প্রাচীন রচনা ও গ্রন্থকর্ত্তাগণ

উৎপত্তি বিবরণ এক প্রকার কথিত হইল, এক্ষণে প্রাচীন রচনা ও গ্রন্থকারদিগের বিষয় আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া যাইতেছে।

পূৰ্ব্বেই উক্ত হইয়াছে যে বিদ্যাপতি, রাজা শিবসিংহ নারায়ণের সমকালে আবির্ভূত হন রাজা শিবসিংহ নারায়ণ চৈতন্য দেবের প্রায় এক শত বৎসর পূর্ব্বে বাঙ্গালার অন্তঃপাতি পঞ্চগৌড় নামক স্থানে রাজত্ব করিয়া গিয়াছেন। এই স্থানটা কোথায়, তাহা জ্ঞাত হইবার উপায় নাই, কিন্তু ইহা যে বঙ্গদেশের অন্তর্গত তদ্বিষয়ে সন্দেহের কোন কারণ দৃষ্ট হয় না। চৈতন্যদেব খৃষ্টীয় ১৪৮৪ অব্দে জন্ম গ্রহণ করেন, সুতরাং বিদ্যাপতি এক্ষণ (১৮৭০ খৃঃ অঃ) প্রায় ৪৮৬ বৎসর হইল বঙ্গদেশে (১৩৮৪ খৃঃ অঃ) বিদ্যমান ছিলেন। ইহার রচনাবলি পাঠ করিয়া জ্ঞাত হওয়া যায় যে ইনি একজন বৈষ্ণব-ধৰ্ম্মাবলম্বী। বিদ্যাপতির রচনায় রূপনারায়ণ প্রভৃতি আরও কয়েকটা ব্যক্তির নামে ভণিতা দৃষ্ট হয়। বোধ হয় তাঁহারা বঙ্গীয় আদি কবির প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন1। বিদ্যাপতির পূর্ব্ববর্ত্তী বাঙ্গালা রচয়িতা এপর্যন্ত আমাদিগের নয়নপথের পথিক হয় নাই, সুতরাং বিদ্যাপতিকেই প্রথম বাঙ্গালি রচয়িতা বলিয়া আখ্যাত করা গেল। সাধারণের গোচরার্থ বিদ্যাপতি-লিখিত কয়েকটী পদ এস্থলে উদ্ধৃত হইয়াছে :—

“এ ধনি কর অবধান। তো বিনে উনমত কান॥
কারণ বিণুক্ষণে হাস। কি কহয়ে গদ গদ ভাষ॥
আকুল অতি উতরোল। হা ধিক্ হা ধিক্ বোল॥
কাঁপয়ে দুরবল দেহ। ধরই না পারই কেহ।
বিদ্যাপতি কহ ভাখি। রূপনারায়ণ সাখি॥”

(প্রহেলিকা। )
“বিধু কোলে করি, বামন কিরয়ে,
দেখয়ে জনম আঁধে।
বোয়ায় বলিছে, বধিরে শুনিছে,
বঙ্গ্যার তনয় কান্দে॥
পাদ্য অর্ঘ্য নিয়া, পথে দাঁড়াইয়া,
আছয়ে পিতার পিতা।
ভয়ে ভঙ্গ দিয়া, গেল পলাইয়া,
শুনিঞা ভবিষ্য কথা॥
কহ্ বিদ্যাপতি, পিতা না জনমিতে,
পুত্রের প্রতাপ এত।
না জানি ইহার, পিতা জনমিলে,
প্রতাপ বাঢ়িত কত॥

বিদ্যাপতির সময়েই চণ্ডিদাসের কবিত্বশক্তি জ্যোতি বঙ্গভূমে প্রতিভাতিত হইয়াছিল। নান্নুর গ্রামে তিনি বাস করিতেন, এই গ্রাম জেলা বীরভূমি সংক্রান্ত সব ডিবিজন সাকুলীপুরের পূর্ব্বদিকে অব্যবহিত নৈকট্যে অবস্থিত। তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন2। “বড়ু” তাঁহার উপাধি ছিল।3 নান্নুর গ্রামে “বাশুলি” অর্থাৎ বিশালাক্ষী নামে এক প্রস্তরময়ী দেবীমূৰ্ত্তি অদ্যাবধি বর্ত্তমান আছেন।4 সেই দেবী চণ্ডিদাসের প্রথম ইষ্ট দেবতা ছিলেন। পরে তিনি বৈষ্ণব ধর্ম্ম অবলম্বন করিলে নান্নুর গ্রাম নিবাসিনী রানী নাম্নী এক রজককন্যা তাঁহার উপনায়িকা হয়। কথিত আছে, বিশালাক্ষী স্বয়ং তাঁহাকে কৃষ্ণোপাসনা করিতে উপদেশ প্রদান করেন, এবং তজ্জন্যই চণ্ডিদাস কৃষ্ণোপাসনা কালে যে সকল সংকীৰ্ত্তন ব্যবহার করিতেন, তন্মধ্যে বিশালাক্ষীকে উপদেশকর্ত্রী বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।5 তিনি কৃষ্ণলীলা বিণয়িণী অনেক পদাবলী ও “শ্রীরাধা গোবিন্দ কেলীবিলাস” নামধেয় একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছিলেন6। তাঁহার রচনার কয়েক পংক্তি নিম্নে প্রকটিত হইল : —

“সে যে নাগর গুণখান। জপয়ে তাঁহারি নাম॥
শুনিতে তাহার বাত। পুলকে ভায়ে গাত ॥
অবনত করি শির। লোচনে ঝরয়ে নীর॥
যদি বা পুছয়ে বাণী। উলাট করয়ে পাণি ॥
কহিয়ে তাহারি রীতে। আন না বুঝিব চিতে।
ধৈরজ নাহিক তায়। বড়ু চণ্ডিদাস গায়।”

সুবিখ্যাত উইলসন সাহেব কৃত উপাসক-সম্প্রদায় নামক ইরাজি পুস্তক ও বিদ্যাপতির কবিতা পাঠ করিয়া অবগতি হয়, যে গোবিন্দ দাস কবি, বিদ্যাপতি ও চাওদাসের সমকালবর্ত্তী লোক।7 বিশেষত গোবিন্দ দাসের রচনা মধ্যে একস্থলে লিখিত আছে-

“বিদ্যাপতি পদ যুগল সরোকহ নিসন্দিত মকরন্দে।
তছ মঝু মানস মাতল মধুকর পিবইতে কুরু অনুবন্দে॥”

এই কবিতা পাঠে স্পষ্ট জানা যাইতেছে যে, গোবিন্দ দাস, বিদ্যাপতি ও চণ্ডী বড়ুর পূর্ব্ববর্ত্তী লোক নহেন। এবং তিনি যদি পূর্ব্বোক্ত কবিদ্বয়ের অধিক পরবর্ত্তী লোক হইতেন, তাহা হইলে, বিদ্যাপতির ভণিতায় তাঁহার নাম প্রকাশিত থাকিত না। ভক্তমাল গ্রন্থে ইহাকে গোবিন্দ কবিরাজ বলিয়া লিখিত আছে। ঐ পুস্তক পাঠে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, গোবিন্দদাস কবিরাজ বুধুরী গ্রাম নিবাসী রামচন্দ্র কবিরাজের ভ্রাতা এবং শ্রীনিবাস আচার্য্যের শিষ্য ছিলেন। ইঁহার প্রণীত কবিতা সকলও নিতান্ত কবিত্বশূন্য ছিল না। নিম্নে কয়েক পংক্তি প্রদত্ত হইল :—

“জন্তু বাঙন করে ধরব সুধাকর পঙ্গুচঢ়ব গিরি শিখরে।
অন্ধধাই কিয়ে দশ দিশে খোজব মিলব কলপতরু নিকরে।
শোনহ অদ্ধ করত অনুবন্ধহু ভকত নখর মণি ইন্দু।
কিরণ ঘটায় উদিত ভেল দশ দিশ হাম কি নাপায়ব বিন্দু।
সোই বিন্দু হাম যৈখানে পায়ব তৈখানে উদিত নয়ান।
গোবিন্দ দংস অতয়ে অবধারল ভকত কৃপা বলবান ॥”

কবিবর গোবিন্দ দাসের পরে, বোধ হয়, ১৫২৯ খৃ; অব্দে প্রবল প্রতাপান্বিত মোগলরাজ্য সংস্থাপনকর্তা বাবর শাহের সময়ে জীব গোস্বামী নামা এক ব্যক্তি “করচাই” গ্রন্থ গ্রন্থন করেন। এই পুস্তকের বয়স প্রায় ৩৪০ বৎসর। অনেকে কহিতেন “ত্রিপুরার রাজাবলি” নামক গ্রন্থ অতিপ্রাচীন, কিন্তু সেই পুস্তক “এসিয়াটিক সোসাইটী” নাম্নী সভার দ্বারা পরীক্ষিত হওয়াতে সে ভ্রম দূর হইয়াছে। জীব গোস্বামীর পর, নরহরিদাস, বৃন্দাবন দাস, শেখর রার, সনাতন, বৈষ্ণব দাস প্রভৃতি অনেকগুলি ব্যক্তির প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। তাঁহারা প্রায় সকলেই চৈতন্যোপাসক ছিলেন। উক্ত ধৰ্ম্ম-সম্বন্ধীয় অনেক সংকীৰ্ত্তনাদি রচনা করত আপন আপন কীৰ্ত্তি সংস্থাপিত করিয়াছেন। তাঁহারা সকলেই চৈতন্যের পরবর্ত্তী লোক। এই সকল মহোদয়দিগের মধ্যে বৃন্দাবন দাস কত চৈতন্যভাগবত নামক একখানি গ্রন্থ আমাদিগের নয়ন-মুকুরে প্রতিবিম্বিত হয়।

সাধারণের দর্শনার্থ এ স্থলে সেই পুস্তকের কয়েক পংক্তি উদ্ধত হইল। :—

“অতএব অদ্বৈত বৈষ্ণব অগ্ৰগণা।
নিবিল ব্রহ্মাণ্ডে যার ভক্তিযোগ ধর্ম্ম॥
এইমত অদ্বৈত বৈসেন নদিয়ায়।
ভক্তি যোগশূন্য লোক দেখি দুঃখ পায়॥
সকল সংসার মত্ত ব্যবহার বশে।
কৃষ্ণ পূজা কৃষ্ণ ভক্তি কারো নাই বাসে॥
বাশুলি পূজয়ে কেহ নানা উপহারে।
মদ্য মাংস দিঞা কেহ যক্ষ পূজা করে॥
পুনরপি নৃত্য গীত বাদ্য কোলাহল।
না শুনে কৃষ্ণের নাম পরম মঙ্গল॥
কৃষ্ণ শূন্য মঙ্গলে নাহি আর সুখ।
বিশেষ অদ্বৈত বড় পান মহা দুখ॥
স্বভাবে অদ্বৈত বড় সারল্য হৃদয়।
জীবের উদ্ধার চিন্তেন হইয়া সদর॥”

এ স্থলে একটা কথা নিতান্ত অপ্রামাণিক নহে যে, চৈতন্যাবতারের অবতরণের পরেই, চৈতন্য ধৰ্ম্মাবলম্বী ব্যক্তিগণ দ্বারা বঙ্গভাষার বিশেষ উন্নতি হইয়াছে। কারণ চৈতন্যপদ, চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যমঙ্গল, ভক্তমাল, চৈতন্য-চরিতামৃত প্রভৃতি যে সকল প্রাচীন গ্রন্থ আমাদিগের নয়ন-মুকুরে প্রতিবিম্বিত হইতেছে, তাহার অধিকাংশই উক্ত সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিগণ দ্বারা রচিত বলিয়া স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যাহা হউক, বৃন্দাবন দাসাদির পর ১৫৬৪ খৃঃ অব্দে প্রজাসুখ সম্বৰ্দ্ধক সম্রাট আকবরের সময়ে কৃষ্ণদাস কবিরাজ নামক এক ব্যক্তি বর্তমান ছিলেন। তিনি “চৈতন্যচরিতামৃত” নামক গ্রন্থের রচয়িতা। এই গ্রন্থে ৬৮ খানি সংস্কৃত গ্রন্থোদ্ধৃত শ্লোকাবলি ও অন্যান্য উপপুরাণ সমূহের অনেক বচন ও কবিতাদি দেখা যায়। এই পুস্তকে চৈতন্য দেবের আদি, মধ্য, ও অন্তলীলা সুবিস্তৃতরূপে বর্ণিত হইয়াছে। গ্রন্থকার নিজেই স্বীকার করিয়াছেন যে, তিনি গৌরাঙ্গ-সহচর রঘুনাথ দাসের শিষ্য ছিলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ-রচিত আর একখানি গ্রন্থ এখনও বৰ্ত্তমান আছে। তাহার নাম “ভক্তমাল”। ভক্তমালে প্রায় ৪১ খানি সংস্কৃত গ্রন্থের শ্লোক দৃষ্ট হয়; এতদ্ভিন্ন অনেকানেক পুরাণাদিরও নামোল্লেখ আছে।

এই গ্রন্থে নাভাজীর নামক পুস্তকের আভাস লইয়া, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি, যুগচতুষ্টয়ে প্রাদুর্ভূত বিষ্ণুভক্তদিগের জীবন-চরিত পরিকীৰ্ত্তিত হইয়াছে। ভক্তমাল কৃষ্ণদাসের বৃদ্ধাবস্থার রচনা। নিম্নে চৈতন্য-চরিতামৃতের একটী অংশ উদ্ধৃত হইল। এই রচনায় পূর্ব্ববর্ত্তী রচনাবলি অপেক্ষা অল্প হিন্দী শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।

“আদিলীলা মধ্যলীলা অন্তলীলা সার।
এবে মধ্যলীলা কিছু করিয়ে বিস্তার॥
অষ্টাদশ বর্ষ কেবল নীলাচলে স্থিতি।
আপনি আচরি জীবে শিক্ষাইল ভক্তি॥
তার মধ্যে ছয় বৎসর ভক্তগণ সঙ্গে।
প্রেম ভক্তি প্ৰবৰ্ত্তাইল নৃত্যগ’ত রঙ্গে॥
নিত্যানন্দ গোসাঞিরে পাঠাইল গৌড়দেশে।
তিহোঁ গৌড়দেশে ভাসাইল প্রেমরসে॥
সহজেই নিত্যানন্দ কৃষ্ণ প্রেমোদ্দাম।
প্রভু আড্ডায় কৈল যাঁহা তাঁহা প্রেমদান॥
তাঁহার চরণে মোর কোটি নমস্কার।
চৈতন্যের প্রিয় যিহোঁ লওয়াইল সংসার॥
চৈতন্য গোসাঞি যারে বলে বড় ভাই।
তিহোঁ কহে মোর প্রভু চৈতন্য গোসাঞি॥”

চৈতন্য-চরিতামৃত রচনার পর কৃত্তিবাসের রামায়ণ প্রচারিত হয়। প্রকৃত গুণ ধরিয়া বিবেচনা করিলে কৃত্তিবাস বঙ্গদেশের প্রথম কবি। তাঁহার পূর্ব্ববর্ত্তী কবিগণ নানা ভাব-পরিপূরিত সুদীর্ঘ গ্রন্থ প্রায় কেহই রচনা করিয়া যান নাই। রামায়ণ পাঠে অবগতি হয় যে, কৃত্তিবাস নদীয়া জেলার অন্তঃপাতি শান্তিপুরের সন্নিকটে ফুলিয়া গ্রামে বাস করিতেন।8  তাঁহার ব্রাহ্মণ কুলে জন্ম।
9 তিনি কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ডের এক স্থলে “কৃত্তিবাস পণ্ডিত মুরারি ওঝার নাতি” বলিয়া আত্ম পরিচয় দিয়াছেন। কৃত্তিবাস কোন্ সময়ে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাহা জ্ঞাত হইবার উপায় নাই। কিন্তু কৃষ্ণদাস কবিরাজ-রচিত চৈতন্য- চরিতামৃতের পরবর্ত্তী লোক ছিলেন, তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেকে অনুমান করেন, প্রায় ৩০০ শত বৎসর হইল, তিনি এ দেশে বিদ্যমান ছিলেন।10 এটি সত্য হইলে অনায়াসেই বলা যাইতে পারে যে কৃত্তিবাস, সম্রাট আকবরের সময়ে বর্ত্তমান ছিলেন। কৃত্তিবাসের রামায়ণ এক্ষণে অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য হইয়াছে। উহা ১৮০২ খৃঃ অব্দে মিশনরিদিগের দ্বারা শ্রীরামপুরে প্রথম মুদ্রিত হইয়াছিল। বৰ্ত্তমান সময়ে কলিকাতা বটতলায় যন্ত্রিত যে রামায়ণ কৃত্তিবাসের বলিইয়া বিক্রীত হয়, উহা জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয় দ্বারা সংশোধিত ও পরিবর্তিত হইয়াছে। কৃত্তিবাসের অব্যবহিত পরে বা তৎ সমকালেই কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্ত্তীর কবিত্ব যশোপ্রভা প্রকাশিত হয়। তিনি বাদশাহ জাঁহাগীরের সময়ে বর্ত্তমান ছিলেন। বর্দ্ধমানের অন্তর্বর্ত্তী দামুন্যা-গ্রামে তাঁহার ঊর্দ্ধতন সপ্ত পুরুষের বাসস্থান ছিল।11 মুকুন্দরামের পিতার নাম হৃদয় মিশ্র, ও পিতামহের নাম জগন্নাথ মিশ্র। এ স্থলে অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, চক্রবর্ত্তী কবির পিতৃ-পিতামহাদির মিশ্র উপাধি হইবার কারণ কি? কিন্তু চিন্তা করিয়া দেখিলে জানিতে পারিবেন যে, কবিবরের মিশ্রই প্রকৃত উপাধি ও চক্রবর্ত্তী ডাক উপাধি মাত্র। তাঁহার গ্রন্থোৎপত্তি বিবরণ পাঠে অবগতি হয় যে, কবিবর জীবদ্দশায় অনেক কষ্ট সহ্য করিয়াছিলেন। কথিত আছে, শঙ্করমোহিনী চণ্ডী স্বপ্নযোগে তাঁহাকে পদ্য রচনার্থ আদেশ করেন, কিন্তু সে বিষয় কত দূর সত্য, তাহা আমরা অবগত নহি। যাহা হউক,তিনি নানা স্থান পর্য্যটন ও দুঃখ-বাত্যা সহ্য করত পরিশেষে বাঁকুড়ার পূর্ব্বাধিকারী আড়রা নামক স্থানের রাজা রঘুনাথ রায়ের নিকট আপনার দুঃখ ও স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণনামন্তর নিজ রচিত কবিতা পাঠ করেন। রাজা রচনা শ্রবণে পরিতুষ্ট হইয়া রচয়িতার ভরণপোষণ জন্য দশ আড়া ধান্য প্রদান করিয়াছিলেন। এবং নিজ পুত্রের শিক্ষাগুরু-পদে অভিষিক্ত করেন। এইরূপে কবিবর দুরবস্থা হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি রাজার আজ্ঞায় উৎসাহিত হইয়া “চণ্ডী” কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। এই গ্রন্থ প্রায় ২৬০ বা ২৭০ বৎসর হইল রচিত হইয়াছে। ইহাতে রামায়ণ অপেক্ষা অধিক কবিত্ব শক্তি দৃষ্ট হয়। মুকুন্দরাম নিজে দরিদ্র ছিলেন, সুতরাং তাঁহার রচনা মধ্যে দু:খীগণের ক্লেশ বর্ণনায় অধিক ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে। স্বভাব বর্ণনায়ও তিনি কৃত্তিবাস অপেক্ষা নিকৃষ্ট ছিলেন না। বঙ্গীয় কবিগণের জীবনী লেখক মহোদয়গণ ইহাকে প্রথম প্রহেলিকা রচয়িতা বলিয়া নির্দেশ করিইয়াছেন। কিন্তু আদি কবি বিদ্যাপতির রচনাতেও প্রহেলিকা দেখা যায়, অতএব আমরা চক্রবর্ত্তী কবিকে উপরোক্ত প্রশংসা প্রদান করিতে কুণ্ঠিত হই।

চণ্ডীর পর “কালিকামঙ্গল” নামক গ্রন্থ রচিত হয়। প্রাণরাম চক্রবর্ত্তী ইহার প্রণেতা। এ ব্যক্তি কে? কোথায় জন্ম? তাহা অবগত হইবার কিছু মাত্র উপায় নাই। কালিকামঙ্গলে বিদ্যাসুন্দরের উপাখ্যান বর্ণিত হইয়াছে। বিদ্যাসুন্দর গ্রন্থ কোন বঙ্গীর কবির মনঃকল্পিত নহে। রাজা বিক্রমাদিত্যের একজন সভাসদ্ বররুচি-বিরচিত সংস্কৃত গ্রন্থের ভাব গ্রহণ করিয়া প্রাণরাম চক্রবর্ত্তী প্রথমতঃ উহা রচনা করেন। তৎপরে পুনরায় প্রথমোক্ত গ্রন্থ হইতে বিখ্যাত রামপ্রসাদ সেন বিদ্যাসুন্দর লিখেন। মূলের সহিত এই দুই গ্রন্থের অনেক সাদৃশ্য আছে। পরিশেষে উক্ত প্রসাদী বিষয় অবলম্বন করিয়া বঙ্গকবিকুল-শেখর ভারতচন্দ্র রায় বর্তমান প্রচলিত বিদ্যাসুন্দর রচনা করেন। কিন্তু তিনি মূলের প্রতি বড় দৃষ্টি রাখেন নাই। তিনি যে ধূয়া প্রণালী অবলম্বন করিয়া কাব্য প্রণয়ন করিয়া গিয়াছেন, উহা প্রথমতঃ প্রাণরাম চক্রবর্ত্তী কর্তৃক উদ্ভাবিত হইয়াছে। কালিকামঙ্গলের পর কাশীরামদাসের মহাভারত প্রচারিত হয়। এই গ্রন্থ প্রায় দুইশত বৎসর হইল রচিত হইয়াছে। গ্রন্থকর্তা ৰঙ্গভূমে কাশীদাস নামে বিখ্যাত, কিন্তু ভণিতা দ্বারা জ্ঞাত হওয়া যায় যে, তাঁহার প্রকৃত উপাধি দেব। এই বাক্যের সত্যতা প্রমাণার্থ মহাভারত হইতে দুইটা পংক্তি উদ্ধৃত হইল। যথাঃ—

“চন্দ্রচূড়পদদ্বয় করিয়া ভাবনা,
কাশীরাম দেবে করে পয়ার রচনা।”

যদি তাঁহার “দেব” উপাধি না হইত, তাহা হইলে কখনই নামের পরে ঐ পদবীটা সংলগ্ন করিতে পারিতেন না। তাঁহার রচনাপাঠে অবগতি হইতেছে যে, তিনি ইন্দ্রাণীনাম্নী স্থানের অন্তর্বর্ত্তী সিদ্ধগ্রামে বসতি করিতেন। ইন্দ্রাণী হুগলী জেলার মধ্যস্থিত। তাঁহার পিতার নাম কমলাকান্ত দেব ও সিতামহের নাম সুধাকর দেব। কাশীরাম দেব একজন পরম কৃষ্ণভক্ত ছিলেন এবং অনেকে অনুমান করেন যে, কৃষ্ণ প্রীত্যর্থই মহাভারত রচিত হইয়াছিল। গ্রন্থকৰ্ত্তা নিজ কবিত্বশক্তি প্রকাশ বা যশোকীৰ্ত্তি স্থাপনার্থ ইহার প্রণয়নে রত হন নাই। বস্তুতঃ মহাভারতের রচয়িতা কৃত্তিবাসের ন্যায় ‘আমি পণ্ডিত’ ‘আমি কবি’ ইত্যাদি গর্ব্বব্যঞ্জক শব্দ কলাপ লিখিয়া ভদ্ৰজনোচিত কার্য্যের বৈপরীত্য দর্শান নাই। তাঁহার রচিত ভারতের প্রত্যেক স্থানে নম্রতাব্যঞ্জক বর্ণসমূহ লক্ষিত হয়। দেব কবির ছন্দ প্রণালী পূৰ্ব্ববর্ত্তী কবিগণ অপেক্ষা বিশুদ্ধ। কিন্তু কবিত্বগুণে মুকুন্দরাম চক্রবর্ত্তী তাঁহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ছিলেন। একটী জন-প্রবাদ যে, কাশীরাম দেব ভারত লিখিতে আরম্ভ করিয়া বিরাটপর্ব শেষ করিতে না করিতেই জীবলীলা সম্বরণ করেন। মৃত্যুকালে আরদ্ধ ভারতের অবশিষ্টাংশ রচনার ভার নিজ জামাতার প্রতি অর্পণ করিয়া যান। কতকগুলি লোক এই বিবরণের প্রতিবাদী। কিন্তু উভয় দলই নিজ নিজ পক্ষসমর্থন জন্য অনেক প্রমাণ দিয়া থাকেন। দুঃখের বিষয় যে,তাঁহাদিগের কোন্ সম্প্রদায়ের কথা সত্য, তাহা জানিবার উপায় নাই। যে মহাত্মার লেখনী সহস্রাধিক পত্রাঙ্কবিশিষ্ট এক মহা কাব্য রচনা করিয়া বঙ্গ-সাহিত্য সমাজের এত শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিয়াছেন; যে মহাজন সংস্কৃতানভিজ্ঞ ভারতামৃতপিপাসী বাঙ্গালিগণের ঔৎসুক্য-পিপাসা দূর করিয়াছেন; যে পণ্ডিতবরের কাব্য অবলম্বন করিয়া সহস্র সহস্ৰ গায়ক ও মুদ্রাঙ্কণকারীগণ বহুল ধন অর্জ্জন করিয়া নিজ নিজ পরিবারের ভরণপোষণ করিতেছে, পরিতাপের বিষয়! সেই মহদ্ব্যক্তির প্রকৃত জীবনী আমাদিগের অবগত হইবার উপায় নাই। কাশীদাসী মহাভারত এক্ষণে দুষ্পাপ্য নহে, সুতরাং তাহা হইতে এস্থলে কোন বিষয় গৃহীত হইল না, কিন্তু তাহাতেও রামায়ণের ন্যায় অনেক স্থান পরিবর্তিত ও সংযোজিত হইয়াছে।

তাহার পর কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের প্রাদুর্ভাব হয়। রামপ্রসাদ সেন কবিরঞ্জন বিদ্যাসুন্দর ও কালীসংকীর্ত্তনের নিমিত্ত বঙ্গভূমে অক্ষয় কীৰ্ত্তি লাভ করিয়া যান। তিনি আনুমানিক ১৬৪৪ বা ১৬৪৫ শকে (১৭২২ বা ১৭২৩ খৃঃ অঃ) রামরাম সেনের ঔরসে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার নিজের বর্ণনায় অবগতি হয় যে, তিনি একজন অতি সম্ভ্রান্ত প্রাচীন বংশজাত। কালক্রমে ঐ বংশের ঐশ্বর্য্য বিলুপ্ত হইয়া যায়, তথাপি রামপ্রসাদের পিতা নিতান্ত নিঃস্ব ছিলেন না। তিনি তাঁহার সন্তানদিগকে বিদ্যালোকে আলোকিত করিতে অকাতরে অর্থ ব্যয় করিয়াছিলেন, কারণ অনুমিত হইয়াছে, রামপ্রসাদ সেন সংস্কৃত, বাঙ্গালা, ও হিন্দী অতি উত্তমরূপ জানিতেন, এবং তদীয় ভ্রাতৃবর্গও নিতান্ত অজ্ঞ ছিলেন না। যাহা হউক, রামপ্রসাদের প্রথমাবস্থা অত্যন্ত হীন ছিল। তিনি নিজ মাতৃভূমি হালিসহরের অন্তবর্ত্তী কুমারহট্ট গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতার কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সন্নিধানে মুহুরীর পদে নিযুক্ত হন। কিছু দিন পরে তৎ প্রভু তাঁহার রচনা ও বিষয়বিরাগতা দর্শনে প্রীত হইয়া তাঁহাকে নিশ্চিন্ত মনে ইষ্টদেবতার ধ্যান ও কবিত্ব যশঃপ্রভা বিকীর্ণ করিবার জন্য মাসিক ত্রিংশৎ মুদ্রা বৃত্তি নিৰ্দ্ধারিত করিয়া দেন। কবিবরও প্রভুর এইরূপ অমায়িকভাবে অনুগৃহীত হইয়া নিজ জন্মস্থান কুমারহট্টে প্রস্থান করিলেন। তথায় বৈষয়িক ব্যাপার হইতে বিরত হইয়া সংকীর্ত্তনাদি রচনায় নিযুক্ত থাকিতেন।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই সময়ে বর্ত্তমান ছিলেন। তাঁহার বায়ু সেবনার্থ কখন কখন কুমারহট্টে শুভাগমন হইত। এক দিবস তিনি গুণবন্ত রামপ্রসাদ সেনের বিষয় অবগত হইয়া তাঁহাকে নিজ সন্নিধানে আহ্বান করেন। রামপ্রসাদ কাব্যপ্রিয় নরপতিকে স্বরচিত কবিতা পাঠ ও সুমধুর সংগীত দ্বারা পরিতুষ্টকরত “কবিরঞ্জন” উপাধির সহিত উপযুক্তরূপ পুরস্কৃত হন। রামপ্রসাদও কৃতজ্ঞতার চিহ্ণস্বরূপ বিদ্যাসুন্দরের উপাখ্যান গ্রহণ করিয়া “কবিরঞ্জন” নামধেয় একখানি অভিনব কাব্য তাঁহাকে উপহার দিয়াছিলেন।

যাহা হউক, জীবনের শেষাংশ তিনি অতি সুখে অতিবাহিত করিয়া ১৬৮০ বা ১৬৮৪ শকে (১৭৫৮ বা ১৭৬২ খৃঃ অঃ) ভবলীলা সম্বরণ করেন। তিনি কৌলিক ধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন, তজ্জন্য কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ সুরাপান করাও অভ্যাস ছিল। ভবমণ্ডলের কি বিচিত্র গতি! এমন কোন জাতি দৃষ্ট হয় না, যাহাদিগের কবিগণ (দুই এক জন ভিন্ন) দরিদ্র নহেন। ইতিবৃত্ত পাঠে অবগতি হয়, কবি-গুরু বাল্মীকির অবস্থা অত্যন্ত হীন ছিল; পারসিকদিগের মহাকবি হাফেজও লক্ষ্মীর প্রিয়পুত্র ছিলেন না; ইউরোপীয় মহাকবিকুল-নায়ক সেক্সপিয়র, বায়রণ প্রভৃতিরও অবস্থা প্রথমে উন্নত ছিল না, কিন্তু কি আশ্চর্য্যের বিষয়! তাঁহারা বিলাসপ্রিয় ব্যক্তিগণ কর্ত্তৃক অপদস্থ ও ঘৃণিত হইয়াও,—প্রথমে সাধারণের নিকট অজ্ঞাত থাকিয়াও নিজ নিজ স্বাধীন লেখনীর প্রভাবে পরে যে অক্ষয় খ্যাতি লাভ করিয়া গিয়াছেন, সহস্র সহস্র অর্থ ও লোকবল সহায়সম্ভূত বিলাস দ্রব্য দ্বারা নশ্বর ইন্দ্রিয় সকল চরিতার্থ করিয়াও ধনিগণ সেই অবিনশ্বর খ্যাতির শতাংশের একাংশেরও অধিকারী হইবার উপযুক্ত নহেন। কবিরঞ্জনের সমকালে আজু গোসাঞী নামক এক ব্যক্তি বর্ত্তমান ছিলেন। তাঁহার জীবনী অত্যন্ত অপরিজ্ঞেয়। অনেকে অনুমান দ্বারা স্থির করিয়াছেন যে, কুমারহট্টের নিকটেই তাঁহার বাসস্থান ছিল। যখন কাব্যপ্রিয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্ৰ ঐ স্থানে বায়ু সেবনার্থ গমন করিতেন, কথিত হইয়াছে, কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন তখন রাজ সমীপে থাকিতেন। এই সময়ে আজু গোসাঞী ও রামপ্রসাদের কবিতা দ্বারা উত্তর প্রত্যুত্তর হইত। রামপ্রসাদ যে কোন বিষয় রচনা করিতেন, আজু গোসাঞী দ্বারা তৎক্ষণাৎ একটী তাহার উত্তর প্রস্তুত হইত। তাঁহার দ্রুত রচনার বিশেষ ক্ষমতা ছিল, পরিতাপের বিষয় এই যে, তৎপ্রণীত কোন কাব্য-কুসুম আমাদিগের নয়নগোচর হয় না। এ স্থলে তাঁহার রচনা-শক্তির কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া যাইতেছে। একদা কবিরঞ্জন দ্বারা এইরূপ গীত হইয়াছিল। যথাঃ—

“শ্যামা মা ভাব-সাগরে ডোবনারে মন।
কেন আর বেড়াও ভেসে——”

আজু গোসাঞী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়াছিলেন। যথাঃ—

“একে তোমার কোফো নাড়ী,
ডুব দিও না বাড়াবাড়ি,
হলে পরে জ্বর জ্বাড়ি,
যেতে হবে যমের বাড়ী।”

কবিরঞ্জন একদিন এইরূপ কহিয়াছিলেন, যথাঃ—

“কর্ম্মের ঘাট, তেলের কাট, আর পাগলের ছাট, মলেও যায় না।”
আজু গোসাঞী কর্ত্তৃক এইরূপ উত্তর প্রদত্ত হইয়াছিল। যথাঃ—
“কর্ম্মডোর, স্বভাব-চোর, আর মদের ঘোর, মলেও যায় না।”

এই সকল রচনা পাঠে অবগতি হয় যে, আজু গোসাঞী একজন অতি উপযুক্ত ও প্রকৃত ভাবুক ছিলেন। বঙ্গভূমির কি দুরদৃষ্ট! যাঁহারা স্বদেশের উন্নতির নিমিত্ত কত শত দিন নিরাহারে, কত শত যামিনী অনিদ্রায় যাপন করিয়া অনেকানেক সুদীর্ঘ গ্রন্থ সকল রচনা করত বঙ্গসাহিত্যসমাজকে পুষ্টাঙ্গ করিয়াছিলেন; যাঁহারা বঙ্গসমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তি, দুঃখের বিষয়, সেই সকল মহাত্মাদিগের জীবনবৃত্তান্ত অতিশয় অপরিজ্ঞেয়। অস্মদ্দেশে, অন্যান্য সভ্যজাতির ন্যায় নিজ নিজ জীবনবৃত্তান্ত রাখিবার রীতি না থাকাতেই কেবল এইরূপ ঘটিয়াছে।

কবিরঞ্জন ও আজু গোসাঞীয়ের পর কত শত মাহাত্মা আবির্ভূত হইয়া নিজ নিজ রচনাকুসুম বিকাসিত করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন, অনেকে সফলপ্রযত্ন হইয়াও নিবিড়ারণ্য শোভাকর প্রসূনের ন্যায় সাধারণের অজ্ঞাতাবস্থাতেই অথবা কতকগুলি কাব্য-কানন-বাসি ঋষির চিত্ত-রঞ্জন হইয়াই মুদিত হইয়া গিয়াছে! রামপ্রসাদ ও আজু গোসাঞীয়ের পরবর্ত্তী রচয়িতাগণের বিষয় অনুসন্ধান করিলে বঙ্গকবি-কেশরী গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় মহোদয় আমাদিগের স্মরণ-পথের পথিক হন। অতএব তাঁহারই বিষয় সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া গেল। এস্থলে গুণাকর কবির পরিচয়-সূচক কয়েকটী কবিতা তাঁহার প্রণীত “সত্যনারায়ণের কথা” নাম্নী রচনা হইতে উদ্ধৃত হইল। যথাঃ—

“ভরদ্বাজ অবতংশ,      
ভূপতি রায়ের বংশ,

সদা ভাবে হত কংস,      
ভুরসুটে বসতি।

নরেন্দ্র রায়ের সুত,      
ভারত ভারতী যুত

ফুলের মুখুটী খ্যাত,       
দ্বিজ পদে সুমতি॥

দেবের আনন্দ ধাম,      
দেবানন্দপুর নাম,

তাহে অধিকারী রাম,      
রামচন্দ্র মুনসী!

ভারতে নরেন্দ্র রায়,      
দেশে যার যশগায়,

হয়ে মোরে কৃপাদায়,      
পড়াইল পারসী॥”

পূর্ব্বোক্ত রচনাংশ পাঠ করিয়া জ্ঞাত হওয়া যাইতেছে যে, গুণাকর ভারতচন্দ্রের পিতার নাম নরেন্দ্র নারায়ণ রায়। তিনি বর্দ্ধমান প্রদেশের অন্তর্ব্বর্ত্তী ভুরসুট পরগণাস্থিত পাণ্ডুয়া গ্রামে অবস্থিতি করিতেন। জাত্যংশে অতি উৎকৃষ্ট ছিলেন, একে ব্রাহ্মণ, তাহাতে আবার ফুলের মুখুটি। অর্থাংশেও বড় ন্যূন ছিলেন না। কারণ যে স্থলে তাঁহার বাসস্থান ছিল, অদ্যাপিও সেই ভূমিখণ্ড “পেঁড়োর গড়” নামে বিখ্যাত; এবং সেই স্থানের ভগ্নাংশ সকল দর্শন করিয়া অনুমান হয়, কোন সম্পত্তিশালী ব্যক্তি তাহার অধিকারী ছিলেন। যাহা হউক, তিনি যে, সে সময়ের একজন বিখ্যাত ধনাঢ্য ছিলেন, তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ কিছুকাল পরে বর্দ্ধমানাধিপের12 কোপানলে পতিত হইয়া, সমুদয় ঐশ্বর্য্য নষ্ট করত অতি ক্লেশে সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন। তাঁহার চারি পুত্র ছিল; চতুর্ভুজ, অৰ্জ্জুন, দয়ারাম, এবং ভারতচন্দ্র ক্রমান্বয়ে জন্ম পরিগ্রহ করেন। যদিও ভারতচন্দ্রকে সর্ব্ব-কনিষ্ঠ বলিয়া বর্ণিত হইল যথার্থ, কিন্তু তিনি কি মহীয়সী শক্তি লইয়াই জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন যে, তাহারই প্রভাবে, মহাজন-গণনীয়া তালিকা মধ্যে তাঁহারই নাম তদীয় ভ্রাতৃবর্গ ও পিতা অপেক্ষা অনেক উচ্চতর স্থানে নিবেশিত হইয়াছে। এই মহাত্মা ১৬৩৪ শকে জন্মগ্রহণ করেন। যখন ইঁহার পিতা অসহনীয় দুরবস্থারূপ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েন, ভারতচন্দ্ৰ সেই সময়ে পিতৃগৃহ হইতে পলায়ন করত মণ্ডলঘাট পরগণার মধ্যবর্ত্তী নওয়াপাড়া গ্রামে (মাতুল ভবনে) বাস করিয়াছিলেন। উক্ত গ্রামের নিকটবর্ত্তী তাজপুর নামক স্থানই তাঁহার বিদ্যাশিক্ষার প্রথম স্থান। এই গ্রামে তিনি চতুর্দ্দশ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত গুরুতর পরিশ্রম ও যত্ন সহকারে সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ ও অভিধান সমাপন পূর্ব্বক গৃহে প্রত্যাগত হন। এই সময়ে তাজপুরের নিকটবর্ত্তী শারদা গ্রামে তাঁহার বিবাহ হয়। এই বিবাহে কবিবরের ভ্রাতৃগণ সন্তুষ্ট না হইয়া বরং তাঁহাকে তিরস্কার করিয়াছিলেন। তেজস্বী ভারতচন্দ্র মনোবেদনায় প্রপীড়িত হইয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, “যতদিন আমি অর্থোপার্জ্জন করিতে সক্ষম না হইব, ততদিবস গৃহে প্রত্যাগমন করিব না।” এইরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া তিনি প্রথমতঃ হুগলী জেলার অন্তঃপাতি বাঁশবেড়িয়ার পশ্চিম দেবানন্দপুরের রামচন্দ্র মুন্সী নামক জনৈক সদাশয় ধনাঢ্য কায়স্থের আশ্রিত হইয়া, পারস্যভাষা শিক্ষার্থ যত্নশীল হন। এই সময়ে তাঁহার সংস্কৃত ও বঙ্গভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি জন্মিয়াছিল। এমন কি, উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট কবিতা সকল অত্যল্প সময়মধ্যে রচনা করিতে পারিতেন। এই সময়েই তিনি বঙ্গভাষায় দুইখানি “সত্যনারায়ণের পুথি” রচনা করেন। তাঁহার জীবনবৃত্তান্ত লেখকেরা বর্ণনা করিয়াছেন,—এই সময়ে তাঁহার বয়স পঞ্চদশ বর্ষের অধিক ছিল না। যে সময়ে বঙ্গভূমির অবস্থা অত্যন্ত মন্দ এবং এতদ্দেশীয়গণের বিদ্যাশিক্ষার পথ অত্যন্ত পঙ্কিল থাকায়, ভারত কাব্যোদ্যানের বৃক্ষ সকল নানা ঝঞ্ঝাবাতে ছিন্ন ভিন্ন হইয়াছিল, সেই সময়ে, এত নবীন বয়সে এইরূপ বিদ্যা ও রচনাশক্তিসম্পন্ন হওয়া সামান্য আশ্চর্য্যের বিষয় নহে! যাহা হউক, ভারতচন্দ্র পারস্য ভাষায় সম্যকরূপ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া প্রায় বিংশতি বৎসর বয়সে পুনর্ব্বার জন্মভূমিতে প্রত্যাগত হইয়াছিলেন। তথার তাঁহার ভাতৃবর্গ কর্তৃক অনুরুদ্ধ হইয়া, পিতৃকৃত ইজারা ভূমি সমূহের গোলযোগ নিষ্পত্তি করণার্থ মোক্তারী পদগ্রহণ পূর্ব্বক বর্দ্ধমানে যাত্রা করেন। সেই কার্য্য তৎকর্তৃক অতি সুচারুরূপে সম্পাদিত হইয়াছিল। কিন্তু ভ্রাতৃগণ উপযুক্ত সময়ে রাজস্ব প্রেরণে সক্ষম না হওয়াতে বৰ্দ্ধমানাধিপ সেই সকল ভূসম্পত্তি নিজ প্রভুত্বাধীন করিয়া লইলেন। ভারতচন্দ্র তাহাতে আপত্তি উত্থাপন করিলে, দুষ্টমতি রাজকর্মচারিগণ চক্রান্ত করিয়া তাঁহাকে কারারূদ্ধ করে। কিন্তু দয়া-ধৰ্ম্মপ্রিয় কারাধ্যক্ষ তাঁহাকে গোপনে নিষ্কৃতি প্রদান করেন। ভারতচন্দ্র এইরূপ অনুগৃহীত হইয়া তথা হইতে কটক যাত্রা করেন। তখন কটক মহারাষ্ট্রীয়দিগের অধিকার ভুক্ত ছিল,এবং শিবভট্ট নামক একজন সদাশয় ব্যক্তি সেই স্থানের সুবাদার ছিলেন। তিনি অনুগ্রহ করিয়া ভারতচন্দ্রকে আশ্রয় দান পূর্ব্বক পুরুষোত্তম ধামে বাসকরণোপযোগী সমুদায় দ্রব্য প্রদানার্থ কর্ম্মচারীদিগকে আদেশ প্রদান করেন। ভারতচন্দ্র কিয়দিবস পরে বৃন্দাবন গমনাভিলাবে পুরুষোত্তম হইতে বহির্গত হইলেন, কিন্তু খানাকুল কৃষ্ণনগরে উপস্থিত হইলে তাঁহার ভায়রাভাই তদীয় বৈরাগ্য ভাব দর্শন করত, অনেক প্রকার প্রবোধ বাক্য দ্বারা তাঁহার মনোভাব পরিবর্তন করিলেন। সুতরাং বৃন্দাবন যাত্রা স্থগিত হইল, এবং কিছুকাল শ্বশুরালয়ে অতিবাহিত করিলেন। অতঃপর তিনি ফরাসী গবর্ণমেন্টের দেওয়ান বাবু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মহাশয়ের সাহায্যে নবদ্বীপাধিপতি সুবিখ্যাত কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নিকট পরিচিত হন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কাব্যপ্রিয়তাগুণে অদ্বিতীয় ছিলেন, সুতরাং তাঁহার নিকট গুণাকর ভারত্চন্দ্রের ন্যায় সুকবির কখনো কি অনাদর হইবার সম্ভাবনা? কখনই নহে। রাজা তাঁহার কবিত্বগুণে মোহিত হইয়া “গুণাকর” উপাধির সহিত ৪০ টাকা বেতনে নিজ সভায় নিযুক্ত করিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের বিশেষানুগ্রহ ও উৎসাহে ভারতচন্দ্ৰ প্ৰথমত অন্নদামঙ্গল রচনার প্রবৃত্ত হয়েন এবং তাহার কিছুকাল পরে বিদ্যাসুন্দর রচিত হয়। অনেকে কহিয়া থাকেন, ভারতচন্দ্র বর্দ্ধমানাধিপের পূর্ব্বকৃত অত্যাচার বিস্মৃত হইতে পারেন নাই, তজ্জন্যই তিনি উক্ত রাজবংশের গ্লানি-সুচক বিষয় অবলম্বন করত বিদ্যাসুন্দর রচনা করেন। একথা নিতান্ত অপ্রামাণিক নহে, কবিবরের জীবনী ও বিদ্যাসুন্দর মনোনিবেশ পূৰ্ব্বক পাঠ করিলে অনায়াসেই সেই ভাব উপলব্ধি হয়। কিন্তু ইহা যে পূৰ্ব্ববর্ণিত সংস্কৃত গ্রন্থের আভাস লইয়া রচিত হইয়াছে, তদ্বিষয়ে কেহ দ্বিরুক্তি করিতে পারিবেন না। বিদ্যাসুন্দর রচনার পর ভারতচন্দ্র রসমঞ্জরী রচনা করেন। ইহাতে আদিরস বর্ণিত হইয়াছে। ভারতচন্দ্র এই রচনায় বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছেন। অনেকের এইরূপ মন্তব্য যে, লেখকের রচনা দেখিয়া তাঁহার আন্তরিক ভাব জ্ঞাত হওয়া যায় অর্থাৎ যাঁহার যে বিষয়ে অধিক আসক্তি তিনি স্বকীয় রচনা মধ্যে তাহা প্রায়ই ব্যক্ত করিয়া ফেলেন। একথা সত্য; কিন্তু ভারতচন্দ্র সে প্রকৃতির লোক ছিলেন না। তিনি যেমন সুরসিক ছিলেন, তেমনি তাঁহার চরিত্র কলঙ্ক বিবর্জিত ছিল। কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন সুরাশত্রু ছিলেন, কিন্তু গুণাকর নিজ চরিত্রকে সে দোষে কলঙ্কিত করেন নাই। তিনি জীবনের শেষাংশ মূলাযোড় গ্রামে অতিবাহিত করেন। অন্নদামঙ্গল, রসমঞ্জরী ও বিদ্যাসুন্দর ব্যতীত তৎকর্তৃক সংস্কৃত ও বঙ্গভাষায় অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবন্ধ রচিত হইয়াছিল। ভারতচন্দ্র রায় ইহলোক পরিত্যাগ করিবার কিছু পূর্ব্বে চণ্ডীনাটক রচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তাহা সংস্কৃত, বাঙ্গালা ও হিন্দী ভাষায় নানালঙ্কারে ভূষিত হইয়া রচিত হইয়াছিল। কিন্তু আমাদিগের দুরদৃষ্টবশতঃ গ্রন্থখানি শেষ না হইতে হইতেই তাঁহার মৃত্যু হয়। ১৬৮২ শকে কবিবর ভারতচন্দ্র নশ্বর তনু ত্যাগ করেন।

ইঁহার সমকালে রাধানাথ নামক এক ব্যক্তি বৰ্ত্তমান ছিলেন। সে ব্যক্তি কে? কোথায় বসতি, তাহা জানিবার উপায় নাই। তিনিও কবিত্ব শূন্য ছিলেন না, বিদ্যাসুন্দরের কোন অংশে তাঁহার রচনা দৃষ্ট হয়। গুণাকর ভারতচন্দ্রের পর রামনিধি গুপ্ত13 আমাদিগের বর্ণনীয় বিষয় হইতেছেন। তিনি ১১৪৮ সালে কলিকাতার অন্তঃপাতি কুমার টুলি পল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির’ অধীনে অনেক প্রধান প্রধান কর্ম্ম করিয়াছিলেন। আদিরস বর্ণনায় তাঁহার বিশেষ ক্ষমতা ছিল। তৎপ্রণীত সঙ্গীত সমূহ এখনো বঙ্গ-সমাজের আদরণীয় পদার্থ মধ্যে গণ্য হইয়া আসিতেছে। অত্যন্ত ধার্মিক ও সচ্চরিত্র মহোদয়গণকেও আহ্লাদের সহিত নিধুবাবুর টপ্পা শ্রবণ করিতে দেখা যায়।  তিনি ১২৪৫ সালে ৯৭ বৎসর বয়সে তনু ত্যাগ করেন। সঙ্গীত ভিন্ন তাঁহার প্রণীত অন্য কোন গ্রন্থ আমাদিগের নয়নগোচর হয় না, রামনিধি গুপ্ত জীবিত থাকিতে থাকিতেই মদনমোহন তর্কালঙ্কারের রচনা
-কুসুম প্রস্ফুটিত হইয়াছিল। এই মহোদয় ১২২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহার পিতার নাম রামধন চট্টোপাধ্যায়, পিতামহের নাম কৃষ্ণকিশোর চট্টোপাধ্যায়। নদীয়ার অন্তবর্ত্তী বিলগ্রামে তাঁহার পূর্ব্ব পুরুষের বাসস্থান ছিল। তিনি বাল্যকালে প্রথমতঃ গ্রাম্য পাঠশালায় অধ্যয়ন করিয়া রামদাস ন্যায়রত্ন সমীপে সংস্কত ব্যাকরণ পড়িতে আরম্ভ করেন। তৎপরে কলিকাতাস্থ সংস্কৃত কালেজে ১৫ বৎসর অধ্যয়ন করিয়া সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শী হন। কালেজ পরিত্যাগের সময় অধ্যক্ষেরা তাঁহাকে তর্কালঙ্কার উপাধি প্রদান করিয়াছিলেন। ইংরাজি ভাষায়ও তাঁহার ব্যুৎপত্তি ছিল। তিনি পঠদ্দশাতেই “বাসবদত্তা” কাব্য রচনা করেন। এই গ্রন্থ বিক্রমাদিত্যের সভাস্থ রত্নবর বররুচির ভাগিনেয় সুবন্ধু কর্তৃক প্রথমত সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়। তর্কালঙ্কার মহাশয় সেই উপাখ্যান অবলম্বন করিয়া বঙ্গ-ভাষায় এক সুবিস্তৃত কবিত্ব পরিপূরিত কাব্য প্রণয়ন করেন। গ্রন্থাবতারিকা মধ্যে লিখিত আছে যে, “এই গ্রন্থ যশোহর জেলার অন্তঃপাতি ইসফপুর পরগণাস্থ নওয়াপাড়া গ্রাম নিবাসী কালীকান্ত রায়ের অনুমত্যনুসারে রচিত হয়।” ক্ষণে (১৮৭০ খৃঃঅঃ) বাসবদত্তার বয়ঃক্রম প্রায় ২১ বৎসর হইয়াছে। তাঁহার পঠদ্দশায় প্রণীত দ্বিতীয় পুস্তকের নাম “রসতরঙ্গিণী” ইহাতে কতগুলি সংস্কৃত উদ্ভট কবিতার অনুবাদ সন্নিবেশিত হইয়াছে। ইহার রচনা প্রণালী বাসবদত্তা অপেক্ষা উত্তম, কিন্তু বর্ণিত বিষয় অত্যন্ত অশ্লীল। পিতা পুত্রে এক স্থানে পাঠ করিবার উপযুক্ত নহে। তর্কালঙ্কার মহাশয় কালেজ হইতে বহির্গত হইয়া প্রথমতঃ কলিকাতা গবৰ্ণমেণ্ট পাঠশালায় ১৫ টাকা বেতনে শিক্ষকতা কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তৎপরে ২৬ টাকা বেতনে বারাসত ইংরাজী-বঙ্গ-বিদ্যালয়ের পণ্ডিত হন। কিছু দিন পরে সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কালেজের দেশীয়ভাষার অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। অনন্তর ৫০ টাকা বেতনে কৃষ্ণনগর কালেজের প্রধান পণ্ডিতের আসন গ্রহণ করেন। কিছুকাল পরে সেস্থান হইতে পুনর্ব্বার কলিকাতা সংস্কৃত কালেজের সাহিত্যাধ্যাপক হন। এই সময়ে বালক বালিকার পাঠ্য পুস্তকের অভাব দেখিয়া তিনি ক্রমান্বয়ে তিন ভাগ শিশুশিক্ষা প্রণয়ন করেন। ইহার পূর্ব্বে বালকবালিকাগণের প্রথম পাঠোপযুক্ত সুপ্রণালীবদ্ধ গ্রন্থ প্রায় ছিল না, তর্কালঙ্কার মহাশয় তাহার প্রথম অভাব মোচন করেন। তাঁহার পুস্তকের আদর্শ লইয়া এখন অনেকেই উক্তবিধ গ্রন্থ সকল প্রণয়ন করিতেছেন ও করিয়াছেন। যাহা হউক, তিনি কখনো একস্থানে দীর্ঘকাল কাৰ্য্য করেন নাই। সংস্কৃত কালেজে কিছুকাল অধ্যাপকতা করিয়া ১২৫৬ সালে মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে বহরমপুরের জজ্পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। সৰ্ব্বশেষে কান্দী মহকুমার ডিপুটি মাজিষ্ট্রেটের পদে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। জীবনের অবশিষ্টাংশ ঐ স্থানে সুখে অতিবাহিত করিয়া ১২৬৪ সালে প্রাণ ত্যাগ করেন।

তর্কালঙ্কার মহাশয়ের সমকালে অথবা অব্যবহিত পরেই রামবসু, হরুঠাকুর, বাসুসিংহ, নিত্যানন্দ বৈরাগী প্রভৃতি কয়েক জন কবিওয়ালা প্রাদুর্ভূত হন।

ইঁহাদিগের মধ্যে কেহই উপযুক্তরূপ বিদ্যালোকসম্পন্ন ছিলেন না। কিন্তু তাঁহাদিগের রচিত সঙ্গীত-মালায় বিশেষ কবিত্ব-জ্যোতি লক্ষিত হয়। তাঁহাদিগের মধ্যে রামবসু সাধারণের নিকট অধিক পরিচিত, সুতরাং তাঁহার বিবরণ এস্থলে কিঞ্চিৎ প্রকটিত হইল:—তিনি ১১৯৪ বঙ্গাব্দে কলিকাতার অপরপারস্থ সালিখা নাম্নী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সঙ্গীত রচনায় তাঁহার বিশেষ ক্ষমতা ছিল। ১২৩৬ সালে ৪২ বৎসর বয়সে তিনি গতায়ু হন। তাঁহার রচনা-কুসুম অস্মদ্দেশীয় লোকদিগের অমনোযোগিতা দোষে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। কিছুকাল পূর্ব্বে কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহোদয় সেই সকল সুভাব সঙ্গীত নিকর সংগ্রহার্থ যত্নবান হইয়াছিলেন। কিন্তু আমাদিগের ভাগ্যদোষে তিনি ও অকালে কালকবলিত হন। এক্ষণে কোন কোন মহাশয় অনুসন্ধান করিয়া রামবসুর বিলুপ্ত রচনার অনেকাংশ আবিষ্কার করিয়াছেন। তাঁহাদিগের আবিষ্ক্রিত এক অংশ আমরা কৃতজ্ঞতার সহিত এস্থলে গ্রহণ করিলাম। যথাঃ-

(ঠাকরুণ বিষয়। )
“ওহে গিরি গাতোল হে মা এলেন হিমালয়।
উঠ দুর্গা দুর্গা বলে, দুর্গাকর কোলে,
মুখে বলো জয় জয় দুর্গা জয়।।
কন্যাপুত্ৰ প্ৰতি বাচ্ছল্য, তার তাচ্ছল্য, করণ নয়;
আঁচল ধরে তারাঃ–
বলে, ছিমা, কিমা, মাগো, ওমা,
মাবাপের কি এমনি ধারা!
গিরি তুমি যে অগতি, বোঝে না পার্ব্বতী,
প্রসূতির অখ্যাতি জগৎময়।”

এক্ষণে কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ি নামক জনৈক ব্যক্তির পরিচয় দেওয়া যাইতেছে। তিনি নবদ্বীপাধিপতি গিরিচশন্দ্র রায়ের14 সভাপণ্ডিত ছিলেন। রাজা তাঁহার উপস্থিত বাকপটুতা ও সুরসিকতায় প্রীত হইয়া “রসসাগর” উপাধি প্রদান করেন। রসসাগরের অতিশয় দ্রুতরচনায় ক্ষমতা ছিল, এমন কি, কোন প্রশ্ন করিলেই তিনি তৎক্ষণাৎ তাহার উত্তর পদ্যে প্রদান করিতে পারিতেন। একদা রাজাকর্তৃক এইরূপ প্রশ্ন প্রদত্ত হয়। যথাঃ–

“গাভীতে ভক্ষণ করে সিংহের শরীর।”

রসসাগর অধিকক্ষণ চিন্তা না করিয়াই এই রূপ উত্তর দিয়াছিলেন। যথাঃ—

“মহারাজ রাজধানী, নগর বাহির।
বারইয়ারি মা ফেটে হলেন চৌচির॥
ক্রমে ক্রমে খড় দড়ী, হইল বাহির।
গাভীতে ভক্ষণ করে, সিংহের শরীর।”

তিনি এইরূপ কত শত কবিতা রচনা করিয়াছিলেন, তাহার সংখ্যা করা যায় না। হিন্দী ভাষাতেও তাঁহার ঐরূপ নৈসর্গিক ক্ষমতা ছিল। তাঁহার প্রণীত কোন পুস্তক আমাদিগের নয়নগোচর হয় নাই।

এক্ষণে কবিবর ঈশ্বরগুপ্ত আমাদিগের বর্ণনার বিষয় হইতেছেন। ১২১৬ সালে কলিকাতার ১৪ ক্রোশ উত্তর কাঁচড়াপাড়া গ্রামে হরিনারায়ণ গুপ্তের ঔরসে গুপ্ত কবির জন্ম হয়। বাল্যকালে তিনি কোন বিখ্যাত বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন নাই। কিন্তু শৈশবকাল হইতেই তাঁহার কবিতা রচনায় বিশেষ অনুরাগ ছিল। বাল্যকাল (প্রায় ছয় বৎসর বয়ঃক্রম) হইতে তিনি কলিকাতায় মাতুলালয়ে বাস করিতেন। ১২৩৭ সালের ১৬ই মাঘ হইতে তিনি প্রথমতঃ সাপ্তাহিক নিয়মে “সংবাদ প্রভাকর” প্রচারণে প্রবৃত্ত হন। কিছু দিন পরে সপ্তাহে তিনবার ও পরিশেষে বর্তমান প্রাত্যহিক নিয়মে ‘প্রভাকর’ প্রচারিত হয়। সেই সময়ে তিনি কবিত্বশক্তির পরিচয় দিবার নিমিত্ত আর একখানি মাসিক প্রভাকর প্রচার করেন। তাহা কেবল নানা বিষয়িণী কবিতামালায় পরিপূরিত থাকিত। “সাধুরঞ্জন” ও “পাষণ্ড-পীড়ন” নামে আর দুইখানি সাপ্তাহিক পত্ৰ তৎ কর্তৃক সম্পাদিত হইত। কবিবর সাধুরঞ্জনকে নানা প্রকার জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ সমূহে ভূষিত করিতেন। পাষণ্ড-পীড়নেও ঐরূপ বিষয় সকল লিখিত হইত। কিন্তু সেই সময়ে মাননীয় ভাস্কর সম্পাদক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য্যের সহিত ঈশ্বর গুপ্তের বিবাদ হওয়াতে শেষোক্ত পত্রখানিতে অশ্লীল বিষয় সন্নিবেশিত হইয়াছিল। কবিবর এই সকল পত্র সম্পাদন করিয়া যে অবকাশ পাইতেন, তাহাও বঙ্গ-সাহিত্যোন্নতি সাধক বিষয়ে অতিবাহিত করিতেন। তিনি দশ বা দ্বাদশ বৎসর নানা স্থান পর্যাটন করত ভারতচন্দ্র, কবিরঞ্জন, রামনিধি গুপ্ত, হরু ঠাকুর, রামবসু ও নিতাইদাস প্রভৃতি মৃত কবিগণের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করেন। সেই গুলি প্রভাকরে প্রকাশিত হইয়াছিল। কেবল ভারতচন্দ্রের জীবনবৃত্তান্ত তিনি স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে পুনর্মুদ্রাঙ্কিত করিয়াছিলেন। তাঁহার যত্ন ও পরিশ্রম বলে অস্মদ্দেশের ও বঙ্গ সাহিত্যসংসারের যে উপকার সাধিত হইয়াছে, তজ্জন্য তাঁহার প্রতি আমাদিগের সকলেরই কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

“প্রবোধ প্রভাকর” নামক তিনি একখানি পুস্তক রচনা করেন। তাহাতে জীব-তত্ত্ব-বিষয়ক প্রসঙ্গ সকল সন্নিবেশিত হইয়াছে। সেই পুস্তকের রচনাপ্রণালী অনেকাংশে প্রাঞ্জল। তাহা ১২৬৪ সালের ১লা চৈত্রে গ্রন্থকর্তা কর্তৃক প্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহার পর “হিত-প্রভাকর” নামধেয় আর একখানি গদ্য পদ্যময় গ্রন্থ রচিত হয়। কথিত আছে, গুপ্ত মহাশয় সুবিখ্যাত বেথুন সাহেবের অনুরোধ-পরতন্ত্র হইয়া বিষ্ণু শর্ম্মাকৃত হিতোপদেশের মিত্রলাভ, সুহৃদ্ভেদ, বিগ্রহ,ও সন্ধি এই চারিটা বিষয় অবলম্বন করত ঐ গ্রন্থ রচনা করেন। ইহার রচনাপ্রণালী সরল; দুর্ব্বোধ স্থান প্রায়ই নয়নগোচর হয় না। ঐ গ্রন্থ তাঁহার মৃত্যুর পর ১২৬৭ সালের ১১ই চৈত্রে তদীয় ভ্ৰাতা শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র গুপ্ত (যিনি বর্তমান প্রভাকর সম্পাদক) কর্তৃক প্রকাশিত হইয়াছে। এতদ্ভিন্ন “বোধেন্দুবিকাশ” ও “কলিনাটক” নামধেয় দুইখানি গ্রন্থের রচনা আরম্ভ করিয়াই জীব-লীলা সম্বরণ করেন। ১২৭২ সালে প্রথমোক্ত পুস্তক খানির তিন অঙ্ক মাত্র প্রচারিত হয়। তাহা প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটকের আভাস লইয়া রচিত। তাহার অধিকাংশ স্থানই হাস্যরসে পরিপূর্ণ। গুপ্ত মহাশয় হাস্যরস বর্ণনায় বিশেষ ক্ষমতা দেখাইয়া গিয়াছেন। এতদ্ভিন্ন তিনি কতশত হাস্যোদ্দীপক সঙ্গীত ও নানা বিষয়িণী কবিতা-মালা রচনা করিয়াছেন, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। ১২৬৫ সালের ১০ই মাঘে তিনি এই সকল অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করত, ইহলোক পরিত্যাগ করেন। কবিবর ঈশ্বর গুপ্তের সমকালেই এতদ্দেশীয় গায়কসম্প্রদায়ের প্রাদুর্ভাব হয়। তাঁহাদিগের মধ্যে দাশরথী রায় বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। অথচ তিনি ভালরূপ লেখা পড়া জানিতেন না। সঙ্গীত রচনাই তাঁহার প্রধান উপজীবিকা ছিল। দাশরথী প্রণীত পাঁচখণ্ড পাঁচালি এখন বহুল পরিমাণে প্রচারিত হইয়া বিক্রীত হইতেছে।

১৭৪৯ শকে (১৮২৭ খৃঃ অব্দে) মুলাযোড় নিবাসী বঙ্গচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অন্নদামঙ্গলের বিষয় লইয়া দুর্গামঙ্গল রচনা করেন। কথিত আছে, কলিকাতা নিবাসী সুবিখ্যাত মৃত বাবু আশুতোষ দেবের উৎসাহে উক্ত কাব্যখানি রচিত হইয়াছে। তাহাতে প্রশংসনীর ভাগ অতি অল্প।

প্রায় ২০ বংসর অতীত হইল, রঘুনন্দন গোস্বামী নামক জনৈক ব্যক্তি রামায়ণের সপ্ত কাণ্ড অবলম্বন পূর্ব্বক “রামরসায়ন” নামক কাব্য রচনা করেন। সেই গ্রন্থের রচনাপ্রণালী বড় উৎকৃষ্ট নহে, কিন্তু তাহাতে রচয়িতার কবিত্বশক্তি পরিচায়ক অনেক স্থল দৃষ্ট হয়। গ্রন্থকর্ত্তা অতি উত্তমরূপ সংস্কৃত জানিতেন।

এইরূপ কত শত মহাত্মা জন্ম গ্রহণ করিয়া বঙ্গ-সাহিত্যের অঙ্গপুষ্টি সাধন করিয়া গিয়াছেন; কত শত মহোদয়ের মনোদ্যানোৎপন্ন পুষ্পসমূহ বিক্রয় করিয়া কত শত লোক জীবন ধারণ করিতেছে; কত শত ব্যক্তি তাঁহা- দিগের রচনাবলী পাঠ করিয়া বঙ্গভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন; কত শত মহোদয় তাঁহাদিগের রচনাপ্রণালী অবলম্বন, কেহ বা আদর্শরূপে গ্রহণ করিরা উৎসাহিত মনে, উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট কাব্য সকল রচনা করিতেছেন, তাড়ার ইয়ত্তা করা যায় না। যে মহোদয়দিগের লেখনীবলে, এতদূর উপকার সাধিত হইয়াছে ও হইতেছে, তাঁহারাই ধন্য। তাঁহাদিগের যশই প্রকৃত ও চিরস্থায়ী। যত দিন বঙ্গভাষা জগন্মণ্ডলে বৰ্ত্তমান থাকিবে, যতদিন একজনও স্বদেশপ্রিয় ব্যক্তি জীবিত থাকিবেন, ততদিন ভারতচন্দ্রাদি কবিকুলের কখনই অনাদর হইবে না। যতই বিদ্যার উন্নতি হইবে, যতই দেশীয় গণ সভ্যতার উচ্চাসনে স্থান পাইবেন, বঙ্গীয় প্রাচীন রচয়িতৃগণের যশোকান্তি ততই বৃদ্ধি হইতে থাকিবে।

এস্থলে শ্রীরামপুরস্থ মিসনরিগণ ও কলি- কাতাস্থ স্কুল বুক সোসাইটী, এবং তত্ত্ববোধিনী সভার বিষয়ও নিতান্ত নিম্ফলে কথিত হইবে না। ১৭৯৯ খৃঃ অব্দের অক্টোবর মাসে একদল প্রোটেষ্টান্ট মিসনরি এতদ্দেশে আগমন করিয়া শ্রীরামপুরে অবস্থিতি করেন। ডাক্তার মার্সমান ও মাষ্টার ওয়ার্ড তাঁহাদিগের প্রধান নায়ক ছিলেন। মহা মান্য কেরি উহাদিগের প্রায় ছয় বৎসর পূর্ব্বে ভারতবর্ষে আগমন করত মালদহ জেলায় বাস করেন। এই সময়ে তিনি শ্রীরামপুরস্থ মিসনরিদিগের সহিত মিলিত হন। যদিও খৃষ্টধর্ম প্রচার করা এই মহোদয় দিগের মুখ্য উদ্দেশ্য, তথাচ তাঁহারা এই দেশবাসিগণের অবস্থা ও ভাষার উন্নতি সাধনে বিশেষ যত্নবান ছিলেন। তাঁহাদিগের যত্ন ও অধ্যবসায় বলে শ্রীরামপুরে একটা মুদ্রাযন্ত্র স্থাপিত হয়। তাহাতে রামায়ণ, মহাভারত, ও অভিধান প্রভৃতি অনেক বাঙ্গালা পুস্তক মুদ্রাঙ্কিত হইয়াছিল। বঙ্গভাষায় ইংরাজি প্রণালীতে অভিধান রচনা করা, কেরি সাহেব কর্তৃক প্ৰথম উদ্ভাবিত হয়। তাঁহার প্রণীত অভিধান এখন অস্মদ্দেশে প্রচারিত রহিয়াছে। তিনি একোন বিংশতি শতাব্দীর প্রারম্ভে “ খৃষ্ট ধৰ্ম্ম শুভ সংবাদ বাহক” নামে একখানি পুস্তক প্ৰথম মুদ্রাঙ্কন করেন। ১৮০১ খং অব্দে “নিউটেষ্টমেন্ট” নামক গ্রন্থের বাঙ্গালা অনুবাদ তৎকর্তৃক প্রচারিত হয়। তিনি ভারতবর্ষে আগমন করিয়া এই গ্রন্থ প্রথম লিখিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা “খৃীষ্টধৰ্ম্ম শুভ সংবাদ বাহক” নামক পুস্তকের কিছুকাল পরে মুদ্রিত হইয়াছিল। এই সময়ে তাঁহার উৎসাহে বাবু রামরাম বসু কর্তৃক “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” নামক একখানি গদ্য গ্রন্থ রচিত হয়। বাবু রামরাম বসু কলিকাতাস্থ ফোর্ট উইলিয়ম কালেজের এক জন শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রতাপাদিত্যের বংশোদ্ভব। বিজ্ঞান ও সাহিত্য শাস্ত্রে তাঁহার বিশেষ জ্ঞান ছিল, কিন্তু তল্লিখিত গ্রন্থের রচনা অত্যন্ত জঘন্য। সেই পুস্তক তৎকালে বিদ্যালয় সমূহের প্রধান পাঠ্য পুস্তক ছিল। সাধারণের দর্শনার্থ উক্ত গ্রন্থের কিয়দংশ এ স্থলে উদ্ধত হইলঃ–

“ইহা ছাড়াইলে পূরির আরম্ভ। পূর্বে সিংহদ্বার পূরির তিনভিতে উত্তর পশ্চিম দক্ষিণ ভাগে সারিসারি লম্বা তিন দালান তাহাতে পশুগণের রহিবার স্থল। উত্তর দালানে সমস্ত দুগ্ধবতী গাভীগণ থাকে দক্ষিণ ভাগে ঘোড়া ও গাধাগণ পশ্চিমের দালানে হাতি ও উঠ তাহাদের সাতে সাতে আর আর অনেক অনেক পশুগণ।

এক পোয়া দীর্ঘ গ্রন্থ নিজপুরী। তার চারিদিগে প্রস্তরে রচিত দেয়াল। পূর্বেরদিগে সিংহদ্বার তাহার বাহির ভাগে পেট কাটা দরজা। শোভাকর দ্বার গতি উচ্চ আমারি সহিৎ হস্তি বরাবর যাইতে পারে। চারের উপর এক স্থান তাহার নাম নওবৎ-খানা চাহাতে অনেক অনেক প্রকার জন্ত্র দিবা রাত্রি সময়ানু- ক্রমে জন্ত্রিরা বাদ্যধ্বনি করে।”

তৎপরে কেরি সাহেব স্বয়ং বঙ্গভাষার ব্যাকরণ ও কথাবলি নামক দুইখানি পুস্তক প্রচার করেন।

১৮০৪ খৃঃ অব্দে তাঁহার দ্বারা মহানগরী কলিকাতার কৃষি-বিদ্যা সমালোচক নামক একটা সমাজ স্থাপিত হয়। ইহার দ্বারা বঙ্গদেশের অনেক উপকার হইয়াছে। পূর্ব্বে এই সভা হইতে বঙ্গভাষায় একখানি পত্রিকা প্রচারিত হইত।

অতঃপর কেরির জ্যেষ্ট পুত্র ফিলিপ কেরি “বৃষ্টিস দেশের বিবরণ” নামক একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ১৮১৭ খৃষ্টাব্দের এপ্রেল মাসে কয়েক জন ইংরাজ ও দেশীয় মহোদয়, দ্বারা স্কুলবুক সোসাইটী নাম্নী সভা স্থাপিত হয়। অল্প মূল্যে উৎকট পুস্তক প্রচার করাই উক্ত সভার উদ্দেশ্য। ১৮৬২ খৃঃ অব্দে বর্ণাকিউলার লিটারেচর সোসাইটা অর্থাৎ বঙ্গীয় সাহিত্য সভা ইহার সহিত সংযোজিত হয়। উক্ত সোসাইটীর দ্বারা উৎসাহিত হইয়া কত শত মহোদয় কত শত গ্রন্থ প্রণয়ন করিতেছেন, তাহার সংখ্যা করা যায় না। উক্ত সভা দ্বারা প্রকাশিত “বিবিধার্থ সংগ্রহ” ও “ রহস্য-সন্দর্ভ” পত্রদ্বয় অতীব প্ৰসংশনীয়। ইহা হইতে বঙ্গদেশের বিস্তর উন্নতি হইয়াছে।

১৭৬১ শকের (১৮৪০ খৃঃ অব্দ) ২১এ আশ্বিন অশেষ গুণালঙ্কৃত পণ্ডিত রামচন্দ্ৰ শৰ্ম্মা ও তাঁহার বন্ধুবর্গ একত্রিত হইয়া বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর মহোদয়ের ভবনে তত্ত্ববোধিনী সভা স্থাপিত করেন। বঙ্গসাহিত্যের গদ্য রচনার উন্নতি এই সভা হইতেই সাধিত হইয়াছে। তত্ত্ববোধিনী সভার পত্রিকাখানি বঙ্গ সাহিত্যের কোষ স্বরূপ বলিলেও বলা যায়। ইহাতে যত উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট বিষয় সন্নিবেশিত হইয়াছে, বোধ হয়, বঙ্গীয় সমাজের প্রচলিত কোন পত্ৰিকায় সেরূপ উন্নতি সাধক বিষয় প্রকাশিত হয় নাই। ১৮৪০ খৃঃ অব্দে কঠোপনিষদ্ নামক গ্রন্থ প্রথম তত্ত্ববোধিনী সভা কর্তৃক প্রচারিত হইয়াছিল।

তৎপরে বেদান্তসার, ব্রাহ্মধর্ম্ম, পঞ্চদশী প্রভৃতি অনেকগুলি উৎকৃষ্ট পুস্তক এই সভা কর্তৃক প্রচারিত হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। ১৮৪৩ খৃঃ অব্দে উক্ত সভার কোন প্রকৃত বন্ধু উহার উন্নতির নিমিত্ত একটা মুদ্রা- যন্ত্র প্রদান করিয়াছিলেন। সভার ব্যয় সাধারণ চাঁদা হইতে সমাধা হইত। মৃত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর এই সভার অনেক উপকার করিয়া ছিলেন। তিনি ১৮৪৮ খৃঃ অব্দে সভার ত্রিতল গৃহ নিৰ্ম্মাণ জন্য ৩,৪২৫ টাকা প্রদান করেন। এদ্ভিন্ন তিনি আর আর অনেক সাহায্য করিয়াছিলেন। পরিশেষে মহোদয় এন হলহেড; সার চারলস্ উইলকিন্স; এবং মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের বিষয় কিছু না বলিয়া উপস্থিত বিষয়ের উপসংহার করিলে, প্ৰস্তাব অসম্পূর্ণ বোধ হয়। এজন্য তাঁহাদিগের বিবরণ ক্রমে লিখিত হইতেছে।

এন, হলহেড মহোদয় ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে সিবিলিয়ান হইয়া এতদ্দেশে আগমন করেন। তিনি নিজ মেধাশক্তি প্রভাবে এতদ্দেশীয় ভাষাসমূহে এতদূর ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন যে, তাঁহার পূর্ব্ববর্ত্তী কোন ইউরোপীয় তত পরিমাণে এদেশীয় ভাষায় জ্ঞানলাভ করিতে সক্ষম হয়েন নাই। ১৭৭২ খৃষ্টাব্দে যখন রাজকার্য্যের তার ইউরোপীয় কৰ্ম্মচারিবর্গের হস্তে অর্পিত হয়, তখন তৎকালিক গবর্ণর জেনেরল ওয়ারেন হেষ্টিংস সেই সকল কৰ্ম্মচারীকে এতদ্দেশীয় প্রণালী অবলম্বন দ্বারা রাজকার্য্য সম্পন্ন করাইবার নিমিত্ত ইচ্ছক হইয়াছিলেন। তজ্জন্যই তিনি হলহেড সাহেবকে হিন্দু ও মুসলমান আইন সমূহ অনুবাদ করিতে আজ্ঞা দেন। হলহেড সাহেব তদনুযারী দেশীয় প্রাচীন আইন সকল অনুবাদ করিয়া এক খানি ইংরাজী পুস্তক প্রণয়ন করেন। তাহা ১৭৭৫ খষ্টাব্দে প্রথম মুদ্রিত হয়। তিনি বঙ্গ ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিরাছিলেন। এমন কি, ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে তৎ কর্তৃক একখানি ব্যাকরণ গ্রন্থিতও প্রচারিত হয়। ইহার পূর্ব্বে কোন বাঙ্গালা পুস্তক যন্ত্রারূঢ় হয় নাই। সেই গ্রন্থ প্রথমতঃ হুগলিতে যন্ত্রিত হইয়াছিল। মহোদয় হলহেড সাহেবের পূর্ব্বে বাঙ্গালা ভাযায় কোন ব্যাকরণ রচিত হইয়াছিল কিনা, তাহার কোন বিশেষ প্রমাণ নাই। সুতরাং তাঁহাকেই বঙ্গভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচয়িতা বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। অবশ্য স্মরণীর চার্লস উইলকিন্স মহাশয়, হলহেড সাহেবের একজন বন্ধু ছিলেন। তাঁহলও বঙ্গ ভাষায় বিশেষ জ্ঞান ছিল। তিনি অতি উৎকৃষ্ট শিল্পী ছিলেন। তাঁহার গুরুতর পরিশ্রম ও সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিপ্রভাবে বঙ্গভাষায় খোদিত অক্ষর প্রথম ঢালাই হয়। যদিও সেই সকল বর্ণমালা সুছাঁদ রূপে খোদিত হয় নাই বটে, তথাচ সেই অজ্ঞান তিমিরাচ্ছন্ন সময়ে, কেবল মাত্র নিজ বুদ্ধি ও শারীরিক পরিশ্রম সহায়ে যে তিনি এক সাট অক্ষর প্রস্তুত করিতে পারিয়াছিলেন, তাহাই তাঁহার পরোপকারিতা ও মহানুভাবিতা গুণের পরিচয় দিতেছে। এবং তজ্জন্য তিনি শত শত ধন্যবাদের পাত্র। অজ্ঞানান্ধকারাবৃত কোন বিদেশে যাইয়া তদ্দেশের ভাষা শিক্ষা, সেই সকল ভাষায় গ্রন্থ রচনা করা, ও তদুন্নতি সাধক যন্ত্র সকল নির্মাণ করা সামান্য ক্ষমতা, অধ্যবসায় ও অস্বার্থপরতার আয়ত্তাধীন নহে, যদি উইলকিন্স সাহেব কষ্ট স্বীকার করিয়া, বাঙ্গালা ভাষায় অক্ষর প্রস্তুত না করিতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, হলহেড সাহেবের ব্যাকরণ জনসমাজের কোন উপকারেই আসিত না। সাধারণের অজ্ঞানতাবস্থাতেই বিলুপ্ত হইয়া যাইত। উইলকিন্স সাহেবের যত্ন ও পরিশ্রমে তদীয় বন্ধু হলহেড মহাশয়ের গ্রন্থ ১৭৭৮ খৃস্টাব্দে হুগলীতে মুদ্রিত হইয়াছিল।

মহামান্য রাজা রামমোহন রায়ের স্বদেশ প্রিয়তা ও বিদ্যানুরাগিতার বিষয় অস্মদ্দেশীয় জনগণের কাহারও অবিদিত নাই। তিনি স্বদেশের উন্নতি জন্য যে কি পর্য্যন্ত কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম করিয়াছিলেন, তাহার পরিমাণ করা যায় না। তিনি স্বদেশের উন্নতি করিতে করিতে অনাথিনী বঙ্গ-ভাষাকেও বিস্মৃত হন নাই। তৎপ্রণীত ব্যাকরণ বক্তৃতা, ও সঙ্গীত মালা বঙ্গভাষার অঙ্গশোভিনী হইয়া রহিয়াছে। প্রকৃত গুণের কখনই অনাদার নাই।

এইরূপ কত শত মহাত্মা বঙ্গভাষার উন্নতি লক্ষ্য করিয়া কত শত পুস্তক রচনা করিয়া ছিলেন; এইরূপ কত শত মহাশয় সঙ্গীত-সুধা অক্লেশে উত্তোলন করত সাধারণের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন; এইরূপ কত শত মহোদয় ভাষা উদ্যানে বাস করত, সুরস-ফল প্রদ কাব্য-বৃক্ষ সকল সাধারণের জন্য রোপণ করিয়া গিয়াছেন, তাহার সংখ্যা করা দুষ্কর। চিরদুঃখিনী বঙ্গভাষার ভাগ্যে কখনই অনুকূল-বৃষ্টি বর্ষিত হয় নাই। সর্ব্বদাই দুরদৃষ্ট রবি প্রখর কিরণে ইহার সাহিত্য-ক্ষেত্র সম্ভূত অঙ্কুর সকল অকালে অধিকাংশই ধ্বংসিত হ‍ইয়াছে। তবে কতকগুলি সদাশয় মহোদয়ের যত্নে, অবশিষ্টাংশ যাহা ছিল, তাহাই যত্নপূর্ব্বক রক্ষিত হইয়াছে। এমন কি, কেহ কেহ শারীরিক পরিশ্রম ও কেহ বা বহুল অর্থ ব্যয় করত, রোপণকারীদিগকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন। ইহা কি সামান্য মহানুভাবতা যে, এক ব্যক্তি স্বার্থের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য না রাখিয়া কেবল সাধারণের উপকারার্থ ভূমির উর্ব্বরতা সাধন পূর্ব্বক তৎসম্ভূত উপস্বত্ব সাধারণকেই প্রদান করিয়াছেন। ধন্য বদান্যতা! এরূপ মহাত্মা পৃথিবীর সকল স্থানে, সকল সময়ে বর্তমান থাকিলে জগতের বিশেষ মঙ্গল সম্ভাবনা।

.

Notes

[←1]

 কারণ বিদ্যাপতি এক স্থলে লিখিয়াছেন।

“বিদ্যাপতি কহ ভাখি।
রূপ নারায়ণ সাখি”

[←2]

  নরহরি দাসের ভণিতায় এইরূপ দৃষ্ট হয়:-

“জয় জয় চণ্ডিদাস দয়াময় মণ্ডিত সকল গুণে।
অনুপম যাঁর ঘশ রসায়ন গাওত জগত জানে ॥
বিপ্ৰকুলে ভুপ ভূবনে পূজিত অতুল আনন্দ দাতা।
যার তনু মন রঞ্জন নাজানি কি দিয়া করিল ধাতা।

[←3]

 চণ্ডিদাস নিজ কবিতায় এইরূপ লিখিয়াছেন:-

“ধৈরত নাহিক ভায়। বড়ু চণ্ডিদাস গায়।”

[←4]

 এই দেবতার প্রতিমূর্তি শিবোপরি চতুর্ভুজাকৃতি এক খণ্ড – খোদিত প্রস্তর।

[←5]

 “কহে চণ্ডিদাসে, বাশুলি আদেশে,
হেরিয়া নখের কোণে।
জনম সফলে, যমুনার কূলে,
মিলায়ল কোনজনে”

[←6]

 নরকরি দানের ভণিতায় এইরূপ দূর হয় :-

“শ্রীরাধাগোবিন্দ কেলী বিলাস যে বর্নিলা বিবিধ মতে।

কবিবর চারু নিরুপম, মহা ব্যাপিল নাহার গীতে।”

[←7]

 ‘‘এত কছি বিষাদ ভাবি বহু মাধব রোই প্রেমে, ভেলা ভোর

“তনয়ে বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস তথি পুরল ইহ রস এর”

[←8]

“.. ফুলিয়ার কৃতিবান গায় সুধাভাণ্ড। রাবণেরে মজাইতে বিধাতার কাণ্ড॥”

রামায়ণ, তারণ্যকাণ্ড।

[←9]

“ রামদরশনে মুনি, যান স্বর্গবাস। রচিল অরণ্যকাণ্ড দ্বিজ কৃত্তিবাস॥”

রামায়ণ, অরণ্যকাণ্ড।

[←10]

 আনুমানিক ১৫৬৯ খৃঃ অব্দে কৃত্তিবাস জীবিত ছিলেন। ইহাতে বোধ হইতেছে, তিনি কৃষ্ণদাস কবিরাজের সমকালবর্তী লোক।

[←11]

“সহর শিলিমাবাজ, তাহাতে সুজন রাজ,
নিবসে নিয়োগী গোপীনাথ।
তাহার তালুকে বসি, দামুন্যায় করি কৃষি,
নিবাস পুরুষ ছয় সাত॥”      

[←12]

 কীর্ত্তিচন্দ্র রায় এই সময়ে বর্দ্ধমানের রাজা ছিলেন

[←13]

 ইনি নিধুবাবু নামে বিখ্যাত।

[←14]

 ইনি মৃত নবব:পধিপতি সতীশচন্দ্র রায়ের পিতামহ

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন