এক যে ছিল রাজা – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

এক যে ছিল রাজা – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগেকার কথা৷ তখন বাংলা এবং বিহারের সিংহাসনে রাজা হলেন মহীপালদেবের ছেলে নয়পাল৷ সেই সময় বাংলাদেশে এক ভুবনবিজয়ী মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন৷ একদা সমস্ত ভারতভূমি তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল, দীপের আলোয় যেমন অন্ধকার আলোকিত হয়ে ওঠে৷ তাই ইতিহাসে তিনি দীপঙ্কর শ্রী নামে পরিচিত৷ তাঁর শ্রী বা সৌন্দর্য এইরকম ছিল যে, তিনি যেখানে যেতেন, সেই জায়গাই দীপের আলোয় হেসে উঠত৷ জ্ঞানে তিনি সকলের বড়ো ছিলেন বলে তাঁর আর এক নাম হয় জ্ঞান-অতীশ৷ লোকে সাধারণত তাঁকে অতীশ বলেও জানত৷ ভারতবর্ষের ইতিহাসে যেসব মহাপুরুষের নাম অনন্ত কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, দীপঙ্কর হলেন তাঁদেরই একজন৷ এবং আমাদের পরম গৌরবের বিষয় যে, তিনি আমাদেরই মতো ছিলেন, এই বাংলাদেশেরই ছেলে৷

হিমালয়ের এপারে ভারতবর্ষ, ওপারে তিব্বত, দুই দেশই তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল৷ আজও তিব্বতবাসীরা দেব অতীশের নাম স্মরণ করে নিত্য প্রণতি জানায়৷

হিমালয়ের ব্যবধান দূর করে সেদিন দীপঙ্কর এই দুই দেশকে এক করেছিলেন৷

দুই

পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে এক রাজার ঘরে দীপঙ্কর জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর মার নাম প্রভাবতী, পিতার নাম কল্যাণ শ্রী৷ ছেলেবেলায় তাঁর বাপ মা তাঁর নাম রেখেছিলেন চন্দ্রগর্ভ৷

সুখের বিষয় তিনি যে-বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে বংশে অর্থের অভাব ছিল না এবং তাঁরা অর্থকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য মনে করতেন না৷ কল্যাণ শ্রী স্থির করলেন যে, তাঁর পুত্রকে তিনি ধর্মশাস্ত্রে এবং অন্য সব জ্ঞানে সুপণ্ডিত করে তুলবেন৷

জেতারী নামে এক অবধূতের কাছে বালক চন্দ্রগর্ভের শিক্ষা আরম্ভ হল৷ বিস্ময়ের ব্যাপার বালক অতি অল্প সময়ের মধ্যে অতি দুরূহ সব গ্রন্থ পড়তে আরম্ভ করে দিল৷ কিশোরকালের মধ্যেই তিনি অধিকাংশ শাস্ত্র পড়ে শেষ করে ফেললেন৷

সেই সময় এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত দেশভ্রমণ করতে করতে তাঁদের দেশে উপস্থিত হন৷ বালক চন্দ্রগর্ভের সহিত সেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের শাস্ত্র নিয়ে বিচার হয়৷ বিচারে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বালকের কাছে পরাজিত হন৷ এমনই অপূর্ব মেধা ছিল সেই বালকের৷

রাজপরিবারের সুখ-ঐশ্বর্য ভোগ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হল না৷ সেই কিশোরকালেই তিনি বেরোলেন, বৃহত্তর জ্ঞানের অনুসন্ধানে৷ কৃষ্ণগিরির বৌদ্ধ বিহারে মহাপণ্ডিত রাহুল গুপ্তের কাছে তিনি বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র পড়তে লাগলেন৷ সেখানকার পাঠ শেষ করে তিনি ওদন্তপুরীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন৷ সেখানকার প্রধান আচার্য শীলরক্ষিতের সংগৃহীত যেসব দুষ্প্রাপ্য শাস্ত্র ছিল, তা-ও শেষ করলেন৷ চন্দ্রগর্ভের অসামান্য প্রতিভা এবং জ্ঞান দেখে, শীলরক্ষিত তাঁর নাম দিলেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান৷ সেই থেকে তিনি দীপঙ্কর নামে পরিচিত৷

তিন

দেখতে দেখতে তাঁর বিদ্যা এবং ধর্মজ্ঞানের কথা ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল৷

তিনি সংসারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করে বৌদ্ধভিক্ষুর পীতবসন পরিধান করলেন৷ যেখানে বুদ্ধদেব জ্ঞান লাভ করেছিলেন, সেই বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মঠে তিনি বাস করতে লাগলেন৷

সেই সময় হঠাৎ চেদী বংশের কর্ণদেব বাংলাদেশ আক্রমণ করেন৷ কিন্তু রাজা নয়পালের কাছে তাঁর ভীষণ পরাজয় হয়৷ প্রতিদিন তাঁর অসংখ্য সৈন্য নিহত হতে লাগল৷

সেই নিদারুণ লোক-হত্যা দেখে দীপঙ্করের মনে বড়ো আঘাত লাগল৷ তিনি নিজে দূত হয়ে, উভয় দলের সঙ্গে কথা বলে, যুদ্ধ বন্ধ করে দেন৷

সেই সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি ভারতবর্ষের সীমা ছাড়িয়ে চীনে, তিব্বতে, দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ এত বড়ো বিশ্ববিদ্যালয় সে সময় জগতে আর ছিল না৷ দীপঙ্কর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যক্ষ হয়ে দেশ-দেশান্তরের ছাত্রদের জ্ঞান বিতরণ করতে লাগলেন৷

হিমালয়ের ওপারে তিব্বতে তাঁর অপূর্ব জ্ঞান মহিমার কথা তখন আর একজন লোকের মনে এক তীব্র জ্ঞানপিপাসা জাগিয়ে তুলেছিল৷ তিনি হলেন স্বয়ং তিব্বতের রাজা যশী হড৷ দেশের লোকের অজ্ঞতা দেখে, তাদের মধ্যে নিদারুণ ধর্মজ্ঞানের অভাব দেখে, সিংহাসনে বসেও, তাঁর মনে শান্তি ছিল না৷ তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যেমন করেই হোক তিব্বত থেকে এই অজ্ঞতা, এই অধার্মিকতা দূর করতে হবে৷

চার

তিনি স্থির করলেন, পুরোনো দলের লোকদের দিয়ে হবে না, নতুন মানুষের দল তৈরি করতে হবে৷ বেছে বেছে সাতটি বুদ্ধিমান বালক সংগ্রহ করলেন৷ তাদের পিতা-মাতার কাছ থেকে যশী হড তাদের জীবনের সমস্ত দায়িত্ব এবং ভার গ্রহণ করলেন৷

সেই সাতটি ছেলেকে তাঁর নিজের মতন করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুললেন৷ এই ভাবে ক্রমে তিনি একুশ জন যুবককে গড়ে তুললেন৷

তাদের শিক্ষা শেষ হলে, একদিন তাদের সকলকে ডেকে তিনি বললেন, ‘এখানকার শিক্ষা তোমাদের শেষ হয়েছে৷ কিন্তু তোমাদের শিক্ষা এখনও অসম্পূর্ণ৷ এইবার তোমাদের হিমালয় পার হয়ে, কাশ্মীরে, মগধে, তক্ষশীলায় যেতে হবে৷ সেখানে ভারতবর্ষে মহাজ্ঞানী সব পুরুষ আছেন৷ সমস্ত ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে, সেই সব পণ্ডিতদের কাছ থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে তোমাদের তিব্বতে ফিরতে হবে৷ আর একটি কথা, তোমাদের সঙ্গে আমি প্রচুর স্বর্ণ দেব; তিব্বতে সত্যকারের জ্ঞান-ধর্ম প্রচারের জন্য সেই স্বর্ণ দিয়ে ভারতবর্ষ থেকে যাকে তোমরা উপযুক্ত মনে করবে, সেইরকম একজন পণ্ডিতশ্রেষ্ঠকে তিব্বতে নিয়ে আসতে হবে৷’

যশী হডের আদেশ নত মস্তকে গ্রহণ করে একুশ জন জ্ঞানভিক্ষু জ্ঞান-অমৃতের জন্যে সেদিন দুর্গম হিমালয়ের পায়ে-হাঁটা পথ দিয়ে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করেন৷

সে কী দুর্গম পথ! স্বর্ণখনির লোভেও সে-পথ দিয়ে মানুষ যাতায়াত করত না৷ পদে পদে সেখানে তুষারের মধ্যে পথ হারিয়ে যায়৷ পথে পথে দস্যু, দস্যুর চেয়ে ভয়ংকর সব হিংস্র জন্তু, বিষভরা সব বিষধর৷ কোথাও দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় মেঘের ওপরে মাথা তুলে আছে, কোথাও তরণীহীন দুস্তর নদী, কোথাও-বা অন্ধকারে পথহীন অরণ্য যোজনের পর যোজন বিস্তৃত হয়ে আছে৷

সেই দুর্গম পথে যাত্রা করল, একুশ জন জ্ঞানভিক্ষু৷

উনিশ জন সে-পথ দিয়ে আর ফিরে এল না৷ পথ তাদের গ্রাস করে নিল৷ মাত্র দু-জন ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে তিব্বতে আবার ফিরে আসতে পেরেছিল৷ সে দু-জনের নাম, রিনছেন জন পো এবং লেগস পহি সেরাব৷

পাঁচ

তাঁরা দু-জনে ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে বুঝতে পারলেন যে, নালন্দার প্রধান অধ্যক্ষ দীপঙ্করের তুল্য পণ্ডিত ভারতে আর নেই৷ যেখানেই তাঁরা যান, সেইখানেই শোনেন, দীপঙ্কর হলেন সর্বজ্ঞ৷

তাঁরা মনে মনে স্থির করলেন, যেমন করেই হোক, দীপঙ্করকে তিব্বতে নিয়ে যেতে হবে৷

নালন্দা মহাবিহারে এসে তাঁরা দীপঙ্করের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন৷ তাঁর অপূর্ব শ্রী এবং শান্ত বচন শুনে তাঁদের অন্তর বিমুগ্ধ হয়ে গেল৷ একদিন দীপঙ্করকে নিভৃতে পেয়ে তাঁরা তিব্বতরাজ যশী হডের অন্তরের বাসনা জানিয়ে তাঁর পায়ের তলায় বিরাট এক তাল সোনা উপহারস্বরূপ রাখলেন৷ বললেন, ভারতের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীর জন্যে তিব্বতরাজ এই উপহার পাঠিয়েছেন৷ আপনি গ্রহণ করে আমাদের সকলকে ধন্য করুন৷ আপনাকে তিব্বতে নিয়ে যাবার জন্যেই এই নিদারুণ পথের কষ্ট সহ্য করে আমরা এখানে এসেছি৷ আপনি যদি তিব্বতে আসেন, তাহলে আপনার জন্যে রাজার স্বর্ণভাণ্ডার খোলা থাকবে, প্রত্যেক তিব্বতবাসীর শ্রদ্ধা আপনি নিত্য অর্ঘ্যস্বরূপ পাবেন৷

তাঁদের কথা শুনে হেসে দীপঙ্কর বললেন, ‘তিব্বতরাজের স্বর্ণভাণ্ডারের দ্বার চিরকাল তিব্বতবাসীদের জন্যে খোলা থাক; এক রতি স্বর্ণেও আমার কোনো প্রয়োজন নেই! আর কোনো লোকের শ্রদ্ধার অর্ঘ্যও আমি কামনা করি না! এখন আমি নালন্দা ত্যাগ করে যেতে অক্ষম৷ এখানে আমার ঘাড়ে এখন প্রভূত দায়িত্ব৷’

তখন তাঁরা কেঁদে ফেললেন৷ বললেন, ‘আমরা একুশ জন যাত্রা করেছিলাম৷ মাত্র দু-জন অবশিষ্ট আছি৷ উনিশ জন এই উদ্দেশ্যে প্রাণ দিয়েছেন! আপনি দয়া করুন!’

তাঁদের সেই সকরুণ কাহিনি শুনে দীপঙ্কর তাঁদের আশ্বাস দিলেন৷ বললেন, ‘ক্ষুব্ধ হয়ো না৷ সেই উনিশ জনের মৃত্যুকে ব্যর্থ মনে কোরো না৷ তবে একথা নিশ্চিত, এখন আমার তিব্বত যাওয়া সম্ভব নয়৷ তোমরা এই স্বর্ণ-উপহার নিয়ে তিব্বতে ফিরে যাও৷ তিব্বতরাজকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ো৷’

অশ্রুতে দু-চোখ ভরে, যে-পথ দিয়ে আসতে উনিশ জন সঙ্গীকে তারা হারিয়েছিল, সেই পথ দিয়ে তারা আবার তিব্বতে ফিরে গেল৷

ছয়

তাঁদের মুখে যশী হড সমস্ত কথা শুনলেন৷ দীপঙ্করের জ্ঞানমহিমার কথা শুনে, মনে মনে তিনি বার বার সেই পণ্ডিতের উদ্দেশ্যে নতি জানালেন৷ কিন্তু যখনই ভাবেন যে, তিনি এলেন না, তখনই তাঁর অন্তর বিষণ্ণ হয়ে পড়ে৷ তার সমস্ত অন্তর আকুল করে কান্না জেগে ওঠে, তিব্বতের সমস্ত স্বর্ণ দিয়েও তোমাকে পেলাম না৷ হে গুরু, আর কী চাও? কবে তুমি আসবে?

যশী হড অনেক ভেবে স্থির করলেন যে, দীপঙ্কর যদি না আসেন, তাহলে তাঁর পরেই যিনি পণ্ডিত আছেন, আপাতত তাঁকে আনতে হবে৷ এবং তিব্বত থেকে ছাত্র পাঠিয়ে, তাদের ভারতবর্ষ থেকে সুপণ্ডিত করে আনতে হবে৷ তারাই পণ্ডিত হয়ে ফিরে এসে তিব্বতে নবযুগের সূচনা করবে৷

এই স্থির করে তিনি আবার একদল লোককে ভারতবর্ষে পাঠালেন৷ ইতিমধ্যে তিনি প্রচুর স্বর্ণ সংগ্রহ করবার পথ খুঁজতে লাগলেন৷ কারণ এই ব্যাপারে যে-পরিমাণ স্বর্ণের প্রয়োজন, তা তাঁর রাজভাণ্ডারে নেই৷

এই সময় তিনি সংবাদ পেলেন যে, নেপালের সীমান্তে একটি স্বর্ণখনি আবিষ্কৃত হয়েছে৷ অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে তিনি সেই স্বর্ণখনি দেখতে যাত্রা করলেন৷

যেখানে স্বর্ণখনি আবিষ্কৃত হয়েছিল, তারই নিকটে ছিল, দুর্ধর্ষ গারলঙ-রাজের রাজত্ব৷ এই গারলঙরা অত্যন্ত হিংস্র প্রকৃতির লোক ছিল৷ বৌদ্ধদের তারা ঘৃণা করত৷ বিশেষত গারলঙ-রাজের যশী হডের ওপর ভয়ানক আক্রোশ ছিল৷

গারলঙ-রাজ গুপ্তচরের মুখে সংবাদ পেলেন যে, তিব্বতরাজ যশী হড অতি অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে তাঁরই রাজ্যের সীমান্তে এসেছেন৷

কালবিলম্ব না করে, সৈন্যসামন্ত নিয়ে গিয়ে, একদিন সহসা গারলঙ-রাজ যশী হড এবং তাঁর অনুচরদের আক্রমণ করলেন৷ হঠাৎ এই ভাবে আক্রান্ত হওয়ায় যশী হডকে সহজেই পরাভব স্বীকার করতে হল৷ গারলঙ-রাজ যশী হডকে বন্দি করে ঘোষণা করলেন যে, হয় যশী হডকে বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে, তাঁদের ধর্ম গ্রহণ করতে হবে, নতুবা তাঁর দেহের সমান ওজনের স্বর্ণ দিতে হবে৷ নতুবা মৃত্যু!

এই সংবাদ তিব্বত রাজ্যে গিয়ে পৌঁছলে, লোকে হাহাকার করে উঠল৷ যশী হডের দুই ছেলে এবং একজন ভাইপো ছিলেন৷ তিনজনই যশী হডকে দেবতা-জ্ঞানে ভক্তি করতেন৷ তাঁরা কালবিলম্ব না করে স্বর্ণ সংগ্রহ করতে লাগলেন৷

প্রচুর স্বর্ণ সংগ্রহ করে তাঁর ভাইপো চেন চাব গারলঙ-রাজের কাছে উপস্থিত হলেন৷

সমস্ত স্বর্ণ ওজন করে দেখা গেল, মাথার ওজনের পরিমাণ সোনা কম পড়ছে!

নিষ্ঠুর গারলঙ-রাজ বললেন, কম সোনা নিয়ে তিনি যশী হডকে কিছুতেই মুক্তি দেবেন না৷

চেন চাব বহু কাতর মিনতি জানালেন; কিছু সময় পেলে তিনি আরও স্বর্ণ সংগ্রহ করে দেবেন৷ কিন্তু গারলঙ-রাজ আর সময় দিতে চাইলেন না৷ হয়, যশী হডকে বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করতে হবে, নতুবা মৃত্যুকে বরণ করতে হবে৷

চেন চাব কারাগারে যশী হডের সঙ্গে দেখা করলেন৷ যশী হডের মুখে দুঃখের চিহ্ন নেই৷

চেন চাবকে তিনি ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন৷ তাঁকে সযত্নে তিনি স্বয়ং বৌদ্ধশাস্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন৷ চেন চাবকে কাঁদতে দেখে, যশী হড বললেন, তুমি অকারণে বিষণ্ণ হচ্ছ৷ তুমি পণ্ডিত৷ মৃত্যুতে কাতর হওয়া তোমার শোভা পায় না৷ অকারণে এত স্বর্ণ কেন খরচ করবে? এই স্বর্ণ থাকলে, ভারতবর্ষ থেকে বহু পণ্ডিতকে আনা সম্ভব হবে৷ আমার জন্যে দুঃখিত হয়ো না৷ এ আমার পরম সৌভাগ্য যে, ধর্মের জন্যে আমি জীবন উৎসর্গ করতে পারলাম৷ তবে একটা মিনতি তোমাকে জানিয়ে যাই, তুমি যেমন করে হোক, দীপঙ্করের কাছে এই সংবাদ পাঠাবে, তিব্বতের সমস্ত স্বর্ণ দিয়ে নয়, জীবন সমর্পন করে জ্ঞানভিক্ষু যশী হড এই অন্তিম মিনতি তাঁর কাছে জানিয়ে গিয়েছেন, যেন তিনি একবার তিব্বতে আসেন৷ এই আমার অন্তিম বাসনা৷

চেন চাব বিদায় নিয়ে যশী হডের মুক্তি-মূল্যের জন্য আরও স্বর্ণ সংগ্রহ করতে লাগলেন, কিন্তু ইতিমধ্যেই শুনলেন যে, কারাগারে তিনি দেহত্যাগ করেছেন৷

সাত

চেন চাব যশী হডের অন্তিম বাসনাকে সফল করাবার জন্যে জীবন উৎসর্গ করলেন৷ আরও দু-বার দীপঙ্করের কাছে লোক পাঠানো হয়েছিল-তিনি প্রত্যেকবারই অক্ষমতা জ্ঞাপন করে সেই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন৷

চেন চাব বহু অনুসন্ধান করে বিনয়ধর নামে এক তিব্বতি পণ্ডিতকে আবার পাঠালেন৷ বিনয়ধর ভারতীয় ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন৷

পাঁচ জন লোক নিয়ে বিনয়ধর হিমালয় পার হলেন৷

আট

নালন্দার দ্বারদেশে আবার তিব্বতের লোক এসে করাঘাত করল৷

দ্বারী দ্বার খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোথা থেকে আসছেন?’

‘আমরা তিব্বত থেকে আসছি!’

‘কী প্রয়োজন আপনাদের?’

‘আমরা মহাজ্ঞানী দীপঙ্করকে তিব্বতে নিয়ে যেতে চাই!’

বৃদ্ধ দ্বাররক্ষক তাঁদের সাদর সম্ভাষণ করে বিহারের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তোমরা বড়োই সরল৷ এইভাবে তোমাদের উদ্দেশ্যের কথা যদি প্রচার কর, তাহলে তোমাদের ওপর এখানকার সকলেই অসন্তুষ্ট হবে৷ দীপঙ্করকে কেউই ছেড়ে দেবে না৷ তা ছাড়া তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন৷ তোমাদের একটা পরামর্শ দিচ্ছি, শোনো! এই বিহারে গ্য-চ্যন বলে একজন তিব্বতীয় আছেন৷ তোমরা এখন তাঁর কাছেই থাকো৷ দীপঙ্কর ছাড়া কারুর কাছে তোমাদের উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ো না৷’

এই বলে দ্বারী তাঁদের গ্য-চ্যনের কাছে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ নিজের দেশের লোকদের দেখে গ্য-চ্যনও উল্লসিত হয়ে উঠলেন৷ বিনয়ধর দীপঙ্করের সাক্ষাৎ লাভের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন৷

একদিন উষাকালে বিনয়ধর দেখেন, বিহারের বাহিরে বহু ভিক্ষুক অন্নের জন্য সমবেত হয়েছে৷ একধারে দাঁড়িয়ে তিনি সেই দৃশ্য দেখতে লাগলেন৷

কিছুকাল পরে দেখেন, এক দিব্যমূর্তি বৃদ্ধ এসে সেই জনতার সামনে দাঁড়ালেন৷ তাঁকে দেখবামাত্রই জনতা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘ভাল হো, নাথ অতীশ, ভাত ওনা, ভাত ওনা!’ (তোমার জয় হোক, প্রভু অতীশ, আমাদের ভাত দাও)৷

তৎক্ষণাৎ বিনয়ধর বুঝলেন, ইনিই সেই মহাপুরুষ, যাঁর সন্ধানে বারে বারে তিব্বত থেকে লোক এসে ফিরে গিয়েছে৷

বিনয়ধর তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে একাধারে সেই অন্ন বিতরণ দৃশ্য দেখতে লাগলেন৷

একদিন প্রভু অতীশকে নিভৃতে পেয়ে বিনয়ধর তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে প্রণাম করলেন৷

বৃদ্ধ দীপঙ্কর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে ভিক্ষু?’

বিনয়ধর বললেন, ‘আমি ভিক্ষু নই, আমি ভিক্ষুক! আমি এসেছি তিব্বত থেকে! সমগ্র তিব্বত অন্ন চায়৷ সে অন্ন থেকে হতভাগ্য তিব্বতবাসীদের বঞ্চিত করা প্রভু অতীশের শোভা পায় না৷’

বারবার তিব্বত থেকে লোক এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছে৷ সমস্ত কথা দীপঙ্করের মনে পড়ল৷ তিনি তখন ছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ব্যস্ত৷ কিন্তু আজ যদিও তাঁর কর্মভার লঘু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আজ তিনি বৃদ্ধ, অশীতিপর!

দীপঙ্করের চরণ স্পর্শ করে বিনয়ধর বললেন, ‘আমি এক মৃত ব্যক্তির অন্তিম বাসনার বাহক হয়ে আপনার কাছে এসেছি৷ তিনি হলেন আমাদের রাজা যশী হড৷ শত্রু-কারাগারে মৃত্যুকালে তিনি আপনার কাছেই তাঁর অন্তরের অন্তিম বাসনা জানিয়ে গিয়েছেন৷’

তখন বিনয়ধর যশী হডের অপূর্ব মৃত্যুর কথা সমস্ত বললেন৷ যশী হডের সেই অপূর্ব ত্যাগের কথা শুনে বৃদ্ধের অন্তর দুলে উঠল৷ মৃত্যু দিয়ে লেখা এ আহ্বানলিপি কি প্রত্যাখ্যান করা যায়?

বৃদ্ধ দীপঙ্কর বললেন, ‘বেশ আমি যাব তিব্বতে৷ যশী হডের অন্তিম-বাসনা আমি সফল করব৷ কিন্তু এ সংবাদ তুমি কাউকেই জানাবে না৷ তাহলে, আমাকে কেউ যেতে দেবে না৷ আমরা গোপনে পালিয়ে যাব!’

তারপর একদিন নিশাযোগে গোপনে ভারতের জ্ঞানবৃদ্ধ তিব্বতের দিকে যাত্রা করলেন৷

লোকে বলে, তিনি ছিলেন জ্ঞানের সূর্য৷ তাঁর অভাবে, হিমালয়ের এপারে ক্রমশ অন্ধকার নেমে এল! তাঁকে পেয়ে হিমালয়ের ওপারে নতুন সূর্য জেগে উঠল! তিব্বত থেকে আর তিনি ভারতবর্ষে ফিরে আসেননি!

আজ পর্যন্ত সমগ্র বৌদ্ধজগৎ তাঁর নাম স্মরণে নতমস্তকে বলে, নমো অতীশ, নমো জোভোজি, নমো প্রভু স্বামী৷

সকল অধ্যায়

১. পুণ্যাদাসীর পুণ্যফল – অপূর্বকুমার কুণ্ডু
২. বাংলার দুরন্ত ছেলে – দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩. ঝিলম নদীর তীরে – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. দেবপুত্র কনিষ্কের কথা – চিত্রা দেব
৫. যুবরাজের চিঠি – বারীন্দ্রনাথ দাশ
৬. ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৭. এক যে ছিল রাজা – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
৮. দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
৯. প্রাচীন বাংলার দু-টি কাহিনি – দীনেশচন্দ্র সেন
১০. গোহ – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১১. চন্দ্রাবতী – প্রবাসজীবন চৌধুরী
১২. রাজপুত ভীষ্ম – কালিদাস রায়
১৩. অন্তর্লোকের বাদশা – তৃষিত বর্মন
১৪. হাত উঠায়া যব – বিশ্বপতি চৌধুরী
১৫. ক্ষাত্র উপবীত – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
১৬. সনাতনের সংসার-ত্যাগ – খগেন্দ্রনাথ মিত্র
১৭. কবুতর আর বাজবহেরি – কুমার মিত্র
১৮. ভুঁইয়া শ্রেষ্ঠ কেদার রায় – প্রসিত রায়চৌধুরী
১৯. সম্মানের মূল্য – সুমথনাথ ঘোষ
২০. মালোজি বনাম লাখোজ – রণজিৎকুমার সমাদ্দার
২১. শিবাজির পলায়ন – যদুনাথ সরকার
২২. বাদশার নেকনজর – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৩. সেই রাত কৃষ্ণাচতুর্দশীর – স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. রাজার ধর্ম – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৫. বিদ্যেধরীর বাঁকে – শিশির বিশ্বাস
২৬. জালিম সিংহ – ফটিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
২৭. মরণজয়ী বীর – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত
২৮. বাঁশের কেল্লা – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
২৯. শালপাতার ডাক – ননী ভৌমিক
৩০. ঘোড়েপর হাওদা – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
৩১. ময়নাগড়ের মহারাজ – দীপান্বিতা রায়
৩২. ছোট্ট পুরুত বলজিৎ – মহাশ্বেতা দেবী
৩৩. দুধ-রোটি – শুভময় মণ্ডল
৩৪. নানাসাহেব – প্রমথনাথ বিশী
৩৫. নীলকর ফেডি ও ডাকাত বিশ্বনাথ – অগ্নি মিত্র
৩৬. জোড়াসাঁকোর সিংহ – পূর্ণেন্দু পত্রী
৩৭. রক্ত স্বাক্ষর – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
৩৮. নমামি – জিতেশচন্দ্র লাহিড়ি
৩৯. জয়হিন্দ – ধীরেন্দ্রলাল ধর
৪০. এক জাহাজওয়ালার গল্প – তাপস চৌধুরী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন