কার্পেটের নিচে ধুলো

জুবায়ের আলম

হোটেল সুকর্ণ। রুম নম্বর ৩০৫। মেজর ফিরোজ রাজধানী থেকে বহরমপুর ফিরেছেন কাল অনেক রাতে। সাথে মেজর রঞ্জন ও ছিল। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিতে মেজর রঞ্জন এখনও ঘুমাচ্ছেন পাশের বেডে। ফিরোজ উঠেছেন ভোর ছয়টায়। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কাল রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। রোজকার মত আধ ঘণ্টা ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ আর পুশআপ শেষে দাড়ি কামালেন। তারপর গোসল করলেন। তারপর কফি আর সংবাদপত্র নিয়ে বসলেন। 

সাতটার দিকে হোটেলের একটা বয় এসে খবরের কাগজ দিয়ে গেল। খবরের কাগজটা টিপয়ের ওপরে রাখলেন ফিরোজ। গরম পানি করে কফি বানালেন। তারপর বারান্দায় গিয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে বসলেন। অনেক কাজ। এই হোটেলেই চাবির মালিক উঠেছে। হোটেল বয়টা পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে জানিয়েছে মেয়েটা ২০২-এ উঠেছে। মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে হবে। কিভাবে তাকিয়া মহলের চাবি তার কাছে গেল সেটাও জানতে হবে। মেজর রঞ্জন বলছে চাবির মালিক একটা মেয়ে, তারমানে সে বশির জামানের কেউ হয়। কে হয়? মেয়ে? প্রেমিকা? বোন? নাকি অন্য কেউ? বশির জামানের কোন পরিবার নেই। কাজেই এই সম্পর্কের কোনটাই বশির জামানের সাথে যায় না। 

আরেকবার তাকিয়া মহলে যেতে হবে আজকে। মেজর ইকবাল কিংবা ডঃ বশির জামানের কোন খোঁজ কোথায় থাকতে পারে সেই সম্পর্কে কোন ব্লু পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। ফিরোজের কেন জানি মনে হচ্ছে, দুই একজন এই শহরেই আছে। 

টিপয়ের ওপরে রাখা কফির মগে শ্রাবণের রোদ এসে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য ফিরোজ সব ভুলে গেলেন। প্রকল্পের কথা, এতগুলো মানুষের রক্তের কথা- সব কিছুক্ষণের জন্য তার মন থেকে সরে গেল। যেন কিছুই হয়নি। সব কিছু আগের মতই আছে। আগের মতই এই বহরমপুরের ঘুম ভাঙছে। নিচের রাস্তা দিয়ে ইউনিফর্ম পরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। সামনের মোড়ের ভাতের হোটেল থেকে ধোঁয়া উড়ে আসছে। মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা কালো গাড়িতে হেলান দিয়ে একজন শ্রমিক গোছের লোক মুখে গুল নিচ্ছে। সব কিছু যেন বলে দিচ্ছে, কিছুই হয়নি। সব কিছু ঠিক আছে। 

ফিরোজ বাম হাতে কফির মগ নিয়ে ডান হাতে স্থানীয় খবরের কাগজটা আগে খুললেন। 

“বন্যার পরিস্থিতির অবনতি”

“তিন খুনের মামলার আসামী গ্রেপ্তার 

“বাণে ভেসে গেল কৃষকের স্বপ্ন”

“গৃহবধূর আত্মহনন,পরিবার বলছে পরিকল্পিত হত্যা”

“কাল থেকে শুরু হচ্ছে আন্তঃজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট”

“তারাগাছিতে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার”

ফিরোজের চোখ আটকে গেল এই খবরটাতে। একেবারে ভেতরের পাতায় এক কোণায় খবরটা ছাপা হয়েছে। রিপোর্টারের নাম দেওয়া হয়নি। লেখা আছে নিজস্ব প্রতিবেদক। নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা অপরিষ্কার হরফগুলো বেশ সময় নিয়ে পড়লেন। স্থানীয়দের মতে, জমি জমা নিয়ে কলহের জের ধরে যুবককে খুন করা হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ লাশ সুরতহালের জন্য মর্গে পাঠিয়েছে। দুইজনের বিরুদ্ধে মামলা। এর বেশি কিছু লেখা নেই। 

ফিরোজ পৃষ্ঠা উল্টালেও খবরটা মনের ভেতরে খচখচ করতে লাগল। বাকি খবরগুলোতে মন বসাতে পারলেন না ফিরোজ। অস্বস্তি বাড়তে শুরু করল। তিনি মেজর রঞ্জনকে ডেকে তুললেন। 

রঞ্জন যেন জেগেই ছিলেন। ফিরোজ ডাকার সাথে সাথে উঠে পড়লেন। স্বভাববসত বালিশের পাশে রাখা রিভলভারে হাত চলে যাওয়ায় একটু বিব্রত হলেন। এটা তার অনেক পুরনো অভ্যাস। 

ফিরোজ বললেন, “এই অভ্যাস কবে যাবে রঞ্জন? এগুলো চোর ডাকাতদের অভ্যাস। আমাদের মত মানুষদের এইসব অভ্যাস মানায় না। যাও ফ্রেশ হয়ে আস। কথা আছে। জরুরী কথা আছে।” 

মেজর রঞ্জন ফ্রেশ হয়ে আসলেন। এক মগ কফি বানিয়ে বারান্দায় এসে বসলেন। 

মেজর জেনারেল ফিরোজ ইশারায় রঞ্জনকে চেয়ার টেনে বসতে বললেন। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত কপালে চিন্তার ছাপ। খবরের কাগজটা বাড়িয়ে দিলেন রঞ্জনের দিকে। বললেন, “দেখো।”

মেজর রঞ্জন পুরো সংবাদটা পড়লেন। তারপর ফিরোজের দিকে তাকালেন। ফিরোজ বললেন, “অটোওয়ালার লাশটা কি তুমি তারাগাছির ওইদিকে ফেলেছিলে?” 

রঞ্জন বললেন, “জী স্যার। ওদিকে বসতি কম। তাই ওইদিকেই ফেলেছিলাম। যেভাবে ফেলেছিলাম, ভেসে ওঠার কথা না।” 

“সেটা আমার কথা না। লাশ হয়ত কিছুতে টেনে পাড়ে এনেছে। বিল যেহেতু।” 

“কিন্তু কিসে টেনে আনবে? যেভাবে লাশটাকে ফেলা হয়েছে তাতে শেয়াল কুকুরে তো টেনে আনা সম্ভব না। এখন কী করা উচিৎ স্যার?” 

“কথা হল। খবরটা এইভাবে ছেপেছে কেন? যেন কেউ এই খুনটাকে আর দশটা খুনের মতই মনে করে? তাহলে কি কেউ এর পেছনের ঘটনা জেনে গিয়েছে বলেই সেটা ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে? আমাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে?” 

“হতে পারে স্যার।” 

“উঁহু। নাহ, যদি কেউ জেনেও যায়, আর আমাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টাও করে, তাহলেও সেটা খুব একটা ভালো লক্ষণ না। বাইরের কেউ জানলে, বিশেষ করে মিডিয়ার কেউ জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তুমি লাশটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নাও রঞ্জন। আগে পত্রিকা অফিসে যাও। গিয়ে খোঁজ নাও কে এই খবর ছেপেছে। তারপর লাশটার যেন পোস্টমর্টেম না হয় সেই ব্যবস্থা কর। দ্রুত। গাড়ি নিয়ে যাও। কাবার্ডে আমার প্যান্টের পকেটে গাড়ির চাবি আছে।” 

রঞ্জন চলে যেতে চাচ্ছিলেন। হঠাৎ ফিরোজ সাহেব তাকে আবার ডাকলেন, “আচ্ছা শোন রঞ্জন। এক কাজ কর। দ্বীপশহরে এক উকিল থাকেন। শাকিল মাহমুদ। উনার সাথে একবার দেখা করে যেও। আমি ফোন দিয়ে দিচ্ছি। আর একটা কথা মনে রাখবা। পিস্তলকে কখনও কোনকিছুর সমাধান হিসাবে ব্যবহার করবা না। যদি দেখো সমস্যার সমাধান একেবারেই হচ্ছে না, সমস্যাটাই সরিয়ে ফেলতে হবে, কেবল তখনই ওটা ব্যবহার করবে। আর হ্যাঁ, ভালো কথা, ফাইল আর ভিডিও ফুটেজগুলো আজকেই হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দাও। ওগুলোর ব্যাপারে কেউ যেন জানতে না পারে। বিশেষ করে সরকারের কোন লোকজন আর মিডিয়ার কেউ তো অবশ্যই না। আমি নাসরিনকে বলে দিচ্ছি। ও ফাইলগুলো হাতে পেলেই আমাকে কনফার্ম করবে।” 

ইয়েস স্যার। রঞ্জনের স্বভাবসুলভ সামরিক উত্তর। 

কফির কাপটার দিকে চোখ পড়তেই ফিরোজের মনে হলো, কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। 

মেজর রঞ্জন একটা নীল পোলো শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরলেন। তারপর রিভলভারটা হোলস্টারে গুঁজে বেরিয়ে পড়লেন। ল্যান্ডরোভারটা বেরিয়ে গেল দু মিনিটের মধ্যে। 

মেজর জেনারেল আবার খবরের কাগজে মন দিলেন। 

হঠাৎ কি মনে করে মেজর জেনারেল আরেকবার মোড়ের দিকে তাকালেন। কালো গাড়িটা নেই। 

সকল অধ্যায়

১. পূর্বাভাস
২. প্যান্ডোরার ‘ব্যাগ’
৩. নরকের ভাঙা দরজা
৪. একজন বিচ্ছিন্নবাদী
৫. ব্যাগের পিরামিডের নিচে
৬. ছাই চাপা স্বপ্ন
৭. মেরিলিনার কথা
৮. প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প
৯. টিলার ওপর সোনার খাঁচা
১০. চৌদ্দ নম্বর গিনিপিগ
১১. অভিনিষ্ক্রমণ
১২. স্বীকারোক্তি
১৩. টিকটিকি
১৪. মাকড়সার লাশ
১৫. কার্পেটের নিচে ধুলো
১৬. ফাঁদ
১৭. প্লিজ, কেঁচো খুঁড়বেন না
১৮. মুখোমুখি
১৯. বিচ্যুত নিশানা
২০. কংসচক্র
২১. মৃতদেহের অভিশাপ
২২. শীতল শহুরে গুঞ্জন
২৩. হেডিস
২৪. ঈশ্বর
২৫. যমদূত
২৬. পোসাইডন
২৭. পুনর্জন্ম
২৮. নিম্নলিখিত উত্তরমালা
২৯. প্রমিথিউস
৩০. টিকিটিকি না, স্যালামেভার
৩১. ঝরে যাওয়া সময়ের গল্প
৩২. দারিয়ুসের অবিশ্বাস
৩৩. শেয়ালের গর্তে
৩৪. অপারেশেন মিরর হান্ট
৩৫. বিষাক্ত শহরে
৩৬. ধনুকের তূণ
৩৭. অসংশোধনযোগ্য ভুল
৩৮. পলায়ন
৩৯. মৃত্যু ছক
৪০. বহরমপুরের বাঁশিওয়ালা
৪১. অপারেশন ফুলস্টপ
৪২. শূন্যস্থানের শেষ সূত্র
৪৩. এবং সেই সূত্রের ভুলগুলো
৪৪. আর্ফিউসের ভুল
৪৫. নির্ণেয় সরলফল
৪৬. মালতী বালা বিউটি পার্লার
৪৭. শেষ পাপের প্রায়শ্চিত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন