উন্নতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উপরে যাবার সিঁড়ি,
         তারি নীচে দক্ষিণের বারান্দায়
             নীলমণি মাস্টারের কাছে
                 সকালে পড়তে হত ইংলিশ রীডার।
  ভাঙা পাঁচিলের কাছে ছিল মস্ত তেঁতুলের গাছ।
                 ফল পাকবার বেলা।
ডালে ডালে ঝপাঝপ বাঁদরের হ’ত লাফালাফি।
      ইংরেজি বানান ছেড়ে দুই চক্ষু ছুটে যেত
             লেজ-দোলা বাঁদরের দিকে।
      সেই উপলক্ষে–
আমার বুদ্ধির সঙ্গে রাঙামুখো বাঁদরের
         নির্ভেদ নির্ণয় করে
             মাস্টার দিতেন কানমলা।
 
ছুটি হলে পরে
      শুরু হত আমার মাস্টারি
             উদ্ভিদ্‌-মহলে।
      ফলসা চালতা ছিল, ছিল সার-বাঁধা
             সুপুরির গাছ।
অনাহূত জন্মেছিল কী করে কুলের এক চারা
      বাড়ির গা ঘেঁষে;
  সেটাই আমার ছাত্র ছিল।
      ছড়ি দিয়ে মারতেম তাকে।
  বলতেম, “দেখ্‌ দেখি বোকা,
      উঁচু ফলসার গাছে ফল ধরে গেল–
কোথাকার বেঁটে কুল উন্নতির উৎসাহই নেই।’
      শুনেছি বাবার মুখে যত উপদেশ
তার মধ্যে বার বার “উন্নতি’ কথাটা শোনা যেত।
         ভাঙা বোতলের ঝুড়ি বেচে
      শেষকালে কে হয়েছে লক্ষপতি ধনী
             সেই গল্প শুনে শুনে
উন্নতি যে কাকে বলে দেখেছি সুস্পষ্ট তার ছবি।
         বড়ো হওয়া চাই–
অর্থাৎ, নিতান্ত পক্ষে হতে হবে বাজিদপুরের
      ভজু মল্লিকের জুড়ি।
  ফলসার ফলে ভরা গাছ
বাগান-মহলে সেই ভজু মহাজন।
      চারাটাকে রোজ বোঝাতেম,
  ওরই মতো বড়ো হতে হবে।
কাঠি দিয়ে মাপি তাকে এবেলা ওবেলা–
      আমারি কেবল রাগ বাড়ে,
         আর কিছু বাড়ে না তো।
সেই কাঠি দিয়ে তাকে মারি শেষে সপাসপ্‌ জোরে–
      একটু ফলে নি তাতে ফল।
             কান-মলা যত দিই
         পাতাগুলো ম’লে ম’লে,
                 ততই উন্নতি তার কমে।
 
এ দিকে ছিলেন বাবা ইন্‌কম্‌-ট্যাক্সো-কালেক্টার,
         বদলি হলেন
             বর্ধমান ডিভিজনে।
      উচ্চ ইংরেজির স্কুলে পড়া শুরু করে
                 উচ্চতার পূর্ণ পরিণতি
                     কোলকাতা গিয়ে।
             বাবার মৃত্যুর পরে সেক্রেটারিয়েটে
                 উন্নতির ভিত্তি ফাঁদা গেল।
         বহুকষ্টে বহু ঋণ করে
                 বোনের দিয়েছি বিয়ে।
         নিজের বিবাহ প্রায় টার্মিনসে এল
                 আগামী ফাল্গুন মাসে নবমী তিথিতে।
      নববসন্তের হাওয়া ভিতরে বাইরে
             বইতে আরম্ভ হল যেই
                 এমন সময়ে, রিডাক্‌শান্‌।
             পোকা-খাওয়া কাঁচা ফল
                 বাইরেতে দিব্যি টুপ্‌টুপে,
                     ঝুপ্‌ করে খসে পড়ে
                         বাতাসের এক দমকায়,
                            আমার সে দশা।
      বসন্তের আয়োজনে যে একটু ত্রুটি হল
             সে কেবল আমারি কপালে।
      আপিসের লক্ষ্মী ফিরালেন মুখ,
         ঘরের লক্ষ্মীও
             স্বর্ণকমলের খোঁজে অন্যত্র হলেন নিরুদ্দেশ।
      সার্টিফিকেটের তাড়া হাতে,
         শুক্‌নো মুখ,
             চোখ গেছে বসে,
                 তুবড়ে গিয়েছে পেট,
                     জুতোটার তলা ছেঁড়া,
                         দেহের বর্ণের সঙ্গে চাদরের
                            ঘুচে গেছে বর্ণভেদ–
      ঘুরে মরি বড়োলোকদের দ্বারে।
                 এমন সময় চিঠি এল
                     ভজু মহাজন
                 দেনায় দিয়েছে ক্রোক ভিটেবাড়িখানা।
 
    বাড়ি গিয়ে উপরের ঘরে
জানলা খুলতে সেটা ডালে ঠেকে গেল।
        রাগ হল মনে–
ঠেলাঠেলি করে দেখি,
           আরে আরে ছাত্র যে আমার!
        শেষকালে বড়োই তো হল,
               উন্নতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিলে
        ভজু মল্লিকেরই মতো আমার দুয়ারে দিয়ে হানা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন