বাংলার দুরন্ত ছেলে – দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বাংলার দুরন্ত ছেলে – দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের কথা৷ বুদ্ধদেব তখনও বেঁচে আছেন৷

বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশের তখন বিভিন্ন নাম৷ কোনো অংশের নাম বঙ্গ, কোনো অংশের নাম রাঢ়, কোনো অংশের নাম পুণ্ড্র, কোনো অংশের নাম আবার সমতট-এইরকম নানা অংশের তখন নানা নাম-৷

তখন রাঢ়ের রাজা সিংহবাহু৷ সিংহপুর নগর ছিল তাঁর রাজধানী৷ হুগলি জেলায় সিঙ্গুর নামে একখানা গ্রাম আছে৷ খুব সম্ভব এইখানেই ছিল সেকালের সেই রাজধানী সিংহপুর৷ আজকের হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলার অংশবিশেষ নিয়ে ছিল সিংহবাহুর রাঢ়রাজ্য৷ সিংহবাহুর রাজ্যে কোনো অশান্তি নেই৷ প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করে৷ সিংহবাহুর অনেক ছেলে-মেয়ে৷ বড়ো ছেলের নাম বিজয় সিংহ, মেজো ছেলের নাম সুমিত্র৷

বিজয় বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে হঠাৎ অশান্তি দেখা দিল৷ বিজয় ছিলেন যেমন দুরন্ত তেমনি অত্যাচারী৷ তাঁরই মতো অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ অনুচরও তাঁর জুটে গেল৷ তাদের দিয়ে প্রজাদের ওপর তিনি অত্যাচার করে বেড়াতেন৷ কাঁদতে কাঁদতে প্রজারা এসে রাজার কাছে নালিশ জানাত, প্রতিকার প্রার্থনা করত৷

রাজা সিংহবাহু ছেলেকে নানা উপদেশ দিতেন৷ মাঝে মাঝে কঠিন শাস্তিও দিতেন৷ বড়ো ছেলে বিজয়কে ঠিকপথে আনার চেষ্টাতে তাঁর ত্রুটি ছিল না৷

কিন্তু কে শোনে কার কথা৷ দুর্বিনীত বিজয় বাবার কথা কানেও তুলতেন না৷ দিনে দিনে তাঁর দুরন্তপনা ও অত্যাচার বেড়েই চলে৷ আর প্রজাদের মধ্যে দেখা দেয় দারুণ হাহাকার ও অসন্তোষ৷ শেষে একদিন প্রজারা দল বেঁধে এসে রাজাকে বলল, ‘মহারাজ৷ আমরা আর পারছি না৷ বিজয়কে হয় বধ করুন, নয়তো রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিন৷’

সিংহবাহুও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন৷ নিরুপায় হয়ে স্নেহের সন্তানকে তিনি রাজ্য থেকে নির্বাসিত করবেন বলে ঠিক করলেন৷ এছাড়া রাজ্য রাখার কোনো পথ আর নেই৷

বিজয়কে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করার সময় তিনি তাকে তিনখানা জাহাজ দিলেন৷ বিজয়ের অনুচরদের মোট সংখ্যা ছিল সাত-শো৷ একখানা জাহাজ হল বিজয় ও তাঁর ওই সাত-শো অনুচরদের জন্য৷ আর একখানা হল তাদের বউদের জন্যে৷ তৃতীয়খানা হল তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্যে

মেদিনীপুর জেলায় আজ যেখানে তমলুক শহর, সেকালে ওখানেই ছিল বিরাট এক বন্দর৷ বন্দরটির খ্যাতি ছিল পৃথিবী জোড়া৷ তার নাম ছিল তাম্রলিপ্ত বা তাম্রলিপ্তি৷ তাম্রলিপ্তের অল্প দূরেই ছিল সুনীল সমুদ্র৷ বঙ্গোপসাগর৷ বিজয় সিংহ অনুচরদের নিয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে সমুদ্র জাহাজ ভাসালেন৷ দিনের পর দিন পার হয়৷ অকূল সমুদ্রের বুকে পাল তুলে জাহাজ তিনখানা চলেছে৷ অজানা অচেনা পথ-অজানা ভবিষ্যৎ৷ তাঁরা কোথায় যাবেন কিছুই ঠিক নেই৷ ভারতের পূর্ব উপকূল ধরে বিজয়সিংহ তাঁর দলবল নিয়ে চলেছেন দক্ষিণ দিকে৷

শান্ত সমুদ্র৷ সমুদ্রের বুকে সাদা রাজহংসের মতো জাহাজ তিনখানা নির্ভাবনায় চলেছে৷ কিন্তু এক দিন হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ করে এল৷ ঝড় উঠল সমুদ্রের বুকে-ভয়ংকর ঝড়৷ দেখতে দেখতে সমুদ্র যেন খেপে উঠল৷ পর্বতপ্রমাণ ঢেউ এসে ভেঙে পড়তে লাগল জাহাজগুলোর ওপর৷ ক্ষিপ্ত অকূল সমুদ্রে অসহায় জাহাজ তিনখানা আছাড়িপিছাড়ি খেতে লাগল খোলামকুচির মতো৷

কিন্তু এখানেই সর্বনাশের শেষ নয়৷ হঠাৎ একসময় উত্তাল সমুদ্রের বুকে শিশুদের জাহাজখানা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল৷ হাহাকার উঠল বিজয়সিংহ ও অনুচরদের মধ্যে৷ কিন্তু জাহাজখানার কোনো হদিশ মিলল না৷

আছাড়িপিছাড়ি খেতে খেতে বাকি জাহাজ দু-খানা ছুটে চলল৷ দিশাহীন৷ ঝড়ের বিরাম নেই৷ ভাসতে ভাসতে বিজয় তাঁর দলবল নিয়ে ভারতের পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূলে এসে পড়লেন৷ তখনও ঝড় চলেছে৷ ক্ষিপ্ত সমুদ্র ফুঁসছে, ফুলছে, গর্জন করে চলেছে একভাবে৷ এমন সময় আবার ঘটল সর্বনাশ৷ ঝড়ের মধ্যে হঠাৎ স্ত্রীদের জাহাজখানাও অকূল সমুদ্রে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল৷ বিজয়সিংহ তারও খোঁজ পেলেন না৷ বিজয়দের চোখের জলই সার হল৷

বাকি একটাই মাত্র জাহাজ৷ বিজয়দের নিয়ে সেই জাহাজ ভারতের পশ্চিম উপকূল বরাবর ছুটে চলল উত্তরমুখো৷

এমনিভাবে দিন যায়, রাত্রি নামে৷ বিজয়সিংহের কষ্টের অবধি নেই৷ শেষে দুঃখের রাত্রিও শেষ হয় এক সময়৷

এক দিন শেষ রাত্রে ঝড়ঝঞ্ঝার বিরাম ঘটল৷ বিজয়রা বেরিয়ে এলেন জাহাজের ভিতর থেকে৷ ভোরের সোনালি আলোয় তখন চারিদিক হাসছে৷ নীচে শান্ত সমুদ্র, উপরে ঝকমকে নীল আকাশ৷ হঠাৎ দূরে তাদের নজর পড়ল৷ একটা বন্দর-তার দালানকোঠা দেখা যাচ্ছে৷ বিজয়সিংহ ও তাঁর অনুচরেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন৷ জাহাজ এসে বন্দরে নোঙর করল৷ বন্দরের নাম সুর্পারক৷ বোম্বাই বন্দর থেকে মাইল ত্রিশেক দূরে-বর্তমানে তার নাম সোপারা৷

বন্দরের বাসিন্দাদের কাছ থেকে বিজয় ও তাঁর অনুচরেরা ভালোই অভ্যর্থনা পেলেন৷ কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায়৷ তাঁদের দুরন্তপনায় বন্দরের বাসিন্দারা কিছু দিনের মধ্যে এমন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল যে বিজয় ও তাঁর অনুচরদের সে বন্দর ছাড়তে হল৷ সেখান থেকে তাঁরা গেলেন ভরুকচ্ছে৷ বর্তমান গুজরাটে ভরুকচ্ছের আর এক নাম ভরোচ বা ব্রোচ৷

কিন্তু সেখানেও সেই একই অবস্থা৷ বিজয়দের অত্যাচারে ভরুকচ্ছের বাসিন্দারাও অস্থির হয়ে পড়ল৷ গতিক খারাপ দেখে বিজয় সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে আবার একদিন সমুদ্রে জাহাজ ভাসালেন৷ ভারতের পশ্চিম উপকূল ধরে জাহাজ ফিরে চলে দক্ষিণমুখো৷

আবার সেই অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ৷ কোথায় তাঁরা যাবেন, ঠিক নেই৷ এমনসময় হঠাৎ আবার একদিন ঝড় উঠল৷ ক্ষিপ্ত মাতাল সমুদ্রের বুকে জাহাজ বুঝি আর টেঁকে না৷ ভাসতে ভাসতে শেষে জাহাজ একদিন এক দ্বীপে এসে লাগল৷

ভারতের শেষ দক্ষিণ সীমার পরে এক ফালি সমুদ্র৷ সমুদ্রের ওপারে এই দ্বীপ৷ দ্বীপের নাম তাম্রপর্ণী৷ আর এক নাম লঙ্কা৷ এই সেই লঙ্কাদ্বীপ, যেখানে পুরাকালে রাক্ষসদের রাজা রাবণ রাজত্ব করতেন৷ রাবণের সঙ্গে অযোধ্যার রাজা রামের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল৷ সেসব কথা রামায়ণে লেখা আছে৷ বিজয়সিংহ ও তাঁর অনুচরদের অবস্থা তখন খুবই সঙ্গিন৷ দুরন্ত সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করে তাঁরা শরীর-মন সবদিক দিয়েই বিপর্যস্ত৷ নিদারুণ ক্লান্তি ও অবসাদে দেহমন ভেঙে পড়ছে৷ তাঁরা লঙ্কাদ্বীপে জাহাজ নোঙর করলেন৷

লঙ্কায় তখন যক্ষরা বাস করে৷ যক্ষরাজার নাম কালসেন৷ বিজয়সিংহ অনুচরদের নিয়ে গোপনে লঙ্কায় বাস করতে লাগলেন৷ ক্রমে কুবর্ণা নামে এক যক্ষিণীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল৷ কুবর্ণাকে তিনি বিয়ে করলেন৷

কিছুদিন পরে বিজয় ও তাঁর অনুচরেরা হঠাৎ একদিন শুনল, দূরে বাজনা বাজছে৷ বিজয় কুবর্ণাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কীসের বাজনা?’

কুবর্ণা বললে, ‘আজ যক্ষরাজার মেয়ের বিয়ে৷ তাই ওই বাজনা৷ দেশের সব যক্ষ আজ আনন্দে মত্ত৷’

তারপর ক্ষণকাল চুপ করে থেকে কুবর্ণা আবার বললে, ‘কুমার, তুমি কি এদেশে রাজা হতে চাও? চাও তো, আজই যক্ষপুরী আক্রমণ করো৷ এমন সুযোগ আর পাবে না৷’

বিজয়সিংহ তখনই অনুচরদের নিয়ে যক্ষপুরী আক্রমণ করলেন৷ ভীষণ যুদ্ধ শুরু হল৷ কুবর্ণা যক্ষিণীর সাহায্য ও পরামর্শের ফলে বিজয়সিংহ যক্ষরাজকে হারিয়ে দিলেন এবং লঙ্কার রাজা হয়ে সুখে-শান্তিতে রাজত্ব করতে লাগলেন৷ দেশে তাঁর নিজরাজ্য রাঢ়েও গেল তাঁর এই রাজ্যজয়ের সংবাদ৷ তাঁর মেজো ভাই সুমিত্র তখন রাঢ়রাজ্যের রাজা৷ . . .

বিজয়দের বংশের উপাধি ছিল সিংহ৷ সেই উপাধি অনুসারে লঙ্কার নতুন নাম হল ‘সিংহল’৷ এমনিভাবেই সেই দূর অতীত যুগে সিংহলে বাঙালি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল৷ এবং দেশের জন্য সে গৌরব অর্জন করেছিলেন বাংলারই এক দুরন্ত ডানপিটে ছেলে৷ পুরাকালের সেই বীরত্ব-গরিমা স্মরণ করে কবি তাই গেয়েছেন-

“আমাদের ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়

সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়৷”

সকল অধ্যায়

১. পুণ্যাদাসীর পুণ্যফল – অপূর্বকুমার কুণ্ডু
২. বাংলার দুরন্ত ছেলে – দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩. ঝিলম নদীর তীরে – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. দেবপুত্র কনিষ্কের কথা – চিত্রা দেব
৫. যুবরাজের চিঠি – বারীন্দ্রনাথ দাশ
৬. ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৭. এক যে ছিল রাজা – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
৮. দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
৯. প্রাচীন বাংলার দু-টি কাহিনি – দীনেশচন্দ্র সেন
১০. গোহ – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১১. চন্দ্রাবতী – প্রবাসজীবন চৌধুরী
১২. রাজপুত ভীষ্ম – কালিদাস রায়
১৩. অন্তর্লোকের বাদশা – তৃষিত বর্মন
১৪. হাত উঠায়া যব – বিশ্বপতি চৌধুরী
১৫. ক্ষাত্র উপবীত – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
১৬. সনাতনের সংসার-ত্যাগ – খগেন্দ্রনাথ মিত্র
১৭. কবুতর আর বাজবহেরি – কুমার মিত্র
১৮. ভুঁইয়া শ্রেষ্ঠ কেদার রায় – প্রসিত রায়চৌধুরী
১৯. সম্মানের মূল্য – সুমথনাথ ঘোষ
২০. মালোজি বনাম লাখোজ – রণজিৎকুমার সমাদ্দার
২১. শিবাজির পলায়ন – যদুনাথ সরকার
২২. বাদশার নেকনজর – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৩. সেই রাত কৃষ্ণাচতুর্দশীর – স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. রাজার ধর্ম – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৫. বিদ্যেধরীর বাঁকে – শিশির বিশ্বাস
২৬. জালিম সিংহ – ফটিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
২৭. মরণজয়ী বীর – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত
২৮. বাঁশের কেল্লা – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
২৯. শালপাতার ডাক – ননী ভৌমিক
৩০. ঘোড়েপর হাওদা – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
৩১. ময়নাগড়ের মহারাজ – দীপান্বিতা রায়
৩২. ছোট্ট পুরুত বলজিৎ – মহাশ্বেতা দেবী
৩৩. দুধ-রোটি – শুভময় মণ্ডল
৩৪. নানাসাহেব – প্রমথনাথ বিশী
৩৫. নীলকর ফেডি ও ডাকাত বিশ্বনাথ – অগ্নি মিত্র
৩৬. জোড়াসাঁকোর সিংহ – পূর্ণেন্দু পত্রী
৩৭. রক্ত স্বাক্ষর – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
৩৮. নমামি – জিতেশচন্দ্র লাহিড়ি
৩৯. জয়হিন্দ – ধীরেন্দ্রলাল ধর
৪০. এক জাহাজওয়ালার গল্প – তাপস চৌধুরী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন