অধ্যায়-১৫ : মধ্যযুগের খ্রিস্টান ইউরোপে

আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ

অধ্যায় ১৫ : মধ্যযুগের খ্রিস্টান ইউরোপে

সপ্তম শতকে মুসলিমরা যখন তাদের অভিযানগুলো পরিচালনা করতে শুরু করে, তখনও কিন্তু তারা পুরো ইউরোপে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারেনি, তাদের বিজয় মধ্যপ্রাচ্যের দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল তখন পর্যন্ত। ইউরোপের দেশগুলো তাই বাইজান্টিন সাম্রাজ্যের মতো খ্রিস্টান শাসনের অধীনে ছিল। একই কথা প্রযোজ্য সেখানকার ইহুদীদের ক্ষেত্রেও।

পশ্চিম ইউরোপের ইহুদী সমাজ তখন ছোট ছোট ছিটমহলের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ এলাকা গড়ে নিয়ে বসবাস করত। স্থানীয় ব্যবসার কাজে তারা তখন একদম সিদ্ধহস্ত। ইসলামি সাম্রাজ্যে ইহুদীদের এক্সিলার্ক প্রথা চালু থাকলেও খ্রিস্টান সাম্রাজ্যে তা ছিল না একদমই। ফলে পুরো খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের সকল ইহুদীদের কেন্দ্রীয় নেতার অভাবে একেক এলাকার ইহুদী সমাজ সম্পূর্ণ একক ইউনিট হিসেবে বসবাস করত।

আশকেনাজি ইহুদীদের এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজকে ডাকা হতো একেকটি ‘ক্বাহাল’ বলে। একেক ক্বাহালের নিজস্ব নিয়মরীতি, নিজস্ব বিচার আদালত। ১৮৪০ সালের দিকে এসে বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আশকেনাজি ইহুদীদের এমন স্বায়ত্ত্বশাসিত ক্বাহাল সরকার প্রচলিত ছিল। এই ক্বাহাল সমাজে স্বাধীনভাবে বিভিন্ন ইহুদী বিদ্যালয় গড়ে ওঠে নানা জায়গায়, যেমন ধরুন রাইন নদীর আশপাশের পশ্চিম জার্মানি তথা রাইনল্যান্ডের মাইনস (Mainz) ও ওয়ার্মস (Worms), আর উত্তর ফ্রান্সের ত্রোয়া (Troyes) ও সাঁস ( Sens) এলাকায়। মাইনস থেকে বিখ্যাত ইহুদী স্কলার র‍্যাবাই গেরশোম (৯৬০-১০২৮) এবং ত্রোয়া থেকে মধ্যযুগের বিখ্যাত ব্যাখ্যাবিদ সলোমন বেন আইজ্যাকের আবির্ভাব হয়েছিল। এই সলোমন পরিচিত ‘রাশি’ (Rashi) নামে, যার গ্রন্থগুলো আজও পঠিত।

পরের প্রজন্মগুলোতে তালমুদের অধ্যয়ন বেড়ে যায়। রাশির পরিবারের কয়েকজনের পাশাপাশি উত্তর ফ্রান্স ও জার্মানির স্কলাররা নতুন আঙ্গিকে তালমুদের ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের ইসরাইলি কবিতার ছন্দের অনুকরণে আশকেনাজি ইহুদীরা এ সময় কবিতা রচনা করতে শুরু করে। তবে ক্বাহাল নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অভাব ছিল না। উনিশ শতকে জ্যাকব ব্রাফম্যান নামের এক রুশ ইহুদী সেখানকার মিনস্ক ক্বাহালের ট্যাক্স এজেন্টদের সাথে বিতণ্ডায় জড়িয়ে ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করেন এবং এক পর্যায়ে ধর্মান্তরিত হয়ে রুশ অর্থোডক্স চার্চের সদস্য হন। তিনি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন, এবং একাধিক বই রচনা করেন ১৮৬৮ ও ১৮৬৯ সালে। বইগুলোতে তিনি বলেন, ক্বাহাল একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, যার উদ্দেশ্য হলো খ্রিস্টানদের ধনসম্পদ ইহুদীদের নিজেদের করে নেয়া। এই তত্ত্ব লুফে নেয় রাশিয়ার ইহুদী-বিরোধী প্রকাশনাগুলো। ১৮৮১ সালে ব্রাফমানের ক্বাহাল তত্ত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পৌঁছে যায়। সেখানকার সেঞ্চুরি ম্যাগাজিনে তার তত্ত্ব অনূদিত হয়। এর ওপর ভিত্তি করে রচিত হয় ‘দ্য প্রোটোকলস অফ দ্য এল্ডার্স অফ জায়োন’ নামের ইহুদী ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বইটি। ১৯৩৩ সালে ক্বাহালের সাথে ইলুমিনাতিরও সংযোগ দেখানোর চেষ্টা করা হয়।

সে যাক, বলছিলাম একাদশ শতকের ইউরোপের ক্বাহালের কথা। সেখানকার এমন অনুকূল পরিবেশ আর জ্ঞানের বিকাশের মধ্যেও মাঝে মাঝে দেখা দিত ইহুদীবিদ্বেষ। ১০৯৫ সালে পোপ দ্বিতীয় আর্বান যখন ফার্স্ট ক্রুসেডের ঘোষণা দেন, তখন জার্মানির ওয়ার্মস আর মাইনসের মতো শহরের ইহুদীদের ওপর খ্রিস্টীয় জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসব ক্বাহালের ইহুদীরা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরের চেয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া ভালো মনে করলো। তাই দলে দলে ইহুদীরা মারা পড়তে লাগলো। ৭০০ ইহুদী হত্যার কথা জানা যায় মাইনসে। ইহুদী মায়েরা নিজ হাতে শিশুসন্তানদের কোলে নিয়ে হত্যা করে, এমন বর্ণনাও আছে। যেন ‘খৎনাহীন’ জাতির নির্দয়তার শিকার না হতে হয়। [‘ম্যাসাকার অ্যাট মাইনস জ্যুয়িশ কমিউনিটি’, পৃষ্ঠা ৪০] এমন না যে এসব হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্র করেছে, ধর্মান্ধ জনতাই করেছে। পরবর্তীতে রাষ্ট্র জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত ইহুদীদেরকে তাদের পুরাতন ধর্মে ফেরত যেতে দেয়।

খ্রিস্টান ইউরোপে একে একে নানা ব্যবসাকার্য থেকে ইহুদীদেরকে জোর করে বের করে দেয়া হচ্ছিল। পরের দুই শতকে ইহুদীরা উচ্চ সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে বেশি করে। এই কড়া সুদে নেয়া ঋণ ফেরত দিতে না পারা খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী ভয়ংকর রকমের রেগে যায় ইহুদী মহাজনদের ওপর। এই অর্থনৈতিক কারণের সাথে মধ্যযুগে ইহুদীদের ওপর ক্ষোভের কারণ হিসেবে নতুন করে যোগ হয় ধর্মীয় কারণ। ইহুদীরা যে খ্রিস্টের হত্যাকারী, এই বোধোদয় বুঝি খ্রিস্টানদের নতুন করে হলো; এ কারণ দেখিয়ে সকল ইহুদীকেই এক কাতারে ফেলে দেয়া হলো ইউরোপে।

১১৪৪ সালের দিকে ইংল্যান্ডের নরউইচে রটে গেল, ঈদুল ফিসাখ বা পাসওভারের উৎসবে ইহুদীরা যে রুটি বানায়, তাতে তারা খ্রিস্টান শিশুদের রক্ত ব্যবহার করে। শিশু হত্যাকারী হিসেবে ইহুদীদেরকে দায়ী করা হলো। ১১৭১ সালে ফ্রান্সে এবং ১২৫৫ সালে ইংল্যান্ডের লিংকনে আবারও একই অভিযোগ আনা হয় ইহুদীদের ব্যাপারে।

যীশুর দ্য লাস্ট সাপারের স্মরণে খ্রিস্টানদের ইউক্যারিস্ট আয়োজনে পবিত্রজ্ঞান করে রুটি খাওয়া হয় আর মদ পান করা হয়। যাকে থ্যাংক্স গিভিংও বলা হয়। খ্রিস্টীয় বিশ্বাস, ইউক্যারিস্ট আয়োজনে সেই মদ আর রুটি যীশুর আক্ষরিক রক্ত-মাংস তুল্য। মোটেও রূপক নয়। এই রুটিকে ‘হোস্ট’ বলা হয়। এই হোস্টকে অসম্মান করা মানে যীশুকেই অসম্মান করা। ত্রয়োদশ শতকের দিকে ইহুদীদের ব্যাপারে প্রায়ই অভিযোগ করা হতো, তারা হোস্টকে ক্ষতবিক্ষত করেছে যীশুর দেহে অত্যাচার করার জন্য।

তাছাড়া, ঋণের বন্ধকের বদৌলতে চার্চগুলোর মালিকানা ইহুদীদের কাছে চলে যেতে থাকায় ক্ষুব্ধ হতে থাকে খ্রিস্টানরা। ১২১৫ সালে চতুর্থ ল্যাটেরান কাউন্সিল অর্থাৎ রোমান চার্চের কাউন্সিলে ঘোষণা করা হলো, এখন থেকে ইহুদী পুরুষ ও নারীদের নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হবে, যেন তাদের দেখলেই চেনা যায়। ইস্টারের পবিত্র সপ্তাহে তারা বাইরে বেরুতে পারবে না। যারা বের হবে, তাদের জন্য অপেক্ষা করবে কড়া শাস্তি।

১২১৬ সালে স্প্যানিশ খ্রিস্টান যাজক সেইন্ট ডমিনিক একটি সংঘ বা অর্ডারের সূচনা করেন, যার নাম ছিল ‘অর্ডার অফ প্রিচারস’। এর সদস্যদের বলা হতো ডমিনিকান। ফ্রান্সে শুরু হওয়া এ ডমিনিকান অর্ডারের ব্যাপারে সম্মতি ছিল পোপ তৃতীয় অনারিয়াসের। এ অর্ডারের সদস্যরা ছিল ফ্রায়ার, নান আর সিস্টাররাও। গসপেল প্রচার আর খ্রিস্টধর্মের বিরোধীদের এক হাত নেয়ার দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় তারা। ডমিনিকানরা আছে এখনও, ২০১৮ সালেই ৫,৭৪৭ জন ডমিনিকান সদস্যের কথা জানা যায়। তবে যে যুগের কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ‍ ত্রয়োদশ শতকে ডমিনিকান অর্ডার ইহুদী সমাজের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগে যায়। তারা তালমুদে যীশুর নামে খারাপ কথা থাকার দায়ে তালমুদের সকল কপি পুড়িয়ে দেয়।

খ্রিস্টান দেশগুলো থেকে ইহুদীদের বের করে দেয়ার নজিরও আছে। যেমন, ১১৮২ সালে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাস প্যারিসের কাছের রাজ এলাকা থেকে সকল ইহুদীকে বহিষ্কার করেন। তিনি ইহুদীদের সম্পত্তি বাতিল করেন, খ্রিস্টানদের ফেরত না দেয়া সকল ঋণ মওকুফ ঘোষণা করেন। ১১৯৮ সালে ইহুদীদেরকে অবশ্য আবার ফিরিয়ে আনা হয়। তবে তাদেরকে তখন অতিরিক্ত রাজকীয় কর বহন করতে হতো। একটা পর্যায়ে তারা রাজার সম্পত্তিতেই পরিণত হয়।

পরের শতকে, ইংল্যান্ডে ইহুদীদের ওপর উচ্চ কর আরোপ করা হয় এবং ১২৯০ সালে ইংল্যান্ডের পুরো ইহুদী সমাজকেই বহিষ্কার করা হয়। কয়েক বছর পর ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ ফিলিপও একই কাজ করলেন তার দেশের ক্ষেত্রে।

ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে জার্মানির ইহুদীদের ওপর আক্রমণ বেড়ে গেল। তাদের সম্মানিত র‍্যাবাই মেয়ারকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি জেলখানায় মারা যান। ১২ বছর পর, জার্মান লোকেরা ইহুদীদের ১৪০টি এলাকা ধ্বংস করে দেয়।

পরের শতকে একটি অদ্ভুত অভিযোগ আনা হয় ইহুদীদের নামে। তারাই নাকি প্লেগ এনেছে, তাদের কারণেই নাকি ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথ হয়েছে! পরের দুই শতক জুড়ে যখন তখন ইহুদীদের ওপর চড়াও হওয়াটা খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় ইউরোপে, যেমন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় তাদের খুন করে ফেলাটাও।

সকল অধ্যায়

১. অধ্যায়-১ : পূর্বকথন
২. অধ্যায়-২ : সেকেন্ড টেম্পলের যুগে
৩. অধ্যায়-৩ : হেলেনিজম শেষে
৪. অধ্যায়-৪ : রাজা হেরোদের রাজত্বে
৫. অধ্যায়-৫ : দুই নবীর হত্যাকাণ্ড
৬. অধ্যায়-৬ : অতঃপর যীশু খ্রিস্ট
৭. অধ্যায়-৭ : রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
৮. অধ্যায়-৮ : জেরুজালেমের পতন
৯. অধ্যায়-৯ : মাসাদার ঘটনা ও মহাবিদ্রোহের ইতি
১০. অধ্যায়-১০ : রোমান শাসনে ইহুদী জীবন
১১. অধ্যায়-১১ : ব্যবিলনের ইহুদী সমাজ
১২. অধ্যায়-১২ : ইসলামি সাম্রাজ্যে ইহুদী ধর্ম
১৩. অধ্যায়-১৩ : খাজার ও কারাইট ইহুদীদের আবির্ভাব
১৪. অধ্যায়-১৪ : আন্দালুসিয়ার দিনগুলিতে
১৫. অধ্যায়-১৫ : মধ্যযুগের খ্রিস্টান ইউরোপে
১৬. অধ্যায়-১৬ : স্পেনের খ্রিস্টান রাজত্বে
১৭. অধ্যায়-১৭ : উসমানি সাম্রাজ্যে ইহুদীরা
১৮. অধ্যায়-১৮ : মধ্যযুগ থেকে আধুনিক ইউরোপে
১৯. অধ্যায়-১৯ : ইহুদী জাতি এবং সুদপ্রথা
২০. অধ্যায়-২০ : ইহুদীদের আমেরিকা গমন
২১. অধ্যায়-২১ : জায়োনিস্ট আন্দোলনের সূচনা
২২. অধ্যায়-২২ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ইহুদী গণহত্যা
২৩. অধ্যায়-২৩ : ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম
২৪. অধ্যায়-২৪ : ছয়-দিনের সেই যুদ্ধ
২৫. অধ্যায়-২৫ : ভৌগোলিক ইসরাইল-ফিলিস্তিন
২৬. অধ্যায়-২৬ : অসলো অ্যাকর্ডস অবধি
২৭. অধ্যায়-২৭ : অতঃপর বর্তমান
২৮. অধ্যায়-২৮ : ইহুদী এসকাটোলজি
২৯. পরিশিষ্ট-১ : পাঠকের যত প্রশ্নের উত্তর
৩০. পরিশিষ্ট-২ : এক ঝলকে পুরো ইতিহাস
৩১. পরিশিষ্ট-৩ : হিব্রু পঠন (অসম্পূর্ণ)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন