নির্জন রোগীর ঘর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নির্জন রোগীর ঘর।
খোলা দ্বার দিয়ে
বাঁকা ছায়া পড়েছে শয্যায়।
শীতের মধ্যাহ্নতাপে তন্দ্রাতুর বেলা
চলেছে মন্থরগতি
শৈবালে দুর্বলস্রোত নদীর মতন।
মাঝে মাঝে জাগে যেন দূর অতীতের দীর্ঘশ্বাস
শস্যহীন মাঠে।

মনে পড়ে কতদিন
ভাঙা পাড়িতলে পদ্মা
কর্মহীন প্রৌঢ় প্রভাতের
ছায়াতে আলোতে
আমার উদাস চিন্তা দেয় ভাসাইয়া
ফেনায় ফেনায়।
স্পর্শ করি শূন্যের কিনারা
জেলেডিঙি চলে পাল তুলে,
যূথভ্রষ্ট শুভ্র মেঘ পড়ে থাকে আকাশের কোণে।
আলোতে ঝিকিয়া-ওঠা ঘট কাঁখে পল্লীমেয়েদের
ঘোমটায় গুন্ঠিত আলাপে
গুঞ্জরিত বাঁকা পথে আম্রবনচ্ছায়ে
কোকিল কোথায় ডাকে ক্ষণে ক্ষণে নিভৃত শাখায়,
ছায়ায় কুন্ঠিত পল্লীজীবনযাত্রার
রহস্যের আবরণ কাঁপাইয়া তোলে মোর মনে।
পুকুরের ধারে ধারে সর্ষেখেতে পূর্ণ হয়ে যায়
ধরণীর প্রতিদান রৌদ্রের দানের,
সূর্যের মন্দিরতলে পুষ্পের নৈবেদ্য থাকে পাতা।

আমি শান্ত দৃষ্টি মেলি নিভৃত প্রহরে
পাঠায়েছি নিঃশব্দ বন্দনা,
সেই সবিতারে যাঁর জ্যোতীরূপে প্রথম মানুষ
মর্তের প্রাঙ্গণতলে দেবতার দেখেছে স্বরূপ।
মনে মনে ভাবিয়াছি, প্রাচীন যুগের
বৈদিক মন্ত্রের বাণী কন্ঠে যদি থাকিত আমার
মিলিত আমার স্তব স্বচ্ছ এই আলোকে আলোকে;
ভাষা নাই, ভাষা নাই;
চেয়ে দূর দিগন্তের পানে
মৌন মোর মেলিয়াছি পাণ্ডুনীল মধ্যাহ্ন-আকাশে।

উদয়ন, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – দুপুর, পূর্বপাঠ: ৭ পৌষ, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪০

সকল অধ্যায়

১. এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি
২. পরম সুন্দর আলোকের স্নানপুণ্য প্রাতে
৩. নির্জন রোগীর ঘর
৪. ঘন্টা বাজে দূরে
৫. মুক্তবাতায়নপ্রান্তে জনশূন্য ঘরে
৬. অতি দূরে আকাশের সুকুমার পান্ডুর নীলিমা
৭. হিংস্র রাত্রি আসে চুপে চুপে
৮. একা ব’সে সংসারের প্রান্ত-জানালায়
৯. বিরাট সৃষ্টির ক্ষেত্রে
১০. অলস সময়-ধারা বেয়ে
১১. পলাশ আনন্দমূর্তি জীবনের ফাগুনদিনের
১২. দ্বার খোলা ছিল মনে
১৩. ভালোবাসা এসেছিল একদিন তরুণ বয়সে
১৪. প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর
১৫. খ্যাতি নিন্দা পার হয়ে জীবনের এসেছি প্রদোষে
১৬. দিন পরে যায় দিন
১৭. যখন এ দেহ হতে রোগে ও জরায়
১৮. ফসল কাটা হলে সারা মাঠ হয়ে যায় ফাঁক
১৯. দিদিমণি– অফুরান সান্ত্বনার খনি
২০. বিশুদাদা– দীর্ঘবপু, দৃঢ়বাহু, দুঃসহ কর্তব্যে নাহি বাধা
২১. চিরদিন আছি আমি অকেজোর দলে
২২. নারী তুমি ধন্যা
২৩. নগাধিরাজের দূর নেবু-নিকুঞ্জের
২৪. অলস শয্যার পাশে জীবন মন্থরগতি চলে
২৫. বিরাট মানবচিত্তে
২৬. এ কথা সে কথা মনে আসে
২৭. বাক্যের যে ছন্দোজাল শিখেছি গাঁথিতে
২৮. মিলের চুমকি গাঁথি ছন্দের পাড়ের মাঝে মাঝে
২৯. এ জীবনে সুন্দরের পেয়েছি মধুর আশীর্বাদ
৩০. ধীরে সন্ধ্যা আসে
৩১. ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় যাত্রার সময় বুঝি এল
৩২. আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই
৩৩. এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন