আহুতি

প্রমথ চৌধুরী

ইউরোপীয় সভ্যতা আজ পর্যন্ত আমাদের গ্রামের বুকের ভিতর তার শিং ঢুকিয়ে দেয় নি; অর্থাৎ রেলের রাস্তা সে গ্রামকে দূর থেকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। কাজেই কলকাতা থেকে বাড়ি যেতে অদ্যাবধি কতক পথ আমাদের সেকেলে যানবাহনের সাহায্যেই যেতে হয়; বর্ষাকালে নৌকা, আর শীত-গ্রীষ্মে পাল্কিই হচ্ছে আমাদের প্রধান অবলম্বন।

এই স্থলপথ আর জলপথ ঠিক উল্টো উল্টো দিকে। আমি বরাবর নৌকাযোগেই বাড়ি যাতায়াত করতুম, তাই এই স্থলপথের সঙ্গে বহুদিন যাবৎ আমার কোনোই পরিচয় ছিল না। তার পর যে বৎসর আমি বি. এ. পাস করি, সে বৎসর জ্যৈষ্ঠ মসে কোনো বিশেষ কার্যোপলক্ষে আমাকে একবার দেশে যেতে হয়; অবশ্য স্থলপথে। এই যাত্রায় যে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল, তোমাদের কাছে আজ তারই পরিচয় দেব।

আমি সকাল ছটায় ট্রেন থেকে নেমে দেখি আমার জন্য স্টেশনে পাল্কি-বেহারা হাজির রয়েছে। পাল্কি দেখে তার অন্তরে প্রবেশ করবার যে বিশেষ লোভ হয়েছিল, তা বলতে পারি নে। কেননা চোখের আন্দাজে বুঝলুম যে, সেখানি প্রস্থে দেড় হাত আর দৈর্ঘ্যে তিন হাতের চাইতেও কম। তার পর বেহারাদের চেহারা দেখে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। এমন অস্থিচর্মসার মানুষ অন্য কোনো দেশে বোধ হয় হাসপাতালের বাইরে দেখা যায় না। প্রায় সকলেরি পাঁজরার হাড় ঠেলে বেরিয়েছে, হাত-পায়ের মাংস সব দড়ি পাকিয়ে গিয়েছে। প্রথমেই চোখে পড়ে যে, এদের শরীরের একটিমাত্র অঙ্গ- উদর-অস্বাভাবিক রকম স্ফীতি ও চাকচিক্য লাভ করেছে। আমি ডাক্তার না হলেও অনুমানে বুঝলুম যে তার অভ্যন্তরে পীলে ও যকৃত পরস্পর পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। মনে পড়ে গেল বৃহদারণ্যক উপনিষদে পড়েছিলুম যে, অশ্বমেধের অশ্বের ‘যকৃচ্চ ক্লোমানশ্চ পর্বতা’ পীলে ও যকৃত নামক মাংসপিণ্ড দুটিকে পর্বতের সঙ্গে তুলনা করা যে অসংগত নয়, এই প্রথম আমি তার প্রত্যক্ষপ্রমাণ পেলুম। মানুষের দেহ যে কতদূর শ্রীহীন শক্তিহীন হতে পারে, তার চাক্ষুষ পরিচয় পেয়ে আমি মনে মনে লজ্জিত হয়ে পড়লুম; এরকম দেহ মনুষ্যত্বকে প্রকাশ্যে অপমান করে। অথচ আমাদের গ্রামের হিন্দুর বীরত্ব এই-সব দেহ আশ্রয় করেই টিকে আছে। এরা জাতিতে অস্পৃশ্য হলেও হিন্দু—শরীরে অশক্ত হলেও বীর। কেননা শিকার এদের জাতব্যবসা। এরা বর্শা দিয়ে শুয়োর মারে, বনে ঢুকে জঙ্গল ঠেঙিয়ে বাঘ বার করে; অবশ্য উদরান্নের জন্য। এদের তুলনায়, মাথায় লাল পাগড়ি ও গায়ে সাদা চাপকান পরা আমার দর্শনধারী সঙ্গী ভোজপুরী দরওয়ানটিকে রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছিল।

এই-সব কৃষ্ণের জীবদের কাঁধে চড়ে বিশ মাইল পথ যেতে প্রথমে আমার নিতান্ত অপ্রবৃত্তি হয়েছিল। মনে হল, এই-সব জীর্ণশীর্ণ জীবস্মৃত হতভাগ্যদের স্কন্ধে আমার দেহের ভার চাপানোটা নিতান্ত নিষ্ঠুরতার কার্য হবে। আমি পাল্কিতে চড়তে ইতস্তত করছি দেখে বাড়ি থেকে যে মুসলমান সর্দারটি এসেছিল, সে হেসে বললে, “হুজুর, উঠে পড়ুন, কিছু কষ্ট হবে না। আর দেরি করলে বেলা চারটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছতে পারবেন না।”

দশ ক্রোশ পথ যেতে দশ ঘণ্টা লাগবে, এ কথা শুনে আমার পাল্কি চড়বার উৎসাহ যে বেড়ে গেল, অবশ্য তা নয়। তবুও আমি ‘দুর্গা’ বলে হামাগুড়ি দিয়ে সেই প্যাকবাক্সের মধ্যে ঢুকে পড়লুম, কেননা তা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না। বলা বাহুল্য, ইতিমধ্যে নিজের মনকে বুঝিয়ে দিয়েছিলুম যে, মানুষের স্কন্ধে আরোহণ করে যাত্রা করায় পাপ নেই। আমরা ধনীলোকেরা পৃথিবীর দরিদ্র লোকদের কাঁধে চড়েই তো জীবনযাত্রা নির্বাহ করছি। আর পৃথিবীতে যে স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং অসংখ্য দরিদ্র ছিল, আছে, থাকবে এবং থাকা উচিত—এই তো ‘পলিটিকাল ইকনমির’ শেষ কথা। Conscienceকে ঘুম পাড়াবার কত-না মন্ত্রই আমরা শিখেছি!

অতঃপর পাল্কি চলতে শুরু করল।

সর্দারজি আশা দিয়েছিলেন যে, হুজুরের কোনোই কষ্ট হবে না। কিন্তু সে আশা যে ‘দিলাশা’, মাত্র, তা বুঝতে আমার বেশিক্ষণ লাগে নি। কেননা হুজুরের সুস্থ শরীর ইতিপূর্বে কখনো এতটা ব্যতিব্যস্ত হয় নি। পাল্কির আয়তনের মধ্যে আমার দেহায়তন খাপ খাওয়াবার বৃথা চেষ্টায় আমার শরীরের যে ব্যস্তসমস্ত অবস্থা হয়েছিল, তাকে শোয়াও বলা চলে না, বসাও বলা চলে না। শালগ্রামের শোওয়া-বসা দুই এক হলেও মানুষের অবশ্য তা নয়। কাজেই এ দুয়ের ভিতর যেটি হোক একটি আসন গ্রহণ করবার জন্য আমাকে অবিশ্রাম কসরৎ করতে হচ্ছিল। কুচিমোড়া না ভেঙে বীরাসন ত্যাগ করে পদ্মাসন গ্রহণ করবার জো ছিল না, অথচ আমাকে বাধ্য হয়ে মিনিটে মিনিটে আসন পরিবর্তন করতে হচ্ছিল। আমার বিশ্বাস এ অবস্থায় হঠযোগীরাও একস্থানে বহুক্ষণ স্থায়ী হতে পারতেন না, কেননা পৃষ্ঠদণ্ড ঋজু করবামাত্র পাল্কির ছাদ সজোরে মস্তকে চপেটাঘাত করছিল। ফলে, গুরুজনের সুমুখে কুলবধূর মতো আমাকে কুজপৃষ্ঠে নতশিরে অবস্থিতি করতে হয়েছিল। নাভিপদ্মে মনঃসংযোগ করবার এমন সুযোগ আমি পূর্বে কখনো পাই নি; কিন্তু অভ্যাসদোষে আমার বিক্ষিপ্ত চিত্তবৃত্তিকে সংক্ষিপ্ত করে নাভি-বিবরে সুনিবিষ্ট করতে পারলুম না।

শরীরের এই বিপর্যস্ত অবস্থাতে আমি অবশ্য কাতর হয়ে পড়ি নি। তখন আমার নবযৌবন। দেহ তার স্থিতিস্থাপকতা-ধর্ম তখনো হারিয়ে বসে নি। বরং সত্য কথা বলতে গেলে, নিজ দেহের এই-সব অনিচ্ছাকৃত অঙ্গভঙ্গি দেখে আমার শুধু হাসি পাচ্ছিল। এই যাত্রার মুখে পূর্ব দিক থেকে যে আলো ও বাতাস ধীরে ধীরে বয়ে আসছিল, তার দর্শনে ও স্পর্শনে আমার মন উৎফুল্ল উল্লসিত হয়ে উঠেছিল; সে বাতাস যেমন সুখস্পর্শ, সে আলো তেমনি প্রিয়দর্শন। দিনের এই নবজাগরণের সঙ্গে সঙ্গে আমার নয়ন-মন সব জেগে উঠেছিল। আমি একদৃষ্টে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলুম। চারি দিকে শুধু মাঠ ধূ ধূ করছে, ঘর নেই দোর নেই, গাছ নেই পালা নেই, শুধু মাঠ—অফুরন্ত মাঠ—আগা-গোড়া সমতল ও সমরূপ, আকাশের মতো বাধাহীন এবং ফাঁকা। কলকাতার ইটকাঠের পায়রার খোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতির এই অসীম উদারতার মধ্যে আমার অন্তরাত্মা মুক্তির আনন্দ অনুভব করতে লাগল। আমার মন থেকে সব ভাবনা-চিন্তা ঝরে গিয়ে সে মন ঐ আকাশের মতো নির্বিকার ও প্রসন্ন রূপ ধারণ করলে—তার মধ্যে যা ছিল, সে হচ্ছে আনন্দের ঈষৎ রক্তিম আভা। কিন্তু এ আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, কেননা দিনের সঙ্গে রোদ, প্রকৃতির গায়ের জ্বরের মতো বেড়ে উঠতে লাগল, আকাশ-বাতাসের উত্তাপ দেখতে দেখতে একশো পাঁচ ডিগ্রিতে চড়ে গেল। যখন বেলা প্রায় নটা বাজে, তখন দেখি বাইরের দিকে আর চাওয়া যায় না; আলোয় চোখ ঝলসে যাচ্ছে। আমার চোখ একটা- কিছু সবুজ পদার্থের জন্য লালায়িত হয়ে দিগ্‌দিগন্তে তার অন্বেষণ করে এখানে-ওখানে দুটি-একটি বাবলা গাছের সাক্ষাৎ লাভ করলে। বলা বাহুল্য, এতে চোখের পিপাসা মিটল না, কেননা এ গাছের আর যে গুণই থাক্, এর গায়ে শ্যামল শ্রী নেই, পায়ের নীচে নীল ছায়া নেই। এই তরুহীন পত্রহীন ছায়াহীন পৃথিবী আর মেঘমুক্ত রৌদ্রপীড়িত আকাশের মধ্যে ক্রমে একটি বিরাট অবসাদের মূর্তি ফুটে উঠল। প্রকৃতির এই একঘেয়ে চেহারা আমার চোখে আর সহ্য হল না। আমি একখানি বই খুলে পড়বার চেষ্টা করলুম। সঙ্গে Meredithএর Egoist এনেছিলুম, তার শেষ চ্যাপ্টার পড়তে বাকি ছিল। একটানা দু-চার পাতা পড়ে দেখি তার শেষ চ্যাপ্টার তার প্রথম চ্যাপ্টার হয়ে উঠেছে—অর্থাৎ তার একবর্ণও আমার মাথায় ঢুকল না। বুঝলুম পাল্কির অবিশ্রাম ঝাঁকুনিতে আমার মস্তিষ্ক বেবাক ঘুলিয়ে গেছে। আমি বই বন্ধ করে পাল্কি—বেহারাদের একটু চাল বাড়াতে অনুরোধ করলুম, এবং সেইসঙ্গে বকশিশের লোভ দেখালুম। এতে ফল হল। অর্ধেক পথে যে গ্রামটিতে আমাদের বিশ্রাম করবার কথা ছিল, সেখানে বেলা সাড়ে দশটায়, অর্থাৎ মেয়াদের আধঘণ্টা আগে, গিয়ে পৌঁছলুম।

এই মরুভূমির ভিতর এই গ্রামটি যে ওয়েসিসের একটা খুব নয়নাভিরাম এবং মনোরম উদাহরণ, তা বলতে পারি নে। মধ্যে একটি ডোবা, আর তার তিন পাশে একতলা-সমান উঁচু পাড়ের উপর খান-দশবারো খোড়ো ঘর, আর-এক পাশে একটি অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছের নীচে পাল্কি নামিয়ে বেহারারা ছুটে গিয়ে সেই ডোবায় ডুব দিয়ে উঠে ভিজে কাপড়েই চিড়ে-দইয়ের ফলার করতে বসল। পাল্কি দেখে গ্রামবধূরা সব পাড়ের উপরে এসে কাতার দিয়ে দাঁড়াল। এই পল্লীবধূদের সম্বন্ধে কবিতা লেখা কঠিন, কেননা এদের আর যাই থাক্—রূপও নেই, যৌবনও নেই। যদি-বা কারো রূপ থাকে তো তা কৃষ্ণবর্ণে ঢাকা পড়েছে, যদি-বা কারো যৌবন থাকে তো তা মলিন বসনে চাপা পড়েছে। এদের পরনের কাপড় এত ময়লা যে তাতে চিমটি কাটলে একতাল মাটি উঠে আসে। যা বিশেষ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সে হচ্ছে তাদের হাতের পায়ের রুপোর গহনা। এক জোড়া চূড় আমার চোখে পড়ল, যার তুল্য সুশ্রী গড়ন এ কালের গহনায় দেখতে পাওয়া যায় না। এই থেকে প্রমাণ পেলুম যে, বাঙলার নিম্নশ্রেণির স্ত্রীলোকের দেহে সৌন্দর্য না থাক্, সেই শ্রেণির পুরুষের হাতে আর্ট আছে।

ঘণ্টা-আধেক বাদে আমরা আবার রওনা হলুম। পাল্কি অতি ধীরে-সুস্থে চলতে লাগল, কেননা ভূরিভোজনের ফলে আমার বাহকদের গতি আপন্নসত্ত্বা স্ত্রীলোকের তুল্য মৃদুমন্থর হয়ে এসেছিল। ইতিমধ্যে আমার শরীর মন ইন্দ্রিয় পঞ্চপ্রাণ প্রভৃতি সব এতটা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল যে, আমি চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করলুম। ক্রমে জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুর রোদ্দুর এবং পাল্কির দোলার প্রসাদে আমার তন্দ্রা এল; সে তন্দ্রা কিন্তু নিদ্রা নয়। আমার শরীর যেমন শোওয়া বসা এ দুয়ের মাঝামাঝি একটা অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিল, আমার মনও তেমনি সুপ্তি ও জাগরণের মাঝামাঝি একটা অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিল। এই অবস্থায় ঘণ্টা-দুয়েক কেটে গেল। তার পর পাল্কির একটা প্রচণ্ড ধাক্কায় আমি জেগে উঠলুম, সে ধাক্কার বেগ এতই বেশি যে তা আমার দেহের ষট্চক্র ভেদ করে একেবারে সহস্রারে গিয়ে উপনীত হয়েছিল। জেগে দেখি ব্যাপার আর কিছুই নয়—বেহারারা একটি প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় সোয়ারি সজোরে নিক্ষেপ করে একদম অদৃশ্য হয়েছে। কারণ জিজ্ঞাসা করতে সর্দারজি বললেন, “ওরা একটু তামাক খেতে গিয়েছে।”

যাত্রা করে অবধি, এই প্রথম একটি জায়গা আমার চোখে পড়ল যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। সে বট একাই একশো; চারি দিকে সারি সারি বোয়া নেমেছে, আর তার উপরে পাতা এত ঘনবিন্যস্ত যে সূর্যরশ্মি তা ভেদ করে আসতে পারছে না। মনে হল, প্রকৃতি তাপক্লিষ্ট পথশ্রান্ত পথিকদের জন্য একটি হাজার-থামের পান্থশালা সস্নেহে স্বহস্তে রচনা করে রেখেছেন। সেখানে ছায়া এত নিবিড় যে সন্ধে হয়েছে বলে আমার ভুল হল, কিন্তু ঘড়ি খুলে দেখি বেলা তখন সবে একটা।

আমি এই অবসরে বহুকষ্টে পাল্কি থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে হাত-পা ছড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলুম। দেহটিকে সোজা করে খাড়া করতে প্রায় মিনিট-পনেরো লাগল; কেননা ইতিমধ্যে আমার সর্বাঙ্গে খিল ধরে এসেছিল, তার উপর আবার কোনো অঙ্গ অসাড় হয়ে গিয়েছিল; কোনো অঙ্গে ঝিনঝিনি ধরেছিল, কোনো অঙ্গে পক্ষাঘাত, কোনো অঙ্গে ধনুষ্টঙ্কার হয়েছিল। যখন শরীরটি সহজ অবস্থায় ফিরে এল, তখন মনে ভাবলুম গাছটি একবার প্রদক্ষিণ করে আসি। খানিকটে দূর এগিয়ে দেখি, বেহারাগুলো সব পাঁড়েজিকে ঘিরে বসে আছে, আর সকলে মিলে একটা মহা-জটলা পাকিয়ে তুলেছে। প্রথমে আমার ভয় হল যে, এরা হয়তো আমার বিরুদ্ধে ধর্মঘট করবার চক্রান্ত করছে; কেননা সকলে একসঙ্গে মহা-উৎসাহে বক্তৃতা করছিল। কিন্তু তার পরেই বুঝলুম যে, এই বকাবকি চেঁচামেচির অন্য কারণ আছে। এরা যে-বস্তুর ধূমপান করছিল, তা যে তামাক নয়—’বড়ো তামাক’, তার পরিচয় ঘ্রাণেই পাওয়া গেল। এদের স্ফূর্তি এদের আনন্দ, এদের লম্ফঝম্প দেখে গঞ্জিকার ত্বরিতানন্দ নামের সার্থকতার প্রত্যক্ষপ্রমাণ পেলুম। এক-এক জন কল্কেয় এক-এক টান দিচ্ছে, আর ‘ব্যোম কালী কলকাত্তাওয়ালি’ বলে হুংকার ছাড়ছে। গাঁজার কল্কের গড়ন যে এত সুডৌল তা আমি পূর্বে জানতুম না। গড়নে কল্কে-ফুলও এর কাছে হার মানে। মাদকতার আধার যে সুন্দর হওয়া দরকার—এ জ্ঞান দেখলুম এদেরও আছে।

প্রথমে এদের এই ধূমপানোৎসব দেখতে আমার আমোদ বোধ হচ্ছিল, কিন্তু ক্রমে বিরক্তি ধরতে লাগল। ছিলেমের পর ছিলেম পুড়ে যাচ্ছে, অথচ দেখি কারো ওঠবার অভিপ্রায় নেই। এদের গাঁজা খাওয়া কখন শেষ হবে জিজ্ঞাসা করাতে সর্দারজি উত্তর করলেন, “হুজুর, এদের টেনে না তুললে এরা উঠবে না, সুমুখে ভয় আছে তাই এরা গাঁজায় দম দিয়ে মনে সাহস করে নিচ্ছে।”

আমি বললুম, “কি ভয়?”

সে জবাব দিলে, “হুজুর, সে ভয়ের নাম করতে নেই। একটু পরে সব চোখেই দেখতে পাবেন।

এ কথা শুনে ব্যাপার কি দেখবার জন্যে আমার মনে এতটা কৌতূহল জন্মাল যে বেহারাগুলোকে টেনে তোলবার জন্যে স্বয়ং তাদের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলুম। দেখি যে-সব চোখ ইতিপূর্বে যকৃতের প্রভাবে হলুদের মতো হলদে ছিল, এখন সে-সব গঞ্জিকার প্রসাদে চুন-হলুদের মতো লাল হয়ে উঠেছে। প্রতি লোকটিকে নিজের হাতে টেনে খাড়া করতে হল, তার ফলে বাধ্য হয়ে কতকটা গাঁজার ধোঁয়া আমাকে উদরস্থ করতে হল; সে ধোঁয়া আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ লাভ করে আমার মাথায় গিয়ে চড়ে বসল। অমনি আমার গা পাক দিয়ে উঠল, হাত-পা ঝিঝিম্ করতে লাগল, চোখ টেনে আসতে লাগল, আমি তাড়াতাড়ি পাল্কিতে গিয়ে আশ্রয় নিলুম। পাল্কি আবার চলতে শুরু করল। এবার আমি পাল্কি চড়বার কষ্ট কিছুমাত্র অনুভব করলুম না, কেননা আমার মনে হল যে শরীরটা যেন আমার নয়—অপর কারো

খানিকক্ষণ পর—কতক্ষণ পর তা বলতে পারি নে—বেহারাগুলো সব সমস্বরে ও তারস্বরে চীৎকার করতে আরম্ভ করল। এদের গায়ের জোরের চাইতে গলার জোর যে বেশি তার প্রমাণ পূর্বেই পেয়েছিলুম, কিন্তু সে জোর যে এত অধিক তার পরিচয় এই প্রথম পেলুম। এই কোলাহলের ভিতর থেকে একটা কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল— সে হচ্ছে রামনাম। ক্রমে আমার পাঁড়েজিটিও বেহারাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘রামনাম সৎ” হ্যয়’ ‘রামনাম সৎ হ্যয়’ এই মন্ত্র অবিরাম আউড়ে যেতে লাগলেন। তাই শুনে আমার মনে হল যে আমার মৃত্যু হয়েছে; আর ভূতেরা পাল্কিতে চড়িয়ে আমাকে প্রেতপুরীতে নিয়ে যাচ্ছে। এ ধারণার মূলে আমার অন্তরস্থ গঞ্জিকাধূমের কোনো প্রভাব ছিল কি না জানি নে। এরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানবার জন্য আমার মহা কৌতূহল হল। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি, গ্রামে আগুন লাগলে যে রকম হয়, আকাশের চেহারা সেই রকম হয়েছে, অথচ আগুন লাগবার অপর লক্ষণ—আকাশ-জোড়া হৈ হৈ রৈ রৈ শব্দ—শুনতে পেলুম না। চারি দিক এমন নির্জন, এমন নিস্তব্ধ যে, মনে হল মৃত্যুর অটল শান্তি যেন বিশ্বচরাচরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার পর পাল্কি আর- একটু অগ্রসর হলে দেখলুম যে, সুমুখে যা পড়ে আছে তা একটি মরুভূমি—বালির নয়, পোড়ামটির, সে মাটি পাতখোলার মতো, তার গায়ে একটি তৃণ পর্যন্ত নেই। এই পোড়ামাটির উপরে মানুষের এখন বসবাস নেই, কিন্তু পূর্বে যে ছিল তার অসংখ্য এবং অপর্যাপ্ত চিহ্ন চারি দিকে ছড়ানো রয়েছে। এ যেন ইটের রাজ্য। যতদূর চোখ যায়, দেখি শুধু ইট আর ইট, কোথায়ও বা তা গাদা হয়ে রয়েছে, কোথায়ও বা হাজারে হাজারে মাটির উপর বেছানো রয়েছে; আর সে ইট এত লাল যে, দেখতে মনে হয় টাটকা রক্ত যেন চাপ বেঁধে গেছে; এই ভূতলশায়ী জনপদের ভিতর থেকে যা আকাশের দিকে ঠেলে উঠেছে, সে হচ্ছে গাছ। কিন্তু তার একটিতেও পাতা নেই, সব নেড়া, সব শুকনো, সব মরা। এই গাছের কঙ্কালগুলি কোথায়ও বা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, কোথায়ও-বা দু-একটি একধারে আলগোছ হয়ে রয়েছে। আর এই ইট কাঠ মাটি আকাশের সর্বাঙ্গে যেন রক্তবর্ণ আগুন জড়িয়ে রয়েছে। এ দৃশ্য দেখে বেহারাদের প্রকৃতির লোকের ভয় পাওয়াটা কিছু আশ্চর্যের বিষয় নয়, কেননা আমারই গা ছম্ ছম্ করতে লাগল। খানিকক্ষণ পরে এই নিস্তব্ধতার বুকের ভিতর থেকে একটি অতি ক্ষীণ ক্রন্দনধ্বনি আমার কানে এল। সে স্বর এত মৃদু এত করুণ এত কাতর যে, মনে হল সে সুরের মধ্যে যেন মানুষের যুগযুগান্তের বেদনা সঞ্চিত, ঘনীভূত হয়ে রয়েছে। এ কান্নার সুরে আমার সমগ্র অন্তর অসীম করুণায় ভরে গেল, আমি মুহূর্তের মধ্যে বিশ্ব- মানবের ব্যথার ব্যথী হয়ে উঠলুম। এমন সময়ে হঠাৎ ঝড় উঠল, চার দিক থেকে এলোমেলো ভাবে বাতাস বইতে লাগল। সেই বাতাসের তাড়নায় আকাশের আগুন যেন পাগল হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। আকাশের রক্তগঙ্গায় যেন তুফান উঠল, চারি দিকে আগুনের ঢেউ বইতে লাগল। তার পর দেখি সেই অগ্নি-প্লাবনের মধ্যে অসংখ্য নরনারীর ছায়া কিবিল্ করছে, ছট্‌ফট্ করছে। এই ব্যাপার দেখে উনপঞ্চাশ বায়ু মহানন্দে করতালি দিতে লাগল, হা হা হো হো শব্দে চীৎকার করতে লাগল। ক্রমে এই-সব শব্দ মিলেমিশে একটা অট্টহাস্যে রূপান্তরিত হল— সে হাসির নির্মম বিকট ধ্বনি দিগ্‌দিগন্তে ঢেউ খেলিয়ে গেল। সে হাসি ক্রমে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে, আবার সেই মৃদু করুণ ও কাতর ক্রন্দনধ্বনিতে পরিণত হল। এই বিকট হাসি আর এই করুণ ক্রন্দনের দ্বন্দ্বে আমার মনের ভিতর এই ধ্বংসপুরীর পূর্বস্মৃতি সব জাগিয়ে তুললে— সে স্মৃতি ইহজন্মের কি পূর্বজন্মের তা আমি বলতে পারি নে। আমার ভিতর থেকে কে যেন আমাকে বলে দিলে যে, সে গ্রামের ইতিহাস এই—

এই ইটকাঠের মরুভূমি হচ্ছে রুদ্রপুরের ধ্বংসাবশেষ। রুদ্রপুরের রায়বাবুরা এককালে এ অঞ্চলের সর্বপ্রধান জমিদার ছিলেন। রায়বংশের আদিপুরুষ রুদ্রনারায়ণ, নবাব-সরকারে চাকরি করে রায়-রাইয়ান খেতাব পান, এবং সেইসঙ্গে তিন পরগনার মালিকী স্বত্ব লাভ করেন। লোকে বলে এঁদের ঘরে দিল্লির বাদশার স্বহস্তে-স্বাক্ষরিত সনদ ছিল, এবং সেই সনদে তাঁদের কোতল-কচ্ছলের ক্ষমতা দেওয়া ছিল। সনদের বলে হোক আর না হোক, এঁরা যে কোতল-কচ্ছল করতেন সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। কিম্বদন্তী এই যে, এমন দুর্দান্ত জমিদার এ দেশে পূর্বাপর কখনো হয় নি। এঁদের প্রবল প্রতাপে বাঘে ছাগলে একঘাটে জল খেত। কেননা, যার উপর এঁরা নারাজ হতেন, তাকে ধনেপ্রাণে বিনাশ করতেন। এঁরা কত লোকের ভিটামাটি যে উৎসন্নে দিয়েছেন, তার আর ইয়ত্তা নেই। রায়বাবুদের দোহাই অমান্য করে এত বড়ো বুকের পাটা বিশ ক্রোশের মধ্যে কোনো লোকেরই ছিল না। তাঁদের কড়া শাসনে পরগনার মধ্যে চুরি-ডাকাতি দাঙ্গা-হাঙ্গামার নামগন্ধও ছিল না, তার একটি কারণ ও অঞ্চলের লাঠিয়াল সড়কিয়াল তীরন্দাজ প্রভৃতি যত ক্রূরকর্মা লোক, সব তাঁদের সরকারে পাইক- সর্দারের দলে ভর্তি হত। এক দিকে যেমন মানুষের প্রতি তাঁদের নিগ্রহের সীমা ছিল না, অপর দিকে তেমনি অনুগ্রহেরও সীমা ছিল না। দরিদ্রকে অন্নবস্ত্র, আতুরকে ঔষধপথ্য দান এঁদের নিত্যকর্মের মধ্যে ছিল। এঁদের অনুগত আশ্রিত লোকের লেখাজোখা ছিল না। এঁদের প্রদত্ত ব্রহ্মোত্তরের প্রসাদে দেশের গুরুপুরোহিতের দল সব জোতদার হয়ে উঠেছিলেন। তার পর পূজা-আর্চা দোল-দুর্গোৎসবে তাঁরা অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। রুদ্রপুরে দোলের সময় আকাশ আবীরে ও পুজোর সময় পৃথিবী রুধিরে লাল হয়ে উঠত। রুদ্রপুরের অতিথিশালায় নিত্য এক শত অতিথি-ভোজনের আয়োজন থাকত। পিতৃদায় মাতৃদায় কন্যাদায়-গ্রস্ত কোনো ব্রাহ্মণ রুদ্রপুরের বাবুদের দ্বারস্থ হয়ে কখনো রিক্তহস্তে ফিরে যায় নি। এঁরা বলতেন—ব্রাহ্মণের ধন বাঁধবার জন্য নয়, সৎকার্যে ব্যয় করবার জন্য। সুতরাং সৎকার্যে ব্যয় করবার টাকার যদি কখনো অভাব হত, তা হলে বাবুরা সে টাকা সা-মহাজনদের ঘর লুঠে নিয়ে আসতেও কুণ্ঠিত হতেন না। এক কথায়, এঁরা ভালো কাজ মন্দ কাজ সব নিজের খেয়াল ও মর্জি-অনুসারে করতেন; কেননা নবাবের আমলে তাঁদের কোনো শাসনকর্তা ছিল না। ফলে, জনসাধারণে তাঁদের যেমন ভয় করত তেমনি ভক্তিও করত, তার কারণ তাঁরা জনসাধারণকে ভক্তিও করতেন না, ভয়ও করতেন না। এই অবাধ যথেচ্ছাচারের ফলে তাঁদের মনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে ধারণা উত্তরোত্তর অসাধারণ বৃদ্ধিলাভ করেছিল। তাঁদের মনে যা ছিল, সে হচ্ছে জাতির অহংকার, ধনের অহংকার, বলের অহংকার, রূপের অহংকার। রায়-পরিবারের পুরুষেরা সকলেই গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি ও বলিষ্ঠ ছিলেন, এবং তাঁদের ঘরের মেয়েদের রূপের খ্যাতি দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল। এই-সব কারণে মানুষকে মানুষ জ্ঞান করা এঁদের পক্ষে এক-রকম অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

এ দেশের ইংরেজ আসবার পূর্বেই এ পরিবারের ভগ্নদশা উপস্থিত হয়েছিল, তার পর কোম্পানির আমলে এঁদের সর্বনাশ হয়। এঁদের বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পত্তি ভাগ হওয়ার দরুন যে-সকল শরিক নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল, ক্রমে তাদের বংশ লোপ পেতে আরম্ভ হল; কেননা নিজের চেষ্টায় নিজের পরিশ্রমে অর্থোপার্জন করাটা এঁদের মতে অতি হেয় কার্য বলে গণ্য ছিল। তার পর শরিকানা বিবাদ। রায়-পরিবারে ছিল শাক্ত- এত ঘোর শাক্ত যে, রুদ্রপুরের ছেলে-বুড়োতে মদ্যপান করত। এমন-কি, এ বংশের মেয়েরাও তাতে কোনো আপত্তি করত না, কেননা তাদের বিশ্বাস ছিল মদ্যপান করা একটি পুরুষালি কাজ। সন্ধ্যার সময় কুলদেবতা সিংহবাহিনীর দর্শনের পর বাবুরা যখন বৈঠকখানায় বসে মদ্যপানে রত হতেন, তখন সেই-সকল গৌরবর্ণ প্রকাণ্ড পুরুষদের কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা আর জবাফুলের মতো দুই চোখ—এই তিনে মিলে সাক্ষাৎ মহাদেবের রোষকষায়িত ত্রিনেত্রের মতো দেখাত। এই সময়ে পৃথিবীতে এমন দুঃসাহসের কার্য নেই যা তাঁদের দ্বারা না হত। তাঁরা লাঠিয়ালদের এ-শরিকের ধানের গোলা লুঠে আনতে, ও-শরিকের প্রজার বৌ-ঝিকে বে-ইজ্জৎ করতে হুকুম দিতেন। ফলে রক্তারক্তি কাণ্ড হত। এই জ্ঞাতি-শত্রুতার দরুন তাঁরা উৎসন্নের পথে বহুদূর অগ্রসর হয়েছিলেন। তার পর এঁদের বিষয়সম্পত্তির যা অবশিষ্ট ছিল তা দশশালা বন্দোবস্তের প্রসাদে হস্তান্তরিত হয়ে গেল। কিস্তির শেষ তারিখে সদর খাজনা কোম্পানির মালখানায় দাখিল না করলে লক্ষ্মী যে চিরদিনের মতো গৃহত্যাগ করবেন, এ জ্ঞান এঁদের মনে কখনো জন্মাল না। পূর্ব আমলে নবাব-সরকারে নিয়মিত শালিয়ানা মাল-খাজনা দাখিল করবার অভ্যাস তাঁদের ছিল না। এই অনভ্যাসবশত কোম্পানির প্রাপ্য রাজস্ব এঁরা সময়মত দিয়ে উঠতে পারতেন না। কাজেই এঁদের অধিকাংশ সম্পত্তি খাজনার দায়ে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে রায়বংশ প্রায় লোপ পেয়ে এসেছিল। যে গ্রামে এঁরা প্রায় একশো ঘর ছিলেন, সেই গ্রামে আজ একশো বৎসর পূর্বে ছ ঘর মাত্র জমিদার ছিল।

এই ছ ঘরের বিষয়সম্পত্তিও ক্রমে ধনঞ্জয় সরকারের হস্তগত হল। এর কারণ ধনঞ্জয় সরকার ইংরেজের আইন যেমন জানতেন, তেমনি মানতেন। ইংরেজের আইনের সাহায্যে, এবং সে আইন বাঁচিয়ে, কি করে অর্থোপার্জন করতে হয়, তার অন্ধি-সন্ধি ফিকির-ফন্দি সব তাঁর নখাগ্রে ছিল। তিনি জিলার কাছারিতে মোক্তারি করে দু-চার বৎসরের মধ্যেই অগাধ টাকা রোজগার করেন। তার পর তেজারতিতে সেই টাকা সুদের সুদ তস্য সুদে হুহু করে বেড়ে যায়। জনরব যে, তিনি বছর-দশেকের মধ্যে দশ লক্ষ টাকা উপায় করেন। এত না হোক, তিনি যে দু-চার লক্ষ টাকার মালিক হয়েছিলেন, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। এই টাকা করবার পর তাঁর জমিদার হবার সাধ গেল, এবং সেই সাধ মেটাবার জন্য তিনি একে একে রায়বাবুদের সম্পত্তি-সকল খরিদ করতে আরম্ভ করলেন; কেননা এ জমিদারির প্রতি কাঠা জমি তাঁর নখদর্পণে ছিল। রায়বংশের চাকরি করেই তাঁর চৌদ্দপুরুষ মানুষ হয়, এবং তিনিও অল্প বয়সে রুদ্রপুরের বড়ো শরিক ত্রিলোকনারায়ণের জমাসেরেস্তায় পাঁচ-সাত বৎসর মুহুরির কাজ করেছিলেন। সকল শরিকের সমস্ত সম্পত্তি মায় বসতবাটী খরিদ করলেও, বহুকাল যাবৎ তাঁর রুদ্রপুরে যাবার সাহস ছিল না, কেননা তাঁর মনিবপুত্র উগ্রনারায়ণ তখনো জীবিত ছিলেন। উগ্রনারায়ণ হাতে পৈত্য জড়িয়ে সিংহবাসিনীর পা ছুঁয়ে শপথ করেছিলেন যে, তিনি বেঁচে থাকতে ধনঞ্জয় যদি রুদ্রপুরের ত্রিসীমানার ভিতর পদার্পণ করে, তা হলে সে সশরীরে আর ফিরে যাবে না। তিনি যে তাঁর প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন, সে বিষয়ে ধনঞ্জয়ের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। কেননা তিনি জানতেন যে, উগ্রনারায়ণের মতো দুর্ধর্ষ ও অসমসাহসী পুরুষ রায়বংশেও কখনো জন্মগ্রহণ করে নি।

উগ্রনারায়ণের মৃত্যুর কিছুদিন পরে, ধনঞ্জয় রুদ্রপুরে এসে রায়বাবুদের পৈতৃক ভিটা দখল করে বসলেন। তখন সে গ্রামে রায়বংশের একটি পুরুষও বর্তমান ছিল না, সুতরাং তিনি ইচ্ছা করলে সকল শরিকের বাড়ি নিজ-দখলে আনতে পারতেন, তবুও তিনি উগ্রনারায়ণের একমাত্র বিধবা কন্যা রত্নময়ীকে তাঁর পৈতৃক বাটী থেকে বহিষ্কৃত করে দেবার কোনো চেষ্টা করেন নি। তার প্রথম কারণ, রুদ্রপুরের সংলগ্ন পাঠানপাড়ার প্রজারা উগ্রনারায়ণের বাটীতে রত্নময়ীর স্বত্বস্বামিত্ব রক্ষা করবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছিল। এরা গ্রামসুদ্ধ লোক পুরুষানুক্রমে লাঠিয়ালের ব্যবসা করে এসেছে। সুতরাং ধনঞ্জয় জানতেন যে, রত্নময়ীকে উচ্ছেদ করতে চেষ্টা করলে, খুন জখম হওয়া অনিবার্য। তাতে অবশ্য তিনি নিতান্ত নারাজ ছিলেন, কেননা তাঁর মতো নিরীহ ব্যক্তি বাঙলা দেশে তখন আর দ্বিতীয় ছিল না। তার দ্বিতীয় কারণ, যার অন্নে চৌদ্দপুরুষ প্রতিপালিত হয়েছে, ধনঞ্জয়ের মনে তার প্রতি পূর্ব-সংস্কারবশত কিঞ্চিৎ ভয় এবং ভক্তিও ছিল। এই-সব কারণে ধনঞ্জয় উগ্রনারায়ণের অংশটি বাদ দিয়ে, রায়বংশের আদ্‌বাড়ির বাদবাকি অংশ অধিকার করে বসলেন, সেও নামমাত্র। কেননা, ধনঞ্জয়ের পরিবারের মধ্যে ছিল তাঁর একমাত্র কন্যা রঙ্গিণী দাসী, আর তাঁর গৃহজামাতা এবং রঙ্গিণীর স্বামী রতিলাল দে। এই বাড়িতে এসে ধনঞ্জয়ের মনের একটা বিশেষ পরিবর্তন ঘটল। অর্থ উপার্জন করবার সঙ্গে সঙ্গে ধনঞ্জয়ের অর্থলোভ এতদূর বেড়ে গিয়েছিল যে, তাঁর অন্তরে সেই লোভ ব্যতীত অপর কোনো ভাবের স্থান ছিল না। সেই লোভের ঝোঁকেই তিনি এতদিন অন্ধভাবে যেন-তেন-উপায়ে টাকা সংগ্রহ করতে ব্যস্ত ছিলেন। কিসের জন্য কার জন্য টাকা জমাচ্ছি, এ প্রশ্ন ধনঞ্জয়ের মনে কখনো উদয় হয় নি।

কিন্তু রুদ্রপুরে এসে জমিদার হয়ে বসবার পর ধনঞ্জয়ের জ্ঞান হল যে, তিনি শুধু টাকা করবার জন্যই টাকা করেছেন, আর কোনো কারণে নয়, আর কারো জন্য নয়। কেননা তাঁর স্মরণ হল যে, যখন তাঁর একটির পর একটি সাতটি ছেলে মারা যায়, তখনো তিনি একদিনের জন্যও বিচলিত হন নি, একদিনের জন্যও অর্থোপার্জনে অবহেলা করেন নি। তাঁর চিরজীবনের অর্থের আত্যন্তিক লোভ এই বৃদ্ধবয়েসে অর্থের আত্যন্তিক মায়ায় পরিণত হল। তাঁর সংগৃহীত ধন কি করে চিরদিনের জন্য রক্ষা করা যেতে পারে এই ভাবনায় তাঁর রাত্তিরে ঘুম হত না। অতুল ঐশ্বর্যও যে কালক্রমে নষ্ট হয়ে যায়, এই রুদ্রপুরই তো তার প্রত্যক্ষপ্রমাণ। ক্রমে তাঁর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হল যে, মানুষে নিজ চেষ্টায় ধনলাভ করতে পারে, কিন্তু দেবতার সাহায্য ব্যতীত সে ধন রক্ষা করা যায় না। ইংরেজের আইন কণ্ঠস্থ থাকলেও ধনঞ্জয় একজন নিতান্ত অশিক্ষিত ছিলেন। তাঁর প্রকৃতিগত বর্বরতা কোনোরূপ শিক্ষা-দীক্ষার দ্বারা পরাভূত কিংবা নিয়মিত হয় নি। তাঁর সমস্ত মন সেকালের শূদ্রবুদ্ধিজাত সকলপ্রকার কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে পরিপূর্ণ ছিল। তিনি ছেলেবেলায় শুনেছিলেন যে, একটি ব্রাহ্মণশিশুকে যদি টাকার সঙ্গে একটি ঘরে বন্ধ করে দেওয়া যায়, তা হলে সেই শিশুটি সেই ঘরে অনাহারে প্রাণত্যাগ করে যক্ষ হয়ে সেই টাকা চিরকাল রক্ষা করে। ধনঞ্জয়ের মনে এই উপায়ে তাঁর সঞ্চিত ধন রক্ষা করবার প্রবৃত্তি এত অদম্য হয়ে উঠল যে, তিনি যখ্ দেওয়াটা যে তাঁর পক্ষে একান্ত কর্তব্য, সে বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত হলেন। যেখানে ধনঞ্জয়ের কোনো মায়ামমতা ছিল না, সেখানে তিনি সকল বাধা অতিক্রম করে নিজের কার্য উদ্ধার করবার কৌশলে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এক বিষম বাধা উপস্থিত হল। ধনঞ্জয় একটি ব্রাহ্মণশিশুকে যখ্ দিতে মনস্থ করেছেন শুনে, রঙ্গিণী আহারনিদ্রা ত্যাগ করলে। ফলে, ধনঞ্জয়ের পক্ষে তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। ধনঞ্জয় এ পৃথিবীতে টাকা ছাড়া আর কিছু যদি ভালোবাসতেন তো সে হচ্ছে তাঁর কন্যা। চুনসুরখির গাঁথনির ভিতর এক-একটি গাছ যেমন শিকড় গাড়ে, ধনঞ্জয়ের কঠিন হৃদয়ের কোনো একটি ফাটলের ভিতর এই কন্যাবাৎসল্য তেমনিভাবে শিকড় গেড়েছিল। ধনঞ্জয় এ বিষয়ে উদ্যোগী না হলেও ঘটনাচক্রে তাঁর জীবনের শেষ সাধ পূর্ণ হল।

রত্নময়ীর একটি তিন বৎসরের ছেলে ছিল। তার নাম কিরীটচন্দ্র। তিনি সেই ছেলেটি নিয়ে দিবারাত্র ঐ বাড়িতে একা বাস করতেন, জনমানবের সঙ্গে দেখা করতেন না, তাঁর অন্তঃপুরে কারো প্রবেশাধিকার ছিল না। রুদ্রপুরে লোকে তাঁর অস্তিত্ব পর্যন্ত ভুলে যেত, যদি না তিনি প্রতিদিন স্নানান্তে ঠিক দুপুরবেলায় সিংহবাহিনীর মন্দিরে ঠাকুর দর্শন করতে যেতেন। সে সময়ে তাঁর আগে পিছে পাঠানপাড়ার দুজন লাঠিয়াল তাঁর রক্ষক হিসেবে থাকত। রত্নময়ীর বয়েস তখন বিশ কিংবা একুশ। তাঁর মতো অপূর্বসুন্দরী স্ত্রীলোক আমাদের দেশে লাখে একটি দেখা যায়। তাঁর মূর্তি সিংহবাহিনীর প্রতিমার মতো ছিল, এবং সেই প্রতিমার মতোই উপরের দিকে কোণতোলা তাঁর চোখ দুটি—দেবতার চোখের মতোই স্থির ও নিশ্চল ছিল। লোকে বলত সে চোখে কখনো পলক পড়ে নি। সে চোখের ভিতরে যা জাজ্বল্যমান হয়ে উঠেছিল, সে হচ্ছে চার পাশের নরনারীর উপর তাঁর অগাধ অবজ্ঞা। রত্নময়ী তাঁর পূর্বপুরুষদের তিন শত বৎসরের সঞ্চিত অহংকার উত্তরাধিকারীস্বত্বে লাভ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, রত্নময়ীর অন্তরে তাঁর রূপেরও অসাধারণ অহংকার ছিল। কেননা তাঁর কাছে সে রূপ ছিল তাঁর আভিজাত্যের প্রত্যক্ষ নিদর্শন। রত্নময়ীর মতে রূপের উদ্দেশ্য মানুষকে আকর্ষণ করা নয়—তিরস্কার করা। তিনি যখন মন্দিরে যেতেন তখন পথের লোকজন সব দূরে সরে দাঁড়াত, কেননা তাঁর সকল অঙ্গ, তাঁর বর্ণ ও রেখার নীরব ভাষায় সকলকে বলত, “দূর হ! ছায়া মাড়ালে নাইতে হবে।” বলা বাহুল্য, তিনি কোনো দিকে দৃপাত করতেন না, মাটির দিকে চেয়ে সকল পথ রূপে আলো করে সোজা মন্দিরে যেতেন, আবার ঠিক সেই ভাবে বাড়ি ফিরে আসতেন। রঙ্গিণী জানালার ফাঁক দিয়ে রত্নময়ীকে নিত্য দেখত, এবং তার সকল মন, সকল দেহ হিংসার বিষে জর্জরিত হয়ে উঠত—যেহেতু রঙ্গিণীর আর যাই থাক্, রূপ ছিল না। আর, তার রূপের অভাব তার মনকে অতিশয় ব্যথা দিত, কেননা তার স্বামী রতিলাল ছিল অতি সুপুরুষ।

ধনঞ্জয় যেমন টাকা ভালোবাসতেন, রঙ্গিণী তেমনি তার স্বামীকে ভালোবাসত—অর্থাৎ এ ভালোবাসা একটি প্রচণ্ড ক্ষুধা ব্যতীত আর কিছুই নয়, এবং সে ক্ষুধা শারীরিক ক্ষুধার মতোই অন্ধ ও নির্মম। এ ভালোবাসার সঙ্গে মনের কতটা সম্পর্ক ছিল বলা কঠিন, কেননা ধনঞ্জয় ও রঙ্গিণীর মতো জীবদের মন, দেহের অতিরিক্ত নয়, অন্তর্ভূত বস্তু। তার পর ধনঞ্জয় যে ভাবে টাকা ভালোবাসতেন, রঙ্গিনী ঠিক সেই ভাবে তার স্বামীকে ভালোবাসত—অর্থাৎ নিজের সম্পত্তি হিসেবে। সে সম্পত্তির উপর কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে—এ কথা মনে হলে সে একেবারে মায়ামমতাশূন্য হয়ে পড়ত, এবং সে সম্পত্তি রক্ষা করবার জন্য পৃথিবীতে এমন নিষ্ঠুর কাজ নেই যা রঙ্গিণী না করতে পারত।

রঙ্গিণীর মনে সম্পূর্ণ অকারণে এই সন্দেহ জন্মেছিল যে, রতিলাল রত্নময়ীর রূপে মুগ্ধ হয়েছে; ক্রমে সেই সন্দেহ তার কাছে নিশ্চয়তায় পরিণত হল। রঙ্গিণী হঠাৎ আবিষ্কার করলে যে, রতিলাল লুকিয়ে লুকিয়ে উগ্রনারায়ণের বাড়ি যায়, এবং যতক্ষণ পারে ততক্ষণ সেইখানেই কাটায়। এর যথার্থ কারণ এই যে, রতিলাল, রত্নময়ীর বাড়ীতে আশ্রিত যে ব্রাহ্মণটি ছিল তার কাছে ভাঙ খেতে যেত। তার পর রত্নময়ীর ছেলেটির উপর নিঃসন্তান রতিলালের এতদূর মায়া পড়ে গিয়েছিল যে সে কিরীটচন্দ্রকে না দেখে একদিনও থাকতে পারত না। বলা বাহুল্য, রত্নময়ীর সঙ্গে রতিলালের কখনো চার চক্ষুর মিলন হয় নি, কেননা পাঠানপাড়ার প্রজারা তার অন্তঃপুরের দ্বার রক্ষা করত। কিন্তু রঙ্গিণীর মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, রত্নময়ী তার স্বামীকে সুপুরুষ দেখে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এর প্রতিশোধ নেবার জন্য—তার মজ্জাগত হিংসাপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্য, রঙ্গিণী রত্নময়ীর ছেলেটিকে যখ্ দেবার জন্য কৃতসংকল্প হল। রঙ্গিণী একদিন ধনঞ্জয়কে জানিয়ে দিলে যে যখ্ দেওয়া সম্বন্ধে তার আর কোনো আপত্তি নেই, শুধু তাই নয়, ছেলের সন্ধান সে নিজেই করবে।

এ কাজ অবশ্য অতি গোপনে উদ্ধার করতে হয়। তাই বাপে মেয়েতে পরামর্শ করে স্থির হল যে, রঙ্গিণীর শোবার পাশের ঘরটিতে যখ্ দেওয়া হবে। দু-চার দিনের ‘ভিতর সে ঘরটির সব দুয়ার জানালা ইট দিয়ে গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া হল। তার পর অতি গোপনে ধনঞ্জয়ের সঞ্চিত যত সোনা রুপোর টাকা ছিল সব বড়ো বড়ো তামার ঘড়াতে পুরে সেই ঘরে সারি সারি সাজিয়ে রাখা হল। যখন ধনঞ্জয়ের সকল ধন সেই কুঠরীজাত হল, তখন রঙ্গিণী একদিন রতিলালকে বললে যে, রত্নময়ীর ছেলেটি এত সুন্দর যে তার সেই ছেলেটিকে একবার কোলে করতে নিতান্ত ইচ্ছে যায়; সুতরাং যে উপায়েই হোক তাকে একদিন রঙ্গিণীর কাছে আনতেই হবে। রতিলাল উত্তর করলে, সে অসম্ভব, রত্নময়ীর লাঠিয়ালরা টের পেলে তার মাথা নেবে। কিন্তু রঙ্গিণী এত নাছোড়া হয়ে তাকে ধরে বসল যে রতিলাল অগত্যা একদিন সন্ধ্যাবেলা কিরীটচন্দ্রকে ভুলিয়ে সঙ্গে করে রঙ্গিণীর কাছে নিয়ে এল। কিরীটচন্দ্র আসবামাত্র রঙ্গিণী ছুটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলে, চুমো খেলে, কত আদর করলে, কত মিষ্টি কথা বললে। তার পর সে কিরীটচন্দ্রের গায়ে লাল চেলির জোড়, তার গলায় ফুলের মালা, তার কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, আর তার হাতে দু গাছি সোনার বালা পরিয়ে দিলে। কিরীটচন্দ্রের এই সাজ দেখে রতিলালের চোখমুখ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তার পর রঙ্গিণী হঠাৎ তার হাত ধরে টেনে নিয়ে, সেই ব্রাহ্মণশিশুকে সেই অন্ধকূপের ভিতর পুরে দিয়ে, বাইরে থেকে দরজার গা-চাবি বন্ধ করে চলে গেল। রতিলাল এ দোর ও দোর ঠেলে দেখে বুঝলে যে, রঙ্গিণী তাকেও তার শোবার ঘরে বন্দী করে চলে গিয়েছে। রতিলাল ঠেলে, ঘুসো মেরে, লাথি মেরে সেই অন্ধকূপের কপাট ভাঙবার চেষ্টা করে দেখলে সে চেষ্টা বৃথা। সে কপাট এত ভারী আর এত শক্ত যে কুড়োল দিয়েও তা কাটা কঠিন কিরীটচন্দ্র সেই অন্ধকার ঘরে বন্ধ হয়ে প্রথমে ককিয়ে কাঁদতে লাগলে, তার পর রতিলালকে ‘দাদা’ ‘দাদা’ বলে ডাকতে লাগলে। দু-তিন ঘণ্টার পর তার কান্নার আওয়াজ আর শুনতে পাওয়া গেল না। রতিলাল বুঝলে সে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার পর তিন দিন তিন রাত নিজের ঘরে বন্দী হয়ে রতিলাল কখনো শোনে যে কিরীটচন্দ্র দুয়োরে মাথা ঠুকছে, কখনো শোনে সে কাঁদছে, আবার কখনো-বা চুপচাপ। রতিলাল এই তিন দিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দিনের ভিতর হাজার বার পাগলের মতো ছুটে গিয়ে সেই কপাট ভাঙতে চেষ্টা করেছে অথচ সে দরজা একচুলও নাড়াতে পারে নি। যখন কান্নার আওয়াজ তার কানে আসত তখন রতিলাল দুয়োরের কাছে ছুটে গিয়ে বলত, “দাদা দাদা, অমন করে কেঁদো না, কোনো ভয় নেই, আমি এখানে আছি।” রতিলালের গলা শুনে সে ছেলে আরো জোরে কেঁদে উঠত, ঘন ঘন কপাটে মাথা ঠুকত; রতিলাল তখন দুই কানে হাত দিয়ে ঘরের অন্য কোণে পালিয়ে যেত ও চীৎকার করে কখনো রঙ্গিণীকে কখনো ধনঞ্জয়কে ডাকত, এবং যা মুখে আসে তাই বলে গালি দিত। এই পৈশাচিক ব্যাপারে সে এতটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল যে, কিরীটচন্দ্রের উদ্ধারের যে অপর কোনো উপায় হতে পারে, এ কথা মুহূর্তের জন্যও তার মনে উদয় হয় নি, তার সকল মন ঐ কান্নার টানে সেই অন্ধকূপের মধ্যেই বন্দী হয়েছিল।

তিন দিনের পর সেই শিশুর ক্রন্দনধ্বনি ক্রমে অতি মৃদু, অতি ক্ষীণ হয়ে এসে, পঞ্চম দিনে একেবারে থেমে গেল। রতিলাল বুঝলে, কিরীটচন্দ্রের ক্ষুদ্র প্রাণের শেষ হয়ে গিয়েছে। তখন সে তার ঘরের জানালার লোহার গরাদে দু হাতে ফাঁক করে নীচে লাফিয়ে পড়ে একদৌড়ে রত্নময়ীর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হল। সেদিন দেখলে অন্তঃপুরের দরজায় প্রহরী নেই, পাঠানপাড়ার প্রজারা সব ছেলে খোঁজবার জন্য নানা দিকে বেরিয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে রতিলাল রত্নময়ীর নিকট উপস্থিত হয়ে সকল ঘটনা তার কাছে এক নিশ্বাসে জানালে। আজ তিন বৎসরের মধ্যে রত্নময়ীর মুখে কেউ হাসি দেখে নি। তার ছেলের এই নিষ্ঠুর হত্যার কথা শুনে তার মুখ চোখ সব উজ্জ্বল হয়ে উঠলে, দেখতে দেখতে মনে হল সে যেন হেসে উঠলে। এ দৃশ্য রতিলালের কাছে এতই অদ্ভুত বোধ হল যে, সে রত্নময়ীর কাছ থেকে ছুটে পালিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

তার পর, সেই দিন দুপুর রাত্তিরে যখন সকলে শুতে গিয়েছে—রত্নময়ী নিজের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে। সকল শরিকের বাড়ি সব গায়ে গায়ে। তাই ঘণ্টা-খানেকের মধ্যে সে আগুন দেবতার রোষাগ্নির মতো ব্যাপ্ত হয়ে ধনঞ্জয়ের বাড়ি আক্রমণ করলে। ধনঞ্জয় ও রঙ্গিণী ঘর থেকে বেরিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল, সদর ফটকে এসে দেখে রত্নময়ীকে ঘিরে পাঠানপাড়ার প্রায় একশো প্রজা ঢাল সড়কি ও তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রত্নময়ীর আদেশে তারা ধনঞ্জয় ও রঙ্গিণীকে সড়কির পর সড়কির ঘায়ে আপাদমস্তক ক্ষতবিক্ষত করে সেই জ্বলন্ত আগুনের ভিতর ফেলে দিলে। রত্নময়ী অমনি অট্টহাস্য করে উঠল। তার সঙ্গীরা বুঝলে যে, সে পাগল হয়ে গিয়েছে।

তার পর সেই পাঠানপাড়ার প্রজাদের মাথায় খুন চড়ে গেল। তারা ধনঞ্জয়ের চাকর দাসী, আমলা ফয়লা, দারোয়ান বরকন্দাজ যাকে সুমুখে পেলে তার উপরেই সড়কি ও তলোয়ার চালালে, রায়বংশের পৈতৃক ভিটার উপরে আগুনের ও নীচে রক্তের নদী বইতে লাগল। তার পর ঝড় উঠল, ভূমিকম্প হতে লাগল। যখন সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেল তখন রত্নময়ী সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করলে।

রুদ্রপুরের সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। শুধু কিরীটচন্দ্রের কান্না ও রত্নময়ীর উন্মত্ত হাসি আজও তার আকাশ-বাতাস পূর্ণ করে রেখেছে।

আষাঢ় ১৩২৩

সকল অধ্যায়

১. প্রবাসস্মৃতি
২. আহুতি
৩. বড়োবাবুর বড়োদিন
৪. একটি সাদা গল্প
৫. ফরমায়েশি গল্প
৬. ছোটো গল্প
৭. রাম ও শ্যাম
৮. অদৃষ্ট
৯. নীল-লোহিত
১০. নীল-লোহিতের সৌরাষ্ট্র-লীলা
১১. প্রিন্স
১২. বীরপুরুষের লাঞ্ছনা
১৩. গল্প লেখা
১৪. ভাববার কথা
১৫. সম্পাদক ও বন্ধু
১৬. পূজার বলি
১৭. সহযাত্রী
১৮. ঝাঁপান খেলা
১৯. নীল-লোহিতের স্বয়ম্বর
২০. ভূতের গল্প
২১. দিদিমার গল্প
২২. অবনীভূষণের সাধনা ও সিদ্ধি
২৩. নীল-লোহিতের আদিপ্রেম
২৪. অ্যাডভেঞ্চার : জলে
২৫. ট্রাজেডির সূত্রপাত
২৬. মন্ত্রশক্তি
২৭. যখ
২৮. ঘোষালের হেঁয়ালি
২৯. বীণাবাই
৩০. ঝোট্টন ও লোট্টন
৩১. মেরি ক্রিসমাস
৩২. ফার্স্ট ক্লাস ভূত
৩৩. সল্পগল্প
৩৪. জুড়ি দৃশ্য
৩৫. পুতুলের বিবাহবিভ্রাট
৩৬. চাহার দরবেশ
৩৭. সারদাদাদার সন্ন্যাস
৩৮. ধ্বংসপুরী
৩৯. সারদাদাদার সত্য গল্প
৪০. সরু মোটা
৪১. সোনার গাছ হীরের ফুল
৪২. সীতাপতি রায়
৪৩. সত্য কি স্বপ্ন?
৪৪. অ্যাডভেঞ্চার : স্থলে
৪৫. প্রগতিরহস্য
৪৬. প্রফেসারের কথা
৪৭. চার-ইয়ারি কথা
৪৮. প্রসঙ্গকথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন