ভারতচন্দ্র রায়
নায়িকা প্রকরণ
শৃঙ্গার বীভৎস হাস্য রৌদ্র বীর ভয়। করুণা অদ্ভুত শান্তি এই রস নয়।।
 অদ্যরস সকল রসের মধ্যে সার। নায়িকা বর্ণিব অগ্রে তাহার আধার।।
নায়িকার স্বীয়াদি ভেদ
 স্বীয়া পরকীয়া আর সামান্য বণিতা। অগ্রে এই তিন ভেদ পণ্ডিতবর্ণিতা।।
স্বীয়া নায়িকা
 কেবল আপন নাথে অনুরাগ যার। স্বকীয়া তাহার নাম নায়িকার সার।।
 নয়ন অমৃত নদী : সর্ব্বদা চঞ্চল যদি : নিজপতি বিনা কভু অন্য পানে চায় না।
 হাস্য অমৃত সিন্ধু : ভুলায় বিদ্যুৎ ইন্দু : কদাচ অধর বিনা অন্য দিকে ধায় না।।
 অমৃতের ধারা ভাষা : পতির শ্রবণে আশা : প্রিয়সখা বিনা কভু অন্য কানে যায় না।
 নতি রতি গতি মতি : কেবল পতির প্রতি : ক্রোধ হলে মৌনভাব কেহ টের পায় না।।
মুগ্ধাদি ভেদ
 মুগ্ধামধ্যে প্রগল্ভা তাহার ভেদ তিন। তিনেতে এ তিন ভেদ বুঝহ প্রবীণ।।
মুগ্ধা
 মুগ্ধা বলি তারে যার অঙ্কুর যৌবন। বয়ঃসন্ধি সেই কাল বুঝ বিচঃক্ষণ।।
 দেখিনু নাগরী : রূপের সাগরী : বয়সসন্ধি সময়।
 শিশুগণ মিলি : রাঁধুবাড়ু খেলে :পুরুষে কিঞ্চিৎ ভয়।।
 হংস খঞ্জরীটে : দেখি পদে দিঠে : কবে হল বিনিময়।
 হৃদয়সরোজ : পূজিতে মনোজ : পণ্ডিতে হয় সংশয়।।
নবোঢ়া
 এ যদি রমণে লাজে ভয়ে হয় স্তব্ধ। নবোঢ়া তাহাকে বলি প্রশ্রয়বিশ্রব্ধ।।
স্বকীয়া নবোঢ়া
 হস্তেতে ধরিয়া : শয্যায় আনিয়া : যদি বা কোলে বসায়।
 নানা বাক্যচ্ছলে : যত্নে কলে বলে : বাহিরে যাইতে চায়।।
 নবোঢ়াকে বশ : করণ কর্কশ : সে রস কহিব কায়।
 যেই পারা করে : স্থির করে ধরে : সেই জন ব্যামোহ পায়।।
পরকীয়া নবোঢ়া
 আপনার পতি আছে : ভয়েতে না শুই কাছে : গায়ে হাত দেয় পাছে : এই ডরে ডরে হে।
 প্রীতের বিষম কাজ : সে ভয়ে পড়িল বাজ : লাজে গলাইয়া লাজ : আশা বাসা করে হে।।
 মুখের বাড়াও প্রীতি : হৃদয়ের হর ভীতি : তার পরে যেবা রীতি : রাখ রক্ষা কর হে।
 যৌবন কমলাঙ্কুর : লোভে না করিও চুর : হিয়া কাঁপে দুরদুর : পাছে যাই মরে হে।।
সামান্য নবোঢ়া
 কি ছার ধনের আসে : আইনু তোমার পাশে : আগে জানিতাম নাহি এত দায় হবে হে।
 মুখ দেখি শোষে মুখ : বুক দেখি কাঁপে বুক : মনে হতে মন পড়ে কিসে প্রাণ রবে হে।।
 কেবা ইহা সহিবেক : আমা হতে নহিবেক : ক্রুদ্ধ হও যদি নিজ ধন ফিরে লবে হে।
 যেবা তীর্থে নাইলাম : তারি পুণ্য পাইলাম : অতঃপর ক্ষমা দেহ আমারে না সহে হে।।
বিশ্রব্ধ নবোঢ়া
 স্তন দুটি করে ছ্যাঁদা : উরু দুটি ভুজে বাঁধা : লাজে ভয়ে মুদিল নয়ন।
 প্রথমেতে নিরুত্তর :না না না তা : টাল টোল এখন তখন।।
 যদি খেয়ে লাজ ভয় : কিঞ্চিত সঞ্চিত হয় : তবে আর না যায় ধারণ।
 নবীন ভূষণ বাস : নব সুধা হাস বাস : নর রস কে করে গণন।।
মুগ্ধার ভেদ
 মুগ্ধার প্রভেদ দুই করিয়া বর্ণনা। অজ্ঞাতযৌবনা আর বিজ্ঞাতযৌবনা।।
অজ্ঞাতযৌবনা
 হয়েছে যৌবন যার নহে অনুভব। অজ্ঞাতযৌবনা তাকে বলে কবি সব।।
 সখা সখী মেলি : ধাওয়াধাওয়ি লেলি : হারি কেহ যেন চোর।
 অন্য দিনে ধাই : সবা আগে যাই : আজ কেন হারি মোর।।
 নিতম্ব হৃদয় : ভারি হেন লয় : চক্ষু কর্ণে পড়ে জোর।
 কটি দেখি ক্ষীণ : খসে পড়ে চীন : বাড়ে ঘাগরার ডোর।।
বিজ্ঞাতযৌবনা
 নিজ নবযৌবন যে ব্যক্ত করে ছলে। বিজ্ঞাতযৌবনা তাকে কবিবর বলে।।
 দেখিলাম ঘরে ঘরে : সকলে কাঁচলী পরে : নানা বর্ণে উড়ায় উড়ানি।
 পরিহাস্যজন যত : নানা ছলে কহে কত : বাহিরায় হইল পোড়ানী।।
 দেহের কি কব কথা : সকল শরীর ব্যথা : কত শত বিছার জ্বলনী।
 তোরে বলি প্রিয় সই : লাজে কারে নাহি কই : পাছে জানে জনক জননী।।
মধ্যা
 লজ্জা আর রতিআশা সমান যাহার। রসিক পণ্ডিতে কহে মধ্যা নাম তার।।
 রতি রসে কৃতি পতি : মোরে ভালবাসে অতি : দেয় নিজাঙ্গুরী কণ্ঠমালা।
 আঁখিআড়ে নাহি রাখে : সদা কাছে কাছে থাকে : সুখ বটে কিন্তু এক জ্বালা।।
 নখাঘাত দেখি বুকে : দন্তচিহ্ন দেখি মুখে : সখি হাসে কর্ণে লাগে তালা।
 শয্যা ঠেকি এই দোষে : না শুইলে পতি রোষে : শরীর হইল ঝালাপালা।।
প্রগল্ভা
 প্রগল্ভা সে রতিরসে পূর্ণ আশা যার। রতি প্রীতি আনন্দেতে মোহ হয় যার।।
মধ্যা প্রগল্ভা ধীরাদি ভেদ
 মানকালে মধ্যা প্রগল্ভার তিন ভেদ। ধীরাধীরা আর ধীরাধীরা পরিচ্ছেদ।।
 মুগ্ধার এ ভেদ নাই ভয় তার মূল। ক্রোধ হলে এক ভাব ক্রন্দনআকুল।।
 প্রকারে প্রকাশে ক্রোধ যে জন সে ধীরা। সোজাসোজি যার ক্রোধ সে জন অধীরা।।
 কিছু সোজা কিছু বাঁকা যার হয় ক্রোধ। ধীরাধীরা বলে তারে পণ্ডিত সুবোধ।।
মধ্যা ধীরা
 আজি প্রভু দড় দড় : বেশ বনায়েছ বড় : শ্বেত রক্ত চন্দনের : চাঁদ ভালে ধরেছ।
 মন দেখি ভাঙ্গা ভাঙ্গা : নয়ন হয়েছে রাঙ্গা : বুঝি কোন দোষ দেখি : মোরে রোষ করেছ।।
 তোমা বিনা প্রভু নাই : যাইবার নাহি ঠাঁই : কুমুদের চাঁদ যেন : তেন মন হরেছ।
 অপরাধ ক্ষমা কর : নূতন চন্দন পর : এই লও নবমালা বাসীমালা পরেছ।।
মধ্যা অধীরা
 সোহাগ করিয়া নিত্য : বসহ আমার ভৃত্য : আজি দেখি এ কি কৃত্য : দর্পণেতে চাও হে।
 অধরে কজ্জলদাগ : নয়নে তাম্বুলরাগ : অলক্তাক্ত ভাল ভাগ : কার কাছে পাও হে।।
 মোরে প্রাণ বলে ডাক : অন্যের নিকটে থাক : বুঝিলাম মনে রাখ : মন কলা খাও হে।
 তোমা দেখি হয় ভীতি : কঠিন তোমার রীতি : বুঝিনু তোমার প্রীতি : যাও যাও যাও হে।।
মধ্যা ধীরাধীরা
 তুমি মোর প্রাণপতি : কখন ধরিলা রতি : বুঝি সুখে ভুলেছিনু : তেঁই নাই মনে হে।
 বুকে দেখি নখচিহ্ন : অধর দর্শনে ভিন্ন : ভালে আলতার দাগ : রক্তিমা নয়নে হে।।
 শ্রমযাক মুখ ধোও : ক্ষণেক শয্যায় শোও : ছুঁয়ে শুদ্ধ কর মালা : তাম্বুল চন্দন হে।
 কত জান ভারিভুরি : দেখিতে দেখিতে চুরি : পরিহার নমস্কার : তোমা হেন জনে হে।।
প্রগল্ভা ধীরাধীরা
 কাজের সময় : যত কথা হয় : এবে কোথা রয় : মনে না থাকে।
 কেমন ধরম : কেমন রকম : কেমন মরম : কহিব কাকে।।
 ধিক্ বিধাতায় : এ হেন আমায় : দিয়াছে তোমায় : ইহারি পাকে।
 দেখি হে চঞ্চল : ছোঁবে কি অঞ্চল : এ কাজে কি ফল : কে তোমা ডাকে।।
প্রগল্ভা অধীরা
 কোন ফুলে বঁধু : পান কর মধু : হয়ে এলে যদু : পোড়াতে মোরে।
 আল্তা কজ্জল : সিন্দুর উজ্জ্বল : জাগিয়া বিকল : নয়ন ঘোরে।।
 এতেক বলিয়া : ক্রোধেতে জ্বলিয়া : কমল ফেলিয়া : মারিল জোরে।
 কাঁদিয়ে নাগর : গুণের সাগর : কোথায় আদর : থাকয়ে চোরে।।
প্রগল্ভা ধীরাধীরা
 জাগিয়া নয়ন : তোমার যেমন : আমার তেমন : সকল বটে।
 সব কাজে মম : ফলে তরতম : কিসে আমি কম : বুঝিলে বটে।।
 বিধি কৈল নারী : লাজ দিল ভারী : তেঁই সে না পারি : তোমার হঠে।
 বৃক্ষমূলে হানি : শিরে চাল পানি : চরণ দুখানি : নৌকার তটে।।
জ্যেষ্ঠাদি ভেদ
 এই ধীরা এ অধীরা এই ধীরাধীরা। জ্যেষ্ঠা আর কনিষ্ঠা দ্বিভেদ হয় ফিরা।।
 পতির অধিক স্নেহ যারে সেই জ্যেষ্ঠা। অল্প স্নেহ যারে তারে বলয়ে কনিষ্ঠা।।
ধীরা জ্যেষ্ঠা
 স্ত্রীর বুঝি ধীর ক্রোধ : দূরে গেল শোধবোধ : বন্ধু করে উপরোধ : ধীরে ধীরে কহিছে।
 যদি পেয়ে থাক দোষ : তবু যুক্ত নহে রোষ : হাস্য কর পরিতোষ : কামানলে দহিছে।।
 রক্তপদ্ম দুটি পায় : ভ্রমর নূপুর তায় : নিত্য নানারস খায় : আজি তাই রহিছে।
 আকূল আমার প্রাণ : তবু নহে সমাধান : কঠিন তোমার মান : পরিমাণ নহিছে।।
ধীরা কনিষ্ঠা
 স্ত্রীর দেখে স্থির মাস : করিবারে সমাধান : বন্ধু করে অপমান : ক্রোধে ক্রোধ হরিব।
 কিসে মোর পেয়ে দোষ : কেন কর এত রোষ : কিসে হবে পরিতোষ : বল তাই করিব।।
 কেহ বুঝি কহিয়াছে : গিয়াছিনু কারো কাছে : অঙ্গে বুঝি চিহ্ন আছে : তবে কিসে তরিব।
 আরম্ভিয়া ছিল ক্রোধ : তা করিল উপরোধ : এত দূরে শোধবোধ : কত সেধে মরিব।।
অধীরা জ্যেষ্ঠা
 যদ্যপি অধীরা হয়ে : গালি দিলা কটু করে : তবু থাকিলাম সয়ে : না সয়ে কি করিব।
 তুমি প্রাণ তুমি ধন : তোমা বিনা অন্য জন : যদি জানে মোর মন : পরীক্ষা আচরিব।।
 রুষ্ট হলে কটু কও : তুষ্ট হলে কোলে লও : আমা বিনা কারো নও : এই গুণে তরিব।
 ছলছুতা মিছা সাঁচা : না জানি বিস্তর প্যাঁচা : প্রাণেশ্বরী প্রাণ বাঁচা : নহে আজ মরিব।।
অধীরা কনিষ্ঠা
 বিনা দোষে দেও গালি : মাথে কলঙ্কের ডালি : মুখে যেন চুনকালি : কিসে মুখ চাহিব।
 হয়েছি তোমার প্রভু : কত দোষ পাই তবু : গালি নাই দেই কভু : কত গালি খাইব।।
 বিনয়ে না মানে বোধ : যদি নাহি ছাড় ক্রোধ : এত দূরে শোধবোধ : দেশ ছেড়ে যাইব।
 তোমার যেমন মর্ম্ম : আমার তেমন কর্ম্ম : ইশাদ থাকিও ধর্ম্ম : কার্য্যকালে পাইব।।
ধীরাধীরা জ্যেষ্ঠা
 একবাক্যে বুঝি রাগ : আর বাক্যে অনুরাগ : হৃদয়ে হইল দাগ : বুঝিতে না পারিয়া।
 কি করিলে হও তুষ্ট : কি কহিলে হও রুষ্ট : অদৃষ্ট হইল দুষ্ট : কিসে যাবে সরিয়া।।
 যদি অপরাধী হই : নিতান্ত করিয়া কই : তোমা বিনা কারো নই : দুঃখে লও তারিয়া।
 তুমি ধ্যান তুমি জ্ঞান : তুমি মান অপমান : তোমা বিনা নাহি আন : দেখিনু বিচারিয়া।।
ধীরাধীরা কনিষ্ঠা
 একবাক্যে দেখি রোষ : আর বাক্যে বুঝি তোষ : না বুঝিনু গুণ দোষ : বড় দায় পড়িল।
 কি করিলে ভাল হবে : বল ভাই করি তবে : নহে ঘরে লয়ে রবে : আমার কি বহিল।।
 পদ্মিনী ভ্রমরপ্রিয়া : ভ্রমরে খেদায়ে গিয়া : তাহারি বিদরে হিয়া : বুঝি তাই ফলিল।
 প্রমোদসময় নইক : আমারে না হয় হউক : ক্রোধটি তোমার রউক : যা হবার হইল।।
পরকীয়া নায়িকা
 অপ্রকাশে যার মতি পরপতি সনে। পরকীয়া তাহারে বলয়ে কবিগণে।।
পরকীয়া ভেদ
 উঢ়া আর অনূঢ়া বিভেদ হয় তার। উঢ়া সেই বিবাহ হইয়া থাকে যার।।
 অনূঢ়া সে জন যার হয় নাই বিয়া। পিত্রাদি অধীন হেতু সেও পরকীয়া।।
অনূঢ়া
 শুন শুন প্রাণবঁধু : পিয়াইয়া মুখমধু : এমত করিলে বশ কত গুণ কব হে।
 অন্য সঙ্গে যদি পিতা : করে মোরে বিবাহিতা : কেমনে তাহার সঙ্গে তোমা ছাড়ি রব হে।।
 এমত করিয়া কর্ম্ম : নহে যেন স্ত্রীর ধর্ম্ম : বুকে মুখে হলে দাগ কলঙ্কিনী হব হে।
 যাবৎ না বিভা হয় : তাবৎ এমন হয় : তাবতি এমত পীড়া দুজনেতে সব হে।।
উঢ়া
 আপনার পতি আছে : সদা তারে পাই কাছে : তথাপি দারুণ মন পর লাগি মরে গো।
 সঙ্কেত তরুর মূলে : সঙ্কেত নদীর কূলে : ঘাটে ভাঙ্গামাঠে মাঠে অন্ধকার ঘরে গো।।
 কিঙ্কিণী-কঙ্কণ-রোল : লুকায়ে চুম্বন কোল : মরনে নাহিক সুখ কোটালের ডরে গো।
 পরপতিরতি আশ : ঘর ছাড়ি পরবাস : সুখ যদি নহে লোক তবে কেন করে গো।।
পরকীয়ার অন্যভেদ
 বিদগ্ধা ললিতা গুপ্তা কুলটা মুদিতা। পরকীয়া নানাভেদ প্রাচীন লিখিতা।।
বিদগ্ধা
 বিদগ্ধ দ্বিমত হয় বাক্য আর কাজে। কথা শুনি কার্য্য দেখি বুঝি বা অব্যাজে।।
বাগ্বিদগ্ধা
 চিরপরবাসী স্বামী : বিরলে কাতর আমি : বসন্তে মাতিল কাম কেমনে বা থাকিব।
 প্রভুর কুসুমোদ্যান : বড় মনোহর স্থান : মনুষ্যের গম্য নহে সেই স্থানে যাইব।।
 ডাকে পিক অলিকুল : ফুটে নানাজাতি ফুল : গাইয়া প্রভুর গুণ রজনী পোহাইব।
 করিতে আমার তত্ত্ব : হইবে যাহার সত্ত্ব : সেই বঁধু তারে দেখা সেইখানে পাইব।।
ক্রিয়াবিদগ্ধা
 সুখে শুয়ে পতি আছা : রামা বসে তার কাছে : ইশারায় উপপতি পিকডাকে ডাকিল।
 রামা বলে হলো দায় : পাছে পতি টের পায় : না দেখি উপায় ভেবে স্তব্ধ হয়ে রহিল।।
 কোকিল ডাকিছে হোর : কাম ভয়ে পাছে ঘোর : শ্রান্ত আছ নিদ্রা যাও বলে চক্ষু ঢাকিল।
 জাগ্রত আমার প্রিয় : কেহ ডাকে বনপ্রিয় : আর কি তোমারে ভয় বলে দুই রাখিল।।
লক্ষিতা
 পরপতিমতিআশা ঢাকিতে যে নারে। লক্ষিতা করিয়া কবিগণ বলে তারে।।
 আজি প্রভু দেশে এলে : রতিচিহ্ন কিসে পেলে : সোহাগ পড়ুক মরে সতীপনা হরিলে।
 তুমি এলে বার্ত্তা পেয়ে : দেখিতে আইনু ধেয়ে : আছাড় খাইনু পথে সে তত্ত্ব না করিলে।।
 মুখে বল দন্তচিহ্ন : বুক বলে নহে ছিন্ন : আলু থালু বেশ দেখি বুঝি লতা ধরিলে।
 নষ্ট হই দুষ্ট হই : তোমা বিনা কারো নই : কলঙ্ক এড়াবে নাহি সে জন না মরিলে।।
গুপ্তা
 হয়েছে হতেছে হবে পরসঙ্গে রতি। গুপ্ত করে যে জন সে জন গুপ্তমতি।।
 মুখে বুকে দেখি দাগ : শাশুড়ী করেন রাগ : একে তো বিরহে মরি আর অই ভয় লো।
 কান্দিয়া পোহাই নিশা : আবেশে হারাই দিশা : কেমন কেমন করে অধর হৃদয় লো।।
 স্তন নিজ নখাঘাতে : অধর পীড়িয়া দাঁতে : কোনমতে নিবারণ করি এ সময় লো।
 এইরূপে দিবারাতি : রাখিয়াছি কুজ জাতি : চক্ষু খেয়ে তবু লোক কত কথা কয় লো।।
কুলটা
 পতি বর্ত্তমানে যার অনেকেতে কাজ। কুলটা তাহারে বলে পণ্ডিতসমাজ।।
 আরে বিধি নিদারুণ : কি তোর স্মরিব গুণ : কুলটার আশা পূর্ণ করিতে না পারিলি।
 হস্ত পদ চক্ষু কান : দিলি দুই দুই খান : উড়িবারে দুই খান পাখা দিতে নারিলি।।
 চৌদ্দ ভুবনে যত : পুরুষ বিবিধ মত : সবার বুঝিতে বল তাই বুঝি সারিলি।
 এ দুঃখ বা কত সব : অন্যের কি কথা কব : চতুর্ম্মুখ রজোগুণ তবু তুই নারিলি।।
মুদিতা
 পরসঙ্গে রতিআশে উল্লসিতা যেই। বিঘ্নহীন দেখিয়া মুদিতা হয় সেই।।
 প্রবাসে রয়েছে পতি : ননদী প্রসূতবতী : বিধবা শাশুড়ী ঐ দৃষ্টিহীন রয় লো।
 দেবর বিলাস রায় : শ্বশুর ভবনে যায় : মন্দ মন্দ গন্ধবহ বিদরে হৃদয় লো।।
 অস্ত গেছে দিনমনি : যতেক রসিক ধনি : ওই শুন বংশীধ্বনি : করয়ে ললিত লো।
 রোমাঞ্চ হতেছে মোর : খসিছে কাঁচালী ডোর : কেন সই ওষ্ঠাধর : হতেছে কম্পিত লো।।
 পরকীয়া সুখ যত : ঘরে ঘরে শুনি কত : অভাগীর ধর্ম্মভয় এত করে মরি লো।
 পরপুরুষের মুখ : দেখিয়া যে হয় সুখ : এ কি জ্বালা সদা জ্বলি হরি হরি হরি লো।।
সামান্য বনিতা
 ধনলোভে ভজে যেই পুরুষ সকলে। সামান্য বনিতা তারে কবিগণ বলে।।
 স্বকীয়া ধর্ম্মের বশে : পরকীয়া প্রীতি রসে : অমূল্য যৌবন ধন পুরুষেরে দেই লো।
 আমার যৌবনধন : ভোগ করে যেই জন : মান বুঝি মূল্য করে দিতে পারে যেই লো।।
 যখন যে ধন চাই : সেইক্ষণে যদি পাই : আমার মনের মত বন্ধু হবে সেই লো।
 ধনিক রসিক জানি : নাগর মিলাবে আনি : আপনার মর্ম্ম কথা কয়ে দিনু এই লো।।
সামান্য বনিতার ভেদ
 অন্যভোগ দুঃখিতা আর বক্রোক্তি গর্ব্বিতা। মানবতী আদিভেদে সামান্য বনিতা।।
বক্রোক্তিগর্ব্বিতা
 গর্ব্বিতা দ্বিমত হয় রূপে আর প্রেমে। দুইটি একত্র হলে হীরা যেন হেমে।।
রূপগর্ব্বিতা
 মুখ দেখি যদি আরশী ধরে। দড় বলে ছায়া সে লয় হরে।।
 মদন জানিত অধিক করে। দেখিতাম কিন্তু গিয়াছে মরে।।
প্রেমগর্ব্বিতা
 অনিমিষ আঁখি স্থির চরিত্র। আপনার বঁধু করিয়া চিত্র।।
 আমারে দেখয়ে এ কি বিচিত্র। কেহ বঁধু সখী শত্রু কি মিত্র।।
অন্যসম্ভোগদুঃখিতা
 কহ দূতি গিয়াছিলে কোন বনে। বড় শোভয়ে অঙ্গ ফুলাভরণে।।
 নিজবেশ করে দড় আইলি লো। কই গেলি নরাধমসন্নিধি লো।।
 ভুলিয়াছিলি আর ভুলাইলি রে। মধু গূঢ় বনে কত পাইলি রে।।
মানবতী
 এস পরাণ-পুত্তলি এস : মরে যাই কিবা বেশ : আলোতে রহ হে রূপ ভাল করে হেরি রে।
 আলতা কজ্জলদাগ ভালে : অরুণ প্রকাশ রাহু গালে : ভাবে আছ ভাল জানি ভারিভুরি হেরি রে।।
নায়িকার অবস্থাভেদ
 এ সব নায়িকা পুনঃ অষ্টমত হয়। বিপ্রলব্ধা সম্ভোগ তাহার পরিচয়।।
 বাসসজ্জা উৎকণ্ঠিতা ও অভিসারিকা। বিপ্রলব্ধা তার পর স্বাধীনভর্ত্তৃকা।।
 খণ্ডিতা তাহার পর কলহান্তরিতা। প্রোষিতভর্ত্তৃকা এই অষ্ট পরিমিতা।।
বাসসজ্জা
 পতি হেতু বাসঘরে যেই করে সাজ। বাসসজ্জা বলে তারে পণ্ডিতসমাজ।।
 আঁচড়িয়া কেশপাশ : পরিয়া উত্তম বাস : সখীসঙ্গে পরিহাস গীতবাদ্য ঘটনা।
 চামর চন্দন চুয়া : ফুলমালা পানে গুয়া : হাতে লয়ে শারীশুকে কামরস পঠনা।।
 কিঙ্কিনীকঙ্কণ হার : বাজুবন্ধ সীঁতি টাড় : নূপুরাদি অলঙ্কার নিতি নব পর না।
 যোগী যেন যোগাসনে : বসিয়া ভাবয়ে মনে : কতক্ষণে পতিসঙ্গে হইবে ঘটনা।।
উৎকণ্ঠিতা
 স্বামীর বিলম্ব যেই ভাবে অনুক্ষণ। উৎকণ্ঠিতা তাহারে বলয়ে কবিগণ।।
 হইল বহু নিশি : প্রকাশ হয় না দিশি : আইল কেন নাহি কালিয়া।
 পিকের কলরব : ডাকিছে অলি সব : অনলে দেও দেহ জ্বালিয়া।।
 তিমির ঘনতরে : সভয়ে বনচরে : ফিরয়ে কিবা পথ ভুলিয়া।
 অপর সখীরসে : রহিল পরবশে : মদন মোরে দিল জ্বালিয়া।।
অভিসারিকা
 স্বামীর সঙ্কেতস্থলে যে করে গমন। তারে অভিসারিকা বলয়ে কবিগণ।।
 নিকট সঙ্কেতসময় আইল : শুনে রসময়ী মূরলী গাইল : ধরি ধনুঃশর মদন ধাইল : চলে নিধুবনে কামিনী।
 পিক কলকলি শারীশুক ধ্বনি : ফুটে বনফুল ভ্রমর গুনগুনী : তাহাতে মিলিত নূপুর রুণরুণী : শীঘ্র চলে মৃদুগামিনী।।
 বাছিয়া পরিলেক নীল অম্বর : মদন হেম গৃহে মেঘাড়ম্বর : পথিকজন ডর করিতে সম্বর : ঝাঁপিল তাহে তনু দামিনী।
 বদন সরসিজ গন্ধযুত মন : মোহিত সহচরী ভ্রমর শিশুগণ : তথি মলয়াচল গতি মন্দ পবন : যাওল দ্রুত সখি যামিনী।।
বিপ্রলব্ধা
 সঙ্কেতে স্থানেতে গিয়া নাহি পায় পতি। বিপ্রলব্ধা বলে তারে পণ্ডিত সুমতি।।
 তিল পরিমাণ মান : সদা করি অনুমান : গুরুভয় লঘুভয় গেলা।
 গৃহ ছাড়ি ঘন ঘন : করিমাল আরোহণ : সিন্ধু তরিনু ধরি ভেলা।।
 হরি হরি মরি মরি : উহু উহু হরি হরি : তব নহে হরি সনে মেলা।
 পর দুঃখ পরশ্রম : পরজনে জানে কম : অপরূপ খলজন খেলা।।
স্বাধীনভর্ত্তৃকা
 কোলে বসে যার পতি আজ্ঞার অধীন। স্বাধীনভর্ত্তৃকা তারে বলে সুপ্রবীণ।।
 শুন শুন প্রাণনাথ : নিবেদি হে যোড়হাত : পূরিল সকল সাধ : কিছু শেষ রয় হে।
 বেঁধে দেহ মুক্তকেশ : বিনাইয়া দেহ বেশ : তুমি মোরে ভালবাস : লোকে যেন কয় হে।।
 দেখিয়া তোমার মুখ : অতুল হইল সুখ : পাসরিনু যত দুখ : আছিল যে ভয় হে।
 যত কাল জীয়ে রই : তোমা ছাড়া যেন নই : নিতান্ত করিয়া কই : মনে যে রয় হে।।
খণ্ডিতা
 অন্য ভোগচিহ্ন অঙ্গে আসে যার পতি। খণ্ডিতা তাহার নাম বলে শুদ্ধমতি।।
 আইস বঁধু দ্রুত হয়ে : কেন আইস রয়ে রয়ে : মরিব বালাই লয়ে : কিবা শোভা পেয়েছ।
 কপালে সিন্দূরবিন্দু : মলিন বদনইন্দু : নয়ন রক্তের সিন্ধু : মোর দিকে ধেয়েছ।।
 অধরে কজ্জল দাগ : নয়নে তাম্বুল রাগ : বুঝি কেবা পেয়ে লাগ : মোর মাথা খেয়েছ।।
 তোমার কি দোষ দিব : বাপমায়ে কি বলিব : হরি হরি শিব শিব : যম মোরে ভুলেছে।।
কলহান্তরিতা
 কলহে খেদয়ে পতি পশ্চাৎ তাপিতা। কবিগণে বলে তারে কলহান্তরিতা।।
 ক্রোধে হয়ে হতজ্ঞান : কৈনু তোরে অপমান : এখন আকুল প্রাণ : দেখিতে না পাইয়া।
 ফুটিছে বিবিধ ফুল : ডাকে ভৃঙ্গ অলিকুল : সামালিব এই শূল : কার মুখ চাহিয়া।।
 কাতর হইয়া অতি : বিস্তর করিয়া নতি : চরণে ধরিল পতি : না চাহিনু ফিরিয়া।
 করিনু যেমন কর্ম্ম : ফলিল তাহার ধর্ম্ম : মরুক এমত মর্ম্ম : দুঃখে যাই মরিয়া।।
প্রোষিতভর্ত্তৃকা
 পরবাসে পতি যার মলিনা বিরহে। প্রোষিতভর্ত্তৃকা তারে কবিগণ কহে।।
 অনল চন্দন চুয়া : গরল তাম্বুল গুয়া : কোকিল বিকল করে অতি।
 বিধবার মত বেশ : অস্থিচর্ম অবশেষ : তাপে কাম পোড়ায় বসতি।।
 মনোজ তনুজ মত : কোদণ্ড করিয়া হত : হাতে লয় পিণ্ডের পদ্ধতি।
 সখীমুখে মান শুনি : পতি এলো হেন গণি : দেখিয়া শ্বাসের গতাগতি।।
প্রোষৎভর্ত্তৃকা
 যার কাছে আসি পতি প্রবাসগমন। প্রোষিতভর্ত্তৃকা মধ্যে তাহার গণন।।
 এ আট লক্ষণে তার না মিলে লক্ষণ। নবমী নায়িকা হতে পারে কেহ কন।।
 কিন্তু অষ্ট নায়িকা সকল গ্রন্থে কয়। নবমী কহিতে গেলে গণ্ডগোল হয়।।
 অতএব দ্বিধা বলি প্রোষিতভর্ত্তৃকা। প্রোষিতভর্ত্তৃকা আর প্রোষ্যৎপতিকা।।
 পুনঃ শুন ওহে প্রাণ : পতি পরবাসে যান : তুমি কি করিবে এবে সত্য করি কহিবে।
 এবে জানিলাম দড় : তোমা হইতে পতি বড় : নহে কেন আগে যান তুমি পাছে রহিবে।।
 যদি বড় হতে চাও : তবে আগে আগে যাও : নহে তুমি লঘু হবে আমার কি বহিবে।
 এবে সুখ দেয় যারা : পিছে দুঃখ দিবে তারা : কয়ে অবসর আমি কত জ্বালা সহিবে।।
 ইত্যাদি কহিয়া দিনু নায়িকা যতেক। পতির গমনকালে সবার প্রত্যেক।।
 পুথি বাড়ে সকলের করিতে কবিতা। অনুভবে বুঝি হবে লক্ষণ মিলিতা।।
নায়িকাদি উত্তমাদি ভেদ
 উত্তমা মধ্যমা আর অধমা নিয়মে। এ সব নায়িকা তিন মত হয় ক্রমে।।
উত্তমা
 অহিত করিলে পতি যেবা করে হিত। উত্তমা তাহার নাম বলয়ে পণ্ডিত।।
মধ্যমা
 হিত কৈলে হিত করে অহিতে অহিত। মধ্যমা তাহার নাম মধ্যমচরিত।।
অধমা
 হিত কৈলে অহিত করয়ে যেই জন। অধমা তাহার নাম বলে কবিগণ।।
চণ্ডী নায়িকা
 পতি প্রতি করে যেই অকারণ ক্রোধ। চণ্ডী তার নাম বলে পণ্ডিত সুবোধ।।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন