সুনীতিকুমারকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

|| পত্রসংখ্যা ১ ||

ওঁ

শান্তিনিকেতন

কল্যাণীয়েষু

সুনীতি, অমিয়ের বিবাহেখ শুদ্ধির মূলচ্ছেদ করে দিয়েচি। কথাটা যখন শূন্যেই ছিল তখন চিন্তা করবার জোর পাওয়া যায়নি—তখন সম্ভব অসম্ভবের গন্ডিভেদটা দূর থেকে চোখে পড়েনি। ব্যাপারটা যে মুহূর্তে কাছে এল তখনি বোঝা গেল ওকে আর কাছে আসতে দেওয়া চলবে না, দেউড়ি থেকেই বিদায় করে দিতে হবে। যাদের কাছে এ রকম অনুষ্ঠানের কোনো মোহ আছে অমিয় বা হৈমন্তী সে জাতের মানুষ নয়। এ সমস্তই হচ্চে ম্যাজিকমানা বুদ্ধির বিলাস, এর প্রধান দুর্গ এখনো আছে মধ্য আফ্রিকার অরণ্যগহনে, আমাদের সমাজেরও অনেকখানি আছে তার প্রত্যন্ত প্রদেশে। কিন্তু শান্তিনিকেতনকে ঐ ভূভাগের অন্তর্গত কোনো কারণেই করা যেতে পারে না। যতরকম ভাণ ভড়ঙ আছে সে মুগ্ধ চিত্তের পক্ষেই সাজে—যাদের এই মোহ নেই তাদের পক্ষে এটা কপটতা। অনেক সময়ে আমরা যথার্থ যা তার চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করবার জন্যে কপটতা করে থাকি, কিন্তু তার চেয়েও নিজেকে নিকৃষ্ট প্রমাণ করবার জন্যে কপটতা করার মতো বিড়ম্বনা কিছুই নেই। যদি বিশুদ্ধ বৈদিক প্রথায় বিবাহ হয় তবে সেটার দ্বারা বরকন্যার উভয়েরই আর্যসভ্যতার ধারাকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে গায়ে পড়ে হাল আমলের ‘‘হিঁদুয়ানী’’র খাদ মিশিয়ে যে বিকৃত পদার্থের সৃষ্টি করা হয়েচে সেটাতে কি বুদ্ধি, কি ধর্ম, কি সৌন্দর্য্যবোধ সমস্তকেই পীড়িত করা হল, সেটা অসঙ্গত, অন্যায় এবং অশোভন। অমিয় যথাস্থানে পত্র লিখে এ প্রস্তাবটাকে প্রত্যাখ্যান করেচে। এখন এমন কোনো একটা পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে যেটা সাদাসিধে, যেটার মধ্যে ভাবুকতার তৃপ্তি হয়তো না হতেও পারে, কিন্তু যার মধ্যে মূঢ়কে ভোলাবার জন্যে নূতন পুরাতন পাঁচমিশালি ‘‘ও ব্রাকাডাব্রা’’র বর্বরতা নেই। তোমাকে ও প্রশান্তকেগ যদি কাছে পাওয়া যেত তাহলে মোকাবিলায় কথাটার আলোচনা করা যেত। আজকাল তোমার হয়তো চলৎশক্তি নেই তুমি এখন বদ্ধ জীব।ঘ আমরা খুব সম্ভব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় যাব—তখন সকল দিক থেকে কথাটাকে আলোড়িত করে তলা পর্যন্ত দেখবার চেষ্টা করা যেতে পারে।

কিভাবে আছ, কি অবস্থায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্রান্তচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছ, না লিখতে আরম্ভ করেচ? অর্থাৎ সরস্বতীর কমলবনের পঙ্ক ঘোলাচ্চ না পঙ্কজরেণু বিকীর্ণ করচ?

নূতন অক্ষর রচনা সম্বন্ধে যে আলোচনা হয়েছিল সেটাকে কাজে খাটাবার সময় এল। বিচিত্রা সম্পাদকঙ তোমার নির্দেশ অনুসারে অক্ষর ঢালাই করতে রাজি আছেন এবং তুমি সে বিষয়ে ব্যাখ্যা করে যদি কিছু লেখ তাঁরা সেটাকে প্রকাশ করতে চান—এ সম্বন্ধে এ দেশে তোমার মতই সবচেয়ে প্রামাণ্য এই কারণে বাঙলা বর্ণমালার নূতন অক্ষর যোজন তোমার মত ধ্বনিতত্ত্ববিশারদের কাছেই প্রত্যাশা করি। তোমার কাছে আরো অনেক কিছু প্রত্যাশা করবার আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল চাপে তোমার মানসক্ষেত্রের অনেক বীজ হয় ত অঙ্কুরিত হতে বাধা পাবে—তার মধ্যে উপন্যাস রচনা একটা।চ তবু যদি উপন্যাস লেখো তাহলে শুদ্ধির জাদুজালে জড়িত কোনো একটা কৃত্রিম বিবাহের ট্র্যাজেডি তার বিষয় হতে পারে। ইতি ৯ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪

তোমাদের

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমার ভ্রমণবৃত্তান্তক বেশ লাগচে, তার প্রধান কারণ, ওর ভাষাটা অত্যন্ত তোমার নিজের মতো। অধিকাংশ লোক শিশুকাল থেকেই পরের মতো লেখা লিখতে অভ্যাস করে পরীক্ষায় মার্কা পায় (। ) তাদের পক্ষে সকলের চেয়ে কঠিন কাজ হচ্চে নিজের কথা নিজের ভাষায় লেখা। তোমার এই লেখায় ধীরেন যাকে বলে ‘‘মজা’’ সেইটে পাওয়া যাচ্চে। এ কলের জল নয়, ঝরণার জল।

|| পত্রসংখ্যা ২ ||

ওঁ

কল্যাণীয়েষু

সুনীতি, বাকেক এসেচেন। বেচারা তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে অবলম্বন [করে] অর্থ উপার্জন করতে চান—তাঁর অবস্থা আমারি মত শোচনীয়। কিছু যদি অর্থাগম না হয় তাহলে অন্নাভাব ঘটবে—আমরা ভেঙে-পড়া ভূতলশায়ী গাছের মতো, আমাদের আশ্রয় করে তাঁর আশালতা উন্নতিলাভ করবে না। যদি ঢাকায় মাদ্রাজে কলকাতায় এবং অন্যত্র তাঁর সঞ্চয়ের সম্ভাবনা থাকে তাহলেই কিছুকালের মতো ভরা পেটে ও প্রফুল্ল মুখে দিন যাপন করতে পারবেন। আমি তাঁকে আভাস দিয়েছি যে, যদি তিনি বৃহত্তর ভারতের পতাকা বহন করে বক্তৃতা দিতে রাজী হন তাহলে তাঁর পথ প্রশস্ত হতে পারে—বিশ্বভারতীর প্রভাব নিরতিশয় ক্ষীণ,—তিনি তাতে সম্মত আছেন—এই দৌত্যকার্যে তোমরা যদি তাঁকে ব্যবহার করো তিনি নিশ্চয় কাজে দেখবেন।

‘‘বগডানোভ’’খ শুনেচেন তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পারসীকের ‘‘চৌকি’’ খালি—সেইটে তিনি ভর্তি করতে উৎসুক। যোগ্যতা আছে সন্দেহ নেই—লোকটি নিরতিশয় নিরীহ—ফ্রেঞ্চ ও জর্মান ভাষায় সুপন্ডিত। যদুবাবুরগ কাছে তাঁর হয়ে সুপারিশ করতে আমাকে অনুরোধ করেচেন—যদি দরকার বোধ করো, আমাকে লিখো—আমি সত্যের অপলাপ না করে তাঁর গুণানুবাদ করতে পারি।

বাকে অনেক ফোটো এনেচেন, সেগুলো জাদুলন্ঠনের জন্যে চিত্রফলকে তুলে নিতে প্রস্তুত আছেন, তৎসহায়তায় ইন্দোনেশীয় পুরাণ কথার ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

বোধহয় ৪ ডিসেম্বর কলকাতায় যাব।

তোমাদের

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ৩ ||

ওঁ

কল্যাণীয়েষু,

প্রজা খাজনা বন্ধ করাতে সামরিক গোমস্তা ব্যোমযান থেকে বোমা বর্ষণ ক’রে খাজনা আদায় করতে বেরিয়েছিল এমন একটা দুঃসংবাদ কিছুকাল পূর্বে শোনা গিয়েছে। আমার মনে হয় শনিবারের চিঠির সঙ্গে সেই শাসনপ্রণালীর কিছু একটু সাদৃশ্য আছে।

শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ করবার ক্ষমতার একটা অসামান্যতা অনুভব করেছি। বোঝা যায় যে, এই ক্ষমতাটা আর্ট-এর পদবীতে গিয়ে পৌঁচেচে। আর্ট পদার্থের একটা গৌরব আছে—তার পরিপ্রেক্ষিত খাটো করলে তাকে খর্বতার দ্বারা পীড়ন করা হয়। ব্যঙ্গ সাহিত্যের যথার্থ রণক্ষেত্র সর্বজনীন মনুষ্যলোকে কোনো একটা ছাতাওয়ালা-গলিতে নয়। পৃথিবীতে উন্মার্গযাত্রার বড়ো বড়ো ছাঁদ, type আছে, তার একটা না একটার মধ্যে প্রগতিরও গতি আছে। যে-ব্যঙ্গের বজ্র আকাশচারীর অস্ত্র, তার লক্ষ্য এই রকম ছাঁদের প’রে। এই type এর অভিব্যক্তি নানা আকারে নানা দেশে নানা কালে,—এই জন্যে, একে যে-ব্যঙ্গ আঘাত করে তা আর্টিস্টের হাতের জিনিষ হওয়া চাই, কেননা তাকে চিরকালের পথে যাত্রা করতে হবে। আর্ট যা’কে আঘাত করে তাকে আঘাতের দ্বারাও সম্মান করে। ক্ষুদে ক্ষুদে রাবণ অলিতে গলিতে বাস করে, সর্বদা হাটেবাটে তাদের বিচরণ, কিন্তু বাল্মীকির রামচন্দ্র ক্ষুদে রাবণদের প্রতি বাণ বর্ষণ করেননি, যে মহারাবণের এক দেহে দশমুন্ড বিশহাত তার উপরেই হেনেছেন ব্রহ্মাস্ত্র।

তারুণ্য নিয়ে যে-একটা হাস্যকর বাহ্বাস্ফোটন আজ হঠাৎ দেখতে দেখতে মাসিক সাপ্তাহিকের আখড়ায় আখড়ায় ছড়িয়ে পড়ল এটা অমরাবতীবাসী ব্যঙ্গ-দেবতার অট্টহাস্যের যোগ্য। শিশু যে আধো আধো কথা কয় সেটা ভালোই লাগে, কিন্তু যদি সে সভায় সভায় আপন আধো আধো কথা নিয়ে গর্ব করে বেড়ায়, সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায় ‘‘আমি কচি খোকা’’, তখন বুঝতে পারি কচি ডাব অকালে ঝুনো হয়ে উঠেচে। তরুণের স্বভাবে উচ্ছৃংখলতার একটা স্থান আছে, স্বাভাবিক অনভিজ্ঞতা ও অপরিণতির সঙ্গে সেটা খাপ খেয়ে যায়, কিন্তু সেইটেকে নিয়ে যখন সে স্থানে অস্থানে বাহাদুরী করে বেড়ায়, ‘‘আমরা তরুণ, আমরা তরুণ’’ করে আকাশ মাত করে তোলে, তখন বোঝা যায় সে বুড়িয়ে গেছে, তখন এই বুড়ো-তারুণ্যের অজ্ঞানকৃত প্রহসনে হেসে উঠে জানিয়ে দিতে হবে যে, এটাকে আমরা মহাকালের মহাকাব্য বলে গণ্য করিনে। চিরকাল দেখে এসেচি, তরুণ জ্বর নিজেকে তরুণ বলে কম্পান্বিত করে দেখায়, তরুণ স্বাস্থ্য নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলেই থাকে—আজকাল তারুণ্য হঠাৎ একটা কাঁচা রোগের মতো হয়ে উঠল, সে নিজেকে ভুলচে না, এবং পাড়াসুদ্ধ লোককে মনে করিয়ে রাখচে যে, সে টনটনে তরুণ, বিষফোড়ার মতো দগদগে তার রঙ। শুধু তাই নয় তরুণরা যে তরুণ বুড়োদের অধ্যাপক পাড়াখ থেকে তার প্রমাণপত্র সংগ্রহ করা চলচে। এর মধ্যে কৌতুকের কথাটা হচ্ছে এই যে, তারুণ্যটা হল বয়সের ধর্ম, ওটা স্বভাবের নিয়ম,—ওটার জন্য রুশীয় সাহিত্যশাস্ত্র থেকে নোট মুখস্থ করে কাউকে এগজামিন পাস করতে হয় না,—বিধাতার বিধানে ঐ বয়সটাতে মানুষ আপনিই আসে। কিন্তু আজকালকার দিনে তারুণ্যের বিশেষ ডিগ্রীধারীরা নিজেদের দুঃসহ তারুণ্য সম্বন্ধে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদের থীসিস লিখতে শুরু করেচে। তারা বলচে আমরা তরুণ বয়স্ক বলেই সবাই আমাদের সমস্বরে বাহবা দাও,—আমরা যুদ্ধ করেচি ব’লে না, প্রাণ দিয়েচি ব’লে না, তরুণ বয়সে আমরা যা-ইচ্ছে-তাই লিখেচি ব’লে। সাহিত্যের তরফে বলবার কথা এই যে, যেটা লেখা হয়েচে সাহিত্যের আদর্শ থেকে তাকে হয় ভালো, নয় মন্দ বলব, কিন্তু তরুণ বয়সে লেখার একটা স্বতন্ত্র আদর্শ খাড়া করতে হবে এতো আজ পর্যন্ত শুনিনি। বাঙলাদেশে সাহিত্যের বিচারে দুইজাতের আইন, দুইজাতের জুরি রাখতে হবে, একটা হচ্চে আঠারো থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের লেখকদের জন্যে, আর-একটা বাকি সকলের জন্যে, এই বিধানটাই পাকা হবে না কি? এখন থেকে লেখকদের কুষ্ঠি মিলিয়ে তবে লেখার ভালোমন্দ ঠিক করতে হবে? কোনো তরুণ বয়স্কের লেখার নির্লজ্জতা দোষ ধরলে নালিশ উঠবে যে, সেটাতে কেবলমাত্র লেখার নিন্দা করা হোলো না, বিশ্বব্রহ্মান্ডে যেখানে যত তরুণ আছে সবাইকেই গাল দেওয়া হোলো। যাই হোক, আমার বক্তব্য এই যে, যথার্থ সাহিত্যের হাসি বিরাট, দূরগামী। সে নিষ্ঠুর, কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের উপরে নয়, হাস্যকর মানুষের ’পরে। ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ বিশেষ উক্তি সম্বন্ধে ভুল করবার আশঙ্কা আছে, চিরদিন সেরকম হয়ে এসেচে, কিন্তু বহু মানুষ নিয়ে বিধাতা মাঝে মাঝে যে অদ্ভুতরসের অবতারণা করেন তার মধ্যে একটি সার্বজনীনতা আছে। ডনকুইকসোটে যদিচ য়ুরোপীয় মধ্যযুগের এবং পিকবিকে ইংরেজি ভিক্টোরীয় যুগের সাহিত্যিক-হাসি ধ্বনিত, তবু সে-হাসি সকল মানুষের অন্তরের হাসি; কোনো দেশে তার সীমা নেই, কোনো কালে তার অবসান নেই। বাঙালী তরুণের স্বভাবে যদি কোনো হাস্যকরতা ব্যাপকভাবে এসে থাকে তবে সাহিত্যে তার হাসি তেমনি বড়ো করে দেখা দিক এই হচ্চে আমার সাহিত্যিক দাবী, এটা আমার সামাজিক দাবী নয়। তুমি তর্ক করবে সবাই সর্বান্টেস বা ডিকন্স হতে পারে না—সে তর্ক আমি মানিনে, সাহিত্যে বড়ো ছোটোদের ভেদ আছে, মূল আদর্শে ভেদ নেই। যার কলমেই সাহিত্যিক শক্তি দেখতে পাব ত তার কলমের কাছেই সাহিত্যিক দাবী করব—এই দাবীর দ্বারাই সাহিত্যের আদর্শ জোর পায়।

সাহিত্যের দোহাই ছেড়ে দিয়ে সমাজ হিতের দোহাই দিতে পারো। আমার নিজের বিশ্বাস ‘‘শনিবারের চিঠি’’র শাসনের দ্বারাই অপরপক্ষে সাহিত্যের বিকৃতি উত্তেজনা পাচ্চে। যেসব লেখা উৎকট ভঙ্গীর দ্বারা নিজের সৃষ্টিছাড়া বিশেষত্বে ধাক্কা মেরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সমালোচনার খোঁচা তাদের সেই ধাক্কা মারাকেই সাহায্য করে। সম্ভবত ক্ষণজীবীর আয়ু এতে বেড়েই যায়। তাও যদি না হয় তবু সম্ভবত এতে বিশেষ কিছু ফল হয় না। আইনে প্রাণদন্ডের বিধান আছে, প্রাণহত্যাও থামচে না।

ব্যঙ্গরসকে চিরসাহিত্যের কোঠায় প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে আর্টের দাবী আছে। শনিবারের চিঠির অনেক লেখকের কলম সাহিত্যের কলম, অসাধারণ তীক্ষ্ণ, সাহিত্যের অস্ত্রশালায় তার স্থান,—নব নব হাস্যরূপের সৃষ্টিতে তার নৈপুণ্য প্রকাশ পাবে, ব্যক্তিবিশেষের মুখ বন্ধ করা তার কাজ নয়। সে কাজ করবারও লোক আছে, তাদের কাগজী লেখক বলা যেতে পারে, তারা প্যারাগ্রাফ-বিহারী। ইতি ২৩ পৌষ ১৩৩৪, শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আর একটা কথা যোগ করে দিই। যে সব লেখক বে-আব্রু লেখা লিখেচে তাদের কারো কারো রচনাশক্তি আছে। যেখানে তাদের গুণের পরিচয় পাওয়া যায় সেখানে সেটা স্বীকার করা ভালো। যেটা প্রশংসার যোগ্য তাকে প্রশংসা করলে তাতে নিন্দা করবার অনিন্দনীয় অধিকার পাওয়া যায়।

|| পত্রসংখ্যা ৪ ||

ওঁ

কল্যাণীয়েষু,

রাজবন্দীদের জন্যে টাকা তোলারক যে ব্যবস্থা হয়েচে সেটা অনেকের মনকে আঘাত দিয়েচে। এর ভিতরে দুঃখের যথার্থ যে কারণটা রয়েচে সেটা এই ব্যবস্থার মধ্যে নয়, এমনতর ব্যবস্থার যে প্রয়োজন হল তারই মধ্যে। বন্দীদের পরিবারবর্গ যে অর্থকষ্ট ভোগ করচে, সেটাও বন্দীদের শাস্তির অন্তর্গত। যাঁরা রাজশাসন অবরুদ্ধ তাঁদের অবরোধ সম্বন্ধে বিলাপ করা ছাড়া আমাদের কিছুই করবার নেই—কিন্তু অবরোধের বহিরঙ্গে তাঁদের পরিবারের যে দুঃখ সেটা দূর করায় আমাদের স্বাধীনতা ছিল। সে সম্বন্ধেও কেবলমাত্র আমরা রাজ সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে এসেচি নিজেরা কিছুই করিনি। আমাদের বেদনা যদি সত্য হত তবে এটা কোনোমতেই সম্ভবপর হ’ত না। বহুকোটি লোকের মধ্যে চার লক্ষ লোক বছরে যদি চার কিস্তিতে চার আনা দিতে পারত তাহলে অনাথ পরিবার বুঝতে পারত যে, যে-দেশকে তারা মা বলে এসেচে সে সত্যই মা। অন্য দেশে হলে সম্পন্ন অবস্থার লোকদের মধ্যে অনেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অর্থসাহায্য করত। এমনটা যে হয়নি তার একমাত্র কারণ, পলিটিকস আমাদের দেশে বাস্তব পদার্থ নয়। তারও কারণ যদি জিজ্ঞাসা করো তাহলে বলব পলিটিকস দেশের সর্বসাধারণের জন্য একটিমাত্রও সেবার কাজ করেনি, কি করা কর্তব্য তাই সে কেবল রাজপুরুষদের স্মরণ করিয়েচে মাত্র। রাষ্ট্রনীতিতে যারা উন্মত্ত তারা নিয়ত চীৎকার করে বলেচে, দেশের জন্যে আমরা স্বাধীন শাসন চাই—কোন দেশের জন্য? যে দেশের জন্য আমরা নিজে কিছুই করিনে—দুঃখে বিপদে দেশের লোকই যে দেশের লোকের একান্ত আপন একথা কাউকে বুঝতেই দিইনে। চোখের সামনে প্রতিদিন যখন দেখতে পাই দেশের লোক অন্নাভাবে জলাভাবে বিদ্যাভাবে স্বাস্থ্যাভাবে দুর্গতির রসাতলে তলিয়েই চলেচে তখন আর কিছুই করিনি, কেবল স্বরাজের অভাবেই যে আমাদের যত দুঃখ এইটে উচ্চস্বরে ঘোষণা করবার একটা রাষ্ট্রনৈতিক বাগযন্ত্র নির্মাণের চেষ্টা করেচি। পল্লীসেবার দোহাই দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করি, দেখতে দেখতে সে টাকা দুর্লক্ষ্য হয়ে ওঠে। পরস্পর সেবার মিল দিয়েই দেশকে দেশের লোক আপন ব’লে অনুভব করে, সেই অনুভূতিটা সত্য হলে তার পরে সেই দেশের পলিটিকস আপনি সত্য হয়ে ওঠে। মোট কথাটা হচ্চে রাজবন্দীদের দুঃখে দেশের লোকের বেদনা যথেষ্ট পরিমাণে সত্য নয় বলেই তাদের জন্যে স্বল্পমাত্র ত্যাগ স্বীকার আজ পর্যন্ত সহজ হয়নি। অথচ তাঁদের পরিবারের কষ্টটা তো সত্য—করুণার পথ ত্যাগ করে সম্ভোগের পথে তাঁদের দুঃখ দূর করবার চেষ্টায় নিশ্চয়ই লজ্জা আছে—এটাতে দেশের লোকের স্বদেশপ্রীতি বা দাক্ষিণ্যের প্রতি দাবী করা হোলো না। করা হোলো না, তার কারণ, ক’রে কোনো ফল নেই, সেইটেই প্রকৃতপক্ষে শোচনীয়। নাচগানের আসরে যাদের কাছ থেকে টাকা পাওয়া যায় তাদের কাছ থেকে স্বদেশপ্রেমের দাবীতে পাওয়া যায় না। আমোদের সিঁদকাঠি দিয়ে তাদের পকেট ফুটো করে যা-কিছু পাওয়া যায় তাতে করে যদি বহুসংখ্যক নিরপরাধা অনাথা স্ত্রীলোক, অনাথ বালকবালিকার অন্নসংস্থান হয় তবে সেই পথ আশ্রয় করা ছাড়া গতি কি? যেন দেশের লোক সত্যই দেশের দুঃখমোচনের জন্য ত্যাগস্বীকার করতে উদ্যত এমন একটা মিথ্যা ভাণকে আঁকড়ে ধরে উপবাসীর উপবাসকষ্ট ত দূর হয় না। যদি বলো, এর চেয়ে তাদের উপবাসে মরাও শ্রেয়। এমন কথা বলবার অধিকার আমাদের তো নেই, কেননা আমরা তো উপবাসে মরব না। পরকে বলপূর্বক matyr করার বীরত্ব কোথায়। এই বীরত্ব আর একদিন দেখেছিলুম, সেদিন অন্নবস্ত্রের দুর্ভিক্ষে অনেক স্ত্রীলোক লজ্জায় ঘরের বাহির হতে পারছিল না। তাদেরই দ্বারের সামনে বিদেশী কাপড় পোড়ানো হচ্ছিল। আপত্তি করলে বলা হয়েছিল অশুচি বিদেশী বস্ত্র নগ্নপ্রায় স্ত্রীলোককেও দেওয়া চলে না। যতক্ষণ সেই স্ত্রীলোকদেরকে যথেষ্ট খদ্দর না দেওয়া গিয়েচে ততক্ষণ এমন কথা কি তাদের মুখে শোভা পায় যাদের ব্যবহারযোগ্য দুখানা কাপড়ও আছে? গান শোনবার জন্যে যারা টাকা দিচ্চে তারা স্পষ্টই কবুল করচে যে এইজন্যেই আমরা দু-চার টাকা দিতে পারি, অন্য দাবী মেটাবার উপলক্ষ্যে পারিনে। এই টাকাটা সংগ্রহ করে এমন কারো দুঃখলাঘবের জন্যে যদি ব্যয় করা যায় যারা সত্যই দুঃখ পাচ্চে তবে বাধা দেবার অধিকার তাদেরই আছে দুঃখটা যাদের। গান শুনিয়ে টাকা তোলবার প্রয়োজনটা বাহুল্য হওয়া উচিত ছিল কিন্তু একথাও বলতে হবে যে, গান জিনিষটাকে অবজ্ঞা করবার সন্ন্যাসিয়ানাও ভালো নয়। স্বদেশহিতের তালিকায় স্বদেশের রুচি-শিক্ষার চর্চাও মস্ত জিনিষ। মুশকিল এই যে, রুচি সম্বন্ধে অনৈক্য অবশ্যম্ভাবী। সে হলে রুচি সম্বন্ধেই তর্ক চলতে পারে কিন্তু স্বদেশের হিতের উদ্দেশে গান গাওয়াটাই অন্যায়, এমন কথা বলা চলে না। কোনো একজন লেখক তাঁর কোনো বইয়ের উপস্বত্ব এজন্যে দিলে বোধহয় আপত্তি হত না কিন্তু গান সম্বন্ধে অনেককাল আমাদের মনে একটা অবজ্ঞা আছে বলেই হয়তো বর্তমান ক্ষেত্রে একটা আন্দোলন উঠেচে। এই গানের আসর সম্বন্ধে কিভাবে বিজ্ঞাপন আদি প্রচার হয়েছিল আমি তার কিছুই জানিনে—আর্ট-এর তরফ থেকে আমার কেবল এই বক্তব্য যে, আর্ট থেকে যে আনন্দ তাকে যদি সাধারণ ভাষায় যাকে আমোদ বলে তার থেকে পৃথক না করতে পারি তবে সরস্বতীর কাছে অপরাধী হব—তাহলে নারদের বীণাটাকেও কোন সন্ন্যাসী কোন দিন বিশ্বহিতের অছিলায় বাজেয়াপ্ত করে দিতে পারেন। আর্টিসট তাঁর আর্টকে যদি তাঁর দেশের সেবায় নিযুক্ত করেন তবে সন্ন্যাসী যেন তাঁকে নিন্দা না করেন।

তোমার চিঠিতে আর আর যে কথা লিখেচ স্মরণ রইল।

ইতি ১৯ মাঘ ১৩৩৪

তোমাদের

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ৫ ||

ওঁ

“UTTARAYAN”

SANTINIKETANBENGAL

কল্যাণীয়েষু

সুনীতি, গুটিকতক কাজের কথা আছে। নন্দলাল বললেন তুমি প্রবাসী প্রভৃতির জন্যে তাঁর কাছ থেকে ছ’খানা ছবি নিয়ে গেছ। বোধ করি প্রত্যেক ছবির জন্যে তাঁরা দশ টাকা পান। তাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট আছেন। কিন্তু এইসব ছবি তাঁরা বই আকারে ছাপতে চান। এখানে যে সব গরীব আর্টিস্ট আছে তাদের নিয়মিত আয়ের উপায় না করলে আমরা এখানে তাদের স্থির করে রাখতে পারব না, আর তাহলেই আমাদের কলাভবনের মৌচাকটি খাদ্য অভাবে ভেঙে যাবে। তাদের হাতের কাজ দিয়েই তাদেরকে আমরা সাহায্য করতে চাই। অতএব মাসিক-পত্রে ছাপানোর অতিরিক্ত কোনোরকমে এই ছবিগুলি যেন ব্যবহার করা না হয়।

মণ্টুক আমাকে একখানি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ চিঠি লিখেছিল, না লিখলেই ভাল করত। কিন্তু এই প্রাইভেট ঘটনা নিয়ে কোনোরকম প্রকাশ্য আলোচনা করলে আমাকে তাতে অত্যন্ত দুঃখ দেবে।

সেই জর্মান বইটা?

তুমি সেবার তাড়াতাড়ি চলে গেলে। এখানে আমি সমস্ত কাজের ভার নিজের কাঁধে নিয়েচি তোমার সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করবার ইচ্ছে ছিল। ইতিমধ্যে কি একবার আসতে পারবে না? কি করলে আমাদের আর্টিস্টদেরকে জীবিকার দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচিয়ে তাদের সাধনকে বাধামুক্ত করা যেতে পারে সেও একটা আলোচ্য বিষয়।

যাই হোক, এদের নিজেদের ছবিগুলি যাতে সম্পূর্ণ এদের নিজের উপার্জনের সহায় হয় সে আমাকে করতেই হবে।

একটা উত্তর শীঘ্র দিয়ো। ইতি পূর্ণিমা কার্তিক ১৩৩৫

তোমাদের

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একটা কথা মনে রেখো, প্রত্যেক ছবি তিনখানি পত্রিকায় ছাপা হয়। দশ টাকা মূল্য কি যথোচিত?

|| পত্রসংখ্যা ৬ ||

ওঁ

কল্যাণীয়েষু,

আমার বিজয়ার আশীর্বাদ গ্রহণ কোরো। ইতি বিজয়াদশমী ১৩৩৬

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ৭ ||

ওঁ

শ্রীমান সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

কল্যাণীয়েষু,

মনে করেছিলুম তোমার খাতা থেকে আমার ছবিটাকেক নির্বাসিত করব। তুমি রক্ষা করতে অনুরোধ করচ, রইল ওটা।

সেদিন তোমার সঙ্গে যে কথার আলোচনা হয়েছিল সে সম্বন্ধে আরো কয়েকটা কথা এইখানে বলে রাখি। তুমি বলেছিলে শনিবারের চিঠিতে যাঁরা আমার অবমাননা করেচেন তাঁরা আমার ভক্ত, কেবল বিশেষ কোনো ব্যক্তিগত কারণেই তাঁরা আমাকে আক্রমণ করে ক্ষোভ নিবৃত্তি করেচেন। কিছুকাল থেকেই এটা দেখেচি ব্যক্তিগত কারণ ঘটবার বহুকাল পূর্ব হতেই তাঁরা আমার নিন্দায় আনন্দভোগ করে এসেচেন। এটা দেখেচি যাঁরা কোনোদিন আমার নিন্দায় আনন্দভোগ করে এসেচেন। এটা দেখেচি যাঁরা কোনোদিন আমার লেখার কোনো গুণ ব্যাখ্যা করবার জন্যে একছত্রও লেখেননি তাঁরাই নিন্দা করবার বেলাতেই অজস্রভাবে বহু পল্লবিত করে লিখেচেন। সকল লেখকের রচনাতেই ভালোমন্দ দুইই থাকে কিন্তু ভালোটার সম্বন্ধে নীরব থেকে মন্দটাকেই দীর্ঘস্বরে ঘোষণা করার উৎসাহ শ্রদ্ধার লক্ষণ নয়। মোটের উপর যাকে আমরা নিন্দার্হ বলে জানি তার সম্বন্ধেই এরকম আগ্রহ স্বাভাবিক। কিন্তু তবু এরকম ব্যবহারকে নিন্দা করা যায় না। কেন না সকলেই আমার রচনা বা চরিত্রকে প্রশংসনীয় বলে মনে করবে এরকম প্রত্যাশা করাও লজ্জার কথা। বাঙলাদেশে আমার সম্বন্ধে এমন প্রত্যাশা করার হেতুই ঘটেনি। এঁরাই কথায় কথায় খোঁটা দিয়ে থাকেন যে স্তাবকবৃন্দ আমাকে বেষ্টন করে সর্বদা যে স্তব-কোলাহল করে থাকেন তার দ্বারাই নিজের ত্রুটিবিচারে আমি অক্ষম। এঁরা নিজে আমাকে পরিবেষ্টন করে থাকেন না, যাঁরা থাকেন তাঁরা কী করেন সে সম্বন্ধে এঁদের অনভিজ্ঞ কল্পনা আমার প্রতি প্রতিকূল মনোভাবের পরিচয় দেয়। কিছুকাল ধরে তুমি নিরন্তর আমার কাছে ছিলে, নিজের স্তব শোনবার আকাঙ্ক্ষা ও অভ্যাস তোমার দ্বারা পরিতৃপ্ত করবার কোনো চেষ্টা করেচি কিনা তার সাক্ষ্য তুমিই দিতে পারো। আমার যতদূর মনে পড়ে যেখানে তোমার কোনো গুণ দেখেচি সেখানে তোমার গোচরে অগোচরে তোমার স্তব আমিই করেচি। আমার বক্তব্য এই যে অসঙ্কোচে যাঁরা আমার নিন্দা করতে আনন্দ পান তাঁদের সংখ্যা অনেক এবং আমি তাঁদের দোষ দেব না, কিন্তু তাঁরা আমার প্রতি শ্রদ্ধাবান একথা বলা চলবে না।

সময় এসেচে যখন এসব ব্যাপারকে শান্তভাবে আমাকে গ্রহণ করতে হবে। দেশের লোকের কাছ থেকে আমি যা পাই তা আমার প্রাপ্য নয় এবং যা না পাই তাই আমার প্রাপ্য এই হিসেবনিকেশের নালিশ তুলে কিছু লাভ হয় না। মানরক্ষাও হয় না। কিন্তু অনাত্ম্যভাবে সত্যটাকে জেনে রাখা দরকার। চিত্তরঞ্জন বা মহাত্মাজিকে দেশের লোকে কদাচিৎ প্রতিবাদ করেচে, এমনকি নিন্দাও করেচে কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের কাছ থেকে আঘাত পেয়েও গর্হিত কুৎসিতভাবে তাঁদের প্রতি অসম্মান করেননি, করতে পারলে আনন্দ পেতেন না তাও নয় কিন্তু সাহস করেননি—কারণ তাঁরা জানেন দেশের লোক তা সহ্য করবে না। আমার সম্বন্ধে সে রকম সঙ্কোচের লেশমাত্র কারণ নেই—অনেকেই আমার নিন্দায় প্রীত হন এবং বাকি অধিকাংশই সম্পূর্ণ উদাসীন। আমার প্রকাশ্য অপমানে দেশের লোকের চিত্তে বেদনা লাগে না, সুতরাং আমার প্রতি যাঁরা কুৎসা প্রয়োগ করেন তাঁদের ক্ষতি বিপদ বা তিরস্কারের আশঙ্কা নেই। এক হিসেবে তাঁরা সমস্ত দেশের প্রতিনিধি-স্বরূপেই এ কাজ করে থাকেন। সুতরাং তাঁরা উপলক্ষ্য মাত্র। যাঁরা আমার অন্ধ স্তাবক বলে কল্পিত, যাঁরা আমার সুহৃদ বলে গণ্য তাঁরা আমার এই অবমাননার কোনো প্রকাশ্য প্রতিকার করে থাকেন তারও কোনো প্রমাণ নেই। বুঝতে পারি প্রকাশ্যে অপমান করতে অপর পক্ষের যত সাহস ও নৈপুণ্য এ পক্ষের তা নেই, তার প্রধান কারণ তাঁরা মনে মনে জানেন দেশের লোকের সহযোগিতার বল তাঁদের দিকে নয়। দেশের লোকের কাছে যে কোনো কারণে যাঁরা শ্রদ্ধাভাজন তাঁদের ভাগ্যে এ রকম গ্লানি কোনো দেশে কখনোই ঘটে না—রাস্তার চৌমাথার মধ্যে এমন নির্যাতন নি:সহায়ভাবে তাঁদের কখনোই ভোগ করতে হয় না। তাই বলচি এই ব্যাপারে মূল সত্যটাকে আমার জেনে নেওয়া এবং মেনে নেওয়া দরকার—তারপরে চিত্তকে অবিচলিত রাখা আরো দরকার। সত্তরের কাছে এসে পৌঁছেচি—আমার আয়ু শেষ হয়ে এসেচে, এখন মনের সমস্ত শক্তি নিয়ে এই কামনা করচি যে এই হতভাগ্য আমি নামক বাহিরের পদার্থটার সমস্ত বোঝা এবং লাঞ্ছনা থেকে ভিতরের আমি সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যেন ইহলোক থেকে বিদায় নিতে পারে।

এই উপলক্ষ্যে সংক্ষেপে আর একটা কথা বলে রাখি। প্রকাশ করাই আমার স্বধর্ম—প্রকাশের প্রেরণাকে অবরুদ্ধ করা আমার পক্ষে ধর্মবিরুদ্ধ। আমার প্রকৃতিতে এই প্রকাশের নানা ধারার উৎস আছে—তাদের যেটাকেই আমি অগ্রাহ্য করব সেটাতেই আমার খর্বতা ঘটবে। প্রকাশ আর ভোগ এক জিনিস নয়—প্রকাশের অভিমুখতা বাইরের দিকে, বস্তুত সেইটাতেই অন্তঃপ্রকৃতির মুক্তি, ভোগের অভিমুখতা ভিতরের দিকে, সেইটেতে তার অবরোধ। আমার নাট্যাভিনয় সম্বন্ধে তোমার মনে আপত্তি উঠেচে। কিন্তু নাটক রচনার মধ্যে যে প্রকাশচেষ্টা, অভিনয়ের মধ্যেও তাই। রচনার মধ্যেই যদি কলুষ থাকে সেটা নিন্দনীয়, অভিনয়ের মধ্যে যদি থেকে থাকে সেও নিন্দনীয়—কিন্তু অভিনয় ব্যাপারের মধ্যেই আত্মলাঘবতা আছে। এ কথা আমি মানিনে। আমার মধ্যে সৃষ্টিমুখী যতগুলো উদ্যম আছে তার প্রত্যেটাকেই স্বীকার করতে আমি বাধ্য। তোমাদের অভ্যাস ও সংস্কারের বাধায় তোমরা যে দোষ কল্পনা করচ তার দ্বারা আমার চেষ্টাকে প্রতিরুদ্ধ করলে নিজের প্রতি গুরুতর অন্যায় করা হবে। ইতি ১১ই পৌষ, ১৩৩৬

শুভাকাঙ্ক্ষী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ৮ ||

ওঁ

“UTTARAYAN”

SANTINIKETANBENGAL

কল্যাণীয়েষু,

অনেককাল হল তোমার খাতায় ছবি একটা এঁকেচি। কাজটা ভালো করলুম কিনা বোঝা গেল না। ছবিতে আমার নাম লিখিনি, লিখবও না। আমি যে ছবি আঁকি এ পরিচয় আমার প্রদেশবাসীর কাছে দিতে ইচ্ছে করিনে। তৎসত্ত্বেও বিচারে শাস্তি আরম্ভ হয়েচে। সেদিন তুমি ছবিগুলো কিছু কিছু স্বয়ংপ্রবৃত্ত হয়ে দেখে নিয়েচ সে জন্যে আমার মনে অত্যন্ত সংকোচ রয়ে গেল। আমার এ রচনা আমার দেশে আমার জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থায় কোনো দিনই প্রকাশ করব না। আমার অন্য রচনার দ্বারা দেশের কাছে যে অপরাধ করেচি ছবির দ্বারা তা ঘটবে না। তোমার খাতায় কিন্তু অনবধানবশত প্রমাণ রয়ে গেল। তাই তোমার কাছে আমার দরবার এই যে, খাতাটা তোমাকেক ফেরত দেবার আগে ঐ পাতাটা ছিঁড়ে নিতে চাই—নিলে ভারতীয় কলাভান্ডারে লেশমাত্র ক্ষতি ঘটবে না, আমিও নিরাপদে থাকব।

মালয়, জাভা ও সিয়ামে আমাদের নবপরিচিতবর্গের নামধামের তালিকা যদি একটা দাও তাহলে ভালো হয়। ইতিপূর্বে যেখানে যেখানে গেছি আমার সঙ্গীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েচে। মাঝে মাঝে এঁদের কাছ থেকে কোনো না কোনো আকারে বার্ষিক তত্ত্ব পাঠানো দরকার মনে করি। তোমার কাছে যেগুলি আছে পাঠিয়ে দিয়ো। কিছুদিন কতকগুলো জরুরি কাজ সারতে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়েচে। তাই আমার সংকলিত সেই শব্দ সংগ্রহখ তোমাকে পাঠানো হয়নি—একটু যখন হাঁপ ছাড়তে পারব পাঠিয়ে দেব। ইতি ৫ পৌষ ১৩৩৬

শুভাকাঙ্ক্ষী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ৯ ||

ওঁ

৩ জানুয়ারি

১৯৩০

কল্যাণীয়েষু,

প্রতিশ্রুতি পালন করা গেলক। নিরতিশয় ব্যস্ত ছিলুম, এখনো আছি, তাই কিছু দেরি হল। জিনিষটা যে পাঠালুম তার প্রধান উদ্দেশ্য এই যে এই প্রণালীতে আরো অনেক উৎসাহী লোক সংস্কৃত শব্দভান্ডার থেকে বাঙলার ভান্ডারে শব্দ আহরণ করবেন। তোমাদের পত্রিকায়খ চারদিকে ডাক পৌঁছবে কিনা জানি না। যাই হোক, আমার উৎসাহ আছে পান্ডিত্য নেই, সেইজন্যে দৃষ্টান্ত দেখাতে পারি বেশিদূর এগিয়ে দিতে পারিনে। এই কাজের জন্যে আমি ঘেঁটেচি অমরকোষ, মনিয়ার বিলিয়মস আপ্তে এবং বিলসনের অভিধান। ভুলচুক থাকতেও পারে, যাঁদের বিচার করবার অধিকার আছে তাঁরা বিচার করবেন। ভূমিকায় যদি অপক্ষ্য বা অসঙ্গত কিছু লিখে থাকি তুমি শোধন বর্জন করে দিয়ো।

অনুমান করচি ছুটিতে তুমি ঘরে ছিলে না—কলেজ খুলেচে ফিরে এসেচ আন্দাজ করে সঞ্চয়নটা পাঠাই। এই উপলক্ষ্যে প্রশ্ন এই যে, সংকলন synthesis এবং বিকলন analysis অর্থে ব্যবহার করা চলে কিনা? কলা শব্দের অর্থ খন্ড, কলাগুলিকে একত্র করাই সংকলন, বিযুক্ত করাই বিকলন। ব্যবকলন কথাটা গণিতে চলেচে অতএব কাজে লাগবে না। আর একটা প্রশ্ন—তুমি ধ্বনিবেদবিৎ,—নিম্নলিখিত পদে কি ছন্দভঙ্গ হয়েচে?—

‘‘হে ভৈরব, ত্রৈলোক্যপাবন,

মহেশ্বর, হে ভূত ভাবন।’’

তৃতীয় প্রশ্ন, আমার পূর্বপত্রখানা তোমার হস্তগত হয়েচে কি? ইতি

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ১০ ||

ওঁ

শান্তিনিকেতন

কল্যাণীয়েষু,

তোমার শেষ পত্রে অসঙ্গত কিছুই ছিল না। বস্তুত তোমাকে চিঠি লেখার পরে আমারই মনে কুন্ঠা জন্মেছিল। নিজেকে নিয়ে যে সমস্ত ক্ষুদে ক্ষুদে দুঃখ এসে ভিড় করে দাঁড়ায় তাদেরকে দ্বারের বাইরে খেদিয়ে রাখব বলেই দৃঢ়পণ করে থাকি—কারণ তারা আমাকে অপমানিত করতে পারে না—তাদেরকে স্বীকার করা দ্বারাই আমি নিজেকে খাটো করি। কিন্তু চিরাভ্যাসবশত নিজের প্রতি মমত্ব মাঝে মাঝে ঝাঁকানি দিয়ে ওঠে—তার অনতিকাল পরেই ধিক্কার বোধ হয়। ঋতু পরিবর্তনের সময়ে এই রকমেরই দ্বন্দ্ব ঘটতে থাকে। মনে আশা করে আছি এই দ্বন্দ্ব মিটতে দেরি হবে না। দেখেছি শরীরের দুর্বলতার সময়েই ধৈর্য্যের বাঁধ সহজে ভাঙে—কিন্তু সত্তর বছরের ধারে এসে শরীরের শক্তির পরে নির্ভর করা কিছু নয়। সংসারে আমার প্রাপ্যের হিসাব নিয়ে অসংযত আলোচনা আর আমার কাছে শুনতে পাবে না। তোমার খাতায় যে ছবিটা এঁকেচি—কিছুদূরে রেখে সেটা দ্রষ্টব্য। ইতি ১০ জানুয়ারি ১৯৩০

স্নেহানুবদ্ধ

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ১১ ||

ওঁ

কল্যাণীয়েষু,

সুনীতি, একটা সামাজিক সঙ্কটে তোমার শরণাপন্ন হলুম। ইতিহাসটা এই—সুরেনক এবং নুটুখ কোনো এক গ্রহচক্রে পরস্পরকে পছন্দ করেচে। নুটু বৈদ্য ঘরের মেয়ে, সুরেন কায়স্থ ঘরের ছেলে। নুটুর মা হিন্দুসমাজের সনাতন বিধি বিধানে অবিচলিত নিষ্ঠাবতী। তাঁর মন শান্ত করবার জন্য প্রমথনাথ তর্কভূষণগ মশায়ের কাছ থেকে এক পত্রী সংগ্রহ করেচি। তিনি বলেচেন এরকম বিবাহ শাস্ত্রমতে এবং লোকাচারের মতে বৈধ। এখন ঠেকেচে পুরোহিত নিয়ে। যদি সুরেন হিন্দুসমাজ থেকে তিরস্কৃত হবার মতো কোনো অপরাধ না ক’রে থাকেন তবে তাঁকে সে দন্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া তোমাদের কর্তব্য হবে। যদি তোমরা আনুকূল্য না করো তবে অগত্যা অশাস্ত্রীয়ভাবে কার্যসমাধা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। কিন্তু হিন্দুসমাজে এমন করে ছিদ্র খনন করলে সমাজ কতদিন টিকবে?

বিবাহের দিন ২৫শে বৈশাখ শুক্রবারে।ঘ বিলম্ব করা চলবে না যেহেতু শীঘ্র আমাকে স্থানান্তরিত হতে হবে। তুমি স্বয়ং যদি বন্ধুর প্রতি অনুকম্পা ক’রে এই কাজটি সম্পন্ন করে দাও তো সবচেয়ে ভালো হয়।ঙ যদি কোনো অনিবার্য বিঘ্ন থাকে তবে তোমার কোনো সুহৃদকে এই কাজে নিয়োগ ক’রে দিয়ো। সময় অল্প অতএব তার যোগে সম্মতি জানিয়ে আমাকে নিরুদ্বিগ্ন কোরো। ইতি ২১ বৈশাখ ১৩৩৮

শুভানুধ্যায়ী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ১২ ||

ওঁ

“UTTARAYAN”

SANTINIKETAN, BENGAL

৬/১/৩০

কল্যাণীয়েষু,

বালিদ্বীপের নৃত্যগীতের দলের সম্বন্ধে যে চিঠি লিখেছ, কাল পেয়েছি। আমার শরীর অসুস্থ, চলাফেরা করা একেবারে বন্ধ। কিন্তু তা হলেও তাঁদের আমি এখানে ডেকে এনে অভ্যর্থনা করতে পারতুম। কিন্তু একটা বিষয়ে আমার আশঙ্কা রয়েছে। আমার জনকয়েক আত্মীয়স্বজন কলকাতায় তাঁদের নাচ দেখেছেন—জিনিসটা পুরোপুরি খাঁটি কি না সে সম্বন্ধে তাঁদের সংশয় আছে ও নাচ তাঁদের খুব ভালো লাগেনি। তাঁদের মতামতের উপর আমি সম্পূর্ণ নির্ভর কর্চ্ছি না কিন্তু বিদেশীদের এখানে ডেকে এনে নাচ দেখে আমার যদি ভালো না লাগে, তবে তাঁদের মিথ্যা মনোকষ্ট দেওয়া হবে। তাই তাঁদের এখানে ডাকবার দায়িত্ব গ্রহণ করতে আমি অক্ষম। অকারণে ওঁদের অসুবিধায় ফেলতে চাইনে। দেহে মনে অবসন্ন বোধ করছি, সহজে কিছুতে উৎসাহ পাচ্ছিনে।

তোমাদের

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

[টাইপকরা চিঠির নিচে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর]

|| পত্রসংখ্যা ১৩ ||

ওঁ

কল্যাণীয় ডাক্তার শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

করকমলে—

আমার এই বইখানি ছাত্রদের বয়সী ছেলেদের জন্যে বিশেষ করে লেখা, কিন্তু ছাত্রদের জন্যে নয়। অর্থাৎ এ বই পড়ে কিম্বা পড়ার ভান করে কেউ পরীক্ষা পাস করবে সে উদ্দেশ্য আমি মনে রাখিনি।

ভাষার নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখতে গেলে কুচ্ছ্রাসাধনা চাই। মানব-সন্তানকে সে দুঃখ দেব বলে আমি প্রস্তুত হইনি। ভাষার ক্ষেত্রে আমি পথচলা মানুষ। চলতে চলতে যা আমাকে চমক দিয়েছে, ভাবিয়েছে, খুশি করেছে ঝুলিতে আমার সঞ্চয় তাই নিয়ে। বিষয়টা যাঁরা ফলাও করে দেখেছেন এবং তলিয়ে বুঝেছেন তাঁরা এর মালমশলায় খুঁৎ দেখতে পাবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মোটের উপরে জিনিসটা অপথ্য হবে না। ভাষাতত্ত্বে প্রবীণ তোমার সঙ্গে আমার তফাৎ এই যে, তুমি যেন ভাষা সম্বন্ধে ভূগোলবিজ্ঞানী, আর আমি যেন ভবঘুরে। নানা দেশের শব্দমহলের এমনকি তার প্রেতলোকেরও হাটহদ্দ তোমার জানা, তার খবর [২] তুমি সহজেই সাজিয়ে দিতে পারো সুসম্বন্ধ প্রণালীতে। চলতে চলতে যা আমার চোখে পড়েছে এবং ভাবনা জাগিয়েছে আমার মনে, তা নিয়ে খাপছাড়া ভাবে বকা আমার কাজ। আমার সেই চলে বেড়াবার স্বাদটুকু দিতে চাই। জ্ঞানের দেশে আপন মনে পায়ে চলে বেড়াবার সখ ছিল বলেই বেঁচে গেছি, সাধনা না থাকলেও। সেই সখটা যদি পাঠকের মনে জাগাতে পারি তাহলে খুশি হব, তার বেশি ফল পাবার অধিকার আমি দাবি করিনে।

এই বইয়ে যে ভাষার রূপ দেখাতে চেয়েছি তাকে বলে চলতি ভাষা। আমি তাকে বলি প্রাকৃত বাঙলা। সংস্কৃত ভাষার আধিপত্যকালে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃত প্রচলিত ছিল, তেমনি বাঙলার ভিন্ন ভিন্ন অংশে প্রাকৃত বাঙলার ভিন্ন ভিন্ন রূপ আছে। এদেরি মধ্যে একটা বিশেষ প্রাকৃত চলেছে আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে। এই বইয়ে সেই প্রাকৃতেরই স্বভাব বিচার করা হয়েছে। লেখকের পক্ষে তার একটা মুশকিল আছে। চলতি [৩] এই বাঙলা চলতি বলেই সম্পূর্ণ এক নিয়মে আজো বাঁধা পড়েনি। সাধুভাষার রীতিপদ্ধতি ও বানান সাহিত্য ব্যবহারের শাসনে বিধিবদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যে প্রাকৃত বাঙলায় ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারের পথে বাধা নেই। এটা অকর্তব্য। এখন থেকে একে একটা নিয়মের মধ্যে আনা চাই। এই গ্রন্থে রইল তার প্রথম চেষ্টা। এই গ্রন্থে সমর্থিত কোনো কোনো বানান উচ্চারণ বা ভাষাব্যবহার কারো কারো অভ্যস্ত নয় এমন হতে পারে। সে অবস্থায় রাশীকরণের প্রণালীতে অর্থাৎ অধিকাংশ লোকের সাংখ্যিক তুলনায় ক্রমশ তার বিচার স্থির হতে পারবে।

তাতে বিলম্ব ঘটবার আশঙ্কা যদি থাকে তবে বিশ্ববিদ্যালয় আপন হাতে কতৃত্বের অধিকার নিয়ে প্রাকৃত বাঙলার ব্যাকরণ নির্দিষ্ট করে দেবার ভার তোমার উপরেই যদি দেন তাহলে যোগ্য ব্যবস্থাই হবে। আমি কেবল এই ভাষার আকরণ অর্থাৎ আকারটা নিয়ে সাধ্যমতে হালকাভাবে একটা ছবি আঁকবার চেষ্টা করে বিদায় নিতে চাই।

|| পত্রসংখ্যা ১৪ ||

“UTTARAYAN”

SANTINIKETAN, BENGAL

ওঁ

কল্যাণীয় শ্রীমান সুমনকুমারকে তাঁর শুভ উপনয়ন উপলক্ষ্যে এই আশীর্ব্বাদ করি যে, এই অনুষ্ঠানের প্রভাব তাঁর চরিত্রে সর্র্ব্ব্যুতোভাবে সার্থকতা লাভ করুক। ইতি ২০/১/৪০

শুভার্থী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

|| পত্রসংখ্যা ১৫ ||

Mangpoo P.O.

(Darjeeling Dist)

কল্যাণীয়েষু,

কিছুকাল থেকে দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতাবশত ছাপার বা লেখার অক্ষর পড়ে ওঠা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়েছে। তবু ডাক্তার সুকুমার সেনের রচিত বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসের মুদ্রিত যে অংশটুকু আমার হাতে এসেছে ধীরে ধীরে তা আমি পড়ে শেষ করেছি। শেষ পর্যন্ত আমার ঔৎসুক্য জাগরুক ছিল। বাঙলা সাহিত্যের সমগ্র পরিচয়ের এমন পরিপূর্ণ চিত্র ইতিপূর্বে আমি পড়িনি। গ্রন্থকার তাঁর বিবৃতির সঙ্গে সঙ্গে আলোচিত পুস্তকগুলি থেকে যে দীর্ঘ অংশসকল উদ্ধৃত করে দিয়েছেন তাতে করে তাঁর গ্রন্থ একসঙ্গে ইতিহাসে এবং সঙ্কলনে সম্পূর্ণ রূপ ধরেছে। সেই কারণে এই গ্রন্থ ছাত্রদের প্রয়োজন সিদ্ধ করবে এবং সাহিত্যরসসন্ধানীদের পরিতৃপ্তি দেবে। এই গ্রন্থে সাহিত্যের ইতিহাস বাঙলাদেশের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ইতিহাসের পটভূমিকায় বর্ণিত হওয়াতে রচনার মূল্যবৃদ্ধি করেছে। গ্রন্থকারকে আমার সকৃতজ্ঞ অভিনন্দন জানাই।ক

এই উপলক্ষ্যে একটা কথা বলে রাখি। ‘‘বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা’’র এক জায়গায় লেখা হয়েছে দিনেন্দ্রনাথ আমার রচিত অনেক গানে সুর বসিয়েছেন,—কথাটা সম্পূর্ণই অমূলক। এই মিথ্যা জনশ্রুতি ইতিপূর্বেও অন্যত্র ছাপার অক্ষরে দেখেছি। মুখে মুখেও অনেকে চালনা করেন।

অমিয় বলছিলেন আমার সঙ্গে সায়ামে ভ্রমণকালে তোমার খাতায় যে সকল তন্ন তন্ন বিবরণ জমিয়েছ তা প্রচুর এবং প্রকাশযোগ্য। এগুলি হাতের অক্ষরের অন্তঃপুরে অবগুন্ঠিত না থাকাই শ্রেয় মনে করি। ইতি ৪/৫/৪০

তোমাদের

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সকল অধ্যায়

১. ব্যাকরণিয়া রবীন্দ্রনাথ
২. বাকপতি রবীন্দ্রনাথ
৩. রবীন্দ্রনাথ ও বাঙলাভাষা
৪. বিশ্বমনা: বাকপতি
৫. ভারতীয় সংগীত ও রবীন্দ্রনাথ
৬. রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রলিপি’
৭. রবীন্দ্রনাথের দেশমর্যাদাবোধ
৮. রবীন্দ্রনাথ
৯. ভারতদূত রবীন্দ্রনাথ
১০. মেক্সিকোতে রবীন্দ্র-সাহিত্য
১১. লন্ডনে রবীন্দ্রনাথ
১২. রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধ
১৩. রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বীপময় ভারতে
১৪. রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দেবতা’
১৫. RABINDRANATH TAGORE
১৬. PREFACE TO DEVANĀGARI GITĀNJALI
১৭. VIŚVA-MANĀH VĀK-PATI
১৮. VĀK-PATI
১৯. BOOK REVIEW
২০. TAGORE, THE FULL MAN AND IRAN
২১. MESSAGE
২২. TRANSLATION OF THE POEM
২৩. SOEKARNA MET TAGORE IN JAVA
২৪. MEETING SOEKARNO
২৫. A RECENT TRIBUTE TO RABINDRANATH THROUGH SCULPTURE FROM SOVIET LATVIA
২৬. সুনীতিকুমারকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি
২৭. রবীন্দ্রনাথকে লেখা সুনীতিকুমারের চিঠি
২৮. পত্রপরিচিতি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন