কবুতর আর বাজবহেরি – কুমার মিত্র

কবুতর আর বাজবহেরি – কুমার মিত্র

এক ঝাঁক পায়রাকে উড়িয়ে দিয়ে, দু-এক মুহূর্ত পার হওয়ার পর, ওস্তাদ প্রশিক্ষক খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিল গোটাকতক বাজবহেরিকে৷ বাজবহেরি? হ্যাঁ, একপ্রকার বড়োসড়ো চেহারার বাজপাখি৷ বাজপাখির দুনিয়ায় বাজবহেরি হল নৈকষ্য কুলীন৷

তো এখন দেখা যাক নীল আকাশের প্রচ্ছদে কীসের ছবি৷ সেখানে নক্ষত্রবেগে ধাবমান দু-টি পক্ষ-শিকার ও শিকারি৷ নীচের বিস্তীর্ণ ঘাসঢাকা জমিতে দাঁড়িয়ে সপার্ষদ দাউদ খাঁ-বঙ্গেশ্বর সুলেমান কররানির কনিষ্ঠ পুত্র৷ আকাশে দেখছেন বিচিত্র খেলা৷

অবশ্য এ খেলা দীর্ঘস্থায়ী নয়৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই কবুতরগুলোর ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীর ঝরে পড়বে ঘাসের প্রান্তরে৷

হত্যার নেশায় পাগল বাজবহেরিরা আকাশের বুকে দ্রুত চক্কর কাটতে লাগল তখনও অক্ষত পারাবতদের পাঁজর শাণিত নখরে বিদীর্ণ করে দেওয়ার জন্যে৷

হাততালির ঝড় বয়ে গেল নিঃশব্দ তৃণভূমিতে৷ সেখানে দাঁড়ানো মানুষগুলো শাবাশি জানাল বৃদ্ধ শ্বেতশ্মশ্রু প্রশিক্ষককে৷ শীর্ণকায় তামাটে রোদপোড়া চেহারার মানুষটির দিকে চেয়ে দাউদ খাঁ বললেন, ‘তোমার ওস্তাদির তুলনা হয় না রহিম শেখ৷ বাজগুলোকে যা তৈরি করেছ না! এরকম খেলা খিদেতেষ্টা ভুলে সারাদিন দেখা যায়৷’

রহিম শেখ সেলাম জানিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলল, ‘গোস্তাকি মাফ করবেন জনাব৷ আপনাদের মেহেরবানিতে কাজটা আমি খারাপ শিখিনি৷ বাজপাখি মানেই তো আগুন৷ আমি শুধু আগুনটা উসকে দিই৷ এ খেলা দেখে যে সুখ পান সে আমার সৌভাগ্য৷ তবে খোলা আসমানে কবুতর আর বাজবহেরি-ফলটা কী হবে তা তো সব্বার জানা৷ কবুতর কোনোদিন জেতে না, জিততে পারে না৷’

দাউদ খাঁ ওস্তাদের কথাগুলো হাসিমুখে শুনছিলেন, হঠাৎ হাসিটা নিভে গেল, ‘কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে একথা খাটে না৷’

ওস্তাদ সপ্রশ্ন চোখে তাকাল, ‘মানে?’

দাউদ খাঁ বললেন, ‘ধরো আমি আর দিল্লির বাদশা৷ দু-জনের তুলনা করলে আমাকে কী বলবে? কবুতর বলবে তো? আর বাদশাকে বলবে বাজবহেরি৷ কেমন কিনা?’

-‘জি হাঁ৷’

-‘ধরে নাও আমিই বঙ্গেশ্বর৷ তো আমার আর বাদশার মধ্যে যদি লড়াই বাধে, সেই লড়াইয়ের বাদশাই যে জিতবেন এমন কোনো কথা নেই৷ বাদশা হেরে গেলেন, এমনটাও হতে পারে৷ আমি এটাই বলতে চেয়েছিলাম৷’

বৃদ্ধ ওস্তাদ যেভাবে ঘাড় নাড়ল তাতে বোঝা গেল দাউদের কথায় তার মনের ধন্দ কাটেনি৷ তবে রাজবংশটিকে সে চটাতেও চাইল না৷ মুখে বলল, ‘এ বাত ঠিক আছে৷ মানুষের ব্যাপার আলাদা৷’

বৃদ্ধ মুখে যা-ই বলুক, তার মন যে অন্য কথা বলছে সেটা আঁচ করে নিয়ে দাউদ বললেন, ‘আমি যদি বাংলার মসনদ পেতাম তাহলে দেখিয়ে দিতাম কবুতরও বাজবহেরিকে ঝামেলায় ফেলতে পারে৷ নসিবে লেখা থাকলে মসনদটা পেয়ে গেলেও যেতে পারি৷ তখন না হয় বাদশার সঙ্গে এক হাত পাঞ্জা কষা যাবে৷’

দুই

মসনদ পাওয়ার কথাটা নেহাত কথার কথা হিসেবে বলেছিলেন দাউদ৷ ওটা পাওয়ার প্রকৃত অধিকারী সুলেমন কররানির জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়োজিদ খাঁ৷ কিন্তু দাউদের এমনি কপাল যে তাঁর ভাগ্যেই জুটে গেল বাংলার মসনদ৷ সুলেমান কররানির এন্তেকাল হওয়ার পর শাহি বংশের ঐতিহ্য অনুযায়ী বায়োজিদই সিংহাসন লাভ করেছিলেন, কিন্তু সিংহাসনে বসেই তিনি ধরাকে সরা দেখতে লাগলেন৷ স্বেচ্ছাচারের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে লাগলেন প্রজাদের৷

ক্ষুব্ধ ওমরাহরা প্রথমে সতর্ক করলেন, কাজ হল না৷ অগ্যতা এক জোট হয়ে বায়োজিদকে জল্লাদের হাতে সঁপে দিলেন৷ বায়োজিদের মুণ্ড খসে গেল৷ শূন্য মসনদে কে আর বসবে তখন বায়োজিদের ছোটোভাই দাউদ ছাড়া? দাউদের মুখের কথা সত্যি হয়ে গেল৷ বিনা ঝক্কিতে পেয়ে গেলেন বাংলার সিংহাসন৷

ওমরাহদের ধারণা হয়েছিল এ ছেলে রাজকার্য ভালোই চালাবে৷ একে মসনদ আলো করা চেহারা, তায় যুদ্ধবিদ্যেটাও রপ্ত করেছে ভালো৷ দাউদের মতো দুর্ধর্ষ অসিচালক নবাবি সেনাদলে নেই বলতে গেলে৷ সাধারণ প্রজারা ছাড়াও, সৈন্য থেকে সেনাপতি, সবাই ওকে খুব মানেগণে৷ এরকম শাসকই দেশ চালাতে দরকার৷

কিন্তু ওমরাহরা ভুল অঙ্ক কষেছিলেন৷ সিংহাসনে বসেই যে দাউদের মতিগতি আমূল বদলে যাবে তা তাঁরা জানবেন কী করে?

দাউদের পিতা সুলেমান কররানি বাদশা আকবরের গোঁড়া ভক্ত ছিলেন, এমনকী মসজিদে মসজিদে আকবরের নামে খুতবা পাঠ করার আদেশও দিয়েছিলেন৷ কিন্তু এহেন পিতার পুত্র হয়েও দাউদ ছিলেন আকবরের নামে হাড়ে চটা৷ তিনি নিজেকেই বাদশাহ বলে ঘোষণা করলেন, আদেশ জারি করলেন যে তাঁর নামেই খুতবা পাঠ করতে হবে মসজিদে৷ বাদশাহদের মতো স্বনামে মুদ্রাও চালু করলেন-দাউদি মুদ্রা৷

আগের শাসকরা আফগান সর্দার ও সাধারণ পাঠানদের সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ আচরণ করতেন৷ দাউদ সে-পথে গেলেন না৷ তাদের সঙ্গে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক দাঁড়াল দাউদের৷ আসলে বাংলার মতো একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শাসন কর্তৃত্ব হাতে পেয়ে মাথা ঠিক রাখতে পারেননি দাউদ খাঁ৷ তার ওপর তাঁর বাস্তববোধকে একেবারে ঘুলিয়ে দিয়েছিল তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকা পারিষদরা৷ আর প্রমোদে মেতে থাকা তরুণ শাসকদের মোসাহেবপ্রিয়তা নতুন কোনো ঘটনা নয়৷

তারা বোঝাতে শুরু করল, ‘বাংলার মালিক তো হলেন, এবার নতুন কিছু করুন৷ এবার আমির-ওমরাহদের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো কিছু না করলে তারা বলবে-এ ছোঁড়াটাও দেখছি বায়োজিদের মতো ঢোঁড়াসাপ৷ এবার একটু ফণা তুলে বুঝিয়ে দিন আপনি আসলে জাতসাপ৷’

দাউদ বেশ খোশমেজাজে ছিলেন৷ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা আসলে কী বলতে চাইছেন?’

পারিষদরা সমস্বরে বলল, ‘যুদ্ধ৷ একটা যুদ্ধ-টুদ্ধ লাগিয়ে দিন৷ যুদ্ধ ছাড়া আফগানরা জানেটা কী?’

-‘কার সঙ্গে যুদ্ধ?’

-‘যুদ্ধ যদি করতেই হয় তাহলে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা সম্মানজনক সেটা আপনিই ভেবে দেখুন৷’

-‘আপনারা কি দিল্লির বাদশার কথা বলতে চাইছেন?’

-‘আপনি ঠিকই ধরেছেন৷ তামাম হিন্দুস্থানে বাদশা আকবর ছাড়া আপনার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী আর কে হতে পারেন? যুদ্ধ যদি লাগাতেই হয় আকবর বাদশা কী দোষ করলেন? চুনোপুঁটির সঙ্গে লড়ে কী লাভ?’

পারিষদদের মনে হল দাউদ যেন সামান্য দ্বিধাগ্রস্ত৷ মুখে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব৷

-‘কী ভাবছেন জাঁহাপনা?’

-‘ভাবছি মানসিংহ, টোডরমল, আলি কুলি খানের মতো মস্ত মস্ত সেনাপতি তো আমার নেই৷ ওদের মোকাবেলা করা কী সহজ কাজ?’

পারিষদরা আকাশে তুলল দাউদ খানকে, ‘আপনিই বা কম কীসে? আপনার মতো যোদ্ধা ক-জন আছে বাদশার সৈন্যদলে? অকারণ ভাবনাচিন্তা করে নিজেকে দুর্বল করে তুলবেন না৷’

দাউদ ফুলদানি থেকে একটা সবৃন্ত গোলাপ তুলে ঘ্রাণ নিতে নিতে বললেন, ‘বলছেন আপনারা?’

-‘বলছি৷’

-‘তাহলে সত্যি কথাটাই বলে ফেলি৷ মানসিংহ, টোডরমল-এদের আমি কি দেখেছি নাকি? সবই শোনা কথা৷ তা ছাড়া মানসিংহ হচ্ছে বাদশা আকবরের সেরা পোষা সিংহ, জমিজমা আর টাকাকড়ি ছাড়া কিছু বোঝে না, ওই লোক যুদ্ধের জানেটা কী? তা বাদে মোগলরা হচ্ছে কুঁড়ের বাদশা৷ ভালো ভালো খানাপিনা আর ঘুম-এসব পেলে আর কিছু চায় না ওরা, তবে হ্যাঁ, এই মোগলরাই শেরশাহের আমলে আমাদের অনেক জ্বালিয়েছে৷ এবার ওদের একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার৷’

-‘আমরা এতক্ষণ ধরে এই কথাটাই তো বলছি৷’

-‘তাহলে আগে তো আমাদের শক্তিসামর্থের একটু হিসেব নিতে হয়৷’

-‘তা নেবেন বই কী, এক-শো বার নেবেন৷’

এক-শো বার নয়, একবার হিসেব নিতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল দাউদ খাঁর৷ আরেব্বাস! এ যে আরব্য উপন্যাসের রত্নভাণ্ডার! অন্যদিকে তেমনি অঢেল যুদ্ধোপকরণ আর সৈন্যসামন্ত৷ শুধু পদাতিক সৈন্যের সংখ্যাই এক লক্ষ চল্লিশ হাজার, অশ্বারোহী সৈন্য চল্লিশ হাজারের মতো৷ কামান-বন্দুক রয়েছে কুড়ি হাজার৷ তা ছাড়া রয়েছে কয়েক-শো রণপোত, সাড়ে তিন হাজার রণহস্তী৷ ইচ্ছে করলে এসব দিয়ে তো দুনিয়া জয় করা যায়, আকবর বাদশাকে ঘোল খাওয়ানো এমন কী কাজ? এই ভেবে হাতে তুলে নিলেন রাজদণ্ড৷ আর তাঁর মাথার ওপর শোভা পেতে লাগল স্বাধীন নৃপতির পক্ষে ধারণযোগ্য শ্বেতছত্র৷ এরপর শুরু হল নীল আকাশের প্রচ্ছদে সেই শিকারির খেলা-যার একদিকে কবুতর, অন্যদিকে বাজবহেরি৷ একদিকে সত্যিকার বাদশা, অন্যদিকে ঘোষিত বাদশা৷

তিন

পদ্মার দক্ষিণ পারে, গাজিপুরের সামান্য উত্তরে, দিল্লির বাদশার অধীনে একটি দুর্গ ছিল-জেমিনিয়া দুর্গ৷ দাউদ খাঁ সৈন্য পাঠালেন দূর্গটি দখল করতে৷

এ সংবাদ যথাসময়ে দিল্লীশ্বর পেয়ে গেলেন চরের মুখে৷ পত্রপাঠ তিনি পাঠিয়ে দিলেন প্রতিরোধ-বাহিনী, মুনায়ম খাঁর নেতৃত্বে৷ মুনায়ম খাঁ দক্ষ সেনাপতি, কিন্তু যেমন আরামপ্রিয় তেমনি শ্লথগতি৷ যুদ্ধ হচ্ছিল বিহারে৷ মোগল বাহিনীর গতিমন্থরতার জন্যে যুদ্ধ যেন শেষ হতে চাইছিল না৷ সে খবরও সময়মতো কানে গেল দিল্লির বাদশার৷

টোডরমলকে ডেকে বললেন, ‘এখন দিনকতক জমি মাপামাপি আর রাজস্বের হিসেবনিকেশ বন্ধ রাখো বন্ধু৷ মুনায়ম খাঁ বেচারা অসুবিধেয় পড়েছে৷ ওকে একটু সাহায্য করতে হবে৷’

বাদশাহের আদেশে মুনায়মের সঙ্গে যোগ দিতে এসে হাজির হলেন টোডরমল৷ তা দাউদ খাঁও বসে তসবি জপার লোক নন৷ নিজের প্রধানমন্ত্রী লোদি খাঁকে পাঠিয়ে দিলেন মুনায়মের বিরুদ্ধে৷ পাটনা হয়ে, মুনায়ম আসছিলেন বাংলার দিকে৷ লোদি খাঁ রুখে দিলেন মুনায়মের অগ্রগতি৷

অগ্রগতি রুখলেন বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলেন৷ পাটনায় উড়ল বাদশাহি পতাকা৷ বিহারে মোগল-পাঠানের এই যুদ্ধে মোগলদের জয়লাভে যাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক তিনি টোডরমল৷

দাউদ খাঁ এবার বুঝলেন টোডরমল নিছক কলমপেষা মুতসুদ্দি নন, তলোয়ার তাঁর হাতে ছোবলহানা গোখরো সাপ৷ অবশ্য প্রবীণ আর অভিজ্ঞ যোদ্ধারা তাঁর খবরদারি খুব একটা পছন্দ করতেন না৷ তবে এটাও তাঁরা জানতেন যে, আকবর যাঁকে পাঠিয়েছেন তাঁকে অগ্রাহ্য করার অর্থ খোদ বাদশাহের বিরুদ্ধাচরণ৷ আর এতেও সন্দেহ নেই যে কলমপেষা লোকটি আসার ফলে মোগলবাহিনী নতুন উদ্যম ও গতিবেগ পেয়েছিল৷ এরই ফলে বাংলার নতুন রাজধানী হয় টাডায় (পুরাতন রাজধানী গৌড়, ম্যালিরিয়ার তীব্রতার জন্যে সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত হয়)৷ মোগলরা পাঠানদের পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়৷

তবে দাউদ খাঁ হার মানার লোক নন৷ তিনি প্রমাণ করে ছাড়বেনই যে তিনি বাজবহেরি৷ বেপরোয়া আর দুঃসাহসী এই পাঠান বার বার পরাজিত হয়েও সংকল্প ত্যাগ করার কথা ভাবেননি৷ পরিবারস্থ নারী, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা এবং শিশুদের রোহতাস দুর্গে রেখে বাদশাহি সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন নতুন উদ্যমে৷ সে আক্রমণের তীব্রতা বড়ো ভয়ংকর৷ মুনায়ম খাঁর মনে সংশয় দেখা দিল-পাঠানদের দাপটে মোগলরা এবার গেল৷ কিন্তু ইতিহাস বিখ্যাত সেই মুৎসুদ্দি-টোডরমল অবিচলিত৷ বললেন, ‘সম্রাট তো যুদ্ধ থামাবার আদেশ দেননি, সুতরাং যুদ্ধ চলবে৷’

এবং চলল৷ পাঠানরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে বাধ্য হল৷

এদিকে দাউদমন্ত্রী লোদি খাঁ যুদ্ধ চালাতে চালাতে সাংঘাতিক বিরক্ত৷ মুনায়ম খাঁর কাছে দূত মারফত বলে পাঠালেন, ‘বাংলা-বিহারের অধীশ্বর হলে কী হবে, দাউদ খাঁর মাথায় কিছু নেই৷ নইলে দিল্লীশ্বরের সঙ্গে বার বার টক্কর দিতে যায়? খামোকা সময় নষ্ট, জীবন নষ্ট৷ তার চেয়ে আসুন একটা চুক্তি করি৷’

মুনায়ম খাঁ বলে পাঠালেন, ‘কী চুক্তি?’

-‘চুক্তি হল, আপনারা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবেন৷ বিনিময়ে আমরা সম্রাটকে দেব নগদ দু-লক্ষ টাকা আর এক লক্ষ টাকার রেশম ও মসলিন৷’

-‘আপনাদের মালিক রাজি হবেন তো?’

-‘রাজি করাবার ভার আমার৷ লোদি খাঁর কথা দাউদ খাঁ কানে তুলবেন না, তা কি হয়?’

কিন্তু লোদি খাঁর বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে ভারি বয়েই গেছে দাউদ খাঁর৷ তিনি বঙ্গ-বিহারের অধীশ্বর৷ সন্ধি-চুক্তির কথা পাড়ার একমাত্র অধিকার তাঁরই৷ অথচ ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে গেলেন কিনা বেতনভূক কর্মচারী লোদি খাঁ! তো খাঁ সাহেবকে ডাকিয়ে এনে দাউদ বললেন, ‘লোদি খাঁ, সবার কাছে আমার মাথা হেঁট করে দিয়েছেন আপনি৷ আমাকে অগ্রাহ্য করে নিজে প্রধান হয়ে উঠতে চেয়েছেন৷ আমার অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে দিতে চেয়েছেন প্রচুর ইনাম৷ এটা তো আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা৷ এজন্যে আপনার সব সম্পত্তি রাজ-সরকারে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেওয়া হল৷ আর যে মাথা থেকে ওইসব বদ মতলব বেরিয়েছে সেই মাথাটা যতদিন ঘাড়ের ওপর থাকবে ততদিন আমার পক্ষে নিশ্চিন্ত থাকা কঠিন৷ ওটারও একটা বন্দোবস্ত করা দরকার৷ লোকমুখে শুনলাম জল্লাদের প্রধান জমির আলি চোরছ্যাঁচড় আর গুপ্তচরের মাথা কেটে কেটে বিরক্ত৷ হেলেতেলির মাথা নয়, দু-চারটে দামি না কাটতে পারলে ওর আবার সম্মান থাকে না৷ কাল ভোরেই যাতে আপনার ঘাড়ের ওপর থেকে বদ মতলবে ভরা মাথাটা নেমে যায় তার আদেশ আজই পাঠিয়ে দিচ্ছি৷’

জল্লাদপ্রধান জমির আলির মুখে অনেক দিন পরে হাসি ফুটল৷ ইমানদার আদমির গর্দান নেওয়ার আনন্দ৷

সেনানায়ক মুনায়ম খাঁর কাছে অবিলম্বে দুঃসংবাদ পৌঁছোল-দাউদ খাঁ সন্ধিচুক্তিতে রাজি নন এবং চুক্তির প্রস্তাব যিনি দিয়েছিলেন সেই লোদি খাঁ আর ইহজগতে নেই৷ বরাত মন্দ মুনায়মের৷ সন্ধি তো হলই না, তার ওপর বিপদ হল হাজিপুরের শাসনকর্তা ফতে খাঁ সহসা মোগল বাহিনীকে আক্রমণ করে বসল, আর এমন লড়াইটাই দিল যে মোগল সৈন্যদের আশি ভাগই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল৷

সে খবর দিল্লীশ্বরের কানে গেল সময়মতো এবং তাঁর পক্ষে ক্রুদ্ধ হওয়া খুবই স্বাভাবিক৷ সভাসদদের কাছে বললেন, ‘চুহাগুলো আজকাল বড্ড বাড় বেড়েছে৷ ফতে খাঁ সামান্য একটা সুবাদারের গোলাম, তার এত তেজ৷’

-‘এর একটা বিহিত করুন সম্রাট৷’

তা করলেন সম্রাট৷ তিন-তিনটে সৈন্য-ভরতি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দিলেন হঠকারী ফতে খাঁকে শায়েস্তা করতে৷ ফলে খাঁ এবার হঠে গেল৷ সসৈন্য বন্দিও হল৷

বন্দি তো হল, কিন্তু কী করা হবে তাদের নিয়ে?

চটপট নির্দেশ এল দিল্লি থেকে,-ফতে খাঁ সমেত সমস্ত শত্রুসৈন্যের মাথা কেটে নৌকো বোঝাই করো, আর সেই নৌকো পৌঁছে দাও দাউদ খাঁর কাছে৷ ইনাম হিসেবে কাটা মাথাগুলো পেয়ে দাউদ ছোকরার চেতনা যদি একটু ফেরে৷’

সেই মধ্যযুগে মানুষের জীবনের দাম ছিল খুবই সস্তা৷ সৈন্যদের তলোয়ার কারণে, অকারণে ঝলসে উঠত৷ জাতিগত শত্রুতা থাকলে দয়ামায়ার প্রশ্নই উঠত না৷ মোগল-পাঠানের সম্পর্কটা ছিল যাকে বলে সাপে-নেউলের সম্পর্ক৷ একে অপরকে বাগে পেলেই প্রাণনাশ ছাড়া কথা নেই৷ সৈন্যদের অনেকেই জল্লাদমনস্ক৷ তো তারা দিল্লীশ্বরের হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করল৷ কবন্ধগুলোর জন্যে তৈরি হল গণকবর আর মুন্ডুগুলো বোঝাই হল নৌকোতে৷ সেই বিচিত্র উপঢৌকন অবিলম্বে পৌঁছোল দাউদ খাঁর কাছে৷ নৃশংস আর ভয়াবহ দৃশ্য নিঃসন্দেহে৷ যুদ্ধক্ষেত্রে ছিন্ন শির দেখা আর নৌকো-ভরতি নরমুণ্ড দেখা এক জিনিস নয় অবশ্যই৷ সেই বিচিত্র দৃশ্য দর্শনে দাউদ খাঁর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ইতিহাসে তা লেখা নেই৷ হয়তো নিজের অজ্ঞাতেই ঘাড়ে হাত বুলিয়ে নিয়েছিলেন একবার৷ তখন কি দাউদ খাঁ স্বপ্নেও ভেবেছিলেন ওই ঘাড়েই একদিন নেমে আসবে ভাগ্যের অভিশাপ?

চার

সন্ধি চুক্তির কথা তোলায় লোদি খাঁর প্রাণ গিয়েছিল৷ অথচ সেই সন্ধির কথাই শেষ পর্যন্ত ভাবতে হল দাউদ খাঁকে৷ গরজ বড়ো বালাই৷

দাউদ খাঁ যতই আস্ফালন করুন মোগল-পাঠানের যুদ্ধে হার-জিতের নকশাটা অস্পষ্ট নয় তাঁর কাছে৷ তাঁকে যে কেবলই সেনাদল আর পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘাট থেকে আঘাটায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে এ তাঁর চেয়ে কে আর বেশি জানে? কিন্তু কত আর পালাবেন? ওড়িশার কটকের কাছে মোগল বাহিনী পাঠানদের নাগাল পেয়ে গেল৷ এই সময় মোগল আর পাঠানসৈন্য প্রায় সমান সমান৷ কিন্তু মোগলদের একটা সুবিধের দিক ছিল, তাদের সঙ্গে ছিল অজস্র কামান৷ অন্যদিকে পাঠানদের সঙ্গে ছিল শুধুই বুনোহাতি৷ হাতিগুলো যুদ্ধজয়ে সাহায্যে তো এলই না, উপরন্তু কামানের কানফাটানো আওয়াজে ভয় পেয়ে এমন এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি বাধিয়ে দিল যে তাতে পাঠানপক্ষেরই ক্ষতি হল বেশি৷ পাঠানরা হেরে গেল বিচ্ছিরিভাবে৷ ইতিমধ্যে আকবরের অন্য এক সেনাধ্যক্ষ গৌড় আর তান্ড্রা দখল করে বসে আছে৷ তার মানে ধনেমানে সব যেতে বসেছে দাউদ খাঁর৷ বঙ্গেশ্বর এবার বুঝলেন এই ভরাডুবি থেকে একমাত্র সন্ধির রাস্তাটাই তাঁকে বাঁচাতে পারে, অন্য পথ নেই৷

যা ভাবা তাই কাজ৷ দৌত্যকর্মে সুপটু এক ব্যক্তিকে মুনায়ম খাঁর কাছে পাঠালেন দাউদ৷ দূত জানাল দাউদ খাঁ আত্মসমর্পণ করতে চান, অবশ্য শর্তসাপেক্ষে৷ তাঁর চাই নিরাপত্তা, সপরিবারে বাঁচার জন্যে একটুকরো জমি আর অনুচরদের জন্যে বাসস্থান৷ এইসব শর্ত পুরণ করলে দাউদ খাঁ মোগলদের অধীনতা মেনে নেবেন৷

মুনায়ম বললেন,-‘আর কিছু কি বলেছেন দাউদ?’

-‘বলেছেন মোগলই হোক আর পাঠানই হোক, সবাই একই ধর্মের লোক৷ তাদের মধ্যে এই রেষারেষি, লোকক্ষয় আর রক্তপাত বন্ধ হওয়া উচিত৷’

-‘বহুত খুব৷ তবে আমাদের দিক থেকেও একটা শর্ত আছে৷ তুমি যেসব কথা বললে, তা দাউদ খাঁর নিজের মুখে শুনতে চাই৷’

দূত দ্বিধাগ্রস্ত, ‘কিন্তু . . .’

-‘তোমার দ্বিধার কোনো কারণ নেই৷ দাউদ খাঁ নির্ভয়ে এখানে আসতে পারেন৷ তাঁর কোনো ক্ষতি বা অসম্মান হবে না৷ মুনায়ম খাঁ কখনো কথার খেলাপ করে না৷ পত্রযোগে তাঁকে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি৷’

কতিপয় ওমরাহকে সঙ্গে নিয়ে দাউদ খাঁ মোগল শিবিরে এলেন৷ বুক চিতিয়েই এলেন অবশ্য, তবে বুকের ভেতরে যে আশঙ্কার ঘূর্ণিঝড় পাক খাচ্ছে সেটা মালুম হয় মুখের দিকে তাকালে৷ মোগল শিবিরে নাহয় গেল, অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে তো? অবশ্য মুনায়ম খাঁ নাকি মানুষ ভালো, বিশ্বাসভঙ্গ করা তাঁর ধাতে নেই৷

না, মুনায়ম সত্যি ভালোমানুষ৷ কথার খেলাপ তিনি করলেন না৷ মোগল শিবিরে যথেষ্ট সম্মান-সৌভাগ্য লাভ করলেন দাউদ খাঁ৷ আপ্যায়ন আর সৌজন্যের চুড়ান্ত৷ স্বয়ং মুনায়ম খাঁ এসে দাউদকে আলিঙ্গন করলেন যার মধ্যে হৃদ্যতার উত্তাপ ছিল যথেষ্ট৷ পরিবর্তে দাউদ নিজের কোমরবন্ধ থেকে তরবারি খুলে মুনায়মের হাতে তুলে দিলেন৷ বললেন, ‘এই তরবারি আমাদের বন্ধুত্বের প্রতীক৷ আপনার মতো মহান ব্যক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র উত্তোলন করেছি বলে আমি লজ্জিত৷ যুদ্ধ আর করব না৷ বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটাতে চাই৷ আর চাই দিল্লীশ্বরের অনুগ্রহ৷ আপনার শিবিরে কোরান আছে?’

মুনায়ম বললেন, ‘আছে৷’

-‘তাহলে, আনুন সেই পবিত্র গ্রন্থ৷ আমি কোরান স্পর্শ করে সর্বসমক্ষে অঙ্গীকার করতে চাই যে মোগলের বিরুদ্ধে আর আমি যাব না, সম্প্রীতির সম্পর্ক রেখে চলব৷’

-‘পবিত্র কোরান কেন? চুক্তি মেনে চললেই তো হল৷’

-‘না, মাননীয় সেনাপতি৷ মানুষের মন বড়ো চঞ্চল আর দুর্বল৷ ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ নিলে তা রক্ষার দায়িত্ব বেড়ে যায়৷’

আনা হল কোরান৷ তা স্পর্শ করে দাউদ বললেন, ‘আমি মোগল সম্রাটের সেবক আজ থেকে৷ তাঁর অনুগ্রহ লাভ করলে ধন্য হবে আমার জীবন৷’

মুনায়ম লিপিকারকে ডেকে দাউদের কথাগুলো লিখিয়ে নিলেন৷ সন্ধিপত্র প্রস্তুত হল৷ তাতে স্বাক্ষর করলেন দাউদ খাঁ৷ সেই স্বাক্ষর হয়ে রইল সন্ধি এবং সন্ধিভঙ্গের চিরস্থায়ী স্বাক্ষর৷

পাঁচ

মোগল শিবিরে দাউদ একটি বহুমূল্য বস্তু লাভ করেছিলেন৷ তা হল রত্নখচিত একটি সুদৃশ্য তরবারি৷ এটি দাউদের হাতে তুলে দিয়ে মুনায়ম খাঁ বলেছিলেন, ‘এ উপহার আমাদের মহামান্য বাদশাহের তরফ থেকে৷ আশাকরি এর মর্যাদা সারা জীবন আপনি বজায় রাখার চেষ্টা করবেন দাউদ খাঁ৷ সম্রাটের বিরুদ্ধে যাওয়ার চিন্তা তো দূরের কথা, খোয়াবও দেখবেন না৷ আর একটা কথা৷ একটুকরো থাকার জমি চেয়েছিলেন, একটুকরো নয়,-সমগ্র ওড়িশা রাজ্যেরই অধিকার দেওয়া হল আপনাকে৷ আমি কি নিঃসন্দেহ হতে পারি যে সন্ধিপত্রে লিখিত কথাগুলি আপনি বর্ণে বর্ণে পালন করবেন?’

দাউদ শির নত করে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, দোস্ত৷’

মুনায়ম বলেছিলেন, ‘আর শুনুন, সম্রাটের আদেশ দিল্লি থেকে আসা সময়সাপেক্ষ৷ ফলে উড়িষ্যার অধিকার পেতে একটু সময় লাগবে৷ তবে আমাদের সম্রাট বিবেকবান, তাঁর ক্ষমা আর অনুগ্রহ আপনি পাবেন সন্দেহ নেই৷’

দাউদ অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, ‘আপনার সৌজন্য তুলনাহীন, মুনায়ম খাঁ৷ এন্তেকাল পর্যন্ত তা ভুলব না৷’

মোগল শিবিরে দাউদ যখন এসব কথা বলেছিলেন তখন আচার-আচরণ আর মুখের ভাবে তিনি যেন নিষ্পাপ দেবদূত৷ কিন্তু শিবির ত্যাগের সঙ্গেসঙ্গে তাঁর মুখে যে হাসি ফুটে উঠল সেরকম হাসি কেবল বিশ্বাসহন্তারাই হাসতে পারে৷ সে হাসির অর্থ-সন্ধিচুক্তি লিখিতই হোক আর মৌখিকই হোক তা মানা না-মানা তো আমার ইচ্ছাধীন৷ আর কোরান স্পর্শ করে শপথগ্রহণ? হ্যাঁ, কোরান পবিত্র গ্রন্থ তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু কোরান ছুঁয়ে শপথ নেওয়ার পর তা ভঙ্গ করলে মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে এমন ভাববার মতো দুর্বলচিত্ত অন্তত দাউদ খাঁ নয়৷ অনেক আলেম বা মৌলবিকে কতবার তো তিনি কোরানবিরোধী কাজ করতে দেখেছেন৷ তারা তো বেশ বহাল তবিয়তেই আছে৷ তাহলে?

মোদ্দা কথা হল যে, দাউদ খাঁ মোগল শিবিরে গিয়েছিলেন সন্ধিস্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে, আর যে দাউদ সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর বেরিয়ে এলেন মোগল শিবির থেকে, তাঁরা শরীরে এক কিন্তু মনে ভিন্ন৷

এরপর পরবর্তী ঘটনামালার দিকে নজর ফেরানো যাক৷

সেই ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলা ছিল রোগ-মহামারীর আকর৷ মৃত্যুদূতের মতো যখন-তখন ঝাঁপিয়ে পড়ত প্লেগরোগ৷ একবার আক্রান্ত হলে শেষ আশ্রয় চিতার আগুন কিংবা কবর৷ মোগল-সেনাপতি মুনায়ম খাঁ জানতেন না পাঠানের সঙ্গে বিজয়ী হলেও এক মারণব্যাধির সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁর জয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷ ওড়িশা থেকে গৌড়ে এসে খাঁ-সাহেব সবে যুদ্ধক্লান্ত শরীরটাকে খানিকটা আরাম দেওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁর ওপর ছোবল হানল মৃত্যুব্যাধি প্লেগ৷ শেষ নিশ্বাস ফেললেন দাউদের মহান শত্রু মুনায়ম খাঁ৷

বাংলার আফগানরা দেখল-এই সুযোগ৷ মুনায়ম খাঁর মৃত্যু মানেই তো আফগানের পক্ষে আশীর্বাদ৷ এই সুবর্ণসুযোগ হেলায় হারাতে রাজি হল না তারা৷ গৌড়ের অস্থায়ী শাসনকর্তা ছিল সাহেম খাঁ জেলিয়ার৷ তাকে হঠিয়ে দিল বিদ্রোহী আফগানরা৷ তাদের হাত শক্ত করতে এবার আসরে নেমে পড়লেন দাউদ খাঁ৷ এই সময় নিজের শপথের কথা মনে পড়লে বাংলার ইতিহাসটাই হয়তো বদলে যেত৷ কিন্তু তা তো হওয়ার নয়৷ ভাগ্যলিপি বদলাবার মতো পুরুষকার অন্তত দাউদ খাঁর ছিল না৷

দাউদের এক পরম বিশ্বাসী অনুচর ছিল হরি রায়৷ মস্ত যোদ্ধা৷ স্বয়ং দাউদ তাকে পরাক্রান্ত হিন্দুসম্রাট বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে তুলনা করতেন৷ সেই হরি রায় চেতাবনি শোনাল, ‘দিল্লীশ্বরের বিরুদ্ধে যাওয়া অনুচিত আপনার৷ শপথের কথা ভুলে যাবেন না৷’

দাউদ ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন, ‘শপথ! যুদ্ধে শঠতার নীতিই চলে আসছে চিরকাল৷ শপথ নেওয়ার কথাটা যেমন আছে তেমনি শপথ ভাঙার কথাও আছে৷ শপথ করেছিলাম তো মুনায়ম খাঁর কাছে, দিল্লীশ্বরের কাছে নয়, মুনায়ম খাঁ তো নেই৷ তাহলে শপথের আর কী মূল্য রইল? দাউদ খাঁ পুরোনো মামলা নিয়ে ঘামায় না৷’

-‘মাঝে মাঝে তারও দরকার আছে৷’

-‘ভালো যোদ্ধা মানেই ভালো পরামর্শদাতা নয় হরি রায়৷’

হরি রায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ মনে মনে হয়তো বলল,-তোমাকে শয়তানে পেয়েছে দাউদ খাঁ৷ তোমার একমাত্র ভরসা ভগবান৷

দাউদ খাঁর তর্জন-গর্জনের সময় ফুরিয়ে এসেছিল বোধ হয়৷ সেটা দাউদ টের পাননি, কারণ ওড়িশা হাতে পেয়ে তিনি অর্ধলক্ষ রণনিপুণ অশ্বারোহী সৈন্য এবং তারও বেশি পদাতিক সৈন্যের প্রভু৷ এই পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা তাঁকে দিল্লির সিংহাসন হাতে পাওয়ার সুখস্বপ্ন দেখাচ্ছিল৷

কিন্তু স্বপ্ন দেখা এক, আর বাস্তব অন্য কিছু৷ বাস্তব এই যে, আকবরের এক সেনাপতি হোসেন কুলি খাঁ, যার উপাধি ছিল খাঁ জাহান, রাজমহলে এসে দাউদের সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি হল৷ এখানেই শেষ নয়৷ হোসেন কুলিকে সাহায্য করতে জলস্রোতের মতো পাটনা এবং আরও নানান জায়গা থেকে সৈন্য এসে হাজির হল রাজমহলে৷ আফগানদের ভরসা ছিল দাউদ খাঁর ভাইপো জোনিয়েদ কররানি৷ ঠান্ডামাথা ভালো সেনাপতি৷ কিন্তু একে মোগলরা সংখ্যায় বিপুল, তায় তাদের হাতে অজস্র কামান৷ গোলন্দাজদের সঙ্গে যদি জোনিয়েদ কাররানির পদাতিক আর ঘোড়সওয়াররা এঁটে উঠতে না পারে তাহলে জোনিয়েদকে দোষ দেওয়া যায় না৷ দাউদ খাঁ হারলেন এবং বন্দি হলেন মোগলদের হাতে৷

হোসেন কুলি খাঁ সোজাসাপটা মানুষ৷ মুনায়ম খাঁর মতো সৌজন্য আর নৈতিকতার পাঠশালায় সে পড়েনি৷ পরিষ্কার ভাষায় জিজ্ঞেস করল বন্দিকে, ‘অকৃতজ্ঞ আর শপথভঙ্গকারীর শাস্তি কী জানো দাউদ খাঁ?’

জানেন বই কী দাউদ৷ কিন্তু সে কথা কি মুখে বলা যায়? অগত্যা দাউদ নীরব৷

-‘তাহলে আমিই বলি৷ মৃত্যুদণ্ড৷ কোরান ছুঁয়ে শপথ নিয়েও তুমি তা পালন করনি৷ সম্রাটের অনুগ্রহের মর্যাদাও রাখোনি তুমি৷ যে মুসলমানের পবিত্র কোরানের অমর্যাদা করে, যে অধর্মাচারী ভাবে কোরান মানে গোটাকতক কাগজের পাতা-সে কোনোরকম ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য৷’

দাউদ খাঁ নির্বাক৷ চরম পরিণতির কাছে দাঁড়িয়ে ভাষাহারা৷ এই সময় কি অনেক দিন আগে দেখা ছবিটা তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিল-নীল আসমানের নীচে ভীত আর পলায়মান কবুতরের পিছুপিছু ধাবমান বাজবহেরি? মনে পড়ে যাচ্ছিল বৃদ্ধ ওস্তাদের কথাগুলো,-কবুতর কোনোদিন জেতে না, জিততে পারে না৷

নিজের অজ্ঞাতে শিকলবাঁধা বাঁ-হাতটা কষ্টে তুলে ঘাড়ের ওপর বোলালেন দাউদ খাঁ৷

হোসেন কুলি খাঁ সাপের হিসহিসানির মতো চাপা গলায় হেসে উঠলেন, ‘হ্যাঁ ওটাই তো তোমার শাস্তি৷ শিরশ্ছেদ৷ সামান্য কবুতর হয়ে যে বাজবহেরির সঙ্গে পাঞ্জা কষতে যায় তার তো ওটাই পাওনা৷’

দাউদ খাঁর প্রাণ গেল জল্লাদের তরবারিতেই৷ তার ছিন্ন মুণ্ড প্রেরিত হল দিল্লির অধিপতির কাছে৷ সালটা পনেরো-শো ছিয়াত্তর৷

সকল অধ্যায়

১. পুণ্যাদাসীর পুণ্যফল – অপূর্বকুমার কুণ্ডু
২. বাংলার দুরন্ত ছেলে – দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩. ঝিলম নদীর তীরে – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. দেবপুত্র কনিষ্কের কথা – চিত্রা দেব
৫. যুবরাজের চিঠি – বারীন্দ্রনাথ দাশ
৬. ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৭. এক যে ছিল রাজা – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
৮. দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান – নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
৯. প্রাচীন বাংলার দু-টি কাহিনি – দীনেশচন্দ্র সেন
১০. গোহ – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১১. চন্দ্রাবতী – প্রবাসজীবন চৌধুরী
১২. রাজপুত ভীষ্ম – কালিদাস রায়
১৩. অন্তর্লোকের বাদশা – তৃষিত বর্মন
১৪. হাত উঠায়া যব – বিশ্বপতি চৌধুরী
১৫. ক্ষাত্র উপবীত – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
১৬. সনাতনের সংসার-ত্যাগ – খগেন্দ্রনাথ মিত্র
১৭. কবুতর আর বাজবহেরি – কুমার মিত্র
১৮. ভুঁইয়া শ্রেষ্ঠ কেদার রায় – প্রসিত রায়চৌধুরী
১৯. সম্মানের মূল্য – সুমথনাথ ঘোষ
২০. মালোজি বনাম লাখোজ – রণজিৎকুমার সমাদ্দার
২১. শিবাজির পলায়ন – যদুনাথ সরকার
২২. বাদশার নেকনজর – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৩. সেই রাত কৃষ্ণাচতুর্দশীর – স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. রাজার ধর্ম – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৫. বিদ্যেধরীর বাঁকে – শিশির বিশ্বাস
২৬. জালিম সিংহ – ফটিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
২৭. মরণজয়ী বীর – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত
২৮. বাঁশের কেল্লা – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
২৯. শালপাতার ডাক – ননী ভৌমিক
৩০. ঘোড়েপর হাওদা – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
৩১. ময়নাগড়ের মহারাজ – দীপান্বিতা রায়
৩২. ছোট্ট পুরুত বলজিৎ – মহাশ্বেতা দেবী
৩৩. দুধ-রোটি – শুভময় মণ্ডল
৩৪. নানাসাহেব – প্রমথনাথ বিশী
৩৫. নীলকর ফেডি ও ডাকাত বিশ্বনাথ – অগ্নি মিত্র
৩৬. জোড়াসাঁকোর সিংহ – পূর্ণেন্দু পত্রী
৩৭. রক্ত স্বাক্ষর – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
৩৮. নমামি – জিতেশচন্দ্র লাহিড়ি
৩৯. জয়হিন্দ – ধীরেন্দ্রলাল ধর
৪০. এক জাহাজওয়ালার গল্প – তাপস চৌধুরী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন