ছায়াচরাচর – ৩১

সন্মাত্রানন্দ

একত্রিশ 

মাটির বেড়ার উপর খড়ের চালে সন্ধ্যামালতীর ঝাড় পল্লবিত হইয়া রহিয়াছে। বেড়ার গায়ে সেই আগের মতোই বাড়ির প্রধান ফটক। ফটকের সম্মুখে বাঁশঝাড় আরও ঘন হইয়াছে। বাঁশবাগানের ভিতর ক্ষুদ্র পুষ্করিণী শৈবালদামে আচ্ছন্ন হইয়া আছে। এইসব অতিক্রম করিয়া কমলনয়ন ফটক দিয়া গৃহপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করিল। কে একজন অল্পবয়সি বধূ প্রাঙ্গণ ঝাঁট দিতেছে। কমলনয়নকে দেখিয়াই ঘোমটা টানিয়া ঘরের ভিতর চলিয়া গেল। 

এইবার আর পদব্রজে নয়, ডুলিতে করিয়া কমলনয়ন বৃন্দাবন হইতে উনসিয়া আসিয়াছে। আসিতে প্রায় এক পক্ষকাল লাগিয়া গেল। পথে মধুমতী নদীটি পড়িল। এবার তো আর অপ্রসিদ্ধ পথে আসে নাই, প্রসিদ্ধ পথেই আসিয়াছে। খেয়ানৌকায় মধুমতী পার হইল। পুনরায় ডুলি। বুকের ভিতর কৃষ্ণকিশোর তাহার অঙ্গে অঙ্গে লাগিয়াই আছে। এতটা পথ; তবু পথশ্রমে ক্লান্ত হয় নাই। মনের ভিতর কেমন একটা নির্ভরতা ও প্রফুল্লতার ভাব। 

কমলনয়ন গৃহাঙ্গণে অপেক্ষা করিতেছিল। কিছুক্ষণ পর এক বৃদ্ধ বাহির হইয়া আসিলেন। যাদব। দাদা এত পরিণত বয়স্ক হইয়া গিয়াছে? প্রথমে কমলনয়নকে চিনিতে পারে নাই। বোধহয় ভাবিয়াছিল, গৈরিক ভাষায় পরিহিত কোনো ভিক্ষাপ্রার্থী সন্ন্যাসী। তাহার পর চিনিতে পারিয়া একেবারে জড়াইয়া ধরিল। 

“কমলনয়ন? তুই আসিয়াছিস? আমি যে কল্পনাও করিতে পারিতেছি না। সেই আসিলি, কিন্তু কত বিলম্ব করিয়া আসিলি রে! পিতা-মাতা উভয়েই স্বর্গগমন করিয়াছেন। আয়, গৃহের ভিতরে আয়। প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া থাকিস না।” 

দাদার সহিত কমলনয়ন ঘরের ভিতরে গেল। পিতা-মাতার স্বর্গারোহণের সংবাদে মন দমিয়া গেল। এইরূপই কিছু অনুমান করিয়াছিল। কিন্তু তাহা যে সাক্ষাৎ শুনিতে হইবে, ভাবে নাই। 

এই ঘর! শৈশবের কত স্মৃতি যে এসব কক্ষের সঙ্গে জড়ানো! ওই বাতায়নপার্শ্বে বসিয়া একদিন ধাতুপাঠ মুখস্থ করিত। এখন ভাবিলে অবাক লাগে। পিতা নিকটে বসিয়া শুনিতেন। কখনো-কখনো বাতায়নপথে চাহিয়া দেখিতে পাইত, জননী পুকুরঘাট হইতে ওই কাঠালগাছটার ছায়ায় স্নানান্তে ঘটকক্ষে ফিরিতেছেন। কাঁঠালগাছটা এখনও একইরকম আছে। মা যে কোথায় লুকাইল! 

কমলনয়নের চক্ষুদুটি কী এক অননুভূতপূর্ব বেদনায় ভিজিয়া আসে।

বলিল, “যিনি প্রাঙ্গণ ঝাঁট দিতেছিলেন, উনি কে? চিনিলাম না তো!” 

যাদব মৃদু হাস্যে বলিল, “সে অনেক কথা। কাশী হইতে দেশে ফিরিয়া অধ্যাপনা করিতেছি। দুয়েকটি শিষ্য জুটিল। মন্দ হইতেছে না। পিতামাতা প্রয়াণ করিলেন। বড়ো একা হইয়া গেলাম।” 

“এত বড়ো গৃহে তুমি একা?” 

“একাই তো। কেহ নাই। নিজে স্বপাক রাঁধিয়া খাই। তাহাতে দুঃখ ছিল না। কাশীতে বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর নিকট সন্ন্যাসের দুয়ার অবধি তো গিয়াছিলাম। মনে ভাবিতাম, গৃহে সন্ন্যাসীভাবেই থাকিব। সন্ন্যাস হয় নাই তো কী হইয়াছে? সে-জীবন তো ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করিয়াছি। ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কাহারও উপর নির্ভর করিতাম না। গৃহদেবতার পূজা, দুয়েকটি ছাত্রের অধ্যাপনা আর নিজের সাধনভজন লইয়াই ছিলাম।” 

“আহা! দাদা, তোমার একান্তবাসের কথা শুনিয়া আমারই লোভ হইতেছে।”

“হাঁ রে! ভালোই ছিলাম। কিন্তু একদিন দ্বিপ্রহরবেলায় এক কাণ্ড হইল।”

“কী কাণ্ড?” 

“দেখিতেছি কি, আমাদিগের গৃহসংলগ্ন উদ্যান হইতে কে একটি বালিকা ফুল পাড়িতেছে। এত ফুল লইতেছে দেখিয়া আমি বলিলাম, কে তুমি এত ফুল তুলিয়া লইয়া যাইতেছ? তাহা হইলে আমার পূজা হইবে কী প্রকারে? কিন্তু সেই বালিকা আমার কথায় কর্ণপাতও না করিয়া ফুল তুলিতে লাগিল।” 

“কী আশ্চর্য! তুমি একটা পরিণতবয়স্ক মানুষ, আর সে একটি ক্ষুদ্র বালিকা। তা সত্ত্বেও তোমার কথা শুনিল না?” 

“না, শুনিল না। তখন আমি তাহাকে ভয় দেখাইবার নিমিত্ত পরিহাসচ্ছলে বলিলাম, তুমি যদি আমার কথা না-শুন, তবে আমি তোমাকে বিবাহ করিয়া লইব।” 

“হাঃ হাঃ হাঃ! তখন সে থামিল?” 

“কই থামিল? আমি দুইবার, তিনবার তাহাকে বারণ করিলাম। সে তিনবারই আমার কথা অগ্রাহ্য করিল। তিনবারই আমি তাহাকে ভয় দেখাইবার নিমিত্ত, তোমাকে বিবাহ করিয়া লইব, বলিলাম।” 

“তাহার পর?” 

“আমি তিনবার ওই কথা বলামাত্র বেড়ার আড়াল হইতে বালিকার পিতা বাহির হইয়া আসিয়া আমার চরণযুগল জড়াইয়া ধরিল।” 

“কী উদ্দেশ্য?” 

“আরে, আমি তো আর জানি না বালিকার পিতা বেড়ার আড়ালে থাকিয়া আমার কথা শুনিয়াছে। সে-ব্যক্তি আমার চরণ জড়াইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, আমি সব শুনিয়াছি। আপনি ব্রাহ্মণ। ত্রিসত্য করিয়াছেন। আপনার কথা মিথ্যা হইতে পারে না।” 

“কী মুশকিল!” 

“মুশকিল বলিয়া মুশকিল! আমি যতই বলি, ও কথা আমি পরিহাসচ্ছলে বলিয়াছি, বালিকার পিতা ততই বলিতে থাকে, আপনি সত্য অঙ্গীকার করিয়াছেন। এক্ষণে সত্যরক্ষার্থ আপনার আমার কন্যাকে বিবাহ করা উচিত।” 

“হে প্রভু!” 

“জানি না, কী প্রভুর ইচ্ছা! আমাকে শেষাবধি সম্মত হইতেই হইল। কথা দিলাম, আমি তাহার কন্যাকে বিবাহ করিব। কিন্তু তখন আর-এক গোল বাঁধিল।” 

“কী হইল?” 

“দেখা গেল, কন্যাটি সর্বসুলক্ষণা হইলেও, তাহারা নীচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। আমি তো কন্যাটিকে বিবাহ করিলাম, কিন্তু এই লইয়া গ্রামের অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ আমাদের একঘরে করিয়া রাখিয়াছে।” 

“তবে তো সমস্যা! তোমাদের চলিতেছে কীরূপে?” 

“ওই চলিয়া যাইতেছে। ঈশ্বর যেমন রাখিয়াছেন, তেমনই আছি।” 

“তবে এই প্রাঙ্গণ-মার্জনকারিণীই আমার ভ্রাতৃবধূ?” 

“ঠিকই ধরিয়াছিস। উহার নাম নিস্তারিণী। এই নিস্তারিণী হইতে আমি আবার এক পুত্রসন্তান লাভ করিয়াছি। তাহার নাম গৌরীদাস।” 

“আচ্ছা!! সে কোথায়?” 

“ঘরে ঘুমাইতেছে। এখনও তোর আগমন সংবাদ পায় নাই। আমাদিগের জ্ঞাতিগণ তো আমাদের একঘরে করিয়াছে। এদিকে তোর বউঠাকুরানি উত্তেজিত হইয়া জ্ঞাতিদিগের উদ্দেশে সদর্পে এক কথা বলিয়া বসিয়াছে।” 

“কী বলিয়াছেন?” 

“বলিয়াছে, আপনারা তো আমাদের ঠেকো করিলেন। কিন্তু দেখিব আমার পুত্রকে আপনারা কীরূপে ঠেকাইতে পারেন। আমার পুত্র কৃতবিদ্য হইয়া আপনাদের সকল অভিযোগের উত্তর দিবে।” 

“বলো কী?” 

“হাঁ রে! এখন ওই এক কাজ। পুত্রটিকে উপযুক্ত বিদ্যায় শিক্ষিত করিয়া তুলা। যাহাতে আমাদের পিতা প্রমোদন পুরন্দরের পাণ্ডিত্যের ধারা সজীব হইয়া থাকে।”

“দাদা, কী আশ্চর্য! তুমি একদিন সন্ন্যাসী হইতে গিয়াছিলে। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা অন্যরূপ। তোমাকে কৌশলে সংসারে ধরিয়া রাখিলেন।” 

“তাহাই বটে!” এই বলিয়া যাদব কী যেন ভাবিতেছিল। তাহার পর সহসা খুবই সংকুচিত হইয়া সভয়ে বলিল, “কমলনয়ন! তুই তো সন্ন্যাসী—মায়িক সম্বন্ধের অতীত! তোর কি আমাদের গৃহে অবস্থান করা চলিবে?” 

কমলনয়ন বলিল, “দাদা! আমার সেসব সংস্কার উড়িয়া পুড়িয়া গিয়াছে। তবে আমার সহিত কৃষ্ণকিশোর আছে। আমাদের ভিটার সংলগ্ন বহির্বাটীতে অবস্থান করিলেই সুবিধা হয়।” 

যাদব অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কৃষ্ণকিশোর কে?” 

তখন কমলনয়ন ফতেহপুরের শিশোদিয়া রাজপুত পরিবার হইতে কৃষ্ণকিশোরকে আনয়ন প্রভৃতি তাহার সকল কথাই দাদাকে বলিল। বক্ষবিলগ্ন ঝুলির ভিতর হইতে কৃষ্ণকিশোরকে বাহির করিয়া যাদবকে দেখাইলও। 

যাদব সব শুনিয়া চমৎকৃত। ভাবিতে লাগিল, প্রেমের আকর্ষণে কে কোথায় যে বাঁধা পড়ে! 

তাহার পর সে বিস্ময়ের ভাব অপসারিত করিয়া যাদব শশব্যস্তে বলিল, “সে তো হইল। কিন্তু দেখ, এত কথা কহিলাম, তোর তো এখনও খাওয়াই হয় নাই।”

কমলনয়ন দ্রুত বলিল, “না, দাদা, আমি তো স্বপাক করিয়া কৃষ্ণকিশোরকে ভোগ দিই। তাহার পর কৃষ্ণের প্রসাদ গ্রহণ করি।” 

এই কথা বলিবামাত্রই গৃহের অন্তরাল হইতে সুবিনীত কিন্তু মধুর নারীকণ্ঠ ভাসিয়া আসিল, “সেটি হইবে না। অন্তত আজিকার দিনটিতে সেবা করিবার অধিকার দিতে হইবে। আমি ঠাকুরের ভোগ রাঁধিয়া পাঠাইয়া দিতেছি। কাল হইতে না হয় স্বপাক।” 

যাদব এই কথার সস্মিত সম্মতিজ্ঞাপন করিয়া কমলনয়নের দিকে চাহিল। তাহার পর কহিল, “তবে আর দেরি নয়। পুকুরঘাট হইতে ডুব দিয়া আয় দেখি। বেলা হইয়াছে।” 

কত কত যুগ পর কমলনয়ন খেজুরের মাজা দিয়া প্রস্তুত শৈশবের সেই প্রাচীন পুকুরের ঘাট বাহিয়া জলে নামিল। জলতল নিঃসাড় হইয়া শুইয়া আছে। কমলনয়নের গাত্রে ঘা দিয়া গম্ভীর ভারী ঢেউগুলি সেই শান্ত জলতলের উপর দিয়া পরপারের দিকে চলিয়া গেল। পুকুরের চারিপাশে তেঁতুল, আম ও কাঁঠালের গাছগুলি জড়ামড়ি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। মাথার উপর নীল আকাশটা উপুড় হইয়া শুইয়া আছে। জলের উপর শেওলার দল নাচিতেছে। সেই শৈবালদাম সরাইয়া কমলনয়ন দেখিল স্বচ্ছ শীতল নীরে উপরের আকাশের ছায়া পড়িয়াছে। মনে হইল, যেন একটা অঙ্গুরীয়কের রত্নের উপর চোখ রাখিলে তাহার ভিতরটা যেমন অনড় স্বচ্ছ দেখায়, এ পুষ্করিণীর জলতলও সেইরূপ। দুই হস্তে জলের উপরিতল সরাইয়া কমলনয়ন জলের ভিতর ডুব দিয়া চোখ খুলিল। সেই সুদূর বাল্যকালে এইরূপ খেলা খেলিত। আজও সেইরূপ করিল। দেখিল, পুকুরের নিম্নে জলস্তর শৈশবেরই ন্যায় সবুজ অন্ধকার দেখাইতেছে। আর সেই আঁধার পটভূমিকায় জলের বুদ্বুদ নীচ হইতে উপরে উঠিতেছে। যত উপরে উঠে, তত তাহাদের আয়তন বিবর্ধিত হইয়া যায়। ভাবিতেছিল, তাহার জীবনও কি ওইরূপ নয়? সে যেন জীবনের একটুখানি বাতাস। এ গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনবৃত্তের নিম্নে সে চাপা পড়িয়াছিল। তখন সে ক্ষুদ্র; তাহার পর তাহার জীবনের বাতাস ওই বুদ্বুদেরই ন্যায় ধীরে ধীরে আয়তনে বিবর্ধিত হইয়া উপরে উঠিতেছে। যতক্ষণ না উপরের বায়ুস্তরের সহিত মিলিয়া অসীম হইয়া যায়, ততক্ষণ তাহার মুক্তি নাই। 

ঘাট হইতে স্নান সারিয়া ফিরিতে ফিরিতে তাহার মনে হইল, এই তাহার গ্রাম। পুকুর হইতে ফিরিবার এই আম-কাঁঠাল-তেঁতুলের ছায়ায় ছাওয়া পথ দিয়া যুগের পর যুগ তাহার পুর্বপুরুষগণ মধ্যাহ্নবেলায় স্নানান্তে ফিরিয়া আসিয়াছেন। তাঁহাদের পদচিহ্নের উপাখ্যান পুকুরের পাড় হইতে মুছিয়া গিয়াছে। এই যে সে ভিজা পায়ে পুকুরপাড় দিয়া চলিয়া যাইতেছে, এক মুহূর্ত পরেই তাহারও সিক্ত পদচিহ্ন মুছিয়া যাইবে। তবু এই মুহূর্তটি একান্ত মিথ্যা নহে। ইহা পূর্বজদিগের উপাখ্যানের অনুষঙ্গে রচিত নুতন একটা অধ্যায়। এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাখ্যানের অস্ফুট কলিকা লইয়াই এক-একটি আখ্যানপুষ্পের গুচ্ছ, উপাখ্যানমঞ্জরী রচিত হইতে চলিল। কোনো পুথিতে ইহা লিখিত হইয়া রহিবে না, ইহা রহিয়া যাইবে মানবমনের আলো-অন্ধকারময় নিশাভাগে। পুকুরের জলতলে যেমন সবুজ অন্ধকার স্তম্ভিত হইয়া আছে, তেমনই সমষ্টি মানবের চিত্তের অন্তরতম প্রদেশে এমনই কত কথাকাব্য অদৃশ্য অক্ষরে লিখিত হইয়া রহিয়াছে। উহাতে পিতা প্রমোদন পুরন্দর কিংবা তাঁহার পূর্বপুরুষদের কথা যেমন লিপিবদ্ধ আছে, তেমনই কমলনয়নের জীবনেতিহাসও ইহাতে লিপিবদ্ধ হইতেছে, আবার দাদা যাদবের পুত্র গৌরীদাসের কথাও উহাতেই লিপিবদ্ধ রহিবে। মানব উহা সচেতনভাবে পাঠ করে না ঠিকই, কিন্তু অগণিত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া, প্রভাতের আলো, সায়াহ্নের অন্ধকার, মধ্যরাত্রির নৈঃশব্দ্য, মধ্যদিনের নিরাকার রৌদ্রের ধারার ভিতর দিয়া, ওই সকল অনাদি অতীতের কথামঞ্জরী মানবের মনে নিরাসক্ত উদাস ভঙ্গিমায় প্রবেশ করিয়া থাকে; মানুষ জানে না কবেকার কোকিলের ডাক, কবেকার শিউলি ফুলের গন্ধ, কবেকার দুরাকাশ হইতে নামিয়া আসা নক্ষত্রের আলোক তাহার চিত্তের ভিতর, তাহার সত্তার ভিতর প্রবেশ করিয়া মিশিয়া যাইতেছে। উহাই তো মানবের সম্পূর্ণ ইতিহাস! পুথির পাতায় আর কী জ্ঞান থাকে? উহা তো মানবের চিন্তার খণ্ড খণ্ড প্রকাশ। উহার জীবনীশক্তি বড়ো অল্প। উহা লেখনীপ্ৰসূত কিংবা মস্তিষ্কপ্রসূত হইতে পারে, কিন্তু উহা রক্তবীজ নহে, আত্মবীজ নহে। কিন্তু এই যে জ্ঞানের পরম্পরার ইতিহাস নিঃশব্দে নিরবয়ব অক্ষরে লিখিত হয়, এই যে কত প্রভাতের প্রসূন, কত অমিতাভ জ্যোৎস্নার আলোক, কত সন্ধ্যামালতীর সুগন্ধ যে পূর্বপুরুষদিগের আশীর্বাদ হইয়া অনুপ্রেরণা হইয়া মানবের চলার পথকে সুগম করিয়া তুলে, কত আয়ুদ প্রার্থনায় তাহার ভবিষ্যতের চলার পথে বকুলরেণু ছড়াইয়া যায়, ইহা কে সচেতনভাবে অনুভব করে? তথাপি, এই বহু যুগ পরে গৃহসংলগ্ন পুষ্করিণীতে স্নান করিতে যাইয়া যেমন হইল, তেমনই কোনো কোনো তন্ময় মুহূর্তে এই বোধ— এই অপরিমেয় কৃতজ্ঞতার করুণাঘন অনুভূতি মানুষের হৃদয়কে অভিভূত করিয়া যায়, তাহার অনির্বচনীয়তাই কমলনয়নের মনকে পূজার পূর্বে সঘন ধূপের সুগন্ধে যেন আবিষ্ট করিয়া তুলিল। মনে হইল, ইহারই ভিতর এক পরিপূর্ণতার মূর্তি তাহার হৃদয়ের পূজার আসনে আসিয়া বসিয়াছে। হয়তো সেই বিশ্বজীবনের জগদ্বন্দ্য সুগম্ভীর উপাস্য দেবতাই এইবার সকল সম্ভ্রমের দূরত্ব ঘুচাইয়া অপার্থিব প্রেমের আলোকে তাহার কৃষ্ণকিশোর হইয়া আসিয়াছে। 

.

সেই দিন বিকালবেলায় প্রচণ্ড ঝড় উঠিল; অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ একাকার করিয়া দেওয়া এক অপার্থিব ঝড়! 

সকল অধ্যায়

১. ছায়াচরাচর – ১
২. ছায়াচরাচর – ২
৩. ছায়াচরাচর – ৩
৪. ছায়াচরাচর – ৪
৫. ছায়াচরাচর – ৫
৬. ছায়াচরাচর – ৬
৭. ছায়াচরাচর – ৭
৮. ছায়াচরাচর – ৮
৯. ছায়াচরাচর – ৯
১০. ছায়াচরাচর – ১০
১১. ছায়াচরাচর – ১১
১২. ছায়াচরাচর – ১২
১৩. ছায়াচরাচর – ১৩
১৪. ছায়াচরাচর – ১৪
১৫. ছায়াচরাচর – ১৫
১৬. ছায়াচরাচর – ১৬
১৭. ছায়াচরাচর – ১৭
১৮. ছায়াচরাচর – ১৮
১৯. ছায়াচরাচর – ১৯
২০. ছায়াচরাচর – ২০
২১. ছায়াচরাচর – ২১
২২. ছায়াচরাচর – ২২
২৩. ছায়াচরাচর – ২৩
২৪. ছায়াচরাচর – ২৪
২৫. ছায়াচরাচর – ২৫
২৬. ছায়াচরাচর – ২৬
২৭. ছায়াচরাচর – ২৭
২৮. ছায়াচরাচর – ২৮
২৯. ছায়াচরাচর – ২৯
৩০. ছায়াচরাচর – ৩০
৩১. ছায়াচরাচর – ৩১
৩২. ছায়াচরাচর – ৩২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন