২৫. উহুদ যুদ্ধ

প্রতিশোধমূলক যুদ্ধের জন্যে কুরাইশদের প্রস্তুতি (اِسْتِعْدَادُ قُرَيْشٍ لِمَعْرِكَةٍ نَاقِمَةٍ):

বদরের যুদ্ধে মক্কাবাসীগণের পরাজয় ও অপমানের যে গ্লানি এবং তাদের সম্ভ্রান্ত ও নেতৃস্থানীয় লোকদের হত্যার যে দুঃখভার বহন করতে হয়েছিল তারই কারণে তারা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও প্রতিহিংসার অনলে দগ্ধীভূত হচ্ছিল। এমনকি তারা তাদের নিহতদের জন্যে শোক প্রকাশ করতেও নিষেধ করে দিয়েছিল এবং বন্দীদের মুক্তিপণ আদায়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতেও নিষেধ করেছিল, যাতে মুসলিমরা তাদের দুঃখ যাতনার কাঠিন্য সম্পর্কে ধারণা করতে না পারে। অধিকন্তু তারা বদর যুদ্ধের পর এ বিষয়ে সর্ব সম্মত সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল যে, মুসলিমগণের সঙ্গে এক ভীষণ যুদ্ধ করে নিজেদের কলিজা ঠান্ডা করবে এবং নিজেদের ক্রোধ ও প্রতিহিংসার প্রক্ষোভ প্রশমিত করবে। এ প্রেক্ষিতে কালবিলম্ব না করে যুদ্ধের জন্য তারা সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণও শুরু করে দেয়। এ কাজে কুরাইশ নেতৃবর্গের মধ্যে ইকরামা ইবনু আবূ জাহল, সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া, আবূ সুফইয়ান ইবনু হারব এবং আব্দুল্লাহ ইবনু রাবীআহ খুব বেশী উদ্যোগী ও অগ্রগামী ছিল।

তারা এ ব্যাপারে প্রথম যে কাজটি করে তা হচ্ছে, আবূ সুফইয়ানের যে কাফেলা বদর যুদ্ধের কারণ হয়েছিল এবং যেটাকে আবূ সুফইয়ান বাঁচিয়ে বের করে নিয়ে যেতে সফলকাম হয়েছিল, তার সমস্ত ধনমাল সামরিক খাতে ব্যয় করার জন্যে আটক করে রাখা। ঐ মালের মালিকদের সম্বোধন করে তারা বলেছিল, ‘হে কুরাইশের লোকেরা, মুহাম্মাদ (ﷺ) তোমাদের ভীষণ ক্ষতি সাধন করেছে এবং তোমাদের বিশিষ্ট নেতাদের হত্যা করেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে যু্দ্ধ করার জন্যে এ মালের মাধ্যমে সাহায্য কর। সম্ভবত আমরা প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারব।’ কুরাইশরা তাদের এ কথা সমর্থন করে। সুতরাং সমস্ত মাল, যার পরিমাণ ছিল এক হাজার উট এবং পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য তা সবই বিক্রয় করে দেয়া হয়।

এ ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করেন:‏(‏إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُنفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوْا عَن سَبِيْلِ اللهِ فَسَيُنفِقُوْنَهَا ثُمَّ تَكُوْنُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُوْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏ :‏ 36‏]‏

‘যে সব লোক সত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে তারা আল্লাহর পথ হতে (লোকেদেরকে) বাধা দেয়ার জন্য তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে থাকে, তারা তা ব্যয় করতেই থাকবে, অতঃপর এটাই তাদের দুঃখ ও অনুশোচনার কারণ হবে। পরে তারা পরাজিতও হবে।’ [আল-আনফাল (৮) : ৩৬]

অতঃপর তারা স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এ ঘোষণা দিল, ‘যে কোন সেনা ‘কিনানাহ’ এবং ‘তেহামাহ’র অধিবাসীদের মধ্য হতে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে চায় সে যেন কুরাইশদের পতাকা তুলে সমবেত হয়।’

এ ছাড়া আরবের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন বংশ ও বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদেরকে উত্তেজিত করে তুলতে লাগল। এ জন্য তারা মক্কায় দু’জন কবিকে বিশেষভাবে নিয়োজিত করল। তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিল আবূ আযযা। এ নরাধম বদরের যুদ্ধে মুসলিমগণের হাতে বন্দী হয়েছিল। অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দয়ায় বিনা মুক্তিপণে মুক্তি পেয়েছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল যে, আর কখনো মুসলিমগণের বিরুদ্ধাচরণ করবে না। কিন্তু মক্কায় পৌঁছামাত্র সে খুব জোরালো কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে কেমন ঠকিয়ে এসেছি।’ যা হোক, এ নরাধম কুরাইশের অন্যতম কবি মুসাফে’ ইবনু আবদে মানাফ জুমাহির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন গোত্রের আরবদের নিকট উপস্থিত হয়ে নিজেদের দুষ্ট প্রতিভা ও শয়তানী শক্তির প্রভাবে হিজাযের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রচারণার আগুন জ্বালিয়ে দিল। এ কাজে উৎসাহিত করার জন্য সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া আবূ আয্যাহকে প্রতিশ্রুতি দিল যে, সে যদি নিরাপদে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয় তাহলে ধন সম্পদ দিয়ে তাকে ধনবান করে দেবে। অন্যথায় তার কন্যাদের লালন-পালনের জামিন হয়ে যাবে।

অধিকন্তু, ধর্মের অপমান, ধর্ম মন্দিরের অপমান, ঠাকুর-দেবতার অপমান ইত্যাদি বিষয়ে মুখরোচক ও অপ-প্রচারণা চালিয়ে সর্বত্র তারা এমনই উত্তেজনা সৃষ্টি করে দিল যে, অল্পকালের মধ্যেই নানা স্থান হতে বহু দুর্ধর্ষ আরব যোদ্ধা এসে মক্কায় সমবেত হল এবং দেখতে দেখতে প্রায় তিন সহস্র সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।

এদিকে আবূ সুফইয়ান ‘গাযওয়ায়ে সাভীক’ থেকে অকৃতকার্য হয়ে সমস্ত ধন সম্পদ ফেলে দিয়ে পলায়ন করে এসেছিল। সে সম্পর্কেও মুসলিমগণের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করল।

এ ছাড়াও সারিয়্যায়ে যায়দ বিন হারিসার ঘটনাটি কুরাইশদের যে আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছিল এবং তাদের যে দুঃখ কষ্টের কারণ হয়েছিল- এ ঘটনাও যেন কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটার মতো হল এবং মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এক ফায়সালাকারী যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।

কুরাইশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম এবং কামান (قَوَامُ جَيْشِ قُرَيْشٍ وَقِيَادَتِهِ):

বছর পূর্ণ হতে না হতেই কুরাইশের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেল। তিন হাজার সৈন্যের এক বাহিনীর সঙ্গে ১৫ জন মহিলা গেল। কুরাইশ নেতৃবর্গের ধারণায় মেয়েদেরকে সঙ্গে রাখলে তাদের মান-সম্ভ্রম রক্ষাহেতু বেশী করে বীরত্ব প্রকাশ করার ও ‘আমরণ লড়ে যাওয়ার প্রেরণা লাভ করা যাবে।

সওয়ারীর জন্য তাদের সঙ্গে ছিল তিন হাজার উট এবং যুদ্ধের জন্য ছিল দু’শটি ঘোড়া।[1] ঘোড়াগুলোকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখার জন্য ওগুলোর পিঠে আরোহণ করা হয়নি। প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে সাত’শটি ছিল লৌহবর্ম। পুরো বাহিনীর জন্য আবূ সুফইয়ানকে সেনাপতি নির্বাচন করা হয় এবং খালিদ ইবনু ওয়ালীদকে ঘোড়সওয়ারী বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়, আর ইকরামা ইবনু আবূ জাহলকে তার সহকারী বানানো হয়। প্রথা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পতাকা বনু আবিদ্দার গোত্রের হস্তে সমর্পণ করা হয়।

[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯২ পৃ: এটাই বিখ্যাত কথা । কিন্তু ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৪৬ পৃষ্ঠাতে ঘোড়ার সংখ্যা একশ‘ বলা হয়েছে।

 মক্কা বাহিনীর যুদ্ধ যাত্রা (جَيْشُ مَكَّةَ يَتَحَرَّكُ):

এরূপ সম্পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণের পর মক্কাবাহিনী এমন অবস্থায় মদীনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করল যে, মুসলিমগণের বিরুদ্ধে ক্রোধ, প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধ গ্রহণের উত্তেজনা তাদের অন্তরে অগ্নিশিখার ন্যায় প্রজ্জ্বলিত ছিল, যা অচিরেই এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইঙ্গিত বহন করছিল।

 মদীনায় সংবাদ (حَرْكَةُ الْعَدُوِّ):

আব্বাস (রাঃ) কুরাইশের এ উদ্যোগ আয়োজন ও যুদ্ধ প্রস্তুতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং এতে তিনি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছিলেন। সুতরাং তিনি এর বিস্তারিত সংবাদ সম্বলিত একখানা পত্রসহ জনৈক বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে মদীনায় প্রেরণ করেন। আব্বাস (রাঃ)-এর দূত অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মদীনার পথে এগিয়ে চললেন। মক্কা হতে মদীনা পর্যন্ত প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার পথ মাত্র তিন দিনে অতিক্রম করে তিনি ঐ পত্রখানা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাতে অর্পণ করেন। ঐ সময় তিনি মসজিদে কুবাতে অবস্থান করছিলেন।

উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) পত্রখানা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে পাঠ করে শুনালেন। তিনি এগুলোর গোপনীয়তা রক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং খুব দ্রুত গতিতে মদীনায় আগমন করে আনসার ও মুহাজিরদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে সলা-পরমার্শ করেন।

 আকস্মিক যুদ্ধাবস্থা মোকাবেলার প্রস্তুতি (اِسْتِعْدَادُ الْمُسْلِمِيْنَ لِلطَّوَارِئْ):

এরপর মদীনায় সাধারণ সামরিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেল। যে কোন আকস্মিক আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে জনগণ সদাসর্বদা রণসাজে সজ্জিত হয়ে থাকতে লাগলেন। এমনকি সালাতের সময়েও তাঁরা অস্ত্র-শস্ত্র সরিয়ে রাখতেন না।

এদিকে আনসারদের এক ক্ষুদ্র বাহিনী, যাদের মধ্যে সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ), উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) এবং সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ) ছিলেন, এরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিত হয়ে যান।

তারা অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘরের দরজার উপর অবস্থান নিয়ে রাত্রি অতিবাহিত করতেন।

আরো কিছু সংখ্যক বাহিনী মদীনার বিভিন্ন প্রবেশ পথে নিয়োজিত হয়ে যান এ আশঙ্কায় যে, না জানি অসতর্ক অবস্থায় আকস্মিক কোন আক্রমণের শিকার হতে হয়।

অন্য কিছু সংখ্যক বাহিনী শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্যে গোয়েন্দাগিরির কাজ শুরু করে দেন।

 মদীনার প্রান্তদেশে মক্কা সেনা বাহিনী (الْجَيْشُ الْمَكِّيْ إَلٰى أَسْوَارِ الْمَدِيْنَةِ):

এদিকে মক্কা সেনাবাহিনী সুপ্রসিদ্ধ রাজপথ দিয়ে চলতে থাকে। যখন তারা আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছে তখন আবূ সুফইয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতু ‘উতবাহ এ প্রস্তাব দেয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাতার সমাধি উৎপাটন করা হোক। কিন্তু এর দরজা খুলে দেয়ার কঠিন পরিণামের কথা চিন্তা করে সেনাবাহিনী তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করে।

এরপর এ সেনাবাহিনী তাদের সফর অব্যাহত রাখে এবং শেষ পর্যন্ত মদীনার নিকটবর্তী হয়ে প্রথমে ‘আকীক, নামক উপত্যকা অতিক্রম করে। তারপর কিছুটা ডান দিকে বাঁকিয়ে উহুদের নিকটবর্তী ‘আয়নাইন’ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে, যা মদীনার উত্তরে ‘কানাত’ উপত্যকার ধারে অবস্থিত, এটা ছিল তৃতীয় হিজরীর ৬ই শাওয়াল, শুক্রবারের ঘটনা।

 মদীনার প্রতিরক্ষা হেতু পরামর্শ সভার বৈঠক (الْمَجْلِسُ الْاِسْتِشَارِيْ لِأَخْذِ خُطَّةِ الدِّفَاعِ):

মদীনার গোয়েন্দা বাহিনী মক্কা সেনাবাহিনীর এক একটি করে খবর মদীনায় পৌঁছে দিচ্ছিল। এমনকি তাদের শিবির স্থাপন করার শেষ সংবাদটিও তাঁরা পৌঁছে দেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি পরামর্শ করার ইচ্ছা করেছিলেন। ঐ সভায় তিনি নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথাও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,

‏‏(‏إِنِّيْ قَدْ رَأَيْتُ وَاللهِ خَيْراً، رَأَيْتُ بَقَراً يُذْبَحُ، وَرَأَيْتُ فِيْ ذُبَابٍ سَيْفَيْ ثُلْماً، وَرَأَيْتُ أَنِّيْ أَدْخَلْتُ يَدِيْ فِيْ دِرْعٍ حَصِيْنَةٍ‏)

‘আল্লাহর শপথ! আমি একটি ভাল জিনিস দেখেছি। আমি দেখি যে, কতগুলো গাভী যবেহ করা হচ্ছে। আরো দেখি যে, আমার তরবারীর মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে। আর এও দেখি যে, আমি আমার হাতখানা একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে ঢুকিয়েছি।’ তারপর তিনি গাভীর এ তা’বীর ব্যাখ্যা করেন যে, কিছু সাহাবা (রাঃ) নিহত হবেন। আর তরবারীর ভঙ্গুরতার এ তা’বীর করেন যে, তার বাড়ির কোন লোক শহীদ হবেন এবং সুরক্ষিত বর্মের এ তা’বীর করেন যে, এর দ্বারা মদীনা শহরকে বুঝানো হয়েছে।

অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-এর সামনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রতিরোধমূলক কর্মসূচী সম্পর্কে এ মত পেশ করেন যে, এবার নগরের বাইরে গমন করা কোন মতেই সঙ্গত হবে না, বরং নগরের অভ্যন্তরে থেকে যুদ্ধ করাই সঙ্গত হবে। কেননা, মদীনা একটি সুরক্ষিত শহর। সুতরাং শত্রু-সৈন্য নগরের নিকটবর্তী হলে মুসলিমরা সহজেই তাদের ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হবে। আর মহিলারা ছাদের উপর থেকে তাদেরকে ইট পাটকেল ছুঁড়বে। এটাই ছিল সঠিক মত। আর মুনাফিক্বদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইও এ মত সমর্থন করে। সে এ পরামর্শ সভায় খাযরাজ গোত্রের একজন প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল। সে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ মত সমর্থন করেনি, বরং যুদ্ধ থেকে দূরে থাকাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। কারণ এর ফলে সে যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতেও পারছে, আবার কেউ এর টেরও পাচ্ছে না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। তিনি চেয়েছিলেন যে, এ লোকটি তার সঙ্গীসাথীসহ সর্ব সম্মুখে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হোক এবং তার কপটতার উপর যে পর্দা পড়ে ছিল তা অপসৃত হয়ে যাক। আর মুসলিমরা তাদের চরম বিপদের সময় যেন এটা জানতে পারে যে, তাদের জামার আস্তিনের মধ্যে কত সাপ চলাফেরা করছে।

কিন্তু বিশিষ্ট সাহাবীগণের একটি দল এ প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। তারা সবিনয় নিবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা এ প্রস্তাব সমর্থন করতে পারছি না। কারণ আমাদের মতে, এভাবে নগরে অবরুদ্ধ হয়ে থাকলে শত্রুপক্ষের সাহস বেড়ে যাবে। তারা মনে করবে যে, আমরা তাদের বলবিক্রম দর্শনে ভীত হয়ে পড়েছি। আমরা শত্রুপক্ষকে দেখাতে চাই যে, আমরা দুর্বল নই কিংবা কাপুরুষও নই। আজ যদি আমরা অগ্রসর হয়ে আক্রমণ করতে পারি তবে ভবিষ্যতে মক্কাবাসীগণ আমাদেরকে আক্রমণ করতে এত সহজে সাহসী হতে পারবে না।’ এরই মধ্যে আবার কেউ কেউ তো বলে উঠলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমরা তো এ দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আমরা আল্লাহর কাছে এ মুহূর্তের জন্যই দু‘আ করেছিলাম তিনি তা গ্রহণ করেছেন। এটাই ময়দানে যাওয়ার উপযু্ক্ত সময়।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতৃতুল্য বীরকেশরী হামযাহ (রাঃ) এতক্ষণ চুপ করে এ সব আলোচনা শ্রবণ করে যাচ্ছিলেন। এতক্ষণে তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘এটাই তো কথার মতো কথা। আমরা সত্যের সেবক মুসলিম। সত্যের সেবায় প্রাণ বিলিয়ে দেয়াই আমাদের পার্থিব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা। জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে এবং জীবন মরণ তাঁরই অধিকারে। এ ধরণের চিন্তা করার কোন দরকার আমাদের নেই। হে আল্লাহর সত্য নাবী (ﷺ), যিনি আপনার উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন তাঁর শপথ! মদীনার বাইরে গিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ না করে আমি খাবার স্পর্শ করব না।’[1]

রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) অধিকাংশের এ মতের সামনে নিজের মত পরিত্যাগ করলেন এবং মদীনার বাইরে গিয়েই শত্রু বাহিনীর সঙ্গে যু্দ্ধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।

[1] সীরাতে হালবিয়্যাহ ২য় খন্ড ১৪ পৃঃ।

 ইসলামী সেনাবাহিনীর বিন্যাস এবং যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাত্রা (تَكْتِيْبُ الْجَيْشِ الْإِسِلاَمِيْ وَخُرُوْجِهِ إِلٰى سَاحَةِ الْقِتَالِ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জুম’আর সালাতে ইমামত করেন। খুতবা দান কালে তিনি জনগণকে উপদেশ দেন, সংগ্রামের প্রতি উৎসাহিত করেন এবং বলেন যে, ‘ধৈর্য্য ও স্থিরতার মাধ্যমেই বিজয় লাভ সম্ভব হতে পারে। এছাড়া তিনি তাদেরকে এ নির্দেশও দান করেন যে, তারা যেন মোকাবালার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়।’ তাঁর এ নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে জনগণের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।

অতঃপর আসরের সালাত শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যক্ষ করেন যে, লোকেরা জমায়েত হয়েছে এবং আওয়ালীর অধিবাসীগণও এসে পড়েছে। অতঃপর তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন, তাঁর সাথে আবূ বাকর (রাঃ) এবং উমারও (রাঃ) ছিলেন। তাঁরা তাঁর মাথায় পাগড়ী বেঁধে দিলেন ও দেহে পোষাক পরিয়ে দিলেন। তিনি উপরে ও নীচে দুটি লৌহ বর্ম পরিধান করলেন, তরবারী ধারণ করলেন এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জনগণের সামনে আগমন করলেন।

জনগণ তাঁর আগমনের অপেক্ষায় তো ছিলেনই, কিন্তু তাঁর আগমনের পূর্বে সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) এবং উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) জনগণকে বলেন, ‘আপনারা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে জোর করে ময়দানে বের হতে উত্তেজিত করেছেন। সুতরাং এখন ব্যাপারটা তাঁর উপরই ন্যস্ত করুন।’ এ কথা শুনে জনগণ লজ্জিত হলেন এবং যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বের হয়ে আসলেন তখন তাঁরা তাঁর নিকট আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনার বিরোধিতা করা আমাদের মোটেই উচিত ছিল না। সুতরাং আপনি যা পছন্দ করেন তাই করুন। যদি মদীনার অভ্যন্তরে অবস্থান করাই আপনি পছন্দ করেন তবে সেখানেই অবস্থান করুন, আমরা কোন আপত্তি করব না।’ তাঁদের এ কথার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘কোন নাবী যখন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যান তখন তাঁর জন্যে অস্ত্রশস্ত্র খুলে ফেলা সমীচীন নয়, যে পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ও শত্রুদের মধ্যে ফায়সালা করে না দেন।’[1]

  1. এরপর নাবী কারীম (ﷺ) সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেন:মুহাজিরদের বাহিনী। এর পতাকা মুসআব ইবনু উমায়ের আবদারী (রাঃ)-কে প্রদান করেন।
  2. আউস (আনসার) গোত্রের বাহিনী। এর পতাকা উসায়েদ ইবনু হুযাযির (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।
  3. খাযরাজ (আনসার) গোত্রের বাহিনী। এর পতাকা হাববাব ইবনু মুনযির (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।

মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার, যাদের মধ্যে একশ জন ছিলেন বর্ম পরিহিত এবং পঞ্চাশ জন ছিলেন ঘোড়সওয়ার।[2] আবার এ কথাও বলা হয়েছে যে, ঘোড়সওয়ার একজনও ছিল না।

যারা মদীনাতেই রয়ে গেছে সেসব লোকদেরকে সালাত পড়ানোর কাজে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দেন এবং মুসলিম বাহিনী উত্তর মুখে চলতে শুরু করে। সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) ও সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ) বর্ম পরিহিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগে আগে চলছিলেন।

‘সানিয়্যাতুল বিদা’ হতে সম্মুখে অগ্রসর হলে তাঁরা এমন বাহিনী দেখতে পান, যারা অত্যন্ত উত্তম অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ছিল এবং পুরো সেনাবাহিনী হতে পৃথক ছিল। তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন যে, তারা খাযরাজের মিত্র ইহুদী[3] যারা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা মুসলিম হয়েছে কি?’ জনগণ উত্তরে বলেন, ‘না’। তখন তিনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানালেন।

[1] মুসনাদে আহমাদ, নাসায়ী, হা’কিম ও ইবনু ইসহাক্ব।

[2] এ কথাটি ইবনু কাইয়্যেম যাদুল মা‘আদ, ২য় খন্ডের ৯২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। ইবনু হাজার বলেন, এটা ভুল কথা। মুসা ইবনু উক্ববা জোর দিয়ে বলেন, উহুদের যুদ্ধে মুসলিমগণের সাথে কোন ঘোড়াই ছিল না। ওয়াক্বিদী বলেন, শুধু দু’টি ঘোড়া ছিল। একটি ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এবং আরেকটি ছিল আবূ বুরদাহ (রাঃ)-এর নিকট। (ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড ৩৫০ পৃ:)

[3] এ ঘটনাটি ইবনু সা‘দ বর্ণনা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে যে, তারা বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রের ইহুদী ছিল। (২য় খন্ড ৩৪ পৃঃ)। কিন্তু এটা সঠিক কথা নয়। কেননা বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রকে বদর যুদ্ধের অল্প কিছু দিন পরেই নির্বাসন দেয়া হয়েছিল।

 সৈন্য পর্যবেক্ষণ (اِسْتِعْرَاضُ الْجَيْشِ):

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘শায়খান’ নামক স্থানে পৌঁছে সৈন্যবাহিনী পরিদর্শন করেন। যারা ছোট ও যুদ্ধের উপযুক্ত নয় বলে প্রতীয়মান হল তাদেরকে তিনি ফিরিয়ে দিলেন। তাদের নাম হচ্ছে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ), উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ), উসাইদ ইবনু যুহাইর (রাঃ), যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ), যায়দ ইবনু আরক্বাম (রাঃ), আরাবাহ ইবনু আউস (রাঃ), ‘আমর ইবনু হাযম (রাঃ), আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ), যায়দ ইবনু হারিসাহ আনসারী (রাঃ) এবং সা‘আদ ইবনু হাব্বাহ (রাঃ)।

এ তালিকাতেই বারা ইবনু আযিব (রাঃ)-এর নামও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সহীহুল বুখারীতে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তা দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয় যে, তিনি উহুদের যুদ্ধে শরীক ছিলেন। অবশ্যই অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রাফি ইবনু খাদীজ (রাঃ) এবং সামুরাহ ইবনু জুনদুব (রাঃ) যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি লাভ করেন। এর কারণ ছিল, রাফি ইবনু খাদীজ (রাঃ) বড়ই সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। যখন তাকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হলো তখন সামুরাহ ইবনু জুনদুর (রাঃ) বললেন, ‘আমি রাফি (রাঃ) অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী। আমি তাঁকে কুস্তিতে পরাস্ত করতে পারি।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ সংবাদ দেয়া হলে তিনি তাদের দুজনকে কুস্তি লাগিয়ে দেন এবং সত্যি সত্যিই সামুরাহ (রাঃ) রাফি (রাঃ)-কে পরাস্ত করে দেন। সুতরাং তিনিও যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতি পেয়ে যান।

 উহুদ ও মদীনার মধ্যস্থলে রাত্রি যাপন (الْمَبِيْتُ بَيْنَ أُحُدٍ وَالْمَدِيْنَةِ):

এ জায়গায় পৌঁছে সন্ধা হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ স্থানে মাগরিব ও এশার সালাত আদায় করেন এবং এখানেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পাহারার জন্যে পঞ্চাশ জন সাহাবী (রাঃ)-কে নির্বাচন করেন, যারা শিবিরের চার পাশে টহল দিতেন। তাদের পরিচালক ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা আনসারী (রাঃ)। এ ব্যক্তি হচ্ছেন সেই যিনি কা‘ব ইবনু আশরাফির হত্যাকারি দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাফওয়ান ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু ক্বায়স (রাঃ) নির্দিষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাশে পাহারা দিচ্ছিলেন।

আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সঙ্গীদের শঠতা (تَمَرُّدُ عَبْدُ اللهِ بْنِ أُبَيٍّ وَأَصْحَابِهِ):

ফজর হওয়ার কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুনরায় চলতে শুরু করলেন এবং ‘শাওত’ নামক স্থানে পৌঁছে ফজরের সালাত আদায় করলেন। এখন তিনি শত্রুদের নিকটে ছিলেন এবং উভয় সেনাবাহিনী একে অপরকে দেখতে ছিল। এখানে মুনাফিক্ব আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সে এক তৃতীয়াংশ সৈন্য (তিনশ জন সৈন্য) নিয়ে এ কথা বলতে বলতে ফিরে গেল যে, অযথা কেন জীবন দিতে যাব? সে এ বিতর্কও উত্থাপন করল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার কথা না মেনে অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তার কথা মেনে নেন নি এটা তার মুসলিম বাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অবশ্যই কারণ ছিল না। কেননা এ অবস্থায় নাবী (ﷺ)-এর সেনাবাহিনীর সাথে এত দূর পর্যন্ত তার আসার কোন প্রশ্নই উঠত না। বরং সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু হওয়ার পূর্বেই তার পৃথক হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। সুতরাং প্রকৃত ব্যাপার তা নয় যা সে প্রকাশ করেছিল। বরং প্রকৃত ব্যাপার ছিল, ঐ সংকটময় মুহূর্তে পৃথক হয়ে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা যখন শত্রুরা তাদের প্রতিটি কাজ কর্ম লক্ষ্য করছিল। তখন মুসলিম বাহিনীর মধ্যে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল তার মূখ্য উদ্দেশ্য। যাতে একদিকে সাধারণ সৈন্যরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গ ত্যাগ করে এবং যারা বাকী থাকবে তাদেরও উদ্যম ও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে, পক্ষান্তরে এ দৃশ্য দেখে শত্রুদের সাহস বেড়ে যায়। সুতরাং তার এ ব্যবস্থাপনা ছিল নাবী কারীম (ﷺ) এবং তার সঙ্গীদেরকে শেষ করে দেয়ারই এক অপকৌশল। মূলত ঐ মুনাফিক্বের এ আশা ছিল যে, শেষ পর্যন্ত তার ও তার বন্ধুদের নেতৃত্বের জন্য ময়দান সাফ হয়ে যাবে।

এ মুনাফিক্বের কোন কোন উদ্দেশ্য সফল হবারও উপক্রম হয়েছিল। কেননা আরো দুটি দলের অর্থাৎ আউস গোত্রের মধ্যে বনু হারিসাহ এবং খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বনু সালামাহরও পদস্খলন ঘটতে যাচ্ছিল এবং তারা ফিরে যাবার চিন্তা ভাবনা করছিল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের সহায়তা করেন। ফলে তাঁদের চিত্তচাঞ্চল্য দূর হয়ে যায় এবং তারা ফিরে যাবার সংকল্প ত্যাগ করে।

তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:‏(‏إِذْ هَمَّتْ طَّآئِفَتَانِ مِنكُمْ أَن تَفْشَلاَ وَاللهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ‏)‏ ‏[‏آل عمران‏ :‏ 122‏]

‘যখন তোমাদের মধ্যকার দু’দল ভীরুতা প্রকাশ করতে মনস্থ করেছিল, কিন্তু আল্লাহ উভয়ের বন্ধু ছিলেন, মু’মিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা।’ [আল ‘ইমরান (৩) : ১২২]

যাহোক, মুনাফিক্বরা ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ঐ সংকটময় সময়ে জাবির (রাঃ)-এর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনু হারাম (রাঃ) তাদেরকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেন। সুতরাং তিনি তাদেরকে ধমকের সুরে (যুদ্ধের জন্যে) ফিরে আসার উৎসাহ প্রদান করে তাদের পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন এবং বলতে থাকলেন, ‘এসো, আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর।’ কিন্তু তারা উত্তরে বলল, ‘আমরা যদি জানতাম যে, তোমরা যুদ্ধ করবে তবে আমরা ফিরে যেতাম না।’ এ উত্তর শুনে আব্দুল্লাহ ইবনু হারাম (রাঃ) এ কথা বলতে বলতে ফিরে আসলেন, ‘ওরে আল্লাহর শত্রুরা, তোদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হোক। মনে রেখ যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নাবী (ﷺ)-কে তোদের হতে বেপরোয়া করবেন।’ এ সব মুনাফিক্বের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‏(‏وَلْيَعْلَمَ الَّذِيْنَ نَافَقُوْا وَقِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أَوِ ادْفَعُوْا قَالُوْا لَوْ نَعْلَمُ قِتَالاً لاَّتَّبَعْنَاكُمْ هُمْ لِلْكُفْرِ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ مِنْهُمْ لِلإِيْمَانِ يَقُوْلُوْنَ بِأَفْوَاهِهِم مَّا لَيْسَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُوْنَ‏)‏ ‏[‏آل عمران‏ :‏ 167‏]

‘আর মুনাফিক্বদেরকেও জেনে নেয়া। তাদেরকে বলা হয়েছিল; এসো, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর, কিংবা (কমপক্ষে) নিজেদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা কর’। তখন তারা বলল, ‘যদি আমরা জানতাম যুদ্ধ হবে, তাহলে অবশ্যই তোমাদের অনুসরণ করতাম’। তারা ঐ দিন ঈমানের চেয়ে কুফরীরই নিকটতম ছিল, তারা মুখে এমন কথা বলে যা তাদের অন্তরে নেই, যা কিছু তারা গোপন করে আল্লাহ তা বিশেষরূপে জ্ঞাত আছেন।’ [আল ‘ইমরান (৩) : ১৬৭]

 উহুদ প্রান্তে অবশিষ্ট ইসলামী সেনাবাহিনী (بَقِيَّةُ الْجَيْشِ الْإِسْلاَمِيْ إِلٰى أُحُدٍ):

মুনাফিক্বদের এ শঠতা ও প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অবশিষ্ট সাতশ জন সৈন্য নিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে ধাবিত হলেন। শত্রুদের শিবির তাঁর মাঝে ও উহুদের মাঝে কয়েক দিক থেকে বাধা সৃষ্টি করছিল। তাই, তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘শত্রুদের পাশ দিয়ে গমন ছাড়াই ভিন্ন কোন পথ দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে এমন কেউ আছে কি?’ এ প্রশ্নের জবাবে আবূ খাইসামা (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এ খিদমতের জন্যে আমি হাযির আছি।’’ অতঃপর তিনি এক সংক্ষিপ্ত পথ অবলম্বন করলেন, যা মুশরিকদের সেনাবাহিনীকে পশ্চিম দিকে ছেড়ে দিয়ে বনু হারিসা গোত্রের শস্য ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিল।

এ পথ ধরে যাবার সময় তাদেরকে মিরবা’ ইবনু ক্বাইযীর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ লোকটি মুনাফিক্ব ছিল এবং অন্ধও ছিল। সে সেনাবাহিনীর আগমন অনুধাবন করে মুসলিমগণের মুখমণ্ডলে ধূলো নিক্ষেপ করল এবং বলতে লাগল, ‘আপনি যদি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) হন তবে জেনে রাখুন যে, আমার বাগানে আপনার প্রবেশের অনুমতি নেই।’’

তার এ কথা শোনা মাত্র মুসলিমরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে বললেন,

‏(‏لَا تَقْتُلُوْهُ، فَهٰذَا الْأعْمٰى أَعْمٰى الْقَلْبِ أَعْمٰى الْبَصَرِ‏)

‘তাকে হত্যা করো না, সে অন্তর ও চোখের অন্ধ।’’

তারপর নাবী কারীম (ﷺ) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উপত্যকার শেষ মাথায় অবস্থিত উহুদ পাহাড়ের ঘাটিতে অবতরণ করেন এবং সেখানে মুসলিম বাহিনীর শিবির স্থাপন করিয়ে নেন। সামনে ছিল মদীনা ও পিছনে হল সুউচ্চ উহুদ পর্বত। এভাবে শত্রুদের বাহিনী মুসলিম ও মদীনার মাঝে পৃথককারী সীমানা হয়ে গেল।

 প্রতিরোধ ব্যবস্থা (خُطَّةُ الدِّفَاعِ):

এখানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেনাবাহিনীর শ্রেণী-বিন্যাস করেন এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি সারিতে বিভক্ত করে নেন। সুনিপুণ তীরন্দাযদের একটি দলও নির্বাচন করা হয়। তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় পঞ্চাশ জন। আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ইবনু নু’মান আনসারী দাওসী বাদরী (রাঃ) এ দলের অধিনায়ক পদে নিয়োজিত হন। তাঁর দলকে কানাত উপত্যকার দক্ষিণে ইসলামী সৈন্যদের শিবির থেকে পূর্ব-দক্ষিণে একশ পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে একটি ছোট পাহাড়ের ধারে অবস্থান গ্রহণের দির্দেশ দেয়া হয়। ঐ পাহাড়টি এখন ‘জবলে রুমাত’ নামে প্রসিদ্ধ। ঐ পর্বতমালার মধ্যে একটি গিরিপথ ছিল। শত্রু সৈন্যরা যাতে পশ্চাৎ দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে এ জন্য এ পঞ্চাশ জন তীরন্দাযকে ঐ গিরিপথ রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত করা হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এদের অধিনায়ককে সম্বোধন করে বলেন,

‏‏(‏اِنْضَحِ الْخَيْلَ عَنَّا بِالنَّبْلِ، لَا يَأْتُوْنَا مِنْ خَلْفِنَا، إِنْ كَانَتْ لَنَا أَوْ عَلَيْنَا فَاثْبُتْ مَكَانَكَ، لَا نُؤْتِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ‏)

‘ঘোড়সওয়ারদেরকে তীর মেরে আমাদের নিকট থেকে দূরে রাখবে। তারা যেন পিছন থেকে কোন ক্রমেই আমাদেরকে আক্রমণ করতে না পারে। সাবধান, আমাদের জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমাদের দিক থেকে যেন আক্রমণ না হয়।’’[1]

তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুনরায় অধিনায়ককে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা আমাদের পিছন দিক রক্ষা করবে। যদি তোমরা দেখ যে, আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি তবুও তোমরা আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে না। আর যদি দেখতে পাও যে, আমরা গণীমতের মাল একত্রিত করছি তবে তখনও তোমরা আমাদের সাথে শরীক হবে না।[2] আর সহীহুল বুখারীর শব্দ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন,

‏‏(‏إِنْ رَأَيْتُمُوْنَا تَخْطَفْنَا الطَّيْرُ فَلَا تَبْرَحُوْا مَكَانَكُمْ هٰذَا حَتّٰى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ، وَإِنْ رَأَيْتُمُوْنَا هَزَمَنَا الْقَوْمَ وَوَطَأْنَاهُمْ فَلَا تَبْرَحُوْا حَتّٰى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ‏)

‘তোমরা যদি দেখ যে, পাখিগুলো আমাদেরকে ছোঁ মারছে, তবুও তোমরা নিজেদের জায়গা ছাড়বে না, যে পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে ডেকে না পাঠাই।’

আর যদি তোমরা দেখতে পাও যে, আমরা শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেছি এবং তাদেরকে পদদলিত করেছি, তবুও তোমরা নিজেদের জায়গা হতে সরবে না, যে পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে ডেকে না পাঠাই।[3]

এ কঠিনতম সামরিক নির্দেশাবলী ও হিদায়াতসহ এ বাহিনীকে তিনি ঐ পাহাড়ের গিরিপথে মোতায়েন করে দেন, যে পথ দিয়ে মুশরিকবাহিনী পিছন দিক থেকে মুসলিমদেরকে আক্রমণ করার খুবই আশঙ্কা ছিল।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অবশিষ্ট সৈন্যের শ্রেণীবিন্যাস এভাবে করেন যে, দক্ষিণ বাহুর উপর মুনযির ইবনু ‘আমর (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন এবং বাম বাহুর উপর নিযুক্ত করেন, যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ)-কে আর মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ (ﷺ)-কে তার সহকারীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যুবাইর (রাঃ)-এর উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয় যে, তিনি খালিদ ইবনু ওয়ালিদের (যিনি তখনও মুসলিম হন নি) ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে প্রতিরোধ করবেন। এ শ্রেণীবিন্যাস ছাড়াও সারির সম্মুখভাগে এমন বাছাইকৃত মুসলিম বীর মুজাহিদদেরকে নিযুক্ত করা হয় যাদের বীরত্বের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যাদের প্রত্যেককে হাজারের সমান মনে করা হতো।

রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর এ শ্রেণীবিন্যাস ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ও কৌশলপূর্ণ এবং এর দ্বারা তাঁর সামরিক দক্ষতা প্রমাণিত হয়। কোন কমান্ডার, সে যতই দক্ষ ও যোগ্য হোক না কেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) অপেক্ষা অধিক সূক্ষ্ণ ও নিপুণ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে না। কেননা, দেখা যায় যে, তিনি যদিও শত্রুবাহিনীর পরে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন, তথাপি তিনি স্বীয় সেনাবাহিনীর জন্যে এমন স্থান নির্বাচন করেছেন যা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে উত্তম স্থান ছিল। অর্থাৎ তিনি পাহাড়কে আড়াল করে নিয়ে পিছন ও দক্ষিণ বাহু রক্ষিত করে নেন এবং যে গিরি পথ দিয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণের আশঙ্কা ছিল ওটা তিনি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। আর শিবির স্থাপনের জন্যে একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। কারণ, যদি আল্লাহ না করুন পরাজয় বরণ করতে হয় তবে যেন পলায়নের পরিবর্তে শিবিরের মধ্যেই আশ্রয় নিতে পারা যায়। যদি শত্রুরা শিবির দখল করার জন্যে এগিয়ে আসে তবে যেন তাদেরকে ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অপর পক্ষে তিনি শত্রুু বাহিনীকে তাদের শিবির স্থাপনের জন্যে এমন নীচু জায়গা গ্রহণ করতে বাধ্য করেন যে, তারা জয় লাভ করলেও যেন তেমন কোন সুবিধা লাভ করতে না পারে। আর যদি মুসলিমরা জয়যুক্ত হন তবে যেন তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের হাত থেকে তারা রক্ষা না পায়। এভাবে তিনি বাছাই করা বীর পুরুষদের একটি দল গঠন করে সামরিক সংখ্যার স্বল্পতা পুরণ করে দেন। এটাই ছিল নাবী কারীম (ﷺ)-এর সেনাবাহিনীর শ্রেণীবিন্যাস যা তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের ৭ তারিখের শনিবার কার্যকর হয়েছিল।

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬৫৩ ও ৬৬ পৃঃ।

[2] মুসনাদে আহমাদ, তাবারানী ও হা’কিম, ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত , ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৫০ পৃঃ।

[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড, কিতাবুল জিহাদ ৪২৬ পৃঃ।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সেনাবাহিনীর মধ্যে বীরত্বের প্রেরণাদান (الرَّسُوْلُ ﷺ يَنْفُثُ رُوْحَ الْبَسَالَةِ فِيْ الْجَيْشِ):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘোষণা করেন যে, তিনি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যেন যুদ্ধ শুরু না করে। তিনি নীচে ও উপরে দুটি লৌহ বর্ম পরিহিত ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-কে যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে জোর দিয়ে বলেন যে, তারা যেন শত্রুদের সাথে মোকাবেলার সময় অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে বীরত্বের প্রেরণা দিয়ে তিনি একখানা অত্যন্ত ধারাল তরবারী হাতে নিয়ে বললেন,

‘কে এটা গ্রহণ করবে? কে এর মর্যাদা রক্ষা করবে?’’

‏‏(‏مَنْ يَّأْخُذُ هٰذَا السَّيْفَ بِحَقِّهِ‏؟‏‏)

বলা বাহুল্য যে, ঐ তরবারী খানা গ্রহণের জন্য চারদিক থেকে কয়েক শ’ বাহু উর্ধ্বে উত্থিত হয়েছিল যার মধ্যে আলী ইবনু আবূ ত্বালিব, জোবায়ের ইবনু ‘আউওয়াম এবং উমার ইবনু খাত্তাবও ছিলেন। উপস্থিতদের মধ্যে অনেকে ওটা গ্রহণ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু তা গ্রহণের জন্য আবূ দুজানাহ সিমাক ইবনু খারশা (রাঃ) সবার আগে অগ্রসর হলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ তরবারীর হক কী?’’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,

(‏أَنْ تَضْرِبَ بِهِ وُجُوْهَ الْعَدُوَّ حَتّٰى يَنْحَنِيَ‏)‏

‘এর দ্বারা তুমি শত্রুদের মুখমণ্ডলে এমন ভাবে মারবে যেন তা বেঁকে যায়।’

তখন তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল আমি এর হক আদায় করব।’’ তখন তলোয়ারটি তাঁর হাতে দিয়ে দেয়া হল।

আবূ দুজানাহ (রাঃ) অত্যন্ত বীর পুরুষ ছিলেন, যুদ্ধের সময় গর্ব ভরে চলাফেরা করতেন। তাঁর নিকট একটি লাল পাগড়ী ছিল যখন তিনি সেটা মাথায় বাঁধতেন তখন উপস্থিত জনতা অনুভব করতেন যে, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করবেন।

কাজেই তলোয়ারটি হাতে পেয়ে আবূ দুজানাহর গর্ব দেখে কে? তিনি মাথায় লাল রুমালের খুব সুন্দর পাগড়ি বেঁধে নিয়ে হেলতে দুলতে ও নর্তন কুর্দনের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে করতে গিয়ে কুরাইশ বাহিনীর উপর আপতিত হলেন। এ দৃশ্য দেখে করে নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,

(‏إِنَّهَا لَمَشِيَّةٌ يَبْغُضُهَا اللهُ إِلَّا فِيْ مِثْلِ هٰذَا الْمَوْطِنِ‏)

‘এরূপ চাল- চলন আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন না বটে, কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে নয়।’’

 মক্কা বাহিনীর বিন্যাস (تَعْبِئَـةُ الْجَيْشِ الْمَكِّيْ):

মুশরিকগণও কাতারবন্দী নীতির অনুসরণে নিজেদের সেনা বাহিনীর বিন্যাস সাধন করেছিল। তাদের সেনাপতি ছিল আবূ সুফইয়ান। সে নিজের কেন্দ্র তৈরি করেছিল সেনা বাহিনীর মধ্যস্থলে। দক্ষিণ বাহুর উপর ছিল খালিদ ইবনু ওয়ালীদ, যিনি তখন পর্যন্ত মুশরিক ছিলেন। বাম বাহুর উপর ছিল ইকরামা ইবনু আবূ জাহল। পদাতিক সৈন্যের সেনাপতি ছিল সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া আর তীরনন্দাজদের নেতা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনু রাবী’আহ।

তাদের পতাকা ছিল বনু আবদিদ্দারের ছোট একটি দলের হাতে। এ পদ তারা ঐ সময় হতে লাভ করেছিল যখন বনু আবদি মানাফ কুসাই হতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পদসমূহকে পরস্পর বন্টন করে নিয়েছিল। তারপর পূর্বপুরুষ হতে যে প্রথা চলে আসছিল ওটাকে সামনে রেখে কেউ এ পদের ব্যাপারে তাদের সাথে বিতর্কেও লিপ্ত হতে পারত না। কিন্তু সেনাপতি আবূ সুফইয়ান তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, বদরের যুদ্ধে তাদের পতাকা বাহক নযর ইবনু হারিস বন্দী হলে কুরাইশকে বড়ই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। এটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই তাদের ক্রোধ বৃদ্ধি করার জন্য বলেন, ‘হে বনী আবদিদ্দার গোত্র! বদরের যুদ্ধের দিন আমাদের পতাকা তোমরা নিয়ে রেখেছিলে। ঐ দিন আমাদেরকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল তা তোমরা অবগত আছ। প্রকৃত পক্ষে সেনাবাহিনীর উপর পতাকার দিক থেকেই বিপদ নেমে আসে। যখন পতাকা পতিত হয় তখন তাদের পা আলগা হয়ে যায়। সুতরাং এবার তোমরা আমাদের পতাকা সঠিকভাবে ধারণ করে থাকবে অথবা আমাদের পতাকা আমাদেরকেই দিয়ে দিবে। আমরা নিজেরাই এর ব্যবস্থা করব।’’ এ কথায় আবূ সুফইয়ানের যে উদ্দেশ্য ছিল তাতে সে সফলকাম হয়। কেননা, এ কথা শুনে বনু আবদিদ্দার ভীষণ চটে যায় এবং ক্রোধে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়। তারা বলে ওঠে, ‘আমরা আমাদের পতাকা তোমাদেরকে দেব? কারও মোকাবেলা হলে আমরা কী করি তা দেখতে পাবে।’’ আর বাস্তবিকই যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখন তারা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত এক এক করে সবাই মৃত্যুর কবলে পতিত হল।

 কুরাইশের রাজনৈতিক চাল (مُنَاوَرَاتٌ سِيَاسِيَةٌ مِنْ قِبَلِ قُرَيْشٍ)

যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু পূর্বে কুরাইশরা মুসলিমগণের সারিতে বিচ্ছিন্নতা ও বিবাদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। এ উদ্দেশ্যে আবূ সুফইয়ান আনসারদের নিকট পয়গাম পাঠায়, ‘তোমরা আমাদের স্বগোত্রের লোকগুলোকে পরিত্যাগ করে সরে দাঁড়াও, আমরা তোমাদেরকে কিছুই বলব না, তোমাদের নগর আক্রমণ করব না এবং এখান থেকেই ফিরে যাব।’’ আবূ সুফইয়ানের এ জঘন্য প্রস্তাব শ্রবণ করা মাত্রই আনসারগণ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন এবং তাকে প্রচন্ডভাবে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করতে লাগলেন।

উভয় সেনাবাহিনী একে অপরের নিকটবর্তী হলে কুরাইশরা তাদের পূর্বোক্ত উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে অন্য এক চেষ্টা করল এবং তা হচ্ছে, মদীনার আউস বংশে আবূ ‘আমর নামক একজন যাজক বাস করত, তার নাম ছিল আবদি ‘আমর ইবনু সুফী। ইসলামের পূর্বে সে রাহিব’ (বনবাসী) আখ্যায় আখ্যায়িত ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার নাম রেখেছিলেন ‘ফাসিক’ (লম্পট)। অজ্ঞতার যুগে সে আউস গোত্রের সর্দার ছিল। কিন্তু, ইসলামের আবির্ভাব ঘটলে ওটা তার গলার ফাঁস হয়ে যায় এবং প্রকাশ্যভাবে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শত্রুতায় লেগে পড়ে।

আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা দলে দলে মুসলিম হয়ে যাচ্ছে দেখে সে কতগুলো লোককে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় পালিয়ে যায় এবং সেখানে কুরাইশদের সাথে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। মদীনার এ প্রবীণ পুরোহিত কতিপয় দুর্ধর্ষ সৈন্য কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে সর্বপ্রথমে ময়দানে উপস্থিত হলো এবং আনসারদেরকে সম্বোধন করে উচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘হে মদীনার অধিবাসীরা। আমাকে চিনতে পারছ কি? আমি তোমাদের পুরোহিত আবূ আমির। তোমরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে ত্যাগ করে আমার সাথে যোগদান কর, তোমাদের কল্যাণ হবে।’ কিন্তু আনসারগণ এখন পুরোহিতদের প্রবঞ্চনার অতীত, তারা সমবেত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘দুর হ প্রবঞ্চক, তোর পৌরহিত্যের কোন ধার আমরা ধারি না, তোর অভিসন্ধি সিদ্ধ হবে না।’’ আবূ আমির কুরাইশদেরকে আশা দিয়ে বলেছিল, ‘আমি মদীনার পুরোহিত, যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে আমি একবার আহবান করলে মদীনাবাসীগণ সবাই আমার দলে যোগদান করবে।’’ কিন্তুু আনসারদের উত্তর শুনে সে বলতে লাগল, ‘দেখছি, আমার অবর্তমানে হতভাগারা একেবারে বিগড়ে গেছে। অতঃপর তার পৌরহিত্যের ক্ষুব্ধ অভিমান পুরাতন প্রতিহিংসার সাথে যোগ দিয়ে প্রচন্ড হয়ে উঠল এবং এ হতভাগাই সর্বপ্রথমে সদলবলে প্রস্তর ও বাণ বর্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধের সূত্রপাত করে দিল এবং শেষে আক্রমণের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর পেয়ে সরে দাঁড়াল। এভাবে কুরাইশদের পক্ষ হতে মুসলিমগণের কাতারে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করার দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেল। সংখ্যার আধিক্য ও সাজ-সরঞ্জামের প্রাচুর্য সত্ত্বেও মুশরিকগণ মুসলিমগণের ভয়ে কিরূপ ভীত হয়েছিল উপরের ঘটনা দ্বারা তা সহজেই অনুমান করা যায়।

 যুদ্ধোন্মাদোনা ও উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য কুরাইশ মহিলাদের কর্ম তৎপরতা (جُهُوْدُ نِسْوَةِ قُرَيْشٍ فِيْ التَّحْمِيْسِ):

এদিকে কুরাইশ মহিলারাও যুদ্ধে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তৎপর হয়ে উঠল। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আবূ সুফইয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতু ‘উতবাহ। এ মহিলারা সারিসমূহে ঘুরে ঘুরে ও দফ্ বাজিয়ে বাজিয়ে লোকদেরকে উত্তেজিত করল। কখনো কখনো তারা পতাকা বাহকদেরকে সম্বোধন করে বলত,

وَيْها بني عبد الــدار ** বনু আবদিদ্দার শুনে মোদের বাণী

ويـها حُمَاة الأدبـــار ** শুন পশ্চাদ ভাগের রক্ষিবাহিনী

ضـرباً بكـل بتـــــار ** খুব জোরে চালাবে শামশীর খাণি

অর্থাৎ ‘দেখ, হে বনু আবদিদ্দার! দেখ, হে পশ্চাদ্ভাগের রক্ষকবৃন্দ। তরবারী দ্বারা খুব আঘাত কর।

উত্তেজিত করতে গিয়ে কখনো কখনো তারা বলত,

إن تُـقْبلُـوا نُعَانـِـق **

ونَفــْرِشُ النمــارق **

أو تُـدْبِـرُوا نُـفـَارِق **

فــراق غيـر وَامـِق **

অর্থ: ‘যদি তোমরা অগ্রসর হতে পার তবে আমরাতোমাদেরকে আলিঙ্গন করব ও তোমাদের জন্যেশয্যা রচনা করব। আর যদি তোমরা পশ্চাদপদহও তবে আমরা রুখে দাঁড়াব এবং তোমাদের হতে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।’

 যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন (أَوَّلُ وُقُوْدِ الْمَعْرِكَةِ):

এরপর উভয় দল সম্পূর্ণ মুখোমুখী হয়ে যায় এবং একে অপরের নিকটবর্তী হয় ও যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুশরিকদের পতাকাবাহী ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ আবদারী যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন হয়। এ লোকটি ছিল কুরাইশের বড় বীর পুরুষ এবং ঘোড়সওয়ার। মুসলিমরা তাকে ‘কাবশুল কুতায়বা’ (সৈন্যদের ভেড়া) বলতেন। সে উষ্ট্রের উপর আরোহণ করে বেরিয়ে পড়ল এবং মোকাবালার জন্য আহবান করল। তার অত্যধিক বীরত্বের কারণে সাধারণ সাহাবীগণ তার সাথে মোকাবালা করার সাহস করলেন না। কিন্তু যুবাইর (রাঃ) অগ্রসর হন এবং এক মুহূর্তের অবকাশ না দিয়ে সিংহের মতো লম্ফ দিয়ে উটের উপর চড়ে বসেন এবং তাকে নিজের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে নেন। অতঃপর ভূমিতে লাফিয়ে পড়ে তাকে তরবারী দ্বারা দু’টুকরো করে দেন।

নাবী (ﷺ) এ আশাজনক দৃশ্য দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং উচ্চৈঃস্বরে তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তাঁর দেখাদেখি সাহাবীগণও তকবীর পাঠ করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুবাইর (রাঃ)-এর প্রশংসা করে বলেন,

‏(‏إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ حَوَارِياً، وَحَوَارِيْ الزُّبَيْرُ‏)‏

‘প্রত্যেক নাবীরই একজন সহচর থাকেন আর আমার সহচর হলেন যুবাইর (রাঃ)।’[1]

[1] সা’হিরে সীরাত হালাবিয়াহ এটা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাদীসে সমূহে এ বাক্যটি অন্য স্থলে উল্লেখিত আছে।

 যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল এবং পতাকাবাহকদের প্রাণনাশ (ثُقْلُ الْمَعْرِكَةِ حَوْلَ اللِّوَاءِ وَإِبَادَةُ حَمْلَتِهِ):

এরপর চতর্দিক হতে যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে এবং সারাটা ময়দানে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুশরিকদের পতাকা প্রতিষ্ঠিত ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে। বনু আবদিদ্দার নিজেদের কমান্ডার ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহর হত্যার পর একের পর এক পতাকাধারণ করতে থাকে। কিন্তু তারা সবাই নিহত হয়। সর্বপ্রথম ত্বালহাহর ভাই উসমান ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উঠিয়ে নেন এবং নিম্নের ছন্দ পাঠ করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হয় :إنَّ عَلٰى أهْل اللوَاء حقــاً ** أن تُخْضَبَ الصَّعْدَة أو تَنْدَقَّا

অর্থ : ‘পতাকাধারীদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, তাদের পতাকা রক্তে রঞ্জিত হবে অথবা ছিঁড়ে যাবে।’

এ ব্যক্তিকে হামযাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) আক্রমণ করেন এবং তাঁর কাঁধে এমন জোরে তরবারীর আঘাত করেন যে, ওটা তার হাতসহ কাঁধ কেটে দেয় এবং দেহ ভেদ করে নাভি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এমন কি ফুসফুসও দেখতে পাওয়া যায়।

এরপর আবূ সা‘দ ইবনু আবী ত্বালহাহ ঝান্ডা উঠিয়ে নেয়। তার উপর সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) তীর চালিয়ে দেন এবং ওটা ঠিক তার গলায় লেগে যায়, ফলে তার জিহবা বেরিয়ে আসে এবং তৎক্ষণাৎ সে মৃত্যুবরণ করে।

কিন্তু কোন কোন জীবনী লেখকের উক্তি হল, আবূ সা‘দ বাইরে বেরিয়ে এসে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ডাক দেয় এবং আলী (রাঃ) অগ্রসর হয়ে তার মোকাবালা করেন। উভয়ে একে অপরের উপর তরবারীর আঘাত করে। কিন্তুু আলী (রাঃ)-এর তরবারীর আঘাতে আবূ সা‘দ নিহত হয়।

এরপর মুসাফে‘ ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উঠিয়ে ধরে। কিন্তু আ’সিম ইবনু সা’বিত ইবনু আবী আফলাহ (রাঃ) তাঁকে তীর মেরে হত্যা করেন। তারপর তার ভাই কিলাব ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ ঝান্ডা তুলে ধরে। কিন্তু যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ) তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তার প্রাণ নাশ করেন। অতঃপর ঐ দুজনের ভাই জিলাস ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উত্তোলন করে। কিন্তু ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) তীর মেরে তার জীবন শেষ করে দেন। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, আ’সিম ইবনু সাবিত ইবনু আবী আফলাহ (রাঃ) তীর মেরে তাকে খতম করে দেন।

এরা একই পরিবারের ছয় ব্যক্তি ছিল। অর্থাৎ সবাই আবূ ত্বালহাহ আব্দুল্লাহ ইবনু উসমান ইবনু আবদিদ্দারের পুত্র অথবা পৌত্র ছিল, যারা মুশরিকদের ঝান্ডার হিফাযত করতে গিয়ে মারা পড়ল। এরপর বনু আবদিদ্দার গোত্রের আরতাত ইবনু শুরাহবীল নামক আর একটি লোক পতাকা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ) এবং মতান্তরে হামযাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। অতঃপর শুরাইহ ইবনু ক্বারিয পতাকা তুলে ধরে। কিন্তু কুযমান তাতে হত্যা করে। কুযমান মুনাফিক্ব ছিল এবং ইসলামের পরিবর্তে গোত্রীয় মর্যাদা রক্ষার উত্তেজনায় যুদ্ধ করতে এসেছিল।

শুরাইহর পর আবূ যায়দ ‘আমর ইবনু আবদি মানাফ আবদারী পতাকা সামলিয়ে নেয়। কিন্তু তাকেও কুযমান হত্যা করে ফেলে। তারপর শুরাহবীল ইবনু হাশিম আবদারীর এক পুত্র ঝান্ডা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু কুযমানের হাতে সেও মারা পড়ে।

বনু আবদিদ্দার গোত্রের এ দশ ব্যক্তি, যারা মুশরিকদের পতাকা উঠিয়েছিল, সবাই মারা গেল। এরপর গোত্রের কোন লোকই জীবিত থাকল না যে পতাকা উঠাতে পারে। কিন্তু ঐ সময় ‘সওয়াব’ নামক তাদের এক হাবসী গোলাম লাফিয়ে গিয়ে পতাকা উঠিয়ে নেয় এবং তার পূর্ববর্তী পতাকাবাহী মনিবদের চেয়েও বেশী বল বিক্রমে যুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত এক এক করে তার হাত দ’ুটি কর্তিত হয়। কিন্তু এর পরেও সে পতাকা পড়তে দেয় নি। বরং নিজের হাঁটুর ভরে বসে বক্ষ ও কাঁধের সাহায্য পতাকা খাড়া করে রাখে। অবশেষে সে কুযমানের হাতে নিহত হয়। ঐ সময়েও সে বলছিল, ‘হে আল্লাহ! এখন তো আমি কোন ওযর বাকী রাখি নি!’ ঐ গোলাম অর্থাৎ সওয়াব নিহত হওয়ার পর পতাকা ভূমির উপর পড়ে যায় এবং ওটা উঠাতে পারে এমন কেউই বেঁচে রইল না। এ কারণে ওটা পড়েই রইল।

 অবশিষ্ট অন্যান্য অংশসমূহে যুদ্ধের অবস্থা (الْقِتَالُ فِيْ بَقِيَّةِ النُّقَاطِ):

একদিকে মুশরিকদের পতাকা যুদ্ধের কেন্দ্রস্থলে প্রতিষ্ঠিত ছিল, অন্য দিকে যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যান্য অংশসমূহেও কঠিন যুদ্ধ চলছিল। মুসলিমগণের সারিসমূহের উপর ঈমানের রূহ ছেয়ে ছিল। এ কারণে তারা মুশরিক ও কাফির সৈন্যদের উপর ঐ জলপ্লাবনের মতো ভেঙ্গে পড়ছিলেন যার সামনে কোন বাঁধ টিকে থাকে না। এ সময় মুসলিমরা ‘আমিত’, ‘আমিত’ (মেরে ফেল, মেরে ফেল) বলছিলেন এবং এ যুদ্ধে এটাই তাঁদের নিদর্শনের রীতি ছিল।

এদিকে আবূ দুজানাহ (রাঃ) তার লাল পাগড়ী বেঁধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তরবারী উঠিয়ে নেন এবং ওর হক আদায় করার দূঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন ও যুদ্ধ করতে করতে বহু দূর পর্যন্ত ঢুকে পড়েন। যে মুশরিকের সাথেই তাঁর মোকাবালা হতো তাঁকেই তিনি হত্যা করে ফেলতেন। তিনি মুশরিকদের সারিগুলো উলট-পালট করে দেন।

যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘যখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তরবারী চাই এবং তিনি আমাকে তা না দেন তখন আমার অন্তরে চোট লাগে। আমি মনে মনে চিন্তা করি যে, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ফুফু সাফিয়্যাহর পুত্র এবং একজন কুরাইশ। আমি তাঁর নিকট গিয়ে আবূ দুজানার (রাঃ) পূর্বেই তরবারী চাই।’

কিন্তু তিনি আমাকে তা না দিয়ে আবূ দুজানা (রাঃ)-কে দিয়ে দেন। এ জন্য আমি আল্লাহর নামে শপথ করি যে, আবূ দুজানা (রাঃ) তরবারী দ্বারা কী করেন তা আমি অবশ্যই দেখব। সুতরাং আমি তাঁর পিছনে পিছনে থাকতে লাগলাম। দেখি যে, তিনি তার লাল পাগড়ীটি বের করে মাথায় বেঁধে নিলেন। তাঁর এ কাজ দেখে আনসারগণ মন্তব্য করলেন, ‘আবূ দুজানা (রাঃ) মৃত্যুর পাগড়ী বেঁধেছেন।’ অতঃপর তিনি নিম্নের কবিতা বলতে বলতে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হলেন:أنا الذي عاهـدني خليلي ** ونحـن بالسَّفْح لدى النَّخِيل

ألا أقوم الدَّهْرَ في الكَيول ** أضْرِبْ بسَيف الله والرسول

অর্থাৎ ‘আমি খেজুর বাগান প্রান্তে আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ অঙ্গীকার করেছি যে, কখনই আমি সারির পিছনে থাকব না, (বরং সামনে অগ্রসর হয়ে) আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ)-এর তরবারী চালনা করব।’

এরপর তিনি যাকেই সামনে পেতেন তাকে হত্যা করে ফেলতেন। এ দিকে মুশরিকদের মধ্যেও একজন লোক ছিল যে আমাদের কোন আহতকে পেলেই তাকে শেষ করে ফেলত। এ দুজন ক্রমে ক্রমে নিকটবর্তী হতে যাচ্ছিল। আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করলাম যে, যেন তাদের দুজনের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায়। ঘটনা ক্রমে হলোও তাই। উভয়ে একে অপরের উপর আঘাত হানল। কিন্তু আবূ দুজানা (রাঃ) এ আক্রমণ ঢাল দ্বারা প্রতিরোধ করলেন এবং মুশরিকের তরবারী ঢালে আটকে থেকে গেল। এরপর তিনি ঐ মুশরিকের উপর তরবারীর আক্রমণ চালালেন এবং সেখানেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।[1]

এরপর আবূ দুজানাহ (রাঃ) মুশরিকদের সারিগুলো ছিন্ন-ভিন্ন করতে করতে সামনে এগিয়ে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত কুরাইশী নারীদের নেত্রী পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। কিন্তু সে যে নারী এটা তাঁর জানা ছিল না। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেছেন, ‘আমি একটি লোককে দেখলাম যে, সে খুব জোরে শোরে মুশরিক সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করছে। সুতরাং আমি তাকে আমার নিশানার মধ্যে নিয়ে ফেললাম। কিন্তু যখন আমি তাঁকে তরবারী দ্বারা আক্রমণ করার ইচ্ছা করলাম তখন সে হায়! হায়! চিৎকার করে উঠল। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, সে একজন মহিলা। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তরবারী দ্বারা একজন মহিলাকে হত্যা করে তা কলংকিত করলাম না।’

এ মহিলাটি ছিল হিন্দা বিনতু ‘উতবাহ। আমি আবূ দুজানা (রাঃ)-কে দেখলাম যে, তিনি হিন্দা বিনতু ‘উতবাহর মাথার মধ্যভাগে তরবারী উঁচু করে ধরলেন এবং পরক্ষণেই সরিয়ে নিলেন। আমি বললাম আল্লাহ এবং তার রাসূলই (ﷺ) ভাল জানেন।[2]

এদিকে হামযাহও (রাঃ) সিংহের ন্যায় বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন এবং মধ্যভাগের সেনাবাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়ছিলেন। তাঁর সামনে মুশরিকদের বড় বড় বীর বাহাদুরেরা টিকতে পারছিল না। কিন্তু বড়ই আফসোসের কথা, এ ক্ষেত্রে তিনিও শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু তাঁকে সামনা সামনি বীর পুরুষের মতো শহীদ করা হয় নি বরং কাপুরুষের মতো গুপ্তভাবে শহীদ করা হয়েছিল।

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬৮-৬৯ পৃঃ।

[2] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৬৯ পৃঃ।

আল্লাহর সিংহ হামযাহ (রাঃ)-এর শাহাদত (مِصْرَعُ أَسَدِ اللهِ حَمْزَةَ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ):

হামযাহ (রাঃ)-এর ঘাতকের নাম ছিল ওয়াহশী ইবনু হারব। আমরা তার শাহাদতের ঘটনা ওয়াহশীর নিজের ভাষাতেই বর্ণনা করছি। সে বর্ণনা করেছে, ‘আমি জুবাইর ইবনু মুতইমের গোলাম ছিলাম। তার চাচা তুআইমাহ ইবনু আদী বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। যখন কুরাইশরা উহুদের যুদ্ধে বের হয় তখন জুবাইর ইবনু মুত‘ইম আমাকে বলে, ‘তুমি যদি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর চাচা হামযাহ (রাঃ)-কে আমার চাচার বিনিময়ে হত্যা কর তবে তোমাকে আযাদ করে দেয়া হবে।’ তার এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমিও লোকদের সাথে রওয়ানা হয়ে যাই। আমি ছিলাম একজন হাবশী লোক এবং হাবশীদের মতো বর্শা নিক্ষেপের কাজে আমি খুব পারদর্শী ছিলাম। আমার বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো খুবই কম। লোকদের মধ্যে যুদ্ধ যখন চরমে পৌঁছে তখন আমি বের হয়ে হামযাহ (রাঃ)-কে খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে আমি তাঁকে লোকদের মাঝে দেখতে পাই। তাঁকে ছায়া রং-এর উট বলে মনে হচ্ছিল। তিনি লোকদেরকে ছত্রভঙ্গ করে চলছিলেন।

আল্লাহর শপথ! আমি তাঁকে হত্যা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম এবং একটি বৃক্ষ অথবা একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে আমার নিকটে তাঁর আসার প্রতীক্ষা করছিলাম, ইতোমধ্যে সিবা’ ইবনু আবদিল উযযা আমার আগে গিয়ে তাঁর নিকট পৌঁছে যায়। তিনি তাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিয়ে বলেন, ‘ওরে লজ্জাস্থানের চামড়া কর্তনকারীর পুত্র, মজা দেখ।’ এ কথা বলেই তিনি এত জোরে তাকে তরবারীর আঘাত করেন যে, তার মাথা দেহচ্যুত হয়ে যায়।

এর সাথে সাথেই আমি বর্শা উঠিয়ে নেই এবং যখন তিনি আমার আওতার মধ্যে এসে পড়েন তখন আমি তাঁর দিকে ওটা ছুঁড়ে দেই এবং ওটা তাঁর নাভির নীচে লেগে যায় এবং পদদ্বয়ের মধ্যভাগ দিয়ে পার হয়ে যায়। তিনি আমার দিকে ধাওয়া করার ইচ্ছা করেন, কিন্তু অসমর্থ হন। আমি তাঁকে ঐ অবস্থায় ছেড়ে দেই। শেষ পর্যন্ত তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। এরপর আমি তাঁর মৃত দেহের নিকট গিয়ে বর্শা বের করে দেই এবং সৈন্যদের মধ্যে গিয়ে বসে পড়ি। (আমার কাজ সমাপ্ত হয়েছিল) তিনি ছাড়া আর কারো সাথে আমার কোন সম্বন্ধ ছিল না। আমি শুধু আযাদ হওয়ার জন্যেই তাঁকে হত্যা করেছিলাম। সুতরাং আমি মক্কায় ফিরে গেলে আমাকে আযাদ করে দেয়া হয়।[1]

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬৯-৭২ পৃ.। সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮৩ পৃ.। ওয়াহশী ত্বায়িফের যুদ্ধের পর ইসলাম গ্রহণ করে এবং আবূ বকর (রাঃ)-এর খিলাফত কালে তার ঐ বর্শা দিয়েই ইয়ামামার যুদ্ধে মুসাইলামা কায্যাবকে (মিথ্যুককে) হত্যা করে। রোমকদের বিরুদ্ধে ইয়ারমুকের যুদ্ধেও সে শরীক হয়।

 মুসলিমগণের উচ্চে অবস্থান (السِّيْطَرَةُ عَلٰى الْمَوْقِفِ):

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সিংহ হামযাহ (রাঃ)-এর শাহাদতের ফলে মুসলিমগণের অপূরণীয় ক্ষতি হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধে মুসলিমগণেরই পাল্লা ভারী থাকে। আবূ বাকর (রাঃ), উমার (রাঃ), আলী (রাঃ), যুবাইর (রাঃ), মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ), ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ), সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ), সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ), সা‘দ ইবনু রাবী (রাঃ), নযর ইবনু আনাস (রাঃ), প্রভৃতি মহান ব্যক্তিবর্গ এমন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন যে, মুশরিকরা হতোদ্যম ও নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে এবং তাদের দেহের শক্তি হ্রাস পায়।

 পত্নীর বক্ষ ছেড়ে তরবারীর ধারের উপর (مِنْ أِحْضَانِ الْمَرْأَةِ إِلٰى مُقَارَعَةِ السُّيُوْفِ وَالدرْقَةِ):

এদিকে আর এক দৃশ্য চোখে পড়ে। উপর্যুক্ত আত্মত্যাগীদের মধ্যে আর একজন হচ্ছেন হানযালাতুল গাসীল (রাঃ), যিনি এক অদ্ভূত মাহাত্ম্য নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিন ঐ আবূ আমির রাহিবের পুত্র, যে পরবর্তী কালে ফাসিক নামে প্রসিদ্ধ হয় এবং যার বর্ণনা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। হানযালা (রাঃ) নব বিবাহিত ছিলেন। যখন যুদ্ধে গমনের জন্য ঘোষণা দেয়া হয় তখন তিনি নববধূকে আলিঙ্গন করছিলেন। যুদ্ধের ঘোষণা শোনা মাত্রই তিনি নববধূর বক্ষ ছেড়ে দিয়ে জিহাদের জন্যে বেরিয়ে পড়েন। যখন উহুদ প্রান্তরে ভীষণ যুদ্ধ চলছে তখন তিনি মুশরিকদের সারিগুলো ভেদ করে তাদের সেনাপতি আবূ সুফইয়ান পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন এবং তাকে প্রায় ধরাশায়ী করতেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর ভাগ্যেই শাহাদত লিখে রেখেছিলেন। তাই যেমনই তিনি আবূ সুফইয়ানকে লক্ষ্য করে তরবারী উঁচু করে ধরেছেন, তেমনই শাদ্দাদ ইবনু আউস তাঁকে দেখে ফেলে এবং তৎক্ষণাৎ তাঁকে আক্রমণ করে। ফলে তিনি নিজেই শহীদ হয়ে গেলেন।

 তীরন্দাযদের কার্যকলাপ (نَصِيْبُ فَصِيْلَةِ الرُّمَاةِ فِيْ الْمَعْرِكَةِ):

জাবালে রুমতের উপর যে তীরন্দাযদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মোতায়েন করেছিলেন তাঁরাও যুদ্ধের গতি মুসলিমগণের অনুকূলে আনবার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মক্কার ঘোড়সওয়াররা খালিদ ইবনু ওয়ালীদের নেতৃত্বে এবং আবূ আমির ফাসিকের সহায়তায় মুসলিম সৈনিকদের বাম বাহু ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে তিন বার ভীষণ আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুসলিম তীরন্দাযগণ তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাদেরকে এমনভাবে ঘায়েল করে দেন যে তাদের তিনটি আক্রমণই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।[1]

[1] ফাতহুল বারি ৭ম খন্ড ৩৪৬ পৃঃ।

 মুশরিকদের পরাজয় (الْهَزِيْمَةُ تَنْزِلُ بِالْمُشْرِكِيْنَ):

কিছুক্ষণ ধরে এরূপ ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে এবং মুসলিমগণের ক্ষুদ্র বাহিনী যুদ্ধে পূর্ণভাবে আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। অবশেষে মুশরিকদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তাদের সারিগুলো ডান, বাম, সম্মুখ ও পিছন দিক হতে ছত্রভঙ্গ হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন তিন হাজার মুশরিককে সাতশ নয়, বরং ত্রিশ হাজার মুসলিমগণের সাথে মোকাবালা করতে হচ্ছে। আর এদিকে মুসলিমরা ঈমান, বিশ্বাস এবং বীরত্বের অত্যন্ত উঁচুমানের মনোবল নিয়ে তরবারী চালনা করছিলেন।

কুরাইশরা যখন মুসলিমগণের একাধিকবার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও অক্ষমতা অনুভব করল এবং তাদের মনোবল এমনভাবে ভেঙ্গে পড়ল যে, সওয়াবের হত্যার পর কারো সাহস হল না যে, যুদ্ধ চালু রাখার জন্যে তাদের ভূপতিত পতাকার নিকটবর্তী হয়ে ওটাকে উঁচু করে ধরে, তখন তারা পালিয়ে যাবার পন্থা অবলম্বন করল এবং মুসলিমগণের উপর হতে প্রতিশোধ গ্রহণের কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেল।

ইবনু ইসহাক্ব বলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণের উপর স্বীয় সাহায্য নাযিল করেন এবং তাঁদের সাথে কৃত ওয়াদা পুর্ণ করেন। মুসলিমরা মুশরিকদেরকে তরবারী দ্বারা এমনভাবে কর্তন করতে লাগলেন যে, তারা শিবির থেকেও পালিয়ে গেল এবং নিঃসন্দেহে তাদের পরাজয় ঘটে গেল।

আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর পিতা বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ আমি দেখি যে, হিন্দা বিনতু ‘উতবাহ এবং তার সঙ্গিনীদের পদনালী দেখা যাচ্ছে। তারা কাপড় উপরে উঠিয়ে নিয়ে পলায়ন করছে। তাদের গ্রেফতারীতে কম বেশী কোনই প্রতিবন্ধকতা ছিল না।[1]

সহীহুল বুখারীতে বারা‘ ইবনু আ’যিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘মুশরিকদের সাথে আমাদের মোকাবালা হলে তাদের মধ্যে পলায়নের হিড়িক পড়ে যায়, এমনকি আমি নারীদেরকে দেখি যে, তারা পায়ের গোছা হতে কাপড় উঠিয়ে নিয়ে দ্রুত বেগে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পায়ের অলংকার দেখা যাচ্ছিল।’[2]

আর এ সুযোগে মুসলিমরা মুশরিকদের উপর তরবারী চালাতে চালাতে ও তাদের পরিত্যক্ত মাল জমা করতে করতে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করছিলেন।’

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৭৭ পৃঃ।

[2] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৯ পৃঃ।

 তীরন্দাযদের ভয়ানক ভুল (غَلْطَةُ الرُّمَاةِ الْفَظِيْعَةِ):

তীরন্দাযবাহিনী এতক্ষণ পর্বতমূলে অবস্থান গ্রহণ ক’রে নিজেদের কর্তব্য পালন করে আসছিলেন। কিন্তু এ আশাতীত জয়ের উল্লাসে এখন তাঁরা আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তাঁদেরকে যে কোন অবস্থায় তাঁদের স্থান ত্যাগ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন তা তাঁরা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে গণীমত সংগ্রহের জন্য সমরক্ষেত্রের দিক ছুটে যেতে লাগলেন। সে জন্য যুদ্ধের চেহারা বদলে গেল। মুসলিমগণ ভীষণভাবে ক্ষতির স্বীকার হলেন, স্বয়ং নাবী (ﷺ) শহীদ হতে বেঁচে গেলেন!! আর এ কারণেই মুসলিম ভীতি যেটা বদর যুদ্ধের পরিণামে মুশরিকদের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছিল সেটা অনেকটা দূরভীত হতে লাগল। তার মূল কারণ হচ্ছে দুনিয়া প্রীতি, গণীমতের মালের লোভ। সুতরাং সে সময় তারা এক অপরকে বলছিল, গণীমত…….! গণীমত…….! তোমাদের সঙ্গীগণ জিতে গেছেন…….. আর অপেক্ষা কিসের? তাঁদের নায়ক আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাঃ) তাঁদেরকে নিবারিত করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। তিনি তাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কঠোর নিষেধের কথা স্মরণ করে দিলেন। কিন্তু তাঁর অধীনস্থ সৈনিকগণ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলতে লাগলেন, ‘এখন আমাদের সম্পূর্ণ জয় হয়েছে, সুতরাং এখন আর এখানে বসে থাকব কিসের জন্য?’[1] এ কথা বলে তাঁদের অধিকাংশ সৈনিকই স্থান ত্যাগ করে ময়দানের দিকে ছুটে গেলেন। আব্দুল্লাহ (রাঃ) মাত্র নয়জন লোককে নিয়ে ঐ স্থানে বসে রইলেন। যারা নিজ দায়িত্ব পালনে অটল থাকলেন যে, হয় তাঁদের প্রস্থানের অনুমতি দেওয়া হবে অন্যথা তাঁরা আমৃত্যু সেখানে অবস্থান করবেন।

[1] এ কথা সহীহুল বুখারীতে বারা’ ইবনু আযের কর্তৃক বর্ণিত আছে ১/৪২৬ পৃঃ।

 মুসলিম সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদের কৌশল নির্ধারণ (خَالِدُ بْنُ الْوَلِيْدِ يَقُوْمُ بِخُطَّةِ تَطْوِيْقِ الْجَيْشِ الْإِسْلاَمِيْ):

এরূপ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কঠোর আদেশ এবং সেনাপতির নিষেধ অমান্য করার ফলও ফলতে শুরু হল। আরবের বিখ্যাত বীর এবং রণকুশলী সেনাপতি খালিদ ইবনু ওয়ালীদ ঘোড়সওয়ার সেনাদল নিয়ে চারদিকে চক্রাকারে সুযোগের সন্ধান করে বেড়াচ্ছিল। সে আর কালবিলম্ব না করে সেই অরক্ষিত পথের দিকে নক্ষত্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল এবং দেখতে দেখতে পশ্চাদদিক দিয়ে মুসলিমগণের মাথার উপর এসে উপস্থিত হ’ল। শ্রেষ্ঠবীর আব্দুল্লাহ তাঁর সহচর কয়েকজনকে নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশ পালন করে চললেন। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে তাঁরা সবাই শাহাদত বরণ করলেন। এদিকে মুসলিম সৈন্যরা নির্ভাবনায় গণীমতের মাল সংগ্রহ করতে ব্যাপৃত আছেন। এমন সময় প্রথমে খালিদের ঘোড়সওয়ার সেনাদল এবং তার পর অন্যান্য ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক সেনাদল অতর্কিত অবস্থায় তাদেরকে ভীষণভাবে আক্রমণ করল এবং সতর্ক হবার আগেই বহু মুসলিমকে কুরাইশদের হাতে নিহত হতে হল। কুরাইশদের জাতীয় পতাকা এতক্ষণ মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল। খালিদের এ আক্রমণ এবং মুসলিমগণের উপস্থিত সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে আমরাহ বিনতু আলকামা নামে জনৈকা কুরাইশ বীরাঙ্গনা আবার তা তুলে ধরল। সম্পূর্ণ পরাজয়ের পর ভূলুণ্ঠিত জাতীয় পতাকাকে পুনরায় যুদ্ধ ক্ষেত্রে উড্ডীয়মান হতে দেখে ছুটে বিক্ষিপ্ত ও পলায়নপর কুরাইশ সৈন্যগণ আবার সেই পতাকার দিকে ছুটে আসল এবং তারা আবার দলবদ্ধভাবে মুসলিমগণকে আক্রমণ করল। এবার মুসলিমরা অগ্রপশ্চাৎ দু’ দিক হতে আক্রান্ত হয়ে যাঁতার মধ্যস্থলে পড়লে যে অবস্থা হয় তাই হল।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিপদসংকুল ফায়সালা এবং বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ (مَوْقِفُ الرَّسُوْلِ البَاسِلِ إِزَاءً عَمَلَ التَّطْوِيْقِ‏):

এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাত্র নয়জন[1] সাহাবীসহ পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন[2] এবং মুসলিমগণের শৌর্যবীর্য ও মুশরিকদের শোচনীয় অবস্থার দৃশ্য অবলোকন করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ খালিদ ইবনু ওয়ালীদের ঘোড়সওয়ার সৈন্যগণ তাঁর দৃষ্টি গোচর হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে দু’টি পথ ছিল। আর তা হচ্ছে, হয় তিনি তাঁর নয় জন সহচরসহ দ্রুত গতিতে পলায়ন করে কোন এক সুরক্ষিত স্থানে চলে যেতেন এবং স্বীয় সেনা বাহিনীকে যারা ভিড়ের মধ্যে পড়ে যেতে চাচ্ছিলেন, তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতেন, নয়তো নিজের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে স্বীয় সাহাবীদেরকে ডাক দিতেন এবং এক নির্ভরযোগ্য সংখ্যক সাহাবাকে নিজের কাছে একত্রিত করে তাদের মাধ্যমে অবরোধ ভেঙ্গে দিয়ে নিজের সেনাবাহিনীর জন্যে উহুদ পাহাড়ের উপরিভাগের দিকে চলে যাওয়ার পথ করে দিতেন। এ চরম সংকটময় মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তুলনাবিহীন বীরত্ব প্রকাশিত হয়েছে। কেননা তিনি নিজের জীবন রক্ষা করে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নিজের জীবনকে বিপদের মুখে নিক্ষেপ করে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর জীবন রক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

তাই তো তিনি খালিদ ইবনু ওয়ালীদের ঘোড়সওয়ার সৈন্যদেরকে দেখা মাত্রই উচ্চেঃস্বরে স্বীয় সাহাবীদেরকে ডাক দেন, ‘ওরে আল্লাহর বান্দারা এদিকে……….।’ অথচ তিনি জানতেন যে, তাঁর ঐ শব্দ মুসলিমগণের পূর্বে মুশরিকদেরই কানে পৌঁছবে। আর হলোও তাই। যেমন দেখা গেল যে, তাঁর ঐ আওয়াজ শুনে মুশরিকরা অবগত হল যে, এ মুহূর্তে তাঁর অবস্থান কোথায় রয়েছে। যার ফলে তাদের একটি বাহিনী মুসলিমগণের পূর্বেই তাঁর নিকটে এসে পড়ে এবং বাকী ঘোড়সওয়াররা দ্রুততার সাথে মুসলিমগণকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। এখন দুটি ভিড়ের বিস্তারিত বিবরণ পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করছি।

[1] সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ডের ১০৭ পৃঃ। বর্ণিত হয়েছে যে, উহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শুধুমাত্র ৭ জন আনসার ও ২ জন কুরাইশী সাহাবীর মাঝে রয়ে গিয়েছিলেন।

[2] এর দলীল আললাহ পাকের এ এরশাদ {
وَالرَّسُولُ يَدْعُوكُمْ فِي أُخْرَاكُمْ } (১৫৩) سورة آل عمران ‘এবং রাসূল (সাঃ) তোমাদেরকে তোমাদের পিছন হতে আহবান করছিলেন।’’

 মুসলিমগণের মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ততা (تَبَدُّدُ الْمُسْلِمِيْنَ فِيْ الْمَوْقِفِ):

যখন মুসলিমরা ভিড়ের মধ্যে এসে পড়েন তখন একটি দল তো জ্ঞানই হারিয়ে ফেলে। তাদের শুধু নিজেদের জীবনের চিন্তা ছিল। সুতরাং তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে দিয়ে পলায়নের পথ ধরল। পিছনে কী ঘটছে তার কোন খবরই তাদের ছিল না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো পালিয়ে গিয়ে মদীনায় ঢুকে পড়ে এবং কিছু লোক পাহাড়ের উপর উঠে পড়ে। আর একটি দল পিছনে ফিরল তারা মুশরিকদের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়। একে অপরকে চিনতে অসমর্থ হয়। এর ফলে মুসলিমগণেরই হাতে কোন কোন মুসলিম নিহত হয়। যেমন সহীহুল বুখারীতে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, উহুদ যুদ্ধের দিন (প্রথমে) মুশরিকরা পরাজিত হয়। এরপর ইবলীস (সাধারণভাবে) ডাক দিয়ে বলে, ‘ওরে আল্লাহর বান্দারা পিছনে (অর্থাৎ পিছন দিক হতে আক্রমণ কর)।’ তার এ কথায় সামনের সারির সৈন্যরা পিছন দিকে ফিরে আসে এবং পিছনের সারির সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হুযাইফা (রাঃ) দেখেন যে, তাঁর পিতা ইয়ামানের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। তিনি তখন বলে ওঠেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! ইনি যে আমার পিতা।’ কিন্তু আল্লাহর শপথ! (মুসলিম) সৈন্যগণ আক্রমণ হতে বিরত হলেন না। শেষ পর্যন্ত আমার পিতা নিহতই হয়ে গেলেন। হুযাইফা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ আপনাদেরকে ক্ষমা করুন।’ উরওয়া (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! হুযাইফা (রাঃ)-এর মধ্যে সদা-সর্বদা কল্যাণ বিরাজমান ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহ তা‘আলার সাথে মিলিত হন।’[1]

মোট কথা, এ দলের সারিতে কঠিন বিক্ষিপ্ততা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। বহু লোক চিন্তান্বিত ও পেরেশান ছিলেন। তাঁরা কোন্ দিকে যাবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় কোন ঘোষণাকারীর ঘোষণা শোনা গেল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন। এ ঘোষণা শুনে তারা জ্ঞান হারা হয়ে গেলেন। অধিকাংশ লোকেরই সাহস ও উদ্যম নষ্ট হয়ে গেল। কেউ কেউ যুদ্ধ বন্ধ করে দিল এবং দুঃখিত হয়ে অস্ত্র শস্ত্র ফেলে দিয়ে কেউ কেউ এ চিন্তাও করল যে, মুনাফিক্বদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই-এর সাথে মিলিত হয়ে তাকে বলা হোক যে, সে যেন আবূ সুফইয়ানের নিকট তাদের জন্যে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে।

কিছুক্ষণ পর ঐ লোকদের পাশ দিয়ে আনাস ইবনু নাযর (রাঃ) গমন করেন। তিনি দেখেন যে, তারা হাতের উপর হাত ধরে পড়ে আছে। তাদেরকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কিসের অপেক্ষা করছ?’ তাঁরা উত্তরে বলল, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিহত হয়েছেন।’ তাদের এ কথা শুনে আনাস ইবনু নাযর (রাঃ) তাদেরকে বললেন, ‘তাহলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যুর পর তোমরা জীবিত থেকে কী করবে? উঠো, যার উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবন দিয়েছেন তার উপর তোমরাও জীবন দিয়ে দাও।’ এরপর তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! ঐ লোকগুলো অর্থাৎ মুসলিমরা যা কিছু করেছে সে জন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আর ওরা অর্থাৎ মুশরিকরা যা কিছু করেছে তার সাথে আমার সম্পর্কচ্ছেদ করছি।’ এ কথা বলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হলেন। সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর সাথে দেখা হলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হে আবূ উমার (রাঃ)! কোথায় যাচ্ছেন?’ আনাস (রাঃ) উত্তরে বলেন, ‘জান্নাতের সুগন্ধি সম্পর্কে আর কী বলব! হে সা‘দ (রাঃ)! আমি ওর সুগন্ধ অনুভব করছি।’ এরপর তিনি সামনের দিকে গেলেন এবং মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। যুদ্ধ শেষে তাঁকে চেনা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাঁর ভগ্নী শুধু তাঁর আঙ্গুলগুলোর পোর দেখে তাঁকে চিনতে পারেন। তাঁকে বর্শা, তরবারী এবং তীরের আশিটিরও বেশী আঘাত লেগেছিল।[2]

অনুরূপ সাবিত ইবনু দাহ্দাহ (রাঃ) স্বীয় কওমকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়ে থাকেন তবে জেনে রেখ যে, আল্লাহ জীবিত রয়েছেন। তিনি মরতে পারেন না। তোমরা তোমাদের দ্বীনের জন্যে যুদ্ধ করে যাও। আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য ও বিজয় দান করবেন।’ তার এ কথা শুনে আনসারের একটি দল উঠে পড়েন এবং সা’বিত (রাঃ) তাদের সহায়তায় খালিদের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর উপর হামলা করেন এবং যুদ্ধ করতে করতে খালিদের বর্শার আঘাতে শহীদ হয়ে যান। তার মতো তার সঙ্গীরাও যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত লাভ করেন।’[3]

একজন মুহাজির সাহাবী একজন আনসারী সাহাবীর পাশ দিয়ে গমন করেন। যিনি রক্ত রঞ্জিত ছিলেন। মুহাজির তাঁকে বলেন, ‘হে অমুক ভাই! আপনি তো অবগত হয়েছেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন।’ তখন ঐ আনসারী বললেন, ‘যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়ে থাকেন তবে জেনে রাখুন যে, তিনি আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। এখন আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে ঐ দ্বীনের হিফাযতের জন্যে যুদ্ধ করা।’[4]

এরূপ সাহস ও উদ্যম বৃদ্ধিকারী কথায় মুসলিম সৈন্যদের উদ্যম বহাল হয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞান ও চেতনা জাগ্রত হয়। সুতরাং তাঁরা তখন অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দেয়া অথবা ইবনু উবাই এর সাথে মিলিত হয়ে নিরাপত্তা প্রার্থনার চিন্তার পরিবর্তে অস্ত্রশস্ত্র উঠিয়ে নেন এবং মুশরিকদের সাথে মোকাবালা করে তাঁদের অবরোধ ভেঙ্গে দেন ও তাঁদের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে নেয়ার চেষ্টায় রত হয়ে যান।

এ সময়েই তাঁরা এটাও অবগত হন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিহত হওয়ার সংবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এর ফলে তাঁদের শক্তি আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তাঁদের উদ্যম ও উদ্দীপনায় নাবীনতা এসে যায়। সুতরাং তারা এক কঠিন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অবরোধ ভেঙ্গে দিয়ে ভিড় হতে বের হতে এবং এক মজবুত কেন্দ্রের চতুর্দিকে একত্রিত হতে সফলকাম হন।

মুসলিম সেনাবাহিনীর তৃতীয় একটি দলের লোক ছিলেন তারা, যারা শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্পর্কেই চিন্তা করছিলেন। এরা এ ব্যবস্থাপনার কথা অবহিত হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে ফিরে আসেন। এদের মধ্যে অগ্রভাগে ছিলেন আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ), উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এবং আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ) প্রভৃতি মহান ব্যক্তিবর্গ। এরা যোদ্ধাদের প্রথম সারিতেও সকলের অগ্রগামী ছিলেন। কিন্তু যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর মহান ব্যক্তিত্বের জন্যে বিপদের আশংকা দেখা দিল, তখন তাঁর হিফাযত ও প্রতিরোধকারীদের মধ্যেও তাঁরা সকলের অগ্রগামী হন।

[1] সহীহুল বুখারী ১/৫৩৯, ২/৫৮১ ফাতহুলবারী ৭/৩৫১, ৩৬২, ৩৬৩ পৃঃ, বুখারী ছাড়া অন্য বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর দীয়াত দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু হুযায়ফা (রাঃ) বলেন যে, আমি তাঁর দীয়াত মুসলিম জাতিকে সদকা করে দিলাম। এ কারণে নাবী (সাঃ)-এর নিকটে হুযায়ফা (রাঃ)-এর মঙ্গল বৃদ্ধি পায়। মুখতাসারুস সীরাহ, শায়খ আব্দুল্লাহ ২৪৬ পৃঃ।

[2] যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯৩ ও ৯৬ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৯ পৃঃ।

[3] আস্সীরাতুল হালাবিয়াহ ২য় খন্ড ২২ পৃঃ।

[4] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ৯৬ পৃঃ।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আশে পাশে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম (اِحْتِدَامُ الْقِتَالِ حَوْلَ رَسُوْلِ اللهِ‏‏):

মুসলিম সেনাবাহিনী যখন ভীড়ের মধ্যে এসে মুশরিকদের সারিগুলোর দু’টি সারির মাঝে পড়ে যান এবং তাঁদেরকে প্রচন্ডভাবে আক্রমণ করা হয়, ঠিক সেই সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আশে পাশেও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলতে থাকে। এ কথা আগেই বলা হয়েছে যে, মুশরিকরা মুসলিমগণকে যখন ঘিরে ফেলতে শুরু করে তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট মাত্র নয় জন সাহাবী ছিলেন এবং যখন মুসলিমগণকে ‏‏(‏هَلُمُّوْا إِلَيَّ، أَنَا رَسُوْلُ اللهِ‏)‏، ‘আমার দিকে এসো, আমি আল্লাহর রাসূল’ এ কথা বলে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ডাক দেন তখন তাঁর ডাক মুশরিকরা শুনে ফেলে এবং তাঁকে চিনে নেয় (কেননা, ঐ সময় তারা মুসলিমগণের চেয়ে বেশী তাঁর নিকটবর্তী ছিল) সুতরাং তাঁরা দ্রুত বেগে ধাবিত হয়ে তাঁকে আক্রমণ করে বসে এবং কোন মুসলমানের আগমনের পূর্বেই নিজেদের সম্পূর্ণ বোঝা নিক্ষেপ করে। এ আকস্মিক আক্রমণের ফলে ঐ মুশরিকদের ও সেখানে উপস্থিত নয় জন সাহাবীর মধ্যে ভীষণ লড়াই শুরু হয়ে যায়। এতে নাবীপ্রেম, বীরত্বপনা এবং প্রাণ ত্যাগের অসাধারণ ঘটনাবলী সংঘটিত হয়।

সহীহুল মুসলিমে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, উহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাত জন আনসার ও দুই জন কুরাইশী সাহাবীসহ পৃথক রয়ে গিয়েছিলেন। যখন আক্রমণকারীরা তাঁর একেবারে নিকটে পৌঁছে যায় তখন তিনি বলেন, ‏‏مَنْ يَّرُدُّهُمْ عَنَّا وَلَهُ الْجَنَّة ؟‏ এমন কেউ আছে কি, যে এদেরকে আমার নিকট হতে দূর করে দিতে পারে? তাঁর জন্যে জান্নাত রয়েছে। অথবা বলেন, هُوَ رَفِيْقِيْ فِيْ الْجَنَّةِ ‏؟‏‏ ‘সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।’

তাঁর এ কথা শুনে একজন আনসারী সাহাবী অগ্রসর হন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান। এরপর পুনরায় মুশরিকরা তাঁর একেবারে নিকটে এসে পড়ে এবং এবারও তিনি আগের মতোই কথা বলেন। এভাবে পালাক্রমে সাত জন আনসারী সাহাবী শহীদ হয়ে যান। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় অবশিষ্ট দু’জন সাহাবীকে বলেন, (‏(‏مَا أَنْصَفْنَا أَصْحَابَنَا‏ ‘আমরা আমাদের সঙ্গীদের সাথে ন্যায় বিচার করলাম না।’[1]

এ সাতজনের মধ্যে শেষের জন ছিলেন উমারাহ ইবনু ইয়াযীদ ইবনু সাকান (রাঃ)। তিনি লড়তেই থাকেন, শেষ পর্যন্ত অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে মাটিতে পড়ে যান।[2]

[1] সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৭ পৃঃ, বাবু গাযওয়াতে উহুদ ।

[2] কিছুক্ষণ পরে সাহাবায়ে কিরামের একটি দল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসে পড়েন। তাঁরা কাফিরদেরকে আম্মারাহ (রাঃ) হতে ধাক্কা দিয়ে পিছনে সরিয়ে দেন এবং তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে নিজের পায়ের উপর ঠেকা লাগিয়ে দেন এবং আম্মারাহ (রাঃ) এ অবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেন যে, তাঁর গন্ড দেশ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পায়ের উপর ছিল। (ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৮১ পৃঃ) আকাঙ্ক্ষা যেন বাস্তবে রূপায়িত হল। তা হল : ‘প্রাণ যেন নির্গত হয় আপনার পায়ের উপর এটাই মনের আকাঙ্ক্ষা।’

রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে কঠিন সময় (أَحْرَجُ سَاعَةٍ فِيْ حَيَاةِ الرَّسُوْلِ ﷺ‏):

উমারাহ (রাঃ) পতিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মাত্র দু’ জন কুরাইশী সাহাবী রয়ে গিয়েছিলেন। যেমন সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিমে আবূ উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যে যুগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধ করেছেন ঐ যুদ্ধগুলোর কোন একটিতে তাঁর সাথে ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) এবং সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) ছাড়া আর কেউই ছিল না।[1] আর এ মুহূর্তটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্যে অত্যন্ত ভয়ংকর ছিল এবং মুশরিকদের জন্যে ছিল সুবর্ণ সুযোগের মুহূর্ত। প্রকৃত ব্যাপার হল, মুশরিকরা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে নি। তারা একাদিক্রমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল এবং তাঁকে দুনিয়ার বুক হতে চিরতরে বিদায় করতে চেয়েছিল। এ আক্রমণেই ‘উতবাহ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস তাঁকে পাথর মেরেছিল যার ফলে তিনি পার্শ্বদেশের ভরে পড়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর ডানদিকের রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল।[2]

আর তাঁর নীচের ঠোঁটটি আহত হয়েছিল। আব্দুল্লাহ ইবনু শিহাব যুহরী অগ্রসর হয়ে তাঁর ললাট আহত করে। আব্দুল্লাহ ইবনু ক্বায়িমাহ নামক আর একজন দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার লাফিয়ে গিয়ে তাঁর কাঁধের উপর এতো জোরে তরবারীর আঘাত করে যে, তিনি এক মাসেরও বেশী সময় পর্যন্ত ওর ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করতে থাকেন। তবে তাঁর লৌহবর্ম কাটতে পারে নি। এরপর সে আর একবার তাঁকে তরবারীর আঘাত করে, যা তাঁর চক্ষুর নীচের হাড়ের উপর লাগে এবং এর কারণে শিরস্ত্রাণের দুটি কড়া চেহারার মধ্যে ঢুকে যায়।[3] সাথে সাথে সে বলে ওঠো, ‘এটা লও! আমি ক্বামিয়া’র (টুকরোকারীর) পুত্র।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চেহারা হতে রক্ত মুছতে মুছতে বলেন, ‘আল্লাহ তোকে টুকরো টুকরো করে ফেলুন।’[4]

সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং মাথা আহত করা হয়। ঐ সময় তিনি মুখমণ্ডল হতে রক্ত মুছে ফেলছিলেন এবং মুখে উচ্চারণ করছিলেন,

‏‏(‏كَيْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوْا وَجْهَ نَبِيِّهِمْ، وَكَسَرُوْا رُبَاعِيَتِهِ، وَهُوَ يَدْعُوْهُمْ إِلَى اللهِ‏)‏

‘ঐ কওম কিরূপে কৃতকার্য হতে পারে যারা তাদের নাবী (ﷺ)-এর মুখমণ্ডল আহত করেছে এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে, অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করছিলেন?’

ঐ সময় আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করেন,

‏(‏لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوْبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذَّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُوْنَ‏)‏ ‏[‏آل عمران‏:‏128‏]

‘আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন অথবা তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন- এ ব্যাপারে তোমার কিছু করার নেই। কেননা তারা হচ্ছে যালিম।’।[5]

ত্বাবারানীর বর্ণনায় রয়েছে যে, ঐ দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন, ‏‏(‏اِشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلٰى قَوْمٍ دَمُّوْا وَجْهَ رَسُوْلِهِ‏) ‘ঐ কওমের উপর আল্লাহর কঠিন শাস্তি হোক যারা তাদের নাবী (ﷺ)-এর চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে। তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‏(‏اللهم اغْفِرْ لِقَوْمِيْ فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ‏)‏ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমার কওমকে ক্ষমা করুন, তারা জানে না।’[6]

সহীহুল মুসলিমের হাদীসেও এটাই আছে যে, তিনি বার বার বলছিলেন,

(‏رَبِّ اغْفِرْ لِقَوْمِيْ فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ‏)‏

অর্থাৎ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার কওমকে ক্ষমা করে দিন, তারা জানে না।’[7]

কাযী আইয়াযের ‘শিফা’ গ্রন্থে নিম্নলিখিত শব্দ রয়েছে,‏(‏اللهم اهْدِ قَوْمِيْ فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ‏)

অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমার কওমকে হিদায়াত দান করুন, নিশ্চয় তারা জানে না।’[8]

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দুনিয়া হতে বিদায় করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দ’জন কুরাইশী সাহাবী অর্থাৎ সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) ও ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) অসাধারণ বীরত্ব ও অতুলনীয় বাহাদুরীর সাথে কাজ করে শুধু দু’জনই মুশরিকদের সফলতা অসম্ভব করে দেন। এ দু’ব্যক্তি আরবের সুদক্ষ তীরন্দায ছিলেন। তাঁরা তীর মেরে মেরে আক্রমণকারী মুশরিকদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে দূরে সরিয়ে রাখেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর জন্যে স্বীয় তূণ হতে সমস্ত তীর বের করে ছড়িয়ে দেন এবং তাঁকে বলেন, (‏اِرْمِ فِدَاكَ أَبِيْ وِأُمِّيْ‏)‏ ‘তীর ছুঁড়তে থাক, তোমার উপর আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোন।’[9]

সা‘দ (রাঃ)-এর সৌজন্য ও কর্মদক্ষতা এর দ্বারাই অনুমান করা যেতে পারে যে, তিনি ছাড়া আর কারো জন্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পিতামাতা উৎসর্গিত হওয়ার কথা বলেন নি।[10]

ত্বালহাহ (রাঃ)-এর কর্মদক্ষতা অনুমান করা যেতে পারে সুনানে নাসায়ীর একটি বর্ণনার মাধ্যমে, যাতে জাবির (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর মুশরিকদের ঐ সময়ের আক্রমণের উল্লেখ করেছেন যখন তিনি মুষ্টিমেয় আনসারদের সাথে রয়ে গিয়েছিলেন।

জাবির (রাঃ) বলেন যে, মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটবর্তী হয়ে গেলে তিনি বলেন,

‏‏(‏مَنْ لِلْقَوْمِ ‏؟‏‏)‏ ‘এদের সাথে মোকাবালা করে এমন কেউ আছ কি?’

উত্তরে ত্বালহাহ (রাঃ) বলেন, ‘আমি আছি।’ এরপর জাবির (রাঃ) আনসারদের অগ্রসর হওয়া এবং একে একে শহীদ হওয়ার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন যা সহীহুল মুসলিমের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছি। জাবির (রাঃ) বলেন যে, যখন তাঁরা শহীদ হয়ে যান তখন ত্বালহাহ (রাঃ) সম্মুখে অগ্রসর হন এবং এগারো জন লোকের সমান একাই যুদ্ধ করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতের উপর তরবারীর এমন এক আঘাত লাগে যে, এর ফলে তার হাতের আঙ্গুলিগুলো কেটে যায়। ঐ সময় তার মুখ দিয়ে ‘হিস’ শব্দ বের হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

‏(‏لَوْ قُلْتُ ‏:‏ بِسْمِ اللهِ، لَرَفَعَتْكَ الْمَلَائِكَةُ وَالنَّاسُ يَنْظُرُوْنَ‏)‏

‘তুমি যদি বিসমিল্লাহ বলতে তবে তোমাকে ফিরিশতা উঠিয়ে নিতেন এবং জনগণ দেখতে পেত।’

জাবির (রাঃ) বলেন যে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদেরকে ফিরিয়ে দেন।[11] ইকলীলে হা’কিমের বর্ণনা রয়েছে যে, উহুদের দিন তাঁকে ৩৯টি বা ৩৫টি আঘাত লেগেছিল এবং তাঁর শাহাদত ও মধ্যমা আঙ্গুলিদ্বয় অকেজো হয়ে গিয়েছিল।[12]

ইমাম বুখারী (রহ.) ক্বায়স ইবনু আবী হাযিম (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, ‘আমি ত্বালহাহ (রাঃ)-এর হাত দেখেছি যে, ওটা নিষ্ক্রিয় ছিল। ঐ হাত দ্বারাই তিনি উহুদ যুদ্ধের দিন নাবী (ﷺ)-কে রক্ষা করেছিলেন।’[13]

ইমাম তিরমিযীর (রহ.) বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ দিন ত্বালহাহ (রাঃ)-এর ব্যাপারে বলেছিলেন,

(‏مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَّنْظُرَ إِلٰى شَهِيْدٍ يَمْشِيْ عَلٰى وَجْهِ الْأَرْضِ فَلْيَنْظُرْ إِلٰى طَلْحَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ‏)‏

‘কেউ যদি ভূ-পৃষ্ঠে কোন শহীদকে চলতে ফিরতে দেখত চায় তবে সে যেন ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ)-কে দেখে নেয়।’[14]

আবূ দাঊদ তায়ালিসী (রাঃ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ বাকর (রাঃ) যখন উহুদ যুদ্ধের আলোচনা করতেন তখন বলতেন, ‘এ যুদ্ধ সম্পূর্ণটাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর জন্যে ছিল[15] (অর্থাৎ এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হিফাযাত করার আসল কাজ তিনিই আনজাম দিয়েছিলেন)। আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর ব্যাপারে নিম্নের কথাও বলেন,

يا طلحة بن عبيد الله قد وَجَبَتْ ** لك الجنان وبُوِّئتَ المَهَا العِينَا

অর্থাৎ ‘হে ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ), তোমার জন্যে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে এবং তুমি তোমার এখানে আয়তলোচনা হুরদের ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছ।’[16]

এ সংকটময় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা অদৃশ্য হতে স্বীয় সাহায্য নাযিল করেন। যেমন সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিমে সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, ‘আমি উহুদের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখেছি, তাঁরা তাঁর পক্ষ হতে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। আমি এর পূর্বে এবং পরে এ দু’জন লোককে আর কখনো দেখিনি।’ অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তারা দু’জন ছিলেন জিব্রাঈল (আঃ) ও মীকাঈল (আঃ)।[17]

[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১৭ পৃ: এবং ২য় খন্ড ৫৮১ পৃ।

[2] মুখের সম্পূর্ণ মধ্যে নীচের দুটি ও উপরের দুটি দাঁতকে সুনায়ী বলা হয় এবং ওর ডান দিকের ও বাম দিকের উপর দুটি ও নীচের দুটি দাঁতকে রুবাঈ দাঁত বলা হয়। কুচলী দাঁতের পূর্বে অবস্থিত।

[3] লোহা অথবা পাথরের টুপি। যা যুদ্ধের সময় মাথা এবং মুখমণ্ডল হেফাজতের জন্য ব্যবহার করা হয়।

[4] আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এ দু’আ কবুল করে নেন। ইবনু কাময়াহ যুদ্ধ হতে বাড়ী ফিরে যাবার পর তার বকরী খুঁজতে বের হয়। তার বকরীগুলো সে পর্বত চূড়ায় দেখতে পায়। সে সেখানে উঠলে এক পাহাড়ী বকরী তার উপর আক্রমণ চালায় এবং শিং দ্বারা গুতো মারতে মারতে তাকে পাহাড়ের উপর হতে নীচে ফেলে দেয় (ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড ৩৭৩ পৃ.) আর তাবারানীর বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহ তা‘আলা পাহাড়ী বকরীকে তার উপর নির্দিষ্ট করেন যে তাকে শিং মেরে মেরে টুকরো টুকরো করে দেয়। (ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৬৬ পৃ.)

[5] সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৮২ পৃঃ।, সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৮ পৃঃ।

[6] ফাতহুলবারী, ৭ম খন্ড ৩৭৩ পৃঃ।

[7] সহীহুল মুসলিম, ২য় খন্ড, বাবু গাযওয়াতে উহুদ ১০৮ পৃঃ।

[8] কিতাবুশ শিফা বিতা’রীফি হুককিল মুসতফা (সাঃ) প্রথম খন্ড ৮১ পৃঃ।

[9] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৪০৭, ২য় খন্ড ৫৮০-৫৮১ পৃঃ।

[10] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৪০৭, ২য় খন্ড ৫৮০-৫৮১ পৃঃ।

[11] ফাতহুলবারী, ৭ম খন্ড ৩৬১ পৃ: এবং সুনানে নাসায়ী, ২য় খন্ড ৫২-৫৩ পৃঃ।

[12] ফাতহুলবারী ৭ম খন্ড ৩৬১ পৃঃ।

[13] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৫২৭-৫২৮ পৃঃ।

[14] মিশকাত, ২য় খন্ড ৫৬৬ পৃ: এবং ইবনু ইশাম, ২য় খন্ড ৮৬ পৃঃ।

[15] ফাতহুলবারী ৭ম খন্ড ৩৬১ পৃঃ।

[16] মুখতাসার তারীখে দেমাশক ৭ম খন্ড ৮২ পৃঃ, ‘শারহে শুযুরিয়াহব’ এর হাশিয়ার উদ্ধৃতিসহ ১১৪ পৃঃ।

[17] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮০ পৃঃ।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট সাহাবায়ে কিরামের একত্রিত হওয়ার সূচনা (بِدَايَةُ تَجَمُّعِ الصَّحَابَةِ حَوْلَ الرَّسُوْلِ ﷺ):

এ সব ঘটনা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একেবারে অকস্মাৎ এবং অত্যন্ত ত্বড়িৎ গতিতে সংঘটিত হয়ে যায়। অন্যথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাছাইকৃত সাহাবায়ে কেরাম, যারা যুদ্ধ চলাকালে প্রথম সারিতে ছিলেন, যুদ্ধের পট পরিবর্তন হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দ্রুতগতিতে আসেন যাতে তাঁর কোন অঘটন ঘটে না যায়। কিন্তু তাঁরা প্রথম সারিতে থাকার কারণে এ সব খবর জানতে পারেন নি। অতঃপর যখন তাঁদের কানে এ খবর পৌঁছল তখন তাঁরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দৌঁড়িয়ে আসলেন। কিন্তু যখন তাঁরা তাঁর নিকট পৌঁছলেন তখন তিনি আহত হয়েই গেছেন। ৬ জন আনসারী শহীদ হয়েছেন এবং সপ্তম জন আহত হয়ে পড়ে আছেন। আর সা‘দ (রাঃ) এবং ত্বালহাহ (রাঃ) প্রাণপণে যুদ্ধ করে শত্রুদেরকে প্রতিহত করছেন। তাঁরা পৌঁছা মাত্রই নিজেদের দেহ ও অস্ত্র দ্বারা নাবী (ﷺ)-এর চতুর্দিকে বেড়া তৈরি করে দেন এবং শত্রুদের ভীষণ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দেন। যুদ্ধের সারি হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট যাঁরা ফিরে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্ব প্রথম ছিলেন তাঁর গুহার বন্ধু আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)।

ইবনু হিববান (রঃ) তার ‘সহীহ’ গ্রন্থে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ বাকর (রাঃ) বলেছেন, ‘উহুদ যুদ্ধের দিন সমস্ত লোক নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট হতে চলে গিয়েছিলেন (অর্থাৎ রক্ষকগণ ছাড়া সমস্ত সাহাবী তাঁকে তাঁর অবস্থানস্থলে রেখে যুদ্ধের জন্যে আগের সারিতে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর কাফিরদের দ্বারা মুসলিমগণ পরিবেষ্টিত হওয়ার পর) আমি সর্বপ্রথম তাঁর নিকট ফিরে আসি। দেখি যে, তাঁর সামনে একজন মাত্র লোক রয়েছেন যিনি তাঁর পক্ষ হতে যুদ্ধ করছেন এবং তাঁকে রক্ষা করছেন। আমি (মনে মনে) বললাম, ‘তুমি ত্বালহাহ (রাঃ)-ই হবে। তোমার উপর আমার পিতামাতা উৎসর্গিত হোক! ইতোমধ্যে আবূ উবাইদাহ ইবনু জাররাহ (রাঃ) আমার নিকট এসে পড়েন। তিনি এমনভাবে দৌড়াচ্ছিলেন যেন পাখী (উড়ছে), শেষ পর্যন্ত তিনি আমার সাথে মিলিত হয়ে যান। এখন আমরা দুজন নাবী (রাঃ)-এর দিকে দৌঁড় দেই। তাঁর সামনে ত্বালহাহ (রাঃ) অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ে রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে বললেন,

‏(‏دُوْنَكُمْ أَخَـاكُمْ فَقَـدْ أَوْجَبَ‏)‏

‘তোমাদের ভাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর শুশ্রূষা কর। সে জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে।’

আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেন, আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা মুবারক আহত হয়েছে এবং শিরস্ত্রাণের দুটি কড়া চক্ষুর নীচে গন্ডদেশে ঢুকে আছে। আমি কড়া দুটি বের করতে চাইলে আবূ উবাইদাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমি আল্লাহর নাম নিয়ে বলছি যে, এ দু’টি আমাকেই বের করতে দিন।’ এ কথা বলে তিনি দাঁত দিয়ে একটি কড়া ধরলেন এবং ধীরে ধীরে বের করতে শুরু করলেন, যেন তিনি কষ্ট না পান। শেষ পর্যন্ত তিনি কড়াটি টেনে বের করলেন বটে, কিন্তু তাঁর নীচের একটি দাঁত ভেঙ্গে পড়ে গেল। এখন দ্বিতীয় কড়াটি আমিই বের করতে চাইলাম। কিন্তু এবারও তিনি বললেন, ‘আবূ বাকর (রাঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আপনাকে আমি বলছি যে, এটাও আমাকেই বের করতে দিন।’ এরপর দ্বিতীয়টিও তিনি আস্তে আস্তে টেনে বের করলেন। কিন্তু তাঁর নীচের আর একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- বললেন,

‏(‏دُوْنَكُمْ أَخَـاكُمْ فَقَـدْ أَوْجَبَ‏)‏

‘তোমাদের ভাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর শুশ্রুষা কর, সে জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে।’

আবূ বাকর (রাঃ) বললেন এখন আমরা ত্বালহাহ (রাঃ)-এর দিনে মনোযোগ দিলাম এবং তাঁকে সামলিয়ে নিলাম। তাঁর দেহে দশটিরও বেশী যখম হয়েছিল। ত্বালহাহ (রাঃ) ঐ দিন প্রতিরোধ ও যুদ্ধে কত বীরত্বের সাথে কাজ করেছিলেন এর দ্বারা তা সহজেই অনুমান করা যায়।[1]

আর এ সংকটময় মুহূর্তেই প্রাণ নিয়ে খেলাকারী সাহাবাদের (রাঃ) একটি দলও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চতুর্দিকে এসে পড়েন। তাঁরা হলেন, আবূ দুজানা (রাঃ), আবূ মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ), মালিক ইবনু ত্বালিব (রাঃ), সাহল ইবনু হুনায়েফ (রাঃ), মালিক ইবনু সিনান (রাঃ), আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর পিতা, উম্মু আম্মারা রাহনুসাইবাহ বিনতু কাব মায়িনিয়্যাহ (রাঃ), কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ), উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ), হা’তিব ইবনু আবী বলতাআহ (রাঃ) এবং আবূ ত্বালহাহ (রাঃ)।

[1] যা’দুল মাআ’দ, ২য় খন্ড ৯৫ পৃঃ।

 মুশরিকদের চাপ বৃদ্ধি (تَضَاعَفَ ضَغْطُ الْمُشْرِكِيْنَ):

এদিকে মুশরিকদের সংখ্যাও ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর ফলে তাদের আক্রমণও কঠিন হতে কঠিনতর আকার ধারণ করছিল যার ফলে শক্তি এবং চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমনকি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ কতগুলো গর্তের মধ্যে একটি গর্তে পড়ে যান যেগুলো আবূ আ’মির ফা’সিক এ প্রকারের অনিষ্টের জন্যেই খনন করে রেখেছিল। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাঁটু মুবারক মচকে যায়। আলী (রাঃ) তাঁর হাত ধরে নেন এবং ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) (যিনি নিজেও চরমভাবে আহত হয়েছিলেন) তাঁকে স্বীয় বক্ষে নিয়ে নেন। এরপর তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হন।

না’ফে ইবনু জুবায়ের (রাঃ) বলেন যে, তিনি একজন মুহাজির সাহাবীকে বলতে শুনেছেন, ‘আমি উহুদের যুদ্ধে হাযির ছিলাম। আমি দেখি যে, চতুর্দিক হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর তীর বর্ষিত হচ্ছে, আর তিনি তীরগুলোর মাঝেই রয়েছেন। কিন্তু সমস্ত তীরই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে (অর্থাৎ তাঁকে বেষ্টনকারী সাহাবীগণ ওগুলো রুখে নিচ্ছেন) আমি আরো দেখি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু শিহাব যুহরী বলতেছিল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) কোথায় আছে তা আমাকে বলে দাও। এখন হয় আমি থাকব না হয় সে থাকবে।’ অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বাহুতেই ছিলেন (অর্থাৎ তার অতি নিকটে ছিলেন) এবং তাঁর সাথে আর কেউ ছিল না। অতঃপর সে তাঁকে ছেড়ে সামনে এগিয়ে যায়। এ দেখে সাফওয়ান তাকে ভৎর্সনা করে। জবাবে সে বলে, আল্লাহর কসম! আমি তাঁকে দেখতেই পাই নি। আল্লাহর শপথ! আমার নিকট হতে তাঁকে রক্ষা করা হয়েছে। এরপর আমরা চারজন লোক তাঁকে হত্যা করার প্রতিক্ষা করে বের হই। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছতে পারি নি।[1]

[1] যাদুল মাঅদ, ২য় খন্ড ৯৭ পৃঃ।

 অসাধারণ বীরত্ব ও প্রাণপণ লড়াই (الْبُطُوْلَاتُ النَّادِرَةِ‏):

যাহোক এ সময় মুসলিমরা এমনভাবে বীরত্বের সাথে ও জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন এবং আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে মিলে না। যেমন আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) নিজেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে ঢাল স্বরূপ বানিয়ে নিয়েছেন। তিনি স্বীয় বক্ষ উপরে উঠিয়ে নিতেন, যাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে শত্রুদের তীর হতে রক্ষা করতে পারেন। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, উহুদের দিন লোকেরা (অর্থাৎ সাধারণ মুসলিমরা পরাজয় বরণ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আসার পরিবর্তে এদিক ওদিক পালিয়ে যায়, আর আবূ ত্বালহাহ একটি ঢাল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে দাঁড়িয়ে যান। তিনি একজন সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। তিনি খুব টেনে তীর চালাতেন। ঐ দিন তিনি দু’টি কিংবা তিনটি ধনুক ভেঙ্গে ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দিয়ে কোন লোক তূণ নিয়ে গমন করলে তিনি বলতেন, ‏(‏اُنْثُرْهَا لِأَبِيْ طَلْحَةَ)‏

‘তোমার তূণের তীরগুলো আবূ ত্বালহাহ (রাঃ)-এর জন্য ছড়িয়ে দাও।’

আর তিনি যখন এক একবার মাথা উঠিয়ে যুদ্ধের অবস্থা দেখতেন তখন আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) চমকিত হয়ে বলতেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার পিতামাতা আপনার প্রাণের বিনিময়ে উৎসর্গিত হোক। আমার দেহ আপনার দেহের ঢাল হোক। মাথা বের করবেন না।’[1] এ সময় আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি নিক্ষিপ্ত তীরগুলো নিজের বুক পেতে গ্রহণ করছিলেন।

আনাস (রাঃ) থেকে এটাও বর্ণিত আছে যে, আবূ ত্বালহাহ নাবী (ﷺ) সহ একই ঢালের মধ্যে আত্মরক্ষা করছিলেন। আবূ ত্বালহাহ ছিলেন খুব দক্ষ তীরন্দাজ। যখন তিনি তীর নিক্ষেপ করতেন তখন নাবী কারীম (ﷺ) গর্দান উঠিয়ে দেখতেন যে, তীরটি কোথায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।[2]

আবূ দুজানাহ (রাঃ)-এর বীরত্বের কথা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। এ বিপদের মুহূর্তে তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং নিজের পিঠকে করলেন ঢাল। ওর উপর তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল অথচ তিনি ছিলেন অনড়। ওয়াক্কাস

হাতিব ইবনু বালতাআহ (রাঃ) ‘উতবাহ ইবনু আবী ওয়াক্কাসের পিছনে ধাওয়া করেন যে নাবী কারীম (ﷺ)-এর দস্ত মুবারক শহীদ করেছিল। তাকে তিনি ভীষণ জোরে তরবারীর আঘাত করেন। এর ফলে তার মস্তক দেহচ্যুত হয়ে যায়। তারপর তিনি তার ঘোড়া ও তরবারী অধিকার করে নেন। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) তাঁর নিজের ঐ ভাই ‘উতবাহকে নিজ হাতে হত্যা করার জন্য খুবই আকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কিন্তু এতে তিনি সফলকাম হননি। বরং এ সৌভাগ্য হাতিব (রাঃ) লাভ করেন।

সাহল ইবনু হুনায়েফ (রাঃ) একজন সুদক্ষ তীরন্দায ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট মৃত্যুর দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মুশরিকদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও তীর চালাচ্ছিলেন। যেমন কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় ধনুক দ্বারা এতো তীর চালিয়েছিলেন যে, ওর প্রান্ত ভেঙ্গে গিয়েছিল।’ অতঃপর ঐ ধনুকটি কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ) নিয়ে নেন এবং ওটা তার কাছেই থাকে। ঐ দিন এ ঘটনাও সংঘটিত হয় যে, কাতাদা (রাঃ)-এর একটি চোখে চোট লেগে ওটা তাঁর চেহারার উপর ঝুলে পড়ে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ হাতে ওটাকে ওর নিজ স্থানে ঢুকিয়ে দেন। এরপর তাঁর ঐ চক্ষুটিকেই খুব সুন্দর দেখাত এবং ওটারই দৃষ্টি শক্তিও বেশী তীক্ষ্ণ হয়েছিল।

আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) যুদ্ধ করতে করতে মুখে আঘাত প্রাপ্ত হন, ফলে তার সামনের দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং তাঁর দেহে বিশটি কিংবা তার চেয়েও বেশী যখম হন। তাঁর পা যখম হয়, ফলে তিনি খোঁড়া হয়ে যান।

আবূ সাঈদ খুদরী’র (রাঃ) পিতা মালিক বিন সানান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গন্ডদেশের রক্ত চুষে নিলেন আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তারপর তিনি (ﷺ) বললেন, থুথু ফেলে দাও। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ আমি থুথু ফেলব না। তারপর তিনি ফিরে গেলেন ও লড়াইয়ে যোগ দিলেন। তারপর নাবী (ﷺ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি জান্নাতি কোন ব্যক্তিকে দেখতে চায় সে যেন একে দেখে। তারপর তিনি শহীদ হয়ে গেলেন।

এ যুদ্ধে উম্মু ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতু কা’ব (রাঃ) নাম্নী এক অসাধারণ মহিলাও অসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগের পরিচয় প্রদান করেন। তিনি ‘আয়িশাহ (রাঃ) ও অন্যান্য মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে শুশ্রূষা কারিণীরূপে সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে আহত সৈনিকদের পানি সরবরাহ এবং তাদের অন্যান্য প্রকার সেবা শুশ্রূষা করছিলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন যে, মুসলিমরা পরাজিত হয়েছেন এবং কুরাইশ সৈন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। এ সংবাদ শ্রবণ মাত্র উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) কাঁধের মশক ও হাতের জলপাত্র ছুঁড়ে ফেলেন। ঐ সময় মুষ্টিমেয় ভক্ত প্রাণপণ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দেহ রক্ষা করছিলেন। উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) সিংহীর ন্যায় বিক্রম সহকারে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং বিশেষ ক্ষিপ্রতা ও নৈপুণ্য সহকারে তীর বর্ষণ করে কুরাইশদেরকে ধ্বংস করতে লাগলেন। এক সময় তিনি ইবনু ক্বামিয়ার সামনে পড়ে গেলেন। ইবনু ক্বামিয়ার তার কাঁধের উপর এত জোরে তরবারীর আঘাত করল যে, এর ফলে তার কাঁধ গভীরভাবে যখম হল। তিনিও তার তরবারী দ্বারা ইবনু কামআরকে কয়েকবার আঘাত করলেন। কিন্তু নরাধম দুটি লৌহবর্ম পরিহিত ছিল বলে বেঁচে গেল। শত্রুদের বর্শা ও তরবারীর আঘাতে তার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত ও জর্জরিত হয়ে পড়ল। কিন্তু এ বীরাঙ্গনা সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কর্তব্য পালন করে যেতে লাগলেন। উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা কালে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ঐ বিপদের সময় আমি দক্ষিণে বামে যে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, সে দিকেই দেখি যে, উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) আমাকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছেন।’

উহুদের যুদ্ধে মুসলিমগণের জাতীয় পতাকা মুস’আব ইবনু উমায়ের (রাঃ)-এর হাতে অর্পিত হয়েছিল। এ পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য মুসআব (রাঃ)-কে প্রথম থেকেই যুদ্ধ করে আসতে হয়েছিল এবং তীর ও তরবারীর আঘাতে তার আপাদমস্তক একেবারে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য বিপদের সময় দুর্ধর্ষ ইবনু কামআহ অগ্রসর হয়ে তাঁর দক্ষিণ বাহুর উপর তরবারীর আঘাত করল। বাহুটি কেটে যাওয়ার সাথে সাথে মুসআব (রাঃ) বাম হাতে পতাকা ধারণ করলেন। কিন্তু অবিলম্বে ইবনু কামআর তরবারীর দ্বিতীয় আঘাতে তাঁর বাম বাহুটিও দেহচ্যুত হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষের একটি তীর এসে তার জ্ঞান, ভক্তি ও বীরত্বপূর্ণ বক্ষটিভেদ করে চলে গেল এবং তিনি চির নিদ্রায় নিদ্রিত হয়ে শহীদের অমর জীবন লাভ করলেন। নাবী (ﷺ)-এর আকৃতির সাথে মুসআব (রাঃ)-এর আকৃতির সাদৃশ্য ছিল। সুতরাং মুসআব (রাঃ)-কে শহীদ করে ইবনু কামআর মুশরিকদের দিকে ফিরে গেল এবং চিৎকার করে করে ঘোষণা করল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে হত্যা করা হয়েছে।[3]

[1] সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৯১ পৃঃ।

[2] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৪০৬ পৃঃ।

[3] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৭১-৮৩ পৃঃ, যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯৭ পৃঃ।

 নাবী (সাঃ)-এর শহীদ হওয়ার খবর এবং যুদ্ধের উপর এর প্রতিক্রিয়া (إِشَاعَةُ مَقْتَلِ النَّبِيِّ ﷺ وَأَثَرُهُ عَلٰى الْمَعْرِكَةِ‏):

এ ঘোষণায় নাবী (ﷺ)-এর শাহাদতের খবর মুসলিম ও মুশরিক উভয় দলের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল। এ দুঃখ সংবাদ রটনার পর অধিকাংশ মুসলিমই ক্ষণিকের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। একদল মুসলিম ইতোমধ্যেই শাহাদত প্রাপ্ত হয়েছেন, জীবিতদের মধ্যে একদল গুরুতররূপে আহত হয়ে পড়েছেন। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শহীদ হয়েছেন শুনে একদল অস্ত্র ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ এমন কি কেউ কেউ মদীনায় পলায়ন পর্যন্ত করলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাহাদতের এ খবরই আবার এদিক দিয়ে কল্যাণকররূপে প্রতীয়মান হয় যে, তারা অনুভব করছিল যে, তাদের শেষ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং এখন বহু মুশরিক আক্রমণ বন্ধ করে মুসলিম শহীদদের মৃত দেহের মূসলা (নাক, কান ইত্যাদি কেটে নেয়ার কাজ) করতে শুরু করে দেয়।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর্যুপরি যুদ্ধ ও অবস্থার উপর আধিপত্য লাভ (الرَّسُوْلُ ﷺ يُوَاصِلُ الْمَعْرِكَةِ وَيَنْقُذُ الْمَوْقِفِ)

মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ)-এর শাহাদতের পর আলী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পতাকা প্রদান করেন। তিনি প্রাণপণে যুদ্ধ করে যান। সেখানে উপস্থিত অবশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামও অতুলনীয় বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ ও আক্রমণ করেন। এর দ্বারা অবশেষে এ সম্ভাবনা দেখা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুশরিকদের সারিগুলো ভেদ করে ভিড়ের মধ্যে আগত সাহাবায়ে কেরামের দিকে পথ তৈরি করতে পারবেন। তিনি সামনে পা বাড়ালেন এবং সাহাবায়ে কেরামের দিকে আসলেন। সর্ব প্রথম তাঁকে চিনতে পারেন কা‘ব ইবনু মা’লিক (রাঃ)। তিনি খুশীতে চিৎকার করে ওঠেন, ‘হে মুসলিমবৃন্দ! তোমরা আনন্দিত হও, এই যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! তিনি তাঁকে ইঙ্গিত করেন, ‘চুপ থাকো, যাতে মুশরিকরা আমার অবস্থান ও অবস্থানস্থলের টের না পায়।’ কিন্তু কা‘ব (রাঃ)-এর আওয়ায মুসলিমগণের কানে পৌঁছেই গিয়েছিল। সুতরাং তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আশ্রয়ে চলে আসতে শুরু করেন এবং ক্রমে ক্রমে প্রায় ত্রিশ জন সাহাবী একত্রিত হয়ে যান।

যখন এ সংখ্যক সাহাবী সমবেত হয়ে যান তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাহাড়ের ঘাঁটি অর্থাৎ শিবিরের দিকে যেতে শুরু করেন। কিন্তু এ সরে যাওয়ার অর্থ ছিল, মুশরিকরা মুসলিমগণকে তাদের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে ফেলার যে ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করেছিল তা বিফল হয়ে যাবে। তাই, তারা মুসলিমগণের এ প্রত্যাবর্তনকে ব্যর্থ করার মানসে ভীষণ আক্রমণ শুরু করে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ আক্রমণকারীদের ভীড় ঠেলে রাস্তা তৈরি করেই ফেলেন এবং ইসলামের সিংহদের বীরত্বের সামনে তাদের কোন ক্ষমতাই টিকল না। এরই মধ্যে উসমান ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মুগীরা নামক মুশরিকদের একজন হঠকারী ঘোড়সওয়ার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে অগ্রসর হল এবং বলল, ‘হয় আমি থাকব, না হয় সে থাকবে।’ এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তার সাথে মোকাবালা করার জন্য থেমে গেলেন। কিন্তু মোকাবেলা করার সুযোগ হল না। কেননা তাঁর ঘোড়াটি একটি গর্তে পড়ে গেল। আর ইতোমধ্যে হারিস ইবনু সম্মাহ (রাঃ) তাঁর নিকট পৌঁছে তার পায়ের উপর এমন জোরে তরবারীর আঘাত করলেন যে, সে ওখানেই বসে পড়ল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি তার হাতিয়ার নিয়ে নিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে গেলেন। কিন্তু এরই মধ্যে আবার আব্দুল্লাহ ইবনু জাবির নামক আর একজন মক্কার ঘোড়সওয়ার হারিস ইবনু সম্মাহ (রাঃ)-কে আক্রমণ করল এবং তাঁর কাঁধের উপর তরবারীর আঘাত করে যখম করে দিল। কিন্তু মুসলিমরা লাফিয়ে গিয়ে তাঁকে উঠিয়ে নিলেন। আর এদিকে মৃত্যুর সঙ্গে ক্রীড়ারত ম©র্দ মুজাহিদ আবূ দুজানা (রাঃ), যিনি আজ লাল পাগড়ী বেঁধে রেখেছিলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু জাবিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাঁকে এমন জোরে তরবারীর আঘাত করেন যে, তার মাথা উড়ে যায়।

কি স্বর্গীয় মাহাত্ম্য যে, এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলাকালেই মুসলিমরা তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন কুরআন কারীমে বলা হয়েছে যে, এটা ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে বিশ্রাম ও প্রশান্তি। আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) বলেন, ‘উহুদের যুদ্ধের দিন যারা তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েছিলেন আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। এমনকি, আমার হাত হতে কয়েকবার তরবারী পড়ে যায়। প্রকৃত অবস্থা ছিল এরূপ যে, ওটা পড়ে যাচ্ছিল এবং আমি ধরে নিচ্ছিলাম। আবার পড়ে যাচ্ছিল এবং আবারও আমি ধরে নিচ্ছিলাম।[1]

সার কথা হল, এভাবে মরণপণ করে এ বাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে পিছনে সরতে সরতে পাহাড়ের ঘাঁটিতে অবস্থিত শিবির পর্যন্ত পৌঁছে যান এবং বাকী সৈন্যদের জন্যেও এ সুরক্ষিত স্থানে পৌঁছার পথ পরিস্কার করে দেন। সুতরাং অবশিষ্ট সৈন্যরাও এখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট পৌঁছে গেলেন এবং খালিদের বাহিনী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাহিনীর সামনে অকৃতকার্য হয়ে গেল।

[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮২ পৃঃ।

 উবাই ইবনু খালফের হত্যা (مَقْتَلُ أُبَيِّ بْنِ خَلْفٍ):

ইবনু ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন ঘাঁটিতে পৌঁছে যান তখন উবাই ইবনু খালফ এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) কোথায়? হয় আমি থাকব, না হয় সে থাকবে।’ তার এ কথা শুনে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মধ্য হতে কেউ তাঁর উপর আক্রমণ করব কি?’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘তাকে আসতে দাও।’ সে নিকটবর্তী হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হারিস ইবনু সম্মাহ (রাঃ)-এর নিকট হতে একটি ক্ষুদ্র বর্শা চেয়ে নিয়ে নাড়া দেন। তিনি ওটা নাড়া দেয়া মাত্রই জনগণ এমনভাবে এদিকে ওদিক সরে পড়ে যেমনভাবে উট তার শরীর নাড়া দিলে মাছিগুলো উড়ে যায়। এরপর তিনি তাঁর মুখোমুখী হন এবং শিরস্ত্রাণ ও বর্মের মধ্যস্থলে গলার পার্শ্বে সামান্য জায়গা খোলা দেখে ওটাকেই লক্ষ্য করে এমনভাবে বর্শার আঘাত করেন যে, সে ঘোড়া হতে গড়িয়ে পড়ে যায়। তার ঘাড়ে খুব বড় একটা অাঁচড় ছিল না, রক্ত বন্ধ ছিল, এমতাবস্থায় সে কুরাইশদের নিকট পৌঁছে বলে, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) আমাকে হত্যা করে ফেলেছে।’ জনগণ তাকে বলে, ‘আল্লাহর কসম! তোমার মন দমে গেছে, নচেৎ তোমাকে আঘাত তো তেমন লাগে নি, তথাপি তুমি এত ছটফট করছো কেন?’ উত্তরে সে বলে, ‘সে মক্কায় আমাকে বলেছিল, আমি তোমাকে হত্যা করব।[1] এ জন্য, আল্লাহর কসম! যদি সে আমাকে থুথু দিত তা হলেও আমার জীবন শেষ হয়ে যেত।’ অবশেষে এ শত্রু মক্কা ফিরবার পথে ‘সারফ’ নামক স্থানে পৌঁছে মৃত্যু বরণ করে।[2] আবুল আসওয়াদ (রাঃ) উরওয়া (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, সে বলদের মতো আওয়ায বের করত এবং বলত, ‘যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যে কষ্ট আমি পাচ্ছি, যদি যিল মাজাযের সমস্ত অধিবাসী ঐ কষ্ট পেত তবে তারা সবাই মরে যেত।’[3]

[1] ঘটনা হচ্ছে মক্কায় যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে উবাই এর সাক্ষাৎ হতো তখন সে তাঁকে বলত, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ)! আমার নিকট ‘আউদ’ নামক একটি ঘোড়া রয়েছে। আমি দৈনিক তাকে তিন সা’ (সাড়ে সাত কিলোগ্রাম) দানা ভক্ষণ করিয়ে থাকি। ওরই উপর আরোহণ করে আমি তোমাকে হত্যা করব।’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বলতেন, ‘ইনশাআল্লাহ আমিই তোমাকে হত্যা করব।’

[2] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৮৪ পৃঃ, যাদুল মাআদ, ২য় খন্ড ৭ পৃঃ।

[3] মুখতাসার সীরাতুর রাসূল (সাঃ) শায়খ আবূ আব্দুল্লাহ প্রণীত, ২৪০ পৃঃ।

 ত্বালহাহ (রাঃ) নাবী (সাঃ)-কে উঠিয়ে নেন (طَلْحَةُ يَنْهَضُ بِالنَّبِيِّ ﷺ):

পাহাড়ের দিকে নাবী (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তনের পথে একটি টিলা পড়ে যায়। তিনি ওর উপর আরোহণের চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সক্ষম হলেন না। কেননা, একে তো তাঁর দেহ ভারী হয়েছিল, দ্বিতীয়ত, তিনি দুটি বর্ম পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। তাছাড়া, তিনি কঠিনভাবে আঘাত প্রাপ্তও হয়েছিলেন। সুতরাং ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) নীচে বসে পড়েন এবং তাঁকে সওয়ার করিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। এভাবে তিনি টিলার উপর পৌঁছে বলেন,‏‏(‏أوْجَبَ طلحةُ‏)‏ ‘ত্বালহাহ (জান্নাত) ওয়াজিব করে নিয়েছে।’[1]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৮৬ পৃঃ।

 মুশরিকদের শেষ আক্রমণ (آخِرُ هُجُوْمٍ قَامَ بِهِ الْمُشْرِكُوْنَ‏‏):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন ঘাঁটির মধ্যে স্বীয় অবস্থানস্থলে পৌঁছে যান তখন মুশরিকরা মুসলিমগণকে ঘায়েল করার শেষ চেষ্টা করে। ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, যে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘাঁটির মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন ঐ সময় আবূ সুফইয়ান ও খালিদ ইবনু ওয়ালীদের নেতৃত্বে মুশরিকদের একটি দল পাহাড়ের উপর উঠে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ সময় দু‘আ করেন,

‏(‏اللهم إِنَّهُ لَا يَنْبَغِيْ لَهُمْ أَنْ يَعْلُوْنَا‏)‏

‘হে আল্লাহ! এরা যেন আমাদের হতে উপরে যেতে না পারে।’ অতঃপর উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) এবং মুহাজিরদের একটি দল যুদ্ধ করে তাদেরকে পাহাড়ের উপর হতে নীচে নামিয়ে দেন।[1]

মাগাযী উমভীর বর্ণনায় রয়েছে যে, মুশরিকরা পাহাড়ের উপর চড়ে বসলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সা‘দ (রাঃ)-কে বলেন,‏(‏اجْنُبْهُمْ‏)‏ ‘তাদের উদ্যম নষ্ট করে দাও অর্থাৎ তাদেরকে পিছনে সরিয়ে দাও।’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি একাই কিভাবে তাদের উদ্যম নষ্ট করব?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তিন বার এ কথারই পুনারাবৃত্তি করেন। অবশেষে সা‘দ (রাঃ) স্বীয় তূণ হতে একটি তীর বের করেন এবং একটি লোকের উপর নিক্ষেপ করেন। লোকটি সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। সা‘দ (রাঃ) বলেন, ‘পুনরায় আমি আমার তীর গ্রহণ করি। আমি ওটা চিনতাম। ওটা দ্বারা দ্বিতীয় এক ব্যক্তিকে মারলাম। সেও মারা গেল। তারপর আমি আবার ঐ তীর গ্রহণ করলাম এবং তৃতীয় ব্যক্তিকে মারলাম। তাঁরও প্রাণ নির্গত হয়ে গেল। অতঃপর মুশরিকরা নীচে নেমে গেল। আমি বললাম যে এটা বরকতপূর্ণ তীর। তার পর আমি ঐ তীর আমার তূণের মধ্যে রেখে দিলাম।’ এ তীর সারা জীবন সা‘দ (রাঃ)-এর কাছেই থাকে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানদের নিকট থাকে। [2]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৮৬ পৃঃ।

[2] যাদুল মাআ’দ, ২য় খন্ড ৯৫ পৃঃ।

 শহীদগণের মুসলা (অর্থাৎ নাক, কান ইত্যাদি কর্তন) (تَشْوِيْهُ الشُّهَدَاءِ):

এটা ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে শেষ আক্রমণ। যেহেতু মুশরিকদের রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরিণাম সম্পর্কে সঠিক অবগতি ছিল না, বরং তাঁর শাহাদত সম্পর্কে তাদের প্রায় দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে ছিল, সেহেতু তারা তাদের শিবিরের দিকে ফিরে গিয়ে মক্কা ফিরে যাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে। মুশরিকদের কিছু সংখ্যক নারী-পুরুষ মুসলিম শহীদের মুসলায় (নাক, কান ইত্যাদি কাটায়) লিপ্ত হয়ে পড়ে। হিন্দ বিনতু ‘উতবাহ হামযাহ (রাঃ)-এর কলিজা ফেড়ে দেয় এবং তা মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে। সে ওটা গিলে নেয়ার ইচ্ছা করে। কিন্তু গিলতে না পেরে থুথু করে ফেলে দেয়। সে কাটা কান ও নাকের তোড়া ও হার বানিয়ে নেয়।[1]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড, ৯০ পৃঃ।

শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার জন্যে মুসলিমগণের তৎপরতা (مَدَى اِسْتِعْدَادِ أَبْطَالِ الْمُسْلِمِيْنَ لِلْقِتَالِ حَتّٰى نِهَايَةِ الْمَعْرِكَةِ):

অতঃপর এ শেষ সময়ে এমন দুটি ঘটনা সংঘটিত হয় যার দ্বারা এটা অনুমান করা মোটেই কঠিন নয় যে, ইসলামের এ বীর মুজাহিদেরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার জন্যে কেমন প্রস্তুত ছিলেন এবং আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করার জন্য কত আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন।

কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমি ঐ মুসলিমগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম যাঁরা ঘাঁটি হতে বাইরে এসেছিলেন। আমি দেখি যে, মুশরিকদের হাতে মুসলিম শহীদের নাক, কান ইত্যাদি কাটা হচ্ছে। এ দেখে আমি থমকে দাঁড়ালাম। তারপর সামনে এগিয়ে দেখি যে, একজন মুশরিক, যে ভারী বর্ম পরিহিত ছিল, শহীদদের মাঝ হতে গমন করছে এবং বলতে বলতে যাচ্ছে, ‘কাটা বকরীদের নরম হাড়ের মতো ঢেরী লেগে গেছে।’ আরো দেখি যে, একজন মুসলিম তার পথে ওঁৎ পেতে রয়েছেন। তিনিও বর্ম পরিহিত ছিলেন। আমি আরো কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তাঁর পিছনে রয়ে গেলাম। তারপর দাঁড়িয়ে গিয়ে মুসলিম ও কাফিরটিকে চোখের দৃষ্টিতে ওজন করতে লাগলাম।

এমনিভাবে যতটুকু প্রত্যক্ষ করলাম তাতে ধারণা হল যে, মুশরিকটি দেহের বাঁধন ও সাজসরঞ্জাম উভয় দিক দিয়েই মুসলিমটির উপরে রয়েছে। এ পর্যায়ে আমি দুজনের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে উভয়ের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেল এবং মুসলিমটি মুশরিকটিকে তরবারীর এমন আঘাত করলেন যে, ওটা তার পা পর্যন্ত কেটে চলে গেল। মুশরিক দু’টুকরা হয়ে পড়ে গেল। তারপর মুসলিমটি নিজের চেহারা খুলে দিলেন এবং বললেন, ‘ভাই কা‘ব (রাঃ)! কেমন হল? আমি আবূ দুজানাহ (রাঃ)।’[1]

যুদ্ধ শেষে কিছু মুসলিম মহিলা জিহাদের ময়দানে পৌঁছেন। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমি ‘আয়িশাহ বিনতু আবূ বাকর (রাঃ) এবং উম্মু সুলায়েম (রাঃ)-কে দেখি যে, তাঁরা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কাপড় উঠিয়ে নিয়ে পিঠের উপর পানির মশক বহন করে আনছেন এবং পানি বের করে কওমের (আহতদের) মুখে দিচ্ছেন।’[2] উমার (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘উহুদের দিন উম্মু সালীত্ব (রাঃ) আমাদের জন্যে মশক ভরে ভরে পানি আনছিলেন।’[3]

এ মহিলাদের মধ্যে একজন উম্মু আয়মানও (রাঃ) ছিলেন। তিনি পরাজিত মুসলিমগণকে যখন দেখলেন যে, তাঁরা মদীনায় ঢুকে পড়তে চাচ্ছেন তখন তিনি তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, ‘তোমরা এ সূতা কাটার ফিরকী গ্রহণ কর এবং আমাদেরকে তরবারী দিয়ে দাও।’[4] এরপর তিনি দ্রুতগতি যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছেন এবং আহতদেরকে পানি পান করাতে শুরু করেন। তাঁর উপর হিববান ইবনু অরকা তীর চালিয়ে দেয়। তিনি পড়ে যান এবং তিনি বিবস্ত্র হয়ে যান, এ দেখে আল্লাহর শত্রু হো হো করে হেসে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এটা খুব কঠিন ঠেকে এবং তিনি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)-কে একটি পালকবিহীন তীর দিয়ে বলেন, ‏(اِرْمِ بِهِ‏)‏ ‘এটা চালাও।’ সা‘দ (রাঃ) ওটা চালিয়ে দিলে ওটা হিব্বানের গলায় লেগে যায় এবং সে চিৎ হয়ে পড়ে যায় ও সে বিবস্ত্র হয়ে যায়। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন হাসেন যে, তাঁর দাঁত দেখা যায় এবং তিনি বলেন,

‏‏‏‏(‏اِسْتِقَادَ لَهَا سَعْدٌ، أَجَابَ اللهُ دَعْوَتَهُ‏)‏

‘সা‘দ (রাঃ) উম্মু আয়মান (রাঃ)-এর বদলা নিয়ে ফেলেছে। আল্লাহ তাঁর দুআ কবুল করুন।’[5]

[1] আল বিদয়াহ ও য়ান নিহাইয়াহ, ৪র্থ খন্ড ১৭ পৃঃ।

[2] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৪০৩ পৃঃ, ২য় খন্ড, ৫৮১ পৃঃ।

[3] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৪০৩ পৃঃ।

[4] সূতা কাটা আরব মহিলাদের বিশিষ্ট কাজ ছিল। এ জন্য সূতা কাটার ফিরকী আরব মহিলাদের ঐরূপ বিশিষ্ট আসবাব পত্র ছিল যেরূপ আমাদের দেশে চুড়ি। এ স্থলে উল্লেখিত বাকরীতির ভাবার্থ ঠিক ওটাই,

[5] আসসীরাতুল হালবিয়্যাহ, ২য় খন্ড ২২ পৃঃ।

 ঘাঁটিতে স্থিতিশীলতার পর (بَعْدَ اِنْتِهَاءِ الرَّسُوْلِ ﷺ إِلٰى الشَّعْبِ) :

যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘাঁটির মধ্যে স্বীয় অবস্থানস্থলে কিছুটা স্থিতিশীল হন তখন আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ) ‘মিহরাস’ হতে স্বীয় ঢালে করে পানি ভরে আনেন। সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, ‘মিহরাস’ পাথরের তৈরি ঐ গর্তকে বলা হয় যার মধ্যে বেশী পানি আসতে পারে। আবার এ কথাও বলা হয়ে থাকে যে, ‘মিহরাস’ উহুদের একটি ঝর্ণার নাম। যা হোক, আলী (রাঃ) ঐ পানি নাবী (ﷺ)-এর খিদমতে পান করার জন্য পেশ করেন। নাবী (ﷺ) কিছুটা অপছন্দনীয় গন্ধ অনুভব করেন। সুতরাং তিনি ঐ পানি পান করলেন না বটে, তবে তা দ্বারা চেহারার রক্ত ধুয়ে ফেললেন এবং মাথায়ও দিলেন। ঐ সময় তিনি বলছিলেন,

‏(‏اِشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلٰى مَنْ دَمَّى وَجْهَ نَبِيِّهِ‏)‏

‘ঐ ব্যক্তির উপর আল্লাহর কঠিন গযব হোক, যে তার নাবী (ﷺ)-এর চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে।’[1]

সাহল (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যখম কে ধুয়েছেন, পানি কে ঢেলে দিয়েছেন এবং প্রতিষেধকরূপে কোন্ জিনিস প্রয়োগ করা হয়েছে তা আমার বেশ জানা আছে। তাঁর কলিজার টুকরা ফাতিমাহ (রাঃ) তাঁর যখম ধুচ্ছিলেন, আলী (রাঃ) ঢাল হতে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন এবং ফাতিমাহ (রাঃ) যখন দেখেন যে, পানির কারণে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না, তখন তিনি চাটাই এর অংশ নিয়ে জ্বালিয়ে দেন এবং ওর ভস্ম নিয়ে ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দেন। এর ফলে রক্ত বন্ধ হয়ে যায়।’[2]

এদিকে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) মিষ্ট ও সুস্বাদু পানি নিয়ে আসেন। ঐ পানি নাবী (ﷺ) পান করেন এবং কল্যাণের দু’আ করেন।[3] যখমের ব্যথার কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুহরের সালাত বসে বসে আদায় করেন এবং সাহাবায়ে কিরামও (রাঃ) তাঁর পিছনে বসে বসে সালাত আদায় করেন।[4]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৮৫ পৃঃ।

[2] সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৮৪ পৃঃ।

[3] আস সীরাতুল হালবিয়্যাহ ২য় খন্ড ৩০ পৃঃ।

[4] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৮৭ পৃঃ।

 আবূ সুফইয়ানের আনন্দ ও উমার (রাঃ)-এর সাথে কথোপকথন (شَمَاتَةُ أَبِيْ سُفْيَانَ بَعْدَ نِهَايَةِ الْمَعْرِكَةِ وَحَدِيْثِهِ مَعَ عُمَرَ):

মুশরিকরা প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে ফেললে আবূ সুফইয়ান উহুদ পাহাড়ের উপর দৃশ্যমান হল এবং উচ্চৈঃস্বরে বলল, ‘তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ (ﷺ) আছে কি?’ মুসলিমরা কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার বলল, ‘তোমাদের মধ্যে আবূ কুহাফার পুত্র আবূ বাকর (রাঃ) আছে কি?’ তাঁরা এবারও কোন জবাব দিল না। সে পুনরায় প্রশ্ন করে, ‘তোমাদের মধ্যে উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) আছে কি?’ সাহাবীগণ এবারও উত্তর দিলেন না। কেননা, নাবী (ﷺ) তাদেরকে উত্তর দিতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। আবূ সুফইয়ান এ তিন জন ছাড়া আর কারো ব্যাপারে প্রশ্ন করে নি। কেননা, তার ও তার কওমের এটা খুব ভালই জানা ছিল যে, ইসলাম এ তিন জনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মোট কথা, যখন কোন উত্তর পাওয়া গেল না তখন সে বলল, ‘চলো যাই, এ তিন জন হতে অবকাশ লাভ করা গেছে।’ এ কথা শুনে উমার (রাঃ) আর ধৈর্য্য ধরতে পারলেন না। তিনি বলে উঠলেন, ‘ওরে আল্লাহর শত্রু। যাদের তুই নাম নিয়েছিস তাঁরা সবাই জীবিত রয়েছেন এবং এখনো আল্লাহ তোকে লাঞ্ছিত করার উৎস বাকী রেখেছেন।’ এরপর আবূ সুফইয়ান বলল, ‘তোমাদের নিহতদের মুসলা করা হয়েছে অর্থাৎ নাক, কান ইত্যাদি কেটে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এরূপ করতে আমি হুকুমও করিনি এবং এটাকে খারাপও মনে করিনি।’ অতঃপর সে চিৎকার করে বলল,أعْلِ هُبَل ‘অর্থাৎ হুবল (ঠাকুর) সুউচ্চ হোক।’

নাবী (ﷺ) তখন সাহাবীদেরকে বললেন,‏ ‘তোমরা জবাব দিচ্ছ না কেন? তারা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমরা কী জবাব দিব?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা বল,‏‏(‏قُوْلُوْا‏ :‏ اللهُ أَعْلٰى وَأَجَلُّ‏) অর্থাৎ ‘আল্লাহ সুউচ্চ ও অতি সম্মানিত।’ আবার আবূ সুফইয়ান চিৎকার করে বলল,لَنَا الْعُزَّى وَلاَ عُزَّى لَكُمْ অর্থাৎ আমাদের জন্যে উযযা (প্রতিমা) রয়েছে, তোমাদের জন্যে উযযা নেই।’

নাবী (ﷺ) পুনরায় সাহাবীদেরকে বললেন, ‘তোমরা উত্তর দিচ্ছ না কেন?’ তারা বললেন, ‘কী উত্তর দিব?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা বল,‏‏(‏قُوْلُوْا‏:‏اللهُ مَوْلاَنَا، وَلاَ مَوْلٰي لَكُمْ‏)‏‏ অর্থাৎ ‘আল্লাহ আমাদের মাওলা এবং তোমাদের কোন মাওলা নেই।’

অতঃপর আবূ সুফইয়ান বললেন, ‘কতই না ভাল কাজ হল! আজকের দিনটি বদর যুদ্ধের দিনের প্রতিশোধ। আর যুদ্ধ হচ্ছে বালতির ন্যায়।’[1]

উমার (রাঃ) এ কথার উত্তরে বলেন, ‘সমান নয়। কেননা আমাদের নিহতরা জান্নাতে আছেন, আর তোমাদের নিহতরা জাহান্নামে আছে।’

এরপর আবূ সুফইয়ান বলল, ‘উমার (রাঃ) আমার নিকটে এসো।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বললেন, ‘যাও, দেখা যাক কী বলে?’ উমার (রাঃ) নিকটে আসলে আবূ সুফইয়ান তাঁকে বলে, ‘আমি তোমাকে আল্লাহর মাধ্যম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, ‘আমরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে হত্যা করেছি কি?’ জবাবে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! না, বরং এখন তিনি তোমাদের কথা শুনছেন।’ আবূ সুফইয়ান তখন বলল, ‘তুমি আমার নিকট ইবনু কামআর হতে অধিক সত্যবাদী।’[2]

[1] অর্থাৎ কখনও একদল জয় যুক্ত হয় এবং কখনও অন্যদল। যেমন বালতি একবার একজন টেনে তোলে, আরেকবার অন্যজন।

[2] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৯৩-৯৪ পৃঃ, যাদুল মা‘আদ, ২য় খন্ড ৯৪ পৃ: এবং সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৯ পৃঃ।

 বদরে আরেকবার যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা (مُوَاعَدَةُ التَّلاَقِيْ فِيْ بَدْرٍ):

ইবনু ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, আবূ সুফইয়ান এবং তাঁর সঙ্গীরা ফিরে যেতে শুরু করলে আবূ সুফইয়ান মুসলিমগণকে বলল, ‘আগামী বছর বদরে আবার যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা থাকল।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন একজন সাহাবীকে বললেন, ‏ (‏قُلْ‏:‏ نَعَمْ، هُوَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكَ مَوْعِدٌ)‘তুমি তাঁকে বলে দাও ঠিক আছে। এখন আমাদের ও তোমাদের মাঝে এটার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেল।’[1]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৯৪ পৃঃ।

 মুশরিকদের প্রত্যাগমনের সত্যাসত্য যাচাই (التَّثَبُّتُ مِنْ مَوْقِفِ الْمُشْرِكِيْنَ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ)-কে রওয়ানা করিয়ে দিয়ে বলেন,

‏‏(‏اُخْرُجْ فِيْ آثَارِ الْقَوْمِ فَانْظُرْ مَاذَا يَصْنَعُوْنَ‏؟‏ وَمَا يُرِيْدُوْنَ‏؟‏ فَإِنْ كَانُوْا قَدْ جَنَبُوْا الْخَيْلَ، وَامْتَطُوْا الْإِبِلَ، فَإِنَّهُمْ يُرِيْدُوْنِ مَكَّةَ، وَإِنْ كَانُوْا قَدْ رَكِبُوْا الْخَيْلَ وَسَاقُوْا الْإِبِلَ فَإِنَّهُمْ يُرِيْدُوْنَ الْمَدِيْنَةَ)

‘(মুশরিক) কওমের পিছু পিছু যাও, অতঃপর তারা কী করে এবং তাদের উদ্দেশ্য কী তা পর্যবেক্ষণ কর। যদি দেখ যে, তারা ঘোড়াকে পার্শ্বে রেখে উটের উপর সওয়ার হয়ে চলছে, তবে জানবে যে, ফিরে যাওয়াই তাদের উদ্দেশ্য আর যদি দেখ যে, তাঁরা ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে উটকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তবে জানবে যে, মদীনা (আক্রমণ করাই) তাঁদের উদ্দেশ্য।’

তারপর তিনি বলেন,

(وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ، لَئِنْ أَرَادُوْهَا لَأَسِيْرَنَّ إِلَيْهَمْ فَيْهَا، ثُمَّ لَأُنَاجِزَنَّهُمْ‏)

‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যদি মদীনা (আক্রমণ করাই) তাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে মদীনা গিয়ে আমি তাদের মোকাবেলা করব।’

আলী (রাঃ) বলেন, ‘অতঃপর আমি তাদের পিছনে বের হয়ে দেখি যে, তারা ঘোড়াকে পাশে রেখে উটের উপর সওয়ার হয়ে আছে এবং মক্কামুখী রয়েছে।’[1]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৯৪ পৃঃ, হাফেজ ইবনু হাজর (রঃ) ফাতহুল বারী, সপ্ত খন্ডের ৩৪৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, মুশরিকদের উদ্দেশ্য যাচাই করার জন্য সা‘আদ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) রওয়ানা হয়েছিলেন।

 শহীদ ও আহতদের অনুসন্ধান (تَفَقَّدَ الْقَتْلٰى وَالْجُرْحٰى):

কুরাইশের প্রত্যাবর্তনের পর মুসলিমরা তাঁদের শহীদ ও আহতদের খোঁজ খবর নেয়ার সুযোগ লাভ করেন। যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ) বর্ণনা করেছেন : ‘উহুদের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে প্রেরণ করেন যে, আমি যেন সা‘দ ইবনু রাবীর (রাঃ) মৃতদেহ অনুসন্ধান করি এবং বলেন,

‏‏(‏إِنْ رَأَيْتَهُ فَأْقْرَئْهُ مِنِّيْ السَّلَامَ، وَقُلْ لَهُ‏ :‏ يَقُوْلُ لَكَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ‏:‏ كَيْفَ تَجِدُكَ؟‏‏)‏

‘যদি তাঁকে জীবিত দেখতে পাও তবে তাঁকে আমার সালাম জানাবে এবং আমার কথা বলবে যে, সে নিজেকে কেমন পাচ্ছে তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানতে চান।’ আমি তখন নিহতদের মধ্যে চক্কর দিতে দিতে তাঁর কাছে পৌঁছলাম। দেখি যে, তাঁর শেষ নিশ্বাস আসা যাওয়া করছে। তিনি বর্শা, তরবারী ও তীরের সত্তরেরও বেশী আঘাত পেয়েছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘হে সা‘দ (রাঃ)! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং আপনি নিজেকে কেমন পাচ্ছেন তা জানতে চেয়েছেন।’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আমার সালাম জানাবেন এবং তাঁকে বলবেন যে, আমি জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি। আর আপনি আমার কওম আনসারদেরকে বলবেন যে, যদি তাদের একটি চক্ষুও নড়তে থাকে এবং এমতাবস্থায় শত্রু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছে যায় তবে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদের কোন ওযর চলবে না।’ আর এ মুহূর্তে তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে গেল।’[1]

মুসলিমরা আহতদের মধ্যে উসাইরিমকেও দেখতে পান, যার নাম ছিল ‘আমর ইবনু সা’বিত। তাঁর প্রাণ ছিল তখন ওষ্ঠাগত। ইতোপূর্বে তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হতো, কিন্তু তিনি কবুল করতেন না। এ জন্য মুসলিমরা (বিস্মিতভাবে) পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করেন, ‘এ উসাইরিম কিভাবে এখানে আসল? আমরা তো তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে এসেছিলাম যে, সে এ দ্বীনের বিরোধী ছিল। তাই, তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে উসাইরিম, কোন্ জিনিস তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে? তোমার সম্প্রদায়কে সাহায্য করার উত্তেজনা, না ইসলামের আকর্ষণ?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘ইসলামের আকর্ষণ। আসলে আমি আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান এনেছি এবং এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে শরীক হয়েছি। তারপর যে অবস্থায় রয়েছি তা তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন।’ এ কথা বলার পরই তিনি চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হয়ে যান। মুসলিমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে এ ঘটনার উল্লেখ করলে তিনি বলেন,‏(‏هُوَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ‏)‏‏ ‘সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হল।’

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, ‘অথচ তিনি আল্লাহর জন্যে এক ওয়াক্ত সালাতও আদায় করেন নি। (কেননা, ইসলাম গ্রহণের পর কোন সালাতের সময় হওয়ার পূর্বেই তিনি শহীদ হয়ে যান)।’[2]

এ আহতদের মধ্যেই কুযমানকেও পাওয়া গেল। সে এ যুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্ব দেখিয়েছিল এবং একাই সাতজন বা আটজন মুশরিককে হত্যা করেছিল। তাকে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেল। মুসলিমরা তাকে উঠিয়ে বনু যফরের মহল্লায় নিয়ে গেলেন এবং সুসংবাদ শুনালেন। সে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমার যুদ্ধ তো শুধু আমার কওমের মর্যাদা রক্ষার জন্যেই ছিল। এটা না থাকলে আমি যুদ্ধই করতাম না।’ এরপর যখন তার যখমের কারণে সে অত্যধিক যন্ত্রণা অনুভব করল তখন সে নিজেকে জবাই করে আত্মহত্যা করল। এরপর যখনই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে তার আলোচনা করা হত, তখনই তিনি বলতেন যে,‏‏(‏إِنَّهُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ‏ِ)‏ সে জাহান্নামী,[3] আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্য ছাড়া স্বদেশ বা অন্য কিছুর উদ্দেশ্যে যুদ্ধকারীদের পরিণাম এরূপই হয়ে থাকে, যদিও সে ইসলামের পতাকার নীচে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবীদের (রাঃ) সাথে শরীক হয়ে যুদ্ধ করে।

পক্ষান্তরে, নিহতদের মধ্যে বনু সা’লাবাহর একজন ইহুদীকে পাওয়া যায়। যখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল তখন সে তার কওমকে বলেছিল, ‘হে ইহুদীদের দল আল্লাহর কসম! তোমরা জান যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সাহায্য করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য।’ তারা উত্তরে বলেছিল, ‘কিন্তু আজ তো শনিবার।’ সে তখন বলেছিল, ‘তোমাদের জন্যে কোন শনিবার নেই।’ অতঃপর সে নিজের তরবারী এবং সাজ-সরঞ্জাম উঠিয়ে নেয় এবং বলে, ‘আমি যদি নিহত হই তবে আমার মাল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর অধিকারে চলে যাবে। তিনি তা নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করবেন।’ এরপর ঐ ব্যক্তি যুদ্ধ ক্ষেত্রে চলে যায় এবং যুদ্ধ করতে করতে নিহত হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মন্তব্য করেন, ‏‏(‏مُخَيرِيْقٌ خَيْرٌ يَهُوْدٌ‏)‏‏ ‘মুখাইরীক একজন উত্তম ইহুদী ছিল।’[4]

[1] যা’দুল মাআ’দ, ২য় খন্ড ৯৬ পৃঃ।

[2] যাদু’ল মাআ’দ, ২য় খন্ড ৯৪ পৃঃ। ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৯০ পৃঃ।

[3] যাদুল মাআ’দ, ২য় খন্ড ৯৭-৯৮ পৃ: এবং ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৮৮ পৃঃ।

[4] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৮৮-৮৯ পৃঃ।

 শহীদগণকে একত্রিত করণ ও দাফন (جَمْعُ الشُّهَدَاءِ وَدَفْنِهِمْ)‏‏:

এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও শহীদদেরকে পরিদর্শন করেন এবং বলেন,

أَنَا أَشْهَدُ عَلٰى هٰؤُلاَءِ إِنَّهُ مَا مِنْ جَرِيْحٍ يُجْرَحُ فِيْ اللهِ إِلَّا وَاللهِ بَعَثَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَدْمَى اللَّوْنُ لَوْنُ الدَّمِ وَالرِّيْحُ رِيْحُ الْمِسْكِ

‘আমি এ লোকদের ব্যাপারে সাক্ষী থাকব। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহত হয়, আল্লাহ তাঁকে কিয়ামতের দিন এ অবস্থায় উঠাবেন যে, তাঁর ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত বইতে থাকবে। রঙ তো রক্তেরই হবে, কিন্তু সুগন্ধি হবে মিশকের মতো।’[1]

কতিপয় সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তাঁদের শহীদদেরকে মদীনায় স্থানান্তরিত করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁরা যেন শহীদদেরকে ফিরিয়ে এনে তাঁদের শাহাদতের স্থানেই দাফন করেন এবং আরো নির্দেশ দেন যে, তাঁদের অস্ত্র-শস্ত্র এবং চর্ম নির্মিত (যুদ্ধের) পোষাক যেন খুলে নেয়া না হয়, আর গোসল দেয়া ছাড়াই যে অবস্থায় তাঁরা রয়েছেন সেই অবস্থাতেই যেন তাঁদেরকে দাফন করে দেয়া হয়। তিনি দু’দুজনকে একই কাপড়ে জড়াতেন এবং দুই কিংবা তিন শহীদকে একই কবরে দাফন করতেন এবং প্রশ্ন করতেন,‏‏ (‏أَيُّهُمْ أَكْثَرُ أَخْذًا لِلْقُرْآنِ‏؟‏)‘এদের মধ্যে কুরআন কার বেশী মুখস্থ ছিল?’ সাহাবী যার দিকে ইশারা করতেন তাকেই তিনি কবরে আগে রাখতেন এবং বলতেন, ‏‏(‏أَنَا شَهِيْدٌ عَلٰى هٰؤُلاَءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ‏)‏ ‘কিয়ামতের দিন আমি এ লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দান করব।’ আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনু হারাম (রাঃ) এবং ‘আমর ইবনু জমূহ (রাঃ)-কে একই কবরে দাফন করা হয়। কেননা তাঁদের দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল।[2]

হানযালার (রাঃ) মৃতদেহ অদৃশ্য ছিল। অনুসন্ধানের পর এক জায়গায় এমন অবস্থায় দেখা গেল যে, যমীন হতে উপরে রয়েছে এবং ওটা হতে টপ্ টপ্ করে পানি পড়ছে। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবায়ে কিরামকে জানালেন যে, ‘ফিরিশতারা একে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন।’ তখন নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‏‏ (‏سَلُوْا أَهْلَهُ مَا شَأْنُهُ‏؟‏‏) ‘তাঁর বিবিকে জিজ্ঞাসা কর প্রকৃত ব্যাপারটি কী ছিল?’ তাঁর বিবিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তার প্রকৃত ঘটনাটি বলেন। এখান থেকেই হানযালা (রাঃ)-এর নাম (غَسِيْلُ الْمَلاَئِكَةِ) (অর্থাৎ ফিরিশতাগণ কর্তৃক গোসল প্রদত্ত) হয়ে যায়।[3]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর চাচা হামযাহ (রাঃ)-এর অবস্থা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হন। তাঁর ফুফু সাফিয়্যাহহ (রাঃ) আগমন করেন এবং তিনিও তাঁর ভ্রাতা হামযাহ (রাঃ)-কে দেখার বাসনা প্রকাশ করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পুত্র যুবাইর (রাঃ)-কে বলেন যে, তিনি যেন তাঁর মাতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং তাঁর ভাইকে দেখতে না দেন।

এ কথা শুনে সাফিয়্যাহহ (রাঃ) বলেন, ‘এটা কেন? আমি জানতে পেরেছি যে, আমার ভাই এর নাক, কান ইত্যাদি কেটে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার ভাই আল্লাহর পথে রয়েছে। সুতরাং তার উপর যা কিছু করা হয়েছে তাতে আমি পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট আছি। আমি পুণ্য মনে করে ইনশাআল্লাহ ধৈর্য্য ধারণ করব।’ অতঃপর তিনি হামযাহ (রাঃ)-এর নিকট আসেন, তাঁকে দেখেন, তাঁর জন্যে ইন্নালিল্লাহ পড়েন এবং দুআ করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ অনুযায়ী হামযাহ (রাঃ)-কে আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ)-এর সাথে দাফন করা হয়। তিনি হামযাহ (রাঃ)-এর ভাগিনা এবং দুধভাইও ছিলেন। ইবনু মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হামযাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রাঃ)-এর জন্যে যে ভাবে কেঁদেছেন তার চেয়ে বেশী কাঁদতে আমরা তাঁকে কখনো দেখি নি। তিনি তাঁকে ক্বিবলাহমুখী করে রাখেন। অতঃপর তাঁর জানাযায় দাঁড়িয়ে তিনি এমনভাবে ক্রন্দন করেন যে, শব্দ উঁচু হয়ে যায়।[4]

প্রকৃতপক্ষে শহীদদের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। খাব্বাব ইবনু আরত বর্ণনা করেছেন যে, হামযাহ (রাঃ)-এর জন্যে কালো প্রান্তবিশিষ্ট একটি চাদর ছাড়া কোন কাফন পাওয়া যায় নি। ঐ চাদর দ্বারা মাথা আবৃত করলে পা খোলা থেকে যেত এবং পা আবৃত করলে মাথা খোলা থেকে যেত। অবশেষে মাথা ঢেকে দেয়া হয় এবং পায়ের উপর ইযখির[5] ঘাস চাপিয়ে দেয়া হয়।[6]

আব্দুর রহমান ইবনু আউস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ) শহীদ হন এবং তিনি আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। তাঁকে একটি মাত্র চাদর দ্বারা তাঁর মাথা ঢাকলে পা খোলা থাকত এবং পা ঢাকলে মাথা খোলা থেকে যেত।’ এ অবস্থার কথা খাব্বাবও (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি শুধু এটুকু বেশী বলেছেন, ‘(এ অবস্থা দেখে) নাবী (ﷺ) আমাদেরকে বলেন, ‏‏(‏غُطُّوْا بِهَا رَأْسَهُ، وَاجْعَلُوْا عَلٰى رِجْلَيْهِ الْإِذْخِرْ) তার মাথা ঢেকে দাও, আর তার পায়ের উপর ইযখির (ঘাষ) ফেলে দাও।’[7]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ৯৮ পৃঃ।

[2] যাদুল মা‘আদ, ২য় খন্ড ৯৮ পৃঃ, এবং সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৮৪ পৃঃ।

[3] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড, ৯৪ পৃঃ।

[4] এটা ইবনে শাযানের বর্ণনা। শায়খ আব্দুল্লাহর মুখতাসারুস সীরাহ এর ২৫৫ পৃ: দ্রঃ।

[5] এটা মুযের সাথে সম্পূর্ণরূপে সাদৃশ্যযুক্ত এক প্রকার সুগন্ধময় ঘাস যা বহু জায়গায় চায়ে ফেলে দিয়ে চা তৈরি করা হয়। আরবে এ ঘাস এক হতে দেড় হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। আর হিন্দুস্তানে এটা এক মিটারের চেয়েও বেশী লম্বা হয়।

[6] মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত, ১ম খন্ড ১৪০ পৃঃ।

[7] সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৭৯ ও ৫৮৪ পৃঃ।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-মহামহিমান্বিত আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন এবং তাঁর নিকট দুআ করেন (الرَّسُوْلُ ﷺ يَثْنِيْ عَلٰى رَبِّهِ عَزَّ وِجَلَّ وَيَدْعُوْهُ):

ইমাম আহমাদ (রঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, উহুদের দিন যখন মুশরিকরা মক্কার পথে ফিরে যায় তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-কে বলেন, ‘তোমরা সমানভাবে দাঁড়িয়ে যাও, আমি কিছুক্ষণ আমার মহিমান্বিত প্রতিপালকের প্রশংসা ও গুণগান করব।’ এ আদেশ অনুযায়ী সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তাঁর পিছনে কাতার বন্দী হয়ে যান। তিনি বলেন,

اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ كُلُّهُ اللَّهُمَّ لاَ قَابِضَ لِمَا بَسَطْتَ وَلاَ بَاسِطَ لِمَا قَبَضْتَ وَلاَ هَادِيَ لِمَا أَضْلَلْتَ وَلاَ مُضِلَّ لِمَنْ هَدَيْتَ وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُقَرِّبَ لِمَا بَاعَدْتَ وَلاَ مُبَاعِدَ لِمَا قَرَّبْتَ اللَّهُمَّ ابْسُطْ عَلَيْنَا مِنْ بَرَكَاتِكَ وَرَحْمَتِكَ وَفَضْلِكَ وَرِزْقِكَ

‘হে আল্লাহ! আপনার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা। হে আল্লাহ! যে জিনিসকে আপনি প্রশস্ত করেন ওটাকে কেউ সংকীর্ণ করতে পারে না, আর যে জিনিসকে আপনি সংকীর্ণ করে দেন ওটাকে কেউ প্রশস্ত করতে পারে না। যাকে আপনি পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ পথ প্রদর্শন করতে পারে না এবং যাকে আপনি পথ প্রদর্শন করেন তাকে কেউ প্রথভ্রষ্ট করতে পারে না, যেটা আপনি আটকিয়ে রাখেন ওটা কেউ প্রদান করে না, আর যেটা আপনি প্রদান করেন ওটা কেউ আটকাতে পারে না, যেটাকে আপনি দূর করে দেন ওটাকে কেউ নিটকবর্তী করতে পারে না। হে আল্লাহ! আমাদের উপর স্বীয় বরকত, রহমত, অনুগ্রহ এবং রিযক প্রশস্ত করে দিন।

اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ النَّعِيْمَ الْمُقِيْمَ الَّذِيْ لاَ يَحُوْلُ وَلاَ يَزُوْلُ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ النَّعِيْمَ يَوْمَ الْعَيْلَةِ وَالْأَمْنَ يَوْمَ الْخَوْفِ اللَّهُمَّ إِنِّيْ عَائِذٌ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا أَعْطَيْتَنَا وَشَرِّ مَا مَنَعْتَ اللَّهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الإِيْمَانَ وَزَيِّنْهُ فِيْ قُلُوْبِنَا وَكَرِّهْ إِلَيْنَا الْكُفْرَ وَالْفُسُوْقَ وَالْعِصْيَانَ وَاجْعَلْنَا مِنْ الرَّاشِدِيْنَ اللَّهُمَّ تَوَفَّنَا مُسْلِمِيْنَ وَأَحْيِنَا مُسْلِمِيْنَ وَأَلْحِقْنَا بِالصَّالِحِيْنَ غَيْرَ خَزَايَا وَلاَ مَفْتُوْنِيْنَ اللَّهُمَّ قَاتِلْ الْكَفَرَةَ الَّذِيْنَ يُكَذِّبُوْنَ رُسُلَكَ وَيَصُدُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِكَ وَاجْعَلْ عَلَيْهِمْ رِجْزَكَ وَعَذَابَكَ اللَّهُمَّ قَاتِلْ الْكَفَرَةَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ إِلَهَ الْحَقِّ

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এমন নিয়ামতের জন্যে প্রার্থনা করছি যা স্থায়ী থাকে এবং শেষ হয় না। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট দারিদ্রের দিনে সাহায্যের এবং ভয়ের দিনে নিরাপত্তার প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তার অকল্যাণ হতে এবং যা কিছু দেন নি তারও অকল্যাণ হতে আশ্রয় চাচ্ছি। হে আল্লাহ! আমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দিন এবং ওটাকে আমাদের অন্তরে সৌন্দর্যমন্ডিত করুন। আর কুফর, ফিসক ও অবাধ্যতাকে আমাদের নিকট অপছন্দনীয় করে দিন এবং আমাদেরকে হিদায়াতপ্রাপ্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন। হে আল্লাহ! আমাদেরকে মুসলিম থাকা অবস্থায় মৃত্যু দান করুন এবং মুসলিম থাকা অবস্থায় জীবিত রাখুন। আর আমরা লাঞ্ছিত হই এবং ফিৎনায় পতিত হই তার পূর্বেই আমাদেরকে সৎলোকদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি ঐ কাফিরদেরকে ধ্বংস করুন এবং কঠিন শাস্তি দিন, যারা আপনার নাবীদেরকে অবিশ্বাস করে এবং আপনার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। হে আল্লাহ! ঐ কাফিরদেরকেও ধ্বংস করুন যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, হে সত্য মা’বূদ।’[1]

[1] সহীহুল বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ। মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খন্ড ৩২৪ পৃঃ।

 মদীনায় প্রত্যাবর্তন এবং প্রেম-প্রীতি ও আত্মোৎসর্গের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের অসাধারণ ঘটনাবলী (الرُّجُوْعُ إِلَى الْمَدِيْنَةِ، وَنَوَادِرُ الْحَبِّ وَالتّفاَنِيْ):

শহীদদের দাফন কাফন এবং মহা মহিমান্বিত আল্লাহর গুণগান ও তাঁর নিকট দু‘আর কাজ শেষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। যুদ্ধকালে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) হতে প্রেম ও আত্মত্যাগের অসাধারণ ঘটনাবলী প্রকাশিত হয়েছিল, ঠিক তেমনই পথ চলাকালে মুসলিম মহিলাগণ হতেও সত্যবাদিতা ও আত্মত্যাগের বিস্ময়কর ঘটনাবলী প্রকাশ পেয়েছিল।

পথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে হামনাহ বিনতে জাহশ (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। তাঁকে তাঁর ভ্রাতা আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ)-এর শাহাদতের সংবাদ দেয়া হয়। তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাঁর মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করেন। তারপর তাঁর মামা হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)-এর শাহাদতের খবর দেয়া হয়। তিনি আবার ইন্নালিল্লাহ পড়েন ও তাঁর মাগফিরাতের জন্য দুআ করেন। এরপর তাঁকে তাঁর স্বামী মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ)-এর শাহাদতের সংবাদ দেয়া হয়। এ খবর শুনে তিনি অস্থিরভাবে চিৎকার করে উঠেন এবং হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‏‏ (‏إِنَّ زَوْجَ الْمَرْأَةِ مِنْهَا لَبِمَكَانٍ‏)‏ ‘স্ত্রীর কাছে স্বামীর বিশেষ এক মর্যাদা আছে।’[1]

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু দীনার গোত্রের এক মহিলার পাশ দিয়ে গমন করেন যার স্বামী, ভ্রাতা এবং পিতা এ তিন জন শাহাদতের পিয়ালা পান করেছিলেন। তাঁকে এদের শাহাদতের সংবাদ দেয়া হলে তিনি বলে ওঠেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর কী?’ সাহাবীগণ উত্তর দেন, ‘হে উম্মু ফুলান, তুমি যেমন চাচ্ছ তিনি তেমনই আছেন (অর্থাৎ তিনি বেঁচে আছেন।)।’ মহিলাটি বললেন, ‘তাঁকে একটু আমাকে দেখিয়ে দিন, আমি তার দেহ মুবারক একটু দেখতে চাই।’ সাহাবীগণ ইঙ্গিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়া মাত্রই হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, (كُلُّ مُصِيْبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ) অর্থাৎ ‘আপনাকে পেলে সব বিপদই নগণ্য।’[2]

পথে চলাকালেই সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর মা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আসেন। ঐ সময় সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এ ঘোড়ার লাগাম ধরেছিলেন। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ইনি আমার মাতা।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন ‘মারহাবা’ বলেন। অতঃপর তাঁর অভ্যর্থনার জন্যে থেমে যান এবং তাঁর পুত্র ‘আমর ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর শাহাদতের উপর সমবেদনাসূচক কালেমা পাঠ করে তাঁকে সান্ত্বনা দেন এবং ধৈর্য্যধারণের উপদেশ দেন। তখন তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যখন আমি আপনাকে নিরাপদ দেখতে পেয়েছি তখন সব বিপদই আমার কাছে অতি নগণ্য।’ তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উহুদের শহীদদের জন্যে দু‘আ করেন এবং বলেন, ‏‏(‏يَا أُمَّ سَعْدٍ، أَبْشِرِيْ وَبَشِّرِيْ أَهْلَهُمْ أَنْ قَتْلاَهُمْ تَرَافَقُوْا فِي الْجَنَّةِ جَمِيْعًا، وَقَدْ شَفَعُوْا فِيْ أَهْلِهِمْ جَمِيْعاً‏‏‏) ‘হে উম্মু সা‘দ (রাঃ) তুমি খুশী হয়ে যাও এবং শহীদদের পরিবারের লোকদেরকে সুসংবাদ শুনিয়ে দাও যে, তাঁদের শহীদরা সবাই এক সাথে জান্নাতে রয়েছে। আর তাঁদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে তাঁদের সবারই শাফাআত কবুল করা হবে।’

সা‘দ (রাঃ)-এর মাতা (রাঃ) তখন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্যেও দু‘আ করুন।’ তিনি বললেন,(‏اللّٰهُمَّ أَذْهِبْ حُزْنَ قُلُوْبِهِمْ، وَاجْبِرْ مُصِيْبَتِهِمْ، وَأَحْسِنْ الخَلْفَ عَلٰى مَنْ خُلِّفُوْ) ‘হে আল্লাহ! তাঁদের অন্তরের দুঃখ দূর করে দিন, তাঁদের বিপদের বিনিময় প্রদান করুন এবং জীবিত ওয়ারিসদেরকে উত্তমরূপে দেখা শোনা করুন।’[3]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড, ৯৯ পৃঃ।

[2] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড, ৯৯ পৃঃ।

[3] আস সীরাতুল হালবিয়্যাহ, ২য় খন্ড ৪৭ পৃঃ।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় (الرَّسُوْلُ ﷺ فِي الْمَدِيْنَةِ):

সেদিন হিজরী তৃতীয় সনের ৭ই শাওয়াল শনিবার সন্ধ্যার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় পৌঁছেন। বাড়িতে তিনি তাঁর নিজের তরবারীটি ফাতিমাহ (রাঃ)-কে দিয়ে বলেন, ‘মা! এর রক্ত ধুয়ে দাও। আল্লাহর কসম! এটা আজ আমার নিকট খুবই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।’ তারপর আলী (রাঃ)ও তাঁর তরবারীখানা ফাতিমাহ (রাঃ)-এর দিকে বাড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, ‏‏(‏اِغْسِلِيْ عَنْ هٰذَا دَمَهُ يَا بُنَيَّةُ، فَوَاللهِ لَقَدْ صَدَقَنِيْ الْيَوْمَ) ‘এটারও রক্ত ধুয়ে ফেল। আল্লাহর শপথ! এটাও আজ অত্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।’ তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বললেন, ‏‏(‏لَئِنْ كُنْتَ صَدَقْتَ الْقِتَالَ، لَقَدْ صَدَقَ مَعَكَ سَهْلُ بْنُ حُنَيْفٍ وَأَبُوْ دُجَانَةَ) ‘তুমি যদি নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করে থাক তবে তোমার সাথে সুহায়েল ইবনু হুনায়েফ (রাঃ) এবং দুজানাহ (রাঃ)ও নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করেছে।[1]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড, ১০০ পৃঃ।

শহীদ ও কাফির হত্যা সংখ্যা (قَتْلَى الْفَرِيْقِيْنَ):

অধিকাংশ বর্ণনাকারী একমত যে, মুসলিম শহীদদের সংখ্যা ছিল সত্তর জন, যাঁদের মধ্যে অধিক সংখ্যকই ছিলেন আনসার, অর্থাৎ তাঁদের পঁয়ষট্টি জন লোক শহীদ হয়েছিলেন, খাযরাজ গোত্রের একচল্লিশ জন এবং আউস গোত্রের চবিবশ জন। একজন ইহুদী নিহত হয়েছিল এবং মুহাজির শহীদদের সংখ্যা ছিল মাত্র চারজন।

অধিকাংশ বর্ণনাকারী একমত যে, মুসলিম শহীদদের সংখ্যা ছিল সত্তর জন, যাঁদের মধ্যে অধিক সংখ্যকই ছিলেন আনসার, অর্থাৎ তাঁদের পঁয়ষট্টি জন লোক শহীদ হয়েছিলেন, খাযরাজ গোত্রের একচল্লিশ জন এবং আউস গোত্রের চবিবশ জন। একজন ইহুদী নিহত হয়েছিল এবং মুহাজির শহীদদের সংখ্যা ছিল মাত্র চারজন।

এখন বাকী থাকল কুরাইশদের নিহতদের সংখ্যা নিয়ে কথা। ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনা অনুযায়ী তাদের সংখ্যা ছিল বাইশ জন। কিন্তু আসহাবে মাগাযী এবং আহলুসসিয়ার এ যুদ্ধের যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং যাতে যুদ্ধের বিভিন্ন স্থানে নিহত মুশরিকদের যে আলোচনা এসেছে তাতে গভীরভাবে চিন্তা করে হিসাব করলে এ সংখ্যা বাইশ নয়, বরং সাঁইত্রিশ হয়। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী।[1]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড ১২২-১২৯ পৃঃ, ফাতহুলবারী, ৭ম খন্ড, ৩৫ পৃ: এবং মুহাম্মাদ আহমাদ বাশমীল রচিত ‘গাযওয়ায়ে উহুদ ২৭৮, ২৭৯ ও ২৮০ পৃঃ।

 মদীনায় উদ্বেগপূর্ণ অবস্থা (حَالَةُ الطَّوَارِئْ فِي الْمَدِيْنَةِ):

মুসলিমরা উহুদ যুদ্ধ হতে ফিরে এসে (তৃতীয় হিজরী সনের ৮ই শাওয়াল শনিবার ও রবিবার মর্ধবর্তী) রাত্রে উদ্বেগপূর্ণ অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করেন। যুদ্ধ তাঁদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছিল। তবুও তাঁরা মদীনার পথে ও গমনাগমন স্থলে সারারাত পাহারা দিতে থাকেন এবং তাঁদের প্রধান সেনাপতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হিফাযতের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কেননা, যে কোন দিক থেকেই তাঁর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

 হামরাউল আসাদ অভিযান (غَزْوَةُ حَمْرَاءِ الْأَسَدِ‏):

এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধে সৃষ্ট অবস্থার উপর গভীর চিন্তা করে সারা রাত কাটিয়ে দেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, যদি মুশরিকরা এ চিন্তা করে যে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের পাল্লা ভারী থাকা সত্ত্বেও তারা কোন উপকার লাভ করতে পারেনি, তাহলে তারা অবশ্যই লজ্জিত হবে এবং রাস্তা হতে ফিরে এসে মদীনার উপর দ্বিতীয়বার আক্রমণ চালাবে এ জন্যে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, যে প্রকারেই হোক তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে হবে।

আহলে সিয়ারের বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উহুদ যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ তৃতীয় হিজরীর ৮ই শাওয়াল রবিবারে সকালে ঘোষণা করেন যে, শত্রুদের মোকাবেলার জন্যে বের হতে হবে। সাথে সাথে তিনি এ ঘোষণাও দেন যে, ‏‏(‏لاَ يَخْرُجُ مَعَنَا إِلاَّ مَنْ شَهِدْ الْقِتَالَ‏)‏ যারা উহুদ যুদ্ধে শরীক ছিল শুধু তারাই যাবে। এর পরেও আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তাদের সাথে যাবার অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে অনুমতি দিলেন না। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মদীনার মুসলিম পল্লীটি শয্যার উপর লাফিয়ে উঠলেন। সব শোক, সব সন্তাপ, সব জ্বালা, সব যন্ত্রণা বিস্মৃত হয়ে তাঁরা গত কালের রক্ত রঞ্জিত অস্ত্রগুলো তুলে নিলেন হাতে এবং উৎসাহের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে সমবেত হতে লাগলেন। দেখতে দেখতে মুসলিম বাহিনী মদীনা ত্যাগ করে গেলেন।

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) যিনি উহুদ যুদ্ধে শরীক হওয়ার সুযোগ লাভ করেন নি, এ যুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্য নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে আরজ পেশ করলেন। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমি চাচ্ছি যে, আপনি যে সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবেন আমিও যেন সে সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করি। কিন্তু যেহেতু এ যুদ্ধে (উহুদ) আমার পিতা তাঁর সন্তানদের দেখাশোনার জন্য আমাকে বাড়িতে রেখে দেন সেহেতু আমি তাতে শরীক হতে পারিনি। অতএব, আমাকে অভিযানে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ দান করা হোক।’ রাসূল কারীম (ﷺ) তাঁকে অনুমতি প্রদান করলেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আগের মতো রণসাজে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে অগ্রগামী হয়ে চলতে থাকলেন। আর সবাই চলছিলেন পায়ে হেঁটে। কর্মসূচী অনুযায়ী মদীনা হতে আট মাইল দূরে হামরাউল আসাদ নামক স্থানে পৌঁছে তাঁরা শিবির স্থাপন করলেন।

এখানে অবস্থান কালে মা‘বাদ ইবনু আবূ মা‘বাদ খুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। আবার এটাও কথিত আছে যে, সে শিরকের উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল। কেননা, খুযাআহ ও বনু হাশিমের মধ্যে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সাহায্যের চুক্তি ছিল। যাহোক, সে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আপনার ও আপনার সহচরদের ক্ষয় ক্ষতিতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি। আমি কামনা করছিলাম যে, আল্লাহ আপনাদেরকে নিরাপদে রাখবেন। তার এ সহানুভূতি প্রকাশে খুশী হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন, ‘তুমি আবূ সুফইয়ানের নিকট গমন কর এবং তাকে হতোদ্যম করে দাও।’

এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে আশঙ্কা করছিলেন যে, মুশরিকরা মদীনায় প্রত্যাবর্তনের কথা চিন্তা ভাবনা করবে তা ছিল সম্পূর্ণ সত্য।

মুশরিকরা মদীনা হতে ছত্রিশ মাইল দূরে ‘রাওহা’ নামক স্থানে পৌঁছে যখন শিবির স্থাপন করল তখন তারা পরস্পর পরস্পরকে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করতে লাগল। তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল যে, আমরা কোন কাজই করতে পারলাম না এবং আমাদের উদ্দেশ্য সফল হল না। আবূ সুফইয়ান, ইকরামা প্রভৃতি দলপতিগণ বলতে লাগল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) আহত এবং তার অধিক সংখ্যক ভক্তই আঘাতে জর্জরিত, এ অবস্থায় মদীনা আক্রমণ না করে ফিরে যাওয়া আমাদের পক্ষে কোনক্রমেই যুক্তিসম্মত হচ্ছে না। মুসলিমগণকে সমূলে উৎপাটিত ও সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করার জন্যই আমরা এত উদ্যোগ আয়োজন করলাম এবং সবকিছুই বিধ্বস্ত করে ফেললাম। এখন তার সুযোগ উপস্থিত হয়েছে, অথচ আমরা ফিরে যাচ্ছি, দু’দিন পরেই তারা আবারও সামলিয়ে উঠবে, তখন আমাদের উদ্দেশ্য সহজ সাধ্য হবে না। কেননা, তাদের শান-শওকত ও শক্তি কিছুটা খর্ব হলেও তাদের মধ্যে এখনো কিছু সংখ্যক লোক থেকে গেছে যারা আবার তোমাদের মাথাব্যথার কারণ হবে। অতএব, তোমাদের উচিত যে, মদীনায় ফিরে গিয়ে তাদের মূলোৎপাটন করে ফেলবে।

আবূ সুফইয়ান বিভিন্ন গোত্রের যে সমস্ত লোকদেরকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে নিজেদের দলে আনয়ন করেছিলেন তারা বলতে লাগল, ‘কী করতে এসেছিলাম আর কী করে যাচ্ছি। মদীনা আক্রমণ করে ধর্মের শত্রুদেরকে বিধ্বস্ত করে ফেলব, মদীনার সমস্ত ধন-সম্পদ লুটে নিব, তাদের যুবতী ও কুমারীদের সতীত্ব নষ্ট করব এবং যা খুশী তাই করব। কিন্তু এখন দেখছি এ সব কিছুই হল না। আমাদেরকে উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। তাই তারা সিদ্ধান্ত করল যে, মদীনা আক্রমণ করতেই হবে। উমাইয়ার পুত্র সাফওয়ান এর প্রতিবাদ করল বটে, কিন্তু কেউই তার কথা গ্রাহ্য করল না।

কিন্তু এ ধরণের কথাবার্তা থেকে ধারণা করা যায় যে, এটা ছিল মুশরিক কুরাইশদের একটি সাধারণ অভিমত। যারা উভয় পক্ষের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখত না। কিন্তু সাফওয়ান বিন উমাইয়া, যিনি একজন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন, তিনি এ মতের বিরোধিতা করেন এবং বলেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা এরূপ কাজ কর না। আমার ভয় হয় যে, মদীনার যারা উহুদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে নি তারাও তোমাদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে। তোমরা এ অবস্থায় ফিরে চল। এখন বিজয় রয়েছে তোমাদেরই। অন্যথায় আমার ভয় হয় যে, যদি এখন মদীনা আক্রমণ কর তাহলে বিপদে পড়ে যাবে। কিন্তু অধিক সংখ্যক লোকই এ মত গ্রহণ করল না এবং সিদ্ধান্ত হল যে, মদীনা আক্রমণ করতে হবে।

তখনো তারা শিবির ছেড়ে বের হয়নি এমন সময় মা’বাদ ইবনু আবি মা’বাদ খুযায়ী তথায় গিয়ে হাজির হল। মা’বাদের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে আবূ সুফইয়ান কিছুই জানত না। তাই তাকে দেখেই আবূ সুফইয়ান সাগ্রহে বলে উঠলেন, ‘এ যে, মা’বাদ’। সংবাদ কী? মা’বাদ উত্তর দিল, ‘সংবাদ আর কী, এখনই সরে পড়।’ আবূ সুফইয়ান প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাপার কী, মুহাম্মাদ (ﷺ) সম্বন্ধে কোন সংবাদ আছে না কি?’ মা’বাদ জবাবে বলল, ‘আছে বৈ কি। মুহাম্মাদ (ﷺ) বিপুল আয়োজনে অগ্রসর হচ্ছেন। এবার মদীনার প্রত্যেক মুসলিমই যোগদান করেছে।’ এ কথা শুনে আবূ সুফইয়ান বললেন, ‘আরে সর্বনাশ! তুমি বলছ কী? তাদের অবশিষ্ট শক্তিটুকু বিনষ্ট করতে, তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করতে দৃঢ় সংকল্প করে আমরা মদীনার দিকে অগ্রসর হতে যাচ্ছি, মুহাম্মাদ (ﷺ) প্রত্যুষে আবার যুদ্ধ যাত্রা করেছে, এটাও কি সম্ভব? তুমি বলছ কী?’ মা’বাদ জবাব দিল ‘বলছি ভালই, এখনও মানে মানে সরে পড়। মুসলিম বাহিনী এসে পড়তে বেশী দেরী নেই, শীঘ্রই সরে পড়।’

আবূ সুফইয়ান তখন সকলকে মক্কার পথে যাত্রা করার আদেশ প্রদান করলেন। কুরাইশ বাহিনী আর কাল বিলম্ব না করে স্বদেশ অভিমুখে রওয়ানা হল। তবে আবূ সুফইয়ান একটা কাজ করল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) যেন মুশরিকদের পশ্চাদ্ধাবন না করেন এ জন্যে তাদের পাশ দিয়ে গমনকারী আব্দুল ক্বায়স গোত্রের এক কাফেলার লোকদেরকে বলেন, ‘আপনারা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আমাদের একটি পয়গাম পৌঁছিয়ে দিবেন কি? আমি ওয়াদা করছি যে, আপনারা যখন মক্কা আসবেন তখন আমি এর বিনিময়ে আপনাদের উটগুলো যতো বহন করতে পারে ততো কিশমিস প্রদান করব।’

ঐ লোকগুলো বলল, ‘জ্বী হ্যাঁ পারব।’

আবূ সুফইয়ান তখন তাদেরকে বললেন, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে এ খবর পৌঁছে দিবেন যে, আমরা তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদেরকে খতম করে দেয়ার জন্যে দ্বিতীয়বার আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।’

এরপর এ কাফেলা যখন হামরাউল আসাদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কিরামের পাশ দিয়ে গমন করে তখন তাদেরকে আবূ সুফইয়ানের এ পয়গাম শুনিয়ে দেয় এবং বলে,

(‏إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوْا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ‏ ‏إِيْمَاناً وَقَالُوْا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ فَانقَلَبُوْا بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللهِ وَفَضْلٍ لَّمْ يَمْسَسْهُمْ سُوْءٌ وَاتَّبَعُوْا رِضْوَانَ اللهِ وَاللهُ ذُوْ فَضْلٍ عَظِيْمٍ‏)‏‏ [‏آل عمران‏:‏ 173، 174‏]‏‏.‏

‘তোমাদের বিরুদ্ধে লোক (মুশরিকরা) জামায়েত হয়েছে, সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় কর, কিন্তু এটা তাঁদের বিশ্বাস দৃঢ়তর করেছিল এবং তাঁরা বলেছিলেন, ‘আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক!’ তারপর তাঁরা আল্লাহর অবদান ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিলেন, কোন অনিষ্ট তাঁদেরকে স্পর্শ করে নি, এবং আল্লাহ যাতে সন্তুষ্ট তাঁরা তারই অনুসরণ করেছিলেন এবং আল্লাহ বড় অনুগ্রহশীল (সূরাহ আল-ইমরান (৩) : ১৭৩-১৭৪)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রবিবার হামরাউল আসাদে পৌঁছেছিলেন এবং সোমবার, মঙ্গলবার এবং বুধবার অর্থাৎ তৃতীয় হিজরীর ৯ই, ১০ই এবং ১১ই শাওয়াল তথায় অবস্থান করেছিলেন, এরপর মদীনায় ফিরে এসেছিলেন। ফিরবার পূর্বে আবূ উযযা জুমহী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাতে বন্দী হয়। এ ছিল ঐ ব্যক্তি যে বদরের যুদ্ধে বন্দী হওয়ার পর দারিদ্র ও কন্যার আধিক্যের কারণে বিনা মুক্তিপণে মুক্তি পেয়েছিল। শর্ত ছিল, সে ভবিষ্যতে কখনও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে কাউকেও সাহায্য করবে না। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে কবিতার মাধ্যমে নাবী (ﷺ) ও সাহাবায়ে কিরামের বিরুদ্ধে জনগণকে উত্তেজিত করতে থাকে। অতঃপর উহুদ যুদ্ধে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে সে নিজেও আগমন করে, তাকে গ্রেফতার করে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র খিদমতে হাযির করা হয় তখন সে বলতে শুরু করে : ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) আমার অপরাধ ক্ষমা করুন, আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন এবং আমার শিশু সন্তানদের খাতিরে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি অঙ্গীকার করছি যে, এরূপ অপরাধমূলক কাজ আর কখনও করব না।’ নাবী (ﷺ) উত্তরে বলেন,

‏‏(‏لَا تَمْسَحُ عَارِضِيْكَ بِمَكَّةَ بَعْدَهَا وَتَقُوْلُ ‏:‏ خَدَعْتُ مُحَمَّداً مَرَّتَيْنِ، لَا يُلْدَغُ الْمُؤْمِنُ مِنْ جُحْرٍ مَرَّتَيْنِ‏)

‘এখন এটা হতে পারে না যে, মক্কায় ফিরে গিয়ে নিজের কপালে হাত মেরে বলবে, ‘আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে দু’দুবার প্রতারিত করেছি। মু’মিনকে এক ছিদ্র হতে দু’বার দংশন করা হয় না।’ এরপর তিনি যুবাইর (রাঃ)-কে অথবা আ’সিম ইবনু সাবিত (রাঃ)-কে তার গর্দান উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। তাঁরা তাকে হত্যা করেন।

অনুরূপভাবে মক্কার একজন গুপ্তচরও মারা যায়। তার নাম ছিল মুআবিয়া ইবনু মুগীরা ইবনু আবিল আস। সে ছিল আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ানের নানা। উহুদের দিন মুশরিকরা যখন মক্কার দিকে ফিরে যায় তখন সে তার চাচাতো ভাই উসমান ইবনু আফফান (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। উসমান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তার জন্যে নিরাপত্তা প্রার্থনা করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে এ শর্তে নিরাপত্তা প্রদান করেন যে, সে যদি মদীনায় তিন দিনের বেশী অবস্থান করে তবে তাকে হত্যা করে দেয়া হবে। কিন্তু মদীনা যখন মুসলিম সৈন্য হতে শূন্য হয়ে গেল তখন এ লোকটি কুরাইশের গোয়েন্দাগিরি করার জন্য মদীনায় তিন দিনের বেশী থেকে যায়।

অতঃপর যখন মুসলিম সেনাবাহিনী মদীনায় ফিরে আসে তখন সে পালাবার চেষ্টা করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) ও আম্মার ইবনু ইয়াসার (রাঃ)-কে নির্দেশ দেন তারা যেন ঐ ব্যক্তির পিছু নিয়ে তাকে হত্যা করেন।[1]

হামরাউল আসাদ অভিযানের বর্ণনা পৃথক নামে দেয়া হলেও প্রকৃত পক্ষে এটা উহুদ যুদ্ধেরই একটা অংশ ও পরিশিষ্ট।

[1] উহুদ যুদ্ধ এবং হামরাউল-আসাদ অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড, ৯১-১০৮ পৃঃ, ইবুন হিশাম, ২য় খন্ড, ৬০-১২৯ পৃঃ, ফাতহুল বারী শারাহ, সহীহুল বুখারী, ৭ম খন্ড, ৩৪৫-৩৭৭ পৃ: এবং শায়খ আব্দুল্লাহর মুখতাসারুস সীরাহ ২৪২-২৫৭ পৃ: জমা করা হয়েছে। আরও অন্যান্য সূত্রগুলোর হাওয়ালা সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে দেয়া হয়েছে।

 উহুদ যুদ্ধে জয়-পরাজয় পর্যালোচনা (غَزْوَةُ أُحُدٍ بِجَمِيْعِ مَرَاحِلِهَا وَتَفَاصِيْلِهَا):

এই হলো উহুদ যুদ্ধে জয়-পরাজয় পর্যালোচনা। ঐতিহাসিকগণ এ যুদ্ধের যথেষ্ট পর্যালোচনা করেছেন যে এ যুদ্ধে জয়লাভ হয়েছে না পরাজয় হয়েছে? এ যুদ্ধে মুশরিকরা তাদের সপক্ষে ভাল কিছু করতে পেরেছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অধিকন্তু যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ মূলত তাদের হাতেই ছিল। অন্যপক্ষ নিজেদের কর্মদোষে মুসলমানদেরই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বেশি। হ্যাঁ মুমিদিনের একটি দলের মনমানসিকতা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল এবং যুদ্ধের হাল কুরাইশদের পক্ষেই ছিল। তবে এমন কতক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে যার বলে আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি না যে, মুশরিকদের বিজয় হয়েছিল। যেমন আমরা বলতে পারি, মাক্কী বাহিনী মুসলমি শিবিরের দখল নিতে পারে নি এবং ব্যাপক ও কঠিন বিপদের মুহূর্তেও মাদানী বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে মদিনায় পালিয়ে যায় নি বরং তারা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে নেতৃত্ত্বের কেন্দ্রে একত্রিত হয়। আর ততাদের হাত এমন ভেঙ্গে পড়েনি যে, মাক্বী বাহিনী তাদেরকে পশ্চাদ্ধাবন করতে পারে এবং মদিনা বাহিনীর একজন সৈন্যও মাক্বী বাহিনীর হাতে বন্দী হয় নি। কাফিররা মুসলিমদের থেকে কোন গনীমতের মালও সংগ্রহ করতে পারেনি। মুসলিম সৈন্যবাহিনী তাদের শিবিরে অবস্থান করেছে; কিন্তু মুশরিকরা তৃতীয় দফায় যুদ্ধের জন্য সেখানে অবস্থান করেনি এমনকি জয়লাভকারী বাহিনীর যে সাধারণ নীতি আছে, তারা যুদ্ধ ময়দানে এক, দু বা তিনদিন অবস্থান করবে- মাক্কী বাহিনী তাও করেনি। বরং তারা দ্রুত প্রত্যাবর্তন করে এবং মুসলমানদের পূর্বেই তারা যুদ্ধ ময়দান পরিত্যাগ করে। পরে মুশরিক বাহিনী যথাসাধ্য চেষ্টা করেও নারী ও ধনসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য মদিনাদে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি। অথচ স্পষ্ট বিজয়ের এটা অন্যতম লক্ষণ।

সবকিছু পর্যালোচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, মক্কার কুরাইশদের পক্ষে বিজয় লাভ না হলেো এটা সম্ভব হয়েছিল যে, যুদ্ধের পট পরিবর্তনের পর মুসলিমদের সীমাহীন ও যথেষ্ট ক্ষতি সাধনের পরও রেহাই পেয়ে যায়। তবে এটাকে মুশরিকদের বিজয় কক্ষনোই বলা যায় না। বরং আবূ সুফইয়ানের দ্রুত পলায়ন করা ও প্রত্যাবর্তন করা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, তৃতীয় দফায় যুদ্ধ করলে তার বাহিনীর নিদারুন ক্ষতি হওয়ার ব্যাপারে সে খুবই ভীত ছিল। আর বিশেষ করে গাযওয়ায়ে হামরাউল আসাদ আবূ সুফইয়ানের স্বীয় অবস্থান হতে আরো ভালোভাবে বোঝা যায়।

এরূপ অবস্থায় আমরা এ যুদ্ধকে এক দলের বিজয় ও অন্য দলের পরাজয় না বলে অমীমাংসিত যুদ্ধ বলতে পারি, যাতে উভয় দল নিজ নিজ সফলতা ও ক্ষয়-ক্ষতির অংশ লাভ করেছে। অতঃপর যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন এবং নিজেদের শিবিরকে শত্রুদের অধিকারে ছেড়ে দেয়া ছাড়াই যুদ্ধ করা হতে বিরত হয়েছে। আর অমীমাংসিত যুদ্ধ তো এটাকেই বলা হয়। এদিকে আল্লাহ তা‘আলা ইঙ্গিত করে বলেছেন :‏(‏وَلاَ تَهِنُوْا فِيْ ابْتِغَاء الْقَوْمِ إِن تَكُوْنُوْا تَأْلَمُوْنَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُوْنَ كَمَا تَأْلَمونَ وَتَرْجُوْنَ مِنَ اللهِ مَا لاَ يَرْجُوْنَ‏)‏ ‏[‏النساء‏:‏ 104‏]

এ (শত্রু) কওমের পশ্চাদ্ধাবনে দুর্বলতা দেখাবে না, কেননা যদি তোমরা কষ্ট পাও, তবে তোমাদের মত তারাও তো কষ্ট পায়, আর তোমরা আল্লাহ হতে এমন কিছু আশা কর, যা তারা আশা করে না। [আন-নিসা (৪) : ১০৪]

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষতি সাধনে ও ক্ষতি অনুভব করণে এক সেনা বাহিনীকে অন্য সেনা বাহিনীর সাথে উপমা দিয়েছেন। যার মর্মার্থ হল, দু্ই পক্ষেরই অবস্থান সমপর্যায়ের ছিল। উভয় পক্ষই এমন অবস্থায় ফিরে এসেছে যে, কেউ কারোরই উপর জয়ী হতে পারে নি।

 এ যুদ্ধের উপর কুরআনের ব্যাখ্যা (الْقُرْآنُ يَتَحَدَّثُ حَوْلَ مَوْضُوْعِ الْمَعْرِكَةِ):

পরবর্তীতে কুরআন নাযিল হলে তাতে এ যুদ্ধের এক একটি মনযিলের উপর আলোকপাত করা হয়েছে এবং বিশদ ব্যাখ্যা করে ঐ কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলোর ফলে মুসলিমগণকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আর এ ধরণের ফায়সালাকৃত সময়ে ঈমানদার এবং এ উম্মতকে (যারা অন্যান্য উম্মতের মোকাবেলায় শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয়েছে) যে সব উঁচু ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য লাভের জন্যে অস্তিত্বে আনা হয়েছে, ওগুলোর দিক দিয়ে এখনও তাদের বিভিন্ন দলের মধ্যে কী কী দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো বলে দেয়া হয়েছে।

অনুরূপভাবে কুরআন মাজীদে মুনাফিক্বদের বর্ণনা দিয়ে তাদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। তাদের অন্তরে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে যে শত্রুতা লুক্কায়িত ছিল তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সরলমনা মুসলিমগণের অন্তরে এ মুনাফিক্বরা এবং তাদের ভাই ইহুদীরা যে কুমন্ত্রণা ছড়িয়ে রেখেছিল তা দূরীভূত করা হয়েছে। এ প্রশংসনীয় হিকমত এবং উদ্দেশ্যের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যা এ যুদ্ধের ফল ছিল।

এ যু্দ্ধ সম্পর্কে সূরাহ আল-ইমরানের ষাটটি আয়াত নাযিল হয়েছে। সর্ব প্রথম যুদ্ধের প্রাথমিক মনযিলের উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে,

‏(‏وَإِذْ غَدَوْتَ مِنْ أَهْلِكَ تُبَوِّىءُ الْمُؤْمِنِيْنَ مَقَاعِدَ لِلْقِتَالِ‏)‏ ‏[‏ آل عمران‏:‏ 121 ‏]‏

(স্মরণ কর) যখন তুমি সকাল বেলায় তোমার পরিজন হতে বের হয়ে মু’মিনদেরকে যুদ্ধের জন্য জায়গায় জায়গায় মোতায়েন করছিলে। [আলু ‘ইমরান (৩) : ১২১]

তারপর শেষে এ যুদ্ধের ফলাফল ও রহস্যের উপর ব্যাপক আলোকপাত করে ইরশাদ হয়েছে,

‏(‏مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلٰى مَآ أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتّٰى يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَمَا كَانَ اللهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلٰى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللهَ يَجْتَبِيْ مِن رُّسُلِهِ مَن يَشَاء فَآمِنُوْا بِاللهِ وَرُسُلِهِ وَإِن تُؤْمِنُوْا وَتَتَّقُوْا فَلَكُمْ أَجْرٌ عَظِيْمٌ‏)‏ ‏

অসৎকে সৎ থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় আছ, আল্লাহ মু’মিনদেরকে সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না এবং আল্লাহ তোমাদেরকে গায়িবের বিধান জ্ঞাত করেন না, তবে আল্লাহ তাঁর রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছে বেছে নেন, কাজেই তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলগণের প্রতি ঈমান আন। যদি তোমরা ঈমান আন আর তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্য আছে মহাপুরস্কার।’ [আলু ‘ইমরান (৩) : ১৭৯]

 এ যুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলার সক্রিয় উদ্দেশ্য ও রহস্য (الْحُكْمُ وَالْغَايَاتُ الْمَحْمُوْدَةُ فِيْ هٰذِهِ الْغَزْوَةِ):

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন।[1] হাফেয ইবনু হাজার (রঃ) বলেছেন যে, ওলামারা (ইসলামী পন্ডিতগণ) বলেছেন যে, গাযওয়ায়ে উহুদ ও তার মধ্যে মুসলিমগণের পরাজয়ে মহান আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ও উপকার নিহিত ছিল। যেমন অবাধ্যতার প্রায়শ্চিত্ত ও বাধা না মানার দুর্বিপাক সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সতর্ক করা, কারণ তীরন্দাযগণকে নিজ স্থানে জয় ও পরাজয় উভয় অবস্থাতেই স্থির থাকার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা তার বিরুদ্ধাচরণ করে কেন্দ্র পরিত্যাগ করেছিল যার পরিণতি হিসেবে এ পরাজয়। একটি উদ্দেশ্য রাসূলগণের সুন্নাতের প্রকাশ করা, তাঁদেরকে প্রথমে বিপদে ফেলে শেষে বিজয়ী করা হয়। আর তাতে এ রহস্যও লুক্কায়িত আছে যে, যদি তাঁদেরকে বরাবর বিজয়ী করা হয়, তাহলে মুসলিম সমাজে এমন সব লোকের অনুপ্রবেশ ঘটবে যারা মু’মিন নয়। তখন সৎ ও অসৎ এর মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব হবে না। আর যদি বরাবর পরাজয়ের পর পরাজয়ের সম্মুখীন হতো তাহলে নাবী প্রেরণের উদ্দেশ্যই সফল হবে না। কাজেই আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য জয় পরাজয় দুটিরই প্রয়োজন আছে যাতে সৎ ও অসৎ এর মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। কারণ মুনাফিক্বদের কপটতা মুসলিমগণের নিকট গোপন ছিল। যখন এ ঘটনা সংঘটিত হল তখন মুনাফিক্বগণ কথা ও কর্মে প্রকাশ করে দিল। আর মুসলিমগণ জানতে পারল যে, তাঁদের মধ্যেই নিজেদের শত্রু বর্তমান। কাজেই মুসলিমগণ তাদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত ও সতর্ক হলেন।

একটা উদ্দেশ্য বা রহস্য এটাও ছিল যে, কোন কোন ক্ষেত্রে সাহায্য আসতে বিলম্ব ঘটলে নম্রতার সৃষ্টি হয় ও আত্ম-অহংকার নিঃশেষ হয়ে যায়। কাজেই পরীক্ষায় পড়ে যখন মুসলিমগণ বিপন্ন হয়ে পড়লেন তখন তাঁরা ধৈর্য্য অবলম্বন করলেন আর মুনাফিক্বগণ হা-হুতাশ আরম্ভ করে দিল।

একটা উদ্দেশ্য এটাও ছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বাসীগণের জন্য পুরস্কারের ক্ষেত্রে এমন অনেক মর্যাদা (জান্নাত) তৈরি করেছেন, যেখানে তাঁদের আমল দ্বারা পৌঁছা সম্ভব নয়। কাজেই বিপদ ও পরীক্ষার মধ্যে এমন অনেক উপায় নিহিত রেখেছেন যদ্দ্বারা তাঁরা সেই সব মর্যাদায় পৌঁছতে পারেন।

আর একটা হিকমত বা রহস্য ছিল, শাহাদত লাভ আওলিয়া কিরামের সর্বাপেক্ষা বড় পদমর্যাদা। কাজেই এ পদমর্যাআ তাঁদের জন্য সরবরাহ করে দেয়া হয়েছিল।

আরও একটি রহস্য নিহিত ছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা নিজ শত্রুদেরকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কাজেই তাদের ধ্বংসের ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ কুফরী, অত্যাচার ও আল্লাহর ওলীগণকে কষ্ট দেওয়াতে সীমাতিরিক্ত অবাধ্যতা (করার পরিণতিতে) ঈমানদারগণকে গোনাহ হতে পাক ও পরিচ্ছন্ন করলেন ও বিধর্মী কাফিরগণকে ধ্বংস ও নিঃশেষ করলেন।[2]

[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ৯১-১০৮ পৃঃ।

[2] ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৪৭ পৃঃ।

সকল অধ্যায়

১. ৮. দ্বিতীয় ধাপ : প্রকাশ্য প্রচার
২. ৬. পয়গম্বরীত্বের প্রচ্ছায়ায়
৩. ৫. নুবুওয়াতী জীবন, রিসালাত ও দা‘ওয়াত
৪. ৪. সৌভাগ্যময় জন্ম এবং পবিত্র জীবনের চল্লিশ বছর
৫. ৩. পয়গম্বরী বংশাবলী, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সৌভাগ্যময় আবির্ভাব ও তাঁর পবিত্রতম জীবনের চল্লিশটা বৎসর
৬. ১. তৎকালীন আরবের ভৌগলিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা
৭. ২. জাহেলিয়াত সমাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
৮. ৭. প্রথম ধাপ : ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ
৯. ৯. বড় বড় সাহাবাদের ইসলাম গ্রহণ
১০. ১০. পূর্ণাঙ্গ বয়কট
১১. ১১. আবূ ত্বালিব সমীপে শেষ কুরাইশ প্রতিনিধি দল
১২. ১২. শোকের বছর
১৩. ১৩. প্রথম পর্যায়ের মুসলিমগণের ধৈর্য ও দৃঢ়তা এবং এর অন্তর্নিহিত কারণসমূহ
১৪. ১৪. তৃতীয় ধাপ- মক্কাভূমির বাইরে ইসলামের দাওয়াত
১৫. ১৫. ব্যক্তি এবং গোষ্ঠিকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান
১৬. ১৬. নৈশ ভ্রমণ ও উর্ধ্বগমন বা মি’রাজ
১৭. ১৭. হিজরতের সর্বপ্রথম বাহিনী
১৮. ১৮. দারুন নাদওয়াতে (সংসদ ভবনে) কুরাইশদের অধিবেশন
১৯. ১৯. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরত
২০. ২০. মদীনার জীবন দাওয়াত, জিহাদ ও পরিত্রাণের যুগ
২১. ২১. প্রথম পর্যায়
২২. ২২. ইহুদীদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন
২৩. ২৩. অস্ত্রের ঝনাঝনানি
২৪. ২৪. গাযওয়ায়ে বদরে কুবরা- ইসলামের প্রথম ফায়সালাকারী যুদ্ধ
২৫. ২৫. উহুদ যুদ্ধ
২৬. ২৬. উহুদ ও আহযাব যুদ্ধের মধ্যবর্তী সারিয়্যাহ ও অভিযানসমূহ
২৭. ২৭. গাযওয়ায়ে আহযাব (খন্দক বা পরিখার যুদ্ধ)
২৮. ২৮. বনু কুরাইযাহর যুদ্ধ
২৯. ২৯. এ (আহযাব ও কুরাইযাহ) যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনাবলী
৩০. ৩০. বনু মুসত্বালাক্ব যুদ্ধ বা গাযওয়ায়ে মুরাইসী’ (৫ম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরী)
৩১. ৩১. গাযওয়ায়ে মুরাইসী’র পরের সামরিক অভিযানসমূহ
৩২. ৩২. হুদায়বিয়াহর উমরাহ
৩৩. ৩৩. দ্বিতীয় পর্যায়
৩৪. ৩৪. হুদায়বিয়াহর পরের সৈনিক প্রস্তুতি
৩৫. ৩৫. খায়বার ও ওয়াদিল কুরা যুদ্ধ (মুহাররম, ৭ম হিজরী)
৩৬. ৩৬. ৭ম হিজরীর অবশিষ্ট সারিয়্যা ও যুদ্ধসমূহ
৩৭. ৩৭. ক্বাযা উমরাহ
৩৮. ৩৮. মুতাহ যুদ্ধ
৩৯. ৩৯. মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ
৪০. ৪০. তৃতীয় পর্যায়
৪১. ৪১. হুনাইন যুদ্ধ
৪২. ৪২. মক্কা বিজয়ের পর ছোটখাট অভিযান এবং কর্মচারীগণের যাত্রা
৪৩. ৪৩. তাবুক যুদ্ধ – নবম হিজরীর রজব মাসে
৪৪. ৪৪. দাওয়াতের সাফল্য ও প্রভাব
৪৫. ৪৫. বিদায় হজ্জ
৪৬. ৪৬. সর্বোচ্চ বন্ধুর দিকে ধাবমান
৪৭. ৪৭. নাবী (সাঃ)-এর পরিবার
৪৮. ৪৮. আচার-আচরণ ও গুণাবলী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন