কবিতা ও আমার জীবন : আত্মজীবনীর ভগ্নাংশ

বুদ্ধদেব বসু

এককালে কবিতার সঙ্গে আমার সরল একটি ভালোবাসা ছিলো। মনে একটা ভাব জাগে বা অস্পষ্ট কোনো কল্পনা, বা এমন-কিছু ঘটে যার অভিঘাত আমার উপর তীব্র; আমি খাতা খুলে বসি, লাইনগুলো ঝরঝর করে বেরিয়ে আসে। ভাবতে হয় না, কাটাকুটি অদলবদলের বালাই নেই; এত স্বচ্ছন্দে আমার কলম চলে যে এক ঘণ্টার মধ্যে একটি পঞ্চাশ লাইনের কবিতাও লিখে উঠতে পারি— অনায়াসে ও নিষ্কণ্টকভাবে। এমনি করে লেখা হয়েছিলো ‘বন্দীর বন্দনা’, ‘কঙ্কাবতী’ ও ‘নতুন পাতা’র কবিতাগুলো, আমার সতেরো থেকে পঁচিশ বা ছাব্বিশ বছর বয়সের মধ্যে। কিন্তু বইয়ে ছাপানো সেই কয়েক মুঠো কবিতা শুধু নয়, সেই সঙ্গে খাতা-ভর্তি-ভর্তি আরো অনেক লিখেছিলাম— সেগুলো সবই রদ্দি মাল। যা লিখছি তা ভালো হবে কি হবে না, তা পুরোপুরি দৈবের উপর নির্ভর করছে, আমি ভাগ্যের গাঙে গা ভাসিয়ে চলেছি। যেটা উৎরে গেলো সেটার জন্য আমার কোনো দায়িত্ব নেই, সত্যি বলতে; বই ছাপাবার সময় আমি যে রাশি-রাশি জঞ্জাল থেকে ঠিক কবিতাগুলোকে বেছে নিতে পেরেছিলাম, আমার কৃতিত্ব সেটুকুই। 

এমন নয় যে কোনো লেখাই কখনো আটকে যেতো না। ‘কঙ্কাবতী’র “শেষের রাত্রি” কবিতাটা প্রথম স্তবকের পর অনেকদিন আর এগোয়নি। সেটি লিখেছিলাম আমার ঢাকার জীবনের শেষ দফায়―তারপর কলকাতায় এসে বাসা বাঁধলাম, বিয়ে করলাম, আমার প্রথম সন্তান ও ‘কবিতা’ পত্রিকা একই দিনে ভূমিষ্ঠ হলো। ততদিনে সেই পড়ে-থাকা স্তবকটিকে হয়তো ভুলেও গিয়েছিলাম, অন্তত পুরোনো খাতার পাতা ওল্টাতে আর লুব্ধ হইনি—মনে পড়ে গেলো যখন ‘কঙ্কাবতী’ বই ছাপাবার তোড়জোড় চলছে। বইয়ের শেষ কবিতা হিশেবে এটা নেহাৎ মন্দ হবে না মনে হলো—তারই তাগিদে আরো কয়েকটা স্তবক তৈরি করে কবিতাটাকে ঘাটে ভিড়িয়ে দিলাম। 

‘তৈরি করে’ কথাটাই এখানে ঠিক। কেননা তখন আমি আর ‘কঙ্কাবতী’র আবহাওয়ায় বাস করছি না; পুরানা পল্টনের প্রান্তর আর বাতাস আর চন্দ্রোদয় আর তারার আলো থেকে দূরে চলে এসেছি—শুধু ভৌগোলিক অর্থে নয়, মনের দিক থেকেও। তবু, সেই পাঁচ বছর আগেকার সুরে সুর মেলাতে আমার যে কোনো অসুবিধে হলো না এই অভিজ্ঞতাটি আমার পক্ষে নতুন। এতদিন আমার কবিতা ছিলো চলতি মুহূর্ত থেকে বেরিয়ে আসা—আমি ইন্দ্রিয় দিয়ে যখন যা গ্রহণ করছি, অথবা যে-সব আবেগ আমাকে নাড়া দিচ্ছে আমি সেগুলোকেই আমার উপাদান বলে জেনেছিলাম; কিন্তু “শেষের রাত্রি” শেষ করতে গিয়ে মনে হলো আমাদের কল্পনা অনেক বেশি স্বাধীন। 

চলতি মুহূর্তের কবিতা বলতে কী বুঝি, তার একটা উদাহরণ দিই। “চিল্কায় সকাল” কবিতাটি সত্যি চিল্কার ধারে বসেই লিখেছিলাম, সত্যি এক সকালবেলায়―আমার জীবনের নিবিড় এক আনন্দের মুহূর্তে। যেন মুহূর্তটিকে হাতে-হাতে গ্রেপ্তার করে ফেলেছিলাম, তার সব সবুজ গন্ধ আর সজলতা সুদ্ধু তাকে শুকিয়ে যাবার সময় না-দিয়ে, নিজেকে অন্য কোনো দিকে ফিরে তাকাবার সময় না-দিয়ে। এর উল্টো উপায়ে লেখা হয়েছিলো কয়েক বছর পরে “ব্যাং” আর “ইলিশ”। ব্যাং দেখেছিলাম অনেকদিন আগে পুরানা পল্টনে—মাঠে-জমে-থাকা জলের মধ্যে এক মস্ত দল, উল্লসিত ও নির্ঘোষিত এক অসাধারণ কোরাস; —তখন বৃষ্টির পরে জ্বলে উঠেছে রোদ্দুর, আমি বোধহয় কলেজ থেকে ফিরছি। ইলিশ চোখে পড়েছিলো গোয়ালন্দের প্ল্যাটফর্মে— আমি রাত্তির দশটায় স্টিমার থেকে নেমে সবেগে ট্রেনের দিকে ছুটছি—আধো-অন্ধকারে স্তূপীকৃত ইলিশ চালান যাবার জন্য পড়ে আছে, কিন্তু সেদিকে ফিরে তাকাবার সময় নেই আমার; আমি থার্ড ক্লাশ কামরায় শোবার মতো একটু জায়গা করে নিতে পারবো কিনা, আমার মনে সেই ভাবনাটাই প্রধান। “চিল্কায় সকাল”-এ যা-কিছু আছে সবই সেই মুহূর্তে দৃষ্ট ও অনুভূত হয়েছিলো; আর পরের দুটো কবিতার মধ্যে এমন অনেক বিষয় প্রবেশ করেছে যা পুরানা পল্টনে বা গোয়ালন্দে আমি ভাবিনি। 

আমার বয়স বাড়ছে, আমার স্মৃতি বড়ো হয়ে উঠছে। 

*

“দময়ন্তী” কবিতাটাও আমি একটানা শেষ করতে পারিনি, প্রথম অনুচ্ছেদের পর অনেকগুলো মাসের ছেদ পড়েছিলো। আর সেটাই আমার প্রথম কবিতা, যাতে সুচিন্তিতভাবে শব্দচয়ন করেছিলাম—আমার সাধ্যে যতটা কুলিয়েছিলো তখন। এতে দোষের কথা কিছু নেই, কিন্তু আমার সদ্য-জেগে-ওঠা আত্মচেতনার ফলাফল ‘দময়ন্তী’ বইটার উপর পুরোপুরি ভালো হয়নি। তখন আমি কবিতার ভাষা নিয়ে ভাবছি—সেই প্রথম আমার মনে হয়েছে সেটা চিন্তার কোনো বিষয় হতে পারে, কেননা চারদিকে তখন রব উঠেছে কবিতার ভাষাকে মুখের কথার কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে। ‘দময়ন্তী’র কবিতাগুলোতে সেই দিকেই চেষ্টা ছিলো আমার (‘চেষ্টা’ কথাটা থেকেই বোঝা যাবে ‘বন্দীর বন্দনা’ থেকে কত দূরে সরে এসেছি ততদিনে) আর শুধু কবিতা লিখে খুশি না-থেকে, কিছুটা অসতর্ক উৎসাহের ধাক্কায়, বইটাতে একটি জাঁকালো ঘোষণাপত্র জুড়ে দিয়েছিলাম। আমার আদর্শ ছিলো এজরা পাউন্ডের ইমেজিস্ট ম্যানিফেস্টো—আধুনিক যুগে পদ্য কী-ভাবে লিখতে হবে তার কয়েকটা নিয়ম বেঁধে দিতেও আমি দ্বিধা করিনি। ‘সনে’, ‘ছিনু’, ‘মম’, ‘তব’ প্রভৃতি ‘কাব্যিক’ শব্দ হেঁটে ফেলতে হবে, আকাশকে ‘গগন’ বা সূর্যকে ‘তপন’ বলা কখনোই চলবে না, ‘সাধুভাষা’র ক্রিয়াপদগুলিকে উপড়ে ফেলা চাই, একমাত্রিক মিল সসম্মানে স্থান পাবে—নিয়মাবলির চুম্বক হলো এই। চল্লিশ-দশকের সংলগ্নতায় সূত্রগুলির প্রয়োজন ছিলো মানতেই হবে―‘সাধু’ ক্রিয়াপদ ও ‘কাব্যিক’ ভাষা বর্জনের প্রস্তাবটি কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও প্রযুক্ত হয়েছিলো; কিন্তু সে-সময়ে আমি লক্ষ করিনি যে ‘দময়ন্তী’ বইটার মধ্যেই আমার উক্ত নিয়মগুলির অনেক ব্যতিক্রম ঘটে গেছে―আমাকে চিঠি লিখে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন। ‘দময়ন্তী’ যখন দ্বিতীয়বার ছাপা হলো আমি আমার সাধের নিবন্ধটিকে বিসর্জন দিলাম, সেটাকে আমার কোনো বইয়েরও অন্তর্ভূত করিনি। 

‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ প্রকাশের সময় আমাকে এক নতুন ভূত তাড়না করছিলো—আজ পর্যন্ত তার দখলদারি আমি ছাড়াতে পারিনি। নিজের লেখার পরিবর্তন ও পুনর্লিখন—তা-ই নিয়ে আমি অনেকটা সময় কাটিয়ে দিচ্ছি—নতুন কবিতা লেখার চাইতে সেটা আমার কম জরুরি বলে মনে হচ্ছে না। ‘দ্রৌপদীর শাড়ি” নামে যে-কবিতা ‘বৈশাখী’তে প্রথম বেরিয়েছিলো তার সঙ্গে বইয়ের লেখাটার ছন্দের মিল থাকলেও ভাষার মিল প্রায় কিছুই ছিলো না—মূল বক্তব্য এক হলেও লাইনগুলো প্রায় প্রত্যেকটাই ছিলো নতুন। “মায়াবী টেবিল” নামে পনেরো লাইনের কবিতাটাও অনেকবার কাটাকুটির পর দাঁড় করিয়েছিলাম। আমার মাথায় তখন খেলছে অর্ধ-মিল ও মধ্য-মিল; আমি ভাবছি ছড়ার ছন্দে তিন মাত্রার পর্ব কতদূর পর্যন্ত সংগত হতে পারে, প্রবহমান অক্ষরবৃত্তে যতিপাতের আরো বৈচিত্র্য সম্ভব কিনা, কবিতার মধ্যে দীর্ঘ ও জটিল বাক্য কেমন করে চালিয়ে দেয়া যায়। এর ফলাফল শুধু ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ দিয়ে যাচাই করা যাবে না, তা ছড়িয়ে আছে ‘শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর’ থেকে আমার সর্বশেষ কবিতার বই ‘স্বাগতবিদায়’ পর্যন্ত। আসল কথাটা এই যে আমার সেই সময়কার চেষ্টা আর চিন্তা থেকে আমি অনেক শিখেছিলাম —শুধু কলাকৌশল বিষয়ে নয়, কবিতার অন্তরাত্মা বিষয়েও। ততদিনে আমার এটুকু অন্তত যোগ্যতা হয়েছে যে আমি ভাবতে শিখছি, শিখে নিচ্ছি কেমন করে শিখে নিতে হয়। 

আস্তে-আস্তে আরো অনেক ভাবনা আমাকে হানা দিতে লাগলো। অল্প বয়সে এমন অনেক কবিতা লিখেছি যা কবিতাই নয়, পদ্যজাতীয় কিছু-একটা পদার্থ মাত্র। সেই অবস্থা পেরিয়ে এসেছি ভেবেছিলাম —কিন্তু এখনো কি ও-রকম লিখে ফেলি না মাঝে-মাঝে—কর্তব্যবোধে, বন্ধুতার তাগিদে, বা নিজেরই খেয়ালখুশি মেটাবার জন্য? কেন এমন হবে না যে আমি যা-ই লিখবো বা অন্তত ছাপার অক্ষরে বের করবো —তা-ই হবে চলনসইরকম ভালো, যাকে বলে ভদ্রলোকের পাতে দেবার যোগ্য—অন্ততপক্ষে অকবিতা নয়? আমি স্পষ্টভাবে অনুভব করলাম যে এই উচ্চাশা পূরণ করতে হলে আমাকে ছাড়তে হবে অনেক প্রলোভন ও তাৎকালিক তৃপ্তি; ভুলে যেতে হবে হৃদয়ের অনেক ক্ষণচাঞ্চল্য, আর বহির্জগতের অনেক আন্দোলন ও ঘটনা। আমার বিশ্বাস জন্মালো যে কবিতা লেখাও একটা কাজ—খাটুনির অর্থে, ‘মাথার ঘাম পায়ে ফেলা’র অর্থে কাজ আর তার জন্য নানা ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কেমন করে প্রস্তুত হতে হবে তা অন্য কেউ বলে দিতে পারবে না, সেখানেও শুধু নিজেরই মন নির্ভর। কিন্তু মনের সঙ্গে সংলাপ চালাতে গিয়ে আমি এমন অনেক প্রশ্নের সামনে পড়ে যাই, যার উত্তর আমার মন জানে না, এবং যার অস্তিত্বও আমি এর আগে সন্দেহ করিনি। কোনো-একটা লাইন আপনি ধরা দিলে আমি ভাবি : এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? এটা কি আমাকে ঠকাবার মলবে নেই? একটা বিশেষণ বসিয়ে ভাবি : ঠিক হলো তো? আমি যা বলতে চাচ্ছি, তা কি ঠিক এই? আমার অনেক প্রিয় শব্দকে মনে হয় পচা, ক্ষয়ে-যাওয়া, বেসুরো; অনেক অভ্যস্ত সুরে মন আর সাড়া দেয় না; ক্লিশের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে গিয়ে আমার পুঁজিপাটার অনেক অংশ আমি হারিয়ে ফেললাম। পঁচিশ বছরের ভালোবাসাবাসির পর কবিতা এবার যেন রুখে দাঁড়ালো আমার বিরুদ্ধে যেন বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র ভূমি ছাড়তেও সে রাজি নয়। আর তারপর একদিন দেখলাম আমি হেরে যাচ্ছি, ভালো-মন্দ কোনোরকম কবিতাই আর লিখতে পারছি না। 

*

আমি তখন চল্লিশ পেরিয়েছি, আমার জীবনে এক অন্ধকার নেমে এসেছে। ভাঙন ধরেছে স্বাস্থ্যে, সংসার চালাবার মতো উপার্জন নেই, মন অবসন্ন। এদিকে আমার অত্যধিক আত্মচেতনা প্রতিশোধ নিচ্ছে আমার উপর–লেখক হিশেবে আমাকে প্রায় অক্ষম করে দিয়ে। একেবারে কিছুই লিখছি না তা নয়, কিন্তু লিখছি অতি ভারাক্রান্তভাবে, রোজ দু-এক পৃষ্ঠা গদ্য, অপরিসীম অনিচ্ছা ঠেলে, অনপনেয় ব্যর্থতাবোধে পিষ্ট হতে-হতে। আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি যেহেতু কবিতা আমাকে পরিত্যাগ করেছে :- কবিতা লেখার ইচ্ছেটা মরে গিয়েছে তা নয় (তাহলে তো বাঁচতাম!), কিন্তু সেই ইচ্ছে এমন ক্ষমতারিক্ত ও নিষ্ফল যে তার চাপে আমার যন্ত্রণা শুধু বেড়ে যায়, আমার হতাশা আরো বিপুল হয়ে ওঠে। শুভক্ষণ আসে হয়তো কখনো, অন্ধকারে ঝিলিক তুলে মিলিয়ে যায় : তারপর আমি বসে থাকি কলম হাতে নিয়ে লাইন ভাবি, লাইন লিখি, লাইন কেটে চুপচাপ, মন বোবা, স্নায়ুতন্ত্র যেন অবশ দিই; খাতার এক-একটা পৃষ্ঠায় স্রেফ কাটাকুটি ছাড়া অন্য কিছুই ফলিত হয় না। আমার লেখার টেবিলের দিকে তাকিয়ে, স্তূপীকৃত বই-খাতা এবং কাগজের গায়ে আমার হাতের লেখার দিকে তাকিয়ে আমার যেন বমি পায় এক-এক সময়, অথচ আমার আত্মাভিমান আমাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে বাধ্য করে, ‘হার মানলাম, এবার শুয়ে পড়ি’, এ-রকম কথা কখনোই বলতে দেয় না— এমনি কেটেছিলো আমার পুরো একটা বছর, বা হয়তো আরো দীর্ঘ একটি সময়ের প্রসার, দিনের পর দিন, অতি মন্থর ও কষ্টকরভাবে। কিন্তু একদিন আমার এই বন্ধ্য ঋতুর অবসান ঘটলো—প্রত্যাশাতীত ও প্রতিকূল এক মুহূর্তে, অকস্মাৎ। 

সেই প্রথম দেশান্তরে এসেছি। আছি পিটসবার্গে, আমার পক্ষে নির্বান্ধব ও নিরানন্দ এক নগর। কথা বলার লোক কেউ নেই, আমার উপর কাজে, চাপও হালকা, এদিকে হিম এবং ধবল হয়ে ডিসেম্বর মাস নামলো। আমার বাসা জুটেছে সেই ধরনের যাকে ইংরেজিতে ‘গ্যারেট’ বলা হয় : তেতলায় দুটো কামরা—তার একটা আবার অসমকোণ— ছাদটি সামনের দিকে এত ঢালু যে প্রায় হাতে ছোঁয়া যায়, কাঠের মেঝের যে-অংশটুকু কার্পেটহীন তাতে পা পড়লে কঁকানির মতো আওয়াজ বেরোয়। ভালোর মধ্যে সামনের ঘরটি দিনের বেলায় রৌদ্রোজ্জ্বল, সন্ধের আগে সূর্যাস্তের আকাশ রঙিন একটি পটের মতো ঝুলে থাকে আমার চোখের সামনে;—কিছু ক্লাশ পড়িয়ে, কিছু ঘুরে বেড়িয়ে, কিছু ঘরে বসে, দিনের বেলাটা যা-হোক একরকম কেটে যায়, কিন্তু সূর্যদেব অদৃশ্য হবার সঙ্গে-সঙ্গেই এক শত্রু আমাকে আক্রমণ করে। বাড়িটার তাপযন্ত্র এত দুর্বল যে তেতলা পর্যন্ত ছিটেফোঁটার বেশি উষ্ণতা পৌঁছতে পারে না— এদিকে আমি স্বদেশেও শীতকাতুরে, প্রতিটি রাত্রি আমার পক্ষে যন্ত্রণা। এই অদ্ভুত দেশে সন্ধে ছ-টাতেই নৈশ ভোজনে বসে যেতে হয়, রাত্রি তাই দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। তবু অন্তত মহিলা-বিদ্যালয়ের ভোজনশালাটি উজ্জ্বল ও সুতপ্ত, অনেকগুলো মানুষের মুখ দেখা যায় সেখানে, শোনা যায় অনেক তরুণীকণ্ঠের কলস্বর, অনেক হাসি, কথা, আহারের শুরুতে ও ফাঁকে-ফাঁকে নিয়মমাফিক কোরাস গান—আমার কর্মিণীশ্রেণীর টেবিল-সঙ্গিনীরা তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে আমাকেও অন্তর্ভূত করেন। কিন্তু—হয়তো আমারই স্বভাবের দোষে—আমি ভুলতে পারি না যে আমি একজন বাইরের লোক, মনে হয় যেন ভুল জায়গায় চলে এসেছি—আর যখন, ভোজনের পালা সাঙ্গ, আমি উঠে আসতে থাকি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আবার আমার হিমাক্ত আস্তানায়, তখন থেকে আমার চিন্তা : এই ঠান্ডা লম্বা রক্ত-জমানো রাত্তিরটাকে কেমন করে কাটাবো? বার-বার চা খেয়ে, বার-বার গরম জলের ব্যাগ নিয়ে, হাতে হাত ঘষে, পাইচারি করে, আমি কোনোমতে সচল রাখি নিজেকে, দিগ্বিদিকে চিঠি লিখে-লিখে অনেকগুলো ঘণ্টা পার করে দিই। কিন্তু কোনো-এক সময়ে শুয়ে না-পড়ে উপায় থাকে না, আর বিছানায় গা ঠেকানোমাত্র মনে হয় বরফ-জলের চৌবাচ্চায় ঝাঁপ দিয়েছি। তিনটে কম্বলের তলায় শীত আমাকে চাবুক মেরে-মেরে জাগিয়ে রাখে— টোমাস মান্-এর য়োসেফ-কাহিনীও সেই কষ্ট ভোলাতে পারে না— আমার কানে আসে নেকড়ের চীৎকার, ডাইনির হুল্লোড়, উত্তরমেরুর বাতাসের দল যেন জগৎটাকে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলছে। আর এমনি একটি রাত্রে, আমার নিঃসঙ্গতা ও শূন্যতাবোধ ও নির্যাতনকারী শীতের মধ্য থেকে, অতর্কিতে একটি “শীতরাত্রির প্রার্থনা” বেরিয়ে এসেছিলো : আমার জীবনের শেষ কবিতা যেটা আমি ‘তোড়ে’ লিখেছিলাম, অথবা যেটা বলতে গেলে প্রায় নিজেকে দিয়েই নিজেকে লিখিয়ে নিয়েছিলো। 

এসো, ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থ্যের ভাবনা, 
এর পর কী হবে, এর পর, 
ফেলে দাও ভবিষ্যতের ভয়, আর অতীতের জন্য মনস্তাপ 
আজ পৃথিবী মুছে গেছে, তোমার সব অভ্যস্ত নির্ভর 
ভাঙলো একে-একে; —রইলো হিম নিঃসঙ্গতা, আর অন্ধকার নিস্তাপ  
রাত্রি; —এসো প্রস্তুত হও। 

এসো, আস্তে পা ফ্যালো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসো তোমার শূন্য ঘরে—
তুমি ভ’রে তুলবে, তাই শূন্যতা। তুমি আনবে উষ্ণতা, তাই শীত।
এসো, ভুলে যাও তোমার টাকার ভাবনা, বাঁচার ভাবনা, হাজার ভাবনা—
আর এর পরে 
তোমার দিকে এগিয়ে আসবে ভবিষ্যৎ, পিছন থেকে ধরে ফেলবে অতীত। 
এসো, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও আজ রাত্রে। 

“চিল্কায় সকাল”-এর মতো এটাকেও বলা যায় প্রত্যক্ষভাবে আত্মজৈবনিক, এর দীর্ঘায়িত গদ্যছন্দে আমার পিটসবার্গ-প্রবাসের ভাবচ্ছবি মুদ্রিত হয়ে আছে; কিন্তু শুধু একটি মুহূর্তের প্রজাপতিকে আটকে ফেলা হয়নি এখানে—এটার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে আমার সেই সময়কার সম্পূর্ণ মন, তার সব বেদনা ও বেদনাসঞ্জাত আকুতি নিয়ে। এই ‘বরফ-ভাঙা’ আরম্ভ থেকে তক্ষুনি অন্য কবিতা জন্মালো না, কিন্তু অন্তত আমার আত্মবিশ্বাস কথঞ্চিৎ ফিরে এলো, আর— বলতে ভালো লাগছে—দেশে ফিরে যাবার আগেই এই ‘প্রার্থনা’র সম্মতিসূচক উত্তর আমি যেন শুনতে পেলাম। 

শীত শেষ—অথবা প্রায় শেষ; সূর্য উত্তরায়ণে। আমি ছুটি পেয়েছি অপ্রিয় পিটসবার্গ থেকে, মার্কিন মহাদেশের তট থেকে তটান্তর পর্যন্ত ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। আমার চেনা হচ্ছে অনেক নতুন মানুষের সঙ্গে, অনেক মনোমতো মানুষের সঙ্গে; তাদের সাহচর্যে একটু-একটু করে ভালোবাসতে শিখছি সেই দেশটাকেও, যাকে এতদিন ভেবেছি অনাত্মীয় ও বিজাতীয়। বরাতজোরে আমার শেষ তিনমাস কাটলো ন্যুয়র্কে, ক্রমশ আরো দীর্ঘ- এবং উষ্ণ-হয়ে-ওঠা দিনের মধ্য দিয়ে একেবারে কর্কটক্রান্তি পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত—চিত্রশালা, বইয়ের দোকান, বহু জাতি এবং বহু ভাষায় সমৃদ্ধ সেই সমুদ্রবেষ্টিত মহানগর যেখানে পথে বেরোলেই জীবনের একটি তীব্র বেগ অনুভব করা যায়, বিদেশীকে অতি সহজে আপন করে নেয়া যার বহুকালের অভ্যাস। আমার প্রবাসজীবনের এই শেষ পর্যায়ে আমি নতুন অভিজ্ঞতা আহরণেই ব্যস্ত ছিলাম; নিজের কাছে যখন ফিরে এলাম তখন আমি ভারতপথে যাত্রী। 

চলেছি এক সুবৃহৎ অর্ণবপোতে আটলান্টিক পেরিয়ে। আমার পক্ষে অকল্পনীয় সব বিলাসিতা, আমার পক্ষে সুদূর এক যাত্রীর দল যারা বদ্ধপরিকরভাবে সম্ভোগপরায়ণ, পান ভোজন আমোদপ্রমোদের বৃত্তে বাঁধা এক আয়োজিত ও কৃত্রিম জীবনযাত্রা–এ-সবের মধ্যে আমি আবার নিজেকে নিঃসঙ্গ বলে অনুভব করলাম, পিটসবার্গের মতো তিক্তভাবে যদিও নয়। তফাৎ এই–আর মস্ত তফাৎ সেটা–যে আমি এখানে বিরামহীন দ্বৈত গতির মধ্যে অবস্থিত; জল যেমন নিত্যচঞ্চল তেমনি জলযানটিও কখনো থামছে না; আমার নিঃসঙ্গতা তটরেখাহীন সমুদ্র জুড়ে ছড়িয়ে আছে, ঢেউয়ের পর উত্তাল ঢেউয়ে দুর্বোধ ভাষায় কথা বলছে যেন;—এই জগৎ-বিচ্ছিন্ন জঙ্গম দ্বীপে এরাই আমার সহযাত্রী। আমার ভাগ্যে আমি একলা একটি ক্যাবিন পেয়েছি, চেষ্টা করে জুটিয়ে নিয়েছি ভোজনশালার এক কোণে একটি একলা টেবিল; আমার সময় কাটে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে, জাহাজের এক তলা থেকে অন্য তলায় ও এক মহল থেকে অন্য মহলে ঘোরাঘুরি করে, নানা ধরনের কাগজে-এনভেলাপে সমৃদ্ধ ও জনবিরল চিঠি লেখার ঘরটি আমার একটি প্রিয় স্থান। মাঝে-মাঝে মধ্যরাত্রে জাহাজের চূড়ান্ত ছাদে উঠে যাই— দাঁড়াই কয়েক মুহূর্ত আকাশের তলায় জগৎ-জোড়া অন্ধকারের মধ্যে, একটি-দুটি কুয়াশা-ম্লান নক্ষত্রের মুখোমুখি। অনেকের মধ্যে তালগোল পাকানো আমোদপ্রমোদে স্বভাবতই রুচি নেই আমার, তাছাড়া অন্য একটি কারণেও আমি লোকসঙ্গ থেকে বিবিক্ত রাখছি নিজেকে। আমার মনের মধ্যে এক অস্পষ্ট সঞ্চরণ আমি শুনতে পাচ্ছি; আমি তাকে পথ ছেড়ে দিতে চাই, কোনো অবান্তর মেলামেশায় বিক্ষিপ্ত হতে চাই না। ধীরে-ধীরে একটি সামুদ্রিক কবিতা লিখলাম জাহাজে বসে, লন্ডনের হোটেলে এসে আরো একটি, কয়েক সপ্তাহ পরে বম্বাইগামী ইটালিয়ান জাহাজে আরো দুটি লেখা হয়ে গেলো। কলকাতায় ফিরে বুঝলাম ঐ পথে-পথে লেখা কবিতা চারটি “শীতরাত্রির প্রার্থনা”র মতো আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়— এরা একটা নতুন আরম্ভ, আরো কবিতা আমার উপর দাবি জানাচ্ছে। 

*

কলকাতায় সুধীন্দ্র দত্তর সঙ্গে দেখা হতে তিনি বললেন, ‘আপনার “শীতরাত্রির প্রার্থনা” আমার ভালো লাগলো–only that there are too many “মতো”s।’ আমি বুঝতে পারলাম তিনি কী বলতে চাচ্ছেন, কিন্তু ততদিনে আমি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিয়েছি যে এমন কোনো থিওরি হতে পারে না, যা সব কবির বা সব কবিতার উপর সমানভাবে প্রয়োজ্য। তবু : আমি এর পরে যে-সব কবিতা লিখবো, বা লিখতে চাচ্ছি, অথবা সেই জাহাজে লেখা লাইনগুলি যাদের ডেকে আনছে, আমার মনের মধ্যে যাদের নড়া-চড়া আমি টের পাচ্ছি প্রতিদিন, কিন্তু কে ম ন ক রে তাদের বের করে আনবো ভেবে পাচ্ছি না— আমার সেই গোপন সমস্যাটিকেই সুধীন্দ্র যেন আরো একটু উস্কে দিলেন ঐ মন্তব্য করে। আমার নিজেরই কাছে এই কথাটা এখন স্পষ্ট যে আমার পুরোনো ধরনে ফিরে যাওয়া আর চলবে না; আমি যার জন্য হাতড়ে ফিরছি তা নতুন একটা স্টাইল, আমার হয়ে-উঠতে -থাকা কবিতাগুলির পক্ষে সেটাই খুব জরুরিভাবে দরকার। আমাকে ছেড়ে দিতে হবে সরলতার পথ; বলতে হবে উক্তির বদলে চিত্রকল্প দিয়ে, ঘোষণার বদলে ছবির সাহায্যে; যা বলতে চাচ্ছি তার বদলে অন্য কিছু বলতে হবে হয়তো, আসল কথাটা লুকোনো থাকবে অথচ থাকবে না। আর এর জন্য চাই এমন ভাষা যা নির্ভার অথচ অগভীর নয়, যা গম্ভীর সংস্কৃতের পাশে ছিপছিপে কথ্য বুলিকে মানিয়ে নিতে পারে, ভালোমানুষের মতো চেহারা নিয়েও যা অভিনয়নিপুণ। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লম্বা ফরমাশ’ এ হলো তা-ই; আমি কি অতটা পেরে উঠবো? যথেষ্ট পরিমাণ শব্দ আমার মজুত আছে কি? নিজেকে আঁটো হাতে চেপে রাখার ক্ষমতা? আবার বেশি যত্নে ফাঁদ বানাতে গিয়ে পাখিটাকে জখম করবো না তো? এমনি নানান অস্বস্তি আমার মনে, তার উপর আমার চিরকালের চেনা পরিবেশের মধ্যে ফিরে আসামাত্র আমাকে আবার হানা দিচ্ছে সেই পাতা-জোড়া-জোড়া কাটাকুটির বিভীষিকা—যদি এবারেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে আমি তা কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না। 

আমি আরম্ভ করলাম খুব সতর্কভাবে, যেন পা টিপে-টিপে চলছি। রচনা করি মনে-মনে, অদলবদল করি মনে-মনে–পাকাপোক্ত কয়েকটা লাইন মনের মধ্যে তৈরি না-হওয়া পর্যন্ত খাতার গায়ে আঁচড় কাটি না–কেননা আমার প্রতিজ্ঞা এই যে চাক্ষুষ কাটাকুটি যে-করে হোক ঠেকিয়ে রাখবো। লিখছি বেশির ভাগ ছোটো কবিতা, তাই এই মানসরচনার কৌশল খাটানো সম্ভব হচ্ছে; আর প্রাথমিক কয়েকটি পদক্ষেপের পরে আমি আশ্রয় পেলাম সনেটের রূপকল্পে, তার নিয়মের মধ্যে ধরা দিয়ে নিজেকে অনেকটা নিরাপদ বলে মনে হলো। সেই সনাতন চোদ্দ লাইন, স্তবকের বিভাগ, পর্যায়বদ্ধ মিলের শৃঙ্খল; সেই পরিসরের ক্ষীণতা যা বাহুল্যকে নিষিদ্ধ করে দেয়; সেই অনমনীয় শাসন যা স্বাধীনতাকে চেষ্টার দ্বারা অর্জনীয় করে তোলে—এগুলোই যেন এগিয়ে নিচ্ছে আমাকে, ইঞ্চি মেপে মেপে, এমন এক পরিণামের দিকে যা হয়তো আমার পরিকল্পিত ছিলো না। ‘আর তিন লাইন বাকি! ‘এ-ই শেষ লাইন!” এ-রকম কথা বলতে পারা কবির পক্ষে অতি সুখের সন্দেহ নেই, কিন্তু এই সুখের বিনিময়ে দুরন্ত খাটুনি খাটতে হয় আমাকে— কখনো একটি মিল খুঁজে-খুঁজেই সারাটা বেলা কেটে যায়, কখনো বা শেষ লাইনটা তুর্কি-নাচন নাচিয়ে ছাড়ে। আমার এই প্রয়াস চললো তিন বছর ধরে, থেমে-থেমে, কিন্তু ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্যুত না-হয়ে—একটি কবিতার টানে আর-একটি কবিতা বেরিয়ে আসতে লাগলো। ‘যে-আঁধার আলোর অধিক’ বইয়ের জন্য প্রেস-কপি যখন তৈরি করছি তখন দেখলাম তারা সংখ্যায় তেমন বেশি নয়—কিন্তু পরিমাণের প্রাচুর্য দিয়ে কী-লাভ হতো আমার, যদি পুনর্বিবেচনায় ধরা পড়তো যে অনেকগুলো বা এমনকি একটি-দুটিও—বই থেকে বর্জনীয়? 

‘যে-আঁধার আলোর অধিক’-এর জন্মকথা নিয়ে এত কথা বললাম এইজন্যে যে এটা আমার জীবনের এক সন্ধিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্য দিয়ে একটি সংকট আমি কাটিয়ে উঠেছিলাম, এবং এর দ্বারা লব্ধ অভিজ্ঞতা আমার পরবর্তী সব কাব্যরচনায় কাজে লেগেছে―সেগুলি আকারে-প্রকারে যতই না ভিন্ন হোক। 

*

কবিতা লেখার একটা অসুবিধে এই যে সেটা বাঁধা-বরাদ্দ কোনো কাজ হতে পারে না, আপিশের দশটা-পাঁচটার মতো নিশ্চিন্ত ও ব্যাপৃত রাখতে পারে না সারাদিন ও সারা বছর ধরে–অন্তত আজকের দিনে অবস্থাটা তা-ই, যখন পদ্যছন্দে উপন্যাস লেখার প্রচলন লুপ্ত হয়ে গেছে। কোনো কবিতা বা কবিতাগুচ্ছ নিয়ে পড়ে থাকা যায় কয়েকটা দিন, কয়েকটা সপ্তাহ, এমনকি হয়তো দু-চার মাস একটানা; কিন্তু তারপরেই আসে অবকাশ–সেটা দীর্ঘায়িত হলে সুখদায়ক ছুটির ঘণ্টা আর থাকে না, হয়ে ওঠে কর্মহীনতার শূন্যতাবোধ। পৃথিবীর কবিদের মধ্যে, আমি যতদূর জানি, সবচেয়ে অধিকসংখ্যক কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তিনিও তাঁর জীবনের প্রত্যহ কবিতা লেখেননি–অন্য সময়ে তিনি কী করেছেন তা বাংলা দেশে কেউ নেই যিনি জানেন না, এখানে তার উল্লেখ বাহুল্য হবে। রবীন্দ্রনাথের সহস্ররশ্মি প্রতিভা তাঁকে শূন্যতাবোধ থেকে রক্ষা করেছিলো, কিন্তু যাঁরা অবৃহৎ কবি এবং কবিতা লেখা ভিন্ন অন্য কোনো কর্ম করেন না, তাঁদের জীবনে এই শূন্যস্থান-পূরণ কত কষ্টকর একটি সমস্যা হয়ে উঠতে পারে, রিলকের চিঠিপত্রে তার বিস্তীর্ণ ঘোষণা পাওয়া যায়। ঠিক এই সমস্যাটি আমার জীবনে তেমন বড়ো হয়ে ওঠেনি, কেননা আমি অবৃহৎ হলেও একমুখী নই, প্রচুর পরিমাণে গদ্যরচনাও লিখেছি, সাহিত্যসম্পৃক্ত অন্য দু-একটা কাজের দিকেও আমার আগ্রহ ছিলো। কিন্তু মনের যে-সব বৃত্তির দ্বারা আমরা উপন্যাস বা সমালোচনা লিখি, বা পত্রিকার সম্পাদনা করি, কবিতা ঠিক সেখান থেকে নিঃসৃত হয় না; এবং এমন সময় মাঝে-মাঝে আসেই যখন কবিতা লেখার জন্য আঙুল যেন নিশপিশ করে অথচ নিজের কোনো বলার কথা জমে ওঠেনি। এ-রকম সময়ে একটিমাত্র সন্নিকট বিকল্প হাতে আছে আমাদের : তা হলো অন্যের কবিতার অনুবাদ-রচনা। এই বিকল্পটি আমি অনেকবার ব্যবহার করেছি— ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ লেখার সময় থেকে বলা যায় প্রায় ধারাবাহিকভাবে, এই সেদিন পর্যন্ত। আমার সমগ্র কাব্য রচনার মধ্যে অনুবাদগুলিকে আমি নগণ্য বলে ভাবি না; এরাও আমার সচেতন প্রয়াসের ফলাফল, এবং কিছুটা দৈবেরও দান। 

সেবারে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর আমি কয়েকমাস একটি ইংরেজ প্রকাশন-সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। সপ্তাহে তিনদিন অপরাহ্ণে আমাকে আপিশে যেতে হয়; আমি গড়িয়াহাট মোড় থেকে ওয়েলেসলি-ধরমতলা ট্রাম ধরি—কেননা সেটাতে আসনের কখনো অভাব হয় না আমার সঙ্গে থাকে রাজশেখর বসু- সম্পাদিত ‘মেঘদূত’ বইখানা, যেহেতু সেটি আকারে ছোটো এবং ওজনে হালকা, ভিড়াক্রান্ত ফিরতি ট্রামে স্বচ্ছন্দে পকেটে চলে যায়, এবং যেহেতু কবিতাটা আমার চমৎকার লাগছে। রাজশেখর বসুর সংস্করণটি বেরোবার পর থেকেই সেটি আমার অন্যতম প্রিয় পুঁথি হয়ে উঠেছিলো, প্রতি বর্ষায় একবার করে পড়তাম;- কিন্তু সে-বছর, কলকাতার প্রখর গ্রীষ্মে ট্রামে যেতে-যেতে, চলতি পথের পঁচিশ মিনিটে তিনটি অথবা চারটি করে শ্লোকে নিবিষ্ট হতে-হতে, আমার মনে হলো ‘মেঘদূতে’র অন্তর্নিহিত সব সৌন্দর্য ও বিস্ময় আমি এই প্রথম অনুভব করছি। এর কয়েকমাস বা বছরখানেক পরে একদিন জ্বরে শুয়ে শুয়ে পূর্বমেঘের প্রথম কয়েকটা শ্লোক অনুবাদ করে ফেললাম—নেহাৎই খেলাচ্ছলে, বা রোগের নিষ্ক্রিয়তা কাটাবার জন্য। সে-সময়ে কল্পনাও করিনি পুরো কাব্যটির অনুবাদ আমার সাধ্যে কুলোবে; কিন্তু আরম্ভে যা ছিলো খেলা, তা-ই যখন হয়ে উঠলো একটা কাজ, একটা দায়িত্ব যা আমি মেনে নিয়েছি মাথা পেতে, স্বেচ্ছায় তখন দেখলাম যে ধীরে-ধীরে, অনেক চেষ্টায়, সেই দায়িত্বপালনের শক্তিও আমি পেয়ে যাচ্ছি নিজের মধ্যে। এমনি দেখেছি আমি বার-বার—বোদলেয়ার, রিলকে, হোল্ডার্লিন অনুবাদ করতে গিয়েও; অসম্ভব ভেবে অনেকদিন পর্যন্ত যে-কবিতাটার কাছে ঘেঁষিনি, অথচ যেটার প্রতি আমার আকর্ষণ প্রবল, হঠাৎ কোনো শুভ লগ্নে সেই অপ্রবেশ্যার দ্বার খুলে গেছে আমার জন্য। যতক্ষণ আমরা কানে-কানে ধনুকের ছিলা না টানছি ততক্ষণ আমরা আমাদের ক্ষমতার সীমা জানতে পারি না–লেখকের জীবনে ধৈর্য ও পরিশ্রমই সব। 

কিন্তু বিশেষ-বিশেষ কবিতাই শুধু নয়—কোনো কবি অথবা কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে আমাদের প্রণয়বন্ধনও অনেক সময় দৈবের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। এর দৃষ্টান্ত আমার জীবনে বোদলেয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রাবস্থার শেষ বছরে–খুব সম্ভব সুইনবার্ন মারফৎ—এই ফরাশি কবির অস্তিত্ব আমি প্রথম জেনেছিলাম, ইংরেজি অনুবাদে তাঁর একটি কাব্যসংকলনও আমার হাতে এসেছিলো এবং এতদূর পর্যন্ত মনে ধরেছিলো যে দুটি-তিনটি গদ্যকবিতার তর্জমাও আমি করে ফেলেছিলাম। কিন্তু এর পরেই বইটি হারিয়ে যায়, আমার দিগন্ত থেকে বোদলেয়ার অপসৃত হন; আমার কলকাতার জীবনের বিবর্ধমান ব্যস্ততা ও বিক্ষেপের ভিড়ে হয়তো আমি আর তাঁকে খুঁজেও পেতাম না—যদি না একদিন, প্রায় কুড়ি বছর পরে, হঠাৎ আমার চোখে পড়তো পার্ক স্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানে একটি রোগা বই, যার জ্যাকেটের উপর বিরাট অক্ষরে ‘BAUDELAIRE’ নামটি অঙ্কিত। সেদিন আমি নির্দিষ্ট কোনো বইয়ের খোঁজে যাইনি, আমার তল্পিও ছিলো যৎকিঞ্চিৎ—বইখানাকে উল্টে-পাল্টে দেখে রেখে দিতে হলো। ফিরে এলাম পরের দিন— পকেটে দশটাকার নোট, আর মনে দুরুদুরু ভয় পাছে বিক্রি হয়ে গিয়ে থাকে; যা হাতে করে সেই দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম তাকে ক্রীত কোনো সামগ্রীর বদলে অদৃষ্টের উপহার বললেই ঠিক হয়। মনে পড়ে ফিরতি ট্রামে ভিড় ছিলো, আমি জানলায় ঠেশান দিয়ে দাঁড়িয়ে বইখানা চাখছি—একটি, দুটি, তিনটি কবিতা অথবা হয়তো একটাই বার-বার। অনুবাদ ছিলো সরল ও আক্ষরিক গোছের, বাঁয়ের পৃষ্ঠায় মূল ফরাশি ছাপানো ছিলো— কিন্তু ফরাশি ভাষায় আমার অনভিজ্ঞতা ও ইংরেজ অনুবাদকের শিল্পহীনতা অতিক্রম করে বোদলেয়ার আমার মধ্যে প্রবিষ্ট হলেন, আমার মন যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো বাইরের ঐ পড়ন্ত বেলার রৌদ্রেরই মতো যেন এই কবিরই অপেক্ষায় আমি ছিলাম এতদিন, যেন আমি নিজের অজান্তে এ-মুহূর্তে যা প্রার্থনা করছিলাম, এই কবিতাগুলি ঠিক তা-ই। সেবারেও একগুচ্ছ অনুবাদ আমি করেছিলাম ও পত্রিকায় ছেপেছিলাম, কিন্তু ‘কালিদাসের মেঘদূত’ বইটা বেরোবার পর আমি যখন বোদলেয়ার অনুবাদে হাত দিলাম, তখন আমার আগেকার প্রয়াসগুলিকে আমি বাতিল করে দিয়েছি— কেননা ততদিনে, প্রায় দশ-বছর-ব্যাপী সহবাসের ফলে, বোদলেয়ারের কবিতা ও ব্যক্তিত্ব ও জীবনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গভীর হয়ে উঠেছে। 

একটা সময়ের কথা মনে পড়ে। আমি তখন নতুন-খোলা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টারি করছি; শীতকাল। আমি ক্লাশ পড়াই সকালবেলায়; বেলা একটা নাগাদ আটের-বি বাস্-এ বসে আমার ভাবতে ভালো লাগে যে বাড়িতে আমার জন্য বোদলেয়ার অপেক্ষা করছেন। আমি আহার সেরে বসে যাই টেবিলে; শীতের বেলা দেখতে-দেখতে পড়ে আসে, উল্টোদিকের রাস্তাটাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য রঙিন করে তোলে স্কুল-ছুট মেয়েদের দল, শুকনো হাওয়ায় খাতার কাগজ কুঁকড়ে যায়, খুলে-রাখা ফাউন্টেনপেনের মুখে কালি যায় শুকিয়ে আমার উত্তরমুখো ঘর অন্ধকার আর ঠান্ডা, আমি একটার বদলে দুটো ফ্লুওরেসেন্ট বাতি জ্বেলে একটার পর আর-একটা অনুবাদে হাত লাগাই। কখনো-কখনো রাত্রে ঘুমের সময় পর্যন্ত বোদলেয়ারকে নিয়েই কেটে যায় আমার—হয়তো আরো একবার পড়ি তাঁর ‘অন্তরঙ্গ ডায়েরি’ বা চিঠিপত্র, আরো একবার কোনো চিরনতুন কবিতা—অথবা পাতা-খোলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ভাবি এই কবিতাটার অনুবাদ আমাকে দিয়ে হতে পারে কিনা। 

*

আগে বলেছি বিকল্প, পুরোপুরি ঠিক কথা বলিনি। আমি অন্তত অনুবাদকে দুধের বদলে ঘোল বলে ভাবতে পারি না; আমার মনে হয় সেটাও একটা সৃষ্টিকর্ম; তারও জন্য চাই প্রেরণা, যার উৎপত্তিস্থল মূল কবির প্রতি প্রেম আর কখনো বা তাঁর সঙ্গে একাত্মবোধ; তাতেও আছে সেই আনন্দ যা সত্যিকার নিজস্ব কিছু লেখার সময় প্রাপ্ত হই আমরা; আর সেটাও বিস্তর খাটিয়ে নেয় আমাদের, ব্যবহার করে আমাদের সব বুদ্ধিবৃত্তি ও অভিনিবেশ। আমার পক্ষে এই খাটুনি দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ হয়েছিলো, কেননা আমি অন্বয়ের সাহায্যে কালিদাস যদি বা পড়ে উঠতে পারি, ফরাশি ও জর্মান ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় যৎসামান্য। অভিধানের সাহায্যে, ভাষাবিদ বন্ধুদের সাহায্যে, অনেকগুলি ইংরেজি অনুবাদের সাহায্যে, এই অভাবের পরিপূরণ করতে হয়েছে আমাকে— অন্তত পরিপূরণের জন্য যতদূর সম্ভব চেষ্টা চালাতে হয়েছে। উপরন্তু আমি স্থির করেছিলাম যে প্রতিটি রচনায় মূলের রূপকল্প অবিকল বজায় রাখবো; তার মিল অথবা মিলহীনতা, তার পঙক্তিসংখ্যা ও পঙক্তিসজ্জা, মিল এবং স্তবকের বিন্যাস— কোনো-কিছুতেই ব্যত্যয় হতে দেবো না; আর তাইতে আমার কাজটির দুরূহতা আরো কয়েক ডিগ্রি চড়ে গিয়েছিলো, বোদলেয়ার ও রিলকের কোনো-কোনো কবিতাকে চারবার বা পাঁচবারের চেষ্টায় তবে ঠিকমতো বাগাতে পেরেছিলাম। আমার এই পরিশ্রমের ফলে পাঠকসমাজের কোনো লাভ হয়েছে কিনা সে-বিচার তাঁরা করবেন, কিন্তু আমার দিক থেকে এ যে কত সার্থক হয়েছিলো তা অন্য কাউকে বুঝিয়ে বলা শক্ত। অনুবাদের কারণেই আমি প্রথম বুঝেছিলাম কোনো কবির পক্ষে অভিধানচর্চার অভ্যাসটি কত উপকারী, ভাষাতত্ত্বে অল্পবিস্তর জ্ঞান কত প্রয়োজনীয়; শিখেছিলাম মাতৃভাষায় অনেক নতুন শব্দ, এবং নতুন শব্দ তৈরি করে নেবার উপায়; বুঝেছিলাম শব্দব্যবহারে যাথার্থ্যের মূল্য; বাংলা ছন্দকে আরো একটু সাবলীলভাবে চালাতেও হয়তো শিখেছিলাম। আজকের দিনে রচনাকর্মকে আমি যে-ভাবে দেখি এবং চিন্তা করি, যে-সব সমস্যা তা উপস্থিত করে এবং যে-ভাবে তার সমাধানের পথ খুঁজে পাই; যে-ভাবে, ধরা যাক, আমার সাম্প্রতিক কবিতা ও গদ্য- কবিতা ও কাব্যনাট্য, এমনকি কোনো-কোনো গদ্যরচনা আমি লিখেছিলাম, তার মধ্যে কতখানি আমার অনুবাদকর্মের অবদান আছে, আমি তা মনে-মনে ভালোই জানি। 

*

কিন্তু কবি যতই স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে তথ্য টেনে আনুন, যতই কেরামতি খাটান সমালোচকেরা, কবিতার জন্মকথা সম্পূর্ণরূপে অনাবৃত হয় না কখনো, তার একটা অংশ চিরকাল গোপন থেকে যায়—আর সেই অংশটাই আসল। কোনো কবিতা যেদিন উপ্ত হলো, তারপর থেকে কতকাল গর্ভবাস চলবে, এমনকি সেটি আদৌ কখনো ভূমিষ্ঠ হতে পারবে কিনা, এই মোটা হিশেবটাও কোনো বিজ্ঞান কষে উঠতে পারে না, কবির নিজের পক্ষেও তা ধারণাতীত। আমি আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় এর নানারকম নমুনা দেখেছি। আমার যৌবনের যে-সব কবিতাকে এখনো আমি ‘আমার’ বলে ভাবতে পারি, তার বেশির ভাগ যেন মনে হওয়ামাত্র বেরিয়ে এসেছিলো একেবারে নিটোল চেহারা নিয়ে, মাজাঘষার অপেক্ষা না-রেখে। আবার; সেই প্রথম উচ্ছ্বাস যখন নিঃশেষ, যখন আমি আর প্রকৃতির হাতে অচেতনভাবে চালিত হচ্ছি না, তখন কোনো-কোনো কবিতা লিখে উঠতে আমার সময় লেগেছে পাঁচ থেকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত। এই কথাটায় একটুও অত্যুক্তি নেই, কেননা “লেখা’ বলতে শুধু কাগজের উপর কলম চালানোকেই বোঝায় না; আদি কল্পনা ও তৈরি লেখাটার মধ্যে, কোনো অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় কারণে, কখনো-কখনো মস্ত ব্যবধান ছড়িয়ে পড়ে। নিশ্চয়ই নেপথ্যে চলে অনেক আয়োজন, অনেক নতুন বিন্যাস ঘটে কবির জীবনে, অনেক আহরণ ও বর্জন ও সমন্বয়—কিন্তু সেগুলির সঙ্গে অলিখিত ও অপেক্ষমাণ কবিতাটির সম্পর্ক কী, কেমন করে সেটিকে তা পুষ্টি দেয় ও জন্মের জন্য প্রস্তুত করে তোলে, সেই প্রক্রিয়াটি ঘটে সচেতন ও অচেতন মনের সীমান্তরেখায়—কবি তার কিছুটা মাত্র টের পান, বাকি অংশ অর্ধালোকে প্রচ্ছন্ন থাকে। ‘মরচে-পড়া পেরেকের গান’, ‘একদিন : চিরদিন’ ও ‘স্বাগতবিদায়’— আমার এই শেষ তিনটে কবিতার বইয়ে এর অনেকগুলো উদাহরণ আছে। 

সেদিন ছিলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতা কাঁপছে। কোনো-একটা লম্বা ছুটি আসন্ন, আমরা শিগগিরই বোমাতঙ্কহীন ঢাকায় যাচ্ছি; -হয়তো স্বগৃহ ছেড়ে বেরোতে হবে বলে, বা অপরাহ্ণের মলিনতার জন্য, আমার মন বিষণ্ণ হয়ে আছে। আমি রাস্তায় নেমে পনেরো আনা মূল্যে এক টিন প্লেয়ার্স সিগারেট কিনলাম—তখনই বোঝা যাচ্ছিলো ঐ বস্তুটি আর বেশিদিন পাওয়া যাবে না। আমি তাকিয়ে দেখলাম সারা আকাশ ধোঁয়াটে আর ফাঁকে-ফাঁকে অসুস্থ ধরনের হলুদ-রঙা, হাওয়া বইছে জোলো আর এলোমেলো যেন চারদিকে কোনো অমঙ্গল-বার্তা ছড়িয়ে-ছড়িয়ে। কোনো-এক আদিম কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে আমি অনুভব করলাম এ যেন কোনো চিরবিদায়ের মুহূর্ত, কোনো দূরযাত্রার ইঙ্গিত— আমার মনে ছবি ফুটে উঠলো এক হালকা নৌকো উত্তাল ঢেউয়ের উঁচু-নিচু পেরিয়ে চলেছে, দিগম্ভ সন্ধ্যার রঙে লাল। ‘আকাশ কান্নায় অন্ধকার/বাতাসে বিদ্যুৎ কম্পমান—’ এই লাইন দুটো ভেসে উঠলো আমার মনে, আমি ঘরে এসে খাতার কোণে তা লিখেও রাখলাম, সঙ্গে আরো এক-আধটা লাইন, এবং কয়েকটা সম্ভবপর মিল। কিন্তু সেই পড়ে-পাওয়া লাইন দুটো তেমনি পড়ে রইলো তার পরে—বছরের পর বছর, আর অবশেষে “আরোগ্যের তারিখ” বলে যে-কবিতাটায় আশ্রয় পেলো, তার পিছনে ছিলো আমার সেবারকার ‘কুইন ম্যারি’ জাহাজে আটলান্টিক পাড়ির স্মৃতি, অন্তর্বর্তী আরো দু-একটা অভিজ্ঞতা, এবং আমার আসন্ন বার্ধক্যের হিম অনুভূতিও ছিলো। 

আর-একদিন—এটা আরো আগেকার কথা মনে হয়–আমি একদিন কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল থেকে গড়িয়াহাটের ট্রামে বাড়ি ফিরছিলাম। সবেমাত্র দুপুর পেরিয়ে বিকেল পড়েছে, ট্রামে ভিড় নেই, রৌদ্রময় ঈষদুষ্ণ এক দিন। ট্রাম যখন পার্ক সার্কাসের গোল চত্বর ঘুরে মোড় নিচ্ছে, আমার হঠাৎ মনে হলো এই দিন, এই মুহূর্ত আগেও একবার এসেছিলো আমার জীবনে—ঠিক আজকের মতো সূর্যালোকে এই পার্ক সার্কাসের মোড় আমি দেখেছিলাম—কিন্তু কেন এসেছিলাম এখানে, কাকে আমি খুঁজেছিলাম, তা এখন আর মনে করতে পারছি না। ‘মাঝে-মাঝে এক-একটা দিনকে মনে হয় অন্য কোনো দিনের মতো। যেন একটু ঠেলা দিলেই খুলে যাবে। একটু, আর-একটু।’—এই আরম্ভ থেকে পুরো একটা গদ্য-কবিতা আমি খুব অস্পষ্টভাবে ভেবেছিলাম তখন, “একদিন : চিরদিন” শিরোনামা পর্যন্ত–এ-সব টুকেও রেখেছিলাম খাতার পাতায়—কিন্তু এই ভ্রূণ যখন অক্ষরশরীরে প্রকাশিত হলো, তখন আমি আমার প্রৌঢ়ত্বেও প্রৌঢ়, আছি ব্রুকলিনে, ঋতু বসন্ত, আমার ঈষৎ-খোলা জানলায় মাঝে-মাঝে সমুদ্রের হাওয়া টের পাচ্ছি। একবার একটা নাটক ভেবেছিলাম সাবিত্রীকে নিয়ে বহুকাল ধরে লালন করছিলাম মনে-মনে —অবশেষে সেটা পর্যবসিত হলো একটি দীর্ঘ কবিতায়, রোম আর কীটসের মৃত্যু দিয়ে যার আরম্ভ, এবং যার শিরোনামায় ছাড়া সাবিত্রীর নাম উল্লিখিত হয়নি। কিন্তু আরো ভালো উদাহরণ হয়তো ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ ঐ নাটকটাকেও কাব্যজাতীয় রচনা বলে ধরে নিচ্ছি—সেটা আমি লিখেছিলাম আটান্ন বছর বয়সে, কিন্তু প্রথম যখন ভেবেছিলাম তখন আমি সবেমাত্র উত্তরতিরিশ। সেই আমি প্রথম নিচ্ছি কালীপ্রসন্নর মহাভারতের আস্বাদ; সব বিস্তার ও অনুপুঙ্খসমেত ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যান পড়ে চমকে উঠেছি—এর আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের “পতিতা”র বাইরে কিছুই জানতাম না। দুর্ভিক্ষের পশ্চাৎপট, গাঁয়ের মেয়েরা, অজ্ঞান কিশোর তপস্বী ও বিদগ্ধ চতুর বারাঙ্গনার প্রথম দৃষ্টিবিনিময়ের আশ্চর্য মুহূর্ত—এই সবই আমার কল্পনায় ধৃত হয়েছিলো তখন, রূপকল্পের আভাস জুগিয়েছিলো এলিয়টের ‘মার্ডার ইন দি ক্যাথিড্রেল’ নাটকটা। মনে পড়ে লিখেও ফেলেছিলাম গাঁয়ের মেয়েদের মুখে প্রথম দুটো লাইন সে-দুটো দিয়েই ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’র আরম্ভ, যদিও সাতমাত্রা ছন্দ ও প্রথম দুটো শব্দ ছাড়া আদি লেখনের আর কিছুই সেখানে রক্ষিত হয়নি। এ-ক্ষেত্রে আমি বোধহয় জানি আগে লিখে উঠতে পারিনি কেন, কেন আমাকে–বা রচনাটিকে—এত দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। প্রথম পরিকল্পনার সময় আমি ঋষ্যশৃঙ্গ বিষয়ে যথেষ্ট জানতাম না, বিষয়টির মর্মস্থলে প্রবেশ করিনি তখনও, সেটিকে একটি স্বকীয় রচনায় জীবন্ত করে তোলার মতো তহবিল আমার ছিলো না। সেগুলি সংগৃহীত হলো নানা দেশে ঘুরে বেড়াবার ও ক্লাশ পড়াবার সময়, পড়াবার জন্য অনেক বই ঘাঁটতে-ঘাঁটতে, আর বিশ্বপুরাণে আমার বিবর্ধমান কৌতূহলবশত। যাকে গবেষণা বলে সেটা পণ্ডিতমহলের মনোপলি নয়, মাঝে-মাঝে কাব্যরচনাতেও তার প্রয়োজন ঘটে, এই কথাটি বোঝার জন্য আমাকে অনেকগুলো বন্ধুর বছর বাঁচতে হয়েছিলো। 

এক শিক্ষাপ্রদ ব্যাপার, এবং কিছুটা কৌতুকেরও— লেখকের সঙ্গে তাঁর রচনার এই লুকোচুরি খেলা। কোনো সময়ে কিছু-একটা ভেবেছিলাম—দুটো লাইন, ঝাপসা কোনো বিষয়, চোখে-দেখা বা বইয়ে-পড়া কোনো মানুষ, কোনো চরিত্র, কোনো নাটকীয় মুহূর্ত, নিজের অথবা অন্যের জীবনের কোনো ঘটনার অঙ্কুর হয়তো : কিন্তু উড়ে-চলা সময়ের মধ্য দিয়ে এরা পড়ে আছে নিষ্ফল, আমি এদের না পারছি ভুলতে না বা কিছু বানিয়ে তুলতে–এদিকে আমার মাথার চুল প্রতি বছর ধূসর থেকে ধূসরতর। ইতিমধ্যে আমি অন্য কত কী কাজ করছি, ঘরে বসে অনেক রকম লেখা লিখছি আর বাইরে দূরেও ঘুরে বেড়াচ্ছি অনেক, আমার মন নতুন সুরে কাঁপছে, আমার উৎসাহ নতুন বিষয়ে সংলগ্ন; তবু সেই একদা-আরব্ধেরা ছেড়ে যাচ্ছে না আমাকে, চলেছে আমার সঙ্গে-সঙ্গে মোটর ট্রেন এরোপ্লেনে, লুকিয়ে থাকছে আমার ঘরের কোণে-ঘুপচিতে ধৈর্য ধরে, হঠাৎ মাঝে-মাঝে নড়ে উঠে জানান দিচ্ছে নিজেদের। আর শেষ পর্যন্ত যে-বিশেষ রূপ ও বিশেষ অর্থ নিয়ে তারা বেরিয়ে এলো, তা আরম্ভে আমার কল্পনায় ছিলো না। ভাবলে মনে হয় এরাই যেন বেছে নিয়েছিলো আমাকে, তার পরে আর নিস্তার দেয়নি, আমি না-জেনে যেন এতদিন ধরে এদেরই নির্দেশ মেনে চলছিলাম।–কিন্তু মাঝে-মাঝে উল্টো ঘটনা ঘটে না তাও নয়। 

কয়েক বছর আগে আমি একদিন পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে চৌরঙ্গি পার হচ্ছিলাম। উল্টো দিকে লাল আলো ছিলো, আমি শাদা সংকেতরেখার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি— হঠাৎ, আমি যখন ট্রাম লাইনের কাছাকাছি, সমস্ত চৌরঙ্গি অস্থির হয়ে দুলে উঠলো, আমি শুনলাম একপাল দোতলা বাস্-এর গর্জন, দেখলাম মোটরগাড়িগুলোর অপ্রতিহত তীব্রতা–আমার ডাইনে, আমার বাঁয়ে, আমার সামনে। ‘এ-ই শেষ—’ কথাটা ভাবতে-না-ভাবতে আমার সংবিৎ যেন অস্পষ্ট হয়ে এলো, আমার অস্তিত্ব ক্ষীণ সূত্রে ঝুলে আছে তারপর দেখলাম আমি ট্রাম-স্টপে দাঁড়িয়ে আছি, আমার সামনে পুকুর চারদিকে রোদ্দুর-মাখা দিন, গাছে একটা পাখি উড়ে এসে বসলো। ট্রামে যেতে-যেতে আমার অবাক লাগলো যে আমি ঠিক আগের মতোই আছি, আমার জ্ঞান নষ্ট হয়নি, সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অক্ষত আছে; আমার সারা মন জুড়ে ঘণ্টার মতো বেজে উঠলো ‘কী ভালো এই জীবন, কী ভাগ্য আমি বেঁচে আছি!’ বাইরে যা-কিছু দৃশ্য– চৌরঙ্গি, ভবানীপুর, কালিঘাট, টালিগঞ্জ, তারপর ছ-নম্বর বাস্—ধনী, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, বস্তি, পলেস্তরা-খসা জীর্ণ বাড়ি, বারান্দার রেলিঙে হেলান দিয়ে-দাঁড়ানো মহিলা— এই আকাশ, এই রোদ, এই মানুষের ভিড়—আমার চিরচেনা, কিন্তু আজ সব আমার চোখে নতুন, সব আশ্চর্য; আমার শান্ত চুপচাপ গাছের ছায়া-পড়া বাড়িটি ছবির মতো সুন্দর। ভেবে এসেছিলাম বাড়ি ফিরে প্রথমেই আমার স্ত্রীকে বলবো ঘটনাটা, কিন্তু বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। কী বলা যায়? ‘জানো, আমি আজ প্রায় বাস্-চাপা পড়ছিলাম … জানো, আমি আজ মরতে-মরতে বেঁচে গিয়েছি।’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কেন বাস্-এ ট্রামে ঘোরো বলো তো? ট্যাক্সি নিতে পারো না?’ —কী সাধারণ, কী তুচ্ছ এই কথাগুলো, কত দূরে এ-সব থেকে বাস্তব! সত্যি সেই আতঙ্কের মুহূর্তে আমার কেমন লেগেছিলো, তা কি আমার পঁয়ত্রিশ বছরের সঙ্গিনীকেও আমি বোঝাতে পারবো? না কি তুলনীয় অবস্থায় তিনি আমাকে বলতে এলে আমিই তা বুঝতে পারতাম? আমরা পরস্পরকে যতই না ভালোবাসি, আমাদের শরীর দুটো তো আলাদা, শরীরের মধ্যে দুই জীবনও আলাদা। অত্যন্ত আপন জনকেও কোনো আসল কথা বলা যায় না, পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ একলা। সেদিন এই ভাবনাটাই ঘুরে-ফিরে মনে পড়লো আমার, পরের দিন এটাকে একটা কবিতার মধ্যে বেঁধে ফেললাম তার নাম দিলাম “একটি অভিজ্ঞতা”। আমার সাম্প্রতিক রচনার মধ্যে এটাকে বলা যায় সেই জাতের, যা ‘মনে হওয়ামাত্র বেরিয়ে আসে’, কিন্তু “শীতরাত্রির প্রার্থনা”র মতো আবেগের ধাক্কা ছিলো না এর পিছনে; আমাকে লিখতে হলো ভেবে-ভেবে, থেমে-থেমে, কাটাকুটির জঙ্গল পেরিয়ে–ততদিনে চাক্ষুষ কাটাকুটি বিষয়ে ভয়ের ভাবটা আর নেই আমার, হয়তো নিজের উপরে আরো একটু আস্থাবান হতে পেরেছি। এই কবিতায় যেটুকু ‘প্লটে’র অংশ, বা তথ্য, সেটাকে আমি খুব ঝাপসা রেখেছিলাম এই আশায় যে কেউ-না-কেউ কখনো হয়তো বুঝে নেবে; সেটা কোনো পত্রিকায় ছাপা হবার পর একজন পাঠকের মন্তব্য শুনে মনে হয়েছিলো আমার চেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হয়নি। কবিরা ভাগ্যবান; তাঁরা অজানার উদ্দেশে বলতে পারেন। 

১৯৭৩ 

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন