সরু মোটা

প্রমথ চৌধুরী

আমি যখন আমার আত্মীয় শ্রীকণ্ঠবাবুর পুত্র নীলকণ্ঠের ফকিরহাট কাছারির আদায়কারী ছিলাম তখন একদিন শুনলুম যে, নীলকণ্ঠবাবুর দুজন বন্ধু পাড়াগাঁ দেখতে আসছেন। আমরা যেমন কলকাতায় যাই চিড়িয়াখানা দেখতে, তাঁরাও তেমনি কলকাতা থেকে মফস্বল নামক চিড়িয়াখানা দেখতে আসছেন এবং আমাদের কাছারিতে দিনকতক থাকবেন।

নীলকণ্ঠবাবুর কলকাতার বন্ধুরা স্টেশন থেকে তিন মাইল পথ এলেন একজন গোরুর গাড়িতে, আর একজন রামছাগলে টানা ছেলেদের ঠেলাগাড়িতে। এর কারণ, এক বন্ধু ছিলেন রোগা এবং দ্বিতীয় বন্ধু নবনীমোহন ছিলেন মোটা। এত মোটা যে তাঁকে চর্বির গোলা বললেও হয়। তিনি সুন্দর কি অসুন্দর তা বলতে পারি নে। কারণ, তাঁর নাক চোখ সব মাংস আর চর্বিতে ডুবে গেছে।

শুনলুম তাঁরা নাকি খুব কম খান। ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে খান-কতক বাসি লুচি ও গুড়, আর কাঁচা ছোলা ও কাঁচা মুগের ডাল। দুপুরবেলা ভাত খেতেন না, খেতেন চালের পায়েস আর তার সঙ্গে পান্তোয়া প্রভৃতি মিষ্টান্ন, বিকেলে এক বাটি ক্ষীর, ও তার সঙ্গে আম কাঁঠাল প্রভৃতি ফলফুলুরি। রাত্রে খেতেন পরোটা, মাছের কোপ্তা ও মাংসের কাবাব, তার উপর এক বাটি ক্ষীর।

নবনীমোহন লোকটি অতিশয় নির্বিবাদী। যা দেখতেন, তাতেই আশ্চর্য হয়ে যেতেন—যথা খড়ের চাল, দরমার বেড়া, আর আমাদের মতো জানোয়ারদের আচার- ব্যবহার। তাঁর ছোটো ছোটো চোখে যা পড়ত, তাই নাকি অতি নূতন আর অতি সুন্দর।

এ দিকে ধনপতিবাবু অর্থাৎ রোগা লোকটি ছিলেন সব বিষয়ে উদাসীন। এমন-কি, তাঁর কোনো কথায় কিংবা ব্যবহারে টাকার গরমাইয়ের পরিচয় পর্যন্ত কোনোদিন পাই নি। আমাদের তিনি জানোয়ার হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন শুধু অসভ্য মানুষ হিসেবে।

ধনপতিবাবু সভ্যতার নানা রকম মাল-মশলার অভাবে সর্বদাই অত্যন্ত অসুবিধা বোধ করতেন। তিনি ঘড়ি ঘড়ি সিগারেট খেতেন, অথচ সিগারেট ধরাবার জন্য দেশলাই যথেষ্ট সঙ্গে আনেন নি, ফকিরহাটের কাছারিতে দেশলাই পাবেন এই ভরসায়। কিন্তু আমাদের কাছারিতে দেশলাই ছিল না। আমরা তামাক খেতুম, আর কলকের টিকে ধরাতাম্ চকমকি ঠুকে।

এ কথা আমাদের মুখে শুনে ধনপতিবাবু তাঁর বন্ধুকে বলেন। তিনি তা শুনে মহা উল্লসিত হয়ে ওঠেন এবং বন্ধুকে বলেন, “তুমি চমকি ঠুকে সিগারেট ধরাও-না কেন, যস্মিন দেশে যদাচারঃ।”

তিনি উত্তর করেন, “আমি চমকি ঠুকতে পারি নে, আর তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সিগারেটের মুখে ফেলতেও পারি নে।”

তাতে নবনীমোহন বলেন, “তুমি তো হাতের কাজ কিছুই করতে পার না। কি করে চমকি ঠুকতে হয় এঁরা আমাকে দেখিয়ে দিন, আমিই তোমার কাজ করে দেব।”

আমার ডাক পড়ল, এবং ধনপতিবাবুর আদেশে আমি তাঁদের সমুখেই, চকমকি কি করে ঠুকতে হয় ও পাথর থেকে আগুন বার করতে হয় তা দেখিয়ে দিলুম।

এক নজরেই নবনীমোহন এ বিদ্যা শিখে নিলেন, এবং আমাকে বললেন, পাথর আর লোহা আমার কাছে রেখে যান, আমি যা করবার তা করব।”

“খানিক পরে আমি পাশের ঘর থেকে ঠুং ঠুং শব্দ শুনলুম। তার পরেই ধনপতিবাবু চীৎকার করে উঠলেন, “কে আছ, নবনীবাবুকে এসে রক্ষা করো। সে পুড়ে মরছে।”

আমি তাদের শোবার ঘরে ছুটে গিয়ে দেখি, নবনীমোহন কাঠের চৌকিতে বসে আছেন, আর তাঁর পাশে মেঝের উপর ইন্দ্রধনুর সব রকম রঙের পশমে তৈরি একটি গলাবন্ধ পড়ে আছে। চকমকি একবার সজোরে ঠুকতে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিট্‌কে গিয়ে সেই গলাবন্ধের উপর পড়েছে। পশমে আগুন লেগে গেছে, আর তা থেকে শুধু ধোঁয়া বেরুচ্ছে। নবনীমোহন তাঁর স্থূলদেহ নিয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে সেখান থেকে নড়তে পারছেন না।

আমি তার উপর এক ঘটি জল ঢেলে দিতেই সব নিভে গেল।

এর পর ধনপতিবাবু তার বন্ধুকে কড়া হুকুম দিলেন—”আর যেন আগুন নিয়ে খেলা করা না হয়। আমরা এখানে হাওয়া খেতে এসেছি, আগুনে পুড়ে মরতে নয়।”

নবনীমোহনের শখ হল— একদিন ডিঙি চড়ে জলবিহার করবেন।

ধনপতিবাবু তাঁর বন্ধুর সকল শখ মেটাতে দিবারাত্র প্রস্তুত ছিলেন। তাই ঠিক হল, নবনীমোহনকে একদিন ডিঙিতে চড়িয়ে বিলের ভিতর এক চক্র ঘুরিয়ে আনা হবে।

আমি একটি খুব ভালো আর টঙ্ক ডিঙি দেখে, সেই ডিঙিতে নবনীমোহনকে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করলুম। তার পর সে ডিঙি একেবারে পাড়ের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হল, যাতে তাঁর চড়তে কোনো কষ্ট না হয়।

তিনি এক পা লাফিয়ে ডিঙির মধ্যিখানে গিয়ে বসলেন। অমনি তাঁর গুরুভারে ডিঙির মাঝখানটা ফেঁসে গেল, আর তিনি একটা কুণ্ডলী আকার ধারণ করলেন। পা- দুটো উঁচু হয়ে উঠলো, মাথাও তাই। বাদবাকি দেহ এক হাত জলে ডুবে গেল।

ধনপতিবাবু অমনি “নবনীমোহন জলে ডুবে মল” বলে চীৎকার করতে লাগলেন।

আমরা ছুটে গিয়ে দেখলুম তাঁর জলে ডোববার কোনো ভয় নেই, কিন্তু তাঁকে ঐ ডিঙির ভাঙা খোল থেকে উদ্ধার করাই কঠিন। টেনে বার করা যায় না, নিজেরও বেরিয়ে আসবার শক্তি নেই।

তখন করাত দিয়ে আর কুড়ুল দিয়ে ডিঙিটাকে দুখণ্ড করা হল, আর নবনীমোহনের কোমরে কাছি দিয়ে বাঁধা হল। একটি চাকর সেই একহাত জলে নেমে তাঁকে ঠেলতে লাগল, আর দুজন সর্দার সেই কাছি টানতে লাগল। ডিঙির আধখানা এধারে আধখানা ওধারে চলে গেল- সহজে নয়, জেলেরা লগি মেরে সরিয়ে দিল। তার পরে নবনীমোহনকে ডাঙায় তোলা হল। তিনি ডিঙির তলার পাঁকে গেঁথে গিয়েছিলেন। তাঁর পরনে ছিল ঢাকাই ধুতি। তাঁকে দেখে মনে হল—তিনি একটি একমেঠে ঠাকুরের প্ৰতিমা।

তখনই স্থির হল যে, তাঁরা পরদিন সকালেই কলকাতা ফিরে যাবেন।

হলও তাই। তাঁরা যে ভাবে এসেছিলেন, সেই ভাবেই স্টেশনে গেলেন।

.

এ গল্প তোমাদের বলছি এই শিক্ষা দেবার জন্য যে, কখনো মোটা হোয়ো না। অবশ্য কি করে যে মোটাকে রোগা করা যায়, তা আমি জানি নে—স্বয়ং ধন্বন্তরি ও জানেন না, তবে বেশি মোটা না হবার হয়তো দু-চারটি সোজা উপায় আছে, যথা : অতিভোজন না করা, ও চলেফিরে বেড়ানো।

আশ্বিন ১৩৪৯

সকল অধ্যায়

১. প্রবাসস্মৃতি
২. আহুতি
৩. বড়োবাবুর বড়োদিন
৪. একটি সাদা গল্প
৫. ফরমায়েশি গল্প
৬. ছোটো গল্প
৭. রাম ও শ্যাম
৮. অদৃষ্ট
৯. নীল-লোহিত
১০. নীল-লোহিতের সৌরাষ্ট্র-লীলা
১১. প্রিন্স
১২. বীরপুরুষের লাঞ্ছনা
১৩. গল্প লেখা
১৪. ভাববার কথা
১৫. সম্পাদক ও বন্ধু
১৬. পূজার বলি
১৭. সহযাত্রী
১৮. ঝাঁপান খেলা
১৯. নীল-লোহিতের স্বয়ম্বর
২০. ভূতের গল্প
২১. দিদিমার গল্প
২২. অবনীভূষণের সাধনা ও সিদ্ধি
২৩. নীল-লোহিতের আদিপ্রেম
২৪. অ্যাডভেঞ্চার : জলে
২৫. ট্রাজেডির সূত্রপাত
২৬. মন্ত্রশক্তি
২৭. যখ
২৮. ঘোষালের হেঁয়ালি
২৯. বীণাবাই
৩০. ঝোট্টন ও লোট্টন
৩১. মেরি ক্রিসমাস
৩২. ফার্স্ট ক্লাস ভূত
৩৩. সল্পগল্প
৩৪. জুড়ি দৃশ্য
৩৫. পুতুলের বিবাহবিভ্রাট
৩৬. চাহার দরবেশ
৩৭. সারদাদাদার সন্ন্যাস
৩৮. ধ্বংসপুরী
৩৯. সারদাদাদার সত্য গল্প
৪০. সরু মোটা
৪১. সোনার গাছ হীরের ফুল
৪২. সীতাপতি রায়
৪৩. সত্য কি স্বপ্ন?
৪৪. অ্যাডভেঞ্চার : স্থলে
৪৫. প্রগতিরহস্য
৪৬. প্রফেসারের কথা
৪৭. চার-ইয়ারি কথা
৪৮. প্রসঙ্গকথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন