ধ্বংসযজ্ঞ – ২৪

কাজী আনোয়ার হোসেন

চব্বিশ

গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে অ্যাডভেঞ্চারারের সিক বে-তে বসে আছে তানিয়া। সামনে ধূমায়িত কফির মগ, তবে চুমুক দিচ্ছে না তাতে। গরম মগটা দু’হাতে ধরে তাপ নিচ্ছে। মন বিক্ষিপ্ত। কিছুই ভাল লাগছে না, জীবন অর্থহীন মনে হচ্ছে বিছানায় অচেতন পড়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে।

সারফেসে ভেসে ওঠার পাঁচ মিনিটের ভেতরেই অ্যাডভেঞ্চারারের ক্রুরা উদ্ধার করেছে তানিয়াকে। তবে আসিফের বেলায় তা ঘটেনি। কোনও ধরনের সঙ্কেত পাওয়া যায়নি তার তরফ থেকে, সাগরও ছিল উত্তাল। টানা বিশ মিনিট চিরুনিতল্লাশির পর পানিতে চিৎ হয়ে ভাসতে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেছে বেচারাকে। জ্ঞান ছিল না। স্রেফ ওয়েটসুটের পজিটিভ বয়ান্সির কারণে ভেসে উঠেছে অচেতন দেহটা।

তড়িঘড়ি করে ওকে নিয়ে আসা হয়েছে সিক বে-তে; মৃদু হাইপোথারমিয়া আর অক্সিজেনের ঘাটতিজনিত অসুস্থতার জন্যে তানিয়ারও চিকিৎসা চলছিল ওখানে। আসিফকে বিছানায় শুইয়ে পর্দা টেনে দিতে দেখেছে ও, কানে ভেসে এসেছে ডাক্তারের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ: ‘পালস্ নেই… কার্ডিয়োজেনিক শকে চলে গেছে ও।’

ঝট্ করে উঠে বসেছিল তানিয়া, এক টানে পর্দা সরিয়ে তাকিয়েছিল স্বামীর দিকে। থমকে গিয়েছিল পরক্ষণে। এ কোন্ আসিফ! মড়ার মত সাদা হয়ে আছে চামড়া, প্রাণের কোনও লক্ষণ নেই। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল ও। তাড়াতাড়ি একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ওকে।

তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে তারপর। ঘুম থেকে উঠে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে ও। বসে বসে চুপচাপ দেখছে স্বামীর অবস্থা। এখনও জ্ঞান ফেরেনি আসিফের। কম্বলমুড়ি দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে, স্যালাইন দেয়া হচ্ছে, মুখ ঢাকা পড়ে গেছে বিশাল এক অক্সিজেন মাস্কে। চোখদুটো বন্ধ। একটুও নড়ছে না। হার্ট মনিটরে আঁকাবাঁকা রেখা নাচানাচি না করলে বোঝাই যেত না, সে বেঁচে আছে না মরে গেছে। নিশ্চিত হবার জন্যে বার বার স্ক্রিনটার দিকে তাকাচ্ছে তানিয়া।

কফির কাপ নামিয়ে রেখে এগিয়ে গেল ও। আসিফের হাত ধরল—হাতদুটো যেন কাদার তাল, বরফের মত ঠাণ্ডা। তীব্র শীতের দিনেও স্বামীর হাত কখনও এত শীতল পায়নি ও।

‘ফিরে এসো,’ ফিসফিসাল তানিয়া। ‘আমাকে এভাবে একা ফেলে যেয়ো না। প্লিজ, আসিফ!’

পেছনে দরজা খোলার আওয়াজ হলো, ভেতরে ঢুকলেন জাহাজের ডাক্তার—হ্যারল্ড ডওসন। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ আর মাথার সব চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে, তাঁর বয়স কত কেউ জানে না। নুমায় যদি রিটায়ার করার জন্যে কোনও নির্ধারিত বয়স থাকত, তা হলে বহুদিন আগেই অবসরে চলে যেতেন তিনি। এখন তাঁকে আর ডাক্তার হিসেবে দেখে না কেউ, বরং কথাবার্তা আর আচার-আচরণে তিনি জাহাজের সবার স্নেহপরায়ণ পিতার মত হয়ে উঠেছেন।

‘কেমন বুঝছ?’ পাশে এসে জিজ্ঞেস করলেন ডা. ডওসন।

‘এখনও নড়ছে না,’ চোখের পানি মুছে বলল তানিয়া। ‘হার্ট রেট…’

‘হার্ট রেট ঠিকই আছে,’ ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ডাক্তার।

‘পালসও স্বাভাবিক। রক্তে অক্সিজেনের লেভেল বাড়ছে। অবস্থা উন্নতির দিকে।’

‘কিন্তু জ্ঞান ফিরছে কই!’ অধৈর্য শোনাল তানিয়ার গলা।

‘তাতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আসিফ খুবই শক্ত ছেলে। সময় দাও, নিজেই সুস্থ হয়ে উঠবে।’

সেটা তানিয়াও জানে। উন্নতি হচ্ছে আসিফের, কিন্তু কেন যেন মন মানছে না। চাইছে এখুনি ও চোখ মেলে তাকাক, হেসে কিছু বলুক ওকে।

একটা চেয়ার টেনে তানিয়ার পাশে বসলেন ডওসন। ‘হাতটা দেখি।’

হাত বাড়াল তানিয়া। ব্লাড প্রেশার গজ আর স্টেথোস্কোপ দিয়ে ওর রক্তচাপ মাপলেন তিনি। তারপর মাথা নাড়লেন, ‘যা ভেবেছি।’

‘কী?’

‘তোমার নিজের ভাইটালই সুবিধের নয়। দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেকে অসুস্থ করে ফেলছ।’

বড় করে শ্বাস ফেলল তানিয়া। জাহাজে ফেরার পর থেকে কিছুই খায়নি… খাওয়ার রুচিই হয়নি আসিফকে দেখার পর।

‘একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না,’ বলল ও। ওর আগে আমি ভেসে উঠলাম কেমন করে? আসিফের এত দেরি হলো কেন?’

‘এসব নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর কোনও মানে হয় না, ‘ বললেন ডওসন। ‘তোমার চেয়ে ওর শরীর ভারী, সে-কারণে এমনিতেই আগে ওঠার কথা তোমার। তা ছাড়া আসিফ তো সবসময়েই বলে, ওর চেয়ে ভাল সাঁতারু তুমি। ওই সাঁতার দেখেই নাকি প্রেমে পড়েছিল তোমার।’

এ-অবস্থাতেও ক্ষীণ একটু হাসি ফুটল তানিয়ার ঠোঁটে। বলল, ‘আমারই ভুল। আমারই বরং উচিত ছিল ওকে সাহায্য করা। তা হলে হয়তো…’

‘তা হলেও একই ঘটনা ঘটত। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্যে তোমাকে বিপদে ফেলত না আসিফ। অমন ছেলেই নয় ও।’

‘আর এখন? ওর যদি কিছু হয়ে যায়, আমি কীভাবে বাঁচব, বলতে পারেন?’

‘সাহস রাখো, দৃঢ় গলায় বললেন ডওসন। ‘আমার বিশ্বাস, অমন কিছু ঘটবে না। এসব নিয়ে যত ভাববে, ততই মাথা খারাপ হতে থাকবে। তারচেয়ে মনকে অন্য কিছুতে ব্যস্ত করে ফেলো।’

‘সেটা কি এতই সহজ?’

জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ডওসন। তানিয়ার মুঠি থেকে মুক্ত করলেন আসিফের হাত, সাবধানে ওটা ভাঁজ করে রাখলেন ওর বুকের ওপর। এরপর দাঁড় করালেন তানিয়াকে। হাত ধরে বের করে আনলেন সিক বে থেকে। নিয়ে গেলেন পাশের একটা কেবিনে—ওটা জাহাজের ল্যাবরেটরি।

‘তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, নিচ থেকে আরেকজন সার্ভাইভার উঠে এসেছে,’ মৃদু হেসে বললেন ডাক্তার। ‘তার নাম জলকন্যা।’

দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তানিয়ার। ‘রোবটটাকে তুলে নিতে পেরেছেন আপনারা?’

‘হ্যাঁ। শুধু তা-ই নয়, তিনটে স্যাম্পল নিয়ে ফিরেছে ওটা।’

ভুরু কোঁচকাল তানিয়া। ‘তিনটে?’

‘হুঁ। ক্রুদের একজনের লাশ থেকে টিস্যু স্যাম্পল নিয়েছিলে তুমি।’ সুইচ টিপে একটা বাতি জ্বাললেন ডওসন। ল্যাবরেটরির একটা ওয়ার্কবেঞ্চ আলোকিত হয়ে উঠল।

‘মনে আছে,’ বলল তানিয়া। ‘কিন্তু আর কোনও স্যাম্পল তো নিইনি।’

‘নাওনি?’ আরেকটা ওয়ার্কবেঞ্চের দিকে ইশারা করলেন ডাক্তার। স্টিলের এক টুকরো তার পড়ে আছে ওটার ওপরে। ‘জলকন্যার মুঠোর মধ্যে পাওয়া গেছে ওটা।’

গ্রুপারের গায়ে যে-তারটা পেঁচিয়ে গিয়েছিল, নিশ্চয়ই সেটার টুকরো, অনুমান করল তানিয়া। অ্যাসিটিলিন টর্চ দিয়ে কেটে ফেলার পর গ্রিপ থেকে ফেলা হয়নি।

‘আর তৃতীয় স্যাম্পলটা?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘প্লাস্টিকের একটা টুকরো, জলকন্যার ফ্রেমের মধ্যে আটকে ছিল। কোনও কিছু থেকে ভেঙে গিয়েছিল বোধহয়। ঢলের সময় ভাসতে ভাসতে জলকন্যার গায়ে এসে পড়েছে।’

তারটার দিকে এগিয়ে গেলেন ডওসন। আঙুল দিয়ে দেখালেন, কালো কালো কয়েকটা দাগ পড়েছে ওটার গায়ে। জানতে চাইলেন, ‘এগুলো কীসের দাগ, বলতে পারো?’

ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর ঝুঁকল তানিয়া। আঙুল বোলাল দাগগুলোর ওপর। তারের বাকি অংশের চেয়ে গঠন অন্যরকম লাগল। মনে হলো, গরম কিছুর ওপর রেখে দেয়া হয়েছিল তারটা, গলে যাবার পূর্বমুহূর্তে উঠিয়ে আনা হয়েছে। ‘ঝালাইয়ের দাগের মত লাগছে,’ বলল ও।

‘আমারও,’ মাথা ঝাঁকালেন ডওসন। ‘কিন্তু স্টিলের তার কখনও ঝালাই করা হয় বলে শুনিনি। কোথাও জোড়া-টোড়া দিতে হলে একটা কথা ছিল… এই টুকরোটা তো অক্ষত।’

‘জলকন্যার কাটিং টর্চের তাপে এমনটা হয়নি তো?’

মাথা নাড়লেন ডওসন। ‘ওর ভিডিও ফিড চেক করেছি আমি। কাটিং টর্চের এক পোঁচে তারটা কেটে নেয়া হয়েছিল, আর কোথাও আগুনের শিখা লাগেনি।

কৌতূহলী হয়ে উঠেছে তানিয়া। তবু স্বামীর কথা ভেবে বলল, ‘ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, সন্দেহ নেই। আসিফ সুস্থ হয়ে ওঠার পর নাহয় এসব নিয়ে…’

‘সরি, তানিয়া,’ বললেন ডাক্তার, ‘কাজটা এখুনি করতে হবে।’

‘আ…আমি আসলে এসবের জন্যে এখনও পুরোপুরি তৈরি নই।’

‘হুকুমটা অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের,’ জানালেন ডওসন। ‘ঘণ্টাখানেক আগে আমাদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তোমার অবস্থা তিনি জানেন, তারপরেও দিয়েছেন হুকুমটা। জাপানি জাহাজটার রহস্য ধামাচাপা দেবার জন্যে উতলা হয়ে উঠেছে কেউ। কেন, সেটাই জানতে চান তিনি। জলকন্যার আনা স্যাম্পলগুলোই আমাদের হাতে একমাত্র সূত্র।’

‘কিন্তু… এ-অবস্থায় কী করে আমি…’ কথা আটকে যাচ্ছে তানিয়ার।

কাঁধ ঝাঁকালেন ডওসন। ‘অ্যাডমিরালকে তো তুমি চেনো। তা ছাড়া, এ-মুহূর্তে আসিফের ব্যাপারে কিছু করারও নেই তোমার। তারচেয়ে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা ভাল না?’

ভুল বলছেন না ডাক্তার। অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের মনোভাবও বুঝতে পারছে তানিয়া। আর কিছু না হোক, আসিফের এ-অবস্থার জন্যে যারা দায়ী, তাদেরকে খুঁজে বের করতে চাইলেও জাপানি জাহাজের রহস্যটা ভেদ করতে হবে।

‘বেশ,’ বলল ও। ‘কোত্থেকে শুরু করব?’

মাইক্রোস্কোপের কাছে তানিয়াকে নিয়ে গেলেন ডওসন। ‘প্লাস্টিকের স্যাম্পলটা আগে দেখো।’

আইপিসে চোখ লাগিয়ে ফোকাস অ্যাডজাস্ট করে নিল তানিয়া। গুঁড়ো গুঁড়ো কী যেন ভেসে উঠল চোখে।

‘এগুলো ওই প্লাস্টিকের গুঁড়ো,’ জানালেন ডওসন। ‘পরীক্ষার জন্যে আলাদা করা হয়েছে।

‘দু’রকম রঙ কেন?’

‘দু’রকম প্লাস্টিক আছে বলে। আমাদের ধারণা, টুকরোটা কোনও স্টোরেজ কেইস থেকে এসেছে। গাঢ় রঙের প্লাস্টিকটা কেইসের ভেতরের দিক-কিছুটা বেশি শক্ত। আর হালকা রঙেরটা বেশ পাতলা, ওটা বাইরের স্তর।’

সময় নিয়ে স্টাডি করল তানিয়া। বিস্মিত হয়ে লক্ষ করল, গাঢ় প্লাস্টিকটায় বিকৃতি ঘটেছে—রঙটা প্যাঁচ খেয়েছে অনেক জায়গায়… প্লাস্টিকের গোটা কাঠামোই নষ্ট হয়ে গেছে।

‘গাঢ় প্লাস্টিকটা গলে গেছে মনে হচ্ছে,’ বলল ও। ‘কিন্তু হালকাটার কিচ্ছু হয়নি।’

‘আমারও তা-ই ধারণা,’ জানালেন ডওসন।

মুখ তুলল তানিয়া। ‘ব্যাপারটা উল্টো হয়ে গেল না? তাপে তো আগে হালকাটা গলে যাবার কথা।’

‘আরেকটা অসঙ্গতি—তারের পোড়া দাগগুলোর মত।’

‘আর টিস্যু স্যাম্পল? সেটায় কোনও অসঙ্গতি আছে?’

‘নিজেই দেখো। তিনটের ভেতর ওটাই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং।’

আরেকটা মাইক্রোস্কোপের সামনে তানিয়াকে নিয়ে গেলেন ডওসন। ম্যাগনিফিকেশন ঠিক করে স্যাম্পলটা খুঁটিয়ে দেখল ও। ভ্রূকুটি আরও গভীর হলো।

‘মানে কী এর!’

মুচকি হেসে ডওসন বললেন, ‘তুমি তো মেরিন বায়োলজির এক্সপার্ট—জৈবকোষ সম্পর্কে সবকিছুই জানো। তুমিই বলো, গড়বড়টা কোথায়।’

আবারও আইপিসে চোখ ঠেকাল তানিয়া। ফোকাল পয়েন্ট সরিয়ে একপাশ থেকে দেখতে শুরু করল স্যাম্পলটা। বলল, ‘ডানদিকেরগুলো স্কিন-সেল… মানে, চামড়ার কোষ। মোটামুটি ঠিকই মনে হচ্ছে ওগুলো। কিন্তু বামদিকেরগুলো…’

‘স্যাম্পল কোত্থেকে নিয়েছ, মনে করো। লাশের ঊরু থেকে দু’ইঞ্চি গভীর এক টুকরো মাংস উঠিয়ে এনেছ। চামড়া তো দেখলেই। বাকিটা ভেতরদিককার মাংসকোষ।’

‘এ-অবস্থা কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরদিক থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছিল!’

‘ঠিক তা-ই। যত গভীরে যাবে, ততই বেশি ক্ষয়ক্ষতি দেখতে পাবে। অবাক ব্যাপার হলো, ওপরের চামড়ায় তার কোনও চিহ্ন নেই।’

মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলতে পারছে না তানিয়া। অন্ধকারে একটা তীর ছুঁড়ল। ‘কোনও ধরনের কেমিক্যাল’ বার্ন?’

‘সেটারও উচ্ছিষ্ট পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া মাংস পর্যন্ত পৌঁছুবার আগে তো চামড়া পেরুতে হবে ওটাকে… তখন চামড়াও পুড়িয়ে দেবে না?’

‘গুড পয়েন্ট, সোজা হলো তানিয়া। ‘তা হলে কীসে ঘটাল এটা?’

‘শুধু এটা না, এখানকার সবগুলো অসঙ্গতি, ‘ শুধরে দিলেন ডওসন।

‘তিনটে অসঙ্গতি… কিন্তু অনুঘটক একটা। সম্ভব?’ গম্ভীর হলো তানিয়া।

‘সেটা বের করার জন্যেই তোমাকে ডেকে এনেছি।’

মাথায় চিন্তার ঝড় বইল তানিয়ার। আসিফের কথা ভুলে গেল ক্ষণিকের জন্যে, জটিল রহস্যের সন্ধান পেয়ে জেগে উঠেছে ওর বিজ্ঞানী সত্তা। টের পেল, মন খারাপ ভাবটা দূর হয়ে যাচ্ছে, সে-জায়গা দখল করছে উত্তেজনা।

‘থারমাল ড্যামেজ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না,’ একটু পর বলল ও। ‘কিন্তু উচ্চ তাপ বা আগুনে সবার আগে চামড়া পুড়ে যাবার কথা।’

‘এগজ্যাক্টলি,’ বললেন ডওসন। ‘সেজন্যেই আমাদের শরীরের ওপরে চামড়ার আবরণ দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। তাপ বলো, আগুন বলো, বা অন্য কোনও আঘাত… সেটা যেন আগে চামড়ার ওপর দিয়ে যায়। শরীরের ভেতরটা নিরাপদ থাকে।’

ঠোঁট কামড়ে আরেকটু ভাবল তানিয়া। তারপর বলল, ‘এই ঘটনার একমাত্র জীবিত সাক্ষী হলো আরাতামা মারুর ক্যাপ্টেনের স্ত্রী। কিছু জানা গেছে তার কাছ থেকে?’

নিজের নোটবুক খুলে পাতা ওল্টালেন ডওসন। বললেন, ‘তেমন কিছু জানাতে পারেনি। শুধু বলেছে, জ্ঞান হারানোর আগে চোখের সামনে আতশবাজির মত কী যেন ফুটতে শুরু করেছিল। চোখের পাতা বন্ধ করার পরেও দেখতে পাচ্ছিল সেটা।’

‘এ-ধরনের অভিজ্ঞতা নভোচারীদের হয় বলে শুনেছি, ‘ বলল তানিয়া। ‘কিছুদিন আগে একটা জার্নাল পড়েছিলাম, তাতে কয়েকজন নভোচারীর কথা লেখা ছিল… শাটল মিশনে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে ওরা, চোখ মুদলেও আলোর ঝলকানি দেখতে পাচ্ছিল।’

আগ্রহী হয়ে উঠলেন ডওসন। ‘অসুস্থতার কোনও কারণ লেখা ছিল ওখানে?’

মাথা ঝাঁকাল তানিয়া। ‘সোলার ফ্লেয়ারের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল শাটলটা। শিল্ডিং ভেদ করে শাটলে ঢুকে পড়েছিল হাই-এনার্জি রে। সেগুলোই নিউরোলজিক্যাল রিঅ্যাকশন তৈরি করেছিল ওদের চোখে… আলোর ঝলকানি দেখাচ্ছিল।’

‘সত্যি সত্যি দেখছিল? হ্যালিউসিনেশন নয়?’

‘না। ভুল সিগনাল পাচ্ছিল মস্তিষ্ক, তাই ওসব দেখতে পাচ্ছিল ওরা।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ডা. ডওসন, তারপর শুরু করলেন পায়চারি। একটু পর বললেন, ‘একসময় এয়ারফোর্সে ছিলাম আমি… তোমার বোধহয় তখনও জন্ম হয়নি। সে-সময়ের একটা অদ্ভুত কেস মনে পড়ছে। ফ্যান্টম জেটের রেডার টেস্টের সময় অল্পবয়েসী এক ছেলে ভুল করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদম নতুন রিক্রুট ছিল সে, ডান-বাম কিচ্ছু বুঝত না। আমরাও দেখতে পাইনি ও কোত্থেকে উদয় হলো। যা হোক, ওই জেটগুলো ছিল বিশেষ ধরনের—শক্তিশালী রেডার সিগনাল বিকিরণ করতে পারত, যাতে শত্রুদের সমস্ত ইকুইপমেন্ট সেই সিগনালের তোড়ে অচল হয়ে পড়ে।’

‘কী হয়েছিল ছেলেটার?’

‘চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায় সে। তাড়াতাড়ি রেডার অফ করে ওকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে, তবে কোনও লাভ হয়নি, তার আগেই মারা গিয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, চামড়ার ওপরে কিচ্ছু ফুটে ওঠেনি, কিন্তু ময়নাতদন্ত করে দেখা গেল, শরীরের ভেতরটা একদম সেদ্ধ হয়ে গেছে ওর… অনেকটা মাইক্রোওয়েভ আভেনে খাবার সেদ্ধ করার মত। আমি তখন খুব জুনিয়র ডাক্তার, তারপরেও সে-ঘটনা ভুলিনি। মাইক্রোস্কোপে ওর টিস্যু স্যাম্পলে ঠিক আজকের মত অসঙ্গতিই দেখতে পেয়েছিলাম আমি।’

বড় করে শ্বাস ফেলল তানিয়া। গা গুলিয়ে উঠছে ওর ঘটনাটা শুনে। মনোযোগ দিল হাতে থাকা আলামতগুলোর দিকে।

‘স্টিলের তারে পোড়া দাগ,’ চিন্তিত গলায় বলল ও। ‘এটাও হাই-এনার্জি ডিসচার্জের কারণে ঘটতে পারে। মানে, ঝালাইয়ের মতই একটা ব্যাপার, কিন্তু ঝালাই নয়।’

‘বজ্রপাতের কথা বলছ?’

‘উঁহুঁ। যা যা দেখছি, তাতে একে বজ্রপাতের চেয়ে বড় কিছু মনে হচ্ছে। তা ছাড়া বজ্রপাতে মানুষের শরীরের বাইরেটা ঠিক রেখে ভেতরটা পুড়ে যায় না।’

গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন ডা. ডওসন। তানিয়া অনুমান করল, মনে মনে নিশ্চয়ই একটা থিয়োরি দাঁড় করিয়েছেন তিনি। দেখা যাক, সেটা ওর সঙ্গে মেলে কি না।

‘জাহাজের সমস্ত বাতি জ্বলে গিয়েছিল,’ বলল ও, ‘সমস্ত ইকুইপমেন্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল… এমনকী ইমার্জেন্সি বিকনটাও। সেজন্যেই কোনও ডিসট্রেস কল পাঠাতে পারেনি ওরা। ক্যাপ্টেনের স্ত্রী চোখে আলোর ফুলঝুরি দেখেছে, ওপরের ক্রুরা ভেতর থেকে সেদ্ধ হয়ে গেছে।’ একটু বিরতি নিল তানিয়া। চোখ রাখল ডাক্তারের চোখে। ‘এর একটাই ব্যাখ্যা-জাহাজটাতে ম্যাসিভ কোনও ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েভ আঘাত করেছিল… খুবই হাই-ইনটেনসিটির ওয়েভ, নইলে এত ক্ষতি হতো না।’

‘হাজারখানেক রেডার-এমিটার চালালেও এ-ধরনের ওয়েভ তৈরি করা সম্ভব নয়,’ বললেন ডওসন।

‘তা হলে জিনিসটা আরও শক্তিশালী,’ বলল তানিয়া।

‘তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’

‘প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হবার সম্ভাবনা কতটুকু?’

‘কাম অন, তানিয়া,’ হাত নাড়লেন ডাক্তার। ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ? তা হলে একেবারে ঠিক সময়ে জলদস্যুরা ওখানে হাজির হলো কীভাবে? জাহাজ ডুবিয়ে দিল কেন? তুমি আর আসিফ নিচে নামতেই খুন করার চেষ্টা করা হলো কেন? এসব কাকতালীয় হতে পারে না কিছুতেই।’

অকাট্য যুক্তি। ‘তা হলে জিনিসটা মানুষের তৈরি, ‘ তানিয়া বলল, ‘একটা অস্ত্র। সেটা এতই শক্তিশালী যে, পাঁচশো ফুট লম্বা একটা জাহাজকে অনায়াসে ধ্বংস করে দিতে পারে।’

প্রাণহীন একটা হাসি ফুটল ডাক্তারের চেহারায়। ‘আমিও তা-ই ভাবছি। ঈশ্বর! এমনিতেই মারণাস্ত্রের অভাব নেই দুনিয়ায়, এখন আবার নতুন কী উদয় হলো!’

চঞ্চল হয়ে উঠল তানিয়া। ‘অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে জানাতে হবে ব্যাপারটা।’

‘যাও,’ মাথা ঝাঁকালেন ডওসন। ‘আসিফের দিকে আমি খেয়াল রাখছি।’

সকল অধ্যায়

১. ধ্বংসযজ্ঞ – ১
২. ধ্বংসযজ্ঞ – ২
৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩
৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪
৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ৫
৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ৬
৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ৭
৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ৮
৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ৯
১০. ধ্বংসযজ্ঞ – ১০
১১. ধ্বংসযজ্ঞ – ১১
১২. ধ্বংসযজ্ঞ – ১২
১৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৩
১৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৪
১৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৫
১৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৬
১৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৭
১৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৮
১৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৯
২০. ধ্বংসযজ্ঞ – ২০
২১. ধ্বংসযজ্ঞ – ২১
২২. ধ্বংসযজ্ঞ – ২২
২৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৩
২৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৪
২৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৫
২৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৬
২৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৭
২৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৮
২৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৯
৩০. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩০
৩১. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩১
৩২. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩২
৩৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৩
৩৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৪
৩৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৫
৩৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৬
৩৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৭
৩৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৮
৩৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৯
৪০. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪০
৪১. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪১
৪২. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪২
৪৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৩
৪৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৪
৪৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৫
৪৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৬
৪৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৭
৪৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৮
৪৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৯
৫০. ধ্বংসযজ্ঞ – ৫০
৫১. ধ্বংসযজ্ঞ – ৫১
৫২. ধ্বংসযজ্ঞ – ৫২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন