ছায়াচরাচর – ১৬

সন্মাত্রানন্দ

ষোলো 

নিস্তব্ধ মধ্যরাত্রির বিজন প্রহর ভরিয়া উন্মুক্ত বাতায়নপার্শ্বে উৎপলদৃষ্টি বাঁশিতে এক সকরুণ রাগিনীর আলাপ করিতেছিল। সুরটি নূতন — ‘শিবরঞ্জনী’। সরযূবাই পিল্লাইয়ের হাত ধরিয়া এই রাগ দক্ষিণদেশ হইতে আর্যাবর্তে প্রবেশ করিয়াছে। সহজ, অনাড়ম্বর চলন, কিন্তু হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গিয়া বিঁধে। অন্তরের সুগভীর বিরহবেদনা, ফেলিয়া আসা দিনগুলির প্রতি স্মৃতিকাতরতা বাঁশির সুরের সহিত মিশিয়া গবাক্ষপথ বাহিয়া রাত্রির আকাশ যেন ভরিয়া দিতেছিল। কত কথা মনে আসিতেছিল… হারানো সেই গ্রামদেশ… নবদ্বীপের গঙ্গাতীর… যাঁহার ভালোবাসায় উৎপলদৃষ্টি ঘর ছাড়িয়াছিল, তাঁহার দর্শন মিলিল না… চিরবিচ্ছেদের সেই বেদনা বাঁশির সুরে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিল। কাজলকালো অন্ধকারের গাত্রে সুর হাত বুলাইতেছিল। কক্ষের একপার্শ্বে ম্লান প্রদীপের ক্লান্ত শিখা সুরের আঘাতে বুঝি-বা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিল, প্রহরকাল হৃদয় মথিত করিয়া নিঃশব্দ অশ্রুপাতের বেদনার ভিতর নামিয়া অবশেষে সুর আসিয়া থামিয়া গেল। 

অবসিত মূর্ছনার আবেশের ভিতর প্রদীপের ম্লান আলোকে উৎপল দৃষ্টি বাঁশি কোলে আচ্ছন্ন দশায় আরও কিছুক্ষণ বসিয়া আছে, এমন সময়ে সহসা পশ্চাতে কার একটি সুগোপন দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনিতে পাইল। 

উৎপলদৃষ্টি ঘাড় ফিরাইয়া চাহিয়া দেখিল, কক্ষে আর কেহ নাই। তাহা হইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলিল কে? কেহ কি এ কক্ষে আসিয়াছিল? উৎপলদৃষ্টি শিহরিয়া উঠিল। শয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কক্ষের বাহিরে গেল। নির্জন অলিন্দ ধবল চন্দ্রালোকে ধপ্ করিতেছে। কেহ কোথাও নাই। 

মনের ভুলই হইবে। সুরের আবেশে কত কী যে মনে হয়! এই লইয়া সে আর ভাবিল না। প্রদীপ নিভাইয়া শুইয়া পড়িল। নিদ্রা আসিতে বিলম্ব হইল না। 

শেষরাত্রে উৎপলদৃষ্টি কী একটা স্বপ্ন দেখিতেছিল। মধুর স্বপন! কে যেন ফুলদল লইয়া তাহাদের গ্রামে সুদূর শৈশবের রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরে পূজা দিতেছে। অগুরু চন্দনের ঘ্রাণে দেবীর কুঙ্কুমবিলেপিত আননের সুমধুর হাস্যে মন্দির ভরিয়া উঠিতেছে। তাহার পর সে-দৃশ্য যেন কোথায় হারাইয়া গেল, সকল অবয়ব মুছিয়া স্বপ্নলোক জুড়িয়া শুধু এক নিরবয়ব গন্ধমধুর অন্ধকার বিরাজ করিতেছে… সেই অন্ধকারের ভিতর কাহার যেন নূপুরের ঝুম্ ঝুম্ শব্দ হইতেছে, কে যেন নুপুর বাজাইয়া চলিয়া যাইতেছে… সেই নিক্কণধ্বনির ভিতর ঘুম ভাঙিল। 

ঘুম ভাঙিল, কিন্তু তখনও আলস্যভরে শয্যা হইতে উৎপলদৃষ্টি উঠে নাই। শয্যার সমীপে জলপাত্র ছিল, দুই হাতে ঘটিটি তুলিয়া ধরিয়া সে জলপান করিল। উপাধানের পার্শ্বে চিত্রিত বংশীটি পড়িয়া আছে, তাহা লইয়া একবার নাড়াচাড়া করিল, ভাবিতেছিল বাঁশিতে ফুঁ দিবে কি না, এমন সময়ে এক অদ্ভুত শব্দে সচকিত হইয়া উঠিল। 

ঝুম্-ঝুম্, ঝুম্-ঝুম্! নূপুরের শব্দ! উৎকর্ণ হইয়া শুনিবার প্রয়াস করিল। অলিন্দ বাহিয়া সোপানশ্রেণীর মধ্য দিয়া কে যেন নূপুর পরিয়া নামিতেছে। কখনও শব্দ কাছে আসিতেছে, কখনও দূরে সরিয়া যাইতেছে। এ যে সেই ক্ষণপূর্বে অনুভূত স্বপ্নের মতো হইল। স্বপ্ন নয়? বাস্তব? কে তাহার কক্ষের চারিপাশে নুপুর পরিয়া ঘুরে? 

শয্যা হইতে উঠিয়া সে কক্ষের বাহিরে আসিল। ভোরের কুসুম-মায়াবী অস্ফুট আলোকে কেবল শূন্য অলিন্দ ভরিয়া আছে। উৎপলদৃষ্টি নিতান্ত হতবাক হইয়া গেল। 

আর-একদিন। ভোর হইয়া আসিতেছিল। দ্বারের দিকে পিছন ফিরিয়া ও বাতায়নের দিকে মুখ ফিরাইয়া উৎপলদৃষ্টি বাঁশিতে ললিত রাগ বাজাইতেছিল। প্রভাতবেলায় কোমল সুর কৈশোরের প্রথম প্রণয়ের লাজনম্রতায় ফুটিয়া উঠিতেছিল। যেন উদ্যানে কত প্রভাতপ্রসূন ফুটিয়াছে, ভোরের আলো গায়ে মাখিয়া প্রিয় এখনই ঘরে ফিরিয়া আসিবে, কোকিলের কুহুতানে বসন্তবিতান ভরিয়া উঠিল, স্নিগ্ধ মলয়ানিল বীরুৎ- গুল্ম-বনস্পতির শিরোদেশে করস্পর্শ বুলাইয়া দিতেছে। ‘পিউ পিউ পাপিয়া রা বোলে’…তীব্র ও শুদ্ধ মধ্যম পরপর আসিতেছে, মধ্যম ও ধৈবতের সংযোগে মাধুর্য যেন ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে উৎপলদৃষ্টি নিমীলিত চক্ষুদুইটি একবার চকিতে মেলিয়া ধরিল। অমনি অবাক হইয়া দেখিল, ঘরের দেওয়ালে কাহার যেন ছায়া পড়িয়াছে! দ্রুত ফিরিবামাত্র দেখিল, কে যেন দ্বারের নিকট হইতে সরিয়া গেল। কে সে, বুঝা গেল না। বাঁশি ফেলিয়া ঘরের বাহিরে আসিল। অলিন্দপথ একইরকম জনহীন! 

কেহ চুরি করিয়া তাহার বাঁশি শুনিতেছে। কিন্তু ধরা দিতে চাহিতেছে না। উৎপলদৃষ্টির মনে হইল, কেন জানি না মনে হইল, যে আসিয়াছিল, সে নর নহে— নারী! সে এইখানেই কোথাও থাকে। সুরের পাগল! সুর শুনিলে অস্থির হইয়া উঠে। কিন্তু কে সে সুরমুগ্ধা হরিণী? 

বেলা হইলে সে মেহবুবকে জিজ্ঞাসা করিল, “মেহবুব! এই হাভেলিতে কি কোনো রমণী বাস করেন?” 

মেহবুব আকারে-ইঙ্গিতে যাহা বলিল, তাহার অর্থ হইল: “না না! হাভেলিতে নারী আসিবে কোথা হইতে? এখানে তুমি আমি, আমাদিগের মুর্শিদ আর কয়েকজন পুরুষ পরিচারক ভিন্ন কেহ বাস করে না।” 

উৎপলদৃষ্টি তবুও আবার বলিল, “ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখ, মেহবুব! এমন কি কোনো যুবতী আছে, যে সুর শুনিতে বড়ো ভালোবাসে?” 

মেহবুব এইবার নিজের মস্তক ধরিয়া যাহা বলিল, তাহার নির্গলিতার্থ : “তোমার কি মাথা খারাপ হইয়াছে? একা একা থাকিতে থাকিতে মেয়েমানুষের খোয়াব দেখিতেছ? জেনানা-বাই হইয়াছে? সেরূপ কাশীতে বহু জন আছে, বলো তো লইয়া যাই!” 

মেহবুবের সহিত বাক্যালাপ বৃথা। সে তাহার সমস্যা বুঝিতেছে না। হাভেলিতে নিশ্চয়ই কেউ আছে। কোনো সংগীতমুগ্ধা যুবতী! ইহারা তাহার কথা তাহাকে বলিতেছে না। ইহা নিশ্চয়ই ইহাদের একটা গোপন ব্যাপার। যাহাই হউক, সেই নারী তাহার বাঁশির প্রতিটি সুর শুনে, সুর শুনিবার জন্য তাহার কক্ষের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়ায়। তাহাকে অবশ্যই খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। শ্রোতা না হইলে কি আর সুর তৃপ্তি পায়? এই হাভেলি সে তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া দেখিবে। এখন হইতে সর্বদা সজাগ থাকিতে হইবে। 

খুঁজিয়া দেখিল। হাভেলির ঘরগুলি প্রায়শই অব্যবহৃত, কিংবা ব্যবহার হইলেও বহু পূর্বে হইত। এখন বেশিরভাগ ঘরেই তালা দেওয়া। কেহ থাকে না। কক্ষে কক্ষে খুঁজিল, সিঁড়ির নীচে খুঁজিল, হাভেলির আশপাশে সর্বত্র খুঁজিল, এমনকি হাভেলির ছাদেও গিয়া খুঁজিয়া দেখিল। কোনো রমণীর বসবাসের চিহ্নমাত্র নাই। কেবল শুষ্ক বালুচরের ভিতর এই বৃহৎ বিজন হাভেলি অতিকায় পৌরাণিক রাক্ষসীর ন্যায় হস্তপদ প্রসারিত করিয়া পড়িয়া আছে। 

তাহার পর দু-এক মাস সেইরূপ আর কিছু হইল না। উৎপলদৃষ্টি বাঁশি বাজায়, কিন্তু অপর কাহারও অস্তিত্ব আর অনুভব করে না। হয়তো মাথার খেয়াল ছিল— হয়তো মেহবুবের কথাই ঠিক—একা একা থাকিতে থাকিতে অন্তর নারীসান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল হইয়াছিল—এই সব সাতপাঁচ ভাবিয়া উৎপলদৃষ্টি এ বিষয়ে মনোযোগ প্রদান বন্ধ করিয়া দিল। 

শ্রাবণ আসিয়া পড়িল। আকাশে মেঘ ঘন হইয়া থাকে। দিনের বেলাতেও কক্ষ অন্ধকার হইয়া থাকে। গবাক্ষপথে শূন্যপানে তাকাইয়া উৎপলদৃষ্টি দেখে, আকাশ নীলমেঘভারে আকুল হইয়া আসিতেছে। তাহার নিম্নে হাভেলিসংলগ্ন উদ্যানের লতাগুল্মগুলি আশ্চর্য সবুজ হইয়া থাকে। দূর হইতে দেখা যায়, গঙ্গা জলভারে ফুলিয়া ফাঁপিয়া গর্ভিণী নারীর ন্যায় বিলম্বিত লয়ে বহিয়া যাইতেছে। কতগুলা জলচর পক্ষী নদীর উপর দিয়া উচ্চকিত স্বরে ডাকিতে ডাকিতে পরপারের দিকে যাইতেছে। কিছু পরেই গঙ্গার দিক হইতে লক্ষ অশ্বক্ষুরশব্দে হুমড়ি গুমড়ি বৃষ্টির ধারা আসিতেছে। 

এমনই একদিন বর্ষামুখর সন্ধ্যায় প্রদীপের আলোয় কোনোমতে দুইটা চালে ডালে সিদ্ধ করিয়া উৎপলদৃষ্টি কক্ষের একপার্শ্বে বসিয়া রাত্রির আহার সারিয়াছে। সমস্ত দিন বৃষ্টি ঝরিয়াছে। এখনও বর্ষণের ক্ষান্তি নাই। হাভেলির পশ্চাতে যে- বেণুবন আছে, সেখান হইতে ভেকের ঘর্ঘর উঠিয়া আসিতেছে। আজ বৈকালে সে এনায়েৎ খাঁর কক্ষে গিয়াছিল। কিন্তু তাঁহাকে তথায় পাইল না। শুনিল, তিনি সরযূবাইয়ের কোঠিতে গিয়াছেন। ফিরিতে রাত্রি হইবে। 

প্রদীপের আলো সামান্য স্তিমিত করিয়া উৎপলদৃষ্টি শয্যার উপর আসনপিঁড়ি হইয়া বসিল। দুই হস্তে বাঁশিটি সামান্য আনত করিয়া ধরিয়া ফুঁ দিল। গবাক্ষপথে বৃষ্টির ছাট আসিতেছে। সেদিকে তাহার হুঁশ রহিল না। 

রাত্রির বর্ণময় অন্ধকারে মল্লার রাগ বাজিয়া উঠিতেছে। সৃষ্টি-উন্মুখী অঙ্কুরগুলি মৃত্তিকার তলদেশ হইতে জাগিয়া উঠিতেছে। মেঘগর্জনের সহিত আচম্বিত বিদ্যুতের শিখা আকাশপটে নাচিয়া উঠিল। উৎপলদৃষ্টি তন্ময় হইয়া বাঁশির সুরের ভিতর ডুবিয়া গেল। 

এমন সময়ে কেমন জানি তাহার মনে হইল, কণ্ঠদেশে কী যেন উত্তপ্ত স্পর্শ লাগিতেছে! যেন অনেকক্ষণ ধরিয়া সেই উত্তাপ কণ্ঠ বেড়িয়া আছে, গাত্রে উত্তরীয় জড়াইয়া বসিয়াছিল বলিয়া সে খেয়াল করে নাই। সুর শরীর হইতে মনকে বাহির করিয়া লইয়াছিল বা! কিন্তু এ কথা খেয়াল করিবামাত্রই দেহে মন ফিরিল, মনে হইল সেই স্পর্শ বড়ো স্পষ্ট! চক্ষু দ্রুত উন্মীলিত করিয়া তাকাইয়া দেখিল, কাহার যেন দুটি পেলব বাহুলতা তাহার কণ্ঠ ঘিরিয়া পিছন হইতে তাহাকে মধুর আলিঙ্গনে জড়াইয়া রাখিয়াছে! 

পা হইতে মাথা পর্যন্ত বিদ্যুতের শিহরের ন্যায় দেহ শিহরিয়া উঠিল। ফিরিয়া তাকাইবা মাত্র, কে যেন এক ফুঁয়ে প্রদীপের শিখা নিভাইয়া দ্রুতপদে ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া গেল। আর সেই নূপুরের ঝুম্ ঝুম্‌ শব্দ। 

সে আসিয়াছিল। আর কোনো ভুল নাই। তাহাকে পিছন হইতে গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার সুর শুনিতেছিল! এইবার সে খুজিয়া লইবেই লইবে। আর তাহাকে ভুলানো যাইবে না। 

পরদিন প্রভাতবেলায় সে এনায়েৎ খাঁর কক্ষে উপস্থিত হইয়া আনুপূর্বিক সকলই নিবেদন করিল। শিবরঞ্জনী রাগের অন্তে সেই কাহার নিঃশ্বাস পতনের শব্দ, ভোরবেলার তন্দ্রাজড়িমার ভিতর নূপুরের নিক্কণ, ললিত রাগ বাজাইতে বাজাইতে দেওয়ালের উপর কাহার যেন ছায়া সরিয়া যাওয়া, তাহার পর কাল রজনীতে মল্লারের আলাপের ভিতর কাহার দুটি করপল্লবের আলিঙ্গন… সকলই বলিল। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল, “এই হাভেলিতে কে সে যুবতী এমন করিয়া আমার সুর শুনে?” 

এনায়েৎ খাঁ সব শুনিয়া অনেকক্ষণ স্থির হইয়া চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া রহিলেন। তাহার পর ধীরে ধীরে গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “বেটা! তোমার ন্যায় ভাগ্যবান এ দুনিয়াতে আর কেহ নাই। আবার তোমার ন্যায় দুর্ভাগাও কেহ এ জগতে বড়ো একটা নাই!” 

উৎপলদৃষ্টি কহিল, “কী বলিতেছেন, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না!” 

এনায়েৎ বলিলেন, “বলিলে বিশ্বাস করিবে কি না, জানি না। এ হাভেলিতে কোনো নারী বসবাস করে না। নারী আসিবার কোনো সম্ভাবনাও নাই।” 

“তাহা হইলে আমি যে স্পষ্ট শুনিলাম, … তাহার পর দেখিলামও! ইহা তো আমার মনের ভুল হইতেই পারে না। কে সে?” 

এনায়েৎ স্বকর্ণমূল স্পর্শ করিয়া বলিলেন, “আমার মুর্শিদ সুলেইমান খাঁর নিকট একটি কথা শুনিয়াছিলাম। বড়ো গোপন কথা। আজ সময় হইয়াছে, তাই তোমাকে বলিতেছি। শিল্পী যখন সুরের ভিতর এত তন্ময় হইয়া যায়, তখন সুরসরস্বতী সেই নিমগ্ন সুরসাধক কলাবতের প্রেমে পড়িয়া যান। তাহাকে ছাড়িয়া থাকিতে পারেন না। শিল্পীর আকর্ষণে দেবী সুরলোক হইতে মর্তলোকে নামিয়া আসেন। অথচ, তাঁহার প্রেম এত সূক্ষ্ম, এমন মেধাবী যে, তিনি কলাবতকে ধরাও দেন না। সারে জিন্দেগি কলাবত তাঁহাকে খুঁজিয়া খুঁজিয়া সুরের পর সুর সৃষ্টি করিয়া মরে… তাই বলিতেছি, তোমার মতো ভাগ্যবান যেমন কেহ নাই, তোমার মতো দুর্ভাগাও দুনিয়ায় বিরল!” 

উৎপলদৃষ্টি হাহাকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “আমি কি তাঁহাকে কখনও পাইব না?” 

“নাহ, কখনও না। ওই একটু ছায়া, ওই একটু নূপুরের আওয়াজ, ওই একটু দীর্ঘশ্বাস, ওই একটু স্নেহকরুণ স্পর্শ। আর কিছু না।” 

“আর কিছু না?” 

“আর কিছু না। ইহাই। ইহাই তোমাকে রাগ হইতে রাগান্তরে লইয়া যাইবে। তোমার বাঁশি ভরিয়া সুর আসিবে। অথচ হৃদয় বিরহের শূন্যতায় গুমরাইয়া মরিবে।” 

“আমি এখন তবে কী করিব?” 

“যাহা করিতেছ, করিয়া যাও। শুধু সর্বক্ষণ স্মরণে রাখিও, তোমার আশপাশেই তিনি আছেন। তোমার সুর শুনিতেছেন। ইহাতে বিরহবেদনা হয়তো সামান্য সহনীয় হইবে।” 

সেই দিন হইতে উৎপলদৃষ্টির জীবন অন্যরূপ হইয়া গেল। সে এখন বাজায়, তিনি শুনিবেন বলিয়াই। টের পায়, কে একজন দ্বারপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। খাইতে বসিলে মনে হয়, কে যেন খাওয়াইয়া দিতেছে। তৃষ্ণার্ত হইলে মনে হয়, কে যেন পান করাইতেছে। গঙ্গায় স্নান করিতে নামিলে মনে হয়, গঙ্গার ঢেউয়ের ভিতর কে যেন তাহার সর্বাঙ্গ জড়াইয়া ধরিয়াছে। প্রখর নিদাঘতাপে ঘর্মাক্ত হইলে মনে হয়, কে স্নেহভরে তাহার কপালের স্বেদবিন্দু বায়ু হইয়া মুছাইয়া দিতেছে। ঘুমাইলে মনে হয়, স্বপ্নের ভিতর কে যেন আলোর শতদল মেলিয়া ফুটিয়া আছে। জাগরতন্দ্রার সীমালগ্ন দেশে নির্জন মায়াকুটিরের দ্বারপ্রান্তে বসিয়া কে যেন অপরূপ চম্পকাঙ্গুলির মুদ্রায় বীণা বাজাইতেছে। মধ্যনিশীথের নৈঃশব্দ্য ভাঙিয়া কাহার দুটি ললিত চরণ বাজিয়া চলিতেছে, ঝুম্-ঝুম্, ঝুম্-ঝুম্! 

মন বলে, কখনও কি পাইব না? সুলেইমান খাঁ তো বলিয়াছিলেন, কাহাকেও তিনি ধরা দেন না। মন বুঝিলেও প্রাণ তো বুঝে না। প্রাণ খরতপ্ত আকাশের চাতকের ন্যায় অবুঝ স্বরে বলে, পাইব, পাইব! সবার ক্ষেত্রেই একই নিয়ম হইবে কেন? আমাকে সে নিশ্চিত ধরা দিবে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলেই এখনই দেখা পাইল বলিয়া। কিন্তু দেখা সে পায় না। দিনের পর দিন চলিয়া যায়, শূন্য গগনতলে প্রেমার্ত প্রাণ অতৃপ্ত পিপাসায় তাপদগ্ধ বিহঙ্গমের ন্যায় ব্যাকুল আর্তনাদ করিয়া ফিরে! 

একদিন মধ্যাহ্নে এক নিদারুণ সংবাদ হাভেলিতে আসিল। সরযূবাই গঙ্গার ঘাটে স্নান করিতে গিয়া পড়িয়া গিয়াছেন। সঙ্গিনীগণ কোনোমতে ধরিয়া ধরিয়া তাঁহাকে কোঠিতে আনিয়াছে। 

তাকে ও মেহবুবকে সঙ্গে লইয়া এনায়েৎ খাঁ সত্বর সরযূবাইয়ের কোঠিতে উপস্থিত হইলেন। সরযূবাই তাঁহার ছোটো খাটটিতে শুইয়া আছেন। বৈদ্য আসিয়াছেন। পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, কটিদেশে আঘাত লাগিয়া ভাঙিয়াছে। ঔষধ ও মালিশের ব্যবস্থা করিয়া গেলেন। এনায়েৎ খাঁ কিয়ৎকাল পরে উৎপলদৃষ্টি ও মেহবুবকে হাভেলিতে ফিরিতে বলিলেন। তিনি সরযূবাইয়ের শয্যাপার্শ্বে রহিয়া গেলেন। 

সন্ধ্যায় হাভেলিতে বসিয়া উৎপলদৃষ্টি খবর পাইল, জ্বর প্রবল হইয়াছে। সরযুবাইয়ের অবস্থা ভালো নয়। সে একাই কোঠিতে সরযূবাইকে দেখিতে চলিল। 

কোঠিতে উপস্থিত হইয়া সরযুবাইয়ের শয়নকক্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াইয়া প্রবেশ করিবে কি না ইতস্তত করিতেছে, এমন সময়ে কক্ষের ভিতর হইতে সে দুইজন নারীপুরুষের কথোপকথন শুনিতে পাইল। 

পুরুষকণ্ঠ বলিতেছে, “তুমি অস্থির হইও না, সরযূ। কল্য অবশ্যই সুস্থ হইয়া যাইবে।” 

নারী স্নানকণ্ঠে বলিতেছে, “কেন মিথ্যা আশ্বাস দিতেছ, এনায়েৎ? আমি শুনিয়াছি, কোমরে হাড় শতচূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আর আমি ভালো হইব না। আর ভালো হইয়াই কী হইবে? আর তো নাচিতে পারিব না।”

এনায়েৎ বলিলেন, “কিন্তু আমি যে বলিয়াছিলাম, বাঁশি যতদিন বাজিবে, ঘুঙুরে বোল যেন ততদিন উঠে।” 

সরযূ গাঢ় কণ্ঠে বলিলেন, “ঘুঙুর কি তার বাঁশুরীকে পাইয়াছে!” 

কক্ষের অভ্যন্তরে আর কোনো কথা নাই। যেন হাহাকারময় একটা বাতাস আসিয়া সব কথা ডুবাইয়া দিয়াছে। 

পরদিন এনায়েৎ খাঁ হাভেলিতে ফিরিয়া আসিলেন। সরযূবাইয়ের জ্বর ছাড়িয়া গিয়াছে। এবারের মতো বোধহয় সুস্থ হইয়া উঠিলেন। 

মধ্যাহ্ন চলিয়া গিয়া অপরাহ্ণ আসিতেছে। উৎপলদৃষ্টি নিজ কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া সোপানমার্গে চবুতরায় নামিয়া আসিয়া পার্শ্ববর্তী অট্টালিকার দ্বিতলে এনায়েৎ খাঁর কক্ষে গেল। এনায়েৎ তাহাকে নূতন একটি সুর বাঁশিতে তুলিয়া দিবেন। 

প্রাক্সন্ধ্যায় খবর আসিল, সরযূবাই আর নাই। কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি অন্তিম নিঃশ্বাস ফেলিয়াছেন। 

এনায়েৎ খাঁ বাঁশি বাজাইতেছিলেন। তাহারই মধ্যে খবর আসিল।

বাঁশি থামিয়া গেল। আর কখনও বাজিল না। 

সকল অধ্যায়

১. ছায়াচরাচর – ১
২. ছায়াচরাচর – ২
৩. ছায়াচরাচর – ৩
৪. ছায়াচরাচর – ৪
৫. ছায়াচরাচর – ৫
৬. ছায়াচরাচর – ৬
৭. ছায়াচরাচর – ৭
৮. ছায়াচরাচর – ৮
৯. ছায়াচরাচর – ৯
১০. ছায়াচরাচর – ১০
১১. ছায়াচরাচর – ১১
১২. ছায়াচরাচর – ১২
১৩. ছায়াচরাচর – ১৩
১৪. ছায়াচরাচর – ১৪
১৫. ছায়াচরাচর – ১৫
১৬. ছায়াচরাচর – ১৬
১৭. ছায়াচরাচর – ১৭
১৮. ছায়াচরাচর – ১৮
১৯. ছায়াচরাচর – ১৯
২০. ছায়াচরাচর – ২০
২১. ছায়াচরাচর – ২১
২২. ছায়াচরাচর – ২২
২৩. ছায়াচরাচর – ২৩
২৪. ছায়াচরাচর – ২৪
২৫. ছায়াচরাচর – ২৫
২৬. ছায়াচরাচর – ২৬
২৭. ছায়াচরাচর – ২৭
২৮. ছায়াচরাচর – ২৮
২৯. ছায়াচরাচর – ২৯
৩০. ছায়াচরাচর – ৩০
৩১. ছায়াচরাচর – ৩১
৩২. ছায়াচরাচর – ৩২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন