২৯. আষাঢ় মাসের ঝড়বৃষ্টি

হুমায়ূন আহমেদ

আষাঢ় মাসের ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাওলানা ইদরিস গ্রামে ফিরছেন। তাঁর মন বিষণ্ণ। বাড়ি ফেরার আনন্দ পাচ্ছেন না। যে কাজে বের হয়েছিলেন তা শেষ করতে পারেন নি। শশাংক পালের মেয়ে ললিতার খোঁজ বের করতে পারেন নি। যমুনা তাঁকে বগুড়া যেতে দেয় নি, তবে নিজে লোক পাঠিয়েছিল। সেই লোক বিফল হয়ে ফিরেছে।

ইদরিস লঞ্চঘাটায় নেমে হাঁটতে শুরু করেছেন। বৃষ্টি পড়ছে বলেই তাকে কেউ সেভাবে লক্ষ করছে না। তিনি তাতে খুব স্বস্তি বোধ করছেন। সারাজীবন পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি পরেছেন। আজ তার পরনে হাফ হাতা, সাইড পকেটওয়ালা নীল রঙের সার্ট। কালো প্যান্ট। যমুনা তাকে একজোড়া চামড়ার কাবলি স্যান্ডেল কিনে দিয়েছে। কাদার মধ্যে বারবার স্যান্ডেল আটকে যাচ্ছে।

ইদরিসের মাথায় কংগ্রেসি টুপি। যমুনার স্বামী সুরেন এই টুপি তাকে পরিয়ে দিয়েছে। টুপির রঙ কটকট হলুদ। একজন আগ্রহ করে নিজে মাথায় পরিয়ে দিয়েছে বলে খুলতেও পারছেন না। মাথার টুপি হবে সাদা কিংবা কালো। ইদরিসের হাতে গান্ধিজির লাঠির মতো একটা লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে খানিকটা কুঁজো হয়ে তিনি লাবুসের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। অনেক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কেউ তাকে চিনতে পারে নি।

মীরা পুকুরঘাটে খেলছিল। পুকুরঘাটে আসা তার নিষেধ। আজ বাড়িতে কেউ নেই বলে সে চলে এসেছে। কয়লা দিয়ে ঘর কেটে এক্কাদোক্কা খেলছে। এই খেলাটা একটু অন্যরকম। চাড়া ফেলার সময় সুর করে ছড়া পড়তে হয়—

আমি সতী ভাগ্যবতী
আমি যাব স্বামীর বাড়ি
আমার স্বামীর নাই ঘর
আমারে নিয়া রওনা কর।

‘আমারে নিয়া রওনা কর’ বলেই চোখ বন্ধ করে উল্টোদিক ফিরে চাড়া ফেলতে হয়। মীরা তাই করল। তার অনুমানে ভুল হলো। চাড়া গিয়ে পড়ল পুকুরে। চাড়াটা পানিতে ভাসছে। মীরা একধাপ পানিতে নামলেই চাড়া হাতে পাবে। সে সাবধানে একধাপ নিচে নামল। পানিতে ঢেউ ওঠায় চাড়া সামান্য সরে গেছে। তাকে আরো একধাপ নামতে হবে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। চাড়াটা তার পছন্দের। মীরা যখন ঠিক করল সে আরো একধাপ নামবে তখনি মাওলানা ইদরিস কাদায় মাখামাখি হওয়া পা ধুতে পুকুরঘাটে এলেন। মীরা তার দিকে তাকিয়ে টনটনে পরিষ্কার গলায় বলল, বাবা, তোমার দাড়ি গেল কই?

মেয়ে রাম বলছে না। টর টর করে পরিষ্কার কথা বলছে। ইদরিসকে হতভম্ব করে মীরা বলল, বাবা, তোমার হাতের লাঠি কি সাপমারা লাঠি? বাড়িতে হাদিস চাচা একটা সাপ মেরেছে, এক হাজার হাত লম্বা।

মাওলানা মেয়ের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। শিয়ালদা রেলষ্টেশনে যখন পড়ে ছিলেন তখন এই মেয়ের সঙ্গে যে আবার দেখা হবে তিনি কল্পনাও করেন নি। একসময় আল্লাহপাককে ডেকে বলেওছিলেন, হে গাফুরুর রহিম! মেয়েটাকে তোমার হাতে সোপর্দ করলাম।

মীরা বলল, বাবা, কাঁদো কেন?

ইদরিস জবাব না দিয়ে পুকুরঘাটে শোকরানা নামাজ পড়ার জন্যে অজু করতে বসলেন। আল্লাহপাকের কাছে সামান্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। যদিও বান্দার কৃতজ্ঞতায় বা অকৃতজ্ঞতায় তাঁর কিছুই যায় আসে না।

মীরা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছে। মাঝে মাঝে চাড়াটার দিকে তাকাচ্ছে। চাড়াটা বাতাস পেয়ে এখন তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাকে মনে হয়। আরেক ধাপ নিচে নামতে হবে না।

নামাজ শেষ করেই মাওলানা কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে কাগজ এবং কয়লা বের করলেন। বৃষ্টি থেমে গেছে। পুকুরঘাটেই এখন কাক আঁকা যাবে। মেয়েটাকে মুগ্ধ করতে হবে।

মীরা চোখ বড় বড় করে বাবার কাণ্ড দেখছে।

কী কর বাবা?

তাকায়া থাক। দেখ কী করি।

চিঠি লেখা?

হুঁ।

কারে চিঠি লেখা?

ইদরিসের কাক আঁকা শেষ হয়েছে। তিনি কাগজটা মেয়ের সামনে ধরলেন। মীরা চিৎকার দিয়ে বলল, ও আল্লা, কাউয়া!

মাওলানা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ‘কাউয়া’ আঁকলেন। মীরার আনন্দের সীমা রইল না। একসময় সে বলল, বাবা, কাউয়া ছাড়া তুমি আর কিছু আঁকা জানো না?

না। একটাই আঁকতে শিখেছি।

কে তোমারে শিখায়েছে? আল্লাহ।

ঠিকই ধরেছ। উনিই শিখায়েছেন, তবে অন্যের মাধ্যমে।

মাধ্যম কী?

মাওলানা বিপদে পড়লেন। মাধ্যম মেয়েকে বুঝবেন কীভাবে? এত কথা সে কীভাবে বলে এটাও রহস্য।

বাবা, আরো কাউয়া বানাও।

মাওলানা মেয়ের আনন্দ দেখে অভিভূত হলেন। তিনি মনে মনে বললেন, আল্লাহপাক, তুমি আনন্দ তৈরির কারিগর। আমার মেয়েটার মনে তুমি যে আনন্দ তৈরি করেছি। তার জন্যে তোমার পাক দরবারে শুকরিয়া।

 

মাওলানা ইদরিসের মতো আরেকজন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরেই হাতজোড় করে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মূর্তির সামনে বসে আছেন। তিনি বিড়বিড় করে বলছেন, ঠাকুর, আমার পুত্ৰ এখন সর্ব রোগব্যাধি থেকে মুক্ত। ঠাকুর, এই কাজ হরিচরণের মাধ্যমে তোমারই করা। আমার আনন্দের সীমা নাই।

তিনি ঠাকুরকে ফুল নিবেদন করলেন। তারপর শিবশংকরকে ডেকে পাঠালেন।

বাবা, তোমার শরীর কেমন?

শরীর ভালো।

সব সময় খেয়াল রাখবে ঋষি হরিচরণ তোমার দিকে লক্ষ রাখছেন। উনার নির্দেশমতো কাজ করায় আজ তুমি নীরোগ।

শিবশংকর বলল, স্বপ্ন কোনো বিষয় না। বাবা। মানুষ যা ভাবে তাই স্বপ্ন দেখে। সারাক্ষণ তোমার মাথায় ঋষি হরিচরণ থাকে বলে তুমি উনাকে স্বপ্নে দেখ।

মূর্থের মতো অন্যায় কথা বলেছ। ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চাও।

শিবশংকর বলল, আমি ঠাকুরদেবতা মানি না বাবা। আমি স্বামী বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য। আমি স্বামীজির মতো নাস্তিক।

বিবেকানন্দ নাস্তিক?

হুঁ। উনি বলেছেন, ‘যে ঈশ্বর ক্ষুধায় পৃথিবীর মানুষকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি পরকালে আমাদের পরম সুখে রাখিবেন ইহা আমি বিশ্বাস করি না।’

মনিশংকর হতভম্ব গলায় বললেন, স্বামীজি এই কথা বলেছেন? ভগবান রামকৃষ্ণের একনম্বর ভক্ত এই কথা বলেছেন?

শিবশংকর বলল, বইয়ে লেখা আছে। আমার কাছে বই আছে, দেখাব?

না, দেখাতে হবে না। আমি আগামী দুইদিন তোমার মুখ দৰ্শন করব না।

পুত্রের পাপের ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে মনিশংকর ঠিক করলেন, আগামী দুই দিন তিনি নিরন্তু উপবাস করবেন। ঠাকুরঘর থেকে বের হবেন না। একমনে জপ করবেন–

পুত্ৰকে ক্ষমা কর ঠাকুর।
অবোধকে ক্ষমা কর।
নির্বোধকে ক্ষমা কর।
মূর্খকে ক্ষমা কর।

 

এককড়ি তাঁর নিজস্ব ঠাকুরঘরে বসে আছেন। সম্পূর্ণ নিজের আলাদা ঠাকুর থাকার আনন্দ এখন বোধ করছেন। তাঁর নিজের ঠাকুর এখন তাকেই দেখবেন, অন্যকে না।

আজ এককড়ির মন কিছুটা বিক্ষিপ্ত। শ্ৰীনাথের কারণে বিক্ষিপ্ত। সে না-কি নমস্তদ্বদের সাথে মারামারি করে এসেছে। কাজটা ভুল হয়েছে। ছোটজাতকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে হয়। ছোটজাতকে কখনো খেপিয়ে তুলতে নেই। এরা থাকে। দলবদ্ধ। সব একসঙ্গে হলে বিরাট ঝামেলা করতে পারে। তার চালের গুদাম লুট করতে পারে। আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। কিছুদিন আগে বাজারের দোকানে আগুন লাগল। এই আগুনের পেছনে নমশুদ্রের দল থাকতে পারে। ছোটলোকরা ধনবানদের দেখতে পারে না।

বান্ধবপুরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা যেটা হয়েছে তার পেছনে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ আছে, এটা তার মনে হয় না। ঠিকমতো তদন্ত হলে সব বের হতো। তদন্ত ঠিকমতো হচ্ছে না। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ ময়মনসিংহ সদর থেকে এসপি সাহেব আসেন নাই। ইংরেজ এসপি এসে একটু হস্থিতম্বি করলে থলের বিড়াল বের হয়ে যেত। এসেছে কে? ঘোড়ায় চড়ে কেন্দুয়া থানার ওসি। ওসি মুসলমান। নাম হায়দার। এককড়ির উঠানে বসে ডাব খেতে খেতে বলেছেন, এককড়ি বাবু, মসজিদটা পুড়ায়ে দিয়ে ভালো করেন নাই।

হতভম্ব এককড়ি বললেন, মসজিদ পুড়ায়ে দিয়েছি, এটা কী বললেন?

ওসি সাহেব বললেন, মসজিদের ঈমাম সাহেব মারা গিয়েছেন, সেটা বড় কথা না। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় মানুষ মরবেই। কিন্তু মসজিদ- ধর্মস্থান পুড়য়ে দেয়া বিরাট গৰ্হিত কাজ হয়েছে। হিসাবে ভুল করেছেন।

এককড়ি হতাশ গলায় বললেন, আমি কী ভুল করলাম! মসজিদ আমি জ্বালায়ে দিব কোন দুঃখে?

দারোগা সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে গোফে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আমাদের কাছে খবর আছে। থানাওয়ালাদের খুশি করার ব্যবস্থা করেন, দেখি কী করা যায়। আপনি ব্যবসায়ী মানুষ হয়ে হিসাবে কীভাবে ভুল করলেন বুঝলাম না।

এককড়ি থানাওয়ালাদের খুশি করার জন্যে পাঁচশ’ টাকা দিলেন।

দারোগা সাহেব চোখ কপালে তুলে বললেন, এই টাকা তো এসপি সাহেবকেই পাঠায়ে দিতে হবে। লালমুখ ইংরেজ সাহেব। পাঁচশ’ টাকা হাজার টাকা ছাড়া তাদের সামনেই যাওয়া যায় না।

এককড়ি আরো পাঁচশ’ দিলেন।

ঘটনা এইখানেই শেষ হবে বলে এককড়ির মনে হচ্ছে না। থানাওয়ালারা র্তীতের মাকুর মতো আসা-যাওয়া করতেই থাকবে। প্রতিবারই তাদের খুশি করতে হবে।

এককড়ি হাতজোড় অবস্থায় চোখ বন্ধ করে আছেন। মন কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছেন। রাধাকৃষ্ণকে একমনে কিছুক্ষণ ডাকতে হবে। প্রথমে শ্ৰীকৃষ্ণ স্তব, তারপর শ্ৰীরাধিকা স্তব পাঠ করতে হবে। অবিনাশ ঠাকুর দুটি স্তবই লিখে দিয়ে গেছেন। শ্ৰীকৃষ্ণের স্তব মুখস্থ হয়েছে। শ্ৰীরাধিকারটা এখনো হয় নি। এককড়ি স্তব শুরু করলেন–

রক্ষ রক্ষ হরে মাং চ নিমগ্নং কামসাগরে
দুষ্কীৰ্ত্তিজল পূর্ণে চ দুষ্পারে বহু সংকটে
ভক্তি বিস্মৃতি বীজে চ বিপৎ সোপানদুস্তরে
অতীব নির্মল জ্ঞান চক্ষুঃ প্রচ্ছন্নকারিনে…

খুট করে শব্দ হলো। এককড়ির ধ্যান ভঙ্গ হলো। শ্ৰীনাথ দরজা খুলে ঢুকেছে। এককড়ি বললেন, ধ্যানে যখন থাকি হুটহাট শব্দ করা, এটা কেমন কথা!

শ্ৰীনাথ বলল, আপনি ধ্যানে আছেন বুঝব ক্যামনে? দরজা বন্ধ। তারচে’ বড় কথা, সামান্য শব্দে যে ধ্যান ভাঙে সেই ধ্যান কোনো ধ্যানের মধ্যেই পড়ে না।

এককড়ি বললেন, তুমি অতিরিক্ত মাতব্বর হয়ে গেছ শ্ৰীনাথ। তালেবারের মতো কথা বলা শুরু করেছ। শুনেছি। তুমি নামশূদ্রর সাথে মারামারি করেছ।

শ্ৰীনাথ বলল, নরেশ আমারে অপমান করেছিল, আমি তারে দুই চারটা থাপ্নড় দিয়েছি। এটা কোনো বিষয় না। শ্ৰীরামচন্দ্র কী করেছিলেন শুনেন- শম্বুক নামের এক শূদ্র ‘রাম রাম’ বলে উঠল। শূদ্রের মুখে রামনাম নিষিদ্ধ। কাজেই শ্রীরাম চন্দ্র নিজের হাতে শম্বুককে হত্যা করলেন।

এককড়ি বললেন, তুমি কি রামচন্দ্র? তুমি রামচন্দ্র না। তুমি শ্ৰীনাথ। বিরাট চোর।

চোরা?

অবশ্যই চোর। তুমি লাবুসের বাড়ি থেকে কৃষ্ণমূর্তি চুরি কর নাই?

করেছি। আপনার জন্যে করেছি। নিজের জন্যে করি নাই।

এককড়ি বললেন, আমার মন বলতেছে- নানান দুষ্কর্ম তুমি ভবিষ্যতে করবা এবং পরে বলবা— কাজটা আপনার জন্যে করেছি। কাজেই তুমি বিদায়।

কী বললেন?

বললাম, বিদায়। আজ থেকে তুমি আমার সঙ্গে নাই।

আমি যাব কই? খাব কী?

তুমি রামচন্দ্ররে ডাক। উনি ব্যবস্থা করে দিবেন। এখন সামনে থেকে যাও। এককড়ি ধ্যানে মন দিলেন—

হে নাথ করুণাসিন্ধু
দীনবন্ধু কৃপাং করো
ত্বং মহেশ মহাজাতা
দুঃস্বপ্নং মাং ন দর্শয়।।

 

শ্ৰীনাথ ধনু শেখের কাছে গিয়েছে। ধনু শেখ লঞ্চের জন্যে নতুন টিকেট বাবু নেবেন। কাজটা যদি পাওয়া যায়।

ধনু শেখ বললেন, অবশ্যই তোমারে চাকরি দিব। লঞ্চের টিকেট বাবুর জন্যে চতুর লোক লাগে। তোমার মতো চতুর তো সচরাচর পাওয়া যায় না। গরু-ছাগল পাওয়া যায়। নির্বোধি পাওয়া যায়। চতুর পাওয়া যায় না।

শ্ৰীনাথ বিড়বিড় করে বলল, বিরাট কষ্টে আছি। বলতে পারেন না খায়া আছি।

এককড়ি বললেন, না খায়া কেন থাকবা? লাবুসের লিঙ্গরখানা আছে না? সেখানে ভর্তি হয়ে যাও। একবেলা ভরপেট খিচুড়ি।

শ্ৰীনাথ বলল, সেটা সম্ভব না। একটা চাকরি দেন— আমি বাকি জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব।

বলেছি তো চাকরি দিব। একটা শর্ত আছে। কঠিন কিছু না।

শ্ৰীনাথ বলল, যে শর্ত দেন সেটাই মানব।

ধনু শেখ বললেন, আমি ঠিক করেছি। স্বজাতি ছাড়া চাকরি দিব না। মুসলমান হয়ে যাবে। জটিল কিছু না। তিনবার কলিমা পড়লেই হবে।

শ্ৰীনাথ হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে। এখন মনে হচ্ছে, এই আধাপাগল মানুষটার কাছে আসাই ভুল হয়েছে।

ধনু শেখ পান মুখে দিতে দিতে বললেন, কলিমা পড়ার পর তোমার ‘ধন’ কাটা হবে। সামান্য রক্তপাত, তবে অনেকের ‘ধন’ জন্ম থেকে কাটা থাকে। তাদের কাটা লাগে না।

শ্ৰীনাথ বলল, এইগুলা কী বলতেছেন?

ধনু শেখ বললেন, ধুতি খুলে তোমার ধনটা আমারে দেখাও। আমি দেখলেই বলতে পারব তোমার কাটা লাগবে কি-না।

শ্ৰীনাথ দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ধনু শেখ মনের আনন্দে অনেকক্ষণ হাসলেন। একটা বয়সের পর সহজে আনন্দ পাওয়া যায় না। আনন্দ খুঁজে খুঁজে নিতে হয়। জগতে আনন্দই সত্য। আর সব মিথ্যা।

তিনি গোপনে একটা আন্দোলন শুরু করেছেন। এই আন্দোলনের নাম ‘বান্ধবপুর ছাড়’। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ছোটটা। কায়দা করে এই অঞ্চল থেকে হিন্দু দূর করা। দেশ ভাগাভাগি হবে বোঝাই যাচ্ছে। বান্ধবপুর হবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল।

ধনু শেখের মনে হচ্ছে গান্ধিজি যেমন জেল থেকে ছাড়া পেয়েই নিজগ্রামে ফিরে গেছেন, ঠিক সেরকম আরেক গান্ধিও বান্ধবপুরে এসেছে। তার নাম মাওলানা ইদরিস। চুল দাড়ি ফেলে হাতে লাঠি নিয়ে উপস্থিত! হাঁটছেও কুজো হয়ে। দিনরাত নাকি কাকের ছবি আঁকছে। কলিকাতা থেকে এই বিদ্যা নিয়ে এসেছে।

সদরুল।

কর্তা বলেন।

ঝিমায়া বইসা আছ কেন? কিছু কর।

কী করতে বলেন?

সব আমাকে বলা লাগবে কেন? বুদ্ধি খাটায়া কিছু বের কর।

সদরুল বুদ্ধি খাঁটিয়ে কিছু বৈর করতে পারছে না। ধনু শেখ কী চাচ্ছেন বুঝতে পারছে না। গুরুত্বপূর্ণ কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে হতো। সে কারো সঙ্গে আলাপও করতে পারছে না। একবার ভোবল লাবুসের সঙ্গে আলাপ করবে। লাবুস মানুষটা শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ তা-না। ভালোমানুষও। ভালোমানুষের চিন্তা হবে ভালোমানুষের মতো। সেই চিন্তা কি ধনু শেখের পছন্দ হবে?

 

শিবশংকর লঙ্গরখানা নিয়ে কঠিন পরিশ্রম করছে। জঙ্গল থেকে রান্নার খড়ি আনার মতো কাজও করছে। লাবুস তাকে বাধা দিচ্ছে না। মনিশংকর বলে দিয়েছেন, ছেলে যা করতে চায়। তাই যেন তাকে করতে দেয়া হয়। আমার ছেলের কোনো একটা বড় সমস্যা হয়েছে। কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকলে যদি সেই সমস্যাটা কাটে।

বাড়ির সামনে খুঁটি পুতে রাখার বিষয়েও তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলেছেন। ছেলে উত্তর দিয়েছে, সেই উত্তরের কোনোই অর্থ হয় না।

বাবা, খুঁটি কেন পুঁতে রাখ? আমাকে বলতে যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে বলো।

আমাকে একজন পুতিতে বলেছে।

সে তোমার পরিচিত?

হুঁ।

হিন্দু না মুসলমান?

বাবা, আমার ধর্মে বিশ্বাস নাই। আমি হিন্দু-মুসলমান আলাদা করি না।

যে তোমাকে খুঁটি পুঁতিতে বলেছে সে ছেলে না মেয়ে?

তোমার পরিচিত কেউ?

হ্যাঁ।

জীবিত না মৃত?

বাবা সে মৃত।

এটা কি ভৌতিক কোনো ব্যাপার?

জানি না।

মনিশংকর হরিদ্বার থেকে রক্ষাকবচ এনে ছেলেকে পরিয়েছিলেন। একদিন দেখেন সেই রক্ষাকবচ খুঁটির মাথায় লাগানো। মনিশংকর ছেলেকে ডেকে বললেন, কাজটা কেন করেছ?

শিবশংকর বলল, কবচে আমার বিশ্বাস নাই।

কিসে তোমার বিশ্বাস?

কিসে বিশ্বাস সেটা আমি জানি। কিন্তু আপনাকে বলব না।

কেন বলবে না?

কারণ আপনি বুঝতে পারবেন না।

মনিশংকর ঠিক করেছেন ছেলেকে বান্ধবপুর থেকে কোলকাতা নিয়ে যাবেন। জাপানিরা বোমা ফেললে ফেলবে। কী আর করা। বোমার চেয়েও জরুরি ছেলের চিকিৎসা। ছেলেকে বড় বড় ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করতে হবে। তিনি এই মুহূর্তে কাজটা করছেন না, কারণ খুঁটি পুতার সমস্যা ছাড়া ছেলে ভালো আছে। বিপুল উৎসাহে লঙ্গরখানার কাজ করে যাচ্ছে। ইমাম করিমের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। কাজকর্মের ফাঁকে দু’জনে নানান কথা বলে।

করিম তার মনের অতি গোপন পরিকল্পনার কথাও শিবশংকরকে বলেছে। তার পরামর্শ চেয়েছে।

করিম ফিসফিস করে বলেছে, তিনজন মানুষকে খুন করা ফরজ হয়ে গেছে। বুঝেছি, ফরজ হয়ে গেছে।

শিবশংকর বলল, ফরজ কী?

করিম বলল, ফরজ হলো অবশ্য কর্তব্য। তিনজনের মধ্যে একজন হলো ধনু শেখ।

বাকি দু’জনের নাম বলবেন না?

না। দেখি তুমি অনুমান করে বার করতে পার কি না।

তারা কি পুরুষ?

একজন পুরুষ। আরেকজন মহিলা।

তাদের বয়স কত?

ইমাম বলল, থাক বেশি চিন্তার দরকার নাই। আমি নাম বলতেছি। গোপন রাখবা। পুরুষের নাম লাবুস।

লাবুস?

হুঁ। আর মেয়েটার নাম আতর।

আতর? সে তো খুব ভালো মেয়ে।

ইমাম অবাক হয়ে বলল, আতরের কারণে আমার স্ত্রী থাকে নটিবাড়িতে। ভালো কীভাবে হয়?

আতরকে কীভাবে খুন করবেন? সে তো বান্ধবপুরে থাকে না। বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়িতে থাকে।

করিম বলল, শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা বের করেছি, সেখানে যাব।

মানুষ খুন করবেন, আপনার পাপ হবে না?

হবে না। আমি পাগল তো— পাগলের পাপ নাই।

আপনার কথাবার্তা তো পাগলের মতো না।

করিম বলল, কথাবার্তা পাগলের মতো না। কিন্তু হাসি পাগলের মতো। এই দেখ আমি হাসব— পাগলের হাসি।

করিম শরীর দুলিয়ে বিকট শব্দে হাসতে লাগল।

শিবশংকর বলল, পাগলের কি ধর্ম আছে?

করিম বলল, না। পাগলের ধর্ম নাই। তার কাছে আল্লাহ ভগবান সব এক।

কিন্তু আপনি তো নামাজ পড়েন। পাঁচ বেলাই পড়েন। তার অর্থ আপনি পুরোপুরি পাগল হন নাই। কিছু বাকি আছে।

কথা খারাপ বলো নাই।

এখন খুন করলে বিরাট পাপ হবে।

তাও ঠিক।

শিবশংকর বলল, পুরাপুরি পাগল হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করেন।

করিম বলল, এছাড়া উপায় কী?

শিবশংকর বলল, আতরের ঠিকানাটা আমাকে দিবেন?

তুমি ঠিকানা দিয়া কী করব?

একটা চিঠি লিখব।

আচ্ছা ঠিকানা দিব, কোনো সমস্যা নাই। ঠিকানা তোমার কাছে থাকাই ভালো। আমি হারায়ে ফেলতে পারি।

শিবশংকর আতরকে চিঠি লিখেছে। চিঠিটা লিখেছে। সংকেতে। তার ধারণা আতর সংকেত ধরতে পারবে। শিবশংকরের চিঠি–

A ১০০১২—দণ্ড—৩২০১—দণ্ড
৮৮৮৯—Pok—৫৫২—০১—N
MAGO TREE. ২১১—০০০
৬১১৯৩৭২ অ—আ—শ

 

আতর তার শ্বশুরবাড়িতে সুখেই আছে। তাদের বাড়িটা টিনের। বেশ বড় বাড়ি। বাড়ির পেছনে পুকুর। এই পুকুর মেয়েদের। মেয়েরাই শুধু সেখানে স্নান করবে, ধোয়া পাকলার কাজ করবে। পুরুষদের সেখানে যাওয়া নিষেধ। পুকুরের পেছনে ঘন বাঁশঝাড়। বাড়ির সামনে বড় উঠান। উঠানে কয়েকটা আমগাছ। একটা আমগাছে দোলনা টানানো। এই দোলনা কবি শাহনেয়াজের জন্যে। মাঝে মাঝে কবি সাহেব দোলনায় দোল খেতে খেতে কবিতা লিখতে পছন্দ করেন। এতে নাকি ছন্দের হিসাব রাখতে সুবিধা হয়।

আতরের দিন শুরু হয় তার শ্বশুর আব্দুল গনির গজগজানি দিয়ে। তিনি পুত্রকে দীর্ঘক্ষণ গালাগালি না করে তার দিন শুরু করতে পারেন না। শাহনেয়াজ বাবার গালাগালি কিছুই শোনে না। কারণ সূর্য ওঠার পর পরই সে ঘুমাতে যায়। তার ঘুম ভাঙে দুপুরে। ঘুম ভাঙার পরপর দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ঘুম। এই ঘুমের নাম ভাত ঘুম। ভাত ঘুম ভাঙে বিকালে। শাহনেয়াজ তখন গোসল সারে, দাঁত মাজে, ইন্ত্রি করা একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে তার দিন শুরু করে।

শাহনেয়াজের বাবা আব্দুল গনি তাঁর দিন শুরু করেছেন। পুত্রকে নিয়ে গজগজানি শুরু হয়েছে- বিদ্বান গাধা এখন ঘুমে। বিদ্যার খেতায় আগুন। এমন বিদ্যার প্রয়োজন নাই। মূর্খ ভালো। টেকা পয়সা খরচ কইরা যে পুলারে বিদ্বান বানায় সে গাধা। তার বাপ গাধা। তার দাদা গাধা। তার চৌদ্দগুষ্ঠি গাধা। তার মাতুল বংশ গাধা। ইত্যাদি।

আতরের শাশুড়ি মোসাম্মত আমিনা বেগম নামাজ কালাম নিয়ে থাকেন। তার হাতে এক হাজার গুটির তসবি। একজন দাসী সৰ্ব্বক্ষণ তাঁর সঙ্গে থাকে এবং তসবির একটা মাথা ধরে থাকে। এই তসবি এক পীরসাহেব তাকে দিয়েছেন।

আমিনা বেগম অবসর সময় বাড়ির পেছনে পুকুরঘাটে বসে থাকেন। তিনি যেখানে সেখানে ভূত দেখেন। ভূতের গল্প বলায় তার আগ্রহ সীমাহীন। শ্রোতা হিসাবে আতরকে পেয়ে তিনি খুশি। তিনি তাঁর ছেলের বউকে ভূতবিষয়ক শিক্ষায় পুরোপুরি শিক্ষিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন। এই দায়িত্ব তিনি আগ্রহ এবং আনন্দের সঙ্গে পালন করছেন।

বৌমা শোন। ভূত পেতনি আর জিন কিন্তু এক না। ভূত পেতনি এক কিসিম, জিন আরেক কিসিম। জিনরার দেশ আছে। রাজত্ব আছে। রাজা আছে। ভূত পোতনির এইসব কিছু নাই। বুঝলা ঘটনা?

জি আম্মা বুঝলাম।

ভূত পেতনি আবার দুই কিসিমের। শুকনার ভূত। এরা গাছে থাকে, মানুষের বাড়িঘরে থাকে। আরেক কিসিন্ম হইল পাইন্যা ভূত। এরা থাকে পানিতে—খালে, বিলে, হাওরে। বুঝলা ঘটনা?

জি আম্মা বুঝলাম। এই বাড়িতে কি ভূত আছে?

অবশ্যই আছে। ভূত ছাড়া কি বাড়ি হয়? তিন চাইরটা আছে, এর মধ্যে একটা বড়ই বজাত— নাম ‘হাম্বর’।

ভূতদের নাম থাকে?

অবশ্যই থাকে।

আম্মা, ‘হাম্বর’ ছেলে না মেয়ে?

ছেলে। সন্ধ্যাবেল বাঁশঝাড়ের কাছে হাম্বর বলে ডাক দিও, দেখবা ঘটনা।

কী ঘটনা?

বাতাস নাই কিছু নাই দেখবা সমানে বাঁশগাছ দুলতাছে।

মোসাম্মত আমিনা বেগম শুধু যে ভূতের গল্প করেন তা না—প্রতি অমাবশ্যায় ভূতদের উদ্দেশে ভোগ দেন। আস্ত গজার মাছ ভেজে বাঁশগাছের নিচে রেখে আসেন। গজার মাছ ভাজা ভূতপ্রেতের অতি পছন্দের খাবার। জিনরা আবার মাছ খায় না। তাদের পছন্দ ছানার মিষ্টি।

একদিন আতর বলল, আম্মা, গজার মাছ ভাজা দেওয়া ঠিক না। মাছ ভাজার লোভে অন্য ভূতরা চলে আসবে। বাড়ি ভর্তি হয়ে যাবে ভূত পোতনিতে।

আমিনা বেগম পুত্রবধুর অজ্ঞতায় খুব মজা পেলেন। তিনি বললেন, এক সীমানার ভূত অন্য সীমানায় যায় না। তাছাড়া হাম্বর আছে। হাম্বর কাউরে ধারে কাছে আসতে দিবে না।

হাম্বরকে কোনোদিন দেখেছেন?

বৌমা, এদের চোখে পরিষ্কার দেখা যায় না। তারপরেও কয়েকবার দেখেছি। খুবই খাটো। পায়ের পাতা অনেক বড়। মুখের কাটা ছোট। পুতি পুতি দাঁত। ইন্দুরের দাঁতের মতো।

আমাকে একদিন দেখাবেন?

আচ্ছা যাও চেষ্টা নিব। দেখতে পাবা কি-না জানি না। সবাই দেখে না।

আমিনা বেগম চেষ্টা নিয়েছেন। সন্ধ্যাবেলা আতরকে বাঁশঝাড়ের কাছে নিয়ে গেছেন— হাম্বরের সঙ্গে আতরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। উঁচু গলায় বলেছেন, ঐ হাম্বর। বিদের বাচ্চা কইরে? বউমারে নিয়া আসছি। ভালো কইরা দেখ। এর সাথে বিজাতি ফাইজলামি করবি না। ভয় দেখাবি না। নজর দিবি না। অন্য কোনো বিদের বাচ্চা যেন নজর না দেয় সেইটাও দেখবি। তুই যে আমার কথা শুনিছস তার প্রমাণ দে। বাঁশঝারে বাকি দে বিদের বাচ্চা।

বাঁশঝাড় সত্যি সত্যি দুলে উঠল। আতর ভয়ে তার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরল। আমিনা বেগম বড়ই তৃপ্তি লাভ করলেন। কেউ ভূতের ভয়ে অস্থির হলে তিনি খুব আনন্দ পান। তার মনে হলো— ভালো বৌ পেয়েছেন। মাশাল্লাহ!

অল্প কিছু দিনেই আতর বুঝে ফেলেছে তার স্বামী একজন ব্যর্থ মানুষ। সে যে ব্যর্থতা নিজে জানে না। ব্যর্থ মানুষরা ক্ষতিকর হয়, এই লোকটা তা না। সে বাস করে প্রবল ঘোরে। এই ঘোর কোনোদিন কাটবে তাও মনে হয় না।

শাহনেয়াজের বর্তমান কর্মকাণ্ড দুই ভাগে ভাগ করা। কাব্যচর্চা এবং মূর্খ স্ত্রীকে শিক্ষিত করা। আতরকে প্রতিদিন গল্প-উপন্যাস পড়তে হচ্ছে। শুধু পড়াতেই শেষ না, মৌখিক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।

যে উপন্যাস পড়ে শেষ করেছ, তার নাম কী?

নৌকাড়ুবি।

কে লিখেছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

নায়কের নাম কী?

রমেশ।

নায়িকার নাম কী?

সুশীলা।

পার্শ্বচরিত্রের নাম কী?

আতর বলল, পার্শ্বচরিত্র কী জিনিস?

শাহনেয়াজ বলল, যে নায়ক নায়িকা না, তবে তাদের আশেপাশের কেউ।

জানি না।

উপন্যাসটা তোমাকে আবার পড়তে হবে। কাগজ-কলম নিয়ে বসবে। যখনই কোনো নাম আসবে নাম লিখে ফেলবে।

আতর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

আতরকে তার স্বামীর কিছু কবিতাও মুখস্থ করতে দেয়া হয়েছে। একটি কবিতার নাম ‘চাতকের অশ্রু’।

চাতকের অশ্রু

নিশি পথের পেয়েছি নিমন্ত্রণ
শুনেছি ক্ৰন্দন।
ব্যথিত চাতক কাঁদে দুলে উঠে বন।
উড়ে যায় পক্ষীগণ।
বহে বায়ু উত্তরী, শন শন শন।
উচাটন হয়েছে তাহদের মন।
হইতেছে দুঃখের শোণিত ক্ষরণ।

কবিতা মুখস্থ করা ছাড়াও আতরকে যে কাজটি করতে হচ্ছে তা হলো সেজেগুজে কবির সামনে দীর্ঘ সময় বসে থাকা। কারণ কবি প্রচুর প্রেমের কবিতা লেখেন। সেই সময় ‘প্রেরণাদাত্রী’ লাগে। বসে থাকার সময় হাসা যাবে না। নড়াচড়াও করা যাবে না। এতে কবির মনসংযোগে সমস্যা হয়।

আতর শিবশংকরের চিঠি পেয়েছে। চিঠির অর্থ, কে এই চিঠি পাঠিয়েছে, সে কিছুই বুঝতে পারে নি। সে চিঠি তার স্বামীকে দেখিয়েছে। তার বিদ্বান স্বামী চিঠির অর্থ সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছে। গম্ভীর গলায় বলেছে, এটা তাবিজ। কেউ একজন চিঠির মাধ্যমে তোমাকে তাবিজ করেছে।

তাবিজ কেন করেছে?

তোমার আমার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়।

তাবিজ পানিতে ড়ুবিয়ে দিলে তার গুণ নষ্ট হয়। আয়োজন করে সেই তাবিজ পানিতে ড়ুবানো হলো। শাহনেয়াজ ঘোষণা করল, যেহেতু কেউ একজন তার স্ত্রীকে তাবিজ করার চেষ্টা করছে, কাজেই সে স্ত্রীকে ফেলে কোলকাতা যাবে না এবং এবছর এমএ পরীক্ষা দেবে না।

আব্দুল গনি বলেছেন, ঠিক আছে দিস না। আগেও দুইবার ফেইল করছস, এইবারও কারবি। লাভ কী? পাস করলেও বিপদ। আরো বড় গাধা হবি।

শাহনেয়াজ বলল, বড় গাধা কেন হ’ব?

আব্দুল গনি হতাশ গলায় বললেন, ভুল বলেছি। বড় গাধা হবি না। তুই বড় গাধা হইয়াই জন্ম নিছস।

বাবার অপমানসূচক কথায় কবি সাহেবের কোনো ভাবান্তর হলো না। হালকা ধরনের কথাবার্তা শুনলে তার হবে না। সে জগতের মহৎ বিষয় অনুন্ধানে ব্যস্ত। তাছাড়া গতকাল রাত তিনটা একুশ মিনিটে তার মাথায় কবিতার একটা লাইন এসেছে। লাইনটা জেকে বসেছে। পিন আটকে যাওয়া রেকর্ডের মতো বেজে যাচ্ছে। লাইনটার ব্যবস্থা করা দরকার। লাইনটা হচ্ছে—

‘সরবোরে নীল কমলিনি কাদে।’

নীল কমল কাঁদলে ঠিক ছিল। কিন্তু কমলের স্ত্রীলিঙ্গ কমলিনি’ কেন মাথায় এসেছে তা কবি বুঝতে পারছে না।

 

রাত অনেক হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে আকাশ পরিষ্কার। অসংখ্য তারা উঠেছে। পুকুরঘাটে বসে লাবুস তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তার চোখে মুগ্ধ বিস্ময়। কী বিপুল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড! মানুষের বাস তার ক্ষুদ্র এক গ্রহে। না জানি অন্য গ্রহগুলিতে কী আছে। কী তাদের রহস্য।

হাসনাহেনা ফুল ফুটেছে। বাতাসে ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। তারস্বরে ঝিঝি পোকা ডাকছে। লাবুসের মনে হলো ফুলের সৌরভ, ঝিঝির ডাক বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। বিপুল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের এরাও একটা অংশ। এবং মোটেই তুচ্ছ না।

লাবুস।

মাওলানা ইদরিস এসে লাবুসের পাশে বসলেন। লাবুস তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি বাড়িতে পা দেয়ার পর বাড়িটা হেসে উঠেছে।

ইদরিস বললেন, বাবা, তোমার কথা বুঝলাম না।

লাবুস বলল, কোনো কোনো মানুষ আছে যারা যেখানেই যান। সেই জায়গা আনন্দে হেসে ওঠে। আবার উল্টাটাও হয়। কিছু মানুষের উপস্থিতিতে জায়গা কাঁদে।

বাবা, তোমার কথা কিছুই বুঝতেছি না।

লাবুস বলল, বুঝার দরকার নাই। আপনি যে কাজে গিয়েছিলেন সেই কাজ তো হয় নাই।

ঠিকই ধরেছ, কাজটা হয় নাই। তোমার অনেকগুলি টাকা নষ্ট করেছি। আমি শরমিন্দা।

আপনি যে সুস্থ অবস্থায় ফিরতে পেরেছেন এতেই আমি খুশি।

ফিরেছি ঠিকই, কিন্তু মনটা খারাপ। শশাংক পালের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারি নাই।

পূরণ হবে। আপনি যাকে খুঁজছেন সে খবর পাবে এবং একদিন ভরসন্ধ্যায় এই বাড়িতে সে উপস্থিত হবে।

ইদরিস তাকিয়ে আছেন। লাবুসের কোনো কথারই আগামাথা তিনি ধরতে পারছেন না। লাবুস বলল, মাঝে মাঝে আমি চোখের সামনে ভবিষ্যৎ দেখতে পাই।

ইদরিস বললেন, মানুষকে এই ক্ষমতা আল্লাহপাক দেন নাই বাবা।

লাবুস চুপ করে রইল। একটা কথা বলতে গিয়েও বলল না। সে যে কথাটা বলতে গিয়েছিল সেটা হচ্ছে, আপনি যে মেয়ের সন্ধানে গিয়েছিলেন তার নাম আপনি আমাকে বলেন নাই। কিন্তু আমি তার নাম জানি। তার নাম ললিতা। মাওলানা ইদরিসকে চমকে দেয়ার কোনো অর্থ নাই।

কলিকাতা শহর কেমন দেখলেন?

ভালো না। দমবন্ধ লাগে। তবে কয়েকজন অতি ভালোমানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এদের মধ্যে একজন স্কুল শিক্ষক। গোপালনগর স্কুল। বিভূতি বাবু।

লেখক?

হ্যাঁ লেখক। অনেক বই লিখেছেন। উনিও এখানে আসবেন। আপনি তাঁকে তিনবটের মাথা দেখাতে নিয়ে যাবেন।

মাওলানা ইদরিস অবাক হয়ে বললেন, বিভূতি বাবুকে আমি তিনবটের মাথার কথা বলেছি। উনি সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখতে পছন্দ করেন। উনি বলেছেন আসবেন। তাঁর শরীর সামান্য খারাপ। শরীর সারলেই আসবেন।

হঠাৎ লাবুস পরিষ্কার দেখতে পেল, লেখক মানুষটা পুকুরঘাটের শ্বেতপাথরে বসে আছেন। মুগ্ধ গলায় নিজের লেখা পড়ে যাচ্ছেন।

সকল অধ্যায়

১. ০১. সময় ১৯০৫
২. ০২. গ্রামের নাম বান্ধবপুর
৩. ০৩. ধনু শেখের লঞ্চ
৪. ০৪. কার্তিক মাসের শেষ
৫. ০৫. রঙিলা নটিবাড়ি
৬. ০৬. উকিল মুনসি
৭. ০৭. বান্ধবপুরের পশ্চিমে মাধাই খাল
৮. ০৮. শশী মাস্টার
৯. ০৯. বান্ধবপুর গ্রামের নৌকাঘাটায়
১০. ১০. মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসি
১১. ১১. চৈত্র মাসের শেষ দিকের কথা
১২. ১২. বিপ্লবী জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়
১৩. ১৩. ইদুল ফিতরের নামাজ শেষ হয়েছে
১৪. ১৪. বঙ্গবাসী কাগজের শিরোনাম
১৫. ১৫. যমুনা বেতঝোঁপের উপর
১৬. ১৬. ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে
১৭. ১৭. মধ্যাহ্ন – দ্বিতীয় খণ্ড
১৮. ১৮. বান্ধবপুর বাজার
১৯. ১৯. বৈশাখের শুরু
২০. ২০. প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে
২১. ২১. শিবশংকরের শরীর
২২. ২২. ৩০ জুলাই ১৯৪১ সন
২৩. ২৩. ধনু শেখ পালকি নিয়ে পাখি শিকারে
২৪. ২৪. মাওলানা ইদরিস মহাবিপদে পড়েছেন
২৫. ২৫. এককড়ি ভোরবেলার কনকনে ঠান্ডায়
২৬. ২৬. জুলেখা কলিকাতা বেতার ভবনে
২৭. ২৭. বার্লিন আর্মি হেড কোয়ার্টার
২৮. ২৮. নমশুদ্ৰ পাড়া
২৯. ২৯. আষাঢ় মাসের ঝড়বৃষ্টি
৩০. ৩০. এককড়ির মন্দিরের চূড়া
৩১. ৩১. ১৯৪৫ সনের এপ্রিল মাস
৩২. ৩২. জায়গার নাম মালাবার হিল
৩৩. ৩৩. এমএল আড়িয়াল খাঁ লঞ্চ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন