২১. শিবশংকরের শরীর

হুমায়ূন আহমেদ

শিবশংকরের শরীর কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। দুপুরের দিকে নিয়ম করে জ্বর আসছে। সন্ধ্যার পর পর জ্বর সেরে যাচ্ছে। তাকে কুইনাইন মিকচার দেয়া হচ্ছে। অতি তিক্ত সেই মিকচার সে পেটে রাখতে পারছে না। খাওয়ার পর পর বমি হয়ে যাচ্ছে। শিবশংকরের স্বাস্থ্য শিক্ষক গোপীনাথ বল্লভ ভালো দুশ্চিন্তায় আছেন। শিবশংকরকে নিরন্তু উপবাসের বিধান দিয়েছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস। উপবাসে শরীরের বিষ নষ্ট হয়। শিবশংকরের শরীর বিষাক্ত হয়ে গেছে বলে তার ধারণা।

শিবশংকর উপবাস করে যাচ্ছে। খাদ্যে এমনিতেই তার রুচি নেই। উপবাস তার জন্যে ভালো। সে জ্বরের সময়টা চাদর গায়ে শুয়ে শুয়ে কাটাচ্ছে। হাতের কাছে বইপত্র রাখছে। পড়তে ইচ্ছা করলে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। চামড়ায় বাধানো একটা খাতাও তার আছে। মাঝে মাঝে খাতায় ডায়েরির মতো লেখা লিখছে।

এক দুপুরে জ্বরের প্রবল ঘোরে সে খাতায় লিখল—

সাধনা = ফসল

সাধনা + প্রার্থনা = ফসল

কাজেই প্রার্থনা = ০

এর অর্থ প্রার্থনা মূল্যহীন। শিবশংকরের ধারণা হলো সে বিরাট এক আবিষ্কার করেছে। অংক দিয়ে প্রমাণ করেছে যে, প্রার্থনা হলো শূন্য। মূল্যহীন। সে তার আবিষ্কারের কথা গোপীনাথকে বলল। তিনি চোখ কপালে তুলে বললেন, তুমি বিকারের ভেতর আছ। জ্বরের কারণে এই বিকার তৈরি হয়েছে। তিনি শিবশংকরকে পাকস্থলী ধৌত করার বিধান দিলেন। বিকারের কেন্দ্ৰবিন্দু পাকস্থলী। পাকস্থলী ধৌত করার অর্থ বিকার ধৌত করা।

গোপীনাথের পাকস্থলী ধৌত করার পদ্ধতিটা জটিল এবং কষ্টকর। এক জগ লেবু মেশানো পানি পুরোটা খেয়ে ফেলতে হবে। ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট বসে থাকতে হবে। তারপর গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে পাকস্থলীর পুরো পানি ফেলে দিতে হবে।

শিবশংকর কষ্টকর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কোনোরকম আপত্তি করছে না। পাকস্থলী ধৌতকরণ প্রক্রিয়ায় তার বিকার যে দূর হচ্ছে তা না। বরং আরো বাড়ছে। শিবশংকর তার আবিষ্কারের বিষয়টা চিঠি লিখে দু’জনকে জানিয়েছে। একজন তার বাবা মনিশংকর। অন্যজন বিখ্যাত মানুষ— শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মনিশংকর পুত্রের চিঠির জবাব সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়েছেন। তিনি পুত্রের মানসিক অবস্থা নিয়ে যে দুশ্চিন্তগ্রস্ত তা তাঁর চিঠিতে বোঝা যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন–

বাবা শিবশংকর,

তোমার পত্র পাঠ করিয়া দুঃখিত এবং চিন্তিত হইয়াছি। তোমাকে একা রাখা ঠিক হয় নাই। তোমার আশেপাশে আমার থাকা উচিত ছিল। আমি নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত বলিয়া তাহা পারি নাই। ইহা আমার ব্যর্থতা। তুমি প্রমাণ করিয়াছ প্রার্থনা = ০, কিন্তু বাবা আজ তুমি যে বাঁচিয়া আছ তার মূলে আছে প্রার্থনা। তোমার আরোগ্য সাধনের সমস্ত চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয় তখন হরিচরণ বাবু প্রার্থনার মাধ্যমে তোমার জীবন রক্ষা করেন। এই কাহিনী বান্ধবপুরের সকলেই জানে। তুমিও নিশ্চয়ই এই বিষয়ে অবগত আছ।

এখন আমার আদেশ, তুমি মাথা হইতে এই ধরনের উদ্ভট এবং ক্ষতিকর চিন্তা পরিত্যাগ করিবে এবং কায়মনে পাপচিস্তার জন্যে ভগবানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিবে।

গোপীবাবুর কাছে শুনিলাম তোমার শরীর ভালো যাইতেছে না। আমি বিশেষ চিন্তাযুক্ত। মন্ত্রপূত একটি শক্তিকবজ পাঠাইলাম। ভক্তি সহকারে গলায় ধারণ করবে। যেন অন্যথা না হয়।

ইতি তোমার চিন্তাযুক্ত পিতা

শ্ৰী মনিশংকর রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চিঠির জবাব এলো না। শিবশংকর তা আশাও করে না। বড় মানুষদের কাছে সবাই চিঠি লেখে। এত চিঠির জবাব দেয়া সম্ভব না।

মন্ত্রপূত মাদুলির গুণেই হোক কিংবা পাকস্থলী ধৌতকরণ চিকিৎসার কারণেই হোক শিবশংকরের রোগ খানিকটা সেরেছে। পালা জ্বর বন্ধ হয়েছে। সে আগের মতো ঘুরতে বের হচ্ছে। হরিচরণের কবরের পাশে বেড়ে ওঠা আমগাছের চারদিকে রুটিন করে ঘুরছে। এই কাজটা করতে কেন জানি ৩।- ভালো লাগে। নিজেকে তখন ইলেকট্রন মনে হয়। ইলেকট্রন যেমন অ্যাটমো নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরে সেও সেরকম ঘুরছে। আমগাছটা যেন নিউক্লিয়াস। প্রোটন এবং নিউট্রন।

 

বেলা কম হয় নি, দশটার ওপরে বাজে। শিবশংকর আমগাছের চারদিকে ঘুরছে। তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, কারণ ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে। এই বৎসরটা মনে হয় কুয়াশার বছর। শ্রাবণ মাস শুরু হয়েছে। টানা বৃষ্টি হবার কথা। তার বদলে কুয়াশা। কথায় আছে— ‘মেঘের দিনে কুয়াশা, রাজকপালও ধুয়াশা।’ বড় কোনো দুর্ঘটনা অবশ্যই ঘটবে।

শিবশংকর নিজের মনে আছে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলছে, I am Mr. Electron. হঠাৎ সে শুনল অতি মিষ্টি সুরে কেউ যেন কথা বলল, আপনার কী হয়েছে?

শিবশংকর দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশার ভেতর থেকে কিশোরী এক মেয়ে বের হয়ে এলো। মেয়েটির পরনে ঘাগড়া জাতীয় পোশাক। মাথায় ঘোমটার মতো করে দেয়া ওড়না। মেয়েটির গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল গৌর। বড় বড় চোখ। চোখের মণি ঘন কৃষ্ণবর্ণ। মুখ গোলাকার। নাক সামান্য চাপা। কুয়াশার ভেতর মেয়েটাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্রাণীর মতো। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা মুসলমান। মেয়েটা আবার বলল, আপনার কী হয়েছে?

শিবশংকর বিব্রত গলায় বলল, কিছু হয় নাই তো।

চক্কর দিচ্ছেন কেন?

এমি। এটা আমার খেলা।

মেয়েটি বলল, ছোট বাচ্চারা এরকম খেলে। আপনি কি ছোট বাচ্চা?

শিবশংকর বলল, তুমি বান্ধবপুরের?

মেয়েটি বলল, আমার নাম আতর। আমি ধনু শেখের মেয়ে।

কোলকাতায় থাকো?

হুঁ। জাপানিরা বোমা ফেলবে এইজন্যে চলে এসেছি।

স্কুলে পড়?

হুঁ। বেগম রোকেয়ার স্কুলে।

কোন ক্লাসে?

ক্লাস এইট।

তুমি ছাত্রী কেমন?

ভালো না। ক্লাস সেভেনে একবার ফেল করেছি।

আমেরিকা কে আবিষ্কার করেছেন জানো?

জানি। কলম্বাস।

শুধু কলম্বাস বলা ঠিক না। বলা উচিত ক্রিক্টোফার কলম্বাস।

ভাস্কো দা গামা কে জানো?

জানি না। আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি কি বেলারানি?

বেলারানি কে?

বেলারানি আমাদের ইংরেজি। আপা। শুধু প্রশ্ন করেন। কেউ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে বলেন, You goat. আমরা উনাকে কী ডাকি জানেন? আমরা ডাকি মিসেস গোটরানি। তার একটা ছেলে আছে। হাবাগোবা। নাম অক্ষয়। আট বছর বয়স। একদিন স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন। আমি তাকে বললাম, এই তোর নাম কী? সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আততায় বাবু।

শিবশংকর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। কী সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে মেয়েটা কথা বলে যাচ্ছে। যেন শিবশংকর তার অনেক দিনের চেনা কেউ। মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গিটাও কী সুন্দর! হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। অভিনয়ও করছে। তোতলামির অভিনয় করে কী সুন্দর বলল— আততায় বাবু।

শিবশংকর বলল, তুমি তো আমার নাম জিজ্ঞেস করলে না।

আতর বলল, আমি সবাইকে চিনি। আপনাকেও চিনি। আপনি মনিশংকর চাচার ছেলে শিবশংকর। আপনি গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। হয়েছে না?

হয়েছে।

আমি এখন যাই। অনেকক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলে ফেলেছি। আল্লাহ আমাকে পাপ দিকে।

শিবশংকর তাকিয়ে আছে। আতর নামের মেয়েটা ছোট ছোট পা ফেলে। দ্রুত যাচ্ছে। শিবশংকরের কাছে মনে হলো, হাঁটার মধ্যেও এই মেয়ের নাচের ভঙ্গি আছে। মেয়েটির ওপর থেকে এক মুহুর্তের জন্যে সে চোখ ফেরাতে পারল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার জন্যে তার একটু লজ্জাও লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে বান্ধবপুরের সবাই তাকে দেখছে।

 

ধনু শেখ অনেক বেলায় নাশতা খেতে বসেছেন। বাটিভর্তি মুরগির মাংস এবং চালের আটার রুটি। তার হজমের সমস্যা হচ্ছে। যা খান কিছুই হজম হয় না। বুক জ্বালাপোড়া করে। কবিরাজি চিকিৎসা চলছে। কোলকাতার কবিরাজ আয়ুৰ্বেদশাস্ত্রী মিশ্র ঠাকুর চিকিৎসা করছেন। গুরুপাক খাবার সম্পূর্ণ নিষেধ করে দিয়েছেন। নিষেধ মানা ধনু শেখের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

ধনু শেখ খেতে বসেছেন উঠানের জলচৌকিতে। চায়ের কাপে ওষুধ তৈরি করা আছে। খাওয়া শেষ করেই ওষুধ খাবেন। ওষুধ খালিপেটে খাওয়ার কথা। তিনি এই নিয়ম মানেন না। তার মতে ওষুধ হচ্ছে ওষুধ। ওষুধের আবার খালিপেট ভরাপেট কী? যত ফালতু বাত।

নাশতার মাঝখানে আতর উঠানে উপস্থিত হলো। ধনু শেখ বললেন, কই ছিলি?

আতর বলল, বেড়াতে গিয়েছিলাম।

বান্ধবপুরে বেড়ানোর কী আছে?

অনেক কিছুই আছে। নদী আছে, জঙ্গল আছে, পুকুর আছে।

একা কোনোখানে যাবি না।

একা তো যাই নাই। দুইজন সঙ্গে নিয়ে গেছি।

ধনু শেখ বিস্মিত হয়ে বললেন, দুইজন কে?

আতর নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, কান্ধের দুই ফেরেশতা নিয়ে গেছি। একজনের নাম কেরামন, আরেকজনের নাম কাতেবিন। ঠিক আছে না বাবা?

ধনু শেখ হতাশ গলায় বললেন, ঠিক আছে। ঠিক আছে বলা ছাড়া তাঁর উপায়ও নেই। তিনি তার এই মেয়েকে অত্যধিক স্নেহ করেন। তার তিন মেয়ের মধ্যে একজনই বেঁচে আছে। মা মরা মেয়ে। মেয়ের মা বেদানা গত বৎসর হঠাৎ করে মারা গেছে। ধনু শেখ বিনা কারণে কাউকে এভাবে মারা যেতে দেখেন নি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সে পান মুখে দিয়ে শুয়েছে। শোবার আগে দাসীকে বলেছে, আইজ আরামের ঘুম দিব। কেউ যেন না ডাকে। মশারি ফেলে দিও। দিনের বেলা মশা যখন ত্যক্ত করে তখন খুব খারাপ লাগে। রাতের মশা সহ্য করা যায়। দিনের মশা না।

দাসী মশারি খাটাতে গিয়ে দেখে, মুখভর্তি পান নিয়ে বেদানা মরে পড়ে আছে।

মায়ের মৃত্যুশোকে কাতর হয়ে আতর দুইদিন দুই রাত কিছুই মুখে দেয় নি। পানি পর্যন্ত না। তৃতীয় দিনে সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। ধনু শেখকে বলল, বাবা, মা পরকালে খুব ভালো জায়গায় স্থান পেয়েছেন। সুখী এবং পবিত্র

আত্মাদের সঙ্গে এখন তার যোগাযোগ। এখন আর তাকে নিয়ে মনে কষ্ট

পাওয়ার কিছু নাই। ধনু শেখ বিস্মিত হয়ে বললেন, তোকে বলেছে কে?

আতর স্বাভাবিক গলায় বলল, মা বলে গেছেন।

ধনু শেখ জানেন এইসব কল্পনার কথা। মৃত্যমানুষ কখনো কিছু বলে যায় না। তাদের কিছু বলার ক্ষমতা থাকলে জীবিত মানুষদের সারাক্ষণ মৃতদের কথা শুনতে হতো। তারপরেও মেয়ের মনের শান্তির জন্যে তিনি বলেছেন, খুবই ভালো সংবাদ দিলা মা। শুকুর। আলহামদুলিল্লাহ। বান্ধবপুরের ইমাম করিমকে পত্র দিতেছি, সে যেন মসজিদে মিলাদ এবং তাবারুকের আয়োজন করে।

 

মাওলানা ইদরিসের মেয়ে মীরার বয়স তের মাসের কয়েকদিন বেশি। এই বয়সে শিশুরা বাবা, মা, পানি… এরকম অনেক কথা বলে। মীরা একটি শব্দ ছাড়া কোনো কথাই বলে না। সে শব্দটা হলো— ব্লাম। ইদরিসের মনে এই নিয়ে খুবই কষ্ট। এত শব্দ থাকতে তাঁর মেয়ে রামনাম শিখল কেন? যখন তিনি বলেন, মীরা মা, বলো বাবা। বাবা। আমি তোমার বাবা। বলো বাবা।

মীরা বলে, রাম।

ইদরিস বড়ই বিরক্ত হন। ছোট্ট মীরা মনে হয় বাবার বিরক্তি ধরতে পারে। সে তার বাবাকে আরো বিরক্ত করার জন্য মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে, রাম। রাম।

কালী বলে যে মেয়েটা মীরার দেখাশোনা করে তাকে ইদরিস জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি আমার মেয়েটার সামনে রামনাম নাও? তাকে রাম বলা তুমি শিখায়েছ?

কালী দুঃখিত হয়ে বলেছে, মুসলমান মেয়েরে আমি রামনাম কেন শিখাব বলেন? আমার ধর্মভয় আছে না?

মেয়েটা আপনাআপনি রাম ডাকা শুরু করল?

তাই তো দেখি। বিরাট আশ্চর্য ব্যাপার।

মেয়ের ‘রাম’ ডাকার জন্যে মাওলানা ইদরিস যতটা দুঃখিত তারচেয়ে অনেক দুঃখিত হাদিস উদ্দিন। সে মীরার কানের কাছে ক্রমাগত বলে—মরা মরা মরা। রাম উল্টো করে মরা বলা। এতে যদি দোষ কাটে।

দোষ কাটে না। মীরা আরো বেশি করে বলে, রাম রাম। বলে আর হাসে। হাত পা নাড়ে।

একজন মুসলমান মেয়ে জন্মের পর থেকে রামনাম জপ করছে, এই খবরটা বান্ধবপুরে ভালোই ছড়িয়েছে। অনেকের ধারণা মীরার ভেতর দেবী সীতা প্রকাশিত হয়েছেন। তিনিই স্বামী রামের নাম জপ করছেন। এয়োতি মেয়েরা তাদের শাখা এবং সিঁদুরের কোটা মীরাকে দিয়ে ছুইয়ে নিচ্ছে। সবাই ভক্তিভরে মীরাকে কোলেও নিচ্ছে। অতি ভক্তিমতীরা মীরার পায়ে প্ৰণামের ভঙ্গিও করছে।

মীরার বিষয়ে কথাবার্তা শুনে তাকে দেখতে এসেছে শিবশংকর। মীরাকে কোলে নিয়ে শ্ৰীনাথ বাগানে হাঁটছিলেন। শিবশংকরকে দেখে মীরা কোলে ওঠার জন্যে দু’হাত বাড়িয়ে দিল। শিবশংকর তাকে কোলে না নিয়ে বলল, খুকি তোমার নাম কী?

মীরা ফিক করে হেসে বলল, রাম।

শ্ৰীনাথ বাবু বললেন, বুঝলে শিবশংকর, এই মেয়ের মুখে রাম ছাড়া কোনো কথা নেই। তাকে যাই জিজ্ঞেস করো সে বলবে রাম। ভক্তিভরে বলে।

শিবশংকর বলল, কাকু, আমার ধারণা। আপনি তাকে রামনাম শিখিয়েছেন।

শ্ৰীনাথ চোখ কপালে তুলে খড়খড়ে গলায় বললেন, এইরকম ধারণার কারণ কী?

শিবশংকর বলল, আপনি রামভক্ত মানুষ। দিনরাত রামায়ণ পড়েন। মুসলমান এই মেয়েকে রামায়ণ শিখায়ে আমার লাভ?

আপনি পুণ্যের আশায় এই কাজ করেছেন। আপনি ভেবেছেন একটা মুসলমান মেয়েকে রামনাম শেখানোয় আপনার পুণ্য হয়েছে। পুণ্যের আশায় অশিক্ষিত মানুষরা অনেক অন্যায় করে।

তুমি আমাকে অশিক্ষিত বললা? আপনাকে বলি নাই। যারা অশিক্ষিত তাদের বলেছি।

আমি খাঁটি ব্ৰাহ্মণ। তুমি কি জানো তোমার এই আচরণের জন্যে আমি যদি পৈতা ছয়ে অভিশাপ দেই তুমি গলায় রক্ত উঠে মারা যাবে।

শিবশংকর স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি অযথাই আমার ওপর রাগ করছেন। তারপরেও আপনি যদি অভিশাপ দিতে চান দিতে পারেন। অভিশাপ হলো শূন্য। আমি অংক দিয়ে প্রমাণ করতে পারি।

শ্ৰীনাথ রাগে থারথার করে কাঁপছেন। শিবশংকর স্বাভাবিক গলায় বলছে –

জীবন = মৃত্যু

জীবন + অভিশাপ = মৃত্যু

কাজেই অভিশাপ = ০

শ্ৰীনাথ বললেন, তোমার পিতা বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তার ছেলে হয়ে তুমি কুলাঙ্গার হয়েছ। তোমার মুখদর্শনও পাপ।

শিবশংকর চলে এলো। আজ তার মন খুব ভালো, কারণ রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ তার মতো নগণ্য একজন মানুষের চিঠির জবাব দিয়েছেন। চিঠি পড়ে শিবশংকর লজ্জার মধ্যে পড়েছে। কারণ রবীন্দ্ৰনাথ তার চিঠি পড়ে ভেবেছেন যে, শিবশংকর গুরুগম্ভীর বয়স্ক কোনো মানুষ। কলেজের ফাস্ট ইয়ারের ছাত্ৰ ভাবেন নি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

ভবদীয় শিবশংকর,

আপনার পত্র হস্তগত হইয়াছে। আপনি অংকের মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা করিয়াছেন প্রার্থনা সমান শূন্য। আপনার অংকে কিছু কৌশল আছে! কৌশল মানেই ফাঁকি। ভগবান ফাঁকির ঊর্ধ্বে। আপনি যে সাধনার কথা বলিয়াছেন। সেখানেও কিন্তু প্রার্থনা জড়িত। প্রার্থনা বাদ দিয়া সাধনা হয় না।

ইতি শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকু
জোড়াসাঁকো

শিবশংকরের খুব ইচ্ছা চিঠিটা সবাইকে পড়ায়। পড়বার মতো কাউকে সে পাচ্ছে না। এই চিঠির মর্ম উদ্ধার সবার পক্ষে সম্ভব না। তবে তার ধারণা আতর মেয়েটা হয়তো চিঠির গুরুত্ব বুঝতে পারবে। মেয়েটার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। এটাই সমস্যা। রোজ ভোরে আমগাছের চারদিকে চক্কর দেবার সময় তার মনে হয় এই বুঝি কুয়াশার ভেতর দিয়ে আতর এসে দাঁড়াবে। তাকে দেখে ঠোঁট চেপে হাসবে। শিবশংকর ঠিক করেছে সাতদিন সে অপেক্ষা করবে। এর মধ্যে দেখা না হলে চলে যাবে ধনু শেখের বাড়িতে।

 

ধনু শেখ মানপর্বের আগে গায়ে রসুন ভেজানো সরিষার তেল মাখছিলেন। এই অবস্থায় খবর পেলেন মনিশংকরের ছেলে শিবশংকর এসেছে। সে আতরের সঙ্গে কথা বলতে চায়। খুব না-কি জরুরি। ধনু শেখের বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি শিবশংকরকে উঠানে ডেকে পাঠালেন।

তুমি শিবশংকর?

শিবশংকর হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

অমর মেয়ে অন্তরকে চান?

চিনি।

কীভাবে চেন?

তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে।

কী কথা হয়েছে?

নানান বিষয়ে কথা হয়েছে।

তার সঙ্গে তোমার প্রয়োজনটা কী?

তাকে আমি একটা চিঠি পড়তে দিব।

ধনু শেখের হতভম্ব ভোব কাটছে না। বরং বাড়ছে। তিনি চাপা গলায় বললেন, আতর বাড়িতে আছে। তবে তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে না। তুমি আর কখনো এ বাড়িতে আসবেও না।

শিবশংকর বলল, আচ্ছা।

ধনু শেখ বলতে চাচ্ছিলেন, এ বাড়ির ত্ৰিসীমানায় যদি তোমাকে দেখি তাহলে তোমার ঠ্যাং ভেঙে দেব। কঠিন কথাটা বলতে পারলেন না। মনিশংকরের ছেলেকে এমন কথা বলা যায় না। মনিশংকর বিশিষ্ট ব্যক্তি। তবে তাকে তার পুত্রের কর্মকাণ্ড অবশ্যই জানানো উচিত। তিনি ঠিক করলেন, আজ দিনের মধ্যেই মনিশংকরকে চিঠি দিয়ে সব জানাবেন। এই সঙ্গে আতরকেও সাবধান করে দিতে হবে।

আতরের বিষয়ে তিনি খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। মেয়েটা এমন একটা কাণ্ড করেছে যার কাছে শিবশংকরের সঙ্গে আলাপের ঘটনা কিছুই না। তিনি শুনেছেন আতর নৌকা নিয়ে রঙিলা নটিবাড়ি দেখতে গিয়েছিল। এই বিষয়ে আতরের সঙ্গে এখনো কথা হয় নাই। কীভাবে কথা বলবেন বুঝতে পারছেন না বলেই কথা হয় নাই। আতরকে বান্ধবপুরে আনাটাই ভুল হয়েছে। যে কর্মকাণ্ড সে করছে তারচেয়ে কোলকাতায় থেকে জাপানিদের বোমা খাওয়াও অনেক ভালো।

ধনু শেখ ডাকলেন, আতর মা কোথায়?

ঘর থেকে আতর বের হলো না। আতরের দাসী হামিদ বের হলো। হামিদার চেহারা রাক্ষসের মতো। দাঁত উঁচু। মুখে বসন্তের দাগ। একটা চোখ নষ্ট। সেই নষ্ট চোখ অক্ষিকোটির থেকে সামান্য বের হয়ে আছে।

অবিবাহিতা অতি রূপবতী কন্যাদের জন্যে কুৎসিতদর্শন দাসী রাখতে হয়। হামিদাকে এই কারণেই রাখা হয়েছে।

হামিদা ঘোমটা দিয়ে তার নষ্ট চোখ ঢেকে বলল, আম্মা বাড়িতে নাই।

ধনু শেখ বললেন, কই গেছে?

ইমাম করিম সাহেবের বাড়িতে গেছেন।

করিম সাহেবের বাড়িতে কেন?

উনার পরিবারের সাথে আম্মার ভাব হইছে। পেরায়ই ঐ বাড়িতে যায়।

তুমি তার সঙ্গে যাও নাই কেন?

আম্মা আমারে নিয়া কোনোখানে যায় না।

ধনু শেখ বললেন, আতর রঙিলা বাড়িতে গিয়েছিল, এটা কি সত্য?

সত্য না।

সত্য না হলে কেন আমার কানো এমন কথা আসছে?

জানি না কেন আসছে। তুমি ইমাম করিমের বাড়িতে যাও। আতরকে নিয়া আস। জি আচ্ছা।

ধনু শেখ বললেন, জি আচ্ছা বলে দাঁড়ায়া আছ কেন! যাও।

হামিদ চলে গেল। ধনু শেখ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাসের কারণ হামিদা। সে ধনু শেখের জীবনে বড় ধরনের এক সমস্যা তৈরি করেছে। এই মেয়েটির চেহারা যত কুৎসিত তার কণ্ঠস্বর ততটাই মধুর। সে যখন কথা বলে ধনু শেখের শুনতে ভালো লাগে। ধনু শেখের মনে হয়, মেয়েটিকে পর্দার আড়ালে রেখে তিনি তার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘণ্টা আলাপ করতে পারবেন। কেন এরকম মনে হয় তিনি নিজেও জানেন না। হামিদা কি কোনো তুকতাক করেছে? সম্ভাবনা আছে। দাসীশ্রেণীর মেয়েরা তুকতাকে পারদর্শী। হামিদাকে বিদায় করে। দেয়াটাই সবচে’ ভালো বুদ্ধি। সমস্যা একটাই, আতর হামিদাকে অত্যন্ত পছন্দ করে। অনেক রাত জেগে তার সঙ্গে গল্প করে। ধনু শেখ শুনেছেন, এমনও হয়েছে- গল্প করতে করতে তারা রাত পার করে দিয়েছে। এটাও কোনো ভালো কথা না। দাসীর সঙ্গে এত কী গল্প! দাসী হলো দাসী। আতরের বিয়ে হলে হামিদ আতরের সঙ্গে আতরের শ্বশুরবাড়িতে যাবে। হামিদার বাকি জীবন কাটবে সেখানে। আতরের স্বামী যদি চায় দাসীর গর্ভে ও সন্তান জন্মাতে পারবে। সেই সন্তানরা কোনো সম্পত্তির অংশ পাবে না। বাবাকে বাবা ডাকতে পারবে না। তারা বাবার সংসারে কমলা খাটবে। এইটাই নিয়ম। অনেকে এই নিয়মে ভুল খুঁজে। ধনু শেখ কোনো ভুল দেখেন না। নিয়ম সমাজের ভালোর জন্য আসে। মন্দের জন্য আসে না।

 

আতর গল্প করছে। শরিফার সঙ্গে। গল্পের বিষয়বস্তু রঙিলা নটিবাড়ি। আতর সেখানে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ ছিল। সে কী দেখে এসেছে তারই গল্প। শরিফা বলল, তোমার খুবই সাহস।

আতর বলল, ঠিকই বলেছেন, আমার অনেক সাহস।

তোমার বাবা এই ঘটনা জানেন না?

না। আর জানলেই কী? উনি আমারে কি শাস্তি দিবে? আমারে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা উনার নাই! বাপজান আমারে ভয় পায়।

ভয় পায়?

হুঁ। বাপজান ভাব দেখায় সে খুব সাহসী। আসলে ভীতু। বেজায় ভীতু।

শরিফা ইতস্তত করে বলল, রঙিলা বাড়িতে কী দেখলা?

আতর বলল, দিনের বেলা গিয়েছিলাম। কিছুই দেখি নাই। সুন্দর সুন্দর মেয়ে— হাসতেছে, গল্প করতেছে। একৃজুন আরেকজনের চুল বানতেছে।

ইমাম ইদরিস সাহেবের স্ত্রী জুলেখা না-কি রঙিলা বাড়িতে থাকেন? উনার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না। উনি রঙিলা বাড়িতে থাকেন না। উনি কলিকাতা থাকেন। তাঁর গানের নতুন রেকর্ড হবে, এইজনে গিয়েছেন। আপনি কি রেকর্ডে উনার গান শুনেছেন?

শুনি নাই। শুনতে ইচ্ছা করে।

আতর বলল, শুনতে ইচ্ছা করলে আমি শুনাব।

তোমার কাছে কি কলের গান আছে?

কলিকাতার বাড়িতে আছে। আমি আনাব।

কবে আনাবা?

খুব শিগগির আনাব। এখুন্টু আমি যাই।

আচ্ছা যাও, আবার আসবা।

আতর উঠে দাড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করব। যদি মনে কিছু না নেন।

শরিফা বলল, মনে কিছু নিব না। যা ইচ্ছা জিজ্ঞাস করা।

আপনার স্বামী আপনাকে তালাক দিয়েছেন। তারপরেও আপনি স্বামীর ঘরে বাস করেন। এটা কেমন কথা।

শরিফা বলল, আমি আমার ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভাই আমারে সুখে নাই। আমার কোনোখানে যাওয়ার জায়গা নাই। ইমাম সাব আমারে আবার বিবাহ করতে রাজি হয়েছেন। উনি দয়া করেছেন।

বিবাহ কবে?

ধর্মে নিয়ম আছে। উনি বিবাহ করার আগে আমারে অন্য জায়গায় বিবাহ করতে হবে। এরে বলে হিল্লা’ বিবাহ। আমারে কেউ হিল্লা বিবাহ করতে রাজি না বইলা দেরি হইতেছে। তবে আমি একঘরে থাকলেও আলাদা থাকি। উনার সঙ্গে কথা বলি না। পর্দার মধ্যে থাকি। ভইন, আর কিছু জিজ্ঞাস করবা?

না।

আতরের মন খারাপ হয়ে গেল। শরিফা হাসিখুশি মেয়ে, এখন কেমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। আতরের নিজেরও কাঁদতে ইচ্ছা করছে। এরকম তার প্রায়ই হয়। নিজের দুঃখে না, অন্যের দুঃখে তার কাঁদতে ইচ্ছা করে।

 

যে সময়ের কথা বলছি সে-সময়ে হিল্লা বিবাহ কঠিন বিষয় ছিল। ইসলাম ধর্ম প্রচারের যুগে ভারতবর্ষের মুসলমানরা কঠোরভাবে ধর্মের নিয়মকানুন পালন করতেন না। ধর্মকর্মে চিলাঢ়ালা ভাব ছিল। অনেক হিন্দুয়ানী ছিল। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ভক্তিভরে দেবদেবীকে নমস্কার করতেন। তাদের কাছে পারলৌকিক এবং ইহলৌকিক মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা জানাতেন। দেবদেবীদের নাম দিয়ে ছেলেমেয়েদের নামও রাখতেন। যেমন–

নারায়ণ শেখ
গোকুল মোল্লা
কালী বানু।

মুসলমান মেয়েরা শাঁখা পরতেন, কপালে সিঁদুর দিতেন। মুসলমান বাড়িতে থাকত তুলসি মঞ্চ। সেখানে সান্ধ্যপ্ৰদীপ জ্বালানো হতো।

ভারতবর্ষের মুসলমানদের ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে উনিশ শতকের মাঝামাঝি মৌলানা এনায়েত আলী এবং মৌলানা কেরামত আলি ব্যাপক প্রচার শুরু করেন। তাদের ধর্ম প্রচার আন্দোলনের নাম ‘তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া’। এই নামের অর্থ – মোহাম্মদের পথ।

তরিকায়ে মোহম্মদীয়া আন্দোলনের পাশাপাশী চলছিল ফরায়েজী আন্দোলন। এই আন্দোলনের সূচনা করেন শরীয়তুল্লাহ। ফরায়েজী আন্দোলন মোহাম্মদ (দঃ)-এর শিক্ষার চেয়ে কোরানের শিক্ষাকে প্রাধান্য দিল। তাদের মতে মুসলমানদের সব বাদ দিয়ে কোরানের ফরজ আঁকড়ে ধরতে হবে।

ফরায়েজী আন্দোলন এবং তার পরে পরে হানাফি মোস্তাহাবের কট্টরপন্থী আন্দোলনে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সহজিয়া ভাব দূর হয়ে গেল।

তালাক দেয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহের ব্যাপারে কোরান শরীফ ‘হিল্লা বিবাহ’ উল্লেখ করেছে, কাজেই হিল্লা বিবাহ হতে হবে। এর মধ্যেও মনগড়া অনেক নিয়মকানুন তৈরি হয়ে গেল। যেমন, যিনি তার তালাকপ্ৰাপ্ত স্ত্রীকে আবার বিবাহ করতে চান। তিনি তার ইচ্ছার কথা জুমার নামাজের পর সমস্ত মুসল্লিদের জানাবেন। যাতে মুসল্লিদের মধ্যে যিনি ইচ্ছা করেন। তিনিই বিয়েতে আগ্ৰহ প্ৰকাশ করতে পারেন। গোপনে কারো সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়া যাবে না।

পবিত্র কোরান শরীফে এ জাতীয় কোনো নিয়মকানুন নেই। সূরা বাকারায় (আয়াত ২৩০) আল্লাহপাক বলছেন—

And if he hath divorced her (the third time), then she is not lawful unto him thereafter until she hath wedded another husband. Thef if he (the other husband) divorced her it is no sin for both of them that they come together again if they consider that they are able to observe the limits of Allah.

অনুবাদ: M Pickthal

তারপর যদি সে ঐ স্ত্রীকে তালাক দেয়। তবে যে পর্যন্ত না। ঐ স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করেছে তার পক্ষে সে বৈধ হবে না। তারপর যদি সে (দ্বিতীয় স্বামী) তাকে তালাক দেয় তবে তাদের আবার মিলনে কারও কোনো দোষ নেই, যদি দুজনে ভাবে যে তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রেখে চলতে পারবে।

অনুবাদ : মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

এক জুম্মার নামাজে খুৎবা পাঠের পর ইমাম করিম শরিফার হিল্লা বিবাহের কথা বললেন। মুসল্লিদের মাঝে গুঞ্জন দেখা গেল। এ ধরনের ঘটনা বান্ধবপুরে এর আগে ঘটে নি। করিম বললেন, তালাক দেয়া স্ত্রীকে নিজের বাড়িতেই আমি রেখেছি। বাধ্য হয়ে রেখেছি। তবে তার মুখ দর্শন করি না। সে আলাদা ঘরে থাকে। তার হিল্লা বিবাহের পর আমি ইনশাল্লাহ আবার তাকে বিবাহ করব। আমি একটা ভুল করেছি। আল্লাহপাকের কাছে ভুলের জন্যে ক্ষমা চাই। আমি আমার স্ত্রীকে খুব ভালো পাই। সে ভালো মেয়ে। এখন তার জন্যে আমার মন কান্দে।

কথা বলতে গিয়ে ইমাম করিমের গলা ভারী হয়ে গেল। তার চোখে পানিও এসে গেল। পাগড়ির কোণা দিয়ে তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, যদিও আল্লাহপাক তালাক বৈধ করেছেন, তারপরেও তার কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ। অপছন্দের কাজ বলেই তিনি যেসব দম্পতি তালাকের পর পুনর্বিবাহ করতে চায় তাদের জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। হিল্লা বিবাহ এইরকম এক শাস্তি।

জুম্মাবার উপলক্ষে একজন মসজিদে খিচুড়ি সিন্নি দিয়েছিল। করিম সেই খিচুড়ি খানিকটা খেয়ে মসজিদে শুয়ে থাকলেন। বাড়িতে গেলেন না। ঠিক করলেন আছর, মাগরিব এবং এশার নামাজ শেষ করে বাড়িতে যাবেন। আজকাল বাড়িতে যাবার বিষয়ে তিনি আগ্রহ বোধ করেন না। যখন কাজকর্ম থাকে না তখন হাদিস কোরান পড়ে সময় কাটাতে চেষ্টা করেন। কোনো কিছুতেই মন বসে না। প্ৰচণ্ড অস্থিরতা বোধ করেন। অস্থিরতার কারণও তার কাছে খুব স্পষ্ট না। শরিফাই কারণ এটা ঠিক, তবে কোন অর্থে? শরিফাকে মাথা থেকে সম্পূর্ণ দূর করে তিনি দেশ থেকে আরেকটা মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসতে পারেন। এটাই করা উচিত। কিন্তু সেই মেয়ে তো শরিফার মতো হবে না। রং ঢং জানবে না। মজা করে কথা বলবে না। যদিও সারাক্ষণ হাসি মশকরা শোভন না।

ইমাম করিম সাহেব কি মসজিদে?

কে?

আমি ইদরিস।

কী চান?

দুটা কথা বলব।

করিম বিরক্ত হয়ে বের হলেন।

কী বিষয়ে কথা বলতে চান?

তালাক বিষয়ে।

করিম বললেন, তালাক বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

দেওবন্দে ছিলাম। সেখানে বড় বড় আলেমদের তালাক বিষয়ে আলোচনা শুনেছি।

কী শুনেছেন?

নবীজির এক হাদিস আছে যেখানে তিনি বলেছেন, কেউ যদি পর পর তিনবার তালাক দেয় তা এক তালাক হিসাবে গণ্য হবে। এক তালাকের পর ইদ্দতকাল পার করতে হবে। ইদতের পর দ্বিতীয় তালাক আসতে হবে। তারপর আবার ইদ’তকাল পার করতে হবে। কাজেই আপনি যে তালাক দিয়েছেন তা হয় নাই। আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ঘরসংসার করতে পারেন। তাকে হিল্লা বিবাহ দেওয়ার প্রয়োজন নাই।

করিম বললেন, যে বিষয় জানেন না সে বিষয়ে কথা বলবেন না। অন্য মাজহাবের লোকজন। এরকম কথাবার্তা বলে। আমরা হানাফি মাজহাবের। এই মাজহাবে আমার তালাক বৈধ হয়েছে। আপনি কোরান শরীফ মুখস্থ করে বসে আছেন। জানেন না কিছুই।

ইদরিস বললেন, জি, কথা সত্য।

ধর্ম নিয়া আপনার কোনো কথাবার্তা বলাই উচিত না। আপনি বিবাহ করেছিলেন এক বেশ্যা মেয়েকে। শুনেছি আপনার যে মেয়ে হয়েছে সে না-কি দিনরাত হিন্দু দেবদেবীর নাম বলে।

ইদরিস বললেন, সে শুধু রাম বলে, আর কিছু না।

রামই বা কেন বলবে? যাই হোক, সেটা আপনার ব্যাপার। এখন বিদায় হন। ধর্ম হাদিস কোরান এইসব নিয়া আর কোনো দিন আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবেন না।

মাওলানা ইদরিস মন খারাপ করে চলে এলেন। মীরার জন্যে তাকে এখন ভালো যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। বান্ধবপুরের বাইরে থেকেও হিন্দু মেয়েরা মীরাকে দিয়ে শাখা সিঁদুর ছোয়াতে আসছে। মীরার ডান পা ড়ুবানো পানি খেলে না-কি অনেক অসুখ সারছে। বিশেষ করে এই পানি শূলবেদনায় অব্যৰ্থ। ভক্তজনের কাছে মীরার পা ভেজানো পানি বিতরণ করার দায়িত্ব শ্ৰীনাথ নিজের কাঁধে নিয়েছেন। এই পানি খাবার নিয়মও আছে। পূর্ণিমা এবং অমাবশ্যার রাত ছাড়া খাওয়া যাবে না। পানি খাবার পর আর কোনো খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না। এইসব নিয়মকানুন তিনি না-কি স্বপ্নে পেয়েছেন। স্বপ্লে সাদা কাপড়ে সমস্ত শরীর এবং মুখ ঢাকা এক মহিলা এসে বলেছেন, শ্ৰীনাথ, তুই আমার সেবায়েত। কেউ যদি পা ভেজানো পানি চায় তুই দিবি এবং রোজ একবার আমার কানে শাখের শব্দ শুনাবি। শ্ৰীনাথ কিছুদিন হলো শাখ বাজাতে শুরু করেছেন। যখন তখন বাড়িতে শাখ বেজে উঠছে।

 

সন্ধ্যা মিলিয়েছে। লাবুস পুকুরঘাটে বসে আছে। আজ হঠাৎ শীত পড়েছে। উত্তরী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এই হাওয়ার স্থানীয় নাম পাগলা হাওয়া। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে গারো পাহাড় ডিঙিয়ে এই হাওয়া এসে শীত নামায়। কিছু সময়ের জন্যে মনে হয় শীতকাল। প্রকৃতি ভ্ৰান্তি তৈরি করে। লাবুস বসে আছে খালি গায়ে। অসময়ের শীত গায়ে লাগাতে তার ভালো লাগছে। লাবুসের সামনে হুঙ্কা। হুঙ্কায় তামাক পুড়ছে। লাবুস তামাক খায় না। হাদিস উদ্দিন তারপরেও নিয়ম করে হুক্কা জ্বলিয়ে লাবুসের সামনে রাখছে। হাদিস উদিনের ধারণা কোনো একদিন মনের ভুলে ছোটকর্তা হুক্কার নিলে টান দিয়ে বসবেন। আস্তে আস্তে অভ্যাস ধরে যাবে।

তার ওস্তাদ দরবার মিয়া আয়েশ করে তামাক খেতেন। গভীর রাতে হুঙ্কা টানার গুড়ুক গুড়ুক শব্দ শোনা যেত। সেই শব্দ আধো-ঘুম আধো-জাগরণে শোনার আনন্দই আলাদা। হাদিস উদ্দিন ছোটকর্তার কাছ থেকেও এটা আশা করে।

লাবুসের পাশের সিঁড়িতে শ্ৰীনাথ এসে বসলেন। হঠাৎ শীত নামায় তিনি কাবু হয়ে পড়েছেন। চাদর গায়ে দিয়েছেন। কানঢাকা টুপি পরেছেন। তারপরেও শীত যাচ্ছে না।

লাবুস বলল, কিছু বলবেন?

শ্ৰীনাথ বললেন, একটা বিষয়ে আপনার অনুমতি নিতে এসেছি। সকলের স্বার্থে আপনি আশা করি অনুমতি দিবেন। আমি একটা মন্দির দিতে চাই।

কী দিতে চান?

মন্দির। মন্দিরের নাম মীরা মায়ের মন্দির।

ও আচ্ছা।

এই মন্দিরে কোনো মূর্তি থাকবে না। মীরা মায়ের ছবি থাকবে।

ও আচ্ছা।

আপনি কি অনুমতি দিয়েছেন? আপনি অনুমতি না দিলেও মন্দির আমাকে দিতেই হবে। আমি মায়ের আদেশ পেয়েছি। মা স্বপ্নে দেখা দিয়ে আমাকে বলেছেন, আমি হেথায় হোথায় ঘুরে বেড়াই, আমার ভালো লাগে না। তুই আমার থাকার একটা জায়গা করে দে।

আপনি সত্যি স্বপ্নে দেখেছেন?

অবশ্যই। যদি মিথ্যা বলে থাকি যেন আমার শরীরে কুণ্ঠ হয়। সারা অঙ্গ গলে গলে পড়ে।

লাবুস বলল, মিথ্যা আপনি বলেন নাই। সত্যি বলেছেন। এরকম স্বপ্ন আপনি দেখেছেন। মানুষ যা চিন্তা করে স্বপ্নে তাই আসে। স্বপ্নের কোনো মূল্য নাই। আমি আমার এখানে আপনাকে মন্দির বানাতে দিব না। মীরাকে নিয়ে যে ঝামেলা আপনি করছেন সেই ঝামেলাও আপনাকে আর করতে দিব না। মীরা আমার বোন। সৎ বোন। আমার যিনি মা, মীরারও তিনি মা। আপনি জানেন না?

জানি।

লাবুস হঠাৎ খানিকটা উৎসাহিত হয়ে বলল, মন্দির আমি বানাতে না দিলেও আপনি কিন্তু মন্দির বানাবেন। বড় মন্দির, পাকা দালান। মন্দির বানানোর টাকা আপনি কোথায় পাবেন আমি জানি না। তবে বানাবেন।

শ্ৰীনাথ বললেন, কীভাবে জানলেন?

আমি মাঝে মাঝে ভবিষ্যতের কিছু জিনিস চোখের সামনে দেখি। কীভাবে দেখি জানি না, কিন্তু দেখি। আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না। এখন যান।

শ্ৰীনাথ বললেন, মন্দির কবে নাগাদ বানাব?

লাবুস বলল, দিন-তারিখ বলতে পারব না। আমি ঘটনা দেখি। দিন-তারিখ দেখি না।

শ্ৰীনাথ ইতস্তত করে বললেন, অন্য একটা বিষয়ে আপনাকে কি একটা প্রশ্ন করব?

করুন।

আপনাদের ধর্মে হিল্লা বিবাহ বলে একটা ব্যাপার আছে। সেই বিবাহ কি শুধু মুসলমানের সঙ্গে হতে হবে? অন্য কোনো ধর্মের পুরুষের সঙ্গে হবে না?

লাবুস বলল, আমি জানি না। নিয়ম থাকলে আপনি কি রাজি হতেন?

শ্ৰীনাথ জিভে কামড় দিয়ে বললেন, রাম রাম! এটা কী বললেন?

লাবুস বলল, আপনার মনে গোপন ইচ্ছা আছে বলেই বললাম। গোপন ইচ্ছা না থাকলে এরকম প্রশ্ন করতেন না। পুরুষমাত্রই লোভী। এখন আপনি আমার সামনে থেকে যান। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

আপনি কি আমার উপর বিরক্ত হয়েছেন?

না। আমি কারো উপর বিরক্ত হই না।

 

ইমাম করিম খেতে বসেছেন। তাকে খাবার দেয়া হয়েছে উঠানে। দরজার পাশে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শরিফা তদারকি করছে। ইমাম ডাকলেন, শরিফা।

শরিফা হাতের পাখা দিয়ে দরজায় বাড়ি দিল। এর অর্থ সে শুনছে। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ। তবে আকারে ইঙ্গিতে প্রশ্নের জবাব দেয়া যায়। এতে দোষ হয় না।

করিম বললেন, আজ তোমার হিল্লা বিবাহের কথা প্রকাশ্যে বলেছি। মনে হয় অতি দ্রুত ব্যবস্থা হবে। এরপর আগের মতো সংসার করতে পারব। তোমার জন্যে সারাক্ষণ আমার মন কান্দে। তোমারে যে এতটা পছন্দ করতাম আগে বুঝি নাই। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করেছ? ক্ষমা করলে পাখা দিয়া দুটা বাড়ি দেও।

শরিফা দুটা বাড়ি না, সে ঠক ঠক করে ক্রমাগত বাড়ি দিয়েই যেতে লাগল। এর অর্থ কী করিম বুঝতে পারছে না। শরিফাকে দেখতে পেলে করিমের ভালো লাগত। শরিফার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।

করিম বললেন, শরিফা কী বলতে চাও বুঝি না তো। মুখে কথা বলো। অসুবিধা নাই।

শরিফা চাপা গলায় বলল, আমি হিল্লা বিবাহ করব না।

চাও কী তুমি?

আপনারে নিয়া দূরদেশে পালায়া যাব। যেখানে কেউ আমারে চিনব না। আমি যে আপনের তালাকি বউ কেউ জানব না।

কোন দূরদেশে যাইতে চাও?

আসাম।

করিম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আসামে গেলে কেউ জানিব না তা ঠিক আছে। কিন্তু আল্লাহপাক তো জানবেন। না-কি তোমার ধারণা উনিও জানবেন না।

শরিফা চুপ করে গেল। করিম অনেক রাত পর্যন্ত তার ফোঁপানো শুনল।

সকল অধ্যায়

১. ০১. সময় ১৯০৫
২. ০২. গ্রামের নাম বান্ধবপুর
৩. ০৩. ধনু শেখের লঞ্চ
৪. ০৪. কার্তিক মাসের শেষ
৫. ০৫. রঙিলা নটিবাড়ি
৬. ০৬. উকিল মুনসি
৭. ০৭. বান্ধবপুরের পশ্চিমে মাধাই খাল
৮. ০৮. শশী মাস্টার
৯. ০৯. বান্ধবপুর গ্রামের নৌকাঘাটায়
১০. ১০. মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসি
১১. ১১. চৈত্র মাসের শেষ দিকের কথা
১২. ১২. বিপ্লবী জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়
১৩. ১৩. ইদুল ফিতরের নামাজ শেষ হয়েছে
১৪. ১৪. বঙ্গবাসী কাগজের শিরোনাম
১৫. ১৫. যমুনা বেতঝোঁপের উপর
১৬. ১৬. ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে
১৭. ১৭. মধ্যাহ্ন – দ্বিতীয় খণ্ড
১৮. ১৮. বান্ধবপুর বাজার
১৯. ১৯. বৈশাখের শুরু
২০. ২০. প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে
২১. ২১. শিবশংকরের শরীর
২২. ২২. ৩০ জুলাই ১৯৪১ সন
২৩. ২৩. ধনু শেখ পালকি নিয়ে পাখি শিকারে
২৪. ২৪. মাওলানা ইদরিস মহাবিপদে পড়েছেন
২৫. ২৫. এককড়ি ভোরবেলার কনকনে ঠান্ডায়
২৬. ২৬. জুলেখা কলিকাতা বেতার ভবনে
২৭. ২৭. বার্লিন আর্মি হেড কোয়ার্টার
২৮. ২৮. নমশুদ্ৰ পাড়া
২৯. ২৯. আষাঢ় মাসের ঝড়বৃষ্টি
৩০. ৩০. এককড়ির মন্দিরের চূড়া
৩১. ৩১. ১৯৪৫ সনের এপ্রিল মাস
৩২. ৩২. জায়গার নাম মালাবার হিল
৩৩. ৩৩. এমএল আড়িয়াল খাঁ লঞ্চ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন