০৪.০ গুপ্ত পর্বের বর্ণ বিন্যাস

নীহাররঞ্জন রায়

০৪.০ গুপ্ত পর্বের বর্ণ বিন্যাস

প্রথমেই সংবাদ পাওয়া যাইতেছে অগণিত ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠানের। ১ নং দামোদরপুর লিপিতে (খ্ৰীষ্টাব্দ ৪৪৩-৪৪) জনৈক কর্পটিকনামীয় ব্রাহ্মণ অগ্নিহোত্র যজ্ঞকাৰ্য সম্পাদনের জন্য ভূমিক্রয় প্রার্থন করিতেছেন; ২ নং পট্টোলি দ্বা্রা (৪৪৮-৪৯) পঞ্চ মহাযজ্ঞেব জন্য আর এক ব্রাহ্মণকে ভূমি দেওয়া হইতেছে; ধনাইদহ পট্টোলির (৪৩২-৩৩) বলে কটকনিবাসী এক ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ কিছু ভূমি লাভ করিতেছেন; ৩ নং দামোদরপুর পট্টোলিতে (৪৮২-৮৩) পাইতেছি নাভক নামে এক ব্যক্তি কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বসাইবার জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করিতেছেন; ৪ নং দামোদরপুর লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, নগরশ্রেষ্ঠ রিভূপাল হিমালয়ের পাদদেশে ডোঙ্গাগ্রামে কোকামুখস্বামী, শ্বেতবরাহস্বামী এবং নামলিঙ্গের পূজা ও সেবার জন্য ভূমিক্রয় করিতেছেন; বৈগ্রাম পট্টোলির (৪৪৭-৪৮) সংবাদ, ভোয়িল এবং ভাস্কর নামে দুই ভাই গোবিন্দস্বামীর নিত্য পূজার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন; ৫ নং দামোদর পট্টোলিতে (৫৪৩-৪৪) দেখিতেছি শ্বেতবরাহস্বামীর মন্দির সংস্কারের জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন অযোধ্যাবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব। এ সমস্ত লিপিই পুণ্ড্র বর্ধনভূক্তির অন্তর্গত ভূমি সম্বন্ধীয়। এই অনুমান নিঃসংশয় যে পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্ম স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে, এই ধর্মের দেবদেবীরা পূজিত হইতেছেন, ব্রাহ্মণদের বসবাস বিস্তত হইতেছে, অব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করিতেছেন, আনিয়া বসবাস করাইতেছেন, এবং অযোধ্যাবাসী ভিন-প্রদেশী আসিয়াও এইদেশে মন্দির সংস্কার করাইবার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন। যে সব ব্রাহ্মণেরা অসিতেছেন তাহাদের মধ্যে বেদবিদ ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণও আছেন। উত্তরবঙ্গের সংবাদ বোধ হয় আরও পাওয়া যায় কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের নিধনপুর লিপিতে। লিপিটি সপ্তম শতকের, পট্টোলি কর্ণসুবর্ণ জয়স্কান্ধাবার হইতে নির্গত; দত্তভূমি চন্দ্রপুরি বিষয়ের ময়ূরশান্মলাগ্রহার ক্ষেত্র, এবং এই ভূমিদানকার্য ভাস্করের চারি পুরুষ পূর্বে বুদ্ধপ্রপিতামহ ভূতিবর্মণদ্বারা (আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের প্রথম পাদ) প্রথম সম্পাদিত হইয়াছিল। চন্দ্রপুরি বিষয় বা ময়ূরশাল্মল অগ্রহার কোথায় তাহা আজও নিঃসংশয়ে নির্ণীত হয় নাই; তবে উত্তরবঙ্গের পূর্বতন সীমায় (রংপুর জেলায়) কিংবা একেবারে শ্রীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড (লিপির আবিষ্কার স্থান) অঞ্চল, এ দুয়ের এক জায়গায় হওয়াই সম্ভব, যদিও রংপুর অঞ্চল হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয়। যাহাই হউক, এই লিপিতে দেখা যাইতেছে ময়ূরশাল্মল অগ্রহারে ভূতিবর্মণ ভিন্ন ভিন্ন বেদের ৫৬টি বিভিন্ন গোত্রীয় অন্তত ২০৫ জন ‘বৈদিক’ বা ‘সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণের বসতি করাইয়াছিলেন। ব্রাহ্মণের সকলেই বাজসনেয়ী, ছান্দোগ্য, বাহ্বৃচ্য, চারক্য এবং তৈত্তিরীয়, এই পাঁচটি বেদ-পরিচয়ের অন্তর্গত, তবে যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী-পরিচয়ের সংখ্যাই অধিক। চারক্য এবং তৈত্তিরীয়েরাও যজুর্বেদীয়; বাহ্বৃচ্য ঋগ্বেদীয়; ছান্দোগ্য সামবেদীয়। ইঁহাদের অধিকাংশের পদবী স্বামী। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই উত্তরপূর্ব-বাংলায় (ভিন্ন মতে, শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে) পুরাদস্তুর ব্রাহ্মণ-সমাজ গড়িয়া উঠিয়াছে। পূর্বোক্ত অন্যান্য লিপির সাক্ষ্যও তাহাই। ভূমি দান-বিক্রয় যে সব গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে নিম্পন্ন হইতেছে তাহদের মধ্যে অনেক ব্রাহ্মণের দর্শন মিলিতেছে; ইঁহাদের নামপদবী শর্মণ এবং স্বামী দুইই পাওয়া যাইতেছে।

পশ্চিমবঙ্গের খবর পাওয়া যাইতেছে বিজয়সেনের মল্লসারুল লিপি (ষষ্ঠ শতক) এবং জয়নাগের বপ্যঘোষবাট লিপিতে (সপ্তম শতক)। শেষোক্ত লিপিটিদ্বারা মহাপ্রতীহার সূৰ্যসেন বপ্যঘোষবাটনামক একটি গ্রাম ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী নামে এক ব্ৰাক্ষণকে দান করিতেছেন, এই লিপিতেই খবর পাওয়া যাইতেছে কুককুট গ্রামের ব্রাহ্মণদেব ভট্ট উন্মীলন স্বামী এবং প্রবলি স্বামী নামে আরও দুইটি ব্রাহ্মণের দেখা এখানেও মিলিতেছে। এক্ষেত্রেও নাম-পদবী স্বামী। মল্লাসারুল লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, দৈনিক পঞ্চ মহাযজ্ঞ নিম্পন্নের জন্য মহারাজ বিজয়সেন বৎসস্বামীনামক জনৈক ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণকে কিছু ভূমি দান করিতেছেন। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে রাঢ় রাষ্ট্রেও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা যষ্ঠ-সপ্তম শতকেই স্বীকৃত ও প্রসারিত হইয়াছে। এই তথ্যের প্রমাণ আর ও পাওয়া যায় সদ্য আবিষ্কৃত শশাঙ্কের মেদিনীপুর লিপি দুইটীতে। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে দণ্ডভূক্তিদেশে ও যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা স্বীকৃত হইয়াছিল তাহা সিদ্ধান্ত করা যায় ইহাদের সাক্ষ্যে।

মধ্য ও পূর্ব বঙ্গেও এই যুগে অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীত হইতেছেন লৌহিত্য তীরবাসী জনৈক কান্বগোত্রীয় ব্রাহ্মণ, ভট্টগোমীদত্ত স্বামী। যে-মণ্ডলে (বারকমণ্ডলে; ফরিদপুর জেলায়) দত্ত ভূমির অবস্থিতি তাহার শাসনকর্তাও ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ, তাঁহার নাম বৎসপাল স্বামী। এই বংশের আর এক রাজা ধর্মাদিত্যের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীতা হইতেছেন ব্রাহ্মণ চন্দ্রস্বামী, আর একটির জনৈক বসুদেব স্বামী। শেষোক্ত পট্টোলিতে গর্গস্বামী নামে আর এক ব্রাহ্মণের ভূমিরও খবর পাওয়া যাইতেছে। তখনও বারকমণ্ডলের শাসনকতা একজন ব্ৰাহ্মণ, নাম গোপালস্বামী। ধর্মাদিত্যের প্রথম পট্টোলিটিতে গ্রামবাসিদের মধ্যেও দুইজন ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে বলিয়া মনে হয় একজনের নাম বৃহচ্চট, আর একজনের কুলস্বামী। মহারাজ সমাচার দেবের ঘুগ্রাহাটি লিপির দত্তভূমির দানগ্রহীতা ও একজন ব্রাহ্মণ, নাম সুপ্রতীক স্বামী এবং দান-গ্রহণের উদ্দেশ্য বলিচরুসত্ৰ প্রবতন। যষ্ঠ শতকের ফরিদপুর ছাড়িয়া সপ্তম শতকের ত্রিপুরার লোকনাথ লিপির সাক্ষ্য ও একই প্রকার; এখানে ও দেখিতেছি জনৈক ব্রাহ্মণ মহাসামন্ত প্রদোষশর্মণ অনন্তনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং ২১১ জন চাতুবির্দ্য ব্রাহ্মণের বসতি করাইবার জন্য পশুসংকুল বনপ্রদেশে ভূমিদান গ্রহণ করিতেছেন। গ্রামকুটম্বি অর্থাং গৃহস্থদের মধ্যে শর্মা ও স্বামী পদবীযুক্ত অনেক নাম পাইতেছি, যথা মঘশর্মা, হরিশর্মা, রুষ্টশর্মা, অহিশর্মা, গুপ্তশর্মা, ক্রমশর্মা, শুক্রশর্মা, কৈবর্তশর্মা, হিমশর্মা, লক্ষ্মণশর্মা, নাথশর্মা, অলাতস্বামী, ব্রহ্মস্বামী, মহাসেনভট্টস্বামী, বামনস্বামী, ধনস্বামী, জীবস্বামী, ইত্যাদি।

শুধু যে ব্রাহ্মণেরাই ভূমিদান লাভ করিতেছেন তাহাই নয়; জৈন ও বৌদ্ধ আচার্যরা এবং তাঁহাদের প্রতিষ্ঠানগুলিও অনুরূপ ভূমিদান লাভ করিয়াছেন। পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে পাহাড়পুর অঞ্চলে প্রাপ্ত একটি লিপিতে দেখিতেছি (৪৭৮-৭৯ খ্ৰী) জনৈক ব্রাহ্মণ নাথশর্মা এবং তাহার স্ত্রী রামী এক জৈন আচার্য গুহনন্দির বিহারে দানের জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করিতেছেন। ষষ্ঠ শতকে (গুনাইঘর লিপি, ৫০৭-৮ খ্রী) ত্রিপুরা জেলায় জনৈক মহাযানাচার্য শান্তিদেব প্রতিষ্ঠিত আর্য অবলোকিতেশ্বরের আশ্রম বিহারের মহাযানিক অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘের জন্য মহারাজ রুদ্রদত্ত কিছু ভূমি দান করিতেছেন। এই লিপিটিতেও একজন ব্রাহ্মণ কুমারামাত্য বেরজ্জ স্বামীর সংবাদ পাইতেছি। সপ্তম-অষ্টম শতকে ঢাকা জেলার আস্রফপুর অঞ্চলে দেখিতেছি জনৈক বৌদ্ধ আচার্য বন্দ্য সংঘমিত্র তাঁহার বিহার ইত্যাদির জন্য স্বয়ং রাজার নিকট হইতে প্রচু্র ভূমিদান লাভ করিতেছেন।

সকল অধ্যায়

১. ০২. উপাদান-বিচার
২. ০৩. আর্যীকরণের সূচনা : বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্ব
৩. ০৪.০ গুপ্ত পর্বের বর্ণ বিন্যাস
৪. ০৪.১ ব্রাহ্মণদের পদবী ও গাঞি পরিচয়
৫. ০৫. কায়স্থ-করণ
৬. ০৬. ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য
৭. ০৭. পাল যুগ
৮. ০৮. কৈবর্ত
৯. ০৯. বর্ণসমাজের নিম্নস্তর
১০. ১০. ব্রাহ্মণ
১১. ১১. পালরাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ
১২. ১২. চন্দ্র ও কম্বোজ রাজ্যের সামাজিক আদর্শ
১৩. ১৩. বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য আদর্শ
১৪. ১৪. সমাজের গতি ও প্রকৃতি
১৫. ১৫. সেন-বর্মণ যুগ
১৬. ১৬. ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের সূচনা
১৭. ১৭. স্মৃতি ও ব্যবহার শাসনের বিস্তার
১৮. ১৮. ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সেনরাষ্ট্র
১৯. ১৯. বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি ব্রাহ্মণ-তন্ত্রের ব্যবহার
২০. ২০. পরিণতি
২১. ২১. ব্রাহ্মণ (ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক বর্ণব্যবস্থা)
২২. ২২. গাঞী বিভাগ
২৩. ২৩. ভৌগোলিক বিভাগ
২৪. ২৪. বৈদিক ব্রাহ্মণ
২৫. ২৫. ব্রাহ্মণেতর বর্ণবিভাগ
২৬. ২৬. বর্ণ ও শ্রেণী
২৭. ২৭. বর্ণ ও কোম
২৮. ২৮. ব্ৰাহ্মণদের সঙ্গে অন্যান্য বর্ণের সম্বন্ধ
২৯. ২৯. বর্ণ ও রাষ্ট্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন