মৃত্যু ছক

জুবায়ের আলম

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত টেলিফোন অপারেটরের কাছ থেকে দ্রুত নম্বরটা নিয়ে নিলেন মেজর জেনারেল ফিরোজ; যে নাম্বার থেকে বশির জামানের ফোন এসেছিল। নম্বরটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন তিনি। কোন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বশিরের সাথে কথা বলা যাবে না। সহজেই লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলবে লোকটা। যদিও ফিরোজের সাথে বশিরের কোন ব্যক্তিগত বিরোধ নেই, তারপরেও ঝুঁকি নেবেন না ফিরোজ। 

ল্যান্ডরোভারটা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল স্বদেশ কুঞ্জ থেকে। নিজের গোপনীয় আইপি নাম্বার থেকে ফোন করলেন বশিরের নম্বরে। নম্বরটা বন্ধ। যেভাবেই হোক বশিরের সাথে যোগাযোগ করতেই হবে। মাথার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে মেজর ফিরোজের। কি করবেন? বশিরকে ধরিয়ে দিয়ে নিজের বহু দিনের স্বপ্নের এজেন্সিটাকে দাঁড় করাবেন? বশির যদি প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের সব কথা ফাঁস করে দেয়? বশিরকে ধরিয়ে দিলে তিনি তার এজেন্সীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবেন। কিন্তু একই সাথে সব কিছু হারিয়ে ফেলার একটা আশঙ্কা কাজ করল তার ভেতরে। 

আবার কল করলেন। যথারীতি বন্ধ। এখন পর্যন্ত সব কিছু প্ল্যান মতই আছে। শুধু বশির জামানের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। যেভাবেই হোক। কিন্তু আরও কয়েকবার কল করার পরেও নম্বর বন্ধ পেলেন ফিরোজ। ব্যাপার না। তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। 

ল্যান্ডরোভারটা উদ্দেশ্যহীনভাবে কারফিউ লাগা শহরের ভেতরে ঘুরতে লাগল। মোড়ে মোড়ে পুলিশি প্রহরা। কোথাও কোথাও সেনাবাহিনীর ভ্যানও আছে। কিন্তু সামরিক পতাকা লাগানো ল্যান্ডরোভারটাকে কেউ আটকালো না। সামরিক পতাকার পাশাপাশি সবাই জানে এই গাড়িটা কে ব্যবহার করেন। ফিরোজ দেখলেন তিনজন পুলিশ দুইজন যুবককে গুলি করে লাশ ফেলে দিয়েছে। দুইটা রঙের বালতি কাত হয়ে পড়ে পুরো রঙটা রাস্তায় ছড়িয়ে গিয়েছে। ল্যান্ডরোভারটা রঙের ওপর দিয়েই চলে গেল। পুলিশ তিনজন স্যালুট জানালো ল্যান্ডরোভারটাকে। 

হঠাৎ ফিরোজের সেলফোনের স্ক্রিনের আলো জ্বলে উঠল। গোপন আইপি নম্বর থেকে কেউ কল করছে। নম্বর দেখাচ্ছে না। ফিরোজ বুক ভরে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর ফোনটা রিসিভ করে বললেন, “হ্যালো?” 

ওপাশ থেকে ফ্যাস ফ্যাসে কণ্ঠে বশির বললেন, “ভয় পেয়েছেন নাকি মেজর জেনারেল? আরেকটু হলেই তো প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রধানমন্ত্রীর সবথেকে বিশ্বস্ত চাকরটার সত্যিকারের রূপটা বেরিয়ে পড়ছিল।” 

ফিরোজ অপমানটা গায়ে মাখলেন না। সোজাসোজি বললেন, “আপনার সাথে দেখা করতে চাই। কোথায় এবং কবে আসব বলেন।” 

“এতদিন পরে আমার সাথে দেখা করতে চান! তাই নাকি? কেন? পা চাটতে আর ভালো লাগছে না?” 

“আমার কাছে আপনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন অপেক্ষা করছে।” 

“কে?” 

ফিরোজ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, “আপনার মেয়ে। মেরিলিনা।” ওপাশে বশির জামান নীরব। ফিরোজ বোঝার চেষ্টা করলেন, এই কথাটা শোনার পরে লোকটার চেহারার অবস্থা কেমন হয়েছে? বশির কখনওই নিজের আবেগ অন্য কাউকে বুঝতে দেবে না। তাই ফিরোজ সেরকম কিছু আশাও করেননি। 

বশির জামানের গলা থেকে তাচ্ছিল্যের ভাবটা গায়েব হয়ে গেল। তার বদলে গলায় সিরিয়াসনেস। তিনি বললেন, “আপনি এই নাম কিভাবে জানলেন?” 

“আপনার মেয়ে মেরিলিনাই আমাকে তার নাম বলেছে। সে এখন আমার কাছেই আছে।” 

“মিথ্যা কথা। আপনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছেন।” 

“বশির সাহেব। আমি ব্ল্যাকমেইল করার মত নিচু মন মানসিকতার লোক না। যদি হতাম, তাহলে অনেক আগেই শহরের মাঝখানে আপনার মেয়েকে পিটিয়ে আপনাকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করতাম। তার জীবনের বদলে আপনার মৃত্যু চাইতাম। সেরকম কিছুই কিন্তু আমি করিনি। সে আমার কাছেই আছে। ভালো আছে।” 

“ও কবে এসেছে? আপনি আর যাই করেন এই নামটা নিয়ে মিথ্যা বলবেন না মেজর জেনারেল। ফলাফল খুব খারাপ হবে।” 

“মিথ্যা বলছি না। কবে এসেছে জানি না। অনেক কথা। আমার মনে হয় আমাদের সামনাসামনি দেখা করা উচিৎ। আপনার সাথে এটা ছাড়াও অনেক কথা আছে আমার। প্রধানমন্ত্রী খুব তাড়াতাড়িই স্পেশাল ফোর্স নামাবেন। আমি চাই না আপনার কিছু হোক। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি বশির। শুধু আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আপনার সাথে প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের ব্যাপারে অনেক কথা বলার আছে।” 

ওপাশে নীরবতা। 

“বশির সাহেব? শুনতে পাচ্ছেন?” 

“ কাল সন্ধ্যায়। তাকিয়া মহলে চলে আসেন। মেরিলিনাকে ছাড়া আর কাউকে আনবেন না। আনলে সেটার ফলাফল দেখার মত অবস্থায় থাকবেন না আপনি।” 

“একটা শর্ত আছে বশির সাহেব।” 

“কি?” 

“মেরিলিনার বদলে আমাকে আশফাক চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিতে হবে।” কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর বশির বললেন, “আপনাকে একটা কথা বলি মেজর জেনারেল, প্রধানমন্ত্রীকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন না। আপনি যদি আজকে একটা মিথ্যাকে সমর্থন করেন, তাহলে সেই মিথ্যাই আপনার মৃত্যুর কারণ হবে। প্রতিটা মানুষই মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পৃথিবীতে আসে। সেও এসেছে। তার পাপের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাকেই সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।” 

লাইনটা কেটে গেল। 

ফিরোজ বুকের ভেতরে রাখা একটা চাপা নিঃশ্বাস বের করে দিলেন। বশির বেঁচে থাকলে তার বিপদ। সমূহ বিপদ। প্রকল্পের সব কথা ফাঁস হয়ে যাবে। 

বশিরকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না ঠিক করলেন মেজর জেনারেল ফিরোজ হক। 

***

ল্যান্ডরোভারটা পার্ক করে ফিরোজ হক সদর দরজার কাছাকাছি যেতেই দরজা খুলে দিল রুস্তম। ফিরোজ আসলেই একমাত্র রুস্তম বুঝতে পারে। সে দরজা খুলে দেয়। এটা সে কিভাবে করে, এখনও ফিরোজের কাছে রহস্য। ফিরোজ ঘড়ি দেখলেন। রুস্তম বসার ঘরের ইশারা করল। ফিরোজ সোজা বসার ঘরে গেলেন। তীলক বড়ুয়া বসে আছে সোফাতে। বিশাল শরীরটা সোফার ভেতরে অনেকখানি দেবে গিয়েছে। মানুষ হিসাবে তীলক বড়ুয়া রসিক এবং প্রাণবন্ত। এই হাসি খুশি মানুষটার পেছনে যে একজন ভয়ানক ক্রিমিনালিস্ট এবং দুর্দান্ত শ্যুটার আছে তা খুব কম মানুষই জানে। ইনি একজন নাম করা আর্ম ফোর্স ট্রেনারও। পেশাগত এবং বয়স- দুইদিক থেকেই ভদ্রলোক ফিরোজের বেশ জুনিয়র। এলিট ফোর্সের প্রধান হিসাবে তার নাম সব সময় গোপন রাখা হয়। খুব কম মানুষই তার নাম জানে। এবং নিরাপত্তার কারণেই তার পরিবার দেশের বাইরে থাকে। ফিরোজকে দেখেই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের হাত বাড়িয়ে দিলেন। 

ফিরোজ করমর্দন করে সোফায় বসতে বসতে বললেন, “কেমন আছ তীলক? চেহারা তো একদম চকচকে হয়ে গিয়েছে দেখছি। হা হা হা। নিলীমা আর সঞ্চয়িতা কেমন আছে? ওখানে গিয়েছিলে নাকি এর মধ্যে?” 

“ভালো নেই স্যার। নীলিমা আমার ভুঁড়ি নিয়ে বিরক্ত। কি করব বুঝতে পারছি না। আমার মেয়ে তো সেদিন আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বলছে বাবা আমার কি ছোট ভাই হবে? কেমনটা লাগে বলেন তো?” তীলক হাসতে হাসতে বলল। দুইজনই এক প্রস্থ হেসে নিলেন। রুস্তম দুই মগ কফি দিয়ে গেল। 

কথাটা ফিরোজই পাড়লেন, “বসের সাথে কথা হয়েছে?” 

তীলক বড়ুয়া মাথা নেড়ে কফির মগটা হাতে নিতে নিতে বললেন, “হ্যাঁ! প্রাইম মিনিস্টার স্যার ফোন করেছিলেন এক ঘণ্টা আগে।” 

“বুঝতেই পারছ তীলক, ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস।”

“হ্যাঁ। যতদূর শুনলাম, অনেক কমপ্লেক্স একটা ব্যাপার।” 

“বশির অনেক ভয়ঙ্কর একজন খুনি। একজন সাইকোপ্যাথ। ওর কিছু তথ্য আমার অফিসের একটা ফাইলে আছে। আমি কাল তোমাকে স্ক্যান করে মেইল করে দেব।” 

“আচ্ছা। তো প্ল্যান কি স্যার? ওকে আমরা কিভাবে ট্র্যাক করব?” 

“ওর সাথে কাল আমি মিট করব। মানিকপুকুরের একটা বাড়িতে।” 

অবাক হওয়ার কথা ছিল, তীলক অবাক হল না। যেন এটা শোনার জন্য সে প্রস্তুত হয়েই ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন, 

“তারমানে আপনি যাবেন, আর আমরা আপনাকে ফলো করব। এবং ওখানেই ওকে এরেস্ট করব। এই তো?” 

“কাছাকাছি গিয়েছ। আমি যাব। তোমরা বাইরে অপেক্ষা করবে। আমি ভেতরে গিয়ে ওর সাথে কথা বলব। আমার শার্টের বোতামে লুকানো ভিডিও ক্যামেরা থাকবে। তুমি পাঁচ মিনিটের ভেতরে জেনে যাবে ওর সাথে আর কে কে আছে। সেই পাঁচ মিনিটের ভেতরে তুমি টিম নিয়ে ভেতরে ঢুকে পজিশন নিতে শুরু করবে। আমি ওকে কথায় ব্যস্ত রাখব। প্রথমেই ওর আশেপাশে যারা থাকবে তাদেরকে ডিএক্টিভেট করতে হবে। আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করব সবাইকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে।” 

“তা তো বটেই।” 

“তুমি একটা প্লাটুনকে তিনটা দলে আর দুইটা উপদলে ভাগ করবে। রিইনফোর্সমেন্ট হিসাবে পুলিশ থাকবে। আমি ডিআইজি’র সাথে কথা বলে নেব।” 

সোফার সাইড টেবিলে থেকে একটা সাদা কাগজ টেনে নিয়ে ফিরোজ তাকিয়া মহলের এরিয়াটা আঁকালেন। তারপর বললেন, “তুমি টিম আলফা নিয়ে উত্তরদিকের কর্নার দিয়ে ঢুকবে। টিম বিটা পশ্চিম দিয়ে। আর টিম গামা পূর্ব দিক দিয়ে। দক্ষিণ দিকে দুইটা সাব টিম অ্যামবুশের জন্য অপেক্ষা করবে। অ্যামবুশ অবশ্য দরকার হবে না যদি না ওরা পালানোর চেষ্টা করে। 

তীলক মাথা নাড়ল।”

ফিরোজ আরও কিছু ছোটখাট ব্যাপার বলে কফির মগটা হাতে নিলেন। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। ঠাণ্ডা কফিতেই চুমুক দিয়ে ফিরোজ বললেন, “ কাল তুমি প্লাটুনের সবার তথ্য বসের কাছে জমা দাও। অপারেশনের বিস্তারিত বর্ণনার একটা কপি বসকে দিও। কাল দুপুরে আমি তোমার ওখানে আসছি। প্লাটুনের সবাইকে আমি পুরো প্ল্যানটা বুঝিয়ে দেব। কাল সন্ধ্যার ভেতরে আমরা রেডি হয়ে যাব।” 

তীলক মাথা নাড়ল। 

কফি খেতে খেতেই একজন মানুষরূপী জন্তুকে শিকার করার ছক কষা হয়ে গেল। দুইজনেরই কেউই জানেন না, মানুষরূপী জন্তুকে জন্তুর মত করেই ধরতে হয়। মানুষের মত করে না। 

***

লম্বাকৃতির হলঘর। অন্ধকার। এক কোণায় চারটা ছায়া মূর্তি দেখা যাচ্ছে। 

একটা ছায়ামূর্তি বাদে বাকি তিনটা ছায়ামূর্তি কাঠের ক্রেট খুলতে ব্যস্ত। এক একটা ক্রেট খুলে চকচকে কার্বাইন আর অ্যাসন্ট রাইফেলগুলো খবরের কাগজের ওপরে রাখছে। ক্রেটের ভেতরে রাখা বিচালীগুলোতে খস খস শব্দ হচ্ছে। ম্যাগজিনের ক্রেটগুলো এখনও খোলা হয়নি। হ্যান্ড গ্রেনেড আর ধারালো অস্ত্রের ক্রেটগুলোও খোলা বাকি আছে। 

হলঘরের শেষ মাথায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। যেই ছায়ামূর্তিটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল সে তাকাল সেদিকে। একটা লম্বা ছায়া পড়ল মেঝেতে। আস্তে আস্তে ছায়াটা ছোট হতে হতে একটা বেঁটে খাট মানুষে পরিণত হল। বেঁটে খাট মানুষটার গায়ে একটা হাফহাতা শার্ট আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট। মাথায় সাদা রঙের সুতি টুপি। পায়ে রবারের সস্তা জুতা। লোকটার নাম সুলেমান। কংসচক্রের অস্ত্র সরবরাহকারী। থাইল্যান্ড রুটে অস্ত্র চোরাচালানে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কংসচক্রের সাথে সে আছে আজ প্রায় দশ বছর হল। চক্রের অন্তর্ধানের পর পরই সে গা ঢাকা দেয়। আজ আবার তার ডাক পড়েছে। 

লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “কত্তদিন পর, হ্যাঁ? কত্তদিন পর! কেমন আছেন? কখন পৌঁছালেন?” ছায়ামুর্তিটা ঠোঁটে একটা চুরুট ধরিয়ে ম্যাচের কাঠি জ্বালাল। কাঠির আগুনে কংসের মুখটা আলোকিত হল কিছুক্ষণের জন্য। সরীসৃপের মত ফ্যাকাশে মুখে এক জোড়া ঘোলাটে চোখ। 

ছায়ামুর্তিটা কংস। 

“ভালোই আছি সুলেমান। বিকালে পৌঁছলাম এয়ারপোর্টে।” কংস চুরুটে টান দিয়ে বলল। 

বেঁটে খাট সুলেমান বলল, “কি যে বলেন। আপনাদের জন্য এই মথুরা আগলায়ে রাখছিলাম। এখন আপনি এসে গেছেন, আর কোন চিন্তা নাই। মালপত্র সব ঠিকঠাক পাইছেন তো?” 

“হ্যাঁ।” কংস একটা কার্বাইন হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখল। ম্যাগাজিন লিভারটা টেনে ছেড়ে দিতেই খটাশ করে একটা শব্দ হল। কংসকে দেখে মনে হল, নতুন খেলনা পেয়ে সে খুশি। 

সুলেমান আমতা আমতা করে বলল, “আমার একটা কথা ছিল, যদি কিছু মনে না করেন।”

“বলে ফেল।”

“এই এত কম লোকজন নিয়ে কাজটা করতে যাওয়া কি উচিত হচ্ছে? মানে আমি বলছি যে, যতদিন না ডায়েরিটা পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন নিজেদের গুছায়ে নিলে হত না? এখনও অনেকে আপনের ফেরার খবরটা জানে না। এই অবস্থায় এই কাজটা করতে গেলে লাফড়া হয়ে যাবে। সরকারি কুত্তাগুলা পুরা শক্তি দিয়ে এবার কংসচক্রের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগবে। আগের বার তো দেশ ছাড়া করেছিল, এবার পৃথিবী ছাড়া করবে।” 

কার্বাইনটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে কংস বলল, “আমি এখানে বসে থাকতে আসিনি সুলেমান। এই শহরটাকে আর এই দেশটাকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে কংসচক্র কী জিনিস। আর কংসচক্র কি করতে পারে। আর ডায়েরি আজ হোক কাল হোক খুঁজে বের করে ফেলবই। তাছাড়া তফিসুল বারীকে না সরালে আমরা কিছুই করতে পারব না। গত বিশ বছরে সব প্রধানমন্ত্রীরা যা করতে পারেনি এই তফিসুল বারী একা সেই কাজটা করে দেখিয়েছে। একে না সরানো পর্যন্ত না আমরা ডায়েরির খোঁজ করতে পারব, না আমরা দেশের কোথাও হাত দিতে পারব।” 

কংস দেয়ালের একটা অংশ ধরে টান দিতেই হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকতে শুরু করল হলঘরটাতে। কংস তার বাম হাতটা আলগোছে নাড়ালো। হিসহিস করে বলল, “বাতাস এলোমেলো বইছে সুলেমান। এই এলোমেলো বাতাসই বলে দিচ্ছে, এখনই ছোবল দেওয়ার সময়।” 

সুলেমান আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কংস তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি তা জানো না যা আমি জানি সুলেমান।” 

সুলেমান আর কথা বাড়াল না। অদ্ভুত একটা শব্দ করে নাকে জমে থাকা সর্দি টেনে গিলে ফেলল। 

ম্যাগাজিনের ক্রেটটা খোলার শব্দ হল খটাস করে। ক্রোবারটা মাটিতে পড়ার ধাতব শব্দ হলঘরে প্রতিফলিত হল। কংস কার্বাইনটা পাশের ক্রেটে রাখতে রাখতে বলল, “কয়েকটা নাইট ভিশন গগলস লাগবে সুলেমান।” 

“অন্ধকারে দেখা যায় সেই চশমা তো?” 

“হ্যাঁ।” 

“পাওয়া যাবে। কিন্তু দুইদিন দেরি হবে যে।”

“দুইদিন দেরি হলে হবে না। আমার পরশু রাতে লাগবে।” 

“পরশু ক্যামনে দেই? সন্ধ্যার পরে আবার কারফিউ লাগে। কাল সকালে ছাড়া তো পোর্টে যাওয়া যাবে না।” 

“কারফিউ লাগে কেন?” 

“আরে শহরের কি অবস্থা জানেন না? পলিটিশিয়ানদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে পাইকারি হারে।” 

কংস আর কোন কথা বলল না। জানতেও চাইল না পাইকারি হারে লাশ পাওয়ার পেছনের কারণ কি। নীরবে চুরুটে কয়েকটা টান দিল সে। ‘পলিটিশিয়ানদের ব্যাপারে সে অনাগ্রহী। বলল, “একটা পুলিশের ভ্যান ম্যানেজ করতে পারবা?” সুলেমান মাথা নেড়ে জানালো যে সে পারবে। কংস বলল, “পুলিশের ভ্যান ম্যানেজ করে আমার কয়েকজন লোক নিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে বের হবা। পুলিশের ভ্যান থেকে গুলি চালাতে হবে। রাস্তায় কয়েকটা বডি ফেলে দিলেই কারফিউ মাথায় উঠবে।” 

সুলেমান অন্ধকারে মাথা নাড়ল। কংস আবার বলল, “আর প্রতিটা জেলার চেম্বার অফ কমার্সে চিঠি দিয়ে দাও।” 

“কিসের চিঠি?” 

এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে কংস বলল, “কংস দরবার আবার খুলছে। শহরে আবার আগুন জ্বলবে সুলেমান। অনেকদিনের পুরনো আগুন আবার জ্বলবে। কিন্তু তার আগে এই তফিসুল বারীকে রাস্তা থেকে সরাতে হবে। তারপর ডায়েরিটা খুঁজে বের করব।” 

সকল অধ্যায়

১. পূর্বাভাস
২. প্যান্ডোরার ‘ব্যাগ’
৩. নরকের ভাঙা দরজা
৪. একজন বিচ্ছিন্নবাদী
৫. ব্যাগের পিরামিডের নিচে
৬. ছাই চাপা স্বপ্ন
৭. মেরিলিনার কথা
৮. প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প
৯. টিলার ওপর সোনার খাঁচা
১০. চৌদ্দ নম্বর গিনিপিগ
১১. অভিনিষ্ক্রমণ
১২. স্বীকারোক্তি
১৩. টিকটিকি
১৪. মাকড়সার লাশ
১৫. কার্পেটের নিচে ধুলো
১৬. ফাঁদ
১৭. প্লিজ, কেঁচো খুঁড়বেন না
১৮. মুখোমুখি
১৯. বিচ্যুত নিশানা
২০. কংসচক্র
২১. মৃতদেহের অভিশাপ
২২. শীতল শহুরে গুঞ্জন
২৩. হেডিস
২৪. ঈশ্বর
২৫. যমদূত
২৬. পোসাইডন
২৭. পুনর্জন্ম
২৮. নিম্নলিখিত উত্তরমালা
২৯. প্রমিথিউস
৩০. টিকিটিকি না, স্যালামেভার
৩১. ঝরে যাওয়া সময়ের গল্প
৩২. দারিয়ুসের অবিশ্বাস
৩৩. শেয়ালের গর্তে
৩৪. অপারেশেন মিরর হান্ট
৩৫. বিষাক্ত শহরে
৩৬. ধনুকের তূণ
৩৭. অসংশোধনযোগ্য ভুল
৩৮. পলায়ন
৩৯. মৃত্যু ছক
৪০. বহরমপুরের বাঁশিওয়ালা
৪১. অপারেশন ফুলস্টপ
৪২. শূন্যস্থানের শেষ সূত্র
৪৩. এবং সেই সূত্রের ভুলগুলো
৪৪. আর্ফিউসের ভুল
৪৫. নির্ণেয় সরলফল
৪৬. মালতী বালা বিউটি পার্লার
৪৭. শেষ পাপের প্রায়শ্চিত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন