদিক থেকে যেটা তার ‘নিষ্ফলতা’ অন্য দিক থেকে সেটাই তার গৌরব। 

এবং এও আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি যে নীতিচর্চায় ব্যক্তিমানুষ অমেয়ভাবে সমষ্টিকে ছাড়িয়ে যায়, যে বহুসংখ্যক মানুষ যেখানে সংঘবদ্ধ, সেখানে নীতিবোধ থেকেই ঘোর অন্যায় নিঃসৃত হতে পারে, যে সাধু জীবনের দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পাই শুধু বিবিক্তভাবে কোনো-কোনো মানুষে— ব্যক্তিতে— যৌথভাবে কোনো সৈনিকশিবিরে নয়, কোনো ধর্মপ্রচারক-সম্প্রদায়ে নয়। আর, যেহেতু সেই ব্যক্তি-মানুষের সঙ্গেই শিল্পকলা কথা বলে থাকে— তার নির্জন মুহূর্তে, নিচু গলায়, প্রায় কানে-কানে, তাই এমন কথাও কি বলা যায় না যে কোথাও কোনো দূরতর গহনে, অলক্ষ্যে, অব্যক্তভাবে, শিল্পের সঙ্গে সুনীতির একটি সম্বন্ধ আছে? লৌকিক ও আক্ষরিক অর্থে সুনীতি নয়— নয় পুরোহিততন্ত্রের বা আইনগ্রন্থের ধূমাচ্ছন্ন ও পিচ্ছিল সুনীতি, যা নিতান্ত সাময়িক ও স্থানীয় এবং যা মানুষের হাতে অসহিষ্ণু ও অত্যাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু মৌলিক সুনীতি, যার মূর্তি কঠোর নয়, স্নিগ্ধ, যার দৃষ্টিপাতে আমরা সংকুচিত হই না, উন্মীলিত হই, যা আমাদের ইন্দ্রিয়-নির্ভর বৃত্তিগুলিকে নির্জিত করে না, রূপান্তরিত করে— তার সঙ্গে শিল্পকলার সূক্ষ্ম একটি সম্বন্ধ কি নেই? ‘আছে’ বলতে সাহস হয় না আমাদের, ‘নেই’ বলতেও বিবেকে বাধে। কেননা শিল্পের অভিজ্ঞতাও বিস্তীর্ণ ও সম্প্রসারিত করে আমাদের; তার মধ্যে দিয়ে আমরা অনুভব করি— করেছি অনেকবার— জগতের সঙ্গে আকস্মিক এক সমানুকম্পন, এক পবিত্ৰ বেদনাবোধ, কোনো ইন্দ্রিয়াতীত উদ্ভাস, কখনো যেন ক্ষণিকের সঙ্গে শাশ্বতের মিলনস্পর্শ— কিন্তু এ থেকে কিছুই প্রমাণ করতে পারবো না আমরা, এই পলাতক ও বিচ্ছিন্ন মুহূর্তগুলির নৈতিক ‘ফলাফল’ কী তা আমাদের নিজেদের কাছেই অস্পষ্ট। বুকে হাত দিয়ে এমন কথা আমরা বলতে পারি না যে এর ফলে আমরা ‘মানুষ হিশেবে’ আরো ভালো হচ্ছি, আরো মিতাচারী বা বিবেকবান। সত্য অথবা সৌন্দর্যকে নীতির সঙ্গে জুড়ে দেবারও কোনো উপায় নেই, কেননা শিল্পের সত্য ‘সদা সত্য বলিবে’-র ধ্বজাবাহী নয়, পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত সত্যও নয়; ভোক্তার মন যেটাকে মেনে নিচ্ছে ও বিশ্বাস করছে তা-ই সেখানে সত্য। আর শিল্পের সৌন্দর্য এতই উদার ও নির্বিচারী যে সেখানে স্বচ্ছন্দে স্থান করে নেয় গোলাপের পাশেই কুমড়োফুল, বালিকার হাসির পাশেই স্ফীতকায় দন্তিল গণিকা, স্বাস্থ্যবতী রূপসীর পাশেই কৃমিসংকুল জন্তুর শব। আর শিল্পলব্ধ জ্ঞান— যদি কিছু থাকে, আছে বলেই আমাদের বিশ্বাস— তাও নয় ঘোষণীয় বা বিশ্লেষণযোগ্য, তা প্রকাশ করা যায় হয়তো শুধু নতুন একটি শিল্পরচনায়— জীবনের মধ্য দিয়ে নয়। কিন্তু নিশ্চয়ই শিল্পকলা কিছু করে আমাদের নিয়ে, আমাদের জন্য— এমন কিছু, যা আমাদের কোনো গভীরতম অভাব পরিপূরণ করে, মানুষের মনুষ্যত্বের পক্ষে যা অবিচলভাবে কাঙ্ক্ষণীয় :—আমরা সেজন্যই তাকে রহস্যময় এক প্রয়োজন বলেছি। কিন্তু এই রহস্যটা কী? এই প্রয়োজনের প্রতিষ্ঠা ঠিক কোথায়? কী পাই আমরা তার কাছে, যা ধর্ম বিজ্ঞান সমাজনীতি বা অন্য কিছু আমাদের দিতে পারে না? আমরা মানতে বাধ্য যে তা আনন্দ নয়, অনন্তের অনুভূতিও নয়— ও-সব আমরা ধর্মের কাছেও পাই, নৈসর্গিক দৃশ্যের কাছেও, আর কখনো-কখনো প্রেমেও আমাদের অন্তরাত্মার বিকাশ ঘটে থাকে। একান্তভাবে শিল্পকলার কাছে যা প্রাপণীয়, সেটা কী? 

আমার মনে হচ্ছে এর একটিমাত্র উত্তর সম্ভব, যা নির্ভয়ে উচ্চারণ করা যায়। আমরা লক্ষ করি, সভ্যতার একটি লক্ষ্য হলো সামঞ্জস্যস্থাপন— মানুষের সৃষ্ট ধর্ম বিজ্ঞান সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি অনবরত এই চেষ্টাতেই ব্যাপৃত— প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের, ব্যক্তির সঙ্গে গোষ্ঠীর, ও ভিন্ন-ভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সামঞ্জস্য, মানুষের দৈহিক ও আত্মিক জীবনের মধ্যে, তার অন্তঃস্থিত দেবতা ও দানবের মধ্যে :—আপ্রাণ চেষ্টা, কিন্তু সফল হয়নি কখনো, পৃথিবীর কোনো ক্ষুদ্র অংশে ক্ষণিকের জন্য সফল হয়ে থাকলেও স্থায়িত্ব বা সার্বিকতার সম্ভাবনাও কখনো দেখা দেয়নি। কোনো জাতি অথবা গোষ্ঠীর কথা ছেড়েই দাও- ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সামঞ্জস্যবোধ, তা-ই বা কত বিরল! কত বিরল সেই মুহূর্তগুলি, যখন বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, পিতার সঙ্গে পুত্রের, এমনকি প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার মৈত্রীবন্ধনে কোথাও কোনো অপূর্ণতা থাকে না। মনে হয় মানবজীবনের বড়ো অংশটা বিসংগতি নিয়েই কেটে যায় হয়তো তার চৈতন্যবিকাশের এটাও এক ফলাফল; তা যতক্ষণ অব্যক্ত থাকে ততক্ষণ সংসারযাত্রা ব্যাহত হয় না, প্রকট হলেই ছড়িয়ে পড়ে অশান্তি। কিন্তু মানুষের অন্য একটি সৃষ্টি আছে— একটিমাত্র— যা এই বহুবাঞ্ছিত ও অতি দুর্লভ সামঞ্জস্যেরই প্রতিমূর্তি : সেটি তর্কাতীতভাবে শিল্পকলা। শিল্পকলা শুভ না অশুভ, সত্য না মিথ্যা, অনুকরণ না নতুন এক সৃষ্টি— এ-সব নিয়ে অনন্তকাল পর্যন্ত তর্ক চলতে পারে— কিন্তু একটা কথা সকলকেই মানতে হবে; যে শিল্পকলা অবিকলভাবে সুসমঞ্জস। মানুষের সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ সভ্যতার দ্বারা আজ পর্যন্ত তার বহির্জীবনে যা অর্জিত হলো না, সেই সাযুজ্য ও সংহতি— বাইরে থেকে চাপানো নয়, অন্তঃপ্রকৃতিগত— তা আর কোথায় আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি, যদি না কবিতায় ও ছবিতে, সংগীতে ও নৃত্যকলায়? অথচ সেটা প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা নয়, গ্রহনক্ষত্রের আবর্তনের মতো নয়, আমাদের দেহাভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহের অচেতন সহযোগিতার সঙ্গেও তার তুলনা হয় না— মানুষের চৈতন্য ও চেষ্টার ফলেই তা সম্ভূত হয়েছে। ছন্দ ও ছন্দস্পন্দ, সুর ও তাল, রেখা ও বর্ণলেপনের সৌষম্য, প্রস্তরের রূপসমন্বিত পুনরুত্থান— জীবনের সব বিরোধ আর বিভেদ আর বিভ্রান্তির উপরে মানবাত্মার বিজয়ঘোষণা কি এগুলোই নয়? তুলনায় কত ভঙ্গুর মনে হয় সমাজের ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সংগঠন— কত অনির্ভরযোগ্য ও অসম্পূর্ণ। বিশেষত এমন কোনো সময়ে, বাইরে যখন বিশৃঙ্খলাই সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগোচর, আর সবচেয়ে শ্রুতিগম্য যখন বিসংবাদ, তখনই— যদি আমরা ইচ্ছুক হই, মনোযোগী হই— আমরা আরো গভীরভাবে বুঝতে পারি শিল্পকলা কোন বিশেষ অর্থে প্রয়োজনীয়। শৃঙ্খলা- তা সংসারজীবনে কোথাও যদি নাও থাকে, তবু আছে ছন্দোবদ্ধ কোনো চরণে, কোনো সুগঠিত গদ্য বাক্যে, সুর অথবা রেখার কোনো বিন্যাসে- আছে, এবং থাকতেই হবে— স্বরের সঙ্গে স্বরের ও ব্যঞ্জনের সঙ্গে ব্যঞ্জনের সংগতি, এক অংশের সঙ্গে অন্য সব অংশের ভারসাম্য ও মৈত্রী, ধ্বনির সঙ্গে ধ্বনির সহযোগিতা, ধারণা ও রূপকরণের পূর্ণ সমন্বয়, বাগর্থের অর্ধনারীশ্বর-মিলন। সেই একমাত্র স্থান, যেখানে বেসুরোকেও মিলিয়ে দেয়া যায় সুরের মধ্যে, পৃথিবীর সব ছেঁড়া তার থেকে বেরিয়ে আসে মনোলীন এক সিম্ফনি। আপাতত যদি মনে হয় কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না, যদি মনে হয় সব শ্রবণ কলহগর্জনে বধির— তাতেই বা কী এসে যায়? আমরা তো জানি আমাদের দেবী ধৈর্যশীলা, তাঁর অপেক্ষার শক্তি অফুরান। 

আমার চিঠি শেষ হয়ে এলো। এক ঠান্ডা দিনে আরম্ভ করেছিলাম, আর আজ মধ্য-ফাল্গুন। কিছুক্ষণ আগেও শুনছিলাম দূরে কাছে বোমার শব্দ; কিন্তু এখন রাত্রি আরো গভীর, গভীর আর স্তব্ধ আর নির্মল— মাঝে-মাঝে দু-একটা ভারী লরি চলার আওয়াজ তার গায়ে আঁচড় কাটতে পারছে না। আমার জানলার বাইরে এক ফালি নীলচে আকাশ, পাশের বাড়ির জামরুল-ডালের ফাঁক দিয়ে টুকরো চাঁদ আমাকে চমকে দিচ্ছে মাঝে-মাঝে। আমার মন ঘুরে বেড়াচ্ছে দূরে, অন্য দেশে, অন্য সময়ে, অন্য অনেক রাস্তার মোড়ে, ঋতুবদলে— কোনোটাকে পেরিয়ে এসেছি, কোনোটায় পৌঁছতে পারিনি এখনো। যত সমুদ্র, যত নগর, যত প্রীতি, যত বেদনা আমি কোনো-না-কোনো সময়ে দেখেছিলাম বা পেয়েছিলাম, আর যার জন্য এখনো আমি অপেক্ষায় আছি—তারা দাবি জানাচ্ছে আমাকে, আমাকে বলছে তাদের হয়ে কিছু কথা বলতে। খুব ঝাপসা, আজকের আকাশে জড়ানো হালকা কুয়াশার মতো, জ্যোছনায় মাখা পাৎলা শাদা মেঘের মতো, আমার মনের মধ্যে ভেসে-ভেসে উঠছে— এখনো জানি না সেটা কী, কোনো গল্প না নাটক না কবিতা। তুমি বুঝতে পারছো পুরো চিঠিটা আমার নিজের সঙ্গে তর্ক, কিন্তু এতক্ষণে এই তর্ক যেন গান হয়ে উঠছে— ‘ঘরে-বাইরের বিমলার কথা, কিন্তু এ-মুহূর্তে এটা আমারও : যেমন হয় প্রেমে-পড়া মানুষের, তেমনি কোনো অলক্ষ্য উৎস থেকে উঠে আসছে ফোঁটা-ফোঁটা যৌবন, আমার ক্লান্ত শিরায় তার সঞ্চার আমি অনুভব করছি। মনের মধ্যে এই নতুন আরম্ভ নিয়ে আমি এবার ঘুমোতে যাই; যদি হারিয়ে না ফেলি, যদি পারি এ থেকে কিছু গড়ে তুলতে, সে-কথা তোমাকে জানাতে ভুলবো না। অমিতাকে, ডারিনাকে, আর ইতালিকে আমার ভালোবাসা জানিয়ো। ইতি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১, তোমার বন্ধু—। 

অধ্যায় ১ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন