অসংশোধনযোগ্য ভুল

জুবায়ের আলম

গরম পানিতে রেজারটা ডুবিয়ে গালের শেষ দাড়িটুকু চেঁছে ফেললেন জেনারেল। মাথাটা এখনও ঝিম ঝিম করছে তার। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে নিজের হোটেল রুমেই আবিষ্কার করেছেন। কে বা কারা দিয়ে গেল সেটা তিনি জানেন না। 

একটু আগেই খবরটা পেয়েছেন তিনি। সকাল সকাল উঠেই এত ভালো একটা খবর পাবেন ভাবেননি তিনি। খবরটা পেয়ে অনেক হাল্কা বোধ করছেন। আশফাক চৌধুরী অপহৃত হয়েছে। এখন দেশের যে অবস্থা, কোন রাজনীতিবিদ অপহৃত হওয়া মানে খরচার খাতায় নাম উঠে যাওয়া। ওকে নিয়ে আর চিন্তা নেই। মেজর জেনারেল ফিরোজও বশিরকে ঠিক ধরে ফেলবে। ফিরোজকে তিনি চেনেন। এই লোক অন্য ধাতুতে গড়া। ফিরোজ বশিরকে ধরে ফেলার সাথে সাথে তিনি তফিসুল বারীকে প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের নোংরামীগুলো সব ফাঁস করে দেবেন। মিডিয়াতেও ফলাও করে ঘটনাগুলো প্রচার করা হবে। ফিরোজ আর বশির, দুজনকেই জেলে পুরে ফেলা হবে। তারপর তফিসুল বারীকে সরিয়ে দেওয়া হবে চিরতরে। তফিসুল বারীকে সরানোর সাথে সাথে দেশে সামরিক আইন জারি করে ফেলবেন তিনি। তারপর জাতির উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দিয়ে দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দেবেন। নিজেই বিচারবিভাগের প্যানেল ঠিক করবেন, তারপর নামমাত্র বিচার করে ফিরোজ আর বশিরকে ফাঁসি দিয়ে দেবেন। ব্যস! 

সর্বক্ষমতার উৎস ওই চেয়ারটা থেকে তিনি আর কয়েকদিন দূরে আছেন। এখন শুধু কাজগুলো ধাপে ধাপে করতে হবে। কোন ভুল করা যাবে না। 

তোয়ালে দিয়ে গালটা মুছতে মুছতে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলেন তিনি। কালকে রাতের কথা মনে পড়ল তার। কালকে তাকে কি খাওয়ানো হয়েছিল তিনি জানেন না, কিন্তু কেন খাওয়ানো হয়েছিল সেটা এখন পরিষ্কার। তিনি যেন কংসকে খুনটুন করে না ফেলেন তার জন্যই একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরকি। সবকিছু আবছা মনে করতে পারলেও তিনি কংসের চেহারাটা মনে করতে পারলেন না। পুরো ব্যাপারটাই যেন একটা স্বপ্ন মনে হল তার কাছে। 

আফটার শেভ লোশন মাখতে মাখতে জেনারেল ভাবলেন, প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প একটা সুযোগ। একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিটা কাজে লাগাতে হবে। কোনভাবেই এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। 

কংসচক্রের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি। তফিসুল বারীর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে তিনি কংসচক্রের কংসকে সরিয়ে দেবেন। নিজে হাতে গুলি করবেন কংসকে। ব্যস, তফিসুল বারীও মরল, কংসচক্রকেও শেষ করে দেওয়া গেল। কংসকে হত্যা করার জন্য তিনিও হিরো বনে যাবেন জনগণের কাছে। এক ঢিলে অনেক পাখি। 

শাওয়ারের নবটা ঘোরাতেই ঈষৎ উষ্ণ পানি এসে জেনারেলের কাঁধে পিঠে পড়ল। গোসল শেষ করে তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসতেই রুমের ভেতরে দুইজনকে বসে থাকতে দেখলেন জেনারেল। চমকে উঠে বললেন, “কে তোমরা? রুমে কিভাবে ঢুকলে?” 

লোকদুটো মৃতের মত ফ্যাকাশে। নেশা করার ফলে গাল ভেঙে গিয়েছে। ঘোলাটে চোখ। দুজনের পরনেই হাফ-হাতা শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। একজন বসে আছে সোফায়, আর একজন বসে আছে সোফার হ্যান্ডেলের ওপরে। কেউই কোন জবাব দিল না। 

জেনারেল খুব রেগে গেলেন। তিনি ভেতর থেকে দরজা লাগিয়েছিলেন স্পষ্ট মনে আছে তার। লোকগুলোর সাহস কি করে হয় তার হোটেলের রুমের ভেতরে ঢোকার। এখনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ম্যানেজারকে ফোন করে কড়া কিছু কথা শোনাবেন। 

বাথরুম থেকে পায়জামা আর পাঞ্জাবী পরে এসে জেনারেল লোকদুটোকে বললেন, “এক্ষুনি বেরিয়ে যাও। তোমরা জানো আমি কে? বেরিয়ে যাও নাহলে পুলিশ ডাকছি।” লোকদুটোর ভেতরে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তারা একদৃষ্টিতে জেনারেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। জেনারেল রাগে কাঁপতে কাঁপতে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন। 

রিসিভারটা তোলার আগেই টেলিফোনটা বেজে উঠল। ক্রিংক্রিং। রাগ পরিণত হল বিস্ময়ে। তিনি রিসিভার তুললেন 

“হোটেল অপারেটর বলছি। অ্যাম্বাসি থেকে ফোন এসেছে। তিন চেপে কথা বলুন।” 

জেনারেলের ভ্রু কুঁচকে গেল। অ্যাম্বাসি থেকে এত সকালে ফোন আসার কথা না। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত তিনি তিন নম্বর বাটনটা চাপলেন। সাথে সাথে ওপাশে রাষ্ট্রদূত মোসাব্বের কবিরের গলা শোনা গেল, “স্যার, আপনি কি দুইজনকে পাঠিয়েছেন ভিসার জন্য? ওরা আপনার রেফারেন্স দিচ্ছে। আর্জেন্ট ভিসার জন্য এপ্লাইও করেছে। পাসপোর্টও সাবমিট করে ফেলেছে।” 

জেনারেল পাথরের মত রিসিভার কানে ধরে খাটের ওপরে বসে পড়লেন। দুইজন লোকের হাতে বেরিয়ে এলো রিভলভার। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না, কারা অ্যাম্বাসিতে গিয়েছে এবং কেন গিয়েছে। এরা কংসচক্রের লোক। মুহূর্তের জন্য তার মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। যে লোক দু’জন অ্যাম্বাসিতে গিয়েছে তাদেরকে যদি ভিসা দিতে নিষেধ করা হয়, জেনারেলকে গুলি করবে এই দুইজন। কি করবেন এখন? 

রিসিভারটা বাম থেকে ডান কানে ধরলেন তিনি। তারপর বললেন, “তুমি একটু ধর মোসাব্বের।” জেনারেল রিসিভারের মাউথপিসটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরলেন। তারপর সোফার ওপরে বসে থাকা দুইজন লোককে বললেন, “আমি কংসের সাথে কথা বলতে চাই।” 

এই প্রথম লোক দুজনের একজন খনখনে গলায় বলল, “আগে ভিসার অনুমতি দেন, তারপর 

জেনারেল একবার বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারের দিকে তাকালেন। ওখানে তার লুগ্যারটা রাখা আছে। লুগ্যারটা বের করে দুইজনকে গুলি করতে পারবেন না তিনি? খাটের এপাশে কভার নিতে হবে। প্রথমজনকে গুলি করা সহজ, সে হ্যান্ডেলের ওপরে বসে আছে। দ্বিতীয়জন আশেপাশে কোথাও কভার নেবে। তখন? 

জেনারেলের মনে পড়ল, লুগ্যার বের করলেও কোন লাভ নেই। এদেরকে অনুমতি দিতেই হবে। কারণ এরকমই কথা হয়েছিল কাল রাতে। তিনি এদেরকে দেশে ফেরার সুযোগ দেবেন। বদলে এরা তফিসুল বারীকে খুন করবে। তফিসুল বারীকে রাস্তা থেকে সরানোর এরাই একমাত্র মাধ্যম। 

জেনারেল রিসিভারটা কানে ধরে বললেন, “ওরা কয়জন আছে বললে মোসাব্বের?” 

“সব মিলিয়ে পনেরো জনের জন্য ভিসার এপ্লাই করেছে স্যার। এতজনের ভিসা একসাথে অ্যাপ্রুভ করার নিয়ম নেই। তাই আপনাকে ফোন করলাম। আপনার রেফারেন্স দিচ্ছে কিনা।” 

জেনারেল চুপ করে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, “ওদের ভিসা কনফার্ম কর মোসাব্বের।” 

“ওকে স্যার।” 

মোসাব্বের কোন প্রশ্ন করল না। জেনারেলের ওপরে প্রশ্ন করাটা মানায় না। কিন্তু বুঝতে পারল না, দেশের কত বড় সর্বনাশ সে করতে যাচ্ছে। 

ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখলেন জেনারেল। লোক দুটোর হাত থেকে রিভলভার এখনও নামেনি। তারা অপলক দৃষ্টিতে জেনারেলের দিকে তাকিয়ে আছে। রিসিভার রাখার একটু পরেই আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল। জেনারেল রিসিভার তুললেন। 

“জেনারেল।” কংসের গলা। 

“এই সবের মানে কী? “ 

“মানে আর কি, যেমন কথা হয়েছিল সেই অনুযায়ীই তো কাজ হল।” 

কংস সামনে না আসলে জেনারেলের প্ল্যান ভেস্তে যাবে। কংসকে খুন করতে হবে। তফিসুল বারীর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে তাকে সরিয়ে দিতে হবে। টেলিফোনে কথা বললে সেটা হবে না। কংসকে সামনে আনতে হবে। গলাটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে জেনারেল বললেন, “আমি সামনাসামনি কথা বলতে চাই।” স্বভাবসুলভ আদেশ করলেন জেনারেল। 

কংস বলল, “আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি জেনারেল। ধন্যবাদ আপনাকে। তফিসুলের সাথে পুরনো হিসাব মেটাতে হবে। আমাদের চক্রের ডায়েরিটা খুঁজে বের করতে হবে। অনেক কাজ। আপনি এই সুযোগটা না দিলে হয়ত আর কখনওই দেশে ফিরতে পারতাম না।” 

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল জেনারেলের! মানে? কংসও আছে ওই পনেরো জনের ভেতরে? 

কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুবক দুজনের রিভলভার গর্জে উঠল। জেনারেলের নিথর দেহটা ছিটকে পেছনের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল। 

কংসচক্রের কাছে তার প্রয়োজন শেষ। 

সকল অধ্যায়

১. পূর্বাভাস
২. প্যান্ডোরার ‘ব্যাগ’
৩. নরকের ভাঙা দরজা
৪. একজন বিচ্ছিন্নবাদী
৫. ব্যাগের পিরামিডের নিচে
৬. ছাই চাপা স্বপ্ন
৭. মেরিলিনার কথা
৮. প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প
৯. টিলার ওপর সোনার খাঁচা
১০. চৌদ্দ নম্বর গিনিপিগ
১১. অভিনিষ্ক্রমণ
১২. স্বীকারোক্তি
১৩. টিকটিকি
১৪. মাকড়সার লাশ
১৫. কার্পেটের নিচে ধুলো
১৬. ফাঁদ
১৭. প্লিজ, কেঁচো খুঁড়বেন না
১৮. মুখোমুখি
১৯. বিচ্যুত নিশানা
২০. কংসচক্র
২১. মৃতদেহের অভিশাপ
২২. শীতল শহুরে গুঞ্জন
২৩. হেডিস
২৪. ঈশ্বর
২৫. যমদূত
২৬. পোসাইডন
২৭. পুনর্জন্ম
২৮. নিম্নলিখিত উত্তরমালা
২৯. প্রমিথিউস
৩০. টিকিটিকি না, স্যালামেভার
৩১. ঝরে যাওয়া সময়ের গল্প
৩২. দারিয়ুসের অবিশ্বাস
৩৩. শেয়ালের গর্তে
৩৪. অপারেশেন মিরর হান্ট
৩৫. বিষাক্ত শহরে
৩৬. ধনুকের তূণ
৩৭. অসংশোধনযোগ্য ভুল
৩৮. পলায়ন
৩৯. মৃত্যু ছক
৪০. বহরমপুরের বাঁশিওয়ালা
৪১. অপারেশন ফুলস্টপ
৪২. শূন্যস্থানের শেষ সূত্র
৪৩. এবং সেই সূত্রের ভুলগুলো
৪৪. আর্ফিউসের ভুল
৪৫. নির্ণেয় সরলফল
৪৬. মালতী বালা বিউটি পার্লার
৪৭. শেষ পাপের প্রায়শ্চিত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন