প্রশ্ন – গৌরকিশোর ঘোষ

প্রশ্ন – গৌরকিশোর ঘোষ

এবার অনেকদিন, বেশ কয়েক বছর পরে, ও এল। এল আমার অফিসেই। পরনে ঢলঢলে প্যান্ট আর গায়ে কোঁচকানো শার্ট। জুতোর দিকে আর চাইলাম না। ও দিকের অবস্থা যে কী, বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। আশ্চর্য, এই কয় বছরে একটুও বদলায়নি। না পোশাকে, না স্বভাবে। ক বছর আগে প্রচণ্ডভাবে অপমান করার পরে ওকে যেমনভাবে রাস্তায় ফেলে চলে গিয়েছিলাম, ঠিক তেমনিভাবে অবিকল সেই পোশাকেই ও দরজা ঠেলে আমার কামরায় এসে ঢুকল।

স্বভাবসিদ্ধ মৃদু গলায় আমাকে বলল, এই যে। এইটে তাহলে তোমার ঘর। সত্যি তোমার কত উন্নতি হয়েছে। দেখে ভাল লাগল।

ওকে দেখে আমি হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলাম। একটু বিভ্রান্তও হয়ে পড়লাম। কোনও কথা না বলে মুখ নিচু করে কাজে মন দিলাম। ঝাঁ করে মনে পড়ল, সেবার ওর সঙ্গে খুবই রূঢ় ব্যবহার করেছিলাম। অতটা কড়া না হলেও বোধহয় চলত।

একটু থেমে যেন আপন মনেই বলে উঠল, হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। এত হাঁটাতে হয় আজকাল। তারপর শীরটাও ভাল নেই। বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছি। একটু হাঁটলেই মাথা ঘোরে। বুকটাও কেমন ধড়ফড় করে। আজকাল তো আর কলকাতায় থাকিনে। থাকি হালিশহরের ঐদিকে। ট্রেন ধরতেও অনেকখানি হাঁটতে হয়। অনেক সকালে বেরিয়ে পড়ি। সব দিন খেয়েও আসতে পারিনে।

আমি নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম। আমার ভিতরে প্রবল একটা বিতৃষ্ণার ভাব এরই মধ্যে এসে গিয়েছে। আমি সেটাকে দমন করবার চেষ্টা করছিলাম। গতবারের ঘটনা মনে পড়ল। এবারও ও ভিক্ষা চাইতে এসেছে কথাটা মনে হতেই চমকে গেলাম। এটাকে ভিক্ষা বলছি কেন? ছিঃ।

ও মৃদুস্বরে বলল, তোমার শরীর খারাপ হয়েছিল শুনেছিলাম। এখন তো ভালই আছ, না? তোমার এ ঘরটা তো বেশ বড়ই। টেবিলও বেশ বড়। পাশের টেবিলে কে বসেন? তোমার কোনও কলিগ্ বুঝি? ও এত কথা বলছে কেন? কোনও কথা না বলে ও যদি চুপ করে বসে থাকত তাহলে হয়তো ওর উপর আমার এত রাগ হত না। না, আজ আমি নিজেকে কিছুতেই ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না। যা খুশি ও বলুক।।

ও আপন মনেই বলে উঠল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আমি তুমি কি একটু বসতেও বলবে না।

ঝপাৎ করে কেউ যেন আমাকে চাবুক মারল। বললাম, বস। কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে দেব না। কাজ আছে।

খালি চেয়ারে বসে পড়ে তেমনি আস্তে আস্তে ও বলল, কাজ তো আছেই। তোমার কাজে বাধা দেব না। আমি এখনই চলে যাব। একটু চা খাওয়াবে না? গলা শুকিয়ে গিয়েছে।

বেয়ারাকে ডেকে চা আনতে বললাম। ও বলল, শুধু চা-ই খাওয়াবে? তোমাদের এখানে তো অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিছু আনতে বল না।

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, এটা অফিস। খাবারের দোকান নয়।

ও দুঃখও পেল না। অপমানও ওর গায়ে লাগল না। তেমনি ধীর স্বরে বলল, এটা অফিস তাতো জানি তুমি এমন ভাব করছ যেন তুমি ক্ষিধে পেলে এখানে কিছু খাও না বা অন্য কাউকেও কখনও কিছু খাওয়াও না। নাও, কিছু আনতে বল। আজ সারাদিন কিছু খাইনি।

ভাবলাম কিছু আনিয়ে দিই। কিন্তু মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, তোমার খাওয়া হয়নি তো আমি কী করব? এটা সদাব্রত নয়, আমার বাড়িও নয়।।

ও অম্লান বদনে বলে বসল, তবে তোমার বাড়িতেই নিয়ে চল না। ভাল করে খাইয়ে দাও না একদিন। কতদিন যে ভাল কিছু খাইনি।

বললাম, চা খাও। খেয়ে চলে যাও। আমার কাজ আছে।

আমার স্বর তিক্ত হয়ে উঠেছে।

ও বলল, সত্যিই কিছু খাইনি আজ! আমাকে তবে কিছু টাকা দাও।

হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। আমার ভিতরে একটা নির্দয় মানুষ তখন জেগে উঠেছে। সে ছোবল মারবার ফাঁক খুঁজছে।

ও কোনও কিছুই গায়ে মাখল না। আপন মনেই বলে চলল, তবে তুমি আমাকে পাঁচটা টাকা দাও। আমি খুব মুশকিল পড়েছি। জান?

গলার স্বর চড়িয়ে ওকে বললাম, তোমাকে কিছুই দেব না। তুমি চলে যাও।

ও তেমনি মৃদুস্বরে বলল, পাঁচটা টাকা তোমার কাছে এমন কী? পাঁচটা টাকা তুমি অনায়াসেই দিতে পার।

আমি যেন কথা দিয়ে ওকে খুন করব। বললাম, তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছ না। তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছি।

ও উঠল না। বসে বইল। বলল, তবে আমাকে দুটো টাকা দাও। আমি কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলাম, তুমি যদি এখনই না ওঠো, তবে আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

ও বলল, তুমি কি বুঝতে পারছ না, তুমি কিছু না দিলে আমাকে আবার হাঁটতে হবে। এই খালি পেটে…শরীর দুর্বল…একটা মানুষ কত আর হাঁটতে পারে…তুমি মাঝে মাঝে কেন যে এত অবুঝ হয়ে ওঠো…এমন কি ভাল দুটো কথাও বল না।…

আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম। ও চলে গেল।

আবার হয়তো কয়েক বছর আসবেই না। হয়তো কালই আসবে। পঁচিশ বছর ধরে এই রকম চলছে। আশ্চর্য, ওর কোনও পরিবর্তন নেই। পঁচিশ বছর আগেও যে-রকম ছিল, আজও সেই রকম। পঁচিশ বছর আগে আমি আর ও একই রকম ছিলাম। তবে ওকে, কেন আজ সহ্য করতে পারি নে।।

৯ নভেম্বর ১৯৭৩

সকল অধ্যায়

১. রবিবার – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. একটি পাড়াগাঁয়ের মেয়ের প্রেমকাহিনী – সরলাবালা সরকার
৩. ভরতের ঝুমঝুমি – পরশুরাম
৪. মাথার বালিশ – উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়
৫. নিরুপম তীর্থ – জগদীশ গুপ্ত
৬. আহ্বান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৭. কঙ্কাল – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
৮. যাদুকরী – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. প্রিয় চরিত্র – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. বোবা – বনফুল
১১. অপরাজিতা – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১২. আমি এখানে ছিলাম – প্রমথনাথ বিশী
১৩. সভাপর্ব – মনোজ বসু
১৪. আর্দালি নেই – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৫. রেডিয়ো সর্বদাই রেডি – শিবরাম চক্রবর্তী
১৬. অন্ধকারের অন্তরালে – সরোজকুমার রায়চৌধুরী
১৭. বেলা যে গেল – অন্নদাশঙ্কর রায়
১৮. স্নব্ – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৯. অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
২০. হিসাব নিকাশ – সতীনাথ ভাদুড়ী
২১. অ্যাবারক্রোম্বি – লীলা মজুমদার
২২. সঞ্চয়াভিলাষীর অভিযান – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২৩. ভাড়াটে বাড়ি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৪. আবছায়া – বুদ্ধদেব বসু
২৫. আত্মজ – আশাপূর্ণা দেবী
২৬. রুপো ঠাকরুনের ভিটা – সুবোধ ঘোষ
২৭. অনিমন্ত্রিত আশুকাকা – বিমল মিত্র
২৮. কবি শিশির রায়ের মৃত্যু – অজিতকৃষ্ণ বসু
২৯. নীল পেয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
৩০. তমোনাশের মন – অদ্বৈত মল্লবর্মণ
৩১. ক্যালেন্ডার – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৩২. প্রহরী – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
৩৩. পটভূমি – শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৪. স্ত্রৈণ – সন্তোষকুমার ঘোষ
৩৫. বীরভোগ্যা – শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৬. পিকুর ডায়েরী – সত্যজিৎ রায়
৩৭. ইন্টারভিউ – বিমল কর
৩৮. খুনি বউ – রমাপদ চৌধুরী
৩৯. প্রশ্ন – গৌরকিশোর ঘোষ
৪০. বিহিত – সমরেশ বসু
৪১. পর্বত – মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য
৪২. তাপ্পিমামার অপেক্ষায় – হিমানীশ গোস্বামী
৪৩. মায়ার খেলা – ইন্দ্রমিত্র
৪৪. ছিনতাই – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৪৫. বুনোহাঁসের মাংস – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৪৬. ফুল – শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়
৪৭. একটি পিকনিকের অপমৃত্যু – মতি নন্দী
৪৮. কুসুম আসছে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৪৯. চোর চাই – শংকর
৫০. নিশীথে সুকুমার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৫১. ঈর্ষা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫২. মেঘনার গল্প – প্রফুল্ল রায়
৫৩. ঠগী – তুলসী সেনগুপ্ত
৫৪. আজ আমার সংবর্ধনা – অতীন বন্দোপাধ্যায়
৫৫. আমার মেয়ের পুতুল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫৬. P.A. – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৫৭. ভীষণ ভিড়ের মধ্যে – তারাপদ রায়
৫৮. লাল ভেটকি – বুদ্ধদেব গুহ
৫৯. এক্সপ্রেস – নবনীতা দেব
৬০. ওতুলের প্রতিদ্বন্দ্বী – বাণী বসু
৬১. মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ – দিব্যেন্দু পালিত
৬২. নীল আলোয় – শেখর বসু
৬৩. তিনতলার ঘর – রমানাথ রায়
৬৪. ঈশ্বরের ভূমিকায় – সমরেশ মজুমদার
৬৫. কম্পি বড় ভাল মেয়ে – সুব্রত সেনগুপ্ত
৬৬. পৃথিবীটা কার বশ – শৈবাল মিত্র
৬৭. উনিশ বছর বয়স – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৬৮. চান্দ্রায়ণ – সুব্রত মুখোপাধ্যায়
৬৯. একদিন অমিতাভ – রাধানাথ মণ্ডল
৭০. ঈর্ষা – আবুল বাশার
৭১. নবগ্রামের মেয়ে – অমর মিত্র
৭২. ভাগের মা – মানব চক্রবর্তী
৭৩. ঝড়ে কাক মরে – স্বপ্নময় চক্রবর্তী
৭৪. মল্লার যেখানে নামে – জয় গোস্বামী
৭৫. জার্মানি যাচ্ছি না – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন